কে জি মোস্তফা
শাহনাজ কবিতাচর্চায় এক নিবেদিত প্রাণ। কবিতা লেখে, কবিতা আবৃত্তি করে। সংসার, স্বামী ও সন্তানদের দেখাশোনার ফাঁকে ফাঁকে ছুটে যায় কবিতার আসরে। কবিতার প্রতি তার প্রচণ্ড অনুরাগ ও আগ্রহ সত্যি প্রশংসনীয়। তার সঙ্গে আমার পরিচয়ের প্রথম দিনে আমি কিছুটা চমকে উঠেছিলাম। ওর চেহারার আদল যেন অনেকটা আমার ছোট খালার। ছোট খালা ছিলেন আমার আবাল্য আকৈশোর সঙ্গী। চিরদুখী খালা আজ আর নেই। বলা যায় অকালেই ইন্তেকাল করেন।
প্রাণচঞ্চল দুরন্ত জীবনের অন্য নাম কৈশোর। সেই কৈশোরে আমার একমাত্র সঙ্গী আমার ছোট খালা। বয়সে বড় হলেও প্রায় সমবয়সী ছিলাম আমরা। মা-বাবার রাগারাগি বকাঝকায় খালা ছিল আমার আশ্রয়-প্রশ্রয়। খালবিল পুকুরে মাছধরা ছিল আমার নেশা। মনের আনন্দে দুজনে মিলে মাছ ধরতাম। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠে কাঁচাপাকা কত রকমের আম যে কুড়াতাম। কবি জসীম উদদীনের সেই বিখ্যাত কবিতাটি—‘বৈশাখ মাসে ঝড়ের দিনে আম কুড়াতে সুখ, পাকা জামের মধুর রসে রঙিন করি মুখ।’ আম জাম ছাড়াও জানা-অজানা ফুল-ফলের কত যে নাম ছিল আজ আর মনে পড়ে না। কোথায় গেল হারিয়ে আমার বাঁশির দেশের মন, আহা আমার বেতসবনের লুকিয়ে থাকা ক্ষণ! সেই জীবন কথার টুকরো টুকরো স্মৃতিগুলো বেজে ওঠে অহরহ।
মনে পড়ে সেইসব অনাদিকালের দৃশ্য। অমন মায়াবী ল্যান্ডস্কেপে চারদিকে খুশি। খুশির বন্যায় ফুটতো কত বিচিত্র ফুল। ঝোপেঝাড়ে গাঢ় সবুজের হাতছানি। পাতার আড়াল থেকে পাখিদের গান। বড় বড় গাছপালা, নিচু ঝোপঝাড়। নানা রকমের প্রজাপতির ওড়াউড়ি। ফুরফুরে হাওয়া। যেখানে নিঃশব্দ যেন শব্দকে খেয়ে ফেলে। সেই নিস্তব্ধতায় আমরা হাঁটতাম। সঙ্গে হাঁটতো কত আবেগ, কত অনুভূতি, কত স্বপ্ন। ভীরু মনে অজানা করুণ সুর, বুকের ভেতর মন কেমন করা দীর্ঘশ্বাস।
প্রাণের মায়া বড় কঠিন মায়া। জ্যৈষ্ঠমাস মধুমাস। আম জাম কাঁঠালের মাস। স্বজনদের কাছ থেকে বার বার ডাক আসে। একটা ধূসর সময়কে সতেজ করার প্রয়াসে মাঝে মাঝে ছুটে যেতে হয়, যাই। মহানগরীর একাকীত্ব, বহুচর্চিত ক্লিন্নতা থেকে মুক্তি পেতে চায় মন।
যদিও পল্লীসমাজ আজ কোণঠাসা, তবু সৌহার্দ্যবিহীন নয়। মানুষের সামাজিক পরিচয় ও আত্মীয়তার বন্ধনকে কখনই অস্বীকার করা যায় না। সেই পরিচয়গুলোই মানুষের প্রধান পরিচয়, সে বন্ধনই জীবনপ্রবাহকে ছন্দে বেঁধে রাখে।
পল্লীগ্রাম, আটপৌরে স্মৃতি। প্রিয় স্মৃতিগুলো কি এ রকমই টাটকা থাকে!
কবেকার সেইসব স্মৃতি। নদীমাতৃক জীবন। সাবেকি বাড়ি। আনমনা ছায়া গাছ। চৈতালি ঘূর্ণি, ঝড় ও ঝরাপাতা, বহু প্রতীক্ষিত ঝিরঝিরে বৃষ্টি।
সেইসব দিন ছিল নিছক জীবনযাপন। নকশিকাঁথা সে জীবন সম্পর্কে আজও অতীতের অবগুণ্ঠনে ভালোবাসা যেন জেগে আছে।
অবশ্য সময়টা দ্রুত পাল্টাচ্ছে। গ্রাম বলে এখন আর তেমন কিছু নেই। কখন গ্রামের ভেতর চলে গেছে শহর, কেউ কি দেখবে আর সাঁকো দিয়ে পারাপার, পালকি গরুর গাড়ি নৌকার বহর! তবে চিরন্তনের হেফাজতে আগের মতোই অবিকল কিছু কিছু গাছ আজও আছে। আছে আম জাম আরও কিছু বাহারি গাছ। অত নাম জানি না, ঘাসবনও রয়েছে।
ফুলে ফলে বীজে সাবেকি বাড়িঘর আজও আঁকড়ে আছে। গোটা কতক শালিক কিচিরমিচির করে অবিরত। অনেক নিঝুম দুপুরে সুরের আর্তিতে কেঁপে কেঁপে ওঠে গাছের পাতাগুলো। সেইসব গাছের নিচে দাঁড়িয়ে এত বছর বাদেও পুরো দৃশ্যটা অনায়াসে স্মরণে আসে।
প্রাক-সন্ধ্যার আদূরে হাওয়া। সাঁঝের পশ্চিম আকাশ উদাসী লাল। বাইরে সোনালি সন্ধ্যা রক্তিম হয়ে উঠেছে। ঘরে ফেরা পাখিদের ডানা ঝাপটানো। এত উপর থেকে ওই আদিগন্ত কী অদ্ভুত লাগে। দিগন্ত থেকে কিছু উপরে আকাশে দপদপ করে জ্বলছে সন্ধ্যাতারা। হাঁটতে হাঁটতে আজ বড় একা লাগে।
জীবন ছিটকে যাচ্ছে। মানুষ ছিটকে ছড়িয়ে পড়ছে, ফোঁটা ফোঁটা হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে অন্য মানুষদের মধ্যে। গতানুগতিক সঙ্কীর্ণ এই জীবনযাপনের সঙ্গে আত্মিক যোগসূত্র শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিগুলো। অতীতের মধ্যে রয়েছে স্বপ্ন দেখার সৃজনশীলতা। রয়েছে লালিত জীবনের পালিত সুখ। জীবন তোমায় জানাই আমি হাজারো সালাম। কোথা থেকে কেমন করে এত দূরে এলাম! সংসারে যা দেয়ার সব দিয়েছি। জীবনে যা আদায় করার, করে নিয়েছি।
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন। তখন গল্পের জোনাকি রঙে সব কিছু যেন ঝিলিমিলি। সব পাখি ঘরে আসে, সব নদী বয়ে যায়, ফুরায় বুঝি জীবনের সব লেনদেন!
চারদিকে বুঝি অন্ধকার নেমে আসে। অন্ধকার, তুমি যতই বিধ্বংসী হও না কেন, প্রেমই আমার জয়লাভের প্রধান অস্ত্র! প্রেম মহান স্রষ্টার দিব্য স্বরূপ!
লেখক : গীতিকার, কবি, সাংবাদিক
প্রাণচঞ্চল দুরন্ত জীবনের অন্য নাম কৈশোর। সেই কৈশোরে আমার একমাত্র সঙ্গী আমার ছোট খালা। বয়সে বড় হলেও প্রায় সমবয়সী ছিলাম আমরা। মা-বাবার রাগারাগি বকাঝকায় খালা ছিল আমার আশ্রয়-প্রশ্রয়। খালবিল পুকুরে মাছধরা ছিল আমার নেশা। মনের আনন্দে দুজনে মিলে মাছ ধরতাম। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠে কাঁচাপাকা কত রকমের আম যে কুড়াতাম। কবি জসীম উদদীনের সেই বিখ্যাত কবিতাটি—‘বৈশাখ মাসে ঝড়ের দিনে আম কুড়াতে সুখ, পাকা জামের মধুর রসে রঙিন করি মুখ।’ আম জাম ছাড়াও জানা-অজানা ফুল-ফলের কত যে নাম ছিল আজ আর মনে পড়ে না। কোথায় গেল হারিয়ে আমার বাঁশির দেশের মন, আহা আমার বেতসবনের লুকিয়ে থাকা ক্ষণ! সেই জীবন কথার টুকরো টুকরো স্মৃতিগুলো বেজে ওঠে অহরহ।
মনে পড়ে সেইসব অনাদিকালের দৃশ্য। অমন মায়াবী ল্যান্ডস্কেপে চারদিকে খুশি। খুশির বন্যায় ফুটতো কত বিচিত্র ফুল। ঝোপেঝাড়ে গাঢ় সবুজের হাতছানি। পাতার আড়াল থেকে পাখিদের গান। বড় বড় গাছপালা, নিচু ঝোপঝাড়। নানা রকমের প্রজাপতির ওড়াউড়ি। ফুরফুরে হাওয়া। যেখানে নিঃশব্দ যেন শব্দকে খেয়ে ফেলে। সেই নিস্তব্ধতায় আমরা হাঁটতাম। সঙ্গে হাঁটতো কত আবেগ, কত অনুভূতি, কত স্বপ্ন। ভীরু মনে অজানা করুণ সুর, বুকের ভেতর মন কেমন করা দীর্ঘশ্বাস।
প্রাণের মায়া বড় কঠিন মায়া। জ্যৈষ্ঠমাস মধুমাস। আম জাম কাঁঠালের মাস। স্বজনদের কাছ থেকে বার বার ডাক আসে। একটা ধূসর সময়কে সতেজ করার প্রয়াসে মাঝে মাঝে ছুটে যেতে হয়, যাই। মহানগরীর একাকীত্ব, বহুচর্চিত ক্লিন্নতা থেকে মুক্তি পেতে চায় মন।
যদিও পল্লীসমাজ আজ কোণঠাসা, তবু সৌহার্দ্যবিহীন নয়। মানুষের সামাজিক পরিচয় ও আত্মীয়তার বন্ধনকে কখনই অস্বীকার করা যায় না। সেই পরিচয়গুলোই মানুষের প্রধান পরিচয়, সে বন্ধনই জীবনপ্রবাহকে ছন্দে বেঁধে রাখে।
পল্লীগ্রাম, আটপৌরে স্মৃতি। প্রিয় স্মৃতিগুলো কি এ রকমই টাটকা থাকে!
কবেকার সেইসব স্মৃতি। নদীমাতৃক জীবন। সাবেকি বাড়ি। আনমনা ছায়া গাছ। চৈতালি ঘূর্ণি, ঝড় ও ঝরাপাতা, বহু প্রতীক্ষিত ঝিরঝিরে বৃষ্টি।
সেইসব দিন ছিল নিছক জীবনযাপন। নকশিকাঁথা সে জীবন সম্পর্কে আজও অতীতের অবগুণ্ঠনে ভালোবাসা যেন জেগে আছে।
অবশ্য সময়টা দ্রুত পাল্টাচ্ছে। গ্রাম বলে এখন আর তেমন কিছু নেই। কখন গ্রামের ভেতর চলে গেছে শহর, কেউ কি দেখবে আর সাঁকো দিয়ে পারাপার, পালকি গরুর গাড়ি নৌকার বহর! তবে চিরন্তনের হেফাজতে আগের মতোই অবিকল কিছু কিছু গাছ আজও আছে। আছে আম জাম আরও কিছু বাহারি গাছ। অত নাম জানি না, ঘাসবনও রয়েছে।
ফুলে ফলে বীজে সাবেকি বাড়িঘর আজও আঁকড়ে আছে। গোটা কতক শালিক কিচিরমিচির করে অবিরত। অনেক নিঝুম দুপুরে সুরের আর্তিতে কেঁপে কেঁপে ওঠে গাছের পাতাগুলো। সেইসব গাছের নিচে দাঁড়িয়ে এত বছর বাদেও পুরো দৃশ্যটা অনায়াসে স্মরণে আসে।
প্রাক-সন্ধ্যার আদূরে হাওয়া। সাঁঝের পশ্চিম আকাশ উদাসী লাল। বাইরে সোনালি সন্ধ্যা রক্তিম হয়ে উঠেছে। ঘরে ফেরা পাখিদের ডানা ঝাপটানো। এত উপর থেকে ওই আদিগন্ত কী অদ্ভুত লাগে। দিগন্ত থেকে কিছু উপরে আকাশে দপদপ করে জ্বলছে সন্ধ্যাতারা। হাঁটতে হাঁটতে আজ বড় একা লাগে।
জীবন ছিটকে যাচ্ছে। মানুষ ছিটকে ছড়িয়ে পড়ছে, ফোঁটা ফোঁটা হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে অন্য মানুষদের মধ্যে। গতানুগতিক সঙ্কীর্ণ এই জীবনযাপনের সঙ্গে আত্মিক যোগসূত্র শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিগুলো। অতীতের মধ্যে রয়েছে স্বপ্ন দেখার সৃজনশীলতা। রয়েছে লালিত জীবনের পালিত সুখ। জীবন তোমায় জানাই আমি হাজারো সালাম। কোথা থেকে কেমন করে এত দূরে এলাম! সংসারে যা দেয়ার সব দিয়েছি। জীবনে যা আদায় করার, করে নিয়েছি।
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন। তখন গল্পের জোনাকি রঙে সব কিছু যেন ঝিলিমিলি। সব পাখি ঘরে আসে, সব নদী বয়ে যায়, ফুরায় বুঝি জীবনের সব লেনদেন!
চারদিকে বুঝি অন্ধকার নেমে আসে। অন্ধকার, তুমি যতই বিধ্বংসী হও না কেন, প্রেমই আমার জয়লাভের প্রধান অস্ত্র! প্রেম মহান স্রষ্টার দিব্য স্বরূপ!
লেখক : গীতিকার, কবি, সাংবাদিক
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন