॥ মুস্তাফা জামান আব্বাসী ॥
আগামীকাল একটি বিশেষ দিন। জাতির জন্য গৌরবের, আনন্দের, পেছনে ফিরে তাকানোর। কবি নজরুল ১১৩ বছর আগে এই পৃথিবীতে আগমন করেছিলেন, জাতিকে উপহার দিয়েছিলেন নতুন দিগন্ত অভিসারী সাহিত্য, সঙ্গীতের ভুবনে প্রথম জাগরণী কণ্ঠ, জাতিকে যা দিয়েছে প্রেরণা নতুনভাবে বেঁচে থাকার। তার জীবন ছিল না কুসুমাস্তীর্ণ। মাত্র ১০টি বছর ছিল তার দেয়ার মুহূর্ত, দীর্ঘ ৩৪ বছর নির্বাক। বাংলাদেশ জাতি হিসেবে নজরুলের সাহিত্য-সঙ্গীত সাধনার পরিপূর্ণ ফসল।
আগামীকাল সকাল থেকে নানা অনুষ্ঠানে কবিকে স্মরণ করা হবে, এ দিনটিই তার জন্য বরাদ্দ, আর কোনো দিন নয়; ঠিক যেমন ঈদে মিলাদুন্নবীর দিন নবীকে স্মরণ করি, মাঝে মাঝে মিলাদে। প্রতিদিনই নবীকে স্মরণ করা, রোজই কুরআন শরীফ স্পর্শ করা; তা না হলে ওই একটি দিনে কিছুই হবে না। নবীই আমাদের আদর্শ, আর কেউ নয়। তেমনি জাতীয় কবির স্মরণ হবে প্রতিদিন, রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্র সর্বত্র।
রবীন্দ্র-নজরুলের স্মৃতিতর্পণ ব্যবস্থার দাবিদার প্রেসিডেন্ট এরশাদ। বন্ধু ড. এনামুল হক রাষ্ট্রীয়ভাবে কবি রবীন্দ্র ও নজরুলের কাছে আছেন। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারি। একবার এক হোমরাচোমরা ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করলামÑ কই ভাই, এতগুলো অনুষ্ঠান হয়ে গেল, কোনো দিন স্টেজে উঠতে পারলাম না। কারণটা কী? উনি বললেন ফিসফিস করে, অনুষ্ঠান রবীন্দ্রনাথ বা নজরুলকে খুশি করার জন্য কে বলল? বরং যিনি সবচেয়ে বড় অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট এরশাদ, তাকে খুশি করার জন্যই আমাদের যাবতীয় প্রয়াস। সামনাসামনি আপনাকে পছন্দ করলেও তার মনে সদা দ্বন্দ্ব। আপনি বিরাট ব্যক্তিত্ব আব্বাসউদ্দিনের ছেলে, খানিকটা হিংসা কাজ করেছে হয়তো। এখনো সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে।
আগামীকাল প্রধানমন্ত্রী বিরাট অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন, যেটি অনেক লোক টেলিভিশনে প্রত্যক্ষ করবে। আমি গানের ঘরে নিভৃতে গাইব যে গানটি : ‘ঘুমিয়ে গেছে শ্রান্ত হয়ে আমার গানের বুলবুলি’। জিজ্ঞেস করবেনÑ কেন? বলব, আগামীকালের দিনটির পরই নজরুলকে আর কেউ মনে করবে না। তিনি এক দিনের কবি, প্রতিদিনের নন; তাই তার প্রতি এত অবজ্ঞা। ব্যক্তিগতভাবে প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলে জেনেছি তিনি ভালোবাসেন রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে সমভাবে, বরং নজরুলকে একটু বেশি। কারণ উনি নাত ও হামদ লিখেছেন শ-চারেক।
একবার ত্রিশালের জাতীয় কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় অনুষ্ঠানে প্রধান বক্তার আমন্ত্রণ পাই। আনন্দে উৎফুল্ল আমি। পরে ভিসি সাহেব জানালেন, আপনার বক্তব্য আমরা খুবই মূল্য দিই, কিন্তু এটি হতে হবে আমাদের বক্তব্য। প্রধানমন্ত্রীকে খুশি করতে চাই, নজরুলকে নয়। বুঝুন ঠেলা। ওই অনুষ্ঠানে যাইনি, বরং দুই বছর ধরে কোথাও বাইরে না গিয়ে লিখেছি নজরুলের জীবনভিত্তিক উপন্যাস ‘পুড়িব একাকী’ ও ‘নজরুল-আব্বাসউদ্দিন স্মৃতিময় অ্যালবাম’।
জীবনের গল্পটি তুলে এনেছি, রঙ চড়াইনি। প্রজাপ্রতির পাখা রেঙে উঠেছে মাঝে মাঝে। ফিকশন, ইতিহাস নয়। গল্প আমাদের প্রিয় কবির। বিদ্রোহ ও সুন্দরের কারণে হিন্দুরা অনুভব করছেন, মুসলমানেরা আঁকড়ে ধরতে চাইছেন তাদের একমাত্র নকিব, কমরেডরা খুঁজেছেন বঞ্চিতের জয়গান উদ্গাতাকে। মাত্র ১০টি বছর সময় পান কবি তার জীবন মেলে ধরার। সাম্প্রদায়িক মিলনের স্বপ্ন ছিল তার। চুরমার করে দিতে ছুটে আসে মহাযুদ্ধ, মন্বন্তর, দাঙ্গা। প্রতিকূল সময়ের ঝড়ে পাল তোলে হিংসা-অপবাদের ছুরি, অপমান। বিত কবিমনকে ধীরসন্তর্পণে গ্রাস করে দারিদ্র্য, আঘাত, ব্যাধি।
সম্প্রদায়ের সমঝোতা না হতেই দেশ ভাগ। উপন্যাসের ময়ূরপঙ্খী কখনো চলে দুলকি চালে বাতাসের আবর্তে, কখনো ফিকশনের রস্রোতে; স্বগত উচ্চারণে, কবিতায়, গানে, ভাষণে। বাঙালি হিন্দু ও মুসলিম মানসের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত যে কবি, প্রবাহিত তিনি নিজ দুঃখনদীতে। কেউ নিতে পারেননি সে দুঃখভার। ময়লা কথা ময়লা বাক্সে। শেষের দিনে ঘাড়ে মাথায় নিয়েছেন আঘাত। পিতৃবন্ধু কে. মল্লিকের কথন সত্যি বলে গ্রহণ করেছি। বেশ কিছু দিন থেকেই তিনি অসুস্থ, আর ওই দিন থেকে তার অসুস্থতা বেড়েই চলে, চিকিৎসা হয় বহু দিন ধরে, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি ছিলেন নির্বাক। আপনার মনে পুড়েছেন একাকী গন্ধবিধুর ধূপ। এরপর আর গল্প নেই।
সবার আগ্রহ অন্তর্গত মানুষটির গল্পে, কবিপ্রাণে। সমসাময়িকদের স্মৃতিবাসরে সযতনে কুড়িয়েছি সংলাপ। পথ গিয়েছে বেঁকে, দুই ধারের তৃণলতাও কথা বলে উঠেছে। ইথারে ভেসে বেড়ায় স্বগত সংলাপ। কথা ছিল তার গানের ভাষণের আড়াল। কেউ খুঁজবেন স্থান-কাল-পাত্র। শুধু মূল সুর খোঁজার চেষ্টা করেছি।
পুস্তকে অভিনব সংযোজন। পরিশিষ্ট ১ : সাহিত্যবাসর, পাঠক খুঁজে পাবেন কবিকে তার নিজ পরিমণ্ডলে। পরিশিষ্ট ২ : গান ও কবিতার আসরে কবির প্রিয়জন। পরিশিষ্ট ৩ : ১৯৪২ থেকে ২০১১ পর্যন্ত নজরুলকে সামনে নিয়ে এসেছেন যারা। পরিশিষ্ট ৪ : নজরুল ঘনিষ্ঠজনের নির্ঘণ্ট। যারা নজরুলকে জীবন্ত রেখেছেন এতগুলো বছর তার সজ্ঞান অবস্থায় ও অদ্যাবধি তাদের অবদান নিশ্চয়ই স্বীকার করতে হবে। এই নির্ঘণ্ট হালনাগাদ করতে সবার সহায়তা প্রার্থনা করছি।
পিতা আব্বাসউদ্দিন বলেছিলেন : আমাকে ভালোবাস জানি, আমার চেয়েও ভালোবেস নজরুলকে, নজরুলের চেয়েও বেশি রসুলকে। চেষ্টা করে গেছি। নজরুলের ভালোবাসার মানুষ অনেক, তার মাঝে দেখতে পাই যিনি সর্বাধিক অনুপ্রেরণা দিয়েছেন তাঁকে, আমাদের রসুল। নজরুলের সাথে ছিল যাদের ওঠাবসা, কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। পিতা ছাড়াও : আসাদুদ্দৌলা শিরাজী, খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দিন, সুফি জুলফিকার হায়দার, ইব্রাহিম খান, এস ওয়াজেদ আলী, মাহবুবুল আলম, গোলাম মোস্তফা, জসীমউদ্দীন, কমল দাসগুপ্ত [কামাল আহমেদ], ইজাবউদ্দিন আহমেদ, আবুল হোসেন, ওস্তাদ মুহাম্মদ হোসেন খসরু, মাস্তান গামা প্রমুখ। ফিকশনে ওঁরা স্থান করে নিয়েছেন।
ছোট জীবন, ব্যাপ্তি বিশাল, প্রয়োজন হাজার পৃষ্ঠার। কাতিব অশ্রুরুদ্ধ, লিখেছেন অল্পই। তার কেউ নই আমি, তবু উত্তরাধিকারীদের একজন। লক্ষ অনাত্মীয় পাঠক পড়বেন ঘনিষ্ঠতম কবির কাহিনী। প্রজন্মের অশ্রুভরা চোখে নামাবে বিষাদের বৃষ্টি, যা আমার ইচ্ছা ছিল না। একাকী পুড়েছে যে কবির হৃদয়, জলসা শেষে ফিরে গেছেন প্রভুর কাছে। গ্রন্থের প্রতিবাক্য ভালোবাসার অশ্রু দিয়ে গাঁথা, গীত শেষে প্রার্থনা।
বিদ্রোহী প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত। অসহযোগের গান গেয়েছেন এক দিকে, আবার রাজা-রানীর জয়গানও গেয়েছেন তাদের সাথে নজরুলের তফাত বুঝবেন এই গ্রন্থে। যার ধর্ম তার কাছে। পৃথিবীতে এত মানুষ। প্রতি মানুষের সমর্পণ ও সম্পর্ক তার নিজ প্রভুর সাথে আলাদা। ধর্ম বাইরে থেকে শনাক্ত করা গেলেও ভেতরে ঢোকার সাধ্যি কার, প্রতি মানুষের সাথে বিধাতা সেখানে একাকী, নজরুল, আমার, আপনার সবার েেত্র তাই। হিন্দু-মুসলমানের সমঝোতা হয়নি। মাটির কলসি ভেঙে গেলে আর জোড়া লাগে না। থাকব ভাইয়ের মতো, হিংসার ঊর্ধ্বে।
টেগোর সোসাইটি ও ইকবাল অ্যাকাডেমির কার্যক্রম পর্যালোচনার পর জানা গেল নজরুলকে নিয়ে কাজ অগ্রসর হতে পারেনি অর্থাভাবে। সম্প্রতি ইনডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, কাজী নজরুল ইসলাম ও আব্বাসউদ্দিনকে নিয়ে গবেষণার উদ্যোগ নিয়েছে। এর সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকতে পেরে আনন্দিত বোধ করছি।
তার ১১৩তম জন্মদিবসে ভেবেছিলাম প্রতি স্কুলে ছেলেমেয়েরা গাইবে তার গান, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তত একটি অনুষ্ঠানে ছেলেমেয়েরা স্মরণ করবে তাদের প্রিয় কবিকে, তার নামাঙ্কিত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সমবেত হবেন হাজার হাজার নজরুল প্রেমিক; যেখানে জানা যাবে জাতি কিভাবে গত একটি বছর কবিকে নিয়ে এসেছেন জাতির সামনে। জাতীয় ও প্রাইভেট টিভি স্টেশনগুলো উদ্ভাবন করবে নতুন নতুন অনুষ্ঠান, যেখানে কবির ফেলে যাওয়া নাটক-উপন্যাস গীতিনাট্য নতুন করে উপলব্ধি করবে দেশের মানুষ।
গত একটি বছর বিশ্বকবির দেড় শ’ বছর পালন করেছে ভারত ও বাংলাদেশ। এতে রবীন্দ্রনাথের কাব্য ও সঙ্গীতের প্রতি সাধারণের উৎসাহ ও আকর্ষণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আমার ইচ্ছা প্রতিটি স্কুলে নজরুল চর্চা হোক। সেই সাথে আব্বাসউদ্দিন, যিনি নজরুলকে নিয়ে এসেছিলেন সবার কাছে।
‘নজরুল-আব্বাসউদ্দিন স্মৃতিময় অ্যালবাম’ প্রকাশ করেছে চট্টগ্রামের আজাদী পাবলিকেশন্স আমার সংগ্রহ ও সম্পাদনায়। ইসমাইল চৌধুরী সযতেœ প্রকাশ করেছেন নজরুলের আশিটি ও আব্বাসউদ্দিনের ৪৫টি অত্যন্ত মূল্যবান ছবি। রয়েছে বিবক্ষণ, বাংলা ও ইংরেজিতে। বক্তৃতা করে সময় নষ্ট না করে কাজ দুটো করেছি, জাতির উদ্দেশ্যে বিনম্র উপহার। চলে গেলে মূল্য অনুধাবন হবে, আগে নয়।
২৩ মে ২০১২ লেখক : সাহিত্য ও সঙ্গীতব্যক্তিত্ব
mabbasi@dhaka.net
আগামীকাল একটি বিশেষ দিন। জাতির জন্য গৌরবের, আনন্দের, পেছনে ফিরে তাকানোর। কবি নজরুল ১১৩ বছর আগে এই পৃথিবীতে আগমন করেছিলেন, জাতিকে উপহার দিয়েছিলেন নতুন দিগন্ত অভিসারী সাহিত্য, সঙ্গীতের ভুবনে প্রথম জাগরণী কণ্ঠ, জাতিকে যা দিয়েছে প্রেরণা নতুনভাবে বেঁচে থাকার। তার জীবন ছিল না কুসুমাস্তীর্ণ। মাত্র ১০টি বছর ছিল তার দেয়ার মুহূর্ত, দীর্ঘ ৩৪ বছর নির্বাক। বাংলাদেশ জাতি হিসেবে নজরুলের সাহিত্য-সঙ্গীত সাধনার পরিপূর্ণ ফসল।
আগামীকাল সকাল থেকে নানা অনুষ্ঠানে কবিকে স্মরণ করা হবে, এ দিনটিই তার জন্য বরাদ্দ, আর কোনো দিন নয়; ঠিক যেমন ঈদে মিলাদুন্নবীর দিন নবীকে স্মরণ করি, মাঝে মাঝে মিলাদে। প্রতিদিনই নবীকে স্মরণ করা, রোজই কুরআন শরীফ স্পর্শ করা; তা না হলে ওই একটি দিনে কিছুই হবে না। নবীই আমাদের আদর্শ, আর কেউ নয়। তেমনি জাতীয় কবির স্মরণ হবে প্রতিদিন, রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্র সর্বত্র।
রবীন্দ্র-নজরুলের স্মৃতিতর্পণ ব্যবস্থার দাবিদার প্রেসিডেন্ট এরশাদ। বন্ধু ড. এনামুল হক রাষ্ট্রীয়ভাবে কবি রবীন্দ্র ও নজরুলের কাছে আছেন। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারি। একবার এক হোমরাচোমরা ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করলামÑ কই ভাই, এতগুলো অনুষ্ঠান হয়ে গেল, কোনো দিন স্টেজে উঠতে পারলাম না। কারণটা কী? উনি বললেন ফিসফিস করে, অনুষ্ঠান রবীন্দ্রনাথ বা নজরুলকে খুশি করার জন্য কে বলল? বরং যিনি সবচেয়ে বড় অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট এরশাদ, তাকে খুশি করার জন্যই আমাদের যাবতীয় প্রয়াস। সামনাসামনি আপনাকে পছন্দ করলেও তার মনে সদা দ্বন্দ্ব। আপনি বিরাট ব্যক্তিত্ব আব্বাসউদ্দিনের ছেলে, খানিকটা হিংসা কাজ করেছে হয়তো। এখনো সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে।
আগামীকাল প্রধানমন্ত্রী বিরাট অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন, যেটি অনেক লোক টেলিভিশনে প্রত্যক্ষ করবে। আমি গানের ঘরে নিভৃতে গাইব যে গানটি : ‘ঘুমিয়ে গেছে শ্রান্ত হয়ে আমার গানের বুলবুলি’। জিজ্ঞেস করবেনÑ কেন? বলব, আগামীকালের দিনটির পরই নজরুলকে আর কেউ মনে করবে না। তিনি এক দিনের কবি, প্রতিদিনের নন; তাই তার প্রতি এত অবজ্ঞা। ব্যক্তিগতভাবে প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলে জেনেছি তিনি ভালোবাসেন রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে সমভাবে, বরং নজরুলকে একটু বেশি। কারণ উনি নাত ও হামদ লিখেছেন শ-চারেক।
একবার ত্রিশালের জাতীয় কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় অনুষ্ঠানে প্রধান বক্তার আমন্ত্রণ পাই। আনন্দে উৎফুল্ল আমি। পরে ভিসি সাহেব জানালেন, আপনার বক্তব্য আমরা খুবই মূল্য দিই, কিন্তু এটি হতে হবে আমাদের বক্তব্য। প্রধানমন্ত্রীকে খুশি করতে চাই, নজরুলকে নয়। বুঝুন ঠেলা। ওই অনুষ্ঠানে যাইনি, বরং দুই বছর ধরে কোথাও বাইরে না গিয়ে লিখেছি নজরুলের জীবনভিত্তিক উপন্যাস ‘পুড়িব একাকী’ ও ‘নজরুল-আব্বাসউদ্দিন স্মৃতিময় অ্যালবাম’।
জীবনের গল্পটি তুলে এনেছি, রঙ চড়াইনি। প্রজাপ্রতির পাখা রেঙে উঠেছে মাঝে মাঝে। ফিকশন, ইতিহাস নয়। গল্প আমাদের প্রিয় কবির। বিদ্রোহ ও সুন্দরের কারণে হিন্দুরা অনুভব করছেন, মুসলমানেরা আঁকড়ে ধরতে চাইছেন তাদের একমাত্র নকিব, কমরেডরা খুঁজেছেন বঞ্চিতের জয়গান উদ্গাতাকে। মাত্র ১০টি বছর সময় পান কবি তার জীবন মেলে ধরার। সাম্প্রদায়িক মিলনের স্বপ্ন ছিল তার। চুরমার করে দিতে ছুটে আসে মহাযুদ্ধ, মন্বন্তর, দাঙ্গা। প্রতিকূল সময়ের ঝড়ে পাল তোলে হিংসা-অপবাদের ছুরি, অপমান। বিত কবিমনকে ধীরসন্তর্পণে গ্রাস করে দারিদ্র্য, আঘাত, ব্যাধি।
সম্প্রদায়ের সমঝোতা না হতেই দেশ ভাগ। উপন্যাসের ময়ূরপঙ্খী কখনো চলে দুলকি চালে বাতাসের আবর্তে, কখনো ফিকশনের রস্রোতে; স্বগত উচ্চারণে, কবিতায়, গানে, ভাষণে। বাঙালি হিন্দু ও মুসলিম মানসের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত যে কবি, প্রবাহিত তিনি নিজ দুঃখনদীতে। কেউ নিতে পারেননি সে দুঃখভার। ময়লা কথা ময়লা বাক্সে। শেষের দিনে ঘাড়ে মাথায় নিয়েছেন আঘাত। পিতৃবন্ধু কে. মল্লিকের কথন সত্যি বলে গ্রহণ করেছি। বেশ কিছু দিন থেকেই তিনি অসুস্থ, আর ওই দিন থেকে তার অসুস্থতা বেড়েই চলে, চিকিৎসা হয় বহু দিন ধরে, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি ছিলেন নির্বাক। আপনার মনে পুড়েছেন একাকী গন্ধবিধুর ধূপ। এরপর আর গল্প নেই।
সবার আগ্রহ অন্তর্গত মানুষটির গল্পে, কবিপ্রাণে। সমসাময়িকদের স্মৃতিবাসরে সযতনে কুড়িয়েছি সংলাপ। পথ গিয়েছে বেঁকে, দুই ধারের তৃণলতাও কথা বলে উঠেছে। ইথারে ভেসে বেড়ায় স্বগত সংলাপ। কথা ছিল তার গানের ভাষণের আড়াল। কেউ খুঁজবেন স্থান-কাল-পাত্র। শুধু মূল সুর খোঁজার চেষ্টা করেছি।
পুস্তকে অভিনব সংযোজন। পরিশিষ্ট ১ : সাহিত্যবাসর, পাঠক খুঁজে পাবেন কবিকে তার নিজ পরিমণ্ডলে। পরিশিষ্ট ২ : গান ও কবিতার আসরে কবির প্রিয়জন। পরিশিষ্ট ৩ : ১৯৪২ থেকে ২০১১ পর্যন্ত নজরুলকে সামনে নিয়ে এসেছেন যারা। পরিশিষ্ট ৪ : নজরুল ঘনিষ্ঠজনের নির্ঘণ্ট। যারা নজরুলকে জীবন্ত রেখেছেন এতগুলো বছর তার সজ্ঞান অবস্থায় ও অদ্যাবধি তাদের অবদান নিশ্চয়ই স্বীকার করতে হবে। এই নির্ঘণ্ট হালনাগাদ করতে সবার সহায়তা প্রার্থনা করছি।
পিতা আব্বাসউদ্দিন বলেছিলেন : আমাকে ভালোবাস জানি, আমার চেয়েও ভালোবেস নজরুলকে, নজরুলের চেয়েও বেশি রসুলকে। চেষ্টা করে গেছি। নজরুলের ভালোবাসার মানুষ অনেক, তার মাঝে দেখতে পাই যিনি সর্বাধিক অনুপ্রেরণা দিয়েছেন তাঁকে, আমাদের রসুল। নজরুলের সাথে ছিল যাদের ওঠাবসা, কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। পিতা ছাড়াও : আসাদুদ্দৌলা শিরাজী, খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দিন, সুফি জুলফিকার হায়দার, ইব্রাহিম খান, এস ওয়াজেদ আলী, মাহবুবুল আলম, গোলাম মোস্তফা, জসীমউদ্দীন, কমল দাসগুপ্ত [কামাল আহমেদ], ইজাবউদ্দিন আহমেদ, আবুল হোসেন, ওস্তাদ মুহাম্মদ হোসেন খসরু, মাস্তান গামা প্রমুখ। ফিকশনে ওঁরা স্থান করে নিয়েছেন।
ছোট জীবন, ব্যাপ্তি বিশাল, প্রয়োজন হাজার পৃষ্ঠার। কাতিব অশ্রুরুদ্ধ, লিখেছেন অল্পই। তার কেউ নই আমি, তবু উত্তরাধিকারীদের একজন। লক্ষ অনাত্মীয় পাঠক পড়বেন ঘনিষ্ঠতম কবির কাহিনী। প্রজন্মের অশ্রুভরা চোখে নামাবে বিষাদের বৃষ্টি, যা আমার ইচ্ছা ছিল না। একাকী পুড়েছে যে কবির হৃদয়, জলসা শেষে ফিরে গেছেন প্রভুর কাছে। গ্রন্থের প্রতিবাক্য ভালোবাসার অশ্রু দিয়ে গাঁথা, গীত শেষে প্রার্থনা।
বিদ্রোহী প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত। অসহযোগের গান গেয়েছেন এক দিকে, আবার রাজা-রানীর জয়গানও গেয়েছেন তাদের সাথে নজরুলের তফাত বুঝবেন এই গ্রন্থে। যার ধর্ম তার কাছে। পৃথিবীতে এত মানুষ। প্রতি মানুষের সমর্পণ ও সম্পর্ক তার নিজ প্রভুর সাথে আলাদা। ধর্ম বাইরে থেকে শনাক্ত করা গেলেও ভেতরে ঢোকার সাধ্যি কার, প্রতি মানুষের সাথে বিধাতা সেখানে একাকী, নজরুল, আমার, আপনার সবার েেত্র তাই। হিন্দু-মুসলমানের সমঝোতা হয়নি। মাটির কলসি ভেঙে গেলে আর জোড়া লাগে না। থাকব ভাইয়ের মতো, হিংসার ঊর্ধ্বে।
টেগোর সোসাইটি ও ইকবাল অ্যাকাডেমির কার্যক্রম পর্যালোচনার পর জানা গেল নজরুলকে নিয়ে কাজ অগ্রসর হতে পারেনি অর্থাভাবে। সম্প্রতি ইনডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, কাজী নজরুল ইসলাম ও আব্বাসউদ্দিনকে নিয়ে গবেষণার উদ্যোগ নিয়েছে। এর সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকতে পেরে আনন্দিত বোধ করছি।
তার ১১৩তম জন্মদিবসে ভেবেছিলাম প্রতি স্কুলে ছেলেমেয়েরা গাইবে তার গান, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তত একটি অনুষ্ঠানে ছেলেমেয়েরা স্মরণ করবে তাদের প্রিয় কবিকে, তার নামাঙ্কিত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সমবেত হবেন হাজার হাজার নজরুল প্রেমিক; যেখানে জানা যাবে জাতি কিভাবে গত একটি বছর কবিকে নিয়ে এসেছেন জাতির সামনে। জাতীয় ও প্রাইভেট টিভি স্টেশনগুলো উদ্ভাবন করবে নতুন নতুন অনুষ্ঠান, যেখানে কবির ফেলে যাওয়া নাটক-উপন্যাস গীতিনাট্য নতুন করে উপলব্ধি করবে দেশের মানুষ।
গত একটি বছর বিশ্বকবির দেড় শ’ বছর পালন করেছে ভারত ও বাংলাদেশ। এতে রবীন্দ্রনাথের কাব্য ও সঙ্গীতের প্রতি সাধারণের উৎসাহ ও আকর্ষণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আমার ইচ্ছা প্রতিটি স্কুলে নজরুল চর্চা হোক। সেই সাথে আব্বাসউদ্দিন, যিনি নজরুলকে নিয়ে এসেছিলেন সবার কাছে।
‘নজরুল-আব্বাসউদ্দিন স্মৃতিময় অ্যালবাম’ প্রকাশ করেছে চট্টগ্রামের আজাদী পাবলিকেশন্স আমার সংগ্রহ ও সম্পাদনায়। ইসমাইল চৌধুরী সযতেœ প্রকাশ করেছেন নজরুলের আশিটি ও আব্বাসউদ্দিনের ৪৫টি অত্যন্ত মূল্যবান ছবি। রয়েছে বিবক্ষণ, বাংলা ও ইংরেজিতে। বক্তৃতা করে সময় নষ্ট না করে কাজ দুটো করেছি, জাতির উদ্দেশ্যে বিনম্র উপহার। চলে গেলে মূল্য অনুধাবন হবে, আগে নয়।
২৩ মে ২০১২ লেখক : সাহিত্য ও সঙ্গীতব্যক্তিত্ব
mabbasi@dhaka.net
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন