ডাংগুলি, লাটিম, গুলতি, সাতচারা আর গোল্লাছুট শুনলেই মনে পড়ে কিশোরবেলার কথা। আমগাছের ডাল ভেঙে গুলতি বানিয়ে বনবাদাড়ে পাখি শিকারের জন্য কাঁচা হলুদ রোদে ঘুরে বেড়ানোর মধুর স্মৃতি অনেকেরই আছে। মনে পড়ে চোখ বাঁধা ছোঁয়াছুঁয়ির খেলা। বাড়ির পাশে ছাত্তিচোরার বাড়ি ছিল। সে বাড়ির খোলা প্রান্তরে চলত আমাদের নেশার মতো সেসব খেলা। আমার বয়স তখন সাত কি আট হবে। সেসব আজ কেবলই স্মৃতি। কৈশোরের সেসব স্মৃতি একেবারে চোখের সামনে চলে এল একদিন সাভারের ভাকুর্তার কাছের চাইরা গ্রামে গিয়ে।
সেদিন বিরোধী দলের ডাকা হরতালের দ্বিতীয় দিন। মিরপুরে কিছু কাজ ছিল। কাজ সেরে ভাবলাম কাছেপিঠে ধান তোলার দৃশ্য পেলে ছবি তুলব। চলে গেলাম ভাকুর্তা হয়ে চাইরা। এখানেই চলতি পথে দেখা গেল শিশু-কিশোরের মাছ ধরার দৃশ্য। মজার সে দৃশ্য মনে সুখানুভূতি বইয়ে দিল। একটু এগিয়ে দেখলাম, একদল কিশোর গোল্লাছুট খেলছে, খেলছে ডাংগুলি। মনটা চাঙা হলো, মনে পড়ল সুন্দর আমার শৈশব। কিছুক্ষণ পর নাকে ধনেপাতার সুগন্ধ এসে লাগল। এলাকাজুড়ে ধনেপাতাসহ অনেক ধরনের শাকসবজির চাষ হচ্ছে। এগিয়ে চলেছি, কোথাও ধানের চিহ্ন নেই। সোজা পথ, দুই পাশে সবুজ আর সবুজ। এখানেই ভাকুর্তার কাছে জটলার মতো দেখে মোটরসাইকেল ব্রেক করি। এক দঙ্গল ছেলে কিছু একটা নিয়ে বচসা করছে দেখে এগিয়ে যাই। ১০-১২ জন কিশোর। তাদের একজনের হাতে দড়ি আর সুতোয় বাঁধা দুটি পেঁচা। একদল বলছে ছেড়ে দে। আরেক দলের গোঁ-ধরা জেদ, ছাড়মু ক্যান, বিক্রি করমু। বচসার সে পর্যায়ে আমাদের আবির্ভাব। প্রথমে কায়দা করে ওদের বলে পেঁচার ছবি তুলে নিলাম। তারপর আলাপ জমালাম। কেউ কেউ স্কুলে পড়ে, কেউ বেকার। বনবাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়। সঙ্গে পাশের নদীতে ছিপ ফেলে মাছ ধরা, কখনো পাখি শিকার। সঙ্গে এক-আধটু অন্যের বাড়ির ফল না বলে পেড়ে খাওয়া তাদের প্রতিদিনকার দুরন্তপনার তালিকা। বর্তমানের জনপ্রিয় ক্রিকেট খেলা তাদের তালিকায় নতুন সংযোজন। আজ ক্রিকেট খেলার কথা থাকলেও সঙ্গী তিনজন দল থেকে আলাদা হয়ে চলে যায় গোলাই নিয়ে পাখি শিকারে। অন্যদের এই নিয়ে খুব রাগ, কিন্তু কিছু করার নেই। ওরা আবার দলনেতা। রবিউল, ওয়াসকরনী, কাজিমরা যখন ফিরে এল, তখন তাদের হাতে দুটি পেঁচা। বচসা শুরু সেখানেই, কেন খেলার কথা বলে ওরা পাখি ধরতে গেল। তারপর শুরু হলো পেঁচা নিয়ে ঝগড়া। রবিউল, ওয়াসকরনী আর কাজিম বাদে সবাই পেঁচা ছেড়ে দেওয়ার দলে। কিন্তু রবিউলদের এক কথা—ছাড়ুম না, বিক্রি করমু। ওষুধ বিক্রেতারা দুইটা পেঁচা ২০০ ট্যাকা দেব। সে মুহূর্তে শিল্পী কালিদাস কর্মকারের কথা মনে পড়ে গেল। ২০০৪-এ নিঝুম দ্বীপে সূর্য উৎসবে গিয়েছিলাম। দ্বীপে নেমেই আমরা যে যার মতো ঘুরে বেড়াতে গিয়ে হরিণের শিংয়ের খবর পেলাম। তারপর ৩০ টাকা জোড়া সে শিং কেনা শুরু করলাম। তখন কালিদাস দা এসে আমাদের বাধা দিলেন। বলেন, ওদের টাকা চেনাবেন না। এখন শিং বিক্রি করছে। একদিন আস্ত হরিণ ধরে মারবে আর শিংসহ মাংস বিক্রি করবে। তখন আপনি-আমি শত চেষ্টা করেও তাদের আটকাতে পারব না। লোভ খুব খারাপ।
সত্যি লোভ খুব খারাপ। আগেই হয়তো রবিউল, ওয়াসকরনী আর কাজিমরা পাখি বা পেঁচা ধরে বিক্রি করে থাকবে। সুতরাং তাদের বোঝানো খুব কষ্টকর হলো যে তোমরা আজ পেঁচা ধরেছ বা প্রায় সময় পাখি ধরে এসব পাখি বা পেঁচা ধ্বংসের পাশাপাশি পরিবেশের ক্ষতি করে চলেছ, যা খুব অন্যায় ও গর্হিত কাজ। শেষে বললাম, পেঁচা আমাদের দাও, আমরা চিড়িয়াখানায় জমা দেব। তাতেও রাজি না হলে ১০০ টাকায় পেঁচা দুটি কিনে নিলাম। তারপর ভাকুর্তার কাছে এসে এক বিজন এলাকায় গাছগাছালি দেখে পেঁচা দুটিকে একটু সেবা আর পরিচর্যা করে সুতা ও দড়ি মুক্ত করে একটি গাছে চড়ে তার ডালে বসিয়ে দিলাম। একটি পেঁচা সঙ্গে সঙ্গে উড়াল দিল, অন্যটি গোলাই ছোড়ার আঘাত পায়ে দারুণভাবে লেগেছিল। সে গাছের ডালে বসে দাঁড়াতে চেষ্টা করল, মাটিতে পড়েও গেল। তারপর একটু সময় বিশ্রাম নিয়ে সেও উড়াল দিল!
পেঁচা দুটি সম্ভবত হুতুম পেঁচা ছিল। বয়স বেশি না। গ্রামগঞ্জে বড় গাছগাছালি ও বনে পানির খুব কাছে গাছের ওপর এদের সময় কাটে। দিনের বেলায় খাবারের সন্ধানে বের হয়, বিশেষ করে মাছের সন্ধানে। পেঁচা দুটিকে আমি আর আমার সঙ্গী মিলে বেশ সময় নিয়ে সেবা করেছিলাম। কিন্তু উড়ে যাওয়ার কালে একটি পেঁচা আমার কনিষ্ঠায় কামড়ে দিয়ে রক্তপাত ঘটিয়েছিল। সে কষ্ট বা ক্ষত এখন আর নেই, কিন্তু পেঁচা দুটিকে স্বাধীন করার সুখ আজীবন থাকবে!
ফারুখ আহমেদ
সেদিন বিরোধী দলের ডাকা হরতালের দ্বিতীয় দিন। মিরপুরে কিছু কাজ ছিল। কাজ সেরে ভাবলাম কাছেপিঠে ধান তোলার দৃশ্য পেলে ছবি তুলব। চলে গেলাম ভাকুর্তা হয়ে চাইরা। এখানেই চলতি পথে দেখা গেল শিশু-কিশোরের মাছ ধরার দৃশ্য। মজার সে দৃশ্য মনে সুখানুভূতি বইয়ে দিল। একটু এগিয়ে দেখলাম, একদল কিশোর গোল্লাছুট খেলছে, খেলছে ডাংগুলি। মনটা চাঙা হলো, মনে পড়ল সুন্দর আমার শৈশব। কিছুক্ষণ পর নাকে ধনেপাতার সুগন্ধ এসে লাগল। এলাকাজুড়ে ধনেপাতাসহ অনেক ধরনের শাকসবজির চাষ হচ্ছে। এগিয়ে চলেছি, কোথাও ধানের চিহ্ন নেই। সোজা পথ, দুই পাশে সবুজ আর সবুজ। এখানেই ভাকুর্তার কাছে জটলার মতো দেখে মোটরসাইকেল ব্রেক করি। এক দঙ্গল ছেলে কিছু একটা নিয়ে বচসা করছে দেখে এগিয়ে যাই। ১০-১২ জন কিশোর। তাদের একজনের হাতে দড়ি আর সুতোয় বাঁধা দুটি পেঁচা। একদল বলছে ছেড়ে দে। আরেক দলের গোঁ-ধরা জেদ, ছাড়মু ক্যান, বিক্রি করমু। বচসার সে পর্যায়ে আমাদের আবির্ভাব। প্রথমে কায়দা করে ওদের বলে পেঁচার ছবি তুলে নিলাম। তারপর আলাপ জমালাম। কেউ কেউ স্কুলে পড়ে, কেউ বেকার। বনবাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়। সঙ্গে পাশের নদীতে ছিপ ফেলে মাছ ধরা, কখনো পাখি শিকার। সঙ্গে এক-আধটু অন্যের বাড়ির ফল না বলে পেড়ে খাওয়া তাদের প্রতিদিনকার দুরন্তপনার তালিকা। বর্তমানের জনপ্রিয় ক্রিকেট খেলা তাদের তালিকায় নতুন সংযোজন। আজ ক্রিকেট খেলার কথা থাকলেও সঙ্গী তিনজন দল থেকে আলাদা হয়ে চলে যায় গোলাই নিয়ে পাখি শিকারে। অন্যদের এই নিয়ে খুব রাগ, কিন্তু কিছু করার নেই। ওরা আবার দলনেতা। রবিউল, ওয়াসকরনী, কাজিমরা যখন ফিরে এল, তখন তাদের হাতে দুটি পেঁচা। বচসা শুরু সেখানেই, কেন খেলার কথা বলে ওরা পাখি ধরতে গেল। তারপর শুরু হলো পেঁচা নিয়ে ঝগড়া। রবিউল, ওয়াসকরনী আর কাজিম বাদে সবাই পেঁচা ছেড়ে দেওয়ার দলে। কিন্তু রবিউলদের এক কথা—ছাড়ুম না, বিক্রি করমু। ওষুধ বিক্রেতারা দুইটা পেঁচা ২০০ ট্যাকা দেব। সে মুহূর্তে শিল্পী কালিদাস কর্মকারের কথা মনে পড়ে গেল। ২০০৪-এ নিঝুম দ্বীপে সূর্য উৎসবে গিয়েছিলাম। দ্বীপে নেমেই আমরা যে যার মতো ঘুরে বেড়াতে গিয়ে হরিণের শিংয়ের খবর পেলাম। তারপর ৩০ টাকা জোড়া সে শিং কেনা শুরু করলাম। তখন কালিদাস দা এসে আমাদের বাধা দিলেন। বলেন, ওদের টাকা চেনাবেন না। এখন শিং বিক্রি করছে। একদিন আস্ত হরিণ ধরে মারবে আর শিংসহ মাংস বিক্রি করবে। তখন আপনি-আমি শত চেষ্টা করেও তাদের আটকাতে পারব না। লোভ খুব খারাপ।
সত্যি লোভ খুব খারাপ। আগেই হয়তো রবিউল, ওয়াসকরনী আর কাজিমরা পাখি বা পেঁচা ধরে বিক্রি করে থাকবে। সুতরাং তাদের বোঝানো খুব কষ্টকর হলো যে তোমরা আজ পেঁচা ধরেছ বা প্রায় সময় পাখি ধরে এসব পাখি বা পেঁচা ধ্বংসের পাশাপাশি পরিবেশের ক্ষতি করে চলেছ, যা খুব অন্যায় ও গর্হিত কাজ। শেষে বললাম, পেঁচা আমাদের দাও, আমরা চিড়িয়াখানায় জমা দেব। তাতেও রাজি না হলে ১০০ টাকায় পেঁচা দুটি কিনে নিলাম। তারপর ভাকুর্তার কাছে এসে এক বিজন এলাকায় গাছগাছালি দেখে পেঁচা দুটিকে একটু সেবা আর পরিচর্যা করে সুতা ও দড়ি মুক্ত করে একটি গাছে চড়ে তার ডালে বসিয়ে দিলাম। একটি পেঁচা সঙ্গে সঙ্গে উড়াল দিল, অন্যটি গোলাই ছোড়ার আঘাত পায়ে দারুণভাবে লেগেছিল। সে গাছের ডালে বসে দাঁড়াতে চেষ্টা করল, মাটিতে পড়েও গেল। তারপর একটু সময় বিশ্রাম নিয়ে সেও উড়াল দিল!
পেঁচা দুটি সম্ভবত হুতুম পেঁচা ছিল। বয়স বেশি না। গ্রামগঞ্জে বড় গাছগাছালি ও বনে পানির খুব কাছে গাছের ওপর এদের সময় কাটে। দিনের বেলায় খাবারের সন্ধানে বের হয়, বিশেষ করে মাছের সন্ধানে। পেঁচা দুটিকে আমি আর আমার সঙ্গী মিলে বেশ সময় নিয়ে সেবা করেছিলাম। কিন্তু উড়ে যাওয়ার কালে একটি পেঁচা আমার কনিষ্ঠায় কামড়ে দিয়ে রক্তপাত ঘটিয়েছিল। সে কষ্ট বা ক্ষত এখন আর নেই, কিন্তু পেঁচা দুটিকে স্বাধীন করার সুখ আজীবন থাকবে!
ফারুখ আহমেদ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন