॥ সুনির্মল চন্দ্র বসু ॥
আজ আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবস। জীববৈচিত্র্য বলতে সাধারণত জীবের সংখ্যা, প্রজাতিভেদ ও বৈসাদৃশ্যকে বোঝানো হয়ে থাকে। মহান সৃষ্টিকর্তার অপার সৃষ্টি জীববৈচিত্র্য। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, পৃথিবীতে ১৭ লাখ প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী রয়েছে। এর মধ্যে উদ্ভিদ প্রজাতির সংখ্যা দুই লাখ ৬০ হাজার; তবে আইইউসিএন-এর মতে, এ সংখ্যা ৩০ লাখ, কীটপতঙ্গের সংখ্যা সাত লাখ ৫০ হাজার অমেরুদণ্ডী প্রাণী ও জীবাণুর সংখ্যা তিন লাখ ৫০ হাজার এবং মেরুদণ্ডী প্রাণীর প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ৪১ হাজার। মানুষের সব খাদ্য আসে জীববৈচিত্র্য থেকে। আদিকাল থেকেই মানুষ খাদ্যের জন্য প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল। প্রায় ৮০ হাজার উদ্ভিদ প্রজাতির নানা অংশ আহারযোগ্য বলে জানা গেছে। অথচ বর্তমানে আমাদের ৯০ শতাংশ খাদ্য আসে মাত্র ১৫ প্রজাতির উদ্ভিদ থেকে। মানুষের দুর্ভোগ কমাতে জীবন বাঁচাতে জীববৈচিত্র্যের গুরুত্ব অপরিসীম। কুইনাইন ও পেনিসিলিন ছাড়াও অনেক রোগের ওষুধ ও প্রতিষেধক উদ্ভাবনে জীববৈচিত্র্যের কাছে মানুষ ঋণী। বিজ্ঞানীদের হিসেবে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বনভূমির প্রায় এক হাজার ৪০০ প্রজাতির উদ্ভিদ ক্যান্সার চিকিৎসায় কার্যকর বলে জানা গেছে। পৃথিবীর গরিব মানুষের ৯০ শতাংশ তাদের জীবিকার জন্য বনের ওপর নির্ভরশীল। এক শ’ কোটিরও বেশি মানুষ বিশ্বের ১৯টি জীববৈচিত্র্য ভরপুর এলাকায় বাস করে। উদ্ভিদ সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্রহণ করে আবহাওয়ামণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের ঘনত্ব কমিয়ে দেয়। এক গবেষণায় দেখা গেছে, কোনো গাছের শুষ্ক ওজনের ৫০ শতাংশই কার্বন। গাছপালার আচ্ছাদন ভূমিক্ষয় রোধ করে মটির কণায় আবদ্ধ জৈবিক কার্বনকে আবহাওয়ামণ্ডলে কার্বনের পরিমাণ বেড়ে বিশ্বে বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে। বায়ু, পানি ও মাটিতে প্রতি বছর ৩০০ কোটি টনের বেশি ক্ষতিকর পদার্থ মিশে যাচ্ছে। পৃথিবীর বায়ুস্তরের ২০ কোটি টন কার্বন ডাই-অক্সাইড জমছে। কলকারখানার ধোঁয়ার সাথে বাতাস মিশছে ১৬ কোটি টন নাইট্রিক অ্যাসিড। এতে অনবরত তাপমাত্রা বাড়ছে। পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে জীববৈচিত্র্যে সমস্যা দেখা দেয়। গ্রিনহাউস প্রতিক্রিয়ার ফলে বর্তমান শতাব্দীতে বিশ্বজুড়ে তাপমাত্রা ১-৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তে পারে। সেই সাথে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে যাবে ১-২ মিটার। এভাবে কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৮০ প্রজাতির জীব সমুদ্রের তলদেশে তলিয়ে যাবে। জীববৈচিত্র্য ভেঙে যাওয়ার কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১০ শতাংশ পেঁচা মারা যাওয়া, পোল্যান্ডের ৪৩ প্রজাতির পাখি বিলুপ্ত হওয়া, বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার ফলে দণি এশিয়ার বহু দেশ সমুদ্রে তলিয়ে গেলে পর্যাপ্ত জীব প্রজাতি বিলুপ্তির শিকার হবে। ড. হক বলেন, ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে এবং পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। এতে ১০ কোটি হেক্টর উর্বর ভূমি নষ্ট হচ্ছে। ভূমিক্ষয়ের ফলে প্রতি বছর ৬০ লাখ থেকে ৭০ লাখ হেক্টর জমি চাষের অযোগ্য হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের মতে , ২০২০ সালে বাংলাদেশের খাদ্যঘাটতি দাঁড়াবে ৫০ থেকে ৬০ লাখ টন। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, জাতীয় আয়ের ৩০ শতাংশ জীববৈচিত্র্য থেকে আসে। প্রতি বছর ২৫ হাজার স্তন্যপায়ী, ২০ লাখ থেকে ৩০ লাখ পাখি, এক কোটি সরীসৃপের চামড়া এবং ২৫ কোটিরও বেশি ক্রান্তীয় মাছ ব্যবসায়ের তাগিদে বিশ্ববাজারে প্রবেশ করে। ১৪টি পশুপাখি আমাদের প্রাণিজ আমিষের জোগানদার। আতঙ্কিত হতে হয়, ছয় হাজার ৩০০ গবাদিপশু জাতের মধ্যে এক হাজার ৩৫০ প্রজাতি নানা কারণে ইতোমধ্যেই নিঃশেষ হয়ে গেছে। বাংলাদেশ থেকে ১৩ প্রজাতির মেরুদণ্ডী প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
বর্তমান বিশ্বের খাদ্য উৎপাদনের ৯৫ শতাংশ মাত্র ৩০টি প্রজাতির উদ্ভিদের ওপর নির্ভরশীল। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে একসময় প্রায় ১৮ হাজার প্রজাতির ধান উৎপন্ন হলেও বর্তমানে তা কমে ঠেকেছে প্রায় ১৫-৩০ প্রজাতিতে। মাত্র ৪টি মাঠ ফসল যেমনÑ ধান, গম ভুট্টা, আলু মোট খাবারের অর্ধেক সরবরাহ করে। আগামী ১৫ বছরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে পৃথিবীর ১৫ শতাংশ উদ্ভিদ ও প্রাণী। পৃথিবীর স্থলভাগের ৪০ শতাংশ জমি কৃষিকাজে ব্যবহৃত হয়। অধ্যাপক আ ক ম উউসুফ হায়দার বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বায়ুদূষণ ও সমুদ্রের লবণাক্ততা বাড়ছে। এতে জীববৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে।১৯৯২ সালে গ্লোবাল বায়োডাইভার্সিটি স্ট্রেটেসি নামের দলিলে জাতীয়, আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পর্যায়ে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ৮৫টি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব রাখা হয়েছে। জীবসম্পদের মানবকল্যাণমুখী গুরুত্ব ও পৃথিবীর স্থায়িত্ব রক্ষায় ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিওডি জেনিরোতে মিলিত হয়ে জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও গবেষণায় একমত হয়েছেন। জীববৈচিত্র্য কনভেনশন ১৯৯৩ সালের ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হয়। ২০০২ সালে জোহানেসবার্গে পরিবেশ সম্মেলনে জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। ২০০৪ সালে প্রণীত গ্লোবাল গ্রুপ ডাইভারসিটি ট্রাস্ট এবং বায়োলজিক্যাল ডাইভারসিটি সম্পর্কিত কনভেনশনে গৃহীত সিদ্ধান্তাবলিসহ অন্য সব নীতিমালার কার্যকর ও সুষ্ঠু বাস্তবায়ন করা জরুরি। ২-১৪ অক্টোবর ২০০৪ সালের ১৩তম সাইটেস সম্মেলনে জীববৈচিত্র্যের সামগ্রিক অবস্থা নিয়ে আলোচনা করা হয়। বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদের ব্যবসায় ক্ষেত্রে এর নীতিমালা প্রয়োগ ও জোরদার করতে হবে। সব চুক্তির প্রতিশ্রুতি, নৈতিক দায়িত্ব ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অধিকার রক্ষায় বাংলাদেশ সরকার একটি জাতীয় জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকৌশল ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করছে। এ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকৌশল ও কর্মপরিকল্পনার ভিত্তিতেই সরকার জীববৈচিত্র্যের প্রতিটি উপাদানকে রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। প্রকৃতির এ জটিল ইকোসিস্টেম ডাইনামিকের বিস্তারিত উদঘাটিত হলেই জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা সম্ভব হবে। আমরা নষ্ট পরিবেশকে আবার সুস্থ করতে জীববৈচিত্র্যকে ধরে রাখতে চাই। সুষ্ঠুভাবে যারা পৃথিবীর বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মানুষের সব ধরনের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশীয় অবস্থা মেটাতে জীববৈচিত্র্যের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য রক্ষা করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব তাই জীববৈচিত্র্যপূর্ণ একটি পৃথিবী আমাদের স্বপ্ন।
লেখক : প্রভাষক, মুজিব ডিগ্রি কলেজ, কাদেরনগর, টাঙ্গাইল
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন