সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেই চলেছে। অপচয় হচ্ছে মেধার। কবে কে সড়ক দুর্ঘটনার বলি হবে, তা কেউ জানে না। তাই কেউ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলে তাকে আর কে মনে রাখে? হ্যাপী নামের মেয়েটিকেও কি কেউ মনে রেখেছে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলেন শাম্মী আক্তার হ্যাপী। থাকতেন রোকেয়া হলের বর্ধিত ভবনের ৮৫ নম্বর কক্ষে। বাড়ি পঞ্চগড় শহরের ইসলামবাগ মহল্লায়। ২০০৫ সালের ২৮ মে সকালে ঢাকার শাহবাগে সহপাঠীদের সঙ্গে হ্যাপীও গাড়ি থেকে নেমে পড়েন রোকেয়া হলে ফেরার জন্য। সিগন্যাল পড়ার পর হ্যাপীও তাঁদের পিছুপিছু ব্যস্ত রাস্তাটি পার হচ্ছিলেন। কিন্তু সিগন্যাল উপেক্ষা করে একটি বাস মুহূর্তে ওই সড়কে দানবের মতো তেড়ে আসে। মেধাবী প্রাণটি চোখের পলকে নিঃশেষ হয়ে যায়।
হ্যাপীর স্বপ্ন ছিল ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি পাস করে দেশের বিখ্যাত মনোরোগ চিকিৎসক হবেন। সে স্বপ্ন পূরণ হতে দেয়নি ঘাতক ওই বাসটি। সদা হাস্যোজ্জ্বল হ্যাপী সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেছেন।
মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগে বাবার সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলেছিলেন হ্যাপী। তাঁর শেষ কথাটি ছিল, ‘বাবা, আমি ভালো আছি’। এদিন সকালেও বাসায় বাবার সঙ্গে নানা বিষয়ে হ্যাপীর কথা হয়েছিল। কেউ বিশ্বাসই করতে পারেনি কিছুক্ষণ পরে হ্যাপী না-ফেরার জগতে চলে যাবে। তবু এটাই ছিল রূঢ় বাস্তবতা।
পঞ্চগড়ে হ্যাপীদের বাড়িতে শোক আছে, কিন্তু জীবন তো প্রবহমান, কারও জন্য থেমে থাকে না। হ্যাপীর বাবা-মাও সন্তানহারা জীবনের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। তবে তাঁদের মনে এখনো বেঁচে আছে সন্তান।
বাবা মোজাম্মেল হক চৌধুরী (মুকু চৌধুরী) হ্যাপীর প্রসঙ্গ তুলতেই চোখ মুছে বলেন, ‘আমার কাছে ও মরেনি, যত দিন বেঁচে আছি তার কথা ভুলতে পারব না। আমার মেধাবী মেয়েটা বেঁচে থাকলে প্রতিষ্ঠিত হতো। তার স্বপ্ন ছিল ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি পাস করে দেশের সেরা মনোরোগ চিকিৎসক হওয়ার। এদিনে তার সে স্বপ্ন পূরণ হতো। ঘাতক চালক তার সে স্বপ্ন পূরণ করতে দিল না। ঘাতক চালকের কোনো বিচার হয়নি। বিচার হয় না বলেই সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধ হচ্ছে না। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ঘটনায় ব্যাপক আন্দোলন হয়েছিল। কিন্তু কই, সড়ক দুর্ঘটনা তো বন্ধ হয়নি, বরং বেড়েছে। সাংবাদিক, শিল্পী, সাহিত্যিক, শিক্ষার্থী প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সরকার ব্যর্থ।’ কথা বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে পড়েন মুকু চৌধুরী। তারপর আবার শান্ত হয়ে বিড়বিড় করে বলেন, ‘হ্যাপী আমাকে নিয়ে, সংসার নিয়ে খুবই ভাবত। আমার চাকরি থেকে অবসর নেওয়া, বাইপাস সার্জারি করার পর আরও বেশি চিন্তা করত।’
হ্যাপীর মা আলেয়া বেগম বলেন, ‘হ্যাপীকে ভুলতে পারি না। হ্যাপীর কথা মনে পড়লে ছবি দেখি আর কাঁদি। তাই তো প্রতিটি ঘরে হ্যাপীর ছবি বাঁধাই করে রেখেছি। এখনো মনে হয় আমার গলা ধরে পাশে শুয়ে আছে। বেঁচে থাকলে এত দিনে তার চাকরি হতো, বিয়েশাদি হতো। এটা-সেটা নিয়ে আসত। যেমন বড় মেয়েটা নিয়ে আসে। এখনো ওর সব স্মৃতি মনে পড়ে। বাড়িতে এলে আশপাশের বাচ্চাদের খুব আদর করত। পাশের বাড়ির ছেলেটাকে নিয়ে এসে আদর করত, গোসল করিয়ে দিত। বড় ভাই বকুলের ছেলে হয়েছে। ও বেঁচে থাকলে ছেলেটাকে খুবই আদর করত।’ বলেই কেঁদে ফেলেন। আরও বলেন, ‘হ্যাপী শাড়ি আর গয়না পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকত আর আমাকে দেখতে বলত। সাত বছর হচ্ছে, এখনো তার কথা মন থেকে সরাতে পারছি না।’
বকুল ছিলেন তিন ভাইবোনের মধ্যে সবার বড়। আর হ্যাপী সবার ছোট। এ দুজনের সম্পর্কটাও ছিল অনেকটা বন্ধুর মতো, গাঢ়-গভীর। হ্যাপীর চলে যাওয়ার পর বন্ধুবৎসল ভাইটির সময় যেন কিছুতেই কাটে না। এ জন্য বোধহয় প্রায় প্রতিদিনই তাঁকে দেখা যায় কেন্দ্রীয় কবরস্থান মাঠে হ্যাপীর কবরের পাশে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকতে। নীরবে চোখের জলও ফেলেন। হ্যাপীর বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে বলেন, ‘যেন বুকের ভেতর কেউ চেপে ধরেছে। ভালো করে নিঃশ্বাস নিতে পারি না। কিছুতেই মেনে নিতে পারি না হ্যাপী নেই।’
হ্যাপীর সপ্তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে পঞ্চগড়ে তাঁদের ইসলামবাগের বাসায় আজ সোমবার কোরআনখানি, দোয়া মাহফিল, এতিমদের মাঝে খাবার বিতরণের আয়োজন করা হয়েছে।
আমরা একজন হ্যাপীর পরিবারের কথা বললাম। এ রকম কত পরিবারের না-বলা কথা ঘুরে বেড়াচ্ছে আকাশে-বাতাসে। সড়ক দুর্ঘটনা যাঁদের সরিয়ে দিয়েছে পৃথিবী থেকে, তাঁদের স্মৃতি দিনে দিনে ফিকে হয়ে আসে। তাঁরা বেঁচে থাকেন শুধু স্বজনদের গভীরে।
শহীদুল ইসলাম
পঞ্চগড় প্রতিনিধি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলেন শাম্মী আক্তার হ্যাপী। থাকতেন রোকেয়া হলের বর্ধিত ভবনের ৮৫ নম্বর কক্ষে। বাড়ি পঞ্চগড় শহরের ইসলামবাগ মহল্লায়। ২০০৫ সালের ২৮ মে সকালে ঢাকার শাহবাগে সহপাঠীদের সঙ্গে হ্যাপীও গাড়ি থেকে নেমে পড়েন রোকেয়া হলে ফেরার জন্য। সিগন্যাল পড়ার পর হ্যাপীও তাঁদের পিছুপিছু ব্যস্ত রাস্তাটি পার হচ্ছিলেন। কিন্তু সিগন্যাল উপেক্ষা করে একটি বাস মুহূর্তে ওই সড়কে দানবের মতো তেড়ে আসে। মেধাবী প্রাণটি চোখের পলকে নিঃশেষ হয়ে যায়।
হ্যাপীর স্বপ্ন ছিল ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি পাস করে দেশের বিখ্যাত মনোরোগ চিকিৎসক হবেন। সে স্বপ্ন পূরণ হতে দেয়নি ঘাতক ওই বাসটি। সদা হাস্যোজ্জ্বল হ্যাপী সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেছেন।
মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগে বাবার সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলেছিলেন হ্যাপী। তাঁর শেষ কথাটি ছিল, ‘বাবা, আমি ভালো আছি’। এদিন সকালেও বাসায় বাবার সঙ্গে নানা বিষয়ে হ্যাপীর কথা হয়েছিল। কেউ বিশ্বাসই করতে পারেনি কিছুক্ষণ পরে হ্যাপী না-ফেরার জগতে চলে যাবে। তবু এটাই ছিল রূঢ় বাস্তবতা।
পঞ্চগড়ে হ্যাপীদের বাড়িতে শোক আছে, কিন্তু জীবন তো প্রবহমান, কারও জন্য থেমে থাকে না। হ্যাপীর বাবা-মাও সন্তানহারা জীবনের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। তবে তাঁদের মনে এখনো বেঁচে আছে সন্তান।
বাবা মোজাম্মেল হক চৌধুরী (মুকু চৌধুরী) হ্যাপীর প্রসঙ্গ তুলতেই চোখ মুছে বলেন, ‘আমার কাছে ও মরেনি, যত দিন বেঁচে আছি তার কথা ভুলতে পারব না। আমার মেধাবী মেয়েটা বেঁচে থাকলে প্রতিষ্ঠিত হতো। তার স্বপ্ন ছিল ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি পাস করে দেশের সেরা মনোরোগ চিকিৎসক হওয়ার। এদিনে তার সে স্বপ্ন পূরণ হতো। ঘাতক চালক তার সে স্বপ্ন পূরণ করতে দিল না। ঘাতক চালকের কোনো বিচার হয়নি। বিচার হয় না বলেই সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধ হচ্ছে না। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ঘটনায় ব্যাপক আন্দোলন হয়েছিল। কিন্তু কই, সড়ক দুর্ঘটনা তো বন্ধ হয়নি, বরং বেড়েছে। সাংবাদিক, শিল্পী, সাহিত্যিক, শিক্ষার্থী প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সরকার ব্যর্থ।’ কথা বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে পড়েন মুকু চৌধুরী। তারপর আবার শান্ত হয়ে বিড়বিড় করে বলেন, ‘হ্যাপী আমাকে নিয়ে, সংসার নিয়ে খুবই ভাবত। আমার চাকরি থেকে অবসর নেওয়া, বাইপাস সার্জারি করার পর আরও বেশি চিন্তা করত।’
হ্যাপীর মা আলেয়া বেগম বলেন, ‘হ্যাপীকে ভুলতে পারি না। হ্যাপীর কথা মনে পড়লে ছবি দেখি আর কাঁদি। তাই তো প্রতিটি ঘরে হ্যাপীর ছবি বাঁধাই করে রেখেছি। এখনো মনে হয় আমার গলা ধরে পাশে শুয়ে আছে। বেঁচে থাকলে এত দিনে তার চাকরি হতো, বিয়েশাদি হতো। এটা-সেটা নিয়ে আসত। যেমন বড় মেয়েটা নিয়ে আসে। এখনো ওর সব স্মৃতি মনে পড়ে। বাড়িতে এলে আশপাশের বাচ্চাদের খুব আদর করত। পাশের বাড়ির ছেলেটাকে নিয়ে এসে আদর করত, গোসল করিয়ে দিত। বড় ভাই বকুলের ছেলে হয়েছে। ও বেঁচে থাকলে ছেলেটাকে খুবই আদর করত।’ বলেই কেঁদে ফেলেন। আরও বলেন, ‘হ্যাপী শাড়ি আর গয়না পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকত আর আমাকে দেখতে বলত। সাত বছর হচ্ছে, এখনো তার কথা মন থেকে সরাতে পারছি না।’
বকুল ছিলেন তিন ভাইবোনের মধ্যে সবার বড়। আর হ্যাপী সবার ছোট। এ দুজনের সম্পর্কটাও ছিল অনেকটা বন্ধুর মতো, গাঢ়-গভীর। হ্যাপীর চলে যাওয়ার পর বন্ধুবৎসল ভাইটির সময় যেন কিছুতেই কাটে না। এ জন্য বোধহয় প্রায় প্রতিদিনই তাঁকে দেখা যায় কেন্দ্রীয় কবরস্থান মাঠে হ্যাপীর কবরের পাশে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকতে। নীরবে চোখের জলও ফেলেন। হ্যাপীর বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে বলেন, ‘যেন বুকের ভেতর কেউ চেপে ধরেছে। ভালো করে নিঃশ্বাস নিতে পারি না। কিছুতেই মেনে নিতে পারি না হ্যাপী নেই।’
হ্যাপীর সপ্তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে পঞ্চগড়ে তাঁদের ইসলামবাগের বাসায় আজ সোমবার কোরআনখানি, দোয়া মাহফিল, এতিমদের মাঝে খাবার বিতরণের আয়োজন করা হয়েছে।
আমরা একজন হ্যাপীর পরিবারের কথা বললাম। এ রকম কত পরিবারের না-বলা কথা ঘুরে বেড়াচ্ছে আকাশে-বাতাসে। সড়ক দুর্ঘটনা যাঁদের সরিয়ে দিয়েছে পৃথিবী থেকে, তাঁদের স্মৃতি দিনে দিনে ফিকে হয়ে আসে। তাঁরা বেঁচে থাকেন শুধু স্বজনদের গভীরে।
শহীদুল ইসলাম
পঞ্চগড় প্রতিনিধি
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন