॥ শতদল বড়–য়া ॥
আজ শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা তিথি। বুদ্ধ পূর্ণিমা নামে পরিচিত এই পুণ্যতিথি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের জন্য এক অবিস্মরণীয় দিন। এ তিথিকে ঘিরে রয়েছে তথাগত বুদ্ধের তিনটি স্মরণীয় ঘটনা। ত্রিস্মৃতিবিজড়িত এ তিথির তাৎপর্য অত্যন্ত বিশাল।
সব পূর্ণিমা তিথি কোনো না কোনো কারণে গুরুত্ব বহন করে। আজকের তিথির সাথে রয়েছে অন্য তিথিগুলোর বিস্তর ফারাক। বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বৈশাখী পূর্ণিমার ঘটনাবহুল দিক নিয়ে সারা দিন থাকবে উৎসবে মাতোয়ারা। আজ সরকারি ছুটির দিন। প্রতিটি বৌদ্ধ বিহার কমিটি যথাযোগ্য মর্যাদায় বৈশাখী পূর্ণিমা পালনের জন্য পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে প্রায় সপ্তাহখানেক আগে থেকে কাজ শুরু করে দিয়েছে।
ত্রিস্মৃতিবিজড়িত বৈশাখী পূর্ণিমায় আজ আমরা নানাভাবে পুলকিত। জাতির ক্রান্তিকালে বুদ্ধ নির্দেশিত বাণীগুলো বড়ই অপরিহার্য বিষয়। জীবনসংগ্রামে আমরা নানাভাবে অত্যন্ত অসহায়। মানবসৃষ্ট প্রতিকূলতা পেরিয়ে আসতে পারাই হলো একজন মানবের আসল বৈশিষ্ট্য।
গভীর রাত, পুণ্যবতী মায়াদেবী রাজপালঙ্কে অঘোর নিদ্রায় মগ্ন। ঘুমন্ত অবস্থায় তিনি স্বপ্ন দেখলেন, সে দিন ছিল কপিলাবস্তু নগরীতে আষাঢ়ী পূর্ণিমার উৎসব। রানী সারা দিন উৎসবে মেতে কান্ত শরীরে শেষ রাতে স্বপ্নে দেখলেনÑ চার দিক থেকে চার দিকপাল এসে তাকে শয্যাসহ তুলে নিলেন। চাঁদের জ্যোৎস্না ছড়ানো রমণীয় এক হ্রদে রানী দেখলেন সহস্রদল পদ্ম। লাবণ্য আর লালিমায় রক্তিম। এক সাদা হস্তী সেই হ্রদে জলকেলি করছে। হস্তীটি মায়াদেবীর আগমনে সামনে এগিয়ে এলো। একটি বর্ণময় পদ্ম মায়াদেবীর ডান কুক্ষিতে প্রবেশ করিয়ে দিলো হস্তীটি। এতে রানীর দেহমনে এক অপূর্ব শিহরণ জাগ্রত হলো।
মায়াদেবীর ঘুম ভেঙে গেল। তিনি পালঙ্কে উঠে বসলেন। শাক্যরাজ্যের প্রাণপুুরুষ রাজা শুদ্ধোধনের রাজমহিষী তিনি। একি আমি দেখলাম। কেন দেখলাম। পরদিন রানী রাজা শুদ্ধোধনের কাছে স্বপ্নের আদিবৃত্তান্ত শোনালেন। রাজা কালবিলম্ব না করে জ্যোতিষীদের ডেকে পাঠালেন এবং জ্যোতিষীদের কাছ থেকে রানীর স্বপ্নের বিস্তারিত ব্যাখ্যা চাইলেন।
জ্যোতিষীরা বললেনÑ মহারাজ, রানী মায়াদেবীর পুত্রসন্তান হবে। এই পুত্র মহাতেজস্বী ও যশস্বী মহাপুরুষ হবেন। শান্ত, গভীর, জগতে দুর্লভ, জীবের দুঃখহারী ও মহাজ্ঞানী পুত্রের জনক হবেন আপনি। তবে এখানে নৈরাশ্য এবং বেদনার সংবাদও জড়িয়ে রয়েছে। আছে কিছু বিয়োগ-বিচ্ছেদের অশনি সঙ্কেত।
রাজা শুদ্ধোধন অতলায়িত বিস্ময়ে তাকিয়ে জ্যোতিষীদের নির্দেশ করলেন ঘটনা খুলে বলার জন্য। তারা বললেন, পুত্রসন্তান লাভের সাত দিন পর মায়াদেবীর অকালমৃত্যু ঘটবে। এ মৃত্যু অমোঘ, অনিবার্য। এক দিকে রাজপ্রাসাদে মহাপুরুষের আগমন সংবাদ অন্য দিকে মায়াদেবীর আসন্ন মৃত্যু সংবাদে, রাজা শুদ্ধোধন বিচলিত। আসন্ন প্রসবা মায়াদেবীর রূপ যেন বাঁধ মানছে না। যেন লাবণ্য বারিধি উদ্বেলিত হয়ে উঠেছে। ভূকৈলাসের রাজা আসবেন এ মর্ত্যভূমিতে। জ্যোতি রূপোজ্জ্বলা। প্রাণময়ী পরামার্থা। যুগে যুগে মহাপুরুষেরা এভাবেই পৃথিবীতে আগমন করেছিলেন।
যথাসময়ে মায়াদেবী পিত্রালয় দেবদহনগরে যাওয়ার জন্য রাজা শুদ্ধোধনের কাছে অনুমতি প্রার্থনা করলেন। মায়াদেবী দেবদহ নগরের রাজা সুত্রবুদ্ধের জ্যেষ্ঠ কন্যা। এলো বৈশাখী পূর্ণিমা তিথি। ইতঃপূর্বে রাজা রানীর বাপের বাড়ি যাওয়ার সব ব্যবস্থা সুসম্পন্ন করে রেখেছিলেন।
নির্দিষ্ট দিনে সন্তানসম্ভাবা মায়াদেবী সখীদলসহ রথে চড়ে বাপের বাড়ির পথে যাত্রা শুরু করলেন। মুখে তার অপরূপ লাবণ্য, বেদনা, করুণা, ক্ষমা আর ধৃতির স্নিগ্ধতা। তিনি হবেন আলোকসুন্দর দিব্য পুরুষের জন্মদাত্রী। সৃষ্টির পূর্ণতা ও অনুপম সৌন্দর্যে সমুজ্জ্বল। বাপের বাড়ি যাওয়ার পথে লুম্বিনী কাননে পৌঁছামাত্রই মায়াদেবীর প্রসববেদনা শুরু হলো। এক পদ্ম-পলাশ-লোচন ব্রহ্মযোগযুক্ত আত্মভোলা শিশু জগতের ভাবী বুদ্ধের জন্ম হলো। লুম্বিনী উদ্যান হয়ে উঠল সৃষ্টির উৎসারিত আলোকসমুদ্র। পূর্ণতার পরমতম আকর্ষণ। মায়াদেবী উদাসীন অথচ আনন্দময়ী, জগজ্জননী জ্যোতির্ময়ী। মহাসমারোহে শোভাযাত্রা সহকারে মাতা ও তেজস্বী নবজাতককে লুম্বিনী কানন থেকে কপিলাবস্তু নগরের রাজাপ্রাসাদে ফিরিয়ে আনা হলো। এই দিনে গয়ার বোধিবৃক্ষ, রাহুলমাতা গোপাদেবী, চার নিধিকুম্ভ, চার মঙ্গল হস্তী, সারথি ছন্দক এবং অমাত্যপুত্র উদায়ীও জন্মগ্রহণ করেন। মহাপুরুষ গৌতমের সাথে তারা প্রত্যেকে বিশেষভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। সেই শুভদিনটি ছিল আজকের বৈশাখী পূর্ণিমা তিথি।
দিব্যজ্ঞানস্বরূপ সাধনা সম্ভুত জ্যোতির্ময় পুরুষের জন্মদানের সাত দিন পর মায়াদেবীর
অকালমৃত্যু ঘটে। মায়াদেবীর মৃত্যুতে রাজ্যময় শোক নেমে এলো। রাজপ্রাসাদের অঙ্গন-প্রাঙ্গণের সব বাতি নিভিয়ে রাখা হলো। কুমারী কন্যাদের বিঙ্কিনীর রোল আর বাজল না। কাদম্বিনীরূপী কবরী আর খোলা হলো না। মৃদু মলয়ে বসন্ত সখার সুরধ্বনি বন্ধ হয়ে গেল। শাক্যরাজ্যব্যাপী শোক পালনের মধ্য দিয়ে মায়াদেবীর মৃত্যুদিবস পালন করা হলো।
সেই প্রাচীনকালে রাজাদের মধ্যে বহুবিবাহ প্রথা চালু ছিল বিধায় রাজা শুদ্ধোধনেরও একাধিক মহীষী ছিলেন। তার মধ্যে মনোমাধুরী মায়াদেবীই ছিলেন রাজার প্রধান পতœী। রাজা তার অপর স্ত্রী গৌতমীকে সিদ্ধান্তের দায়িত্ব নিতে অনুরোধ জানালেন। গৌতমীও বিন্দুমাত্র চিন্তা না করে সিদ্ধার্থের দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন। ফলে বিমাতা গৌতমীর অশেষ স্নেহপরশে সিদ্ধার্থের শৈশব কাটতে লাগল।
রাজকুমার সিদ্ধার্থ এখন পূর্ণ কিশোর, শান্ত মূর্তি। রাজা শুদ্ধোধন পুত্রের শিক্ষার কথা চিন্তা করতে লাগলেন। সর্বোচ্চ এবং সর্বপ্রকার শিক্ষার জন্য শাক্যরাজ্যের পণ্ডিত প্রধান বিশ্বামিত্রকে নিযুক্ত করলেন। পরে এক শুভ দিনে পণ্ডিতপ্রধান বিশ্বামিত্র রাজকুমারকে রাজা শুদ্ধোধনের কাছে এনে বললেনÑ রাজমহাশয়, রাজকুমারের শিক্ষা শেষ। আমার দেয়ার মতো আর কোনো কিছু অবশিষ্ট নেই। রাজকুমার দৈনিক শিক্ষায়তনেও মেধার বিকাশ ঘটালেন খুব অল্প সময়ে। তার আর কোনো শিক্ষা বাকি রইল না। সব বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে উঠলেন।
এত কিছু রপ্ত করার পরও রাজকুমার চিন্তিত, নিঃসঙ্গ; কিন্তু নিঃশঙ্ক। এ খবর খুব অল্প সময়ে চার দিকে প্রচার হয়ে গেল। রাজা শুদ্ধোধনও পুত্রের চিন্তায় বিভোর। তিনি জানতেন এমন কিছু একটা ঘটবে। এ তার ভবিতব্য, কপাল লিখন। রাজা দেখলেন সিদ্ধার্থের বয়স যতই বাড়ছে তার শরীর ততই হয়ে উঠছে তেজস্বান। কোনো একটা বিষয়ে বিশ্বাস আর ব্যাকুলতা তার বাড়ছে। কিসের বিশ্বাস, কিসের ব্যাকুলতা! রাজা শুদ্ধোধন কিছুই অনুমান করতে পারছেন না।
রাজপুত্রের উদাসীনতা কাটাতে নানা প্রচেষ্টা চালিয়েও রাজা সফলকাম হতে পারছেন না। একদিন মিনি রাজ্যে রথ প্রতিযোগিতার আয়োজন করলেন শুধু সিদ্ধার্থকে ফেরাতে। প্রতিযোগীরা হলেনÑ নন্দ, আনন্দ, দেবদত্ত ও রাজপুত্র সিদ্ধার্থ। ঘোষণা করা হলো, প্রতিযোগিতায় যে প্রথম হবে তাকে বিশেষভাবে পুরস্কৃত করা হবে।
যথারীতি প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল। রথে ঘোড়া যোজনা করল চার প্রতিযোগী। তারপর শুরু হলো যাত্রা। প্রথমে ধীর-মন্দ গতিতে, পরে জোরে, আরো জোরে, ক্ষিপ্রগতিতে এবং সর্বশেষ উল্কা গতিতে। পলকে পলকে দৃশ্য পাল্টে যেতে থাকল। রাজকুমার সিদ্ধার্থ পলকে শাক্যরাজ অতিক্রম করে চলে এলেন। পেছনে, অনেক পেছনে নন্দ, আনন্দ ও দেবদত্ত।
প্রতিযোগিতায় রাজকুমার সিদ্ধার্থ প্রথম হলেন। তাকে বিশেষ পুরস্কারে ভূষিত করা হলো রাজার ঘোষণা অনুযায়ী। এতে রাজার আত্মবিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত হলো। রাজপ্রাসাদের কুললনারা ও সমবেত জনতা আনন্দ ধ্বনিতে সিদ্ধার্থকে জয়মাল্যে ভূষিত করে রাজপ্রাসাদে নিয়ে এলেন। সিদ্ধার্থ জয়ী, প্রতিযোগিতায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু এই প্রতিযোগিতায় তার কোনো আগ্রহ নেই, নেই কোনো আনন্দ। তবু এ কাজ কর্তব্যবোধেই তিনি করলেন; এ তার কর্তব্য, পিতৃ আজ্ঞা পালন।
কুমার সিদ্ধার্থ গৃহ ত্যাগ করে কঠোর সাধনা ও তপস্যার বলে যে দিন বুদ্ধত্ব লাভ করেছিলেন, সে দিনও ছিল আজকের এ শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা তিথি। বুদ্ধত্ব লাভের পর বৌদ্ধধর্ম প্রচার করে যে দিন তিনি মহাপরিনির্বাণ লাভ করেছিলেন তাও ছিল আজকের এ শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা তিথি।
বৈশাখী পূর্ণিমার এই শুভ তিথিতে সবাইকে জানাই মৈত্রীময় শুভেচ্ছা। সবার জীবন হোক পুণ্যময়। জগতের সব প্রাণী সুখী হোক, সমৃদ্ধি লাভ করুক বাংলাদেশ।
লেখক : সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক
আজ শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা তিথি। বুদ্ধ পূর্ণিমা নামে পরিচিত এই পুণ্যতিথি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের জন্য এক অবিস্মরণীয় দিন। এ তিথিকে ঘিরে রয়েছে তথাগত বুদ্ধের তিনটি স্মরণীয় ঘটনা। ত্রিস্মৃতিবিজড়িত এ তিথির তাৎপর্য অত্যন্ত বিশাল।
সব পূর্ণিমা তিথি কোনো না কোনো কারণে গুরুত্ব বহন করে। আজকের তিথির সাথে রয়েছে অন্য তিথিগুলোর বিস্তর ফারাক। বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বৈশাখী পূর্ণিমার ঘটনাবহুল দিক নিয়ে সারা দিন থাকবে উৎসবে মাতোয়ারা। আজ সরকারি ছুটির দিন। প্রতিটি বৌদ্ধ বিহার কমিটি যথাযোগ্য মর্যাদায় বৈশাখী পূর্ণিমা পালনের জন্য পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে প্রায় সপ্তাহখানেক আগে থেকে কাজ শুরু করে দিয়েছে।
ত্রিস্মৃতিবিজড়িত বৈশাখী পূর্ণিমায় আজ আমরা নানাভাবে পুলকিত। জাতির ক্রান্তিকালে বুদ্ধ নির্দেশিত বাণীগুলো বড়ই অপরিহার্য বিষয়। জীবনসংগ্রামে আমরা নানাভাবে অত্যন্ত অসহায়। মানবসৃষ্ট প্রতিকূলতা পেরিয়ে আসতে পারাই হলো একজন মানবের আসল বৈশিষ্ট্য।
গভীর রাত, পুণ্যবতী মায়াদেবী রাজপালঙ্কে অঘোর নিদ্রায় মগ্ন। ঘুমন্ত অবস্থায় তিনি স্বপ্ন দেখলেন, সে দিন ছিল কপিলাবস্তু নগরীতে আষাঢ়ী পূর্ণিমার উৎসব। রানী সারা দিন উৎসবে মেতে কান্ত শরীরে শেষ রাতে স্বপ্নে দেখলেনÑ চার দিক থেকে চার দিকপাল এসে তাকে শয্যাসহ তুলে নিলেন। চাঁদের জ্যোৎস্না ছড়ানো রমণীয় এক হ্রদে রানী দেখলেন সহস্রদল পদ্ম। লাবণ্য আর লালিমায় রক্তিম। এক সাদা হস্তী সেই হ্রদে জলকেলি করছে। হস্তীটি মায়াদেবীর আগমনে সামনে এগিয়ে এলো। একটি বর্ণময় পদ্ম মায়াদেবীর ডান কুক্ষিতে প্রবেশ করিয়ে দিলো হস্তীটি। এতে রানীর দেহমনে এক অপূর্ব শিহরণ জাগ্রত হলো।
মায়াদেবীর ঘুম ভেঙে গেল। তিনি পালঙ্কে উঠে বসলেন। শাক্যরাজ্যের প্রাণপুুরুষ রাজা শুদ্ধোধনের রাজমহিষী তিনি। একি আমি দেখলাম। কেন দেখলাম। পরদিন রানী রাজা শুদ্ধোধনের কাছে স্বপ্নের আদিবৃত্তান্ত শোনালেন। রাজা কালবিলম্ব না করে জ্যোতিষীদের ডেকে পাঠালেন এবং জ্যোতিষীদের কাছ থেকে রানীর স্বপ্নের বিস্তারিত ব্যাখ্যা চাইলেন।
জ্যোতিষীরা বললেনÑ মহারাজ, রানী মায়াদেবীর পুত্রসন্তান হবে। এই পুত্র মহাতেজস্বী ও যশস্বী মহাপুরুষ হবেন। শান্ত, গভীর, জগতে দুর্লভ, জীবের দুঃখহারী ও মহাজ্ঞানী পুত্রের জনক হবেন আপনি। তবে এখানে নৈরাশ্য এবং বেদনার সংবাদও জড়িয়ে রয়েছে। আছে কিছু বিয়োগ-বিচ্ছেদের অশনি সঙ্কেত।
রাজা শুদ্ধোধন অতলায়িত বিস্ময়ে তাকিয়ে জ্যোতিষীদের নির্দেশ করলেন ঘটনা খুলে বলার জন্য। তারা বললেন, পুত্রসন্তান লাভের সাত দিন পর মায়াদেবীর অকালমৃত্যু ঘটবে। এ মৃত্যু অমোঘ, অনিবার্য। এক দিকে রাজপ্রাসাদে মহাপুরুষের আগমন সংবাদ অন্য দিকে মায়াদেবীর আসন্ন মৃত্যু সংবাদে, রাজা শুদ্ধোধন বিচলিত। আসন্ন প্রসবা মায়াদেবীর রূপ যেন বাঁধ মানছে না। যেন লাবণ্য বারিধি উদ্বেলিত হয়ে উঠেছে। ভূকৈলাসের রাজা আসবেন এ মর্ত্যভূমিতে। জ্যোতি রূপোজ্জ্বলা। প্রাণময়ী পরামার্থা। যুগে যুগে মহাপুরুষেরা এভাবেই পৃথিবীতে আগমন করেছিলেন।
যথাসময়ে মায়াদেবী পিত্রালয় দেবদহনগরে যাওয়ার জন্য রাজা শুদ্ধোধনের কাছে অনুমতি প্রার্থনা করলেন। মায়াদেবী দেবদহ নগরের রাজা সুত্রবুদ্ধের জ্যেষ্ঠ কন্যা। এলো বৈশাখী পূর্ণিমা তিথি। ইতঃপূর্বে রাজা রানীর বাপের বাড়ি যাওয়ার সব ব্যবস্থা সুসম্পন্ন করে রেখেছিলেন।
নির্দিষ্ট দিনে সন্তানসম্ভাবা মায়াদেবী সখীদলসহ রথে চড়ে বাপের বাড়ির পথে যাত্রা শুরু করলেন। মুখে তার অপরূপ লাবণ্য, বেদনা, করুণা, ক্ষমা আর ধৃতির স্নিগ্ধতা। তিনি হবেন আলোকসুন্দর দিব্য পুরুষের জন্মদাত্রী। সৃষ্টির পূর্ণতা ও অনুপম সৌন্দর্যে সমুজ্জ্বল। বাপের বাড়ি যাওয়ার পথে লুম্বিনী কাননে পৌঁছামাত্রই মায়াদেবীর প্রসববেদনা শুরু হলো। এক পদ্ম-পলাশ-লোচন ব্রহ্মযোগযুক্ত আত্মভোলা শিশু জগতের ভাবী বুদ্ধের জন্ম হলো। লুম্বিনী উদ্যান হয়ে উঠল সৃষ্টির উৎসারিত আলোকসমুদ্র। পূর্ণতার পরমতম আকর্ষণ। মায়াদেবী উদাসীন অথচ আনন্দময়ী, জগজ্জননী জ্যোতির্ময়ী। মহাসমারোহে শোভাযাত্রা সহকারে মাতা ও তেজস্বী নবজাতককে লুম্বিনী কানন থেকে কপিলাবস্তু নগরের রাজাপ্রাসাদে ফিরিয়ে আনা হলো। এই দিনে গয়ার বোধিবৃক্ষ, রাহুলমাতা গোপাদেবী, চার নিধিকুম্ভ, চার মঙ্গল হস্তী, সারথি ছন্দক এবং অমাত্যপুত্র উদায়ীও জন্মগ্রহণ করেন। মহাপুরুষ গৌতমের সাথে তারা প্রত্যেকে বিশেষভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। সেই শুভদিনটি ছিল আজকের বৈশাখী পূর্ণিমা তিথি।
দিব্যজ্ঞানস্বরূপ সাধনা সম্ভুত জ্যোতির্ময় পুরুষের জন্মদানের সাত দিন পর মায়াদেবীর
অকালমৃত্যু ঘটে। মায়াদেবীর মৃত্যুতে রাজ্যময় শোক নেমে এলো। রাজপ্রাসাদের অঙ্গন-প্রাঙ্গণের সব বাতি নিভিয়ে রাখা হলো। কুমারী কন্যাদের বিঙ্কিনীর রোল আর বাজল না। কাদম্বিনীরূপী কবরী আর খোলা হলো না। মৃদু মলয়ে বসন্ত সখার সুরধ্বনি বন্ধ হয়ে গেল। শাক্যরাজ্যব্যাপী শোক পালনের মধ্য দিয়ে মায়াদেবীর মৃত্যুদিবস পালন করা হলো।
সেই প্রাচীনকালে রাজাদের মধ্যে বহুবিবাহ প্রথা চালু ছিল বিধায় রাজা শুদ্ধোধনেরও একাধিক মহীষী ছিলেন। তার মধ্যে মনোমাধুরী মায়াদেবীই ছিলেন রাজার প্রধান পতœী। রাজা তার অপর স্ত্রী গৌতমীকে সিদ্ধান্তের দায়িত্ব নিতে অনুরোধ জানালেন। গৌতমীও বিন্দুমাত্র চিন্তা না করে সিদ্ধার্থের দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন। ফলে বিমাতা গৌতমীর অশেষ স্নেহপরশে সিদ্ধার্থের শৈশব কাটতে লাগল।
রাজকুমার সিদ্ধার্থ এখন পূর্ণ কিশোর, শান্ত মূর্তি। রাজা শুদ্ধোধন পুত্রের শিক্ষার কথা চিন্তা করতে লাগলেন। সর্বোচ্চ এবং সর্বপ্রকার শিক্ষার জন্য শাক্যরাজ্যের পণ্ডিত প্রধান বিশ্বামিত্রকে নিযুক্ত করলেন। পরে এক শুভ দিনে পণ্ডিতপ্রধান বিশ্বামিত্র রাজকুমারকে রাজা শুদ্ধোধনের কাছে এনে বললেনÑ রাজমহাশয়, রাজকুমারের শিক্ষা শেষ। আমার দেয়ার মতো আর কোনো কিছু অবশিষ্ট নেই। রাজকুমার দৈনিক শিক্ষায়তনেও মেধার বিকাশ ঘটালেন খুব অল্প সময়ে। তার আর কোনো শিক্ষা বাকি রইল না। সব বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে উঠলেন।
এত কিছু রপ্ত করার পরও রাজকুমার চিন্তিত, নিঃসঙ্গ; কিন্তু নিঃশঙ্ক। এ খবর খুব অল্প সময়ে চার দিকে প্রচার হয়ে গেল। রাজা শুদ্ধোধনও পুত্রের চিন্তায় বিভোর। তিনি জানতেন এমন কিছু একটা ঘটবে। এ তার ভবিতব্য, কপাল লিখন। রাজা দেখলেন সিদ্ধার্থের বয়স যতই বাড়ছে তার শরীর ততই হয়ে উঠছে তেজস্বান। কোনো একটা বিষয়ে বিশ্বাস আর ব্যাকুলতা তার বাড়ছে। কিসের বিশ্বাস, কিসের ব্যাকুলতা! রাজা শুদ্ধোধন কিছুই অনুমান করতে পারছেন না।
রাজপুত্রের উদাসীনতা কাটাতে নানা প্রচেষ্টা চালিয়েও রাজা সফলকাম হতে পারছেন না। একদিন মিনি রাজ্যে রথ প্রতিযোগিতার আয়োজন করলেন শুধু সিদ্ধার্থকে ফেরাতে। প্রতিযোগীরা হলেনÑ নন্দ, আনন্দ, দেবদত্ত ও রাজপুত্র সিদ্ধার্থ। ঘোষণা করা হলো, প্রতিযোগিতায় যে প্রথম হবে তাকে বিশেষভাবে পুরস্কৃত করা হবে।
যথারীতি প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল। রথে ঘোড়া যোজনা করল চার প্রতিযোগী। তারপর শুরু হলো যাত্রা। প্রথমে ধীর-মন্দ গতিতে, পরে জোরে, আরো জোরে, ক্ষিপ্রগতিতে এবং সর্বশেষ উল্কা গতিতে। পলকে পলকে দৃশ্য পাল্টে যেতে থাকল। রাজকুমার সিদ্ধার্থ পলকে শাক্যরাজ অতিক্রম করে চলে এলেন। পেছনে, অনেক পেছনে নন্দ, আনন্দ ও দেবদত্ত।
প্রতিযোগিতায় রাজকুমার সিদ্ধার্থ প্রথম হলেন। তাকে বিশেষ পুরস্কারে ভূষিত করা হলো রাজার ঘোষণা অনুযায়ী। এতে রাজার আত্মবিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত হলো। রাজপ্রাসাদের কুললনারা ও সমবেত জনতা আনন্দ ধ্বনিতে সিদ্ধার্থকে জয়মাল্যে ভূষিত করে রাজপ্রাসাদে নিয়ে এলেন। সিদ্ধার্থ জয়ী, প্রতিযোগিতায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু এই প্রতিযোগিতায় তার কোনো আগ্রহ নেই, নেই কোনো আনন্দ। তবু এ কাজ কর্তব্যবোধেই তিনি করলেন; এ তার কর্তব্য, পিতৃ আজ্ঞা পালন।
কুমার সিদ্ধার্থ গৃহ ত্যাগ করে কঠোর সাধনা ও তপস্যার বলে যে দিন বুদ্ধত্ব লাভ করেছিলেন, সে দিনও ছিল আজকের এ শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা তিথি। বুদ্ধত্ব লাভের পর বৌদ্ধধর্ম প্রচার করে যে দিন তিনি মহাপরিনির্বাণ লাভ করেছিলেন তাও ছিল আজকের এ শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা তিথি।
বৈশাখী পূর্ণিমার এই শুভ তিথিতে সবাইকে জানাই মৈত্রীময় শুভেচ্ছা। সবার জীবন হোক পুণ্যময়। জগতের সব প্রাণী সুখী হোক, সমৃদ্ধি লাভ করুক বাংলাদেশ।
লেখক : সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন