সাজজাদ হোসাইন খান
বদনসিব কবি নজরুলের। সংকট-সমস্যা থেকে উতরাতে পারেনি অদ্যাবধি। কবির জীবিতকালে বা সুস্থ থাকার সময় যেমন তার রচিত গান দুষ্টচক্রের কুনজর থেকে রক্ষা পায়নি, হাতসাফাইয়ের কবলে পড়েছে অহরহ, এই প্রক্রিয়াটি বর্তমানেও চলমান। মাঝে মধ্যেই দেখা যায় নজরুলের গান অন্যের নামে উপস্থাপন করা হচ্ছে। দ্বিজেন্দ্রলালতো আছেই, ইদানীং যুক্ত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ। এর কোনটা তথ্য বিভ্রাট কোনটা আবার সজ্ঞানে। এমনি একটি বাক্যের নমুনা এরকম ‘বাংলা বর্ষবরণের সূচনালগ্নে যেন বসনে-ভূষণে, আহারে-বিহারে এবং সংস্কৃতির অন্তর্গত রূপের উদ্ভাসনে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘একি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী জননী' হয়ে ওঠে আমাদের সোনার বাংলা।' বাক্যটিতে উচ্ছবাস আছে আবেগ আছে নেই কেবল সত্যের সুষমা। মূল তথ্য হলো এই চমৎকার গানটি কাজী নজরুল ইসলামের একটি বিখ্যাত কোরাস গান। এইচ এম ভিতে গীত হয়েছিল চৌত্রিশ সালের দিকে সমবেত কণ্ঠে ধীরেন দাসের নেতৃত্বে। নজরুলের ‘‘গানের মালা’’ গ্রন্থের সাঁইত্রিশ নম্বর গান এটি। গানের ওপরে সুরের উল্লেখ আছে বেহাগ মিশ্র-কাওয়ালী। এতো কিছুর পরও গানটি রবীন্দ্র সঙ্গীতের ঝুলিতে ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে। রবীন্দ্র সঙ্গীত হিসাবে গাওয়াও হয় নজরুলের এই গানটি। আজকাল একশ্রেণীর প্রগতিবাদীর ধারণা জন্মেছে ‘কানু' ছাড়া গীত হতে পারে না। তাই যা কিছু ভাল যা কিছু সুন্দর এর সবকটাই এনে জমা করে রবীন্দ্রনাথের থলিতে। কদিন আগেও মোবাইলের রিংটোনওয়ালারা নজরুলের একটি বিখ্যাত গান ‘মোরে ভালবাসায় ভুলিও না/পাওয়ার আশায় ভুলিও গানটি রবীন্দ্র সঙ্গীতের তালিকায় ঢুকিয়ে রেখেছিল। এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বর্তমানে রিংটোনের বিজ্ঞাপন থেকে ‘নজরুল সঙ্গীত', ‘রবীন্দ্র সঙ্গীত' এর তালিকা উধাও। এই সচেতনতার জন্য তাদেরকে সাধুবাদ। কিন্তু দৈনিক ইত্তেফাকের বিশেষ সংখ্যায় (১৭ বৈশাখ ১৪১৯) ‘গীতনাট্যের হাজার বছর' শিরোনামের লেখাটিতে রবীন্দ্রপ্রেমের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে আফসার আহমদ যে কৌশলে নজরুলের গান ছিনতাই করলেন প্রায় এক মাস গত হবার পরও ছিনতাইকৃত এ গানটি ফেরত পাওয়া গেল না। না আফসার আহমদ- না পত্রিকা কর্তৃপক্ষ কোন সংশোধনীর দিকে এগোলেন। রবীন্দ্র সংগীতের বেলায় এমন ঘটলে একশ্রেণীর রবীন্দ্রভক্ত সমস্বরে হুক্কাহুয়া শুরু করতেন। পত্রিকা কর্তৃপক্ষ ‘ভুল' স্বীকার, ‘ক্ষমা' প্রার্থী ইত্যাকার শব্দাবলী ছাপিয়ে দিতেন ইতোমধ্যে। বিষয়টির সাথে নজরুলের নাম যুক্ত বোধ হয় এজন্যে সবাই নীরব। নজরুল অভিভাবকহীন হয়তো এজন্যেও। নজরুলের ব্যাপারে এ জাতীয় কুম্ভিলক আচরণ তাই তেমনটা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায় না। যেমন উল্লেখিত সঙ্গীতটির ব্যাপারে দু'একজন নজরুল ভক্ত প্রতিবিধান চেয়ে আর্জি পেশ করলেও চন্দ্ররেণুর সাথে যারা যুক্ত তারা নির্বিকার। নজরুল নামের প্রতিষ্ঠানগুলোর কি এ ব্যাপারে কোনই করণীয় নেই?
অবশ্য নজরুলের গান লোপাটের শুরুটা নজরুলের জীবিতকাল থেকেই। একটি দুটি গান নয় গানের একটি পুরো খাতাই গায়েব করে দিয়েছিল। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েও সে খাতা আর ফেরত পাওয়া যায়নি। দু'একখানা শব্দ পালটে দিয়ে নজরুলের গান নিজের নামে চালিয়ে দেয়ার ব্যাপারটি ছিল তখন ওপেন সিক্রেট। পুরো-গানই মেরে দেবার ইতিহাসও আছে অনেক। কমল দাস গুপ্তকে উদ্ধৃত করে আববাসউদ্দিন তার বইয়ে সে তথ্যের উল্লেখ করেছেন। তৎকালীন অনেকেই বিষয়টি ফাঁস করেছেন তাদের লেখায়-বক্তব্যে। সে সময় এ ধরনের কুম্ভিলক বিদ্যায় চৌকস ছিলেন প্রণব রায়। এ নামটিই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে উচ্চারণ করেছেন অনেকেই। গানের দু'একটি শব্দ পাল্টে দিয়ে নিজের নামে রেকর্ড করার প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে তখন। তাছাড়া সে সময় গীতিকার সুরকারের নাম ছাপা হতো না রেকর্ডে প্রায়শই। এই সুযোগটিই গ্রহণ করেছে তারা। শিল্পী তালাত মাহমুদের গাওয়া ‘আধো রাতে যদি ঘুম ভেঙে যায়' গানটি প্রণবের নামে প্রচারিত। নজরুলেরও একটি গান আছে প্রথম বাক্যটি হুবহু এক, যে গানের কোন রেকর্ড পাওয়া যায়নি, হস্তলিপি রয়েছে। এমন নজির একটি নয়, বহু। হিন্দি ছবি ‘চৌরঙ্গী'র সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন নজরুল। কাগজপত্রেও তা উৎকলিত আছে। আদি রেকর্ডেও লেখা আছে ‘কম্পোজ এন্ড টুইন কাজী নজরুল।' অবাক করার বিষয় বর্তমানের রেকর্ডে নজরুলের নাম মুছে দিয়ে লেখা হয়েছে ইন্দ্রানী রায়। এমন কুম্ভিলক ব্যাপার-স্যাপার থেমে নেই। যেমন ‘একি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী জননী' গানটির সাথে করা হয়েছে।
বিখ্যাত গায়ক সায়গলের কণ্ঠে গীত ‘গোলাপ হয়ে উঠুক ফুটে তোমার রাঙা কপোলখানি' এই গানটির গজল ঢঙের সুর এবং বাণী বার বার নজরুলকেই উপস্থিত করে। নজরুল গবেষক কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ এই বিষয়টির প্রতি আলোকপাত করেছিলেন। অবশ্য দু' একজন বলছেন গানটি নাকি বানী কুমার কর্তৃক রচিত। তারা কাগজপত্রে এমন সন্ধান পেয়েছেন। তৎকালে নজরুল ব্যতীত অন্য যেসব সুরকার-গীতিকার ছিলেন সে তালিকায় বানী কুমার অনেকটাই ম্লান। ‘গোলাপ হয়ে উঠুক ফোটে'র মতো এমন ভাব সমৃদ্ধ ক্লাসিকেল সুরের গান রচনার পরপরই বানী কুমার বানীহীন হয়ে যাবেন তাতো হতে পারে না। বানী কুমারের আর তেমন কোন উল্লেখযোগ্য গানের কলি উচ্চারিত হয় না যেমনটা প্রণব রায়-অজয় রায়দের বেলায় শোনা যায়। পোস্টারে নাম ছাপা হলেই যে তা সঠিক হবে এমনতো নাও হতে পারে। পরবর্তী সময় সত্য সন্ধানীরা এসব ব্যাপারে বহুদূর অগ্রসর হয়েছেন, মূলের কাছে পৌঁছেছেনও কেউ কেউ। নজরুলের একটি হস্তলিপি পাওয়া গেছে যাতে লেখা রয়েছে ‘টু সংগম ফর সায়গল' নিচে লেখা আছে আর্জেন্ট। সায়গলের জন্য এ গান দু'টি তাহলে কোথায় গেল? জানা যায়, দেবদাস সিনেমার জন্য নজরুল দু'টি গান রচনা করেছিলেন, সায়গলের গজল ঢঙে গাওয়া গানটি এর একটি। পোস্টারে লেখা থাকলেই যে তা সবসময় সত্য তথ্যের সন্ধান দেয় না এর আরেকটি হলো বিদ্যাপতি সিনেমা। নজরুল এ ছবির চিত্রনাট্য লিখলেও পর্দায় নাম গেছে দেবকী বসুর। সঙ্গীত পরিচালকও ছিলেন নজরুল, কিন্তু টাইটেলে নাম প্রদর্শিত হয়েছে রাইচাঁদ বড়াল। পরবর্তী সময় রাইচাঁদ বড়াল এক সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছেন, বিদ্যাপতি সিনেমায় সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে তার নাম প্রদর্শিত হলেও আসলে সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। তাই বানী কুমারের নামটি যে এমন বিভ্রান্তিতে আটকা পড়েনি তা কতটা হলফ করে বলা যায়! কথায় আছে ‘লেজ দেখে যায় চেনা' ঠিক তেমনি গানের বেলায়ও সুর এবং বাণীর কায়দা-কৌশল দেখে আন্দাজ করা যায় রচকের চেহারা। ছাপার অক্ষর অনেক সময় গবেষকদের প্রতারিত করে বিভ্রান্তিতে ফেলে। এই যেমন একশ' বছর পরে যদি কোন গবেষক ছাপার অক্ষরে দেখেন ‘কি অপরূপ রূপে' গানটি রচনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ তখন দশাটা কি হবে বেচারা গবেষকের। তাই পোস্টার দেখেই রোস্টার ঠিক করা কোনক্রমেই সুবুদ্ধির পরিচায়ক নয়। সঙ্গীতে নজরুল তুলনা রহিত এমন ঘোষণা অসংকোচেই করা যায়। তাছাড়া নজরুলের সঙ্গীত সংখ্যা বিপুল বিধায় হাত বদলের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে প্রচুর।
ইদানীং পঞ্চ ‘কবির গান' এই শিরোনামে চ্যানেলগুলো অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। পঞ্চ কবির তালিকায় রাখা হয় রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, ডিএল রায়, রজনীকান্ত এবং অতুল প্রসাদকে। নজরুল-রবীন্দ্র ছাড়া বাকি তিনজনের কবি খ্যাতি বলতে তো তেমন কিছুই নেই। তারপরও তারা কবি। ডিএল রায় নাট্যকাররূপেই সমধিক পরিচিত। বাকি দু'জন কবিতা লিখেছেন বটে তবে তেমন উল্লেখের দাবি রাখে না। তবে তারা তিনজনই গীতিকার হিসাবে পরিচিতি পেয়েছেন। কিছু জনপ্রিয় গানের রচকও তারা। তবে সুর-বাণীর ধারায় এরা তিনজনই রবীন্দ্রানুসারী, একমাত্র ব্যতিক্রম নজরুল, নিজস্বতায় উজ্জ্বল। এই কবি তথা সঙ্গীতজ্ঞদের তালিকা থেকে লালন এবং হাছন রাজাকে তফাতে রাখার কারণ? তাদের গানও তো জনপ্রিয়তায় রজনী-অতুল থেকে কোন অংশে নিম্নে নয়। বরং কয়েক ডিগ্রি উপরেই এদের অবস্থান। সুর এবং বাণীতেও লালন-হাছন দ্বীপ্তিময়, প্রাণস্পর্শী। গীত রচনার সংখ্যার দিক দিয়েও তারা তালিকার উপরের সারিতে। রবীন্দ্রনাথের গানের সংখ্যা ২২২০, নজরুলের ৩৯০৬, ডিএল রায় ৬০৫, অতুল প্রসাদ ২০৭, রজনীকান্ত ২৯১, লালন ৮০০, হাছন রাজা ৩৪৫টি। এ জন্যে পঞ্চ কবির পরিবর্তে সপ্ত কবি শিরোনামটি বোধহয় অধিকতর যুক্তিযুক্ত। কারণ নজরুল-রবীন্দ্রনাথের পাশে অন্য তিনজনকে কবি অভিধায় চিহ্নিত করা এক ধরনের ধৃষ্টতারই নামান্তর, যদি লালন-হাছনকে এ তালিকায় না রাখা হয়।
নজরুলের গান অন্যদের নামে যাচ্ছে অবিরল। কিন্তু এ ব্যাপারে নজরুলের অভিভাবকত্য নিয়ে যেসব প্রতিষ্ঠান তাদের বাবরী চুল উড়ান তাদের অসহায়ত্ব এবং নীরবতা নজরুল ভক্তদের পীড়িত করে। এ পীড়া উপসমে এদের অনুপস্থিতি বিভ্রাটে ফেলে নজরুলগতপ্রাণ ভক্তদের সাথে সাথে স্বয়ং নজরুলকেও।
একি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লি-জননী।
ফুলে ও ফসলে কাদা মাটি জলে ঝলমল করে লাবণি\
রৌদ্রতপ্ত বৈশাখে তুমি চাতকের সাথে চাহ জল,
আম কাঁঠালের মধুর গন্ধে জ্যৈষ্ঠে মাতাও তরুতল।
ঝঞ্ঝার সাথে প্রান্তরে মাঠে কভু খেলো লয়ে অশনি\
কেতকী কদম যূথিকা কুসুমে বর্ষায় গাঁথো মালিকা,
পথে অবিরল ছিটাইয়া জল খেলো চঞ্চলা বালিকা।
তড়াগে পুকুরে থইথই করে শ্যামল শোভার নবনী\
শাপলা শালুকে সাজাইয়া সাজি শরতে শিশিরে নাহিয়া,
শিউলি-ছোপানো শাড়ি পরে ফের আগমনী-গীতি গাহিয়া।
অঘ্রাণে মা গো আমন ধানের সুঘ্রাণে ভরে অবনী\
শীতের শূন্য মাঠে তুমি ফেরো উদাসী বাউল সাথে মা,
ভাটিয়ালি গাও মাঝিদের সাথে, কীর্তন শোনো রাতে মা,
ফাল্গুনে রাঙা ফুলের আবিরে রাঙাও নিখিল ধরণী\
এ গানটি নজরুলের এমন একটি গান যে গানের আদলে সমগ্র বাংলাদেশ জেগে উঠে, তা এখন চন্দ্ররেণুর কবলে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন