শুক্রবার, ১৮ মে, ২০১২

দুই লেখক, দুই গায়কের দেখা

মুস্তাফা জামান আব্বাসী | তারিখ: ১৯-০৫-২০১২



কুহেলিঢাকা, পাখিডাকা, চট্টগ্রামের সবুজ-লালে আচ্ছাদিত কৃষ্ণচূড়া শোভিত ভোরবেলায় পথে আমি। সামনের বাড়িটিই লেখক আবুল ফজলের, ভাবছি অত ভোরে এক কাপ চায়ের দরখাস্ত করব কি না। দীর্ঘদিন পর সে সাহস আর কুলাল না। হাঁটতে গিয়ে দেখা অনেকের সঙ্গে, কেউ পরিচিত, কেউ অপরিচিত। চট্টগ্রাম ক্লাবের নিজ আশ্রয়ে ঢুকতে যাব, তখনই দেখা মোড়ে লেখক আবুল মোমেনের, বললেন, চিনতে পেরেছেন? জানালাম তাঁকে নানা লেখা নিয়ে মন্তব্য, কোথায় কোন কথা মনে দাগ দিয়ে গেছে। অবাক হলাম যখন তিনি জানালেন একই অনুভূতি। আবুল ফজলের সুযোগ্য সন্তান, যাঁর লেখা মন দিয়ে পাঠ করি।
আবার দুই লেখকের দেখা লক্ষ্মৌ শহরে সার্ক সম্মেলনে। এর একজন মুহাম্মদ নূরুল হুদা, কবি, আরেকজন অধম। মনোযোগী শ্রোতা পেয়ে কবি খুলে বসলেন সে প্রাতে লেখা তাঁর তিন কবিতা। অবাক হয়ে লক্ষ করলাম কত মর্মভেদী দৃষ্টির অন্তরালে কলম সজীব রাখেন একজন কবি, যাঁর কবিতায় স্থান লাভ করল কুলুকুলু রবে বয়ে যাওয়া শীর্ণা গোমতী, মায়াবতীর গড়া থরে থরে প্রস্তর মূর্তি, পেছনে শোভা পায় ইমামবাড়া, যার ভুলভুলিয়াতে থেমে অযোধ্যার নবাব ওয়াজেদ আলী শাহের জলসা সুভাসিত ঠুমরি। সাথিরা তো একই বস্তু অবলোকন করলাম। কই আমাদের কারও অনুভূতিতে পুরোনো দিনের কোনো অনুষঙ্গ, কোনো মিনার, কোনো পথ-ঘাট গড়ে তোলেনি নতুন কোনো পঙক্তি, যা ধরা পড়েছে শুধু একজন কবির দৃষ্টিতে।
যে কদিন সেখানে, গুন গুন করেছি এই শহরের ছেলে তালাত মাহমুদের গান, লক্ষ্মৌয়ে জন্ম যার। কয়েকটি গান: ‘সিনে মে সুলাগেত হ্যায় আরমান’, ‘জ্বলতে হ্যাঁয় জিসকে লিয়ে’, ‘তসবির বানাতা হু’, ‘এ্যায় দিল মুঝে এ্যায়ছি জায়গা লে চাল যাহা কোই না হো’, ‘যায়ে তো যায়ে কাঁহা’, ‘ইয়ে হাওয়া ইয়ে রাত চাঁদনি’, ‘এ্যায় মেরি দিল কাঁহি অওর চল’। ওই গানগুলোতেই আমার সঙ্গে যেন দেখা তালাতের।
কত দিন গান শুনিনি অজয়ের, বাংলার শ্রেষ্ঠ সংগীতকার। কলকাতায় গিয়ে টেলিফোন করলে উত্তর পাই হিন্দিতে, ‘সাহাব ঘরমে নেহি হ্যায়’। আরেকবার, ‘সাহেব চেন্নাইমে হ্যায়’। হঠাৎ করে সেদিন ঢাকা মিউজিয়ামে ভরাট গলায় আবির্ভূত পরাক্রান্ত শিল্পী পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী। তাঁর বিনয় গল্পের মতোই, বললেন: যারা আজ আমার গান শুনতে এসেছেন, তাঁদের শ্রীচরণে আমার প্রণাম, এসেছি আপনাদের পায়ের ধূলি নিতে, এই ধূলিই আমার সঞ্চয়। আমার পিতা-মাতার দেশ বাংলাদেশ। এখানে আসা তীর্থের মতো। পুরো মেজাজের সঙ্গে গাইলেন দুটি ঘণ্টা। সূচারু বক্তব্যের ফাঁকে ফাঁকে ইমনে খেয়াল, বিলম্বিত, মধ্যমান ও শেষে তারানায়, কবিরের অনুপম ভজন, নজরুলের ‘আমি চিরতরে দূরে চলে যাব’ আর সাতটি রাগমিশ্রিত বাংলা গান। একেকটি গান শেষ হয়, আর শ্রোতারা ভাবতে থাকেন কোনটি ছেড়ে কোনটি গাইবেন শিল্পী। শেষ গান ছিল গীতিময়তার চূড়ান্ত অভিব্যক্তি: আমি সুরে সুরে ওগো তোমায় ছুঁয়ে যাই। ছোট মেয়ে শারমিনী বারবার চোখ মুচছিল, ঘরভর্তি শ্রোতা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিলেন চার সপ্তকে তাঁর অনুপম পরিবেশনা, কণ্ঠের মডিউলেশন, সুরক্ষেপণ ও এমন কিছু কথা যাতে শ্রোতার মন-প্রাণ গেছে ভরে।
অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলাম, যদি তাঁর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। হলো না। সুরে সিঞ্চিত সারা রাত ও পরের দিন পর্যন্ত ভাবছি এমন একজন গুণীর সঙ্গে দেখা হলো না। রাতে টেলিফোন বেজে উঠল। কলকাতা থেকে অজয়, বললেন: আমার একটাই দুঃখ রয়ে গেল আপনার সঙ্গে দেখা হলো না। আরও অনেক কথা। অজয় পুত্রবৎ, বললেন, আমার পরিচিত তাঁর পিতা এবং মাতা দুজনেরই প্রয়াণের কথা। কয়েক মিনিটের আলাপনে কত কাছে এলাম প্রিয় ব্যক্তি, প্রিয় শিল্পী।
কলকাতা গিয়ে কখনো খুঁজে ফিরি কাজী সব্যসাচী, কাজী অনিরুদ্ধ, সতীনাথ, আলপনা, হেমন্ত, শ্যামল, আঙ্গুরবালা, কৃষ্ণচন্দ্র দে। ওঁরা এই শহরে এখন থাকেন না, চলে গেছেন অন্য কোনো ঠিকানায়। ঢাকায় এসে পঙ্কজ কুমার মল্লিক প্রথমেই ছুটে এসেছেন পিতা আব্বাসউদ্দিনকে দেখতে। দুজনের সংলাপ ভুলিনি। পঙ্কজ মল্লিক বললেন, ‘সারা কলকাতা এখনো আপনার কথাই বলে। আপনি অসুস্থ, তাই আপনাকেই প্রথমে দেখতে এলাম।’ যাঁরা কিছু লেখেন বা গান করেন, তাঁদের কাছে এই মিলন যে কত আনন্দের তা ভাষায় বোঝানো যাবে না।
অথচ এই শহরে লেখক, কলামিস্ট, গায়ক, শিল্পী অন্য কারও ছায়া মাড়াতে উৎসাহী নন, প্রশংসা তো অনেক দূরের কথা। কারও লেখা পড়ি না, গান শুনি না, ছবি দেখি না, প্রশংসায় হই না বিন্দুমাত্র উচ্ছ্বসিত। শিল্পকলা একাডেমীতে কাজ করতাম যখন, প্রস্তাব তৈরি করি, যার মধ্যে একটি: এমন একটি জায়গা হবে এই একাডেমীতে, লেখকেরা জিরোবেন, কবি পাঠ করার জায়গা খুঁজে পাবেন, উঠতি সুরশিল্পী সুর ভাঁজবেন গুনগুনিয়ে। বৃক্ষছায়া, কয়েকটি চেয়ার পাতা, কয়েক কাপ চা হলেই চলবে। এ সুরে সুর মেলালেন না কেউ। বললেন, এটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় নেই, এটির মূল্য নেই এক কানাকড়ি।
বাড়ির পাশে কয়েকটি বাড়ি, কয়েক ঘর লোক, যেন একটি ছোট্ট গ্রামে বাস করছি। অসুস্থ শিল্পী-লেখক-গায়কদের দেখতে খুব ইচ্ছে করে, অথচ এই শহরে ছোট ছোট গণ্ডির মধ্যে ক্রমেই আমরা হয়ে পড়ছি বন্দী।
 মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্য-সংগীত ব্যক্তিত্ব।
mabbasi@dhaka.net

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন