বৃহস্পতিবার, ৩ মে, ২০১২

ইতিহাসের আলোকে স্বদেশের মুখ



আ লী  ই মা ম
ইতিহাস থেকে জানা যায় দু’হাজার বছর আগে বাংলাদেশে উন্নতমানের জাহাজ তৈরি হতো। বাঙালিরা তখন বাণিজ্য করতে যেত সুদূর ক্রিট, আলেকজান্দ্রিয়া ও কৃষ্ণ সাগরে। পূর্বদিকে যেত চীন সাগরে।
রামায়ণে উল্লেখ রয়েছে ক্ষীর সাগর, যবদ্বীপ, ইক্ষুরস সাগর, সালমালা দ্বীপ, সোরা সাগর ও ক্ষিরদা সাগরের।
ঋগবেদে বলা হয়েছে চারটি সমুদ্রে যাতায়াতের কথা।
মহাভারতের দ্রোণপর্বে বলা হয়েছে, সমুদ্রের অগভীর পানিতে বিপদে পতিত লোকরা যদি দ্বীপ পেয়ে যায় তাহলে বেঁচে যায় তারা। আদিপর্বে রয়েছে কারু ও তার বোন বিনীতার কাহিনী। সেখানে সমুদ্রের বর্ণনা রয়েছে। দু’বোন এসে পৌঁছাল কুমিরে ভরা সমুদ্রতীরে। সমুদ্রে ছিল বিশাল তিমিঙ্গল। সামুদ্রিক দানব।
অর্জুন গিয়েছিল উত্তর সমুদ্রে। পাখি ছাড়া সেখানে আর কেউ যায় না। লবণ সমুদ্র সম্পর্কে বলা হয়েছে, সেখানে প্রচুর খনিজ দ্রব্য, পাহাড়-পর্বত রয়েছে।
রামায়ণে বর্ণিত হয়েছে সুমাত্রা ও জাভা দ্বীপের পরে ইক্ষু সাগর অবস্থিত। শিশির পর্বত রয়েছে জাভা দ্বীপের পরে। গর্জনশীল সমুদ্রকে মনে হয় মেঘের মতো কালো। এ সমুদ্র সাপে পরিপূর্ণ। উত্তাল সাগর পাড়ি দিয়ে পড়বে লাল পানির সাগরে। সেখানে রয়েছে সালামালা দ্বীপ। ওই দ্বীপ পেরিয়ে সাদা ও হলুদ মেঘের বর্ণের মতো ক্ষীর সাগর চোখে পড়বে। ওই সাগর দেখতে এত সাদা যেন মুক্তায় পূর্ণ। এই সাগরের মাঝখানে রয়েছে গাছপালায় ভরা পর্বত।
জাতকের একটি কাহিনীতে আছে, ভৃগুচ্ছক থেকে জাহাজে করে সমুদ্রযাত্রার কথা। সাত দিনের পথ। ঝড়ের কবলে পড়ে ভেঙে যায় জাহাজটি। চার মাস একটানা ভেসে চলার পর জাহাজ এসে ভেড়ে উরুকানাল সাগরে। জাহাজটি আগুনের মতো জ্বলা অগ্নিমালা সাগর পেরিয়ে যায়।
প্রাচীন সাহিত্যে এভাবে বিভিন্ন রূপকের মধ্য দিয়ে সমুদ্রের দ্বীপের বর্ণনা রয়েছে। প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে আর্যরা পৃথিবীর বিভিন্ন ভূখণ্ডের বিভিন্ন এলাকা, দ্বীপ, সাগর, নদী সম্পর্কে ধারণা লাভ করে। তারা সমুদ্রে অভিযান চালায়।
বঙ্গ অঞ্চলের প্রাচীন সভ্যতার এক নিদর্শন হচ্ছে পাণ্ডু রাজার ঢিবি। তখনকার দুঃসাহসী লোকজন সাত সমুদ্র তের নদী পেরিয়ে বিদেশে যেত বাণিজ্যের জন্য। তাদের সবচেয়ে বেশি বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল ক্রিট দ্বীপ ও ভূমধ্যসাগরীয় অন্যান্য দেশের সঙ্গে। যেসব দ্রব্যের বাণিজ্য হতো তা হল মসলা, তুলা, হাতির দাঁত, সোনা, রুপা, তামা, হীরা ও শর্করা। লোথাল বন্দর থেকে পাওয়া গেছে পোড়ামাটির জাহাজের মাস্তুল। হরপ্পীয় বন্দরগুলো থেকে বাণিজ্য জাহাজগুলো সমুদ্র উপকূল ধরে ওমান উপসাগর ও হরমুজ প্রণালীর মধ্য দিয়ে পারস্য উপসাগরের বাহারিনে নোঙর করত। লোহিত সাগর বরাবর আরও একটি পথ ছিল। প্রাচীন উর দেশের বণিকরা মেলুহা (ভারতবর্ষ), তিলমুন (বাহারিন) এবং মাগান (ওহমান)-এর সঙ্গে বাণিজ্য করত।
সম্রাট সোলেমানের রাজত্বকাল (৮০০ খ্রিস্টপূর্ব) টায়ারের শাসক হিরামের নির্দেশে একটি বাণিজ্যিক নৌবহর পূর্বদেশ অভিমুখে যাত্রা করেছিল। জাহাজ বোঝাই করে নিয়েছিল সোনা, রুপা, বানর, ময়ূর ও পাথর। অফির নামক এক স্থান থেকে এসব পণ্য সংগৃহীত হয়।
৫১০ খ্রিস্টপূর্বে পারস্য সম্রাট দারায়ুসের নির্দেশে স্কাইলাস সিন্ধু নদের গতিপথ দেখার জন্য কাবুল নদী বেয়ে জাহাজ নিয়ে সিন্ধুতে উপনীত হন।
খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বিখ্যাত আবিষ্কারক ইউডাক্সাস দু’বার সমুদ্রপথে সোজাসুজি ভারত অভিমুখে পাড়ি দিয়েছিলেন।
৪৫ খ্রিস্টাব্দে হিপ্পালাস নামে একজন নাবিক আবিষ্কার করলেন যে, একটি নির্দিষ্ট সময়ে ভারতীয় সমুদ্রের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয় মৌসুমী বায়ু। এই অনুকূল বায়ুর সাহায্যে মাত্র ৪০ দিনের কম সময়ে লোহিত সাগরের ওজেরিন বন্দর থেকে ভারতের মালাবার উপকূলে মুজিরিস বন্দরে পৌঁছানো সম্ভবপর হয়। 
পেরিপ্লাস লিখেছিলেন ভারতের নর্মদা নদীর মোহনায় অবস্থিত ভৃগুকচ্ছ বন্দরে দূরের কাশ্মীর থেকেও রফতানির জন্য পণ্য এনে জমা করা হতো। এর উত্তরে সিন্ধু নদের মুখের মাঝে বারবারিকাম নামে একটি বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল। তখন গ্রিক বাণিজ্য জাহাজগুলোকে সামরিক প্রহরায় নিয়ে আসা হতো। খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকের শেষদিকে আলেকজান্দ্রিয়ার অবক্ষয় ঘটতে শুরু করলে রোমের সঙ্গে এই অঞ্চলের বাণিজ্যে ভাটার লক্ষণ দেখা যায়।
সমুদ্রযাত্রার ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হচ্ছে ‘পেরিপ্লাস, ইরিথ্রিয়ান অব দ্য সি। সত্তর খ্রিস্টাব্দে রচিত। ধারণা করা হয় আলেকজান্দ্রিয়া থেকে আগত কোনো মিসরীয় নাবিকের রচিত এই বই। এর রচয়িতা লোহিত সাগরের এক বন্দর বোরনিস থেকে যাত্রা করে রাব এল মান্দব প্রণালী পার হয়ে মৌসুমী বায়ুপ্রবাহের সুযোগ নিয়ে মধ্য সমুদ্রপথে আরব সাগর অতিক্রম করেন। পথে বারবারিকন, বারিগাজা বন্দরে অবতরণ করেন। এই গ্রন্থে সংশ্লিষ্ট বহু বন্দরের বিশদ বিবরণ রয়েছে। এ সব তথ্য পরবর্তীকালে পর্যটকদের জন্য অত্যন্ত সহায়ক হয়েছিল। জাহাজ পরিচালনাকারী এবং নাবিকরা মৌসুমী বায়ুপ্রবাহের গুরুত্ব এবং প্রভাবকে অনুধাবন করতে পারল। মৌসুমী বায়ুর তথ্য অভিযাত্রীদের উত্সাহিত করল। এর আগে আরব, পারস্য ও বেলুচিস্তানের উপকূলপথে মিসরীয় বাণিজ্য জাহাজগুলো আসত ভারতবর্ষের বন্দরে। পূর্ব আফ্রিকার বণিকরা তখন সরাসরি আরব সাগর পাড়ি দিয়ে আসত।
রোমকরা পেরিপ্লাসের সময় থেকে
সমুদ্র পারাপারের জন্য মৌসুমী বায়ুর সুযোগ গ্রহণ করে।
ভারতীয় বাণিজ্য জাহাজগুলো মণি-মুক্তা, মূলবান পাথর, হাতির দাঁত, মসলা, রেশমি বস্ত্র, মসলিন, চাল, তিল, তেল, ঘি, চিনিসহ নানা ধরনের ভেষজ নিয়ে যেত। বনজদ্রব্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল নীল। এসব বাণিজ্য জাহাজ কুয়ারিকা অন্তরীপ প্রদক্ষিণ করে তাম্রলিপ্তি (তামালিটিস), তাকোলো (মিয়ানমারের রাজধানী ইয়াঙ্গুনের নিকটবর্তী), আবানা, মৌলাসিন বন্দরে যেত। দক্ষিণ-পূর্বে যবদ্বীপ, মালয়, সুমাত্রা, কম্বোজের বিভিন্ন বন্দরে যেত। ভিয়েতনামের হ্যানয়ের কাছে কাট্টিসারা বন্দরে যেত।
খ্রিস্টীয় প্রথম থেকে পঞ্চম শতাব্দী পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে কাশ্মীরি বৌদ্ধ মনীষীরা চীনে গিয়েছিলেন। এদের মধ্যে যাদের সমুদ্রযাত্রার বিবরণ পাওয়া যায় তারা হলেন সঙ্গদেব, বিমলাঙ্ক, পুণ্যত্রাত শঙ্খভূমি। প্রাচীন বৌদ্ধ গ্রন্থ ‘সংযুক্ত নিকায়ে’তে স্বেতক নগরীর উল্লেখ রয়েছে। এই নগরী অবস্থিত ছিল প্রাচীন বাংলার রাঢ়দেশে। খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে রচিত টীকাগ্রন্থ ‘মিলিন্দ’তে বর্ণিত রয়েছে, ‘বঙ্গে একটি প্রধান সামুদ্রিক বন্দর ছিল। বৌদ্ধ নাবিকদের পরিভ্রমণের বিবরণ থেকে প্রাচীন বাংলার অনেক তথ্য পাওয়া যায়। খ্রিস্ট্রীয় প্রথম ও দ্বিতীয় শতকে রচিত ইতিহাসভিত্তিক গ্রন্থ ‘মিলিন্দ’, ‘জাতক’ কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র থেকে প্রাচীন বাংলার সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ ও দ্বীপপুঞ্জের সামুদ্রিক বাণিজ্যের বিবরণ পাওয়া যায়। বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারের সূত্রে বৌদ্ধ শ্রমণরা যেতেন বিভিন্ন অঞ্চলে। এর ফলেও ভৌগোলিক জ্ঞানের যথেষ্ট বিকাশ লাভ হয়েছিল।
প্রাচীনকালের বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রটি সমৃদ্ধ ছিল।
কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, তিব্বতি ভাষা থেকে এসেছে বঙ্গ শব্দটি। তিব্বতি ভাষায় বঙ্গ মানে আর্দ্র ও স্যাঁতসেঁতে। গাঙ্গেয় অববাহিকার এ অঞ্চলটিতে ছিল অসংখ্য বিস্তীর্ণ খালবিল, নদী, জলাশয় ও হাওর। এলাকাটি ছিল জলজ প্রকৃতির। তাই নামকরণের ক্ষেত্রে এই ভৌগোলিক পরিবেশটি প্রভাব ফেলতে পারে। তখনকার এ অঞ্চলের জনপদের নাম ছিল বজ্র, পুণ্ড্র, রাঢ়, তাম্রলিপ্তি, বরেন্দ্র, গৌড়, সমতট ও হরিকেল।
খ্রিস্টীয় প্রথম শতকের প্রারম্ভে মগধ দেশ থেকে বৌদ্ধ প্রচারকরা পূর্বদেশে গিয়েছিলেন ধর্ম প্রচার করতে।
সম্রাট অশোক খ্রিস্টপূর্ব ২০০ বছর আগে পাটলিপুত্র থেকে মোগলীপুত্ত খেরোর নেতৃত্বে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে একটি প্রতিনিধি দল প্রেরণ করেছিলেন। দলটি সুবর্ণভূমি (মিয়ানমার ও শ্যাম দেশ) গমনকালে বঙ্গ অঞ্চলের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রামের ওপর দিয়ে গিয়েছিল।
৪২৩ খ্রিস্টাব্দে বুদ্ধজীব চীনের নানকিভ নগরীতে পৌঁছেছিলেন। পঞ্চম শতাব্দী থেকে ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে বৌদ্ধ দার্শনিকরা চীন দেশে ব্যাপকভাবে যেতে থাকেন। 
ইতিহাসের পথপরিক্রমায় আমরা অবহিত হই কীভাবে বাঙালির রন্ধন শিল্পের সঙ্গে মসলার সংমিশ্রণ ঘটেছিল। মসলার ইতিহাসের উত্স অনুসন্ধান করলে আমাদের দেশের সঙ্গে অন্যান্য অঞ্চলের যোগসূত্র স্থাপনের কাহিনী জানা যাবে। বাঙালির বহির্বাণিজ্যের ইতিহাসে আর্থ-সামাজিক ইতিহাসের বহু প্রেক্ষাপট জানা যাবে।
প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ড. নীহাররঞ্জন রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে ১৯৭৩ সালে এক আলোচনাসভায় মন্তব্য করেছিলেন, বাঙালির ইতিহাস হচ্ছে এদেশের নদীতীরে গড়ে ওঠা গঞ্জ-হাটের ইতিহাস। 
মসলার বাণিজ্য করেই কালিকট রাজ এককালে সমৃদ্ধি লাভ করেছিলেন। পর্তুগালের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল সেই সমৃদ্ধি। পঞ্চদশ শতকে কালিকটে অধিকার বিস্তারের উদ্দেশ্যে তারা অভিযান চালায়। মসলার উত্পাদন পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে বিস্তৃত হয়েছিল। পর্তুগালের পথ ধরে সেখানে আসে ওলন্দাজরা। সতের শতকে আসে ইংরেজরা। মসলার লোভে ইউরোপীয় শক্তিগুলোর অভিযান আমাদের দেশের ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
সে যুগের গাঙ্গেয় অববাহিকা অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার দিক সম্পর্কে অবহিত হওয়া প্রয়োজন। এর সঙ্গে রয়েছে উপনিবেশ স্থাপন ও সাম্রাজ্য বিস্তার, কুিসত লোভ ও বর্বর অন্যায়, মানুষের জীবনযাত্রা নিয়ন্ত্রণের ঔপনিবেশিক প্রচেষ্টা।
বাঙালির অতীত জীবন-যাত্রার কাহিনী, কৃষি ব্যবস্থা ও তার রন্ধনশিল্প সম্পর্কে তথ্য জানা ইতিহাসের উত্স অনুসন্ধানের জন্য প্রয়োজন।
বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন ‘চর্যাপদ’-এ তা বিধৃত রয়েছে।
প্রাচীনকালের লোকরা হরিণের মাংস খেতে পছন্দ করত। শবররা জাল পেতে হরিণ ধরত। তখনকার দিনে যে চারদিক থেকে জাল দিয়ে বন ঘিরে হাঁক পাড়তে পাড়তে শিকারিরা হরিণ ধরত, তার বিবরণ আছে চর্যাপদে। চারদিক থেকে ব্যাধে ঘিরে ফেলেছে, ভীতচকিত হরিণ তখন যে অবস্থায় আছে, তার বর্ণনাও খুব ঝকঝকে-
‘তিন ন চ্ছু পই হরিণ।
পিবই ন পানী,
হরিণা হরিণীর নিলয় ন জানী
হরিণ তো আর সব সময় পাওয়া যেত না। ছাগলের মাংস বেশ পাওয়া যেত। শবর বা পুলিন্দ জাতের লোকরা মাঝে মধ্যে পাহাড়ি ছাগল ধরে আনত।
বড় ভরাট ছিল তখনকার দিনের তরিতরকারির বাগানগুলো। তরতাজা হয়ে যখন ঝুলে থাকত, তাই দেখে চাষিরা পেত শান্তি। নিজের হাতের লাগানো সবজি। শীতকালে শিশির ধোয়া হয়ে যা আরও স্নিগ্ধ হয়ে উঠত। ফলমূলও ছিল অনেক রকম। প্রাচীন পুঁথিতে আমরা তাল, কলা, আখ, নারকেল, আম, কাঁঠালের বিবরণ পাই। বেল, জামরুলের কথাও আছে। আখের রস জ্বাল দিয়ে এক ধরনের গুড় তৈরি হতো। চর্যাপদের এক জায়গায় তেঁতুলের কথা পাওয়া যায়। অনেকে কাঁচা ফল থেকে আচার বানাত। বিভিন্ন পুঁথিতে তার বর্ণনা আছে। ডেফুল নামের এক রকম ফল ছিল। এ গাছের কাঁচা ফল থেকে এক রকম আঠার মতো রস পাওয়া যায়। রং তার সাদা। পাকা ফল ফালি ফালি করে চিরে রাখতে হতো। সেই ফলের টুকরো গরম পানিতে কিছু সময় ডুবিয়ে রাখলেই এক রকম জমাট রস বের হতো। সেই জমাট রসের মাঝে চাল সেদ্ধ করে তৈরি হতো চাটনি। গাঁয়ের লোকজন চালতা ফল তরকারি হিসেবে ব্যবহার করত। কতবেল ছিল হাতির প্রিয় খাদ্য।
পুকুর, খাল-বিলের ধারে কলমি আর হেলেঞ্চা শাক জন্মাত। জলপিপির দল সেই দামের ওপর দিয়ে তিরতির করে হেঁটে যেত। তরিতরকারির রান্না ছাড়াও তৈরি হতো নানা রকম পিঠা। গুড়, চালের গুঁড়া, তেল-ঘি, দুধ মিশিয়ে এসব পিঠা তৈরি হতো। অনেক সময় বিভিন্ন ফলের রস অর্থাত্ তাল, কলা, নারিকেল কিংবা খেজুরের রসের মাঝে এসব পিঠা ভিজিয়ে রাখা হতো। 
কোজাগরী পূর্ণিমার রাতে চিড়া আর নারিকেলের তৈরি নানা রকমের সন্দেশ খেতে দেওয়া হতো আত্মীয়-বন্ধুদের। উড়কি ধানের মুড়কি আর বিন্নি ধানের খইও ছিল। মুড়ি, মোয়া, বাতাসাও ছিল। দুধ থেকে তৈরি হতো ক্ষীর, পায়েস, মিষ্টি। সে আমলের কিছু মিষ্টান্নের নাম বলছি। খাঁড়, কদমা, ফেনি, দুধশাকব, খাজা, ক্ষীরসা; নাড়ু আর ঘি, দই, গুড় ও আদা মিশিয়ে তৈরি হতো শিখারিনী।
মাটি দিয়ে কুমোররা নানা ধরনের পাত্র বানিয়ে দিত। যেমন জাড়ি, তেলাবনী ভাণ্ডী। নৌকাতে ভরে সেসব পাত্র এক গঞ্জ থেকে আরেক গঞ্জে যেত। লাল মাটির পাতিল, কালো মাটির কলস মুলিবাঁশের দরমার ভেতর সাজিয়ে রাখা হতো। দিনরাত ভেসে চলত নৌকা।
শুধু খাওয়া-দাওয়া করলেই তো আর চলে না, মনের আনন্দের জন্য গান বাজনা চাই। কত না বাদ্যযন্ত্র। পিনাক, ভরী, ভেউর, কাড়া, কবিলাস, দুমদুমি, ভাঙ্গরি। কত রকমের শব্দ।
প্রাচীনকালের বাঙালির খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে মিশে আছে ইতিহাসের পথপরিক্রমার নানা যোগসূত্র।
লেখক : শিশুসাহিত্যিক

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন