বুধবার, ১৩ জুন, ২০১২

অবিস্মরণীয় বিপ্লবী নেতা চে গুয়েভারা



 নজমুল হক নান্নু  
স্পা র্টাকাস থেকে শুরু করে এযাবত্কাল পর্যন্ত যত বিপ্লবী নেতা জন্মগ্রহণ করেছেন নিঃসন্দেহে চে গুয়েভারা তাদের মধ্যে একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিপ্লবী নেতা। তাঁর রাজনৈতিক জীবন, বিপ্লবী জীবন ছিল খুবই সংক্ষিপ্ত। ধূমকেতুর মতোই রাজনীতিতে তাঁর আবির্ভাব। তিনি রাজনীতিতে এসেছেন ডান হাতে রাইফেল আর বাম হাতে ডাক্তারী ব্যাগ নিয়ে। বিপ্লবে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েই তিনি রাজনৈতিক মতাদর্শ সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ শুরু করেন। চে গুয়েভারা আর্জেন্টাইন মার্কসবাদী কমিউনিস্ট, বিপ্লবী, চিকিত্সক, লেখক, কবি, বুদ্ধিজীবী, গেরিলা নেতা, কূটনীতিবিদ, সামরিক যুদ্ধের তাত্ত্বিক ও প্রশিক্ষক এবং কিউবা বিপ্লবের অন্যতম প্রধান নেতা। একজন মানুষ যে কত বৈচিত্র্যময় প্রতিভায় সমৃদ্ধ হতে পারে চে গুয়েভারা তার উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত। তিনি জন্মগ্রহণ করেন আর্জেন্টিনায়। বিপ্লব করেন কিউবায়। আর বিপ্লবের মধ্য দিয়েই মৃত্যুবরণ করেন বলিভিয়াতে। তিনি জীবিত থাকাকালীন সমগ্র পৃথিবীকে এমনভাবে ঝাঁকুনি দিয়েছেন, তাঁর মৃত্যুর পর সমগ্র পৃথিবী এমনভাবে আলোড়িত হয়েছে, অতীতে যা আর কখনও এমনটি ঘটেনি। মৃত্যুর পর এ যাবত্কাল পর্যন্ত তাঁর জীবন ইতিহাস নিয়ে পৃথিবীর প্রায় সবগুলো প্রধান প্রধান ভাষায় হাজার হাজার বই লেখা হয়েছে। গবেষণা হয়েছে। এমনকি এখন পর্যন্ত তা অব্যাহত রয়েছে। বর্তমান পৃথিবীর আধুনিক তরুণ সমাজের মধ্যেও চে সম্পর্কে কৌতূহলের সীমা নেই। পরিধেয় বস্ত্রে চে’র ছবিই তার বড় প্রমাণ। চে গুয়েভারার রাজনৈতিক ও বিপ্লবী জীবন ছিল মাত্র আট বছর, ১৯৫৯-১৯৬৭ সাল পর্যন্ত। এই সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে তিনি যা সৃষ্টি করেছেন, সমাজ বিপ্লবে যে অবদান রেখেছেন তা আশ্চর্যতম ঘটনা। তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত লেখনির মধ্যে রয়েছে রাজনীতি ও সামাজিক তত্ত্ব, সামরিক ও গেরিলা যুদ্ধের রণনীতি ও রণকৌশল, কূটনৈতিক পদ্ধতি ও পরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ দলিল, বইপত্র, বক্তৃতার লিখিত কপি, বিভিন্ন ম্যাগাজিনের নিবন্ধ, চিঠিপত্র, ডায়েরী, কবিতা, গান, গল্প, অফিসিয়াল ডকুমেন্টস, মার্কসবাদের ব্যাখ্যা, শ্রমিক, কৃষক, বিপ্লবী পার্টির তাত্ক্ষণিক তাত্ক্ষণিক সিদ্ধান্ত, অর্থনীতি ইত্যাদি বহু বিষয়ের ওপর অজস্র লেখা। চে গুয়েভারার এসব মহামূল্যবান সৃষ্টি কিউবা সরকার আর্কাইভসে সংরক্ষিত করে রেখেছে। এসব সৃষ্টি সর্বকালের জনগণের জন্য দেশপ্রেম, ত্যাগ ও বিপ্লবী জীবনের অনুপ্রেরণার উত্স্য।
১৯৪৭ সালে চে গুয়েভারা বুয়েনস আয়ার্স বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিত্সা শাস্ত্রে অধ্যয়নের জন্য ভর্তি হন। এরপর চে গুয়েভারার জীবন প্রবাহ দ্রুতগতিতে এগিয়ে যেতে থাকে। তিনি সমগ্র ল্যাটিন আমেরিকা ভ্রমণ করে শোষক ও শোষিত মানুষের মধ্যকার শোষণ সম্পর্কে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনের ইচ্ছা পোষণ করেন। ১৯৫০ সালে হঠাত্ করে তিনি একটি তেল ট্যাঙ্কারে খালাসির চাকরি নিয়ে ত্রিনিদাদ ও বৃটিশ গায়ানা ভ্রমণ করেন। তারপর ১৯৫১ সালে বন্ধু আলবার্তো গ্রানাদাসহ ঐতিহাসিক মোটরসাইকেল ভ্রমণে বেড়িয়ে পড়লেন। প্রথমে চিলিতে গ্রামে গ্রামে ঘুরে দেখলেন মানুষের দুর্বিষহ শোষণ-নিপীড়ন। পুরনো মোটরসাইকেল নষ্ট হয়ে গেল। অনেক কষ্টে পেরুতে আমাজন নদীর তীরে এলেন তারা। তারা সু-উচ্চ আন্দিজ পর্বতমালার ওপরে প্রাচীনতম আশ্চর্য নগরী মাচ্চু পিচ্চু ভ্রমণ করলেন। ইনকা সভ্যতার বিকাশ দেখলেন। এরপর কলম্বিয়া। সেখান থেকে ভেনিজুয়েলা হয়ে আর্জেন্টিনায় ফিরে এলেন। ৭ মাস ধরে ল্যাটিন আমেরিকা ভ্রমণ করলেন দু’জন। চে গুয়েভারা ভ্রমণের বাস্তব অভিজ্ঞতা ও খুঁটিনাটি সব কিছুই ডায়রিতে লিখে রেখেছিলেন। পরবর্তী সময়ে ‘দি মটর সাইকেল ডায়ারিস’ এই নামে চে গুয়েভারার একটি বই প্রকাশিত হয়। বইটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। সেই সময় নিউইয়র্ক টাইমস-এর মতে সর্বোচ্চ বিক্রীত বই, ‘দি মটর সাইকেল ডায়ারিস।’ একই নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়, যা দর্শক জনপ্রিয়তার কারণে ২০০৪ সালে পুরস্কার বিজয়ের সম্মান লাভ করে। ১৯৫৩ সালে তিনি ডাক্তারী পাস করলেন, সার্জন ও চর্ম বিশেষজ্ঞ হিসেবে। প্র্যাকটিস করার সনদ ও অনুমতিপত্র পেলেন। কিন্তু শুধুমাত্র ডাক্তারী করে নিজের আর্থিক সচ্ছলতা আনয়নের জন্যই চে গুয়েভারার জন্ম হয়নি। তিনি ১৯৫৩ সালের ৭ জুলাই পুনরায় দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকা সফরে বেরিয়ে পড়লেন, সাথে বাল্যবন্ধু কালিকা (কার্লোস ফেরার)। এবার বলিভিয়া, পেরু, ইকুয়েডর, পানামা, কোস্টারিকা, নিকারাগুয়া, হন্ডুরাস এবং এলসালভাদর ভ্রমণ করলেন। এই দেশে পরিচয় হলো কয়েকজন আর্জেন্টাইন বিপ্লবীর সাথে। আর কোস্টারিকায় পরিচয় হলো কিউবান বিপ্লবী আন্দোলনের কয়েকজন কর্মীর সাথে। এরপর তারা ১৯৫৩ সালে ২৪ ডিসেম্বর এসে পৌঁছলেন গুয়াতেমালায়। এখানেই পেরুর বিপ্লবী মহিলা হিন্দা হিলদাগাদিয়ার সাথে চে’র পরিচয় হলো। সেই সময় গুয়াতেমালায় শাসন ক্ষমতায় ছিলেন গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত বামপন্থী প্রগতিশীল প্রেসিডেন্ট জ্যাকোবো আরবেনজ গুজম্যান। আমেরিকার স্বার্থ বিঘ্নিত হওয়ায় প্রতিবিপ্লবের মাধ্যমে সিআইএ প্রেসিডেন্ট আরবেনজকে উত্খাতের ষড়যন্ত্র করতে থাকে। চে এবং হিলদা প্রতিবিপ্লবে প্রতিহত করার সংগ্রামে যোগ দিলেন। কিন্তু ১৯৫৪ সালের ১৭ জুন আমেরিকা গুয়াতেমালার বিমান থেকে বোমাবর্ষণ শুরু করলো। আরবেনজ  মেক্সিকো দূতাবাসে আশ্রয় নিলেন। চে আর্জেন্টিনা দূতাবাসে আশ্রয় নিলেন। হিলদা গ্রেফতার হলেন। এরপর ১৯৫৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর চে মেক্সিকোতে আসেন। হিলদা কারাগারে অনশন করার কারণে প্রতিবিপ্লবী সরকার তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। তিনিও মেক্সিকোতে এলেন।
 ১৯৫৫ সালের জুলাই মাসে কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ত্রোর সাথে চে’র পরিচয় হয়। আর সেই পরিচয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন তাঁর ছোটভাই রাউল ক্যাস্ত্রো। রাউলের সাথেই চে’র প্রথম পরিচয় হয়। সারারাত ধরে চে ফিদেলের সাথে কিউবা বিপ্লবী অভিযান, রাজনীতি ও রণকৌশল নিয়ে কথা বললেন, পরিকল্পনা করলেন। এরপর স্পেনীয় সেনাবাহিনীর একজন প্রাক্তন কর্নেল আলবার্তো বেয়োর কাছে গোপনে মেক্সিকোতেই গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ শুরু হলো। চে গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণে অসাধারণ কৃতিত্ব প্রদর্শন করলেন। ১৯৬৬ সালের ৭ নভেম্বর বলিভিয়ার নানকাহুয়াসু গেরিলা ঘাঁটিতে পৌঁছলেন চে। ১৯৬৭ সালের ২৩ মার্চ চে’র নেতৃতাধীন গেরিলা বাহিনী নিজেদের চিহ্নিত করলো ‘বলিভিয়ার জাতীয় মুক্তিফৌজ’ নামে। ৮ অক্টোবর কেব্রাদা দেল ইউরোর যুদ্ধে গুরুতর আহত ও নিরস্ত্র অবস্থায় বন্দী হলেন চে। তাঁকে বন্দী অবস্থায় হিগুয়েরা গ্রামের সাধারণ স্কুল বাড়িতে ফেলে রাখা হলো। চিকিত্সা দেয়া হলো না। খাবার পানিটুকুও দেয়া হলো না। অথচ যুদ্ধক্ষেত্রে ড. আর্নেস্টো চে গুয়েভারা নিজে আহত থাকা অবস্থায় আহত শত্রু সৈন্যকে আগে সেবাদান করেছেন, তারপর নিজেদের বাহিনীর আহত কমরেডকে, তারপর নিজের চিকিত্সা করেছেন। যন্ত্রণা দিয়ে ধীরে ধীরে নিষ্ঠুরভাবে হত্যার নীতি গ্রহণ করেছিলেন বলিভিয়া সরকার ও সিআইএ। অবশেষে ৯ অক্টোবর দুপুর ১-২০ মিনিটে এই মহান বিপ্লবী নেতা ড. আর্নেস্টো চে গুয়েভারাকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়। মৃত্যুর সময় চে গুয়েভারা জনগণের উদ্দেশে উচ্চারণ করেছিলেন “হাস্তা লা ভিক্তোরিয়া সিয়াম্প্রে”। অর্থাত্ চিরস্থায়ী বিজয়ের পথে এগিয়ে যাও।
লেখক: আইনজীবী

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন