বৃহস্পতিবার, ৫ জুলাই, ২০১২

শবে বারাআত ও প্রাসঙ্গিক কথা



জুলফিকার আহমদ কিসমতী : 
১৪ শাবান দিবাগত রাতকে আরবীতে লাইলাতুল বারাআত আর উর্দু-ফারসি ভাষায় শবে বারাআত বলা হয়। শব অর্থ রাত আর বারাআত অর্থ অব্যাহতি বা মুক্তি। মানুষ জীবনের চলার পথে বিভিন্ন লোভ-প্রলোভন ও ঘাত-প্রতিঘাতের সম্মুখীন হয়ে যে সব অপরাধে লিপ্ত হয়, ভবিষ্যতে একই  অপরাধে ও অন্যায়ে লিপ্ত হবে না এরূপ দৃঢ় সংকল্প সহকারে কায়মনোবাক্যে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলে করুণাময় স্রষ্টা বছরের যে কোনো সময়ই বান্দার অপরাধ মার্জনা করতে পারেন। কিন্তু এছাড়া সারা বছরের বিভিন্ন সময়-ক্ষণের মধ্যে এমন কিছু মুহূর্ত রয়েছে যেগুলোর মধ্যে তিনি বান্দার কাতর ফরিয়াদ অধিক শুনে থাকেন। তন্মধ্যে পবিত্র রমযান মাসের মহান সংযম প্রশিক্ষণের পূর্ব প্রস্তুতির মাস শাবান একটি। হাদীস শরীফে এ মাসের যথেষ্ট গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে। সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফে হযরত আয়েশা (রা.) কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে যে, আমি রাসূল (সা.)কে রমযান মাস ছাড়া অন্য কোনো মাসে শাবান মাসের মত এত অধিক রোযা রাখতে দেখিনি। তিনি কোনো সময় শাবানের সমগ্র মাসই, আবার কোনো সময় সামান্য দু'একদিন ছাড়া গোটা মাসই রোযা রাখতেন। তবে মহানবী (সা.) নিজে তা করলেও উম্মতকে শাবান মাসের প্রতিদিন রোযা রাখতে নিষেধ করেছেন। রমযানের পূর্বে অল্প কয়েকদিন হলেও রোযা ভাঙতে হবে। অপর হাদীসে আছে ‘‘তোমাদের মধ্যে কেউ যেন এক অথবা দু'দিন পূর্বে রোযা না রাখে। কিন্তু তিরমিযী শরীফে আছে শাবান মাসের যখন অর্ধেক বাকি থাকে, তখন থেকে রমযানের পূর্ব পর্যন্ত আর রোযা রাখবে না। শাবান মাসের এই গুরুত্বের দিক থেকে চিন্তা করলে ১৪ শাবান দিবাগত রাতের গুরুত্বও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিশেষ করে আইয়ামে বীয তথা প্রতি চান্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ দিবাগত রাতের মর্যাদা এমনিতেও স্বীকৃত। তার ওপর শাবানের মাস হওয়াতে সে গুরুত্ব আরও বেড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। এছাড়া মহানবী (সা.) এ রাতে নির্জনভাবে গুনাহ মাফীর জন্যও আল্লাহর কাছে অধিক কান্নাকাটি করেছেন বলে উল্লেখ পাওয়া যায়। সুতরাং এসব গুরুত্বের প্রেক্ষিতে এ রাতকে শবে বারাআত বা গুনাহ মুক্তির রাত বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। তবে এ রাতের গুরুত্ব যতই থাক, পবিত্র কুরআনে বর্ণিত ‘‘লাইলাতুল কদর’’ বা শবে কদরের মতো একে গুরুত্ব দেয়ার দ্ব্যর্থহীন প্রমাণ কুরআন-হাদীসে অনুপস্থিত।
শবে বারাআত মুসলমানদের মনে ইবাদত ও নেক কাজের স্পৃহাকে জাগিয়ে দেয়। এ উপলক্ষে সমবেত মুসলমানদের অন্তরে বিশেষ ভাব-চেতনা ও ধর্মীয় অন্যান্য বিষয়াদি পালনের আগ্রহ সৃষ্টিতে বিরাট সহায়ক হয়। বিশেষ করে জুমার দিনের তুলনায় এ উপলক্ষে মসজিদের মুসল্লীদের উপস্থিতির সংখ্যা অধিক থাকে বিধায় সকলের সামনে রমযানের সিয়াম সাধনা সংক্রান্ত মাসআলা-মাসায়েল, সিয়ামের উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও তাৎপর্য সম্পর্কে তাদের অবহিত করার বিরাট সুযোগ ঘটে। এ ব্যাপারে শবে বারাআতের শরয়ী গুরুত্বের প্রশ্ন তুলে যারা এ রাত ও তার ইবাদতকে ভিন্নভাবে মূল্যায়ন করেন বর্তমান ধর্মবিমুখতার যুগে আমাদের দেশের মুসলমানদের অন্তরে এ রাতটি যে আসন করে নিয়েছে তাদের উচিত মুসলমানদের এ ভাবধারাকে আহত না করা। বিশেষ করে যেখানে নেকভাব বর্ধক ফযিলতের হাদীস বর্ণনায় সনদের চুলচেরা বাছবিচারে শিথিলতার অবকাশ বিদ্যমান, সেখানে বিষয়টিকে ইসলামী ভাববর্ধক সংস্কৃতির একটি অঙ্গ হিসেবে ধরে নিলেই বা ক্ষতি কি?
শবে বারাআতে কুরআন তিলাওয়াত, নফল নামায, কবর যিয়ারতের মাধ্যমে মুর্দারের প্রতি সওয়াব রেসানী ও মাগফিরাতের দোয়া সকলেরই করা উচিত। এ রাতে আল্লাহর কাছে নিজের পূর্ববর্তী গুনাহখাতার ব্যাপারে তওবা করে পবিত্র রমযানের সিয়াম সাধনার জন্য মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ একান্ত জরুরি। পবিত্র হাদীসে ‘‘নেসফুম মিন শাবান’’ শব্দের প্রতি গুরুত্ব আরোপের মাধ্যমে মূলত সেই গুরুত্ব ও তাৎপর্যের দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। তবে এ রাতের নফল ইবাদতগুজারী যাতে ফজরের ফরয নামায তরক হবার কারণ না হয়, সেদিকেও সকলের লক্ষ্য রাখতে হবে। শবে বারাআত উপলক্ষে বাজি পোড়ানো, মাযারে গিয়ে কবরে সিজদা করা, কবরে বাতি দেয়া ইত্যাদি বিদআত শিরেকী কাজ যাতে না হতে পারে সেদিকে সকলের সতর্ক দৃষ্টি থাকা উচিত। অন্যথায় কল্যাণের বদলে তা অকল্যাণই বয়ে আনতে বাধ্য। খানাপিনার প্রস্তুতি অনেক সময় শবে কদর ও শবে বারাআতের ইবাদতকে নষ্ট করে। এসব বিষয়ের ব্যাপারে সতর্ক থাকা সকলের কর্তব্য।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন