বৃহস্পতিবার, ১৭ মে, ২০১২

সাবার পথ নয়, মুক্ত আলোর পথ


॥ মুস্তাফা জামান আব্বাসী ॥


বন্ধু মোহাম্মদ আসাফ্উদ্দৌলাহ্, কুরআনের তাফসির নিয়ে ব্যস্ত, ফোন করলে জানানো হয় যে জীবনের যে ক’টা দিন বাকি, কুরআনের মধ্যেই ডুবে থাকতে চান। ‘কোনো কিছুই আর মনকে আকর্ষণ করে না, কুরআন ছাড়া’। টেলিফোন ছেড়ে অনেকক্ষণ চুপ। ভাবছি চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে কতটুকু সময় কুরআনের সাথে ছিলাম। যে বয়স পেলাম মোট কত বছর ব্যয় করেছি এর পেছনে, আল্লাহ্ তা’য়ালা যার নাম দিয়েছেন: ‘স্পষ্ট জ্যোতি’।
সকালে সূরা সাবায় এসে থামলাম। ‘সাবা’ একটি জায়গার নাম। আমার বিশিষ্ট বন্ধু রেডিওতে চাকরি করতেন, ম ন মুস্তাফা, সঙ্গীত নিয়ে কয়েকটি বই লিখেছেন। অফিসে আসার পর কিছু সময় ব্যয় করতেন কুরআন পাঠে। একদিন বললেন, আব্বাসী, খুব ইচ্ছা, কুরআনে যেসব জাতির কথা উল্লেখ আছে, যেমনÑ আদ, সামুদ, সাবা তাদের নিয়ে গবেষণা করব এবং জানতে চেষ্টা করব তাদের ইতিহাস। কী দোষে তারা অভিশপ্ত জানার জন্য বিদেশে পুস্তকাদির অন্বেষণ করতাম। রেফারেন্স পেয়েছি, বইগুলো সংগ্রহ হয়নি। এখানে কোনো প্রতিষ্ঠান নেই যেখানে জগতের জ্ঞান-বিজ্ঞানের বইগুলো সংগ্রহ করা যায়। বিদেশের লাইব্রেরিগুলোতে কত গ্রন্থের সমাহার। বাইবেল বর্ণিত শহর-বন্দর, পথঘাটের তথ্যাদিতে পরিপূর্ণ পুরাতত্ত্ববিদ ও ঐতিহাসিকদের ভারী ভারী পুস্তক। বাইবেলের পথ ধরে প্রস্তুত অসংখ্য ছবির অ্যালবাম। দুই হাজার বছর আগের বই তো নয়, পাঠকের সামনে শুধু বাইবেল নয়, সে সময়ের ভিজ্যুয়াল ছবি ও ম্যাপ। কুরআন নিয়েও শুরু হয়েছে নতুন গবেষণা, নতুন দিগন্তের অভিসারী এই বিস্তারিত কর্মসূচি নতুন চিন্তা উন্মোচিত করে দিচ্ছে। বিভিন্ন দেশে মুসলিম প্রজন্মের মধ্যে এটি প্রবর্তন করেছে উৎসাহ ও উদ্দীপনা।
আজ সকালে সাবা জাতির দ্বারে এসে থমকে দাঁড়ালাম। ‘সাবা’র নাম অনুসারেই কুরআনের ৩৪ সূরা, যাতে ৫৪টি আয়াত, ৬টি রুকু। ইসলাম দমন করার জন্য জুলুম-অত্যাচারের তীব্রতা তখনো তেমনটি দানা বাঁধেনি, ছিল ঠাট্টা বিদ্রƒপ গুজব মিথ্যা ও বিদ্বেষ প্রচারের প্রারম্ভকাল। মক্কায় নাজিল হয় এই সূরা। যদিও নাম সাবা, সাবার ইতিহাস ও কর্মকাণ্ড বিধৃত অল্পই। হজরত দাউদ আ:-কে যত মর্যাদা দান করা হয়েছিল তার মধ্যে ছিলÑ ১. পাহাড়কে অনুগত হওয়ার হুকুম ২. পাখিদের অনুগত হওয়ার হুকুম ৩. লৌহকে নরম করে দেয়ার শিক্ষা, যা দিয়ে প্রস্তুত করা যেত বর্ম ও কড়া। হজরত সুলেমানকে যে মর্যাদা দান করা হয়েছিল তার মধ্যে ছিল ১. বাতাসকে অনুগত করে দেয়া ২. প্রভাতে এক মাসের পথ অতিক্রম করা ৩. সন্ধ্যায় এক মাসের পথ অতিক্রম করা ৪. গলিত তাম্্েরর প্রস্রবণ প্রবাহিত করে দেয়া ৫. এমন সব জিনকে অধীনস্থ করে দেয়া যারা রবের হুকুমে তার সামনে কাজ করত ৬. উঁচু উঁচু দালান, পুকুরের মতো বড় বড় থালা ৭. বিরাট ডেগ, যা নড়ানো যায় না।
সাবার বাসিন্দাদের নিদর্শন ডানে ও বামে ফুলের বাগান। বলা হয়েছিল রবের পক্ষ থেকে দেয়া রিজিক উপভোগ করার জন্য ও শুকরিয়া জানানোর জন্য। উপভোগ করেছিল, শুকরিয়া জানাননি। মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল শুকরিয়া জানানো থেকে (যেমন প্রায়ই করে থাকি)। তাদের জন্য এলো বাঁধভাঙা বন্যা, বাগান আর রইল না, এলো তেতো ফল, ঝাউগাছ ও কিছু বরই। এ বরকতপূর্ণ জনপদ ছিল সিরিয়া ও ফিলিস্তিন এলাকা।
‘সাবা’ জাতির প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা’য়ালা অনেক কিছুই বলেছেন, যা আমাদের সবার জন্যই প্রযোজ্য। বলেছেন : ১. নবীকে গোটা মানবজাতির জন্য সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে পাঠিয়েছি। বেশির ভাগ লোকই তা জানে না, ২. বান্দাদের রিজিকের ভাণ্ডার খুলে দেয়া হয়, আবার যাকে ইচ্ছা মেপে মেপে দেয়া হয়, ৩. আরবরা পূজা করত ফেরেশ্তাদের, এটা আসলে শয়তানেরই এবাদত, ৪. গভীরভাবে চিন্তা করো তোমাদের সাথীকে (মুহাম্মদ সা:) কেন পাঠিয়েছি।
মানুষ নিজকে নিয়েই মত্ত, ব্যস্ত আহার সংগ্রহে। নেতৃস্থানীয় সচ্ছল যারা, অধিকতর ধনসম্পদ আহরণের পেছনে। এখানে ‘সাথী’র (মুহাম্মদ সা:) কথা চিন্তা করার সময় তাদের নেই। অথচ যতটুকু সময় বাকি আছে এখানে সময় দেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
ইবনে কাসিরের তাফসির অনুযায়ী সাবার কাহিনী অনেক লম্বা। গোষ্ঠী ইয়েমেনের অধিবাসী। তুব্বা ও বিলকিস এই গোষ্ঠীর লোক ছিলেন, তারা প্রাচুর্যের অধিকারী। প্রেরিত রাসূলের নির্দেশ অনুযায়ী জীবন যাপন করতেন। এমন এক সময় এলো যখন নানা রকম সম্পদের খেয়াল তাদের করল অন্য পথের দিশারী। খেয়ালখুশি ও বাঁধভাঙা জীবনে হলো অভ্যস্ত। সময় যখন এলো, তাদের বাগানের ফুল হলো তিরোহিত। রাসূল সা:-কে জিজ্ঞেস করা হলো, সাবা কে, পুরুষ, নারী, না ভূখণ্ড? বললেন : সাবা একজন আরব, যার ছিল দশ সন্তান, ছ’জন ইয়েমেনে, চারজন শাম দেশে। পুরো ঘটনার বর্ণনার জন্য প্রয়োজন অনেক পৃষ্ঠার। আসল কথাটি : ইবাদতে অলসতা ঘণীভূত হলে তাদের সব কিছুই কেড়ে নেয়া হয়। আল্লাহ্ কেড়ে নিলে তাদের কাছে যা বাকি থাকবে : শয়তানের অনুগামী হওয়া।
কুরআনের তিন জায়গায় লেখা আছে সেবিয়ানদের কথা। ইহুদি, খ্রিষ্টান ও সেবিয়ানদের একসাথে বর্ণনা করা হয়েছে, যেটি সাবা থেকে আলাদা হওয়ার কথা। মুসলমান গ্রন্থকারদের মতে, সেবিয়ানরা ছিলেন দাউদ আ: নবীর কাছে আবর্তিত যবুর গ্রন্থের অনুসারী। যেহেতু এই সূরায় দাউদ আ: নবীর কথাও বর্ণিত, সম্ভবত সে কারণেই মারমাডিউক পিকথল এই দুই জাতিকে গুলিয়ে ফেলেছিলেন। একটি আব্রাহামিক সেবিয়ান, অন্যটি হেলেনিস্টিক সেবিয়ান।
হেদায়েত ও গোমরাহি স্বতন্ত্র পথ।
একটি বাতিলের, অপরটি হকের।
বাতিলের পথে চলতে আগ্রহী, সম্পদ কামিয়ে ফেলেছি যারা। আছি উচ্চতর বিলাসের মোহে।
বাতিলের পথ সম্মুখেই খোলা। একপাত্র খেলে কী-ই বা ক্ষতি হবে, সামান্য গোমরাহি, সামান্য অন্ধকার, টের পাবে না কেউ। গা ভাসিয়ে দেয়া যায় জোয়ারে, যেখানে উচ্ছল যৌবনের ভরা গাঙ, যৌবনের মনখুশি উন্মত্ত আবেগ। ওরা আমার সাথে যাবে না কেউ, গান ধরেছি সংক্ষিপ্ত পথের, নাম ‘সিরাতুল মুস্তাকিম’। পথটি সুন্দর। এ পথ উন্মুক্ত, যে আসতে চায় আসতে পারে, সাবার পথ ছেড়ে আলোর পথে। 
লেখক : সাহিত্য, সঙ্গীত ও সংস্কৃতি ব্যক্তিত্ব
mabbasi@dhaka.net

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন