বৃহস্পতিবার, ৩১ মে, ২০১২

এই ধরিত্রী আমাদেরই অংশ


আ লী  ই মা ম
চরম অবিবেচক হিসেবে রোম সম্রাট নিরোর পরিচিতি ছিল। তার খামখেয়ালিপনাজাত স্বভাব এবং ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ নিয়ে প্রচুর কাহিনী প্রচলিত আছে। অন্যজনের প্রতি পীড়াদায়ক ব্যবহার করে বিকৃত মানসিকতার তৃপ্তি পেতেন তিনি। মনোবিদদের ধারণা তিনি একজন মর্ষকামী ছিলেন। তার উদ্ভট আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্টি হয়েছিল সেই বহুল প্রচারিত উক্তিটি, ‘রোম নগরী যখন পুড়ছে সম্রাট নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিলেন।’
কথাটি নতুন করে মনে এল যখন অসহায়ের মতো আমাদের বসবাসের স্থান বিপন্ন গ্রহটিকে প্রত্যক্ষ করছি। সাম্প্রতিক সময়ের বিবিধ ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করে এই চিন্তার উদ্রেক হয়েছে। পৃথিবী নামের গ্রহটি যখন প্রচণ্ড তাপদাহে রীতিমতো পুড়ছে তখন জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে কতিপয় নীতিনির্ধারক-দেশের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠেছে। কূটকৌশলে চিহ্নিত সমস্যাগুলোর সমাধানের উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। সমস্যা সৃষ্টিকারী উন্নত দেশগুলো যেন নিরোর মতোই দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিচ্ছে। কার্বন নিঃসরণে ও গ্রিনহাউস গ্যাসের জন্য ওজোন স্তরে গর্ত হওয়াতে যে ভয়াবহ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে তার সমাধানের জন্য কার্বন (সিএফসি) নিঃসরণের মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করার কার্যকর পদক্ষেপ গৃহীত হচ্ছে না। গ্রহটিকে বাঁচানোর জন্য ঐকমত্যেও আসা সম্ভবপর হচ্ছে না। সুকৌশলে সমস্যাটিকে অনেকটা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
আমাদের গ্রহের এই মারাত্মক বিপর্যয় যেহেতু তাদের যাপিত জীবনযাত্রাকে ততটা ক্ষতিগ্রস্ত করছে না তাই তারা নিস্পৃহতার পরিচয় দিচ্ছে। যেন তাপের আঁচ তাদের গায়ে লাগছে না। আবহাওয়া বৈরী আচরণ করছে। অসহনীয় এক পরিবেশে আমরা প্রতিনিয়ত বিপর্যস্ত হচ্ছি। পরিবেশবিদদের মতে, যদি দ্রুত দেশে পরিবেশবান্ধব পরিস্থিতি সৃষ্টি করা না-যায় তা হলে আমাদের দেশ বসবাসের জন্য অযোগ্য হয়ে পড়বে। এই গ্রীষ্ম তীব্র তাপদাহে আক্রান্ত। বাংলাদেশে প্রতিবছর ০.০০৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস করে তাপমাত্রা বেড়ে চলেছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোয় প্রায়ই তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠছে। এ প্রবণতা আগামী দিনগুলোতে আরও বৃদ্ধি পাবে বলে আবহাওয়াবিদরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। আমাদের দেশটি পরিচিত ছিল নাতিশীতোষ্ণ তাপমাত্রার দেশ বলে। কিন্তু প্রেক্ষাপট এখন পালটে গেছে। বিশ্বাসের পরিবর্তন হয়েছে। বিগত কয়েক বছরের তাপমাত্রার অস্বাভাবিক আচরণ সেই পরিচিতিকে ম্লান করে দিয়েছে। ১৯৬০ সালে আমাদের দেশে সর্বোচ্চ ৪২.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা নথিভুক্ত করা হয়েছিল। ১৯৭২ সালে ৪৫ দশমিক ১ এবং নব্বইয়ের দশকে নথিভুক্ত হয় ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বর্তমানে সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা অত্যধিক বেশি।
আমরা বর্তমান সময়ে তাপমাত্রা বৃদ্ধিজনিত কারণে যে ভয়াবহ সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছি তাতে আবহাওয়াবিদদের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। যে পরিবেশ ব্যবস্থা আমাদের নিয়ন্ত্রণ করছে তার প্রেক্ষাপট আবিষ্কার করতে আগ্রহী হয়ে উঠেছি আমরা। জানা গেছে, গত ৫০ বছরে দেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার দশমিক ৫ শতাংশ। এমনকি ২০৫০ সালে বাংলাদেশের তাপমাত্রা গড়ে ১ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ২১০০ সাল নাগাদ এই হিসাবে ২ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আবহাওয়াবিদরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন যে এই বাড়তি তাপমাত্রায় পানির বাষ্পীভবন বেড়ে যাবে এবং বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বাড়িয়ে দেবে। আর্দ্র বাতাসের প্রভাবে তাপমাত্রা বেড়ে যাবে। বাংলাদেশের আর্দ্রতার মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাধারণ মানুষ তথ্য-উপাত্তের এই হিসাব-নিকাশ না জানলেও এটুকু বুঝতে সক্ষম যে জীবনপ্রবাহ বিপর্যস্ত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ ক্ষতির শিকার হয়েছে আমাদের দেশটি।
আমাদের এ পৃথিবীটা হল একটি সবুজ ঘর এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইডের স্তর ঘরের চারপাশের একটি কাচের দেয়াল। সূর্যের যেসব রশ্মি এ কাচের দেয়াল ভেদ করে পৃথিবীর উপরিভাগকে উত্তপ্ত করে, এ স্তর বা কাচের দেয়াল সেই তাপকে বাইরে বেরিয়ে যেতে বাধা দেয়। এর পরিমাণ বা ঘনত্ব যত বৃদ্ধি পাবে পৃথিবী থেকে তাপ ততই কম নির্গত হবে। যার ফলে পৃথিবী দিন দিন আরও বেশি উত্তপ্ত হবে।
বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণ হচ্ছে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মাত্রা বেড়ে যাওয়া। তাপমাত্রা অত্যধিক বেড়েছে। চরম অবস্থায় এসেছে আর্দ্রতা। পানির স্তর নেমে গেছে নিচে। অঞ্চলভিত্তিক অসম বৃষ্টিপাত হয়েছে। জলবায়ুর বিরূপতার সঙ্গে আমাদের সরাসরি সংশ্লিষ্টতা কম। কিন্তু ভুক্তভোগী আমরা বেশি। আমরা ভুক্তভোগী কারণ পৃথিবীতে সুবিধাভোগী দলটির যথেচ্ছ অনধিকারচর্চায় সম্পদগুলো ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। পৃথিবীর অধিকাংশ সম্পদ ভোগ করছে স্বল্প কয়েকটি দেশ। বেশিরভাগ দেশ বঞ্চিত। পৃথিবীর সাধারণ প্রাকৃতিক সম্পদগুলোও এখন একক কোনো গোষ্ঠী বা দলের স্বেচ্ছাচারিতার শিকার হয়েছে। সম্পদগুলো হচ্ছে পৃথিবীর বিস্তীর্ণ ভূমি, নীল আকাশ, পাহাড়-পর্বত, নদী-সমুদ্র, জলাশয়। এসব সম্পদের প্রাণশক্তিকে ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে নিয়ে গেছে সুবিধাভোগী গোষ্ঠী, যার খেসারত দিতে হয়েছে পৃথিবীর বহু ভূখণ্ডকে। যেমন আমাদের এখন দিতে হচ্ছে। এই চরম সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর মানসিকতাকে চিহ্নিত করেছিলেন প্রখ্যাত পরিবেশবিদ অধ্যাপক হার্ডিন। ১৯৬৮ সালে একটি বিজ্ঞান বিষয়ক জার্নালে হার্ডিন তার এই ধারণাটিকে তুলে ধরেন। তিনি দেখিয়েছিলেন, মধ্যযুগে ইউরোপের বহুবিস্তীর্ণ চারণভূমি পড়ে থাকত উন্মুক্ত। স্বার্থান্বেষী মানুষ তাদের সুযোগ-সুবিধার জন্য ততক্ষণ পর্যন্ত এই ভূমি মাত্রাতিরিক্তভাবে ব্যবহার করত, যতক্ষণ পর্যন্ত চারণভূমিটি তার উর্বরা শক্তি হারিয়ে রুক্ষ না হয়ে যেত। এরপর তারা চলে যেত অন্য কোথায়ও। তখন স্বাভাবিকভাবেই সেই রুক্ষ ভূমির দায় এসে পড়ত নির্দোষ মানুষ জাতির ঘাড়ে। হার্ডিনের ব্যাখ্যার করুণ সুরটিকে এখন আমরা যেন শুনতে পাচ্ছি। আমাদের প্রতিবেশ এখন সঙ্কটাপন্ন এলাকা বলে চিহ্নিত। কাদের দোষে? উন্নত দেশগুলো তাদের উন্নয়ন ও আকাশছোঁয়া সমৃদ্ধির জন্য কুক্ষিগত করেছে পৃথিবীর সেসব সাধারণ সম্পদগুলোকে, যার প্রতি অধিকার ছিল সব মানুষের। এর ফলে আমাদের মতো দেশগুলো বিপন্ন হয়েছে। দায় নিতে হচ্ছে উন্নয়নকামী দেশগুলোকে, তাদের দরিদ্র মানুষগুলোকে- যারা হয়ত এই জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত নয়। কিন্তু তাদের প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে চলতে হচ্ছে এর প্রভাবের সঙ্গে। হতদরিদ্র ও দুস্থ মানুষদের দিতে হচ্ছে মূল্য। তাই কোপেনহেগেন জলবায়ু সম্মেলনে অসংখ্য পরিবেশবাদী এই বলে স্লোগান দিয়েছিল যে, ‘এই পৃথিবী মুনাফার জন্য নয়। বাসযোগ্য আর কোনো পৃথিবীও নেই।’
আমাদের দেশের সেসব পরিবেশবাদী ব্যক্তি, যারা দীর্ঘদিন থেকে আমাদের পরিবেশ বিষয়ে সচেতন করে যাচ্ছেন, তারা তাদের স্বপ্ন, আশা ও আকাঙ্ক্ষার কথাকে সাবলীলভাবে, সুস্পষ্ট প্রত্যয়ে প্রকাশ করে গেছেন। তাদেরই এক অন্যতম প্রবক্তা অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মার ৮৪তম জন্মদিবসটি পালিত হল গত ২৯ মে, যখন আমাদের প্রকৃতি রুক্ষ। পরিবেশ সঙ্কটাপন্ন। নিসর্গ বিষণ্ন। দ্বিজেন শর্মা এই বৈরী পরিবেশের মাঝেও নতুন প্রজন্মকে নিয়ে যাচ্ছেন রমনা উদ্যানে তরুপল্লবের অনুষ্ঠানে। আগ্রহ সহকারে তাদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন গাছগাছালির সঙ্গে। নিবিড় উদ্ভিদজগতের সঙ্গে। প্রসন্ন প্রকৃতির সঙ্গে। নিসর্গপ্রেমী, উদ্ভিদবিজ্ঞানী, সৌন্দর্যপিয়াসী এই মানুষটি দীর্ঘদিন ধরে আমাদের বিপন্ন পরিবেশের কথা বলে উত্কণ্ঠা প্রকাশ করে গেছেন। তিনি ভাটির দেশের নানান গাছপালার সৌন্দর্যকে নিবিড়ভাবে উপভোগ করেছেন। তিনি রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতি চেতনায় গভীরভাবে আস্থাশীল। রবীন্দ্রনাথও বৈরী প্রাকৃতিক পরিবেশকে একদা সুষমামণ্ডিত করার প্রয়াসে ব্রতী হয়েছিলেন। দ্বিজেন শর্মা মুগ্ধতায় সেসব প্রয়াসের কথা জানিয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথের পরিকল্পিত শান্তিনিকেতন একসময় পরিচিত ছিল ভুবনডাঙ্গার ধূসর মাঠ হিসেবে। স্থানীয় অধিবাসীরা সেই অভিশপ্ত মাঠকে এড়িয়ে চলত। ১২ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ তার ঋষি পিতার সঙ্গে সেখানে প্রথম যান- অনুর্বর, রুক্ষ খোয়াইডাঙ্গার প্রান্তরে। তার ৬০ বছর পরে সেই স্মৃতিচারণা করেছিলেন, ‘আমার জীবন নিতান্তই অসম্পূর্ণ থাকত প্রথম বয়সে এই সুযোগ যদি আমার না ঘটত। সেই বালক বয়সে এখানকার প্রকৃতি থেকে যে আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম, এখানকার অনবরুদ্ধ আকাশ ও মাঠ, দূর হতে প্রতিভাত নীলাভ শাল ও তাল-শ্রেণীর সমুচ্চ শাখাপুঞ্জে শ্যামলা শান্তি স্মৃতির সম্পদরূপে চিরকাল আমার স্বভাবের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে।’
রবীন্দ্রনাথ ভুবনডাঙ্গার নিষ্করুণ মাঠের বৈরী পরিবেশকে নিষ্ঠার সঙ্গে নিসর্গমণ্ডিত করে তোলেন। তিনি সেই বিস্তীর্ণ প্রান্তরের বর্ণনা দিয়েছিলেন এভাবে-‘ছায়ার রৌদ্রে বিচিত্র লাল কাঁকরের এই নিভৃত জগত্ না দেয় ফল, না দেয় ফুল, না উত্পন্ন করে ফসল।’ সেরকম রুক্ষ প্রকৃতি ও পরিবেশ সচেতন মানুষের কল্যাণে পরিবর্তিত হয়। তারা এমনভাবে এক প্রসন্ন ভুবনকে সৃষ্টি করেন যে সেখানকার ছাতিমতলায় পাথরে খোদিত হয় ‘এখানে আত্মার আরাম’ বাক্যটি। প্রাণহীন, কঙ্করময় প্রান্তরকে তিনি প্রাণময় শিল্পে পরিণত করে গেছেন। শান্তিনিকেতন হয়ে উঠেছিল এক অনবদ্য নিসর্গ স্থাপত্য, যেন মরু বিজয়ের কেতন উড়েছিল সেখানে।
আজ যখন আমাদের ভূখণ্ডটি মরুকরণের বিস্তারে ক্রমশ ধূসর হয়ে আসছে, তখন দ্বিজেন শর্মার চেতনায় রবীন্দ্র প্রকৃতিচর্চার বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। আমরা রুক্ষতার অবসান চাই। প্রচণ্ড তাপপ্রবাহের অবসান চাই।
খোয়াইডাঙ্গার প্রান্তরে দেবেন্দ্রনাথ যে বীজ রোপণ করেছিলেন তাকে রবীন্দ্রনাথ পরম যত্নে লালন করেছেন। বর্ধিত করেছেন। শাখা-প্রশাখায় বিস্তৃত করেছেন। ফুলে-ফলে সমৃদ্ধ করেছেন। এই পরিবর্তনটি এতই স্মরণীয় যে অকুণ্ঠচিত্তে বলা চলে, ‘সেখানে মৃত্যুর মুখে ঘোষিত হয় বিজয়ী প্রাণের জয়বার্তা।’
রবীন্দ্রনাথের প্রেরণায় দিনে দিনে ঋতুতে ঋতুতে সেখানে রোমাঞ্চিত স্পন্দনের বিস্তার ঘটেছে। তাই লিখেছিলেন, ‘আমি ভালোবাসি গাছপালা, ওদের মধ্যে এই ভালোবাসার অনুভূতি প্রবেশ করে, ওদের কাছ থেকে সেই ভালোবাসারই পাই প্রতিদান।’
আমি ব্যক্তিগতভাবে অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মার প্রবল অনুরাগী। তাকে অনেকবার বলেছি-আপনি কিন্তু আমার কাছে রবীন্দ্রনাথের সেই কিশোর বলাই। যে গাছ কাটলে প্রবল যন্ত্রণা অনুভব করে।
আমার এই আবেগমথিত কথা শুনে দ্বিজেন শর্মা মৃদু হাসেন। মনে হয় আমার ধারণাটির তিনি বিরোধিতা করেন না। তিনি সঙ্কটের প্রতিবেশ বিষয়ে উত্কণ্ঠা প্রদর্শন করেন। তার পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকাশিত ‘প্রকৃতি পত্রে’ থাকে সেই উত্কণ্ঠার কথা। যাতে আমাদের সাম্প্রতিক সময় ক্লিষ্ট।
পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, বর্তমানে পৃথিবীর তাপমাত্রা হচ্ছে ৩.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তার দরুন জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে। ধনী দেশগুলোর কারণে কার্বন নিঃসরণ ঘটছে শতকরা ৫১ ভাগ। এই ভয়াবহ সমস্যার সমাধানকল্পে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে নানা আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিবারই মানুষ প্রবল আশা নিয়ে তাকিয়ে থেকেছে সম্মেলনগুলোর দিকে। শুভকর ফললাভের প্রত্যাশা করেছে। কিন্তু আশার বাণী শোনা যায়নি। সমাধানের জন্য বাস্তবভিত্তিক উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
সাম্প্রতিক সময়ে দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবানে অনুষ্ঠিত সম্মেলনের প্রতি গভীর আশায় তাকিয়ে ছিলেন উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতিনিধিরা। প্রত্যাশা ছিল ভালো পরিণতির। কিন্তু সেখানেও কোনো সুরাহা হয়নি। প্রশ্ন উঠেছে, পৃথিবী কি তাহলে এরকম স্বেচ্ছাচারিতায় নিয়ন্ত্রিত হতে থাকবে? পৃথিবীর সকল সম্পদের ওপর সবার সমান অধিকার রয়েছে।
আমাদের দেশের প্রধান পরিবেশবাদী লেখক অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা এখনও ৮৪ বছর বয়সে উদ্যানে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে গিয়ে গাছ চেনাচ্ছে। উদ্ভিদের প্রতি ভালোবাসা জাগাচ্ছেন। এই প্রচণ্ড তাপপ্রবাহের মাঝে তিনি কি আল মাহমুদের মতো বলবেন, ‘লোক নেই, জন নেই পানির পাশে। গাছগুলো মনে হবে দুঃখমাখা।’

লেখক : শিশুসাহিত্যিক

শবেমেরাজ ও শবেবরাত সামনেই

॥ মুস্তাফা জামান আব্বাসী ॥


রাজনীতি পথপরিক্রমণশীলদের প্রতিদিন কর্মসূচি; আজ জেল দিবস, কাল প্রতিবাদ দিবস, পরশু প্রত্যাবর্তন দিবসÑ দিবসের শেষ নেই। হিন্দুদের বারো মাসের তেরো পার্বন লেগেই আছে। মুসলমানদের কী? দিনের পর দিন কুরআনের পাতা খুলে বসা। যেখানেই আল্লাহর আহ্বান, সেখানেই আসন গেড়ে বসা। কুরআনই পথ, কুরআনই পাথেয়। রাসূলুল্লাহ সা:-এর জীবনের খোলা পাতা নতুন দিগন্তের সন্ধান। শবেমেরাজ সামনে এলে মুসলমান নতুন করে তালাশ করেন, খুলে বসেন সাহাবিদের নানা গ্রন্থ, যেগুলো তেমন খুঁজে পাওয়া যায় না আজ। তাদের মধ্যেÑ হজরত আনাস ইবনে মালেক রা:, উবাই ইবনে কাব রা:, বুরাইদা রা:, জাবেদ ইবনে আবদুল্লাহ রা:, হুজায়ফাহ ইবনে ইয়ামান রা:, সামুরাহ ইবনে জুনদুব, সাহার ইবনে সাদ, সাদ্দাদ ইবনে আউস, শোহায়েব আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস, মা আয়েশা, মা আসমা, উম্মে হানি, উম্মে সালমা প্রমুখ। তাদের সবার কথাই পড়া হয়ে থাকে এবং সবার কথার মধ্যে যে সাদৃশ্যটুকু, সেটাকেই মূল বলে ধরা হয়। এটি তিন-চার শ’ পৃষ্ঠা অধিকার করে আছে।
হজরত আনাস ইবনে মালেক রা: বলছেন হুজুরে পাক সা:-এর জবানিতেÑ একটি বোরাক নিয়ে আসা হলো; গাধার তুলনায় একটু বড়, খচ্চরের চেয়ে একটু ছোট, বায়তুল মুকাদ্দাসে পৌঁছে গেলাম; ভেতরে গিয়ে আদায় করলাম দুই রাকাত নামাজ। জিব্রাইল আ: নিয়ে এলেন দু’টি পাত্র, একটিতে শরাব, আরেকটিতে দুধ। আমি নিলাম দুধ। আবার বোরাকে সওয়ার হলাম। আসমানে অনেকক্ষণ চলার পর দরজা খুলে গেল, তাকে কে যেন জিজ্ঞেস করলেন, কে?
জিব্রাইল বললেন, আমি জিব্রাইল।
প্রশ্ন হলো, উনি কে?
উনি মুহাম্মদ সা:।
প্রশ্ন হলো, উনাকে কি ডেকে আনা হয়েছে?
জিব্রাইল বললেন, জি।
এর পরে দেখা হলো আদম আ:-এর সাথে। তিনি ‘মারহাবা’ বলে শুভকামনা জানালেন। দ্বিতীয় আসমানে দরজা খুললে একই প্রশ্ন। এখানে দেখা হজরত ঈসা আ: ও হজরত ইয়াহ্ইিয়া ইবনে জাকারিয়া আ:-এর সাথে। তৃতীয় আসমানে দেখা হজরত ইউসুফ আ:-এর সাথে, যিনি রূপ ও সৌন্দর্যের আকর। এরপর চতুর্থ আসমানে দেখা হজরত ইদ্রিস আ:-এর সাথে, যাকে দেয়া হয়েছে সুউচ্চ আসন। পঞ্চম আসমানে দেখা হজরত হারুন আ:-এর সাথে। ষষ্ঠ আসমানে হজরত মুসা আ:-এর সাথে। সপ্তম আসমানে হজরত ইব্রাহিম আ:-এর সাথে, ‘বায়তুল মামুরে’ তিনি ইবাদতরত; যেখানে সত্তর হাজার ফেরেশতা ইবাদত করতে প্রবেশ করে।
জিব্রাইল আ: পরে নিয়ে যান সিদরাতুল মুনতাহায়, যার বর্ণনা করতে মর্ত্যবাসী অক্ষম। সে এক অপূর্ব বৃক্ষ, যা ছিল আল্লাহর নির্দেশে অপূর্ব সাজে সজ্জিত। আল্লাহ আমাকে দিলেন এক অপূর্ব নিয়ামত, যা হলো তার প্রতি প্রতি মুহূর্তে ভালোবাসার নির্যাস। পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজ, যা ছিল তাঁর সর্বোৎকৃষ্ট উপহার। এগুলো ফরজ নামাজ, যা পালন করলে মানুষ আর কোনো ভুল করতে পারবে না, আল্লাহর সাথে থাকবে তার সার্বক্ষণিক যোগাযোগ। আল্লাহর এই অপূর্ব দান মাথায় করে আনার সময় প্রথম যার সাথে দেখা, তিনি হজরত মুসা আ:।
জিজ্ঞেস করলেন, কী নিয়ে এসেছেন?
বললাম : আমার উম্মতের জন্য বহন করে নিয়ে এসেছি পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজ।
মুসা আ: বললেন : আমার মনে হয় আপনি আরেকবার যান সেখানে। এর ভার উম্মত বইতে পারবে না। বনি ইসরাইলের ক্ষেত্রে এটি পরীক্ষিত। আপনার এবং আপনার উম্মতের মধ্যে এ ফরজ পালনের সামর্থ্য নেই; কেননা বনি ইসরাইলের ওপর মাত্র দুই ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করা হয়েছিল, তারা এটি পালন করতে পারেনি। এরপর রাসূলে পাক সা: কয়েকবার আল্লাহর কাছে যাতায়াত করলেন এবং সর্বশেষ আল্লাহর তরফ থেকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের ফয়সালা হলো।
বেহেশতের আঙিনায় পৌঁছে জিব্রাইল আ: বললেন, হে মুহাম্মদ সা: আপনি কি রবের কাছে বেহেশতের হুর দেখার আবেদন করেছেন?
তিনি বললেন, হ্যাঁ।
হুজুরে পাক সা: তাদের কাছে গিয়ে সালাম বিনিময়ের পর জিজ্ঞেস করলেন,
আপনারা কারা?
তারা বললেন, আমরা সৎ কর্মশীল সুশীলা সুন্দরী। যারা পাকপবিত্র লোকদের স্ত্রী, আমাদের মধ্যে কখনো বিচ্ছেদ হবে না। আমরা অনন্তকাল ধরে জীবিত থাকব। মৃত্যু কখনো স্পর্শ করবে না আমাদের। এভাবে প্রতিটি সাহাবার কাছে বৃত্তান্ত পৌঁছেছে; কোনো বৃত্তান্তের সাথে আরো কিছু যোগ হয়েছে বটে, কিন্তু কোনোটির সাথে কোনোটির কোনো বিরোধ ঘটেনি। মেরাজে যা পাওয়া গেছে তার নাম সালাত, যেটি মুসলমানদের জন্য সবচেয়ে বড় উপহার।
শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতেই অর্থাৎ ১৫ তারিখের পূর্বরাতই শবেবরাত। হাদিসে নববীর মাঝে তাকে লায়লাতুন নিসফি মিন শাবান অর্থাৎ অর্ধশাবানের রাত বলা হয়েছে। ইসলামি তারিখ মতে, সূর্যাস্তের পর থেকে তারিখ ধরা হয়। শবেবরাতের বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে ওলিরা বলছেনÑ
* আল্লাহর সাথে সম্পর্ক গভীর করার মাধ্যম এ রাত। * আত্মশুদ্ধির মন্ত্রে উদ্দীপ্ত হওয়ার অছিলা এ রাত। * মানবিক দুর্বলতা থেকে মুক্তি এবং বিশুদ্ধ বাসনা পূর্ণ করার উপায় হলো এ রাত। * সাধারণ ক্ষমার রাত। * সাম্য ভ্রাতৃত্ব ও গরিব-দুঃখীদের প্রতি সমবেদনা প্রকাশের রাত। * শবেবরাতে খোদ আল্লাহ তায়ালা ডাকতে থাকেন বান্দাদের। * এই রাত জীবিকা বণ্টনের রাত। * এই রাত ভাগ্য নির্ধারণ করার।
যারা বঞ্চিত হবেন এ রাতে, তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে। তাহলে বঞ্চিতরা এই দুই মাস চেষ্টা করুন এই লিস্ট থেকে নাম কাটানোর। তারা হলোÑ
১. যারা শিরক করবে। দেশ ভরে গেছে শিরকের সওদায় ব্যক্তি মুসলমানদের দিয়ে, যারা নামে মুসলমান, কর্মে নয়। আল্লাহকে বিশ্বাস করেন শুধু মুখে, কর্মে নয়। যখন কিছু বলেন, ইসলামের বিরুদ্ধে বলেন; ইসলামি কওমের বিরুদ্ধে বলেন; সব সময় মুসলমানদের খোঁটা দিয়ে কথা বলেন; অথচ মুসলমানদের ধর্মে স্থিত হওয়ার সব রকমের সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নিয়েছেন। এদেরকে মুরতাদ বলা হয়নি ভদ্রতা করে, কারণ আল্লাহ চট করে মুরতাদ বলা পছন্দ করেন না। এদের কর্মকাণ্ড প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মুরতাদের বর্ণনার সাথেই মিলে যায়। আল্লাহ এদের মাফ করুক। যদি আমি তেমনটি হয়ে থাকি, তাহলে আমাকেই প্রথমে মাফ করে দেয়া হোক। ২. পিতা-মাতার অবাধ্যতা। যারা অবাধ্য, তারা সারা রাত নামাজ পড়লেও কাজ হবে না, বিশেষ করে যারা মাদকদ্রব্য গ্রহণ করেন, তারা পিতা-মাতার অবাধ্য, তাদের কোনো ইবাদত গ্রহণ করা হবে না। ৩. আত্মীয়তা ছিন্নকারী, বড়লোক, যারা গরিব আত্মীয়দের বাড়িতে ঢুকতে দেন না, টেলিফোন করলে টেলিফোন কেটে দেন, সামাজিক অনুষ্ঠানে সালাম দিলে উত্তর দেন না, এমন বড়লোকদের সে দিন দেখা যায় মসজিদে বড় বড় গাড়ি করে প্রবেশ করতে। এদের ইবাদত আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। কোনো দান ছুড়ে দেয়া যাবে না, বরং সেই দান গ্রহণ করে আত্মীয় তার উপকার করেছেন, এই মনোভাবই ফুটিয়ে তুলতে হবে। সমাজে দেখছি বড়মানুষী, এমনকি আমিও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত কি না, আমাকে ভেবে দেখতে হবে। নিজকে নিষ্কলুষ ভাবব তা হবে না, হিসাব খুব সূক্ষ্ম। তবে ন্যায়সঙ্গত কারণে আত্মীয়তা ছিন্ন করেছে, এমন উদাহরণ থাকতে পারে। ৪. অন্যের প্রতি ঈর্ষা পোষণকারী। রাজনীতি, ব্যবসায়, শিক্ষা-সংস্কৃতি প্রভৃতি জগতে আধিপত্য দেখছি ঈর্ষাকারীদের। কেউ কাউকে সহ্য করতে পারছেন না, বিশেষ করে রাজনীতির জগতে তা প্রকট। কেউ কারো লেখা পড়ি না, কেউ কারো কবিতা পড়ি না; গান শুনি না। আমি সবার চেয়ে বড়, এই জ্ঞান ঈর্ষার নামান্তর। এমনকি আপনারা শুনে অবাক হবেন, কিছু আলেম পর্যন্ত সর্বকারী। মনে করছেন, তিনি ছাড়া অন্যরা যাবেন দোজখে, সালামটিও গর্বিতভাবে গ্রহণ করেন। আমি যে একজন সামান্য লেখক হিসেবে এই লেখা লিখছি, এটাও কিছু আলেমের অপছন্দ। ভাবছেন, ইনি মাদরাসায় পড়েননি, লেখাটি আমার আলোচ্য গণ্ডির মধ্যে পড়ে না। টেলিভিশনে আলোচনা করতে গিয়ে দেখেছি, আমার দিকে তাকাচ্ছেন যেন করুণার চোখে। এদের সম্পর্কে সবিস্তারে বর্ণনা আছে। এই অধম লেখক যে নবী করীম সা:-এর ওপর গ্রন্থ রচনা করেছি, সেটা তারা এক দিনও পড়ে দেখেননি। এরই নাম ঈর্ষা। এদের ইবাদত কবুল হবে কি? ৫. তিন দিনের বেশি সময় সম্পর্ক ছেদনকারী। রাগ হলে তা থাকতে হবে সর্বোর্ধ্ব তিন দিন, এর বেশি নয়। তা না হলে ওই দিন রাতে ইবাদতে কাজ হবে না। মেয়েদের সতর্ক থাকতে হবে, তাদের রাগ অনেক সময় হয় চণ্ডালের মতো। মুসলমান রমণীরা যেন তা না হয়। ৬. যারা জাদুকর, তাদের ইবাদত গ্রহণ করা হবে না। সমাজে জাদুবিদ্যা বেশ ভালোভাবেই জমে উঠেছে, এটি ইসলামি মতে গ্রহণযোগ্য নয়। নতুনদের মধ্যে যারা জাদুবিদ্যা শিখতে যান, তাদের বিনম্রভাবে জানাতে হবে যে, এটি আল্লাহ পছন্দ করেন না। এই রাতে জাদুকরদের কোনো ইবাদত গ্রহণযোগ্য হবে না, তিনি যত বড়ই হোন, যত নাম করে থাকুন। ৭. জ্যোতিষবিদ্যা গ্রহণযোগ্য কি না জানি না, তবে গণক গ্রহণযোগ্য নয়; যত বড় গণকই হোক, তার এবাদত কবুল হবে না। ৮. গণক না হলেও কেউ কেউ গণকের কাছে যান। কোনো বন্ধু বলেছেন যেতে, ‘গণক পাথর সংগ্রহ করে রাখবেন ও বিরাট সম্মানের অধিকারী হব আমি’। যাইনি, টেলিফোন করেছিলাম। টেলিফোনে কণ্ঠ শুনেই শনাক্ত করতে পেরেছেন যে, বিরাট পদ পেতে চলেছি, মন্ত্রীও হতে পারি। বললেন বেশ কিছু টাকা নিয়ে দেখা করতে এবং ইত্যবসরে উনি সবচেয়ে দামি পাথর সংগ্রহ করে রাখবেন। আল্লাহর শুকুর, ওর কাছে যাইনি, পাথর পরিনি, পদ পাইনি, মন্ত্রী হইনি। সুখে আছি, যেটা সবচেয়ে প্রয়োজন। গণকের কাছে যারা যাবে, তারা এই রাতের কোনো উপকার পাবে না। ৯. সুদখোর। ব্যাংকের সুদ খাবে যারা, বিপদে তারা। ইসলামি ব্যাংকগুলোতে টাকা রেখেও গভীর চিন্তায় রয়েছি যে ৯ নম্বর সূত্রে বাদ পড়ব কি না। ১০. মদ্যপায়ী। মদ খান যারা, সমাজের উচ্চস্তরে তাদের অবস্থান। ইবাদত করার ফুরসত কোথায়, বরং এ রাতেও মশগুল রঙিন সুরায়। শবেবরাত যেন হাস্যকর প্রক্রিয়া, কারণ ওরা তাকে, এ পৃথিবীতেই বেহেশত হাসিল, অর্থ, প্রতিপত্তি, সুরা, নারী করায়ত্ত। আল্লাহর প্রয়োজন কী? ১১. ব্যভিচারী। যারা আল্লাহর কাছে অপছন্দনীয় ব্যভিচার জীবনে অভ্যস্ত, তাদের এ রাতে হাত না তুললেও চলবে। ১২. কৃপণ। যাদের অনেক অর্থ আছে, তাদের মধ্যে যেমন কৃপণ বেশি, আবার কিছু লোক যারা স্বভাবকৃপণ। অন্যের প্রশংসা করতে জানে না, অন্যের ভালো হলে মন খারাপ করে, পকেটে পয়সা থাকলেও কোনো দিন দানের কথা মনে করে না, তারা আল্লাহর কাছে সারা রাত ধরে হাত পাতলেও লাভ হবে না। ১৩. সব রকমের নেশা বর্জন করতে হবে, হোক তা ধূমপান, মাদক। তারা আল্লাহর করুণা থেকে হবে বঞ্চিত। ১৪. যে ব্যবসায়ী মিথ্যা শপথ করবে, কোর্টে মিথ্যা সাক্ষ্য দেবে, তার জন্য লানত বা অভিশাপ। সে কিছুই পাবে না। ১৫. যে শাসক অত্যাচার করবে, সে হবে লানতের ভাগী। কোনো দিন তার কোনো ইবাদত কবুল হবে না। ১৬. অন্যের অপ্রশংসা করে চলেছে, একজনের কথা আরেকজনকে বলে চোগলখোরি করেছে, তার কোনো ইবাদত কবুল হবে না।
ষোলটি শর্ত পালন করা যেমন সহজ, তেমনি কঠিন। আসলে খুবই সহজ।
ওই রাতে সূর্যাস্তের পরই আল্লাহ তায়ালা নেমে আসেন সর্বনিম্ন আসমানে। বান্দাদের ডেকে বলেনÑ ওহে, আছো কোনো ক্ষমাপ্রার্থী, ক্ষমা করব; আছো কোনো রিজিকপ্রার্থী, রিজিক দেবো; আছো তওবাকারী, তওবা কবুল করব; সুবহে সাদেক পর্যন্ত আল্লাহ তার রহমতের তিন শ’ দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়ে বলতে থাকেনÑ আজ যে যা চাও, তা-ই পাবে।
ইশার নামাজের পর তেলাওয়াত করতে থাকুন, মৃতদের জন্য মাগফিরাত, গরিব-মিসকিনদের জন্য দান, জিকির ও দরুদ, পরের দিন রোজা। পরের জন্য উৎসর্গীকৃত এমন ধর্ম ও জীবনবোধ, পৃথিবীতে আর খুঁজে পাওয়া যাবে কি? ২৬ মে ২০১২
লেখক : সাহিত্য ও সঙ্গীতব্যক্তিত্ব
mabbasi@dhaka.net

একা একটি তরুণী এবং কয়েকজন পুলিশ

ফারুক ওয়াসিফ | তারিখ: ০১-০৬-২০১২
তিনজন পুলিশ মিলে একটি মেয়েকে পেটাচ্ছে। প্রথম আলোর ছবি। পুলিশের হিংস্র মুখ, বর্বর লাঠি, সব স্পষ্ট। কেবল অস্পষ্ট মেয়েটির মুখ। সামাজিক বিড়ম্বনার কথা ভেবে ছবিতে অস্পষ্ট করে রাখা হয়েছে তার মুখচ্ছবি। ঘটনার শুরুতে যে মেয়েটিকে আমরা নিপীড়িত চেহারায় দেখি, ঘটনার শেষে তাকেই ফিরে পাই বীরোচিত সংগ্রামের নায়িকা হিসেবে। যদি সে নারী না হতো, যদি আমাদের দেশে নারীকে কেবল নিপীড়িতা বা কলঙ্কিতা চেহারায় দেখার ও দেখানোর কুঅভ্যাস জারি না থাকত, তাহলে বীরের বন্দনা মেয়েটির প্রাপ্য হতো।
তার নিপীড়ন যতটা সত্য, ততটাই সত্য তার প্রতিবাদের সাহসিকতা, তার আত্মমর্যাদা রক্ষার জেদ। নারীর ওপর আরোপিত ভাবমূর্তি ভেঙে নির্যাতন মোকাবিলা করাই এই প্রায়-কিশোরী ক্লাস এইট পাস, নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েটির প্রধান সার্থকতা। হে মেয়ে, তোমার মুখ যে আমাদের অস্পষ্ট করে দিতে হলো, সেটা আমাদের পুরুষালি মনেরই সমস্যা। অন্য সময়, অন্য সমাজ হলে তোমার মুখ দেখার জন্য, তোমাকে অভিনন্দন জানানোর জন্য অজস্র মানুষ ছুটে আসত। অথচ আমাদের দুর্বলতা ঢাকতে আমরা তোমাকেই লুকিয়ে রাখছি।

স্পষ্ট পুলিশ ও অস্পষ্ট মুখের সেই মেয়েটি
অস্পষ্ট মুখের সেই মেয়েটি সব স্পষ্ট করে দিয়েছে। পুলিশ কতটা নির্যাতক, পুলিশ কতটা যৌন নিপীড়ক এবং পুলিশ কতটা আইন ও অধিকারের বিপরীত শক্তি। নিজের শরীরে পীড়নের চিহ্ন বয়ে সে এই সত্য আবারও প্রমাণ করছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন ‘ভালো’ পুলিশের সার্টিফিকেট দিচ্ছেন, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী যখন পুলিশ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকতে বলেছেন, তখন সেই ‘ভালো’ পুলিশ মেয়েটি ও তার পরিবারকে নিরাপদ দূরত্বে থাকতে দেয়নি। কিন্তু আর দশটি নির্যাতনের ঘটনা থেকে এই ঘটনা খুবই আলাদা। মেয়েটি এখানে নীরবে সহ্য করেনি, পালিয়ে বাঁচতে চায়নি বা অপমানে আত্মহত্যা করে বসেনি। এখানে সে রুখে দাঁড়িয়ে সাংবাদিক, আইনজীবী, মানবাধিকারকর্মীসহ নাগরিকদের পথ দেখিয়েছে।
আদালতের গা-ঘেঁষেই পুলিশ ক্লাব। তার সামনের রাস্তায় মা-বাবার সঙ্গে ভাগাভাগি করে প্রথম পিটুনি খায় সে। তারপর তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় ক্লাবের ভেতরে। সেখানে যা হয় তার সঙ্গে কোনো মাফিয়া নির্যাতনকেন্দ্রের পরিস্থিতিরই তুলনা চলে। এক ঘরে বাবাকে পেটানো হচ্ছে। অন্য একটি ঘরে একা সেই তরুণী এবং তাকে ঘিরে কয়েকজন উদগ্র পুলিশ। তার সঙ্গে যা করা হয়েছে, তার সঠিক নাম পুলিশি সন্ত্রাস ও যৌন নিপীড়ন। সরকার আমাদের বলেছিল, নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে পুলিশকে জিরো টলারেন্স দেখাতে বলা হয়েছে। সেই পুলিশ এমনই পুলিশ, যে নিজেই অবতীর্ণ হয়েছে যৌন নির্যাতকের ভূমিকায়। নাগরিকের নিরাপত্তার সহায় পুলিশ এখন ভয়ের ডাকনাম।

রাষ্ট্র বনাম পরিবার
এই ঘটনায় আক্রান্ত হয়েছে পরিবার। মা, বাবা ও কন্যা—তিনজন তিন ঘরে আটক। সেই মা এক কানে তাঁর স্বামীর চিৎকার শুনছেন, অন্য কানে শুনছেন মেয়ের আর্তনাদ। পুলিশ কিছুই শুনছে না। তারা বধির। তারা পিটিয়ে যাচ্ছে, নির্যাতন করেই যাচ্ছে। তখনই মা, মেয়ে আর বাবার কান্নার ধ্বনি একাকার হয়ে লাঞ্ছিত মানবতার হাহাকার হয়ে ওঠে। এই হাহাকার এই মুহূর্তে বাংলাদেশে নিপীড়িত মানবতারই ডাক।
সেই হাহাকার শুনেই বোধ হয় পুলিশের অন্য কয়েকজন কর্মকর্তা এসে তাঁদের উদ্ধার করেন। যদি তাঁরা সাড়া না দিতেন, যদি তাঁরা বাকিদের মতো অমানুষই হয়ে থাকতেন, তাহলে হয়তো আরেকটা ইয়াসমিন, আরেকটা সীমা চৌধুরীর পরিণতি হতে পারত। কয়েকজন কর্মকর্তার এই সাড়া বিপর্যয়ের মধ্যে ক্ষীণ আশার আলামত হতে পারত। কিন্তু হয়নি।
পুলিশ এবার ‘সত্যিকার’ পুলিশি কারবার শুরু করে দিল। সেই হস্তক্ষেপ করা কর্মকর্তারা পরিবারটির কাছে ক্ষমা চাইলেন না, অপরাধ করা পুলিশদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও ভাবলেন না। তাঁরা ভাবলেন পরিবারটিকে আটকে রেখে ‘কুকীর্তি’ গোপন করবার কথা। পুলিশ তারপর পুলিশি কায়দাতেই বাপ-বেটি আর মাকে ধরে কোতোয়ালি থানায় নিয়ে যায়। বাবার স্থান হয় হাজতে আর মা-মেয়েকে রাখা হয় একটি ঘরে। রাত ১০টা পর্যন্ত গরাদের ভেতর-বাইরে তারা কোনো একজন ত্রাণকর্তার অপেক্ষা করছিল।
এই সময়ে কি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে খবর গিয়েছিল? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অথবা স্বরাষ্ট্রসচিবের কিছু করণীয় ছিল কি? মানবাধিকারকর্মী, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল যা করেছেন, তাঁদের উচিত ছিল সেই কাজটিই করা। তাহলে অন্তত আইন ও সরকারের কার্যকারিতার একটা নমুনা মিলত। কিন্তু মেলেনি। রাষ্ট্রের একক হলো পরিবার। পরিবার না টিকলে রাষ্ট্র টিকবে না। একটি পরিবার যেখানে বিপন্ন, সেই বিপন্নতার জন্য দায়ী যেখানে স্বয়ং রাষ্ট্র, সেখানে রাষ্ট্রীয় হর্তাকর্তাদের উদাসীনতা কি রাষ্ট্রের পক্ষে যায়?

সভ্যতার শেষ প্রহরীরা
আইনের রক্ষকের দায়িত্বে থাকা সরকার যেখানে আইনি সংস্থার আইনভঙ্গে বিচলিত হচ্ছে না, সেখানে নাগরিকদেরই নিজেদের অধিকার রক্ষায় এগিয়ে আসতে হয়। এত কথা হয়তো মেয়েটি ভাবেনি। সহজাত আত্মরক্ষার প্রবৃত্তির বশেই হয়তো মা ও মেয়ে করণীয় ঠিক করে। ঘটনা প্রবেশ করে দ্বিতীয় পর্বে। বিকেলের দিকে তারা থানা থেকে বেরিয়ে সেই আদালত চত্বরেই ফিরে আসে, যেখান থেকে তাদের দুর্ভাগ্যের শুরু হয়েছিল এবং যা নাকি ন্যায়বিচারের তীর্থভূমি। উপস্থিত সাংবাদিক ও আইনজীবীদের কাছে তারা ফরিয়াদ করে, তারা সাহায্য চায়। বেশ কয়েকজন সাংবাদিক এবং আইনজীবী তাঁদের ডাকে সাড়া দেন। দফায় দফায় মার খেয়েও এই সাংবাদিকদের বোধ হয় শিক্ষা হয়নি। তরুণ আইনজীবীদেরও হয়তো মনে পড়েছিল, আইনজীবিতা শুধু ব্যবসায় নয়, দায়িত্বও বটে। মেয়েটির পাশে দাঁড়িয়ে তাঁরা বোঝালেন, মানুষ আছে এখনো। সেই মানুষেরা সবাই ‘পুলিশ’ হয়ে যায়নি। ওদিকে পুলিশ তো জেনে গেছে, সাংবাদিক পেটালে কিছু হয় না। আইনজীবী পেটালে কিছু হয় না। তারা এবার সাংবাদিক-আইনজীবী পেটায় এবং মা-মেয়েসহ প্রতিবাদী আইনজীবী ও সাংবাদিকদের থানায় ধরে নিয়ে আটকে রাখে।
বাকি ঘটনাও সবার জানা। সুলতানা কামাল ছুটে আসেন, আটককৃতদের না নিয়ে থানা ছাড়বেন না বলে জেদ ধরেন এবং রাত পৌনে ১০টায় তাঁরা সবাই ছাড়া পান। অস্পষ্ট মুখের তরুণীর সাহসিকতায় যে করুণ নাটকের শুরু, সুলতানা কামালের অসাধারণ দায়িত্বনিষ্ঠায় তা উপসংহারে পৌঁছায়। এক নারীর প্রতিবাদ আর আরেক নারীর দায়িত্ব পালনে প্রমাণ হয়, মানবতার গতি করতে ঝুঁকি নিতে হয়।
এ অবস্থায় সাংবাদিক আর আইনজীবীদের দায়িত্ব অনেক বেড়ে যায়। সাংবাদিক কেবল সংবাদ সংগ্রাহক নন। জনগণের অংশ হয়ে থাকা, জনস্বার্থের পক্ষে থাকা আর সৎ থাকার দায় তাঁদের রয়েছে। কারণ, তাঁদের পেশাটাই অন্যায় ও মিথ্যার বিরুদ্ধে। তাঁরা ভীত হলে বা আপন গর্তে মুখ লুকালে দাপট আর মিথ্যাই জয়ী হবে। আইনকে মানুষের পক্ষে ধরে রাখার দায় আইনজীবীরাও এড়াতে পারেন না। নির্যাতিত মেয়েটির পাশে দাঁড়িয়ে, মার খেয়ে তাঁরা প্রমাণ করেছেন অসভ্যতার বিরুদ্ধে তাঁরাই সভ্যতার শেষ প্রহরী। এ কথাটি অনেক দিন আমরা ভুলে ছিলাম। ক্রমাগত মানবাধিকার লঙ্ঘনের তালিকায় নিহত বা আহত সাংবাদিকদের নাম যুক্ত হওয়ার এই বাস্তবতায় আর ভুলে থাকার সুযোগ নেই। যদি থাকি, তাহলেআমাদের ভূমিকা ছবির ওই কলাপসিবল গেটের শিকধরে দাঁড়িয়েথাকা মানুষগুলোর মতোই অথর্ব হয়ে যাবে।

কোথাও কেউ নেই?
এই ঘটনার একটি শিক্ষা আছে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গবেষক আকবর আলি খানের কথায় সেটাই উচ্চারিত হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় এক সভায় তিনি বলেছেন, ‘সর্বক্ষেত্রে নাগরিকদের সজাগ, সক্রিয় ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে, প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। না-হয় দুঃশাসন দেখা দেবে।’ নাগরিক নজরদারি, প্রতিবাদ ও নাগরিক সংহতি ছাড়া যে বাঁচা যায় না, অস্পষ্ট মুখের ওই মেয়েটি সেটাই জানিয়ে গেল। বুঝিয়ে দিল ভয়, নিরাপত্তাহীনতা আর দুঃশাসনই শেষ কথা নয়।
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com

উপমহাদেশের সাংবাদিকতা জগতের পথিকৃৎ

শেখ আবদুস সালাম
বাঙালিকে গভীরভাবে ভালোবেসেছিলেন মানিক মিয়া। সাংবাদিকতা চর্চায়, তার লেখায় এই ভালোবাসা নানাভাবে প্রতিমূর্ত হয়ে উঠেছিল। সময় ও সমাজ বদলের মোক্ষম হাতিয়াররূপে তিনি বেছে নিয়েছিলেন সাংবাদিকতা পেশাকে। সুদূরপ্রসারী মিশন ও ভিশন নিয়ে একজন সুদক্ষ ও সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিক হিসেবে তিনি তার পত্রিকা দৈনিক ইত্তেফাকের মাধ্যমে গড়ে তুলেছিলেন বিশাল পাঠকগোষ্ঠী

তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া উপমহাদেশের সাংবাদিকতা জগতের অন্যতম পথিকৃৎ কলমসৈনিক। ডাক নাম মানিক মিয়া। ছদ্মনাম মুসাফির। গতানুগতিক কলমজীবী না হয়ে আদর্শ রাজনীতি ও সমাজচেতনার কালপুরুষরূপে তিনি এ দেশের সাংবাদিকতায় এক কালজয়ী অবদান রেখে গেছেন। কলমসৈনিক ও রাজনীতিবিদ মানিক মিয়ার কর্মকাণ্ড ছিল বিশাল অবয়বে পরিব্যাপ্ত। জাতীয় রাজনীতির অতন্দ্র প্রহরী মানিক মিয়া তার আদর্শ ও কর্মনিষ্ঠা দিয়ে বাঙালির ইতিহাসে এক চিরস্মরণীয় স্থান করে নিয়েছেন।

তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ছিলেন গণতান্ত্রিক রাজনীতির অন্যতম দিকপাল হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠ অনুসারী। সহকর্মী ও সহমর্মী হিসেবে এ দেশের রাজনীতির সঙ্গে তার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক ছিল। এই সম্পর্ক বা যোগসূত্রেরই কার্যকর প্রতিফলন ঘটে তার 'রাজনৈতিক মঞ্চ' কলামের মধ্য দিয়ে। রাজনীতি ও সমাজ সচেতনতায় তার প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার কারণে সে সময় তার কলামটি হয়ে ওঠে দেশবাসীর জন্য রাজনীতির এক দূরশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানস্বরূপ। রাজনীতি ছাড়াও তার কলামে স্থান পেয়েছে অর্থনীতি, সমাজনীতি, শিক্ষা ও সংস্কৃতিসহ জীবনঘনিষ্ঠ নানা প্রসঙ্গ। বস্তুত তার বহুল পঠিত ও আলোচিত কলামের মাধ্যমে তার জীবদ্দশায় তিনি হয়ে ওঠেন একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠান ও পথিকৃৎ জাতীয় ব্যক্তিত্বরূপে।
১৯৪৬ সালে শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলকাতা থেকে 'ইত্তেহাদ' নামের একটি বাংলা পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। আবুল মনসুর আহমেদকে 'দৈনিক ইত্তেহাদে'র সম্পাদক নিযুক্ত করা হয়। মানিক মিয়া এ সময় মুসলিম লীগ অফিসের চাকরি ছেড়ে দিয়ে 'ইত্তেহাদে'র পরিচালনা বিভাগে সেক্রেটারি হিসেবে যোগ দেন। ব্যবস্থাপনা দক্ষতা ও সাংগঠনিক ক্ষমতা দিয়ে এ সময় তিনি সবাইকে মুগ্ধ করেন। সাংবাদিকতায় মানিক মিয়ার প্রত্যক্ষ ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের সূত্রপাত ঘটে এই পত্রিকার মাধ্যমেই। আর এ সময় থেকেই তার রাজনৈতিক রচনার হাতেখড়ি। এক বছরের কিছু বেশি সময় তিনি এই পত্রিকাটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকাটি সে সময় সব দিক দিয়েই একটি প্রথম শ্রেণীর বাংলা দৈনিক ছিল। কিন্তু ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর রাজনৈতিক কারণে এ পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে গেলে মানিক মিয়া ঢাকায় চলে আসেন।
১৯৪৯ সালে মুসলিম লীগের বিরোধী সংগঠন হিসেবে আওয়ামী মুসলিম লীগের আত্মপ্রকাশ ঘটলে সে বছরই এই নতুন দলের মুখপত্র হিসেবে প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক ইত্তেফাক। আওয়ামী মুসলিম লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী তখন পত্রিকাটির সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নেন। এরপর ১৯৫১-এর ১৪ আগস্ট থেকে এই পত্রিকার সম্পাদক নিযুক্ত হন তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে ১৯৫৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর তার সম্পাদনায় সাপ্তাহিক ইত্তেফাক দৈনিকরূপে আত্মপ্রকাশ করে। ইত্তেফাক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে মানিক মিয়া ধীরে ধীরে পত্রিকাটিকে মুসলিম লীগবিরোধী ও পূর্ব বাংলার বঞ্চিত জনগণের মুখপত্র হিসেবে গড়ে তোলেন। ইত্তেফাক অল্পদিনেই সাধারণ পাঠক তথা গণমানুষের পত্রিকা হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবির পেছনে দৈনিক ইত্তেফাক সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছিল। আর এ ক্ষেত্রে 'মুসাফিরে'র 'রাজনৈতিক মঞ্চ' কলামটি বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল।
মানিক মিয়া মুসাফির ছদ্মনামে 'রাজনৈতিক মঞ্চ' কলামটিতে অত্যন্ত সহজ-সরল ভাষায়, অন্তরঙ্গ অথচ তীক্ষষ্টভাবে মুসলিম লীগ সরকারের নানা বৈষম্য, অবিচার, অত্যাচার ও বঞ্চনার কাহিনী তুলে ধরতেন। পাঠকরা পরম আগ্রহভরে এই কলামটি পড়ার জন্য অপেক্ষা করত এবং পত্রিকাটি হাতে পেলে যেন গোগ্রাসে তা পড়ে ফেলত।
১৯৫৪ সালের পর পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে যে ভাঙা-গড়ার সূত্রপাত হয়, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব বাংলার ওপর যে বৈষম্য, অবিচার আর বঞ্চনা চাপিয়ে দেয় তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া তার তীব্র বিরোধিতা করেন। আগুন ঝরা লেখনীর মাধ্যমে স্বৈরশাসনের মুখোশ উন্মোচন করেন। আর তাই স্বর্থান্বেষী কেন্দ্রীয় শাসকচক্র তার লেখা সহ্য করতে পারেনি। তাকে বারবার রাজরোষে পড়তে হয়েছে। কারাবরণ করতে হয়েছে তাকে বহুবার। তার পত্রিকা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। প্রেস বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইনের চোখে তাকে কখনোই দোষী সাব্যস্ত করতে পারেনি।
১৯৫৫ সালে ইত্তেফাকের প্রকাশনা কিছুদিনের জন্য বন্ধ রাখে কেন্দ্রীয় সরকার। ১৯৫৯ সালে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে সামরিক আইন লঙ্ঘনের মিথ্যা অজুহাতে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৬২ সালে আইয়ুব সরকার হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেফতার করলে পূর্ব বাংলায় যে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছিল, তা দমনের জন্য অন্য অনেক নেতার সঙ্গে মানিক মিয়াকে আবারও গ্রেফতার করা হয়। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলনের ডাকে পূর্ব বাংলায় যে হরতাল পালিত হয়, সে সময়ও মানিক মিয়াকে গ্রেফতার করা হয় এবং সে সঙ্গে 'নিউ নেশন প্রেস' বাজেয়াপ্ত করা হয়। ফলে ইত্তেফাক বন্ধ হয়ে যায়। পরে অবশ্য প্রেস বাজেয়াপ্তের বিরুদ্ধে হাইকোর্টের রায়ে তিনি জয়লাভ করেন। কিন্তু স্বৈরাচারী আইয়ুব সরকার অর্ডিন্যান্স সংশোধন করে দ্বিতীয়বার এ প্রেস বাজেয়াপ্ত করে। এ সময় মানিক মিয়া দীর্ঘ ১০ মাস কারাভোগ করেন। ১৯৬৯ সালে গণআন্দোলনের ফলে আইয়ুব সরকার পুনরায় ইত্তেফাক প্রকাশের অনুমতি দিতে বাধ্য হয়। নৈতিক বিজয়ের মধ্য দিয়ে ১৯৬৯
সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ইত্তেফাক পুনঃপ্রকাশিত হয়।
ইত্তেফাকের সাংগঠনিক কাজে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ১৯৬৯ সালের ২৬ মে রাওয়ালপিন্ডি গমন করেন এবং
১ জুন সেখানকার এক হোটেলে
তিনি আকস্মিকভাবে মৃত্যুমুখে
পতিত হন।
বাঙালিকে গভীরভাবে ভালোবেসেছিলেন মানিক মিয়া। সাংবাদিকতা চর্চায়, তার লেখায় এই ভালোবাসা নানাভাবে প্রতিমূর্ত হয়ে উঠেছিল। সময় ও সমাজ বদলের মোক্ষম হাতিয়াররূপে তিনি বেছে নিয়েছিলেন সাংবাদিকতা পেশাকে। সুদূরপ্রসারী মিশন ও ভিশন নিয়ে একজন সুদক্ষ ও সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিক হিসেবে তিনি তার পত্রিকা দৈনিক ইত্তেফাকের মাধ্যমে গড়ে তুলেছিলেন বিশাল পাঠকগোষ্ঠী।
সমাজসেবার ক্ষেত্রেও মানিক মিয়ার ভূমিকা ছিল অনন্য। পিরোজপুর জেলার বহু স্থানে বিশেষ করে জন্মস্থান ভাণ্ডারিয়া এলাকায় তিনি বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

ড. শেখ আবদুস সালাম :অধ্যাপক গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা

বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সোনালি সূর্য, চড়ূইয়ের খেলা, ক্ষুধার দর্শন

আলী যাকের
একদিন সাইকেলে করে আশুলিয়ার পথ ধরলাম। পেঁৗছে গেলাম তুরাগ নদের ধারে সেই জায়গায়, যেখানে রাস্তাটি ত্রিধারায় বিভক্ত হয়েছে। একটি ঢাকা থেকে এসেছে, একটি চলে গেছে আশুলিয়া হয়ে নবীনগর-চন্দ্রা রাস্তার দিকে, আর একটি ঢাকার অদূরে অবস্থিত উদ্ভিদ উদ্যানের পাশ দিয়ে চলে গেছে মিরপুর। নিসর্গ আমার অতি প্রিয় একটি বিষয়। ভাবলাম, এখনও দুপুর হয়নি, সাইকেল চালিয়ে যদি পেঁৗছে যাওয়া যায় উদ্ভিদ উদ্যানে, তবে হয়তো বৃক্ষরাজির সানি্নধ্যে বাকি দিনটা কাটিয়ে সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরে আসা যাবে

রোজ সকালে আমি এখানে এসে বসি, আমার পড়ার টেবিলের পাশে। সামনে বিশাল জানালা। সেই জানালার কোল ঘেঁষে আলসেতে রাখা গাছগাছালির টব। ওই জানালা, ছোট গাছগুলো এবং টবের চারপাশ ঘিরে চড়ূইয়ের কিচিরমিচির আমাকে স্বাগত জানায়। আমি তখন ওদের কিছু আধার খেতে দিই। ওরা দ্বিগুণ উৎসাহে আরও বেশি নাচানাচি করে। এদের মধ্যে অনেকে ঘাড় বেঁকিয়ে আমার দিকে তাকায়। লেজ ওপরে তুলে ধন্যবাদ জানায় আমাকে। পরের দিন সকালে আমি যখন ওই জানালার ধারে গিয়ে বসি, তখন আবারও ওরা একইভাবে আমার কাছে ছুটে আসে। অব্যক্ত ভাষায় আমরা একে অন্যের সঙ্গে কথা বলি। এ রকম প্রতি সকালেই ঘটে। বস্তুতপক্ষে, আমি যদি কোনো সকালে একটু দেরি করে ঘুম থেকে উঠি, ওরা মহাবিরক্ত হয়ে যায়। তারস্বরে চেঁচামেচি করে। ভাবটা এমন যে, যেন আমায় বলছে, 'আজ কী হলো তোমার? এতক্ষণ ধরে এখানে এসে বসে আছি তোমার জন্য?' আমি দেখি, ওরা যখন ওদের খাবার খায়, উড়ে উড়ে এখান থেকে সেখানে। বাচ্চা চড়ূই মায়ের সামনে এসে ঠোঁট দুটি সম্পূর্ণ খুলে ওপরে তাকায়। মা খাবার ভরে দেয় বাচ্চার হাঁ করা মুখের ভেতরে। আবার অনেক সময় দেখি, খাবারের ভাগ নিয়ে কাড়াকাড়ি করতে গিয়ে একে অন্যের সঙ্গে ঝগড়াও বাধিয়ে দেয়। কিন্তু অতি দ্রুত তারা এই শত্রুতা ভুলে গিয়ে আবার বন্ধু বনে যায়। মানুষের সঙ্গে এখানেই বোধহয় ওদের তফাত। আমি প্রতি সকালে অভিনিবেশ সহকারে ওদের দেখি। আমি চেষ্টা করি নিদেনপক্ষে একটি হলুদ বক্ষের চড়ূই খুঁজে বের করতে। যে চড়ূই বিশ্ববিখ্যাত ভারতীয় পক্ষীবিশারদ সেলিম আলীকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল পাখি নিয়ে গবেষণা করতে। অনেকদিন ধরেই আমি খুঁজে আসছি এই হলুদ বক্ষবিশিষ্ট চড়ূই, কিন্তু খুঁজে পাইনি এখনও। হতাশ হয়ে মাঝে মাঝে ভাবি, খালি চোখে বোধহয় এই দুর্লভ পাখি দেখা যায় না, যদি না সেলিম আলীর মতো এক জোড়া বিশেষ চোখ থাকে। তার লেখা ঋধষষ ড়ভ অ ঝঢ়ধৎৎড় ি(একটি চড়ূইয়ের পতন) আমার খুবই প্রিয় গ্রন্থ।

এই একঝাঁক চড়ূইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে, তাদের স্বাধীনতা, তাদের শঙ্কাহীন জীবন ইত্যাদি দেখতে দেখতে আমার মনে কিঞ্চিৎ হিংসার উদ্রেক হয়। হায়, আমাদের জীবন যদি এ রকম হতো! যে জীবনে দ্বন্দ্ব নেই, ঘৃণা নেই, স্বার্থপরতা নেই। যে জীবনে প্রতিনিয়তই আমাদের কণ্ঠ রোধ হয়ে আসে না, কণ্ঠরোধ করা হয় না স্বাধীন-মুক্ত চিন্তার। আমাদের মন পরিপূর্ণ, অজ্ঞানতার অমানিশায়। আমরা কি আজ কোনো কিছুই যুক্তি দিয়ে ভেবে দেখি? অথচ যুক্তিবিদ্যার ছাত্র হিসেবে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে যে বাক্যটি আমি প্রথম শিখেছিলাম, সেটি হচ্ছে 'মানুষ যুক্তিবাদী পশু' (গধহ রং ধ জধঃরড়হধষ অহরসধষ)। এর অর্থ তাহলে তো স্পষ্ট এই দাঁড়ায় যে, যদি আমি যুক্তি-বুদ্ধিকে ত্যাগ করি, তবে কেবল পশুতেই পরিণত হয়ে যাব? এই সহজ কথাটি কি আপাত শিক্ষিত আমরা একবারও ভেবে দেখি? এ জগতে মনে হয় মানুষই একমাত্র জীব, যারা অবলীলায় এবং অসংকোচে পাশবিক আচরণ করে বেড়াচ্ছে যত্রতত্র। এই অযৌক্তিক কর্মকাণ্ড আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। এর অগ্রযাত্রা সর্বব্যাপী, সর্বগ্রাসী। লক্ষ্য করা সম্ভব হবে যে, আমরা অতি সহজেই যুক্তিকে জলাঞ্জলি দিই যখন ব্যক্তিস্বার্থ আমাদের কাছে অনেক বড় হয়ে দেখা দেয়। এ কথাগুলো বলতে বলতে আমার হৃদয়নন্দন বন হঠাৎ কেমন যেন বিমর্ষ হয়ে পড়ে। মনে হয়, এখনও যখন চারদিকে অনেক আলো, অনেক পাখির গান, অনেক শিশুর কলকাকলি, তখন কেন আমি অকারণে নিজের মনকে ভারাক্রান্ত করছি?
ছেড়ে দিই এসব মন-কেমন-করা কথা। ফিরে যাই হৃদয়ের নিকটে আমার। বেশ কিছুদিন আগের কথা। তখন ঢাকা কিংবা এর পার্শ্ববর্তী রাস্তাগুলো অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ছিল। তখন আমি উত্তরাবাসী ছিলাম। ছুটিছাটার দিনে দিব্যি আমরা বাইসাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম বিভিন্ন দিকে। একদিন সাইকেলে করে আশুলিয়ার পথ ধরলাম। পেঁৗছে গেলাম তুরাগ নদের ধারে সেই জায়গায়, যেখানে রাস্তাটি ত্রিধারায় বিভক্ত হয়েছে। একটি ঢাকা থেকে এসেছে, একটি চলে গেছে আশুলিয়া হয়ে নবীনগর-চন্দ্রা রাস্তার দিকে, আর একটি ঢাকার অদূরে অবস্থিত উদ্ভিদ উদ্যানের পাশ দিয়ে চলে গেছে মিরপুর। নিসর্গ আমার অতি প্রিয় একটি বিষয়। ভাবলাম, এখনও দুপুর হয়নি, সাইকেল চালিয়ে যদি পেঁৗছে যাওয়া যায় উদ্ভিদ উদ্যানে, তবে হয়তো বৃক্ষরাজির সানি্নধ্যে বাকি দিনটা কাটিয়ে সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরে আসা যাবে। তখনও আমার জানা ছিল না ওই তিন রাস্তার মোড় থেকে কতদূরে বোটানিক্যাল গার্ডেন। রাস্তার নিচেই ফসলের ক্ষেতের পাশে সবুজ ঘাসে মোড়া একটি সমান জায়গায় কিছু বাচ্চা ছেলে খেলাধুলা করছিল। আমি তাদের ডেকে রাস্তার ওপরে তুললাম। তারা আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকল। আমি তাদের প্রশ্ন করি, 'আচ্ছা, এখান থেকে বোটানিক্যাল গার্ডেন কতদূর, এই পথে গেলে?' তারা কিছুক্ষণ কী যেন ভাবল। তারপর স্বকীয় ভাষায় জবাব দিল, 'ম্যালা দূর।' আমি জিজ্ঞেস করি, 'ম্যালা মানে কত?' আরেকজন, অপেক্ষাকৃত প্রগল্্ভ ছেলে, আমার কাছে এগিয়ে এসে বলল, 'ম্যালা মানে বুঝেন না? ম্যালা মানে ম্যালা দূর।' আমার মাথায় তখন খেপামি ঢুকে গেছে। আমার জানা দরকার কত এই দূরত্ব, সময়ের মাপে কিংবা কিলোমিটারের মাপে। ফলে আমি আবার বলি, 'ম্যালা দূর তো বুঝলাম। কিন্তু সেটা কত ম্যালা?' তাদের মধ্যে একজন, সবচেয়ে কম বয়সী হবে হয়তোবা, সবাইকে ঠেলেঠুলে দু'পাশে সরিয়ে একেবারে আমার কাছে চলে এলো। আমার চোখে চোখ রেখে বলল, 'এতদূর যে, যাইতে যাইতে আপনের খিদা লাইগা যাইব।' আমি একদম নিশ্চুপ হয়ে গেলাম। কী অকাট্য কথা! ক্ষুধা দিয়ে দূরত্বের পরিমাপ। এই যে মানুষগুলো, যাদের জীবনে ক্ষুধা একটি অত্যন্ত বড় সত্য, তাদের সবকিছুর মধ্যেই নিহিত রয়েছে সেই দর্শন, যার পরিমাপ করা যায় কেবল ক্ষুধার মাধ্যমেই। এই দর্শন আপাতদৃষ্টিতে কত সহজ, কত প্রত্যক্ষ, কত নিরাভরণ, কিন্তু কত সত্য। এতদূর যে, যেতে যেতে খিদে লেগে যাবে! এর চেয়ে সুন্দর কথা আমি সাম্প্রতিককালে খুব কমই শুনেছি। বড্ড ভালো লাগল ওদের। স্থানটির অদূরেই যে ঘাট রয়েছে, তার পাশে ঝালমুড়িওয়ালা ছিল। আমি তাকে ডেকে বললাম, আমাদের সবাইকে মুড়ি খাওয়ান। তারপর সেই মুড়ি খাওয়া নিয়ে মহা হৈচৈ, অনেক গল্প, সবশেষে ডাংগুলি খেলা। তারপর সূর্য যখন তেতে উঠল, আমি ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হৃষ্ট চিত্তে সাইকেল চড়ে রওনা হলাম
বাড়ির পথে।

আলী যাকের :সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

মঙ্গলবার, ২৯ মে, ২০১২

‘ওগো নজরুল হয়নি মোদের কোন ভুল’



মনিরুজ্জামান মনির
‘চিরতরে আমি দূরে চলে যাবো। তবু আমারে দেবো না ভুলিতে’—কবি নজরুল এই গানের অংশবিশেষ শুধু তার প্রিয়ার উদ্দেশে উচ্চারণ করেননি, তিনি সমগ্র মানব পাঠক, মানব-শ্রোতার উদ্দেশে এই গীতিময় বাণী রচনা করেছিলেন। সত্যিই তো আমরা নজরুলকে, নজরুলের অপূর্ব সৃষ্টিকে ভুলতে পারিনি, কখনও ভুলতে পারব না। তাই তো কবির ১১৩তম জন্মবার্ষিকী উদযাপিত হয়েছে, এই বাংলাদেশে সাড়ম্বরে, সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে। নজরুল বলেছিলেন, ‘আমার এই পরিচয় হোক, আমি তোমাদের লোক’। হ্যাঁ, অবশ্যই নজরুল আমাদের লোক। আমাদের সাহিত্য, সংস্কৃতি, সঙ্গীতের রাজকীয় ভাণ্ডারের অর্ধেকের বেশি পূর্ণ করে রেখেছেন তিনি। যুগে যুগে সেই সঞ্চয় আমাদের করবে অহঙ্কারী, করবে অনুপ্রাণিত। অভিমান করে নজরুল কখনও বলেছেন, ‘আমায় নহেগো ভালোবাসো শুধু ভালোবাসো মোর গান।’ নজরুলের গানকে এবং নজরুলকে ভালো না বেসে উপায় নেই। কেননা তার গানে আছে সাম্যের কথা, মানবতার কথা, নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কথা, ঝঞ্ঝার মতো উচ্ছল, প্রকৃতির মতো সচ্ছলতার কথা। বিশ্বলয়ে খেলা করা বিরাট শিশুর কথা। অসাম্প্রদায়িকতার কথা, মানবপ্রেমের কথা, ইতিহাসের কথা, সংগ্রামের কথা, বেঁচে থাকার অধিকার আদায়ের কথা, তারুণ্যের কথা, যৌবনের কথা, তার গানের সুর, রাগ-রাগিণী আশ্রিত-মিশ্রিত হয়ে নতুন এক ম্যালোডিপূর্ণ সুরের রূপ ধারণ করেছে। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘সহজ কথায় বলতে আমায় কহ যে, সহজ কথা যায় না বলা সহজে।’ নজরুল ইসলাম তার গানে ওই সহজ কথা বলেছেন সহজে। তাই সহজ কথায় ভাব প্রকাশ নজরুলগীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সাধারণ মানুষের একজন গান শুনে বুঝতে পারে এটি তার হৃদয়ের কথা, অনুভবের কথা। নজরুল তার গানের মতো, কবিতার মতো, গল্পের মতো জীবন যাপন করেছেন। এই সৃষ্টিগুলো তার বাস্তব অভিজ্ঞতারই আন্তরিক বহিঃপ্রকাশ। স্মৃতির ফ্ল্যাশব্যাকে দেখা যায় তিনি জন্মের পর থেকে দারিদ্র্যপীড়িত মানুষ, বিটিশবিরোধী আন্দোলনে সশরীরে সংগ্রামরত সৈনিক, কণ্ঠশিল্পী, গানের শিক্ষক, একজন প্রেমের কাঙাল, সাচ্চা প্রেমিক। নজরুল তার সাহিত্যকর্মে, সঙ্গীত সৃষ্টিতে বাংলার সঙ্গে মিশ্রণ ঘটিয়েছেন কিছু উর্দু, আরবি, ফার্সি শব্দসহ বিদেশি সহজবোধ্য শব্দ। এতে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধ বা অলঙ্কৃত হয়েছে বলা যায়। তার কিছু কিছু গানের সুরেও ইরানি, ইরাকি, মিসরীয় প্রলেপ লক্ষ্য করা যায়। এতে বাংলা গানে সুরের নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। নজরুলগীতির আঙ্গিক গায়কি এতই ব্যতিক্রমী, মৌলিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী যে, সেই গীত নিয়মিত পরিবেশনকারী গায়ক-গায়িকাকে নজরুলগীতির শিল্পী হিসেবে চিহ্নিত বা বিশেষিত করে দেয়। এই প্রসঙ্গে কণ্ঠশিল্পী ফিরোজা বেগম, সোহরাব হোসেন, সুধীন দাস, খালিদ হোসেন, শবনম মুশতারী, ফাতেমা তুজ জোহরা, মোঃ সালাউদ্দিন, রওশন আরা মোস্তাফিজ, নাশিদ কামাল প্রমুখের নাম উল্লেখ করা যায়। নজরুল অন্যায়-অবিচারে ‘বিদ্রোহী’ হয়েছেন, বাজিয়েছেন ‘অগ্নিবীণা’, ‘বিষের বাঁশী’। নজরুলগীতি যেমন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মন্দিরে পূজায় প্রার্থনায় গীত হয়েছে, তেমনি ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মনের মসজিদে উচ্চারিত হয়েছে আল্লাহ ও নবীর হামদ-নাতে। কবির এক হাতে ছিল বাঁশের বাঁশরী, আরেক হাতে রণতূর্য্য। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে নজরুলের গান হয়েছিল মেশিনগান, শব্দসৈনিক শিল্পীদের শত্রু বিনাশের ধারালো অস্ত্র। একাত্তরের রণাঙ্গনে ইথারে গর্জে উঠত তার ‘বিদ্রোহী’ কবিতা, আর বজ্রসঙ্গীত—‘এই শিকল পরা ছল মোদের, চল চল ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল’, ‘মোরা ঝঞ্ঝার মত উদ্দাম’, ‘ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি আমার দেশের মাটি’ ইত্যাদি। নজরুলের সঙ্গে কারও তুলনা হয় না। তিনি শ্রেষ্ঠতম শিখরে একটি আপন ভুবন তৈরি করেছেন। সেখানেই তার একান্ত বসবাস। আমার জীবনে কবি দর্শন একটি উল্লেখযোগ্য অহঙ্কারযোগ্য স্মৃতি। স্বাধীনতা-উত্তরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান বাকরুদ্ধ জীবন্ত কিংবদন্তি কবিকে বাংলাদেশে নিয়ে এলেন। হাজার লোকের লাইনে দাঁড়িয়ে আমিও দর্শন করলাম কবিকে। কী আনন্দ এবং বিস্ময় লেগেছিল তা বলে বোঝানো যাবে না। দেখলাম তার সেই মায়াভরা, প্রেমভরা সুগভীর চোখ দুটো, কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে। ঠোঁট দুটো বিরতিহীনভাবে নড়ছে, কাঁপছে। আমি আশায় ছিলাম, এই বুঝি কবি কথা বলবেন। সবই ব্যর্থ। কবি আর কখনও কথা বললেন না। তার পুঞ্জীভূত অনেক বছরের অনেক কথা পৃথিবীর মানুষের কাছে না বলা, না জানাই রয়ে গেল। আমার কেবল মনে পড়তে লাগল কবির লেখা দুটি গানের দুটি পঙক্তি। ১. ‘তোমাদের প্রাণে চাহিয়া বন্ধু আমি আর জাগিবো না’ এবং ২. ‘কথা কও কও কথা থাকিও না চুপ করে’। আমার দ্বিতীয় স্মৃতি কলকাতার কালিঘাটে এইচএমভি’র প্রাচীন দফতরে কবি নজরুল ইসলামের গান লেখার কক্ষ দর্শন। কবিকে বাংলাদেশের জাতীয় কবির মর্যাদা দেয়া হলো, নাগরিকত্ব দেয়া হলো। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ফার্মগেট থেকে শাহবাগ পর্যন্ত রাস্তার নামকরণ ‘কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ’ করলেন। কিন্তু ধানমন্ডিতে কবির স্মৃতি ঘেরা কবি ভবনটি জাদুঘর হিসেবে সংরক্ষণ করা হলো না। আমি এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র গীতিকার তাকে নিয়ে একটি গান লিখে কবির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছিলাম অনেক আগে। গানটির সুরকার ছিলেন প্রয়াত আবু তাহের, কণ্ঠশিল্পী সৈয়দ আবদুল হাদি।

ওগো নজরুল
হয়নি মোদের কোন ভুল।
মসজিদেরই পাশে তোমার
দিলাম চিরস্থান।
তুমি কি শুনতে পাওনা আজান?
monirlyric@gmail.com

সোমবার, ২৮ মে, ২০১২

সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়



আজ প্রখ্যাত ভাষাবিজ্ঞানী সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুদিবস। জন্ম শিবপুর, হাওরা, ২৬ নভেম্বর, ১৮৯০ সাল। ইংরেজের সওদাগরি অফিসের কেরানি হরিদাস চট্টোপাধ্যায় তার পিতা। মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম। মতিলাল শীল ফ্রি স্কুল থেকে ১৯০৭ সালে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় ষষ্ঠ স্থান অধিকার করে ২০ টাকা বৃত্তি লাভ করেন। স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে তৃতীয় স্থান অধিকার করে এফএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯১১ সালে ইংরেজিতে অনার্সসহ প্রথম স্থান অধিকার করে বিএ পাস করেছিলেন। ১৯১৩ সালে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে ইংরেজিতে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর কলকাতা বিদ্যাসাগর কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক নিযুক্ত হন। পরের বছর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিয়ে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত এ পদে কর্মরত ছিলেন। ১৯১৮ সালে সংস্কৃতের শেষ পরীক্ষায় পাস এবং প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি ও জুবিলি গবেষণা পুরস্কার অর্জন করেন। ভারত সরকারের বৃত্তি নিয়ে ১৯১৯ সালে ধ্বনিতত্ত্ব সম্পর্কে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের জন্য বিদেশ যান এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ধ্বনিতত্ত্বে ডিপ্লোমা লাভ করেন। ১৯২১ সালে ওই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ‘ইন্দো-আরিয়ান ফিলোলজি’ শীর্ষক অভিসন্দর্ভ রচনা করে ডি-লিট উপাধি পেয়েছিলেন। ১৯২২ সালে দেশে ফিরে এলে স্যার আশুতোষ তাকে ভারতীয় ভাষাতত্ত্বের ‘খয়রা’ প্রফেসর নিযুক্ত করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ৩০ বছর এ পদে কর্মরত ছিলেন। বাংলা ভাষার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে The Origin and Development of the Bengali Language গ্রন্থখানি রচনা করে অসাধারণ বিদ্যাবত্তার পরিচয় দেন। ১৯৫২ সালে ইমেরিটাস প্রফেসর নিযুক্ত হন। ১৯৩৬ সালে রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হন। ১৯৬৩ সালে ভারত সরকারের পদ্মবিভূষণ উপাধি পান। ১৯৬৬ সালে জাতীয় অধ্যাপকের সম্মান লাভ করেন। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : The Origin and Development of the Bengali Language, Bengali Phonetic Reader. কিরাত জনকৃতি, ভারত-সংস্কৃতি, বাঙ্গালা ভাষাতত্ত্বের ভূমিকা, পশ্চিমের যাত্রী, ইউরোপ ভ্রমণ, জাতি সংস্কৃতি সাহিত্য, ভারতের ভাষা ও ভাষা সমস্যা, সংস্কৃতি কী, দ্বীপময় ভারত, রবীন্দ্রসঙ্গমে, শ্যামদেশ ইত্যাদি। মৃত্যু, কলকাতা, ২৯ মে, ১৯৭৭ সাল।

আমাদের প্রিয় শিক্ষক প্রফেসর মোজাফফর আহমদ



॥ আবু আহমেদ ॥

স্যারের সরাসরি ছাত্র হইনি আমি কখনো। তিনি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক হিসেবে এলেন, তখন আমি অর্থনীতি বিভাগের বাইরে, আর আমি যখন শিক্ষক হিসেবে অর্থনীতি বিভাগে যোগ দিই তখন তিনি অর্থ বিভাগ ছেড়ে ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটে বা আইবিএতে চলে গিয়েছিলেন। আমার জানা মতে, তখন আইবিএ শিক্ষকস্বল্পতায় ভুগছিল। তার যোগদানের মাধ্যমে আইবিএতে সেই শূন্যতা কিছুটা পূরণ হয়। বলা চলে, সত্তর দশকের শুরুতে বা আমাদের স্বাধীনতার অব্যবহিত পর ঢাবি অর্থনীতি বিভাগের জন্য স্বর্ণযুগ ছিল। তখন প্রথিতযশা অনেক অর্থনীতিবিদই এই বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন প্রফেসর নুরুল ইসলাম, প্রফেসর রেহমান সোবহান, প্রফেসর আনিসুর রহমান, প্রফেসর এমএন হুদা, প্রফেসর মোশাররফ হোসেন প্রমুখ। প্রফেসর মোজাফফর যখন আইবিএতে যোগদান করেন, তার পর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সে ইনস্টিটিউটেরও সোনালি দিন শুরু হয়। তার মতো আদর্শবাদী এবং জ্ঞানে সমৃদ্ধ শিক্ষক ছিলেন বলেই আইবিএ অতি অল্প সময়ের মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের সবার নজর কাড়তে সক্ষম হয়। ছাত্র ভর্তি হয় শিক্ষকদের দেখে। অন্তত আইবিএর গ্র্যাজুয়েটদের যে এত সম্মান ও মূল্য ছিল, তার কারণ তারা প্রফেসর মোজাফফর আহমদের মতো শিক্ষাবিদের ছাত্র ছিলেন। আজো লোকে এর গ্র্যাজুয়টদের বেশি কদর করে। এর মূল কারণ হলো, এই ইনস্টিটিউটগুলো তাদের অতীত ঐতিহ্য ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। অন্তত বাইরের ধারণা এটাই। প্রফেসর মোজাফফর আহমদের বর্ণাঢ্য জীবন ছিল। আসলে প্রতিভাবান লোকেরা এক জায়গায় বসে থাকেন না। তাদের চাহিদা যেমন ব্যাপক, যাকে তেমন এসব লোক নিজের কর্মদক্ষতাকে অন্যত্রও ব্যবহার করতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তিনি বাংলাদেশের প্ল্যানিং কমিশনেও কাজ করেছেন এবং এর আগে সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি শিল্প গড়ার প্রতিষ্ঠান ইপিআইডিসি-তে উঁচু পদে কাজ করেছেন। বলা যেতে পারে, স্বাধীনতাপূর্ব যেসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান এ অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয়, সেগুলোর পেছনে প্রফেসর মোজাফফরেরও বড় অবদান ছিল। এগুলোর মধ্যে ছিল চট্টগ্রামের স্টিল মিলস, কর্ণফুলী পেপার মিলস ইত্যাদি। একপর্যায়ে তিনি মরহুম রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সময় বস্ত্রশিল্প উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করেছেন। বলা চলে, মোজাফফর আহমদের মতো লোকদের হাতে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো যত দিন ছিল তত দিন ওগুলো ভালোই চলেছিল। এসব শিল্পকারখানা ক্ষয় হতে থাকে পরের দশকে যা আজো অব্যাহত আছে। মোজাফফর স্যার আমেরিকার বিখ্যাত শিকাগো ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করেছেন। সেই শিকাগো ‘স্কুল’ কিন্তু পুরোপুরি বাজারমুখী একটা স্কুল। অর্থাৎ ধরে নেয়া হয় সেখান থেকে পাস করা ছাত্রদের শিক্ষাগতভাবেই তারা বাজার অর্থনীতির প্রতি দুর্বল থাকবে এবং পাবলিক সেক্টর অর্থাৎ সরকার নিয়ন্ত্রিত ও সরকারের মালিকানাধীন ব্যবসায়-বাণিজ্যের বিরোধিতা করবেন। কিন্তু স্যারের মধ্যে ওই আদর্শিক প্রবণতা দেখিনি। তিনি পাবলিক সেক্টর এন্টারপ্রাইজের বিরুদ্ধে তো ছিলেন না, বরং ওগুলো সঠিকভাবে চালাতে নানাবিধ কৌশলের কথা বলতেন। অনেক সভা-সেমিনারে আমি স্যারের সাথে বিনয়ের মাধ্যমে দ্বিমত পোষণ করতাম পাবলিক সেক্টরের ভূমিকা নিয়ে। অন্যভাবে যেটা পর্যবেক্ষণ করেছি, সেটা হলো ষাট ও সত্তর দশকের অর্থনীতিবিদদের মধ্যে পাবলিক সেক্টরের প্রতি একধরনের ভক্তি ছিল। হয়তো এমন হবে যে, বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন পলিটিক্যাল ইকোনমির দারুণ প্রভাব। তখনো বিশ্বে সমাজতন্ত্র না পুঁজিবাদ বা বাজার অর্থনীতি, এমন একটা বিতর্ক প্রবলভাবে চলছিল। আমাদের দেশের সিনিয়র অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিদেরাও ওই বিতর্কে প্রভাবিত হয়েছিলেন। একধরনের রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি ও সমাজব্যবস্থার প্রতি তাদের বেশ দুর্বলতা ছিল। তাদের যুক্তি এবং অবস্থান বুঝতে চেষ্টা করেছি এবং বলা চলে, দ্বিমত থাকলেও তাদের যুক্তি বুঝতে সক্ষম হয়েছি। তাদের মধ্যে অনেকে দারিদ্র্যকে হঠানোর জন্য রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত বা প্রভাবিত অর্থনীতির পক্ষে ছিলেন। প্রফেসর মোজাফফর আহমদ উন্মুক্ত বাজারের বিপক্ষে ছিলেন। তার যুক্তি ছিল, এমন বাজার শোষকদের হাতে অপব্যবহৃত হয় এবং অনিয়ন্ত্রিত বাজার একচেটিয়া মুনাফার জন্ম দেয়। হ্যাঁ, স্যারের এই তত্ত্ব ভাবনায় আমিও অংশীদার। সে জন্য বাজার অর্থনীতির পক্ষে বলতে গিয়ে সব সময় বলি, বাজার দরকার, তবে বাজার অবশ্যই সুনিয়ন্ত্রিত হতে হবে। দুর্ভাগ্য, আজকে আমাদের এই বাজার অর্থনীতিতে রেগুলেশন বলতে তেমন কিছু নেই। তাই তো দেশে হাজার হাজার কোটি কালো টাকার উৎপাদন হচ্ছে। তাই তো দেশের বিপুল অর্থ বিদেশ পাড়ি দিচ্ছে। মোজাফফর স্যারের সাথে আইবিএর কক্ষে প্রায় দেখা হতো। তিনি বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলতেন। আমি অনেক কথা শুনতাম এবং তার থেকে অনেক কিছু জেনেছিও। বুঝতাম যে, স্যার কথা ও বিশ্বাসে এক। যেটা বিশ্বাস করতেন সেটাই বলতেন। অবসর নেয়ার পরও স্যার কাজ থেকে দূরে থাকেননি। তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন দেশ থেকে দুর্নীতি কিভাবে তাড়ানো যায়। গঠন করলেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বা টিআইবি বাংলাদেশ চ্যাপ্টার। এই টিআইবির মাধ্যমে মানুষ জানল, বাংলাদেশে দুর্নীতি কত গভীরে। মোজাফফর স্যার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জোর দিয়ে বলতেন বলে সমাজের কথিত ক্ষমতাধরেরা তাকে প্রতিপক্ষ মনে করতেন। কিন্তু তিনি যা করেছিলেন সেটা এই দেশের মানুষের জন্যই করেছিলেন। আজকে তিনি নেই। আমরা উপলব্ধি করছি বাংলাদেশ দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটা জোরালো কণ্ঠস্বর হারাল। আমি তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। 
লেখন : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

রবিবার, ২৭ মে, ২০১২

হ্যাপীকে কি মনে পড়ে?


  • শাম্মী আক্তার হ্যাপী
    শাম
সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেই চলেছে। অপচয় হচ্ছে মেধার। কবে কে সড়ক দুর্ঘটনার বলি হবে, তা কেউ জানে না। তাই কেউ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলে তাকে আর কে মনে রাখে? হ্যাপী নামের মেয়েটিকেও কি কেউ মনে রেখেছে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলেন শাম্মী আক্তার হ্যাপী। থাকতেন রোকেয়া হলের বর্ধিত ভবনের ৮৫ নম্বর কক্ষে। বাড়ি পঞ্চগড় শহরের ইসলামবাগ মহল্লায়। ২০০৫ সালের ২৮ মে সকালে ঢাকার শাহবাগে সহপাঠীদের সঙ্গে হ্যাপীও গাড়ি থেকে নেমে পড়েন রোকেয়া হলে ফেরার জন্য। সিগন্যাল পড়ার পর হ্যাপীও তাঁদের পিছুপিছু ব্যস্ত রাস্তাটি পার হচ্ছিলেন। কিন্তু সিগন্যাল উপেক্ষা করে একটি বাস মুহূর্তে ওই সড়কে দানবের মতো তেড়ে আসে। মেধাবী প্রাণটি চোখের পলকে নিঃশেষ হয়ে যায়।
হ্যাপীর স্বপ্ন ছিল ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি পাস করে দেশের বিখ্যাত মনোরোগ চিকিৎসক হবেন। সে স্বপ্ন পূরণ হতে দেয়নি ঘাতক ওই বাসটি। সদা হাস্যোজ্জ্বল হ্যাপী সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেছেন।
মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগে বাবার সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলেছিলেন হ্যাপী। তাঁর শেষ কথাটি ছিল, ‘বাবা, আমি ভালো আছি’। এদিন সকালেও বাসায় বাবার সঙ্গে নানা বিষয়ে হ্যাপীর কথা হয়েছিল। কেউ বিশ্বাসই করতে পারেনি কিছুক্ষণ পরে হ্যাপী না-ফেরার জগতে চলে যাবে। তবু এটাই ছিল রূঢ় বাস্তবতা।
পঞ্চগড়ে হ্যাপীদের বাড়িতে শোক আছে, কিন্তু জীবন তো প্রবহমান, কারও জন্য থেমে থাকে না। হ্যাপীর বাবা-মাও সন্তানহারা জীবনের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। তবে তাঁদের মনে এখনো বেঁচে আছে সন্তান।
বাবা মোজাম্মেল হক চৌধুরী (মুকু চৌধুরী) হ্যাপীর প্রসঙ্গ তুলতেই চোখ মুছে বলেন, ‘আমার কাছে ও মরেনি, যত দিন বেঁচে আছি তার কথা ভুলতে পারব না। আমার মেধাবী মেয়েটা বেঁচে থাকলে প্রতিষ্ঠিত হতো। তার স্বপ্ন ছিল ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি পাস করে দেশের সেরা মনোরোগ চিকিৎসক হওয়ার। এদিনে তার সে স্বপ্ন পূরণ হতো। ঘাতক চালক তার সে স্বপ্ন পূরণ করতে দিল না। ঘাতক চালকের কোনো বিচার হয়নি। বিচার হয় না বলেই সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধ হচ্ছে না। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ঘটনায় ব্যাপক আন্দোলন হয়েছিল। কিন্তু কই, সড়ক দুর্ঘটনা তো বন্ধ হয়নি, বরং বেড়েছে। সাংবাদিক, শিল্পী, সাহিত্যিক, শিক্ষার্থী প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সরকার ব্যর্থ।’ কথা বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে পড়েন মুকু চৌধুরী। তারপর আবার শান্ত হয়ে বিড়বিড় করে বলেন, ‘হ্যাপী আমাকে নিয়ে, সংসার নিয়ে খুবই ভাবত। আমার চাকরি থেকে অবসর নেওয়া, বাইপাস সার্জারি করার পর আরও বেশি চিন্তা করত।’
হ্যাপীর মা আলেয়া বেগম বলেন, ‘হ্যাপীকে ভুলতে পারি না। হ্যাপীর কথা মনে পড়লে ছবি দেখি আর কাঁদি। তাই তো প্রতিটি ঘরে হ্যাপীর ছবি বাঁধাই করে রেখেছি। এখনো মনে হয় আমার গলা ধরে পাশে শুয়ে আছে। বেঁচে থাকলে এত দিনে তার চাকরি হতো, বিয়েশাদি হতো। এটা-সেটা নিয়ে আসত। যেমন বড় মেয়েটা নিয়ে আসে। এখনো ওর সব স্মৃতি মনে পড়ে। বাড়িতে এলে আশপাশের বাচ্চাদের খুব আদর করত। পাশের বাড়ির ছেলেটাকে নিয়ে এসে আদর করত, গোসল করিয়ে দিত। বড় ভাই বকুলের ছেলে হয়েছে। ও বেঁচে থাকলে ছেলেটাকে খুবই আদর করত।’ বলেই কেঁদে ফেলেন। আরও বলেন, ‘হ্যাপী শাড়ি আর গয়না পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকত আর আমাকে দেখতে বলত। সাত বছর হচ্ছে, এখনো তার কথা মন থেকে সরাতে পারছি না।’
বকুল ছিলেন তিন ভাইবোনের মধ্যে সবার বড়। আর হ্যাপী সবার ছোট। এ দুজনের সম্পর্কটাও ছিল অনেকটা বন্ধুর মতো, গাঢ়-গভীর। হ্যাপীর চলে যাওয়ার পর বন্ধুবৎসল ভাইটির সময় যেন কিছুতেই কাটে না। এ জন্য বোধহয় প্রায় প্রতিদিনই তাঁকে দেখা যায় কেন্দ্রীয় কবরস্থান মাঠে হ্যাপীর কবরের পাশে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকতে। নীরবে চোখের জলও ফেলেন। হ্যাপীর বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে বলেন, ‘যেন বুকের ভেতর কেউ চেপে ধরেছে। ভালো করে নিঃশ্বাস নিতে পারি না। কিছুতেই মেনে নিতে পারি না হ্যাপী নেই।’ 
হ্যাপীর সপ্তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে পঞ্চগড়ে তাঁদের ইসলামবাগের বাসায় আজ সোমবার কোরআনখানি, দোয়া মাহফিল, এতিমদের মাঝে খাবার বিতরণের আয়োজন করা হয়েছে।
আমরা একজন হ্যাপীর পরিবারের কথা বললাম। এ রকম কত পরিবারের না-বলা কথা ঘুরে বেড়াচ্ছে আকাশে-বাতাসে। সড়ক দুর্ঘটনা যাঁদের সরিয়ে দিয়েছে পৃথিবী থেকে, তাঁদের স্মৃতি দিনে দিনে ফিকে হয়ে আসে। তাঁরা বেঁচে থাকেন শুধু স্বজনদের গভীরে।
শহীদুল ইসলাম
পঞ্চগড় প্রতিনিধি

‘মেগাওয়াট’ সমাচার



এমএ নোমান
বেশ কয়েকদিন আগে জাতীয় প্রেস ক্লাবের ক্যান্টিনে জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের টেবিলে দুপুরের খাবার খেতে বসেছি। হঠাত্ করেই চলে গেল বিদ্যুত্। জাতীয় প্রেস ক্লাবে বিদ্যুতের দু’টি লাইন থাকায় দ্বিতীয় লাইন চালু হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গেই। দুর্ভাগ্য ২-৩ মিনিটের মাথায় দ্বিতীয় লাইনটিও চলে গেল। একজন প্রবীণ সাংবাদিক ক্ষোভ আর আক্ষেপের স্বরে একটু জোর গলায় বলে উঠলেন, “গেলি তো গেলি একেবারে ‘মেগাওয়াট’সহ গেলি। আর সময় পেলি না।” মেগাওয়াট গেল আওয়াজ শুনেই ক্যান্টিনজোড়া সাংবাদিকরা একে অপরের দিকে তাকাচ্ছেন। কিছু সময় পর একজন বলে উঠলেন, “কিছুদিন ধরেই শুনে আসছি হাজার হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদিত হয়েছে। এসব বিদ্যুত্ গেল কই?” অপর একজন বলে উঠলেন, সরকার আপাতত তিন হাজার ৩০০ মেগাওয়াট উত্পাদন করেছে। ‘মেগাওয়াট’ যেহেতু উত্পাদন হয়ে গেছে এখন ধীরে ধীরে বিদ্যুত্ও উত্পাদন হবে। এ নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। জাতীয় প্রেস ক্লাবের পর আমি ‘মেগাওয়াট’ সংক্রান্ত আলোচনা আরও অনেক জায়গায়ই শুনেছি।
‘বাংলাদেশ নতুন করে তেলের জগতে প্রবেশ করতে যাচ্ছে’—এ ঘোষণা দেয়ার জন্য গত ২০ মে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেছেন। জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘আজকের দিনটি বাংলাদেশের জন্য এক ঐতিহাসিক ও অবিস্মরণীয় দিন। সমুদ্র বিজয়ের সাফল্যের পর এবার আমরা তেলের জগতেও প্রবেশ করছি। আমরা সিলেটের দুটি কূপে তেল...।’ চেয়ারম্যানের বক্তব্যের এ পর্যায়ে সেই একই বিড়ম্বনা। বিদ্যুত্ চলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে একজন সাংবাদিক বলে উঠলেন, ‘মেগাওয়াট’ চলে গেল। স্যার আপনারা তেলের জগতে প্রবেশ করতে যাচ্ছেন তো তাই এবার মেগাওয়াট আর থাকতে চাইছে না। সেও চলে গেল।’ সাংবাদিকের এ মন্তব্যের পর চেয়ারম্যানসহ পেট্রোবাংলার কর্মকর্তা ও উপস্থিত অন্য সাংবাদিকরাও তেলের আলোচনা বাদ দিয়ে ‘মেগাওয়াট’ সংক্রান্ত সরস আলোচনায় লিপ্ত হলেন। জেনারেটর চালু হওয়া পর্যন্ত ‘মেগাওয়াট’ নিয়ে ওইদিন এক প্রাণবন্ত ও উপভোগ্য আলোচনা হয়। দেশের বর্তমান ‘বিদ্যুতের নাই অবস্থায়’ বিদ্যুত্ উত্পাদন ও বিতরণকারী সংস্থাগুলোর একই মন্তব্য, ‘বর্তমানে যে হারে বিদ্যুতের লোডশেডিং হচ্ছে তা নজিরবিহীন। এর আগে বাংলাদেশে এ ধরনের লোডশেডিং আর হয়নি।’ রাজধানীতে বিজলি চমকানোর মতো বিদ্যুত্ আসা-যাওয়া করলেও পল্লী এলাকার মানুষ ২-৩ দিন পর বিদ্যুতের দেখা পান। বিদ্যুিভত্তিক ব্যবসা-বাণিজ্য লাটে উঠেছে। ক্ষুব্ধ জনগণ সারা দেশের জেলা ও উপজেলায় বিদ্যুতের দাবিতে সড়ক অবরোধ, বিদ্যুত্ অফিস ভাংচুর, বিদ্যুত্ কর্মকর্তাদের মারধর—এসব এখন নিত্য ঘটনা। তীব্র লোডশেডিং যন্ত্রণায় কাতর জনগণের সঙ্গে ক্ষোভে ফুঁসছেন মহাজোটের শীর্ষস্থানীয় নেতারাও। এ নিয়ে জাতীয় সংসদে গত অধিবেশনেও রসাত্মক আলোচনা হয়েছে। সরকারদলীয় এমপি ফজলে রাব্বি স্পিকারের উদ্দেশে বলেছেন, ‘আজকে আমি গোসল করে আসতে পারিনি। বিদ্যুত্ ছিল না, তাই পাম্প দিয়ে পানি উঠানো সম্ভব হয়নি। মাঝেমধ্যে বাথরুম করে শৌচ কাজ সম্পাদন করার মতোও পানি পাওয়া যায় না।’ অ্যাডভোকেট রাব্বির এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করে আ’লীগের প্রবীণ নেতা তোফায়েল আহমদও বলেছেন, ‘অনেক দিন হলো এলাকায় যাইনি। গেলেই জনগণ জানতে চায়, বিদ্যুত্ গেল কই? জবাব দিতে পারি না।’ গত কয়েক মাস ধরে এমন কোনো সভা-সমাবেশ, সেমিনার, সেম্পোজিয়াম হয়নি যেখানে প্রধানমন্ত্রী ও তার উপদেষ্টারা বিদ্যুত্ উত্পাদন নিয়ে নিজেদের সাফল্যের কথা তুলে ধরেননি। প্রতিনিয়তই তারা তিন হাজার ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদনের ‘বায়বীয়’ হিসাব দিয়ে আসছেন। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বিদ্যুতের চলমান সঙ্কটের জন্য বিগত বিএনপি জোটের পাঁচ বছর ও মইন-ফখরুদ্দীনের ‘দানবীয় অসাংবিধানিক’ সরকারের দুই বছরের শাসনকে দায়ী করেন। তবে মইন-ফখরুদ্দীনের দুই বছরে বিদ্যুতের জন্য কিছু না করাটা দোষের নয় বলেই আমার কাছে মনে হয়। কেননা, অসাংবিধানিক ওই সরকারকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ‘আন্দোলনের ফসল’ ঘোষণা দিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি গত জাতীয় নির্বাচনের আগে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ক্ষমতায় এলে ১/১১’র সরকারের কর্মকাণ্ডের বৈধতা দেবেন।’ কাজেই বিদ্যুত্ উত্পাদন না করার অপরাধ থেকে মইন-ফখরুদ্দীনের দানবীয় সরকার মাফ পেয়ে গেছে বলা চলে। তবে প্রকৃত তথ্য হচ্ছে, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার আগে দেশে সর্বোচ্চ বিদ্যুত্ উত্পাদন হয়েছিল ৪ হাজার ১০০ মেগাওয়াট, যা এখন সাড়ে ৪ হাজারে উন্নীত হয়েছে। মেগাওয়াটের হিসাব বোঝার জন্য পিডিবি’র দেয়া এ তথ্যই যথেষ্ট বলে আমার মনে হয়। এ কথা স্বীকার করতেই হবে, বিদ্যুত্ পরিস্থিতির উন্নতির জন্য ৩৪ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি, রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুত্ কেন্দ্র স্থাপন, ঘড়ির কাঁটা ১ ঘণ্টা এগিয়ে আনাসহ সরকার অনেক কাজই করেছে। ঘড়ির কাঁটা ১ ঘণ্টা এগিয়ে আনার যৌক্তিকতা তুলে ধরে তত্কালীন সংস্থাপন সচিব ইকবাল মাহমুদ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, এতে ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ সাশ্রয় হবে। তার এ যুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে একজন সাংবাদিক পাল্টা প্রশ্ন রেখে বলেছিলেন, ঘড়ির কাঁটা ১ ঘণ্টা এগিয়ে আনলে যদি ৩০০ মেগাওয়াট সাশ্রয় হয় তাহলে কেন ৩ ঘণ্টা এগিয়ে দিয়ে ৯০০ মেগাওয়াট সাশ্রয় করা হবে না। সেদিন এ প্রশ্নের কোনো জবাব দেননি তিনি।
আমার বাসায় বিদ্যুতের মিটারের রিডিং নিতে আসা ডিপিডিসি’র রিডারকে বললাম, আপনি ‘মেগাওয়াট’ সম্পর্কে কিছু জানেন? মুচকি হেসে জবাব দিলেন, ‘মেগাওয়াট’ নয় আমার কাজ হচ্ছে ‘ইউনিট’ নিয়ে। তবে বিদ্যুত্ গেলেই এখন মানুষ বলছে ‘মেগাওয়াট’ গেল। ফিরলে বলে ‘মেগাওয়াট’ এলো।
লেখক : সাংবাদিক

হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশ্তী (রাহ:) -এর জীবন ও শিক্ষা



 শাহ্ কাওসার মুস্তাফা চিশ্তী আবুলউলায়ী  
আ জ ৬ই রজব ১৪৩৩ হিজরী, সুলতানুল হিন্দ হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশ্তী আজমেরী (রাহ:)-এর ৮০০ তম উরস মুবারক উদযাপিত হচ্ছে। ৬৩৩ হিজরী ৬ই রজব/১৬ মার্চ ১২৩৬ খ্রী তিনি ভারতের আজমীর শহরে ইন্তেকাল করেন। তিনি যে কতবড় উচ্চমার্গের অলি ছিলেন তার নিদর্শন প্রকাশ পেয়েছিল তার ওফাতের ঠিক পর মুহূর্তেই। উপমহাদেশের বিখ্যাত আলেমে দীন হযরত শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী (রাহ:) তাঁর আখ্বারুল আখিয়ার নামক সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে, হযরত খাজা সাহেবের ললাটে তাঁর ইন্তেকালের পর পরই “হাবীবুল্লাহ মাতা ফী হুব্বিল্লাহ”(অর্থাত্ আল্লাহর হাবীব(প্রিয়তম) আল্লাহর প্রেমেই ইহ্ধাম ত্যাগ করেছেন) শীর্ষক বাক্যটি ফুটে ওঠে। তিনি উপমহাদেশে এসেছিলেন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়াসাল্লামের নায়েব হিসেব। একথা সত্য যে, তার আগমনের বহু আগেই ইসলাম ও মুসলমানদের ভারতবর্ষে আগমন ঘটে এবং অনেক সুফী সাধক ইসলাম প্রচারে নিজেদের নিয়োজিত করেন। কিন্তু হযরত খাজা সাহেবের আগমনে ইসলাম প্রচারে এক বিপ্লব ঘটে এবং তা একটি সামাজিক বিপ্লবেও রূপান্তরিত হয়। তাঁর আবির্ভাবের পূর্বে বিশেষ করে খ্রিষ্টীয় একাদশ ও দ্বাদশ শতাব্দীতে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ চরম পর্যায়ে উপনীত হয়। উঁচু বর্ণের হিন্দু সমাজ তাদের স্ব-ধর্মের নিচু বর্ণের লোকদেরকে অত্যন্ত ঘৃণার চোখে দেখতে থাকেন। সাধারণ মানুষ উচ্চ বর্ণের লোকদের দ্বারা কীভাবে নিগৃহীত হচ্ছিলেন তার বিবরণ আবু রায়হান আল-বিরূনীর কিতাবুল হিন্দ নামক গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক প্রফেসর খালীক আহ্মাদ নিজামী তার তারীখে মাশায়েখে চিশ্ত নামক গ্রন্থে বিষটির উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন যে, আল্লাহ তাদেরকে মানুষ বানিয়েছিলেন কিন্তু তার বান্দারা তাদেরকে, অর্থাত্ নিচু শ্রেণীর লোকদেরকে জানোয়ারের জীবন যাপনে বাধ্য করছিল। আল-বিরূনী আরো বলেন যে, হিন্দুদের মধ্যে জাতিভেদ প্রকট থাকায় এবং মুসলমানদের মধ্যে কোরআনের আয়াত “ইন্না আক্রামাকুম ইন্দাল্লাহি আত্কাকুম” (অর্থাত্ আল্লাহর কাছে সেই সম্মানিত যে আল্লাহকে অধিক ভয় করে) এর মর্মার্থ অনুযায়ী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে মানবীয় মর্যাদা সম্পর্কিত সম্পূর্ণ ভিন্নতর দুটি চিন্তাধারা বিরাজমান ছিল।
হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশ্তী (রাহ:) সেই সময় এই সব জাতিভেদ এবং স্পৃশ্য-অস্পৃশ্যতার বেড়াজাল ছিন্ন করে তাওহীদের দর্শন প্রচার করেন। তাঁর এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে দলে দলে লোক ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নেয়া শুরু করেন। এখানে উল্লেখ্য যে, হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশ্তী (রাহ:) ইরানের সিজিস্তান নামক স্থানে ৫৩৬/৫৩৭ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম খাজা গিয়াসুদ্দীন হাসান। তিনি অত্যন্ত ধার্মিক ছিলেন। খাজা সাহেব মাত্র ১৫ বছর বয়সে পিতৃহীন হন। পৈতৃক সূত্রে তিনি একটি ফলের বাগান লাভ করেছিলেন। ইব্রাহিম কান্দুযী নামক একজন মজ্জুব বুযুর্গের সংস্পর্শে এসে তাঁর জীবনে আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়। তিনি তাঁর ফলের বাগান অন্যদের দান করে দুনিয়াত্যাগী একজন সাধক হিসাবে নতুন জীবন শুরু করেন। আল্লাহ্র রাস্তায় সফরকালীন সময় নিশাপুরের নিকটে হারূন বা হারভান নামক স্থানে চিশিতয়া তরীকার প্রখ্যাত শায়খ হযরত খাজা উসমান হারূনী (অনেকের মতে হারভানী) এর সাক্ষাত্ ঘটে এবং তাঁর কাছে  বায়আত  গ্রহণ করেন। আখবারুল আখিয়ার নামক গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, হজরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশ্তী (রাহ:) দীর্ঘ ২০ বছর ধরে আপন পীর ও মুর্শেদের খিদমতে থেকে উচ্চতর আধ্যাত্মিক মর্যাদা লাভ করেন। এটা ঐতিহাসিক সত্য যে, খাজা সাহেবের এই বাণী অক্ষরে অক্ষরে সত্যে পরিণত হয়েছিল। আফগানিস্তানের অন্তর্গত ঘোর প্রদেশের সাধনকর্তা মঈমুদ্দীন মুহাম্মদ বিন সাম, যিনি শাহাবুদ্দীন মুহাম্মদ ঘোরী নামে সমধিক পরিচিত। স্বপ্নযোগে হযরত খাজা সাহেবের নির্দেশ পেয়ে ভারত আক্রমণ করেন। দিল্লির সন্নিকটে উভয়ের মধ্যে চরম যুদ্ধ হয় এবং সেই যুদ্ধে দেড়শত ভারতীয় রাজন্যবর্গ পৃথ্বীরাজের পক্ষ অবলম্বন করে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন কিন্তু তাঁদের সকল প্রতিরোধ চূর্ণ করে ঘোরী বিজয়ী হন এবং পৃথ্বীরাজকে জীবিত অবস্থায় বন্দি করা হয় এবং সুলতানের নির্দেশে তিনি নিহত হন। এভাবে এই মহান সাধকের দোআয় এই অত্যাচারী শাসকের হাত থেকে জাতি হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশ্তীর দরবারে গরীব, ধনী সবাই সমানভাবে সমাদৃত হতেন। গরীব মিসকিনকে তিনি অত্যন্ত ভালবাসতেন। এই জন্য তাঁর অত্যন্ত বহুল প্রচলিত উপাধি হল গরীবে নেওয়াজ। হযরত গরীবে নেওয়াজ এর রূহানী ফায়েজে এত বিপুল সংখ্যক লোক ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন যে, ইতিহাসে আর কোন মনীষীর হাতে এত অধিক লোক ইসলাম গ্রহণ করেছেন বলে উল্লেখ নেই। প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় নেতা খাজা হাসান নিজামী বিভিন্ন ঐতিহাসিক গ্রন্থ পর্যালোচনা করে তাঁর প্রখ্যাত গ্রন্থ নিজামী বাঁসরীতে উল্লেখ করেন যে, হযরত গরীবে নেওয়াজ এর হাতে প্রায় এক কোটি লোক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। আর এভাবেই সারা ভারত বর্ষে ইসলামের ব্যাপক প্রচার শুরু হয়। হযরত খাজা সাহেবের পরে তাঁর খলিফাগণ, তাঁদের খলিফাগণ এবং অন্যান্য সূফীয়ে কেরাম ও ধর্ম প্রচারকগণ ইসলাম প্রচারের কাজ অব্যাহত রাখেন এবং বিপথগামী মানুষদের সুপথ প্রদর্শন করতে থাকেন। আজ এই উপমহাদেশে, পঞ্চাশ কোটির অধিক মুসলমানের বাস। এর মূল ভিত হযরত গরীবে নেওয়াজ স্থাপন করে গেছেন। তাঁর শিক্ষার মূল বিষয় ছিল আল্লাহ ও তাঁর সৃষ্টির প্রতি প্রেম। তাঁর কাছে খোদা প্রেমই সবচেয়ে বড় শক্তি। যে আল্লাহকে ভালবাসে সে কোন অপশক্তির কাছে মাথা নত করে না। আজ সমাজে যে হিংসা-বিদ্বেষ বিরাজ করছে এর নিরসনে সকলের খাজা গরীবে নেওয়াজের প্রেমের দর্শন থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত। আর তিনি শিক্ষা নিয়েছিলেন আল্লাহর হাবীব রাহমাতাল্লীল আল-আমিন হযরত রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়াসাল্লামের জীবন দর্শন থেকে। নায়েবে নবী সুলতানুল হিন্দ হযরত গরীবে নেওয়াজের ৮০০তম উরসের এই দিনে প্রার্থনা করি এই উপমহাদেশ তথা সমগ্র বিশ্বে শান্তি বিরাজ করুক, সকলে মহান আল্লাহর প্রেমে উজ্জীবিত হয়ে তাঁর সমগ্র সৃষ্টিকে ভালবাসুক।
n লেখকঃ  প্রফেসর, দর্শন বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

‘জেনেশোনে বিষ করেছি পান' এই মধুমাসে


সাজজাদ হোসাইন খান

জ্যৈষ্ঠমাসকে বলা হয় মধুমাস। এ মাসে নানা ধরনের রসালো ফলে সয়লাব হয় হাট-বাজার। এক সময় শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলো ছুটি ঘোষণা করতো এ মাসে। এই ছুটির নাম ছিল আম-কাঁঠালের ছুটি, গ্রীষ্মের ছুটি নামেও পরিচিতি ছিল। ছাত্র-ছাত্রীগণ গ্রামে ছুটে যেত, ফল-উৎসব করতো। নানাবাড়ি, দাদাবাড়ি করতো। একটা অন্যরকম অনুভূতি আনন্দে আন্দোলিত করতো বড়-ছোট সবাইকে। এখন আর সে দৃশ্য দেখা যায় না। স্কুল-কলেজগুলোতেও আম-কাঁঠালের ছুটির অস্তিত্ব নাই। থাকলেও তা নামে মাত্র। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে ফল-ফলাদির গাছ প্রায় উজাড়। গ্রাম-গঞ্জ বৃক্ষশূন্য হতে চলেছে। প্রয়োজনের তুলনায় অপর্যাপ্ত হলেও নানা কিসিমের ফল কেবল আম-কাঁঠালই নয় বিভিন্ন নামের রসালো ফল বাজারে আসে। এই ফলের মিষ্টিগন্ধ তখন বাতাসকে উতলা করে, হৃদয়কে করে প্রশান্ত, আর রসনাকে করে তৃপ্ত। জ্যৈষ্ঠমাস এখন উপস্থিত রসালো ফলের ডালি নিয়ে। আম, কাঁঠাল, জাম, লিচু, তরমুজসহ আরো অনেক ফলই এখন বাজারে। কিন্তু উচ্চমূল্যের কারণে অনেকেরই নাগালের বাইরে এসব ফল। বিশেষ করে স্বল্প আয়ের মানুষের কাছে ফল ভক্ষণ এক প্রকার দুরূহ ব্যাপার। তবু মওসুমী ফলের অপেক্ষায় থাকে শহর-গ্রামের মানুষ।
ফিবছর এই সময়টা আসে আনন্দ-উল্লাসের সাথে। পাশাপাশি আতঙ্ক-আশঙ্কাও ছড়িয়ে পড়ে দেশময়। কারণ এইসব ফলের শতকরা আটানববই ভাগই থাকে বিষ বহনকারী। ফল ভক্ষণের ফলে দীর্ঘমেয়াদী বিষক্রিয়ায় মানবদেহ জেরবার হয় মারাত্মক সব ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে। পুষ্টির পরিবর্তে মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ায়। কোন সময় ফলের পচন রোধে আবার কোন সময় অপুষ্ট ফল পাকানোর জন্য ওষুধ প্রয়োগ করে একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী। যে ওষুধ মানবদেহকে মারাত্মক ক্ষতির দিকে ধাবিত করে। শেষাবধি মৃত্যুর কারণ হয়। তাই এই দুষ্টচক্রকে ‘অসাধু' বিশেষণের আওতায় না এনে সরাসরি ‘খুনি' শব্দটি ব্যবহার করা দরকার। চিকিৎসা-বিজ্ঞানের মতে, ফলে যে পরিমাণ অহিতকর ওষুধ মেশানো হয় তা মানবদেহে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করে। পুষ্টির পরিবর্তে অপুষ্টির জন্ম দেয়। প্রতি মওসুমে এই বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয় পত্র-পত্রিকায়, সভা-সেমিনারে। বছর ঘুরলেই সব ভুলে যায় মানুষ। দ্বিগুণ উৎসাহে খুনি ব্যবসায়ীরা কার্বাইড-ফর্মালিন ইস্তেমাল শুরু করে। যদিও অভিযান জরিমানার মহড়াও সরকারের বিশেষ বিভাগগুলোর পক্ষ থেকে করা হয়। এসব অভিযানে তেমন কোন ইতিবাচক লক্ষণ বাজারে পড়তে দেখা যায় না। বিষ মেশানো ফলে বাজার ভরা থাকে। বেচা-বিক্রিও মন্দ হয় না। প্রতি মওসুমেই সরকারের এই বিভাগটি তাদের জনসংখ্যার স্বল্পতা এবং যন্ত্রপাতির অপ্রতুলতার অজুহাত প্রকাশ করে। এই অজুহাত আর কতকাল চলবে? কুমিরের এক ছানাকে সাতবার দেখানোর মতো হয়েছে এদের। প্রশ্ন রাখলেই তারা একটি শব্দই উচ্চারণ করে ‘অল্প-স্বল্প' ইত্যাদি। তবে দেশবাসীর ধারণা, কথিত স্বল্পতার পশ্চাতে অন্য কোন বৃহৎ কারণ লুকিয়ে থাকা বিচিত্র নয়। যেমন ফুটপাত পরিষ্কার হয় না আইনশৃক্মখলা বাহিনীর সাথে ফুটপাত ব্যবসায়ীদের বামহাতের কায়কারবারের কারণে। এটি যেভাবে ওপেন সিক্রেটের তালিকায় উঠে গেছে ঠিক তেমনি এই বিভাগটিরও সিক্রেটের ফুল ফুটতে শুরু করেছে ইতোমধ্যে। এত জরিমানা-সাবধান বাণী শুনানোর পরও প্রতি মওসুমে একই দৃশ্য কেন দেখছে মানুষ। বিষেভরা লোভনীয় ফলে বাজার সয়লাব হবে কেন? খুনি তেজারতরা চাঙ্গা হয় কোন সাহসে!
আপাতকারণ গুরুপাপে লঘুদন্ড। খুনির ফাঁসির বদলে যদি সাতদিনের হাজতবাস হয় তাহলেতো খুনির পোয়াবারো হবেই। হাজতবাস শেষ করে বিপুল উৎসাহে দ্বিতীয় খুনের আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। এমনটাই অপরাধীর দস্তুর। ফল ফসলে যারা বিষ মিশায় অধিক লাভের আশায়, কঠিন শাস্তির পরিবর্তে জরিমানা-টরিমানায় এদেরকে নিবৃত করা সম্ভব হবে না। কারণ অর্থলোভ একটি দুরারোগ্য ব্যাধির নাম। এই জাতীয় ব্যাধি উপশমে প্রয়োজন উচ্চতর চিকিৎসা, উচ্চতর চিকিৎসক। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে দেশে এ দু'টিরই অভাব প্রকট।
ফল-ফলাদিতে বিষ, আনাজ-পাতিতে বিষ, বিশেষ করে খাবার জিনিসে বিষ প্রয়োগের মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। খাবার-দাবার এবং ফল-ফসলে নির্দিষ্ট মেয়াদে সংরক্ষণের জন্য প্রিজারভেটিভ ব্যবহারের একটা রীতি রয়েছে। তাও সহনীয় পরিমাণে, যা মানবদেহ ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে না। কিন্তু বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম। প্রিজারভেটিভের নামে এখানে সরাসরি বিষজাতীয় ওষুধ প্রয়োগ করা হচ্ছে। আনাজ-পাতিতেও একেবারেই অনাহূতভাবে ফর্মালিন-কার্বাইড জাতীয় ওষুধ স্প্রে করছে। মাছে ফর্মালিন মেশানো তো বর্তমানে স্বাভাবিক রীতি হিসাবেই উঠে আসছে। অপুষ্ট ফল পাকানোর জন্য ব্যবহার করে কার্বাইড। এসব ওষুধের মাত্রাতিরিক্ত প্রয়োগ বিষয়টিকে জটিল করে তুলছে। চিকিৎসকরা বলছেন, ফলে বিষ মানব দেহে ক্যান্সারের মতো মারাত্মক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। হৃদরোগ, ডায়াবেটিসের মতো রোগীর সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে কেবলমাত্র বিষাক্ত ফল ভক্ষণের কারণে।
এরই মধ্যে মওসুমী ফল আম নামতে শুরু করেছে। ফলের দোকানগুলোতে সাজানো আছে পাকা আম। আসলেই কি এগুলো পাকা? পরীক্ষা করলে দেখা যাচ্ছে, অপুষ্ট আম কার্বাইড প্রয়োগ করে পাকানো হয়েছে। ইতোমধ্যে বিএসটিআই লোকজন বিভিন্ন আড়তে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ কার্বাইড যুক্ত আম ধ্বংস করেছে। ফি-বছরই তারা এ কাজটি করে থাকেন। তারা নিজেরাই ঘোষণা করেন তাদের লোকবল এবং যন্ত্রপাতির অপ্রতুলতার কারণে অভিযান অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এই সুযোগে খুনি-ব্যবসায়ীরা মুনাফা গুণে। বিপরীতে বিষভরা আম খেয়ে ক্রেতা সাধারণ অসুস্থ হয়।
এই অপরাধের দন্ড যে পরিমাণ তা মোটেও যুক্তিযুক্ত নয়। পাঁচ-দশ হাজার বা লাখ টাকা জরিমানা অপরাধের তুলনায় এটি কোন শাস্তিই নয়। এই জরিমানার অর্থ তারা তুলে নিচ্ছে অন্য কোন চালান থেকে। যে জন্যে এই অপরাধের মাত্রা কমার বদলে বৃদ্ধি পাচ্ছে। খাদ্যদ্রব্যে যারা বিষ মিশায় তারা আসলে জীবননাশের অপরাধে অপরাধী। খুনের বদলে খুন। এদের অবশ্যই মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা উচিত। নিদেন পক্ষে যাবজ্জীবন কারাদন্ড। সেখানে ৫/১০ হাজার টাকা জরিমানা হাস্যকর বলেই মনে হয়। সভ্যদেশে খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল মারাত্মক অপরাধ বলেই বিবেচিত হয়। প্রয়োজনবোধে আইনের সংশোধন দরকার। আইন কঠোর না হলে, শাস্তির মাত্রা বৃদ্ধি না পেলে খুনি-ব্যবসায়ীগণকে নিবৃত করা হবে অসম্ভব। তাছাড়া একটি-দুটি আড়ৎ এবং ৫-১০ মণ আম ধ্বংস করে শুদ্ধি অভিযানের শুদ্ধতার ফল পাওয়া যাবে না। কেবল পাইকারী দোকানদার নয়, খুচরা দোকানগুলোতেও হানা দিতে হবে। ঘোষণা দিতে হবে যার কাছেই বিষ মাখানো ফল পাওয়া যাবে, তারই জেল-জরিমানা। যেমন নকল নোটের ব্যাপারে ঘোষণা আছে। তাছাড়া যারা অভিযানের হর্তাকর্তা তাদের সাধুতা এবং স্বচ্ছতা অপরাধীদের দ্বিতীয়বার অপরাধে অগ্রসর হতে একশ'বার ভাবনায় ফেলবে। এমন ঘোষণা এবং কার্যক্রম যতসত্বর আসবে ততই মঙ্গল দেশ এবং জনগণের জন্যে।
কার্বাইড-ফরমালিন পুষ্ট ফলে বাজার সয়লাব হবার আরও একটি বড় কারণ হলো ক্রেতাসাধারণের নির্বুদ্ধিতা এবং অসচতেনতা। ফলে বিষ এ তথ্যটি বোধ হয় কারো অজানা থাকার কথা নয়। যেভাবে এ খবরটি পত্র-পত্রিকায় চাউর হয় তাতে করে তো বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরেই পৌঁছে যায়। এরপরও এক শ্রেণীর মানুষ মওসুমের প্রথম ফলটির আস্বাদ নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এই ব্যস্ততায় খুনি ব্যবসায়ীরা উৎসাহ পায়।  জেনে-শোনে যদি কেউ বিষ পান করে তাকে নিবৃত করা কষ্টকর তো বটেই। যে জন্যে বিষ মাখানো ফল বাজার পায়। মওসুমের প্রথম ফলটি খেতে হবে। অবশ্যই খাব, যদি তা পুষ্ট এবং স্বাস্থ্যকর হয়। কিন্তু প্রায়শই দেখা যায়, বাজার থেকে যে ফলটি কেনা হচ্ছে এর ৯৮ ভাগই ভেজাল, শরীরের জন্য ক্ষতিকর। তারপরও কেউ কেউ হুমড়ি খেয়ে পড়ে দোকানে। এ ধরনের বেবুঝ ক্রেতার কারণেও অসাধু বা খুনি-ব্যবসায়ী যে নামেই ডাকা হয়, যাদের দৌরাত্ম্য কমছে না। ক্রেতাদেরও দায়িত্ব আছে। নিজের বুঝতো পাগলেও বুঝে। আমরা কি পাগলের চেয়েও অধম হয়ে গেলাম?

যে দেশে শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড



অ জ য়  দা শ গু প্ত
আমার সন্তানটি এবার ম্যাকুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করল। অস্ট্রেলিয়ায় অভিবাসন নিয়ে আসার সময় ওর বয়স ছিল আট। পড়ত দ্বিতীয় শ্রেণীতে। তৃতীয় শ্রেণী না হয়ে এক লাফে চতুর্থ শ্রেণী থেকে তার শিক্ষাজীবনের শুরু। সে এক কাহিনী বটে। বঙ্গদেশ থেকে দু’ক্লাস উত্তীর্ণ শিশুর তো তৃতীয় ক্লাসেই যাওয়ার কথা। তা ছাড়া আমাদের ইংরেজি জ্ঞান বা পড়াশোনার পদ্ধতিও এদের চেয়ে অগ্রসর। ধারণা ছিল তাকে পুনর্বার দ্বিতীয় শ্রেণী থেকেই শুরু করতে হবে। হল উল্টো, কেন এই ব্যতিক্রম? তখন কি আর জানতাম, এ দেশে শিক্ষাও নিয়মের অধীনে, সুশৃঙ্খল আর সবার জন্য সাম্য মেনে চলে। জুনের আগে জন্মালে যে ক্লাসে, জুনের পরে জন্মালে তার পরের ক্লাসে পড়তে হবে এটাই নিয়ম। যেহেতু তার জন্ম মে মাসে, তাকে জোর করেই চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি করানো হল। এই নিয়মের কারণে আমাদের দেশের মতো জন্মদিন, মাস বা বয়স নিয়ে বিশৃঙ্খলা নেই, নেই কোনো ঝুট-ঝামেলা। সবার জন্য এক নিয়ম, আর এই নিয়মের সূতিকাগার হচ্ছে রাষ্ট্র। প্রতিটি মানবশিশুর জন্মতারিখ, সময় আর জন্মের বৃত্তান্ত সেখানে রেজিস্টার্ড, সে দেশে এ জাতীয় বিধি মেনে চলার সমস্যা হওয়ার কারণ নেই। বলছিলাম প্রাথমিক শিক্ষার কথা। ছেলে তো চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে পড়ল ঘোর বিপদে, ভয়ে স্কুলেই যেতে চায় না। একদিন বিদ্যালয় প্রাঙ্গণের বিশাল বৃক্ষটিকে পরম মমতায় জড়িয়ে সে কী কাঁদা। অস্বাভাবিক কিছু নয়, একদিকে সহপাঠীদের ভাষা না বোঝার কারণে বোবার মতো থাকা, অন্যদিকে উঁচু ক্লাস। আমরা পড়লাম অগাধ সমুদ্রে। কী করে পার হব এই সঙ্কটসমুদ্র? একটাই সন্তান আমাদের, আর তার ভবিষ্যত্ ভেবেই তো অভিবাসনের নামে দেশান্তরী হওয়া। কী আশ্চর্য! আমাদের চেয়েও বিচলিত হয়ে উঠল স্কুল। স্কুলের রাশভারী ডেপুুটি প্রিন্সিপাল ডেকে পাঠালেন আমাকে। ভাবলাম কপালে নির্ঘাত ভোগান্তি আছে। গালমন্দ দিয়ে হয়তো ছেলেটিকে হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলবে, ‘অনেক হয়েছে বাপু, এবার নিয়ে যাও।’ গিয়ে দেখি অন্য কাণ্ড। ভদ্রলোকই উল্টো আমাকে সরি সরি বলে ক্ষমা চেয়ে অস্থির। এক মাস হয়ে যাচ্ছে তবু তারা তাকে ধাতস্থ করতে পারছে না বা সে ধাতস্থ হচ্ছে না, এ যেন তারই দায়। অবাক করে দিয়ে বললেন, ওই হপ্তা থেকে তার জন্য অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা হয়েছে। আমি তো প্রমাদ গুনতে শুরু করলাম, সবেমাত্র চাকরিতে ঢুকেছি, গিন্নি তখনও শিক্ষানবিশ, এ সময় অতিরিক্ত শিক্ষা ও শিক্ষকের জন্য ডলার জোগাড় করব কীভাবে? ডেপুটি প্রিন্সিপালই জানালেন এসব ক্লাস বা ওর শিক্ষার জন্য তারা যেসব ব্যবস্থা নিচ্ছেন সবই ফ্রি। উল্টো আমাকেই চয়েস দিলেন, ভালো না লাগলে বা উন্নতি না দেখলে যেন যোগাযোগ করি। সে বিস্ময় আমার আজও কাটেনি। প্রাথমিক শিক্ষার সূচনাপর্বে কাঁচুমাচু সন্তানটি এখন এ দেশের মূলধারায় নাটক করে, ইংরেজি পড়ায়। তার যাবতীয় কৃতকার্যতার পেছনে আছে শৈশবের ওই স্কুলিং, আর সুযোগ যারা দিয়েছিলেন সেসব শিক্ষক এ দেশের অন্যতম সম্মানিত ও প্রতিষ্ঠিত নাগরিক। এ দেশে বা যেকোনো উন্নত দেশে স্কুলের শিক্ষকতা পাওয়া বা শিক্ষক হতে পারাটা পরম গৌরবের। শুধু সামাজিক মর্যাদা বা জ্ঞানের কারণে নয়, এদের বেতন এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও আকর্ষণীয়। উঁচু বেতনে প্রাচুর্য আর সচ্ছলতার ভেতর থাকেন বলেই উজাড় করে শিক্ষা ও শিক্ষার্থীকে সময় দেন তারা। বলাবাহুল্য এ দায়িত্বের পুরোভাগে আছে সরকার ও রাষ্ট্রব্যবস্থা।
এ তো গেল সিডনি তথা অস্ট্রেলিয়ার কথা। আমাদের উপমহাদেশের অপেক্ষাকৃত অগ্রসর দেশগুলোর কথাই ভাবুন। এশিয়ার উন্নত দেশ ও সমাজেও শিক্ষকরা আছেন বহাল তবিয়তে। যে দেশের অর্থনীতি যেমন বা জীবনের মান যেমন তেমনি ধারায়ও তার অধীনে সমাজের শীর্ষে আছেন শিক্ষককুল। প্রাথমিক শিক্ষা বিশেষত স্কুলের প্রথম পাঠ, যেখানে জীবনের বীজ বোনার কাজ শুরু হয়, সেই বীজতলার প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখে সমাজ ও সমাজপতিরা। আমাদের দেশেও সে ধারা চালু ছিল। প্লেইন লিভিং আর হাই থিংকিংয়ের স্বর্ণযুগে শিক্ষকরাই ছিলেন আদর্শ। রোল মডেল বলে পরিচিত শিক্ষকদের ভেতর প্রাথমিক স্তরের শিক্ষকরাই ছিলেন অধিক আদৃত। সাইকেল চালিয়ে মাইলের পর মাইল ছুটে শিক্ষা ও জ্ঞান বিতরণ করতেন তারা। অতি সস্তা দামের পাঞ্জাবি-পায়জামা বা সাধারণ পোশাকের এসব শিক্ষককে দেখে রক্তচক্ষু চেয়ারম্যান, এমপি বা পাড়ার গুণ্ডারাও ভড়কে যেত। আদাব-সালাম পায়ে ধরে দোয়া-আশীর্বাদ চাওয়াটা ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। পাড়া-মহল্লা বা গ্রামগঞ্জে যে কোনো আপদ-বিপদ বা সালিশ-বিচারে এরাই ছিলেন নিয়ামক। কালক্রমে কালো টাকা, সন্ত্রাস আর দুর্নীতির চাপে অন্য ধরনের মানুষ ‘হঠাত্ বড়লোক’ হয়ে ওঠা বাঙালিরাই সব কিছু গ্রাস করে নিল। মাতব্বর আর সমাজপতিদের দৌরাত্ম্যে একঘরে হতে হতে শিক্ষকরা আজ পরাজিত ও পর্যুদস্ত। প্রাইমারি শিক্ষকের হাল যে কোথায় নেমেছে সাম্প্রতিক ঘটনাবলিই তার বড় উদাহরণ। রাষ্ট্র কোথায় পাশে এসে দাঁড়াবে, কোথায় তাকে আশ্রয় দেবে, বড় বা উজ্জ্ব্বল করে তুলবে, তার পরিবর্তে রাস্তায় নেমে এসেছে প্রতিপক্ষ হয়ে। সে প্রতিপক্ষ বা শত্রুতা আজ এতই প্রকট, জাতির কাঁধে তুলে দেওয়া হয়েছে শিক্ষার লাশ। আমি ভাবি এমন ঘটনা বা এর সিকিভাগও যদি এসব দেশে ঘটত, তোলপাড় হয়ে যেত সবকিছু। সরকারের গদি তো নড়তই, রাষ্ট্রও বিচলিত হয়ে উঠত। ধন্য আমাদের সমাজ, ধন্য বঙ্গদেশ, এই ভারি লাশের বোঝাও তাকে কম্পিত বা নতজানু করতে পারল না। শিক্ষা তবে কোন দেশের কোন জাতির মেরুদণ্ড? আমাদের না উন্নত দেশগুলোর?
লেখক : প্রবাসী সাংবাদিক
dasguptajoye.hotmail.com

শনিবার, ২৬ মে, ২০১২

রূপলাল হাউসের সাতকাহন


পাশা শাহ
আপনারা অনেকেই আহসান মঞ্জিল এক নামে চেনেন। কিন্তু অনেকেই জানেন না পুরান ঢাকায় রূপলাল হাউস নামে একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা আছে। শুনে অবাক হতে হয় যে রূপলাল হাউসে বসবাসকারী অনেক বাসিন্দাই জানে না যে তাদের বসবাসকৃত ভবনটির নাম রূপলাল হাউস। পুরান ঢাকায় বহুবার গিয়েছি কিন্তু কোনোদিন সেখানে যাওয়া হয়নি। সেদিন শ্যামবাজারে ঢুকে খুঁজতে শুরু করলাম রূপলাল হাউস। কেউ চেনে না। শেষে একজনকে অনেক কথার পর জানতে চাইলাম আশপাশে কোনো পুরনো বাড়ি আছে কি-না। তবেই একজন দেখিয়ে দিল। কিন্তু এটা রূপলাল হাউস নামে কেউ চেনে না। অবশেষে অনেক অনুসন্ধান শেষে নিশ্চিত হলাম এই বাড়িটিই রূপলাল হাউস।
একটু পেছনে ফেরা যাক। ইতিহাসটা ফরাশগঞ্জের। ১৭৩০ সালে ফরাসিরা এ দেশে আসে ব্যবসার উদ্দেশ্যে। বুড়িগঙ্গার তীরে অবস্থিত একটি বাড়ি শেখ মতিউল্লাহর কাছ থেকে ফরাসিরা কিনে তাতে তাদের কুঠি তৈরি করে, যা বর্তমানে আহসান মঞ্জিল নামে পরিচিত। নায়িব আজিম এবং নওয়াজিশ আলী খানের অনুমতিক্রমে ফরাসিরা ব্যবসার উদ্দেশ্যে বাজার তৈরি করে নাম দেয় 'ফ্রেন্সগঞ্জ', যা পরবর্তীকালে বর্তমানে 'ফরাশগঞ্জ' নামে পরিচিত। তাদের ব্যবসা লাভজনক না হওয়ার ফলে ১৭৮৪ সালে তারা চলে যান। এরপর আরমেনিয়ান জমিদাররা ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে এলাকাটি লিজ নেন। ১৮৩৫ সালে নবাব আলিমুল্লাহ খান আহসান মঞ্জিলকে পুনরায় কিনে নেন। তারও আগে ১৮২৫ সালে আরমেনিয়ান জমিদার আরাতুন আহসান মঞ্জিলের সামান্য দূরে বুড়িগঙ্গার কোল ঘেঁষে (বর্তমান ১৫নং ফরাশগঞ্জ) একটি প্রাসাদোপম বাড়ি তৈরি করেন। ১৮৩৫ সালে রূপলাল দাস এবং তার ভাই রঘুনাথ দাস বাড়িটি কিনে নেন। এরপর থেকে বাড়ির নাম হয় রূপলাল হাউস।
রূপলাল দাস ছিলেন একজন জমিদার তথা ব্যবসায়ী। তিনি ছিলেন তার পরিবারের একমাত্র শিক্ষিত ব্যক্তি। তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন এবং সে সময় স্কলারশিপ পেয়েছিলেন ১০ টাকা। যত দূর জানা যায়, তিনি একজন সঙ্গীত অনুরাগী ছিলেন। সামাজিক কর্মকাণ্ডে তার যত না অংশগ্রহণ থাকত তার চেয়ে বেশি খরচ করতেন সঙ্গীতের পেছনে। সে সময় রূপলাল হাউসে নিয়মিত সঙ্গীতের আসর হতো। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান, ওস্তাদ ওয়ালী উল্লাহ খান এবং লক্ষ্মীদেবীসহ আরও অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ রূপলাল হাউসে সঙ্গীত আসরে নিয়মিত আসতেন। ১৮৮৮ সালে লর্ড ডাফরিন ঢাকায় আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। তাদের সম্মানে নাচ-গানের আসর কোথায় হবে তা নিয়ে প্রতিযোগিতা হয় আহসান মঞ্জিল এবং রূপলাল হাউসের মধ্যে। এতে অনেক বেশি ভোটে বিজয়ী হয় রূপলাল হাউস। সে সময় ৪৫ হাজার টাকা ব্যয়ে রূপলাল হাউসের আধুনিকীকরণ করা হয়। শ্রুত আছে যে, সে সময়কার বিদেশিরা ঢাকায় এলে রূপলাল হাউসে ভাড়া করে থাকতেন। সে যুগে রুমপ্রতি ভাড়া প্রদান করতেন ২০০ টাকা। শ্যামবাজারের পুরো ইতিহাস এই দাস পরিবারকে ঘিরেই।
১৮৯৭ সালে বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে বাড়িটি অনেকখানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর প্রায় পঞ্চাশ বছর বাড়িটির অনেক অংশ প্রায় অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকে। রূপলাল হাউসের একপাশে সুন্দর বাগান ছিল, যা 'রঘুবাবুর বাগান' এবং একপাশে একটি পুল ছিল যা শ্যামবাজার পুল নামে পরিচিত ছিল। কালের বিবর্তনে অযত্নে-অবহেলায় এগুলো নষ্ট হয়ে যায়। এরপর নদীকে ঘিরে বাজার গড়ে ওঠে, যার নামকরণ করা হয় শ্যামবাজার। বাড়ির ভেতরের অংশে ইউরোপিয়ান অফিসার এবং ব্যবসায়ীরা থাকার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু ১৯৩০ সালের দিকে নদীর অংশটি ব্যবসা কেন্দ্র হয়ে ওঠে। ফলে বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠলে তারাও জায়গাটি ত্যাগ করেন।
রূপলাল হাউসের সর্বশেষ মালিক রূপলালের পৌত্র যোগেন্দ্র দাস এবং তারকনাথ দাস। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাজনের পর দাস পরিবার সপরিবারে ভারতে পারি জমায়। শেষ হয় রূপলাল হাউসের এক পর্বের ইতিহাস।
এখানেই শেষ নয়। ১৯৪৮ সালে বাড়িটি সরকারি সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু সিদ্দিক জামাল নামে একজন দাবি করেন, তিনি দাস পরিবার থেকে ১৯৭১ সালে রঘুনাথের অংশটি কিনে নিয়েছেন। সে সুবাদে তিনি দ্বিতীয়তলায় বসবাস শুরু করেন। তারই সূত্র ধরে সিদ্দিক জামালের মৃত্যুর পর তার ছেলে দাউদ জামাল ১৯৭৩ সালে ভারতে চলে যান, এরপর নূরজাহান ও তার স্বামী দাবি করেন, এই অংশটি তাদের এবং তারা বর্তমানে দখলে আছেন। তারা এখানে গত তিরিশ বছর ধরে বসবাস করছেন। রূপলাল দাসের অংশটিতে প্রিন্স করিম আগা খান প্রিপারেটরি স্কুল চালু হয় ১৯৫৮ সালে। ১৯৭৩ সালে তা কলেজে উন্নীত করলে মাত্র ১৬ দিনের মাথায় তা গুটিয়ে ফেলা হয়। এরপর ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ সরকার রক্ষীবাহিনীর জন্য বাড়িটি রিকুইজিশন করা হয়। রক্ষীবাহিনীর বিলুপ্তির পর ১৯৭৬ সালে রূপলাল হাউসকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করলে পূর্ত মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।
দেখতে কেমন ছিল রূপলাল হাউস। তখনকার যুগের অত্যন্ত ব্যয়বহুল নির্মাণ রূপলাল হাউস। ইংরেজি 'ই' আকৃতির বাড়িটি যোগাযোগের সুবিধার্থে বুড়িগঙ্গার তীরে নির্মাণ করা হয়। বাড়ির সামনে থেকে দুটি সিঁড়িঘাট একেবারে নদীর জল নাগাদ নেমে গেছে। রূপলাল হাউসের ডিজাইন করে কলকাতার মার্টিন কোম্পানি। ইউরোপিয়ান নির্মাণ কৌশলে নির্মিত বাড়ির দৈর্ঘ্য ৯ হাজার ১৪৪ মিটার। প্রস্থ এক হাজার ৮৩০ মিটার। দ্বিতল বাড়িটির দুটি বল্গকে বিভিন্ন সাইজের ৫০টি কক্ষ আছে। ঠিক মাঝখানে কাঠের নৃত্যমঞ্চ। স্থাপত্য নকশায় যথেষ্ট বৈচিত্র্য এবং কারুকাজ বিদ্যমান। সমতল ছাদে তিনটি চিলেকোঠা আছে।
এ তো গেল ইতিহাসের কথা। বর্তমানে কেমন আছে রূপলাল হাউস। কাগজে-কলম আর বাস্তবতায় আকাশ-পাতাল ব্যবধান। অতীতের সেসব কথা আজ শুধুই স্মৃতি। রূপলাল হাউস তার রূপ হারিয়ে ফেলেছে অনেক আগেই আর এখন অস্তিত্ব বিলুপ্তির পথে। স্থানে স্থানে ভেঙে পড়েছে, মেরামতের কোনো উদ্যোগ নেই। ছাদে, কার্নিশে এবং অন্যান্য স্থানে বটগাছ গজিয়েছে। কিন্তু বসবাসকারীরা নির্বিঘ্নে বসবাস করে যাচ্ছেন। চারদিকে অসংখ্য দোকানপাটসহ স্থাপনা গড়ে উঠেছে। ফলে মূল ভবনকে খুঁজে পাওয়া বেশ দুষ্কর। নদীতে গিয়ে ছবির সঙ্গে বাড়িটিকে মেলানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু সামনের দোকানের জন্য মূল নকশা বিলীন হয়ে গেছে অনেক আগেই। তবে সেই সিঁড়িঘাট দুটি এখনও আছে।
পূর্ত মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, বর্তমানে পোস্তগোলার ১২৪৩নং খুঁটির কিছু বিজিবি সদস্য তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করেন। তাদের কোনো ভাড়া দিতে হয় না। এ ছাড়া ভবনের বেশ কিছু কক্ষ বিভিন্ন ব্যবসায়ী মন্ত্রণালয় থেকে লিজ নিয়ে ব্যবসা করছেন এবং তারা নিয়মিত ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে ভাড়া পরিশোধ করছেন।
আসলে কী হচ্ছে তা আমরা অনেকেই জানি না। বসবাসকারী অনেক বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, এই বাড়ির নাম রূপলাল হাউস এটা অনেকেই জানেন না। অন্যদিকে বাড়ির বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন মালিকের নামে (জামাল হাউস, আনোয়ারা হাউস ইত্যাদি) সাইনবোর্ড লাগানো আছে। তাদের প্রত্যেকেরই দাবি, এই অংশটি তাদের। এ বিষয়ে তারা আইনি লড়াইও চালিয়ে যাচ্ছেন। নিচতলার পুরোটাই ব্যবসায়ীদের দখলে। এখানে প্রতিদিন বসে পেঁয়াজ, রসুন, আদাসহ কাঁচা সবজির আড়ত। যার বড় অংশটাই রূপলাল হাউসের নিচতলায়।
সবশেষে বলতে হয় আহসান মঞ্জিলের মতো রূপলাল হাউসও ঢাকার একটি ঐতিহ্য। রূপলাল হাউসের যথাযথ সংরক্ষণ প্রয়োজন। প্রয়োজন মেরামতের। অনাকাঙ্ক্ষিত স্থাপনাগুলো ভেঙে দিয়ে মূল বাড়িটি পুনরায় মেরামত করলেই ফিরে পাবে রূপলাল হাউসের পুরনো সেই রূপ।

বৃহস্পতিবার, ২৪ মে, ২০১২

জাতীয় কবির জন্মদিনে

জাতীয় কবির জন্মদিনে



॥ মুস্তাফা জামান আব্বাসী ॥

আগামীকাল একটি বিশেষ দিন। জাতির জন্য গৌরবের, আনন্দের, পেছনে ফিরে তাকানোর। কবি নজরুল ১১৩ বছর আগে এই পৃথিবীতে আগমন করেছিলেন, জাতিকে উপহার দিয়েছিলেন নতুন দিগন্ত অভিসারী সাহিত্য, সঙ্গীতের ভুবনে প্রথম জাগরণী কণ্ঠ, জাতিকে যা দিয়েছে প্রেরণা নতুনভাবে বেঁচে থাকার। তার জীবন ছিল না কুসুমাস্তীর্ণ। মাত্র ১০টি বছর ছিল তার দেয়ার মুহূর্ত, দীর্ঘ ৩৪ বছর নির্বাক। বাংলাদেশ জাতি হিসেবে নজরুলের সাহিত্য-সঙ্গীত সাধনার পরিপূর্ণ ফসল।
আগামীকাল সকাল থেকে নানা অনুষ্ঠানে কবিকে স্মরণ করা হবে, এ দিনটিই তার জন্য বরাদ্দ, আর কোনো দিন নয়; ঠিক যেমন ঈদে মিলাদুন্নবীর দিন নবীকে স্মরণ করি, মাঝে মাঝে মিলাদে। প্রতিদিনই নবীকে স্মরণ করা, রোজই কুরআন শরীফ স্পর্শ করা; তা না হলে ওই একটি দিনে কিছুই হবে না। নবীই আমাদের আদর্শ, আর কেউ নয়। তেমনি জাতীয় কবির স্মরণ হবে প্রতিদিন, রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্র সর্বত্র।
রবীন্দ্র-নজরুলের স্মৃতিতর্পণ ব্যবস্থার দাবিদার প্রেসিডেন্ট এরশাদ। বন্ধু ড. এনামুল হক রাষ্ট্রীয়ভাবে কবি রবীন্দ্র ও নজরুলের কাছে আছেন। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারি। একবার এক হোমরাচোমরা ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করলামÑ কই ভাই, এতগুলো অনুষ্ঠান হয়ে গেল, কোনো দিন স্টেজে উঠতে পারলাম না। কারণটা কী? উনি বললেন ফিসফিস করে, অনুষ্ঠান রবীন্দ্রনাথ বা নজরুলকে খুশি করার জন্য কে বলল? বরং যিনি সবচেয়ে বড় অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট এরশাদ, তাকে খুশি করার জন্যই আমাদের যাবতীয় প্রয়াস। সামনাসামনি আপনাকে পছন্দ করলেও তার মনে সদা দ্বন্দ্ব। আপনি বিরাট ব্যক্তিত্ব আব্বাসউদ্দিনের ছেলে, খানিকটা হিংসা কাজ করেছে হয়তো। এখনো সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে।
আগামীকাল প্রধানমন্ত্রী বিরাট অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন, যেটি অনেক লোক টেলিভিশনে প্রত্যক্ষ করবে। আমি গানের ঘরে নিভৃতে গাইব যে গানটি : ‘ঘুমিয়ে গেছে শ্রান্ত হয়ে আমার গানের বুলবুলি’। জিজ্ঞেস করবেনÑ কেন? বলব, আগামীকালের দিনটির পরই নজরুলকে আর কেউ মনে করবে না। তিনি এক দিনের কবি, প্রতিদিনের নন; তাই তার প্রতি এত অবজ্ঞা। ব্যক্তিগতভাবে প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলে জেনেছি তিনি ভালোবাসেন রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে সমভাবে, বরং নজরুলকে একটু বেশি। কারণ উনি নাত ও হামদ লিখেছেন শ-চারেক।
একবার ত্রিশালের জাতীয় কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় অনুষ্ঠানে প্রধান বক্তার আমন্ত্রণ পাই। আনন্দে উৎফুল্ল আমি। পরে ভিসি সাহেব জানালেন, আপনার বক্তব্য আমরা খুবই মূল্য দিই, কিন্তু এটি হতে হবে আমাদের বক্তব্য। প্রধানমন্ত্রীকে খুশি করতে চাই, নজরুলকে নয়। বুঝুন ঠেলা। ওই অনুষ্ঠানে যাইনি, বরং দুই বছর ধরে কোথাও বাইরে না গিয়ে লিখেছি নজরুলের জীবনভিত্তিক উপন্যাস ‘পুড়িব একাকী’ ও ‘নজরুল-আব্বাসউদ্দিন স্মৃতিময় অ্যালবাম’।
জীবনের গল্পটি তুলে এনেছি, রঙ চড়াইনি। প্রজাপ্রতির পাখা রেঙে উঠেছে মাঝে মাঝে। ফিকশন, ইতিহাস নয়। গল্প আমাদের প্রিয় কবির। বিদ্রোহ ও সুন্দরের কারণে হিন্দুরা অনুভব করছেন, মুসলমানেরা আঁকড়ে ধরতে চাইছেন তাদের একমাত্র নকিব, কমরেডরা খুঁজেছেন বঞ্চিতের জয়গান উদ্গাতাকে। মাত্র ১০টি বছর সময় পান কবি তার জীবন মেলে ধরার। সাম্প্রদায়িক মিলনের স্বপ্ন ছিল তার। চুরমার করে দিতে ছুটে আসে মহাযুদ্ধ, মন্বন্তর, দাঙ্গা। প্রতিকূল সময়ের ঝড়ে পাল তোলে হিংসা-অপবাদের ছুরি, অপমান। বিত কবিমনকে ধীরসন্তর্পণে গ্রাস করে দারিদ্র্য, আঘাত, ব্যাধি।
সম্প্রদায়ের সমঝোতা না হতেই দেশ ভাগ। উপন্যাসের ময়ূরপঙ্খী কখনো চলে দুলকি চালে বাতাসের আবর্তে, কখনো ফিকশনের রস্রোতে; স্বগত উচ্চারণে, কবিতায়, গানে, ভাষণে। বাঙালি হিন্দু ও মুসলিম মানসের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত যে কবি, প্রবাহিত তিনি নিজ দুঃখনদীতে। কেউ নিতে পারেননি সে দুঃখভার। ময়লা কথা ময়লা বাক্সে। শেষের দিনে ঘাড়ে মাথায় নিয়েছেন আঘাত। পিতৃবন্ধু কে. মল্লিকের কথন সত্যি বলে গ্রহণ করেছি। বেশ কিছু দিন থেকেই তিনি অসুস্থ, আর ওই দিন থেকে তার অসুস্থতা বেড়েই চলে, চিকিৎসা হয় বহু দিন ধরে, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি ছিলেন নির্বাক। আপনার মনে পুড়েছেন একাকী গন্ধবিধুর ধূপ। এরপর আর গল্প নেই।
সবার আগ্রহ অন্তর্গত মানুষটির গল্পে, কবিপ্রাণে। সমসাময়িকদের স্মৃতিবাসরে সযতনে কুড়িয়েছি সংলাপ। পথ গিয়েছে বেঁকে, দুই ধারের তৃণলতাও কথা বলে উঠেছে। ইথারে ভেসে বেড়ায় স্বগত সংলাপ। কথা ছিল তার গানের ভাষণের আড়াল। কেউ খুঁজবেন স্থান-কাল-পাত্র। শুধু মূল সুর খোঁজার চেষ্টা করেছি। 
পুস্তকে অভিনব সংযোজন। পরিশিষ্ট ১ : সাহিত্যবাসর, পাঠক খুঁজে পাবেন কবিকে তার নিজ পরিমণ্ডলে। পরিশিষ্ট ২ : গান ও কবিতার আসরে কবির প্রিয়জন। পরিশিষ্ট ৩ : ১৯৪২ থেকে ২০১১ পর্যন্ত নজরুলকে সামনে নিয়ে এসেছেন যারা। পরিশিষ্ট ৪ : নজরুল ঘনিষ্ঠজনের নির্ঘণ্ট। যারা নজরুলকে জীবন্ত রেখেছেন এতগুলো বছর তার সজ্ঞান অবস্থায় ও অদ্যাবধি তাদের অবদান নিশ্চয়ই স্বীকার করতে হবে। এই নির্ঘণ্ট হালনাগাদ করতে সবার সহায়তা প্রার্থনা করছি।
পিতা আব্বাসউদ্দিন বলেছিলেন : আমাকে ভালোবাস জানি, আমার চেয়েও ভালোবেস নজরুলকে, নজরুলের চেয়েও বেশি রসুলকে। চেষ্টা করে গেছি। নজরুলের ভালোবাসার মানুষ অনেক, তার মাঝে দেখতে পাই যিনি সর্বাধিক অনুপ্রেরণা দিয়েছেন তাঁকে, আমাদের রসুল। নজরুলের সাথে ছিল যাদের ওঠাবসা, কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। পিতা ছাড়াও : আসাদুদ্দৌলা শিরাজী, খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দিন, সুফি জুলফিকার হায়দার, ইব্রাহিম খান, এস ওয়াজেদ আলী, মাহবুবুল আলম, গোলাম মোস্তফা, জসীমউদ্দীন, কমল দাসগুপ্ত [কামাল আহমেদ], ইজাবউদ্দিন আহমেদ, আবুল হোসেন, ওস্তাদ মুহাম্মদ হোসেন খসরু, মাস্তান গামা প্রমুখ। ফিকশনে ওঁরা স্থান করে নিয়েছেন।
ছোট জীবন, ব্যাপ্তি বিশাল, প্রয়োজন হাজার পৃষ্ঠার। কাতিব অশ্রুরুদ্ধ, লিখেছেন অল্পই। তার কেউ নই আমি, তবু উত্তরাধিকারীদের একজন। লক্ষ অনাত্মীয় পাঠক পড়বেন ঘনিষ্ঠতম কবির কাহিনী। প্রজন্মের অশ্রুভরা চোখে নামাবে বিষাদের বৃষ্টি, যা আমার ইচ্ছা ছিল না। একাকী পুড়েছে যে কবির হৃদয়, জলসা শেষে ফিরে গেছেন প্রভুর কাছে। গ্রন্থের প্রতিবাক্য ভালোবাসার অশ্রু দিয়ে গাঁথা, গীত শেষে প্রার্থনা।
বিদ্রোহী প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত। অসহযোগের গান গেয়েছেন এক দিকে, আবার রাজা-রানীর জয়গানও গেয়েছেন তাদের সাথে নজরুলের তফাত বুঝবেন এই গ্রন্থে। যার ধর্ম তার কাছে। পৃথিবীতে এত মানুষ। প্রতি মানুষের সমর্পণ ও সম্পর্ক তার নিজ প্রভুর সাথে আলাদা। ধর্ম বাইরে থেকে শনাক্ত করা গেলেও ভেতরে ঢোকার সাধ্যি কার, প্রতি মানুষের সাথে বিধাতা সেখানে একাকী, নজরুল, আমার, আপনার সবার েেত্র তাই। হিন্দু-মুসলমানের সমঝোতা হয়নি। মাটির কলসি ভেঙে গেলে আর জোড়া লাগে না। থাকব ভাইয়ের মতো, হিংসার ঊর্ধ্বে।
টেগোর সোসাইটি ও ইকবাল অ্যাকাডেমির কার্যক্রম পর্যালোচনার পর জানা গেল নজরুলকে নিয়ে কাজ অগ্রসর হতে পারেনি অর্থাভাবে। সম্প্রতি ইনডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, কাজী নজরুল ইসলাম ও আব্বাসউদ্দিনকে নিয়ে গবেষণার উদ্যোগ নিয়েছে। এর সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকতে পেরে আনন্দিত বোধ করছি।
তার ১১৩তম জন্মদিবসে ভেবেছিলাম প্রতি স্কুলে ছেলেমেয়েরা গাইবে তার গান, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তত একটি অনুষ্ঠানে ছেলেমেয়েরা স্মরণ করবে তাদের প্রিয় কবিকে, তার নামাঙ্কিত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সমবেত হবেন হাজার হাজার নজরুল প্রেমিক; যেখানে জানা যাবে জাতি কিভাবে গত একটি বছর কবিকে নিয়ে এসেছেন জাতির সামনে। জাতীয় ও প্রাইভেট টিভি স্টেশনগুলো উদ্ভাবন করবে নতুন নতুন অনুষ্ঠান, যেখানে কবির ফেলে যাওয়া নাটক-উপন্যাস গীতিনাট্য নতুন করে উপলব্ধি করবে দেশের মানুষ।
গত একটি বছর বিশ্বকবির দেড় শ’ বছর পালন করেছে ভারত ও বাংলাদেশ। এতে রবীন্দ্রনাথের কাব্য ও সঙ্গীতের প্রতি সাধারণের উৎসাহ ও আকর্ষণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আমার ইচ্ছা প্রতিটি স্কুলে নজরুল চর্চা হোক। সেই সাথে আব্বাসউদ্দিন, যিনি নজরুলকে নিয়ে এসেছিলেন সবার কাছে।
‘নজরুল-আব্বাসউদ্দিন স্মৃতিময় অ্যালবাম’ প্রকাশ করেছে চট্টগ্রামের আজাদী পাবলিকেশন্স আমার সংগ্রহ ও সম্পাদনায়। ইসমাইল চৌধুরী সযতেœ প্রকাশ করেছেন নজরুলের আশিটি ও আব্বাসউদ্দিনের ৪৫টি অত্যন্ত মূল্যবান ছবি। রয়েছে বিবক্ষণ, বাংলা ও ইংরেজিতে। বক্তৃতা করে সময় নষ্ট না করে কাজ দুটো করেছি, জাতির উদ্দেশ্যে বিনম্র উপহার। চলে গেলে মূল্য অনুধাবন হবে, আগে নয়।
২৩ মে ২০১২ লেখক : সাহিত্য ও সঙ্গীতব্যক্তিত্ব
mabbasi@dhaka.net

সোমবার, ২১ মে, ২০১২

মাত্র একজন মানুষের পাশে দাঁড়াও


মুস্তাফা জামান আব্বাসী
যেদিকে তাকাই, বন্ধু আর বন্ধু, এত বন্ধুও ভাগ্যে ছিল, কে জানত। বাংলাদেশের মানুষ শুনে অন্যান্য দেশের রোটারিয়ানরা গলা জড়িয়ে ধরেছেন, বলেছেন, শুনেছি তোমাদের দেশ সবচেয়ে সুন্দর, শ্যামল, যেখানে বাস করে পৃথিবীর নামকরা ব্যাঘ্র, রয়েল বেঙ্গল টাইগার আর বাস করে ষোল কোটি শুভ্রহৃদয় মানুষ, অল্পে যারা তুষ্ট, সব ধর্মের মানুষকে যারা আহ্বান জানায়
ব্যাংককে কুড়ি বছর পর। নতুন অনুভূতি। দু'দশকে এ শহর ও জাতি এগিয়ে গেল সামনের দিকে, দেখে বিস্মিত। বিশাল ব্যাংকক, এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত যেতে সময় কুড়ি মিনিট, স্কাই ট্রেইন, ফ্লাইওভার, চকচকে বাস-ট্যাক্সি-টুকটুক চলে মুহূর্তের ইশারায়, প্রতি মানুষ কাজ করছে সকাল থেকে সন্ধ্যা অক্লেশে, বসে নেই কেউ।
পাঁচশ' বঙ্গসন্তান এসেছি রোটারির ১০৩তম কনভেশনে যোগ দিতে, পঁচিশ হাজার রোটারিয়ান পৃথিবীর সব দেশ থেকে। এ এক অনন্য অনুভূতি। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে এসেছে নানা রঙের নানা ভাষার মানুষ। সবাই সবার গলা জড়িয়ে ধরছেন, কেউ পুরনো বন্ধু, কেউ নতুন বন্ধুত্বে আবদ্ধ। শত খাবারের ঘর, খাবার খেতে গিয়ে বন্ধুত্ব, 'হাউজ অব ফ্রেন্ডশিপে' গান-নৃত্য জুড়ে দিয়েছেন গানপাগল বন্ধুরা, সঙ্গে শত স্টল যেখানে মেলে ধরেছি কে কোথায় সমাজের জন্য কী কাজ করেছি। প্রজেক্টে আনন্দ পান যারা, বক্তৃতার আসরে নেই উপস্থিত। সারাদিন খুঁজে বেড়াচ্ছেন সেসব সফল প্রজেক্টের উদ্যোক্তাদের যারা স্টল খুলে বসেছেন, আলাপ করছেন কীভাবে এটি তাদের দেশে উন্মুক্ত করে দেওয়া সম্ভব। অর্থের অভাব নেই, যে যত প্রজেক্ট করতে চান সম্ভব, অর্ধেক অর্থ জোগাবে রোটারি ফাউন্ডেশন। ঢাকা রোটারি ক্লাব আগামী বছর পঁচাত্তরতম জন্মদিন [আমিও হবো ৭৫] পালন করবে, বাংলাদেশেও রোটারি আগমনের ৭৫তম বছর। ঢাকা ক্লাব থেকে এক ডজন রোটারিয়ান ব্যস্ত 'হাউজ অব ফ্রেন্ডশিপে'। তেরোজন রোটারি গভর্নর : ইফতেখারুল আলম, হাবিবুল্লাহ খান, এমএ মাহবুব, প্রফেসর হাফিজুল্লাহ, ড. মোশাররফ হোসেন, এমএ আউয়াল, জামাল উদ্দিন, মীর আনিসুজ্জামান, ড. মনজুরুল হক চৌধুরী, ড. ইশতিয়াক আবিদ-উজ-জামান, গোলাম মোস্তফা, সাফিনা রহমান, কমডোর রহমান ও আমাদের দু'জনকে দেখে বাংলাদেশের ১৬০টি ক্লাবের ও পশ্চিমবঙ্গের রোটারিয়ানরা মহাখুশি। আসমা ও আমি কনভেনশনে আসিনি কোনোদিন, অর্থের প্রয়োজন। পারিবারিক বন্ধু কল্যাণ ব্যানার্জি রোটারি ইন্টারন্যাশনালের প্রেসিডেন্ট। তার স্ত্রী বিনতা ব্যানার্জি বললেন, আসমা, তোমাকে এবার আসতেই হবে, তা না হলে আর কথা বলব না। সেই সুবাদেই প্রথমবারের মতো কনভেনশনে দিয়েছি উপস্থিতি। বক্তৃতা মঞ্চে উঠে দাঁড়াইনি, গাইনি কোনো গান, কোনো কবিতা, একমাত্র হজ ও ইরানে অনুষ্ঠিত রুমি কনফারেন্স ছাড়া এর চেয়ে বেশি আনন্দ আর কোনো কনভেনশনে বা জনসমাবেশ থেকে সংগ্রহ করতে পারিনি।
যেদিকে তাকাই, বন্ধু আর বন্ধু, এত বন্ধুও ভাগ্যে ছিল, কে জানত। বাংলাদেশের মানুষ শুনে অন্যান্য দেশের রোটারিয়ানরা গলা জড়িয়ে ধরেছেন, বলেছেন, শুনেছি তোমাদের দেশ সবচেয়ে সুন্দর, শ্যামল, যেখানে বাস করে পৃথিবীর নামকরা ব্যাঘ্র, রয়েল বেঙ্গল টাইগার আর বাস করে ষোল কোটি শুভ্রহৃদয় মানুষ, অল্পে যারা তুষ্ট, সব ধর্মের মানুষকে যারা আহ্বান জানায়। যাদের সঙ্গে দেখা হয়েছে চারদিনে ৬-৯ মে, তাদের কথা যদি বলি একটু একটু করে, একটি গ্রন্থ সাজানো যাবে অনায়াসেই। কেউ জিজ্ঞেস করলেন বঙ্গবন্ধুর কথা, এতদিন পরেও।
মূল আয়োজনের কথা বলি। মূল শহর থেকে বিশ কিলোমিটার দূরে 'ইমপ্যাক্ট, মুয়াং থং থানি', কুড়িটি বড় বড় হল, বড় কনভেনশনগুলো যেখানে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। সবকিছু তৈরি, কীভাবে শহরের বড় হোটেল থেকে ডেলিগেটরা আসবেন, কীভাবে কোথায় গিয়ে নামবেন, কোন হলে গিয়ে উঠবেন, কোথায় দুপুরের খাবার খাবেন, কোথায় রেস্ট নেবেন, কীভাবে ফিরবেন, সব আগে থেকে নির্ধারিত। সেখানে ইন্টারনেট আউটলেট এক হাজার, নানা দ্রব্যসামগ্রী, কেউ জুয়েলারি কিনতে চাইলে আর শহরে যেতে হবে না। ক্যামেরা, এমনকি কারও জুতা ছিঁড়ে গেলে নতুন জুতা কেনার সুবিধা। আমার জুতা ছেঁড়ার সুবর্ণ মুহূর্তটি উপস্থিত। গিনি্ন কিনে দিলেন সুন্দর একজোড়া জুতা, যেটি ইতালি থেকে গত সপ্তাহে এখানে জায়গা করে নিয়েছে, এখন আমার পায়ে। আম ও পেয়ারার সমঝদার ইচ্ছা করলে লবণ-চিনি-মরিচ মেশানো ফল খেয়ে দিব্যি ক্ষুধা নিবৃত্তে সমর্থ হবেন।
মূল অনুষ্ঠান যেখানে একসঙ্গে বসতে পারে বিশ হাজার লোক। মূল অধিবেশন দু'ভাগে, সকালে ও বিকেলে। সকালের অধিবেশনে এসেছেন রাজকুমারী, যতক্ষণ বক্তৃতা করেছেন সবাই দাঁড়িয়ে ছিলেন। প্রতিদিন প্লেনারি সেশনে চারজন বক্তা। তাদের বক্তৃতা শোনা জীবনের অভিজ্ঞতা বৈকি। সার্কাস দেখতে এসে অনেকেই রয়েল বেঙ্গল টাইগার বা হাতি বা বানরের নাচ দেখেই আনন্দিত, হ্যাঁ পয়সা উসুল হয়েছে। তেমনি আটজনের বক্তৃতা শোনার পর আমার মনে হয়েছে আমার এখানে আসা সার্থক হয়েছে।
প্রথমেই বলি, প্রিয় ব্যক্তিত্ব মুহাম্মদ ইউনূসের কথা। তার বক্তৃতার আগে, মাঝখানে ও শেষে শ্রোতৃমণ্ডলী তিনবার দাঁড়িয়ে কয়েক মিনিট ধরে তাকে ভালোবাসা জানান, আর কেউ এই সম্মানে ভূষিত হননি। তিনি বলেছেন গরিব মানুষের কথা, বলেছেন যারা বড়লোক তাদের জন্য ব্যাংক, তাদের কাছে গিয়ে পয়সা জমা দিতে হয়। তারা আরও টাকা নেন তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য। আর আমার ব্যাংক হলো গরিবদের জন্য, তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে টাকা দিই, তাদের প্রায় সবাই মহিলা। এ এক নতুন দিক যা পৃথিবী আগে জানত না। এখন আমেরিকার শহরগুলোতে গরিবদের জন্য তৈরি হয়েছে এই নতুন ব্যাংক। এ ছাড়া জানালেন, গরিবদের জন্য শুধু দান নয় 'সোশ্যাল বিজনেস' অর্থাৎ যে ব্যবসায় গরিবদের স্থান থাকবে, ওই টাকা শেষ হয়ে যাবে না। রোটারিয়ানদের আহ্বান জানালেন 'সোশ্যাল বিজনেসে' নতুন পুঁজি খাটাতে। এতে দু'দিক সামলানো যাবে। একটি তাদের টাকা, তাদের টাকাই থাকবে। মুনাফা যাবে গরিবদের কাছে, গরিবরা কাজ পাবে, টাকা শেষ হয়ে যাবে না। প্রফেসর ইউনূসের একেকটি বাক্য শেষ হতে লাগছে এক মিনিট সময়, আর আরেক মিনিট করতালির জন্য। মনে পড়ল, সোভিয়েত ইউনিয়নের তাশখন্দ শহরে গেয়েছিলাম ভাওয়াইয়া গান ১৯৬৭ সালে, 'ও কি ও বন্ধু কাজল ভোমরা রে', গানটি তিন মিনিটের, করতালি এক মিনিটের। ইউনূসের বক্তৃতার পর গ্রিনরুমে তার সঙ্গে দেখা করলে তিনি জড়িয়ে ধরে বললেন : আব্বাসী, এ সাফল্য আমার নয়, সমস্ত বাংলাদেশের। আসমাসহ শত শত প্রাচ্যবাসীর চোখে সেদিন চোখের পানি। আমি আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলাম।
কল্যাণ ব্যানার্জি তৃতীয় বাঙালি, যিনি রোটারি ইন্টারন্যাশনালের সভাপতি, স্মার্ট, বিনয়ী, সপ্রতিভ, কর্মচঞ্চল। সমস্ত অবয়ব কল্যাণের স্পর্শে অবধূত, স্ত্রী বিনতা, বিনম্র, সি্নগ্ধশ্রী ও কল্যাণময়ী। এমন একজন দম্পতিকে বন্ধু হিসেবে পেয়ে আমরা আপ্লুত। তার বক্তৃতা প্রতিটি রোটারিয়ানকে করেছে স্পর্শিত। বললেন, বেশি লাগবে না, মাত্র একজন মানুষের পাশে এসে দাঁড়ান, অনুভব করুন কী সে স্পর্শের মূল্য, বিধাতা কখন এসে আলোকিত করেন আপনার জীবন। জলবিহীন জীবন পৃথিবীর অর্ধেক লোককে করেছে তৃষিত, নিজের জন্য নির্ধারিত জলের সাশ্রয় করুন, সেই সাশ্রয়ের টাকা রোটারিকে পাঠান, আফ্রিকার জলবিহীন তৃষিত ধরায় তা আনবে খানিকটা তৃষ্ণার জল, তাই-বা মন্দ কি। তার প্রতিটি কথা এখনও যেন আমার মন্দ্রস্পর্শে নিনাদিত। সহজ কথা বলতে আমায় বল যে, সহজ কথা যায় যে বলা সহজে। প্রয়োজন : সহজ কথা উপলব্ধির মানুষের।
মূল বক্তাদের মধ্যে ভালো লেগেছে কনভেনশন সভাপতি সদাহাস্য ও.পি ভায়েস, ব্যাংকক সিমফনি অর্কেস্ট্রার পরিবেশনা, টাটা ইয়াংয়ের থাই জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনা, ব্যাংকক পিয়ানো ট্রায়োর পরিবেশনা, তিনজন বুলগেরীয় শিল্পী কিরিললিয়েফ, আলেকজান্ডার গসপদিনভ ও ইলিয়ান নেদাভের সঙ্গীত, অস্ট্রেলিয়ার গ্গ্নোবাল পোভার্টি প্রজেক্টের প্রতিষ্ঠাতা হিউ ইভান, ইউনাইটেড ন্যাশন্স ফাউন্ডেশনের গিলিয়ন সোরেনসন ও রাজশ্রী বিরলার বক্তৃতা।
অ্যাঞ্জেলিক কিডজোজো, যিনি গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্তা গায়িকা, সঙ্গীত রচয়িতা এবং ইউনিসেফের 'গুডউইল অ্যাম্বাসাডর' এত সুন্দর গাইলেন যে তার কণ্ঠ এখনও কানে বাজছে। তার সুর দেওয়া 'মালায়কি', গত বছর ডিসেম্বরে নোবেল শান্তি পুরস্কার অনুষ্ঠানে গীত হলে সবাই হন অভিভূত। আমি স্থির নিশ্চিত যে, অ্যাঞ্জেলিককে ঢাকায় আনা হলে বাংলাদেশের মানুষ তার গান শুনে হতো উদ্বুদ্ধ। পৃথিবীর অনেক লেখক সাহিত্যিক সাংবাদিক গায়ক শিল্পী এখানে উপস্থিত, তাদের সবার স্টেজে ওঠার সুযোগ হয়নি, শোনাও এক বিরাট অভিজ্ঞতা, এ অভিজ্ঞতা অমূল্য।
পঞ্চাশটি সেশনে গুরুগম্ভীর আলোচনায় বিভক্ত হলেন কয়েক হাজার রোটারিয়ান চারদিন ধরে, কেউ পোলিও. কেউ জলকষ্ট, কেউ স্যানিটেশন, কেউ শিক্ষা, কেউ স্বাস্থ্য, কেউ গ্রামসেবা, কেউ তারুণ্যসেবা, কেউ মাতৃঋণ নিয়ে ব্যস্ত। আমি কী নিয়ে ব্যস্ত? পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাঙালিরা এসেছেন রবীন্দ্রতর্পণের জন্য অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানাতে। জানালাম, এক বছর ধরে ওই কাজটি করেছি। পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলংকা, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, আফগানিস্তান, মালদ্বীপ, বাংলাদেশ সমবায়ে হতে চলেছে 'হারমোনি কমিটি', যাতে এলাকার যাতায়াত সমস্যা সমাধানকল্পে রোটারি নেতৃত্ব এগিয়ে এসে কিছু কাজ করে। কমিটিতে কাজ করার প্রতিশ্রুতি জানিয়েছি।
সাউথ এশিয়ার রোটারিয়ানরা বড় হোটেলে আয়োজন করেছেন টি পার্টি, কখনও নদীবিহারে নৃত্যগীত সংবলিত ভোজসভা। সেগুলোতে যাইনি। ব্যাংকক হাসপাতালে কাটিয়েছি দু'দিন, দু'জনেরই জীর্ণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো পরীক্ষা করে দেখলেন থাইল্যান্ডের ডাক্তাররা। এর চেয়ে ভালো ডাক্তার দেশেই আছে। তফাত হলো : তারা মনোযোগী, সময় দিয়েছেন, রিপোর্ট দিয়েছেন এবং রোগ নির্ণয় পিনপয়েন্টেড। নতুন সভাপতি জাপানের সাকুজি তানাকা আগামী বছর ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় আসার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন, ঢাকা রোটারির পঁচাত্তরতম জন্মদিনে। তানাকা জানালেন, আগামী বছর কনভেনশন পর্তুগালের লিসবনে। আসবেন অতি অবশ্য। এ মিলনমেলা প্রতি বছরে মাত্র একবার। আসবেন তো?

মুস্তাফা জামান আব্বাসী :সাহিত্য-সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব
mabbasi@dhaka.net