
আকাশচুম্বী অট্টালিকার দাপটে ঢাকার প্রসারিত আকাশ ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। চলে যাচ্ছে দৃষ্টির আড়ালে। একে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে নতুন নতুন বহুতল ভবন ক্রমাগত আকাশ ছোঁয়ার অভিলাষী হয়ে উঠছে। পত্রপত্রিকায় এবং টেলিভিশনে তারা মাঝেমধ্যেই বিজ্ঞাপন দেয় ‘আকাশটা ছোঁবেন নাকি?’ আমরা বুঝতে পারি না এটা বিজ্ঞাপন নাকি সরকারের বিভিন্ন ‘সেকটর’ দু’হাতে লুটপাট করে হঠাত্ বিপুল বিত্তের অধিকারী হওয়া নব্য ধনিক শ্রেণীর বিদ্রূপ! আকাশকে ছোঁয়ার আগ্রহে উল্লসিত হয়ে ওঠা এসব মানুষের বিলাসী ও উদ্ধত ভবনগুলো আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কাছ থেকে নিষ্ঠুরভাবে আকাশ কেড়ে নিচ্ছে। এই শহরের যেখানে ইচ্ছা সেখানে দাঁড়িয়ে এখন আমরা আর আকাশ দেখতে পাই না। অটল পাহাড় কিংবা বাধার বিন্ধাচল হয়ে একেকটি বহুতল ভবন এমনভাবে আমাদের দৃষ্টিকে থমকে দেয় যে, সেখান থেকে অন্য আকাশকে কিছুতেই আর স্বমহিমায় খুঁজে পাওয়া যায় না। মানুষের হাতে তৈরি এই কংক্রিটের ভবনগুলো দিনরাত এমনভাবে তাদের নির্মাতার জয়গান গেয়ে চলেছে যে তার দম্ভের কাছে মহাশক্তিধর প্রকৃতিকে নেহাতই একটা গোবেচারা বলে মনে হয়। আর অপরিকল্পিতভাবে বেড়ে ওঠা এই ঢাকা শহরে এই দীর্ঘদেহী ভবনগুলো যেভাবে জ্যামিতিক হারে বংশবিস্তার করে চলেছে, তাতে মনে হয় ভবিষ্যত্ প্রজন্ম ভবনের ছাদে না উঠে কিংবা মাটিতে দাঁড়িয়ে আর কোনো দিন আকাশের উদারতা, ঐশ্বর্য আর অসীমতার সম্যক রূপ উপলব্ধি করতে পারবে না। হয়তোবা বার তলা ভবনে বসে পূর্ণিমার চাঁদ বা জোছনাভেজা আকাশ দেখতে পাবে না। কেননা তার পাশেই পূর্বদিকের ভবনটি বিশ তলা। হয়তোবা তখন এই শহরের এক বা একাধিক অতি দুর্লভ কিছুটা খোলা জায়গা নিরাপত্তা বেষ্টনীতে ঘিরে ফেলে তার প্রবেশমুখে একটা চমত্কার সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেওয়া হবে, যাতে লেখা থাকবে, ‘এখানে উপযুক্ত সম্মানীর বিনিময়ে উন্মুক্ত আকাশ দেখার সুযোগ রয়েছে’। শহরের আকাশপ্রেমী মানুষেরা লাইনে দাঁড়িয়ে টিকেট কেটে সার বেঁধে সেখানে ঢুকবে, যেমন ঢুকি এখন আমরা চিড়িয়াখানায়। আর যে আতঙ্কঘেরা ভূমিকম্প মাঝেমধ্যেই আমাদেরকে তার অস্তিত্বের জানান দিয়ে যাচ্ছে, বারংবার মৃদু স্পর্শে সচকিত করে তুলছে। একবার তা যদি তীব্র মাত্রায় তার প্রলয়নাচন শুরু করে দেয়, তখন কী অবস্থা হবে আকাশচুম্বী অট্টালিকাশোভিত এই শহরের? ভাবতেও গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। তাই সে প্রসঙ্গ এখন থাক।
ইট-সিমেন্টের এই শহরে সান্ত্বনা-স্বস্তি ও আনন্দের অন্তত একটি জায়গা এখনও টিকে আছে। যেদিকে তাকালে খর-বৈশাখের রৌদ্রদগ্ধ দিনে হঠাত্ নামা একপশলা বৃষ্টির মতোই স্নিগ্ধ শান্তি আমাদের তাপিত দৃষ্টিকে শীতল এবং কোমল করে দিয়ে যায়। সে আমাদের রমনা। হ্যাঁ, জোর দিয়েই বলছি ‘আমাদের রমনা’। কেননা কোনো প্রতাপশালী ভূমিদস্যুর অথবা ব্যক্তিমালিকানার পরোয়ানা জারি করা কোনো ধ্বজা আজও সেখানে উড়তে দেওয়া হয়নি। নির্বাসনে পাঠানো হয়নি ঘাসে-ঢাকা বিস্তীর্ণ সবুজ চত্বরকে। হারিয়ে যেতে দেওয়া হয়নি লতাপাতা ও গাছগাছালির অপরূপ শ্যামলিমাকে। প্রতিষ্ঠা দেওয়া হয়নি অঢেল বিত্তের প্রদর্শনীকেন্দ্র হিসেবে বেড়ে ওঠা কোনো বেঢপ ইমারতকে। যতদিন অক্ষুণ্ন রাখা হবে প্রকৃতির সঙ্গে মেলবন্ধনে গড়ে তোলা এই সৌন্দর্যময়তাকে, ততদিন রমনা আমাদের-শ্যামল রংয়ের প্রেমে পড়া এ দেশের সকল মানুষের।
‘দিনান্তের সূর্য পশ্চিম আকাশ থেকে/ মুঠি মুঠি সোনার রং ছড়িয়ে দেয়/ রমনার ফুল পাখি প্রজাপতি আর/ সবুজ ঘাসের মখমলে মোড়া উঠোনে বৃক্ষলতা/ বুড়িগঙ্গা থেকে ভেসে আসা বাতাসে চুল এলিয়ে/ রমণী সেজে ওঠে সাঁঝের অলৌকিক সাজে...’ অনেক আগে পড়া এই প্রিয় কবিতার পঙিক্তগুলো কখনও কখনও আমি আপন মনে আবৃত্তি করি। আর ঠিক তখনই শেষ সূর্যাস্তের সোনালি রং আপন শরীরে মেখে নিয়ে রমনার রূপবতী হয়ে ওঠার দৃশ্যটা আমার দৃষ্টির সীমানায় দ্যুতিময় হয়ে ওঠে। অনেকটা অভিভূতের মতোই আমি সেদিকে তাকিয়ে থাকি। মনে মনে দেখি রমনাকে।
একসময় আমি ঢাকার বখশিবাজারস্থ সরকারি আলিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করতাম। থাকতাম ইস্কাটন গার্ডেনের নিউ সার্কিট হাউসের পাঁচতলায় ৭৬ নয় স্যুটে। যাওয়া-আসা করতে হতো রমনার প্রাণকেন্দ্র রমনা পার্ক আর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পাশ ঘেঁষে। সকাল ৯টার দিকে বাসা থেকে বেরিয়ে কর্মক্ষেত্রের উদ্দেশে যাত্রা। আর পড়ন্ত বেলার রোদ বৃষ্টি বাতাস গায়ে মেখে ঘরে ফেরা। কোনো কোনোদিন সন্ধ্যা হয়ে যেত। আর তা ছিল আমার জন্য প্রত্যাশিত আনন্দের সচল মুহূর্ত দিয়ে ঘেরা। প্রকৃতির আধো-আলো আর আধো-অন্ধকার দিয়ে ঘেরা বর্ণালি সন্ধ্যার মহামুহূর্তে আমার রিকশা যখন সোহরাওয়ার্দী ও রমনা উদ্যানের পাশ দিয়ে মন্থর গতিতে গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চলত, অবধারিতভাবেই তখন রমনাকে নিয়ে লেখা আমার অতিপ্রিয় ২/৩টি কবিতার কথা মনে পড়ে যেত। আমি তা আবৃত্তি করতাম। কখনও মনে মনে নীরবে আবার কখনও সরবে। রিকশাওয়ালা থেকে পথচারীরা কে কী মনে করল অথবা করতে পারে তা নিয়ে মোটেই মাথা ঘামাতাম না। কেননা তখন আমার বুকে থৈ থৈ আনন্দ। আমার ভেতরের আমিটি আনন্দে পরিপ্লুত। আর সেটিই তখন আমার কাছে একমাত্র সত্য। জীবন ও জগতের বাকি সবকিছু অর্থহীন। অতএব তাতা থৈ, তাতা থৈ।
রমনা বলতে যদিও ঢাকা শহরের বেশ একটা বড় এলাকা বোঝায়, (পূর্বে এর আয়তন আরও বড় ছিল) তবুও আমরা প্রধানত রমনা পার্ক থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মনোরম সবুজ এবং অনেকটাই আয়তাকার পরিমণ্ডলটি বুঝে থাকি। আর এই সবুজ চত্বরের চারপাশ ঘিরে গড়ে ওঠা চমত্কার কিছু জাতীয় প্রতিষ্ঠানের কোনোটিতে জ্ঞান, কোনোটিতে গবেষণা আবার কোনোটিতে সৃজনশীলতার চর্চা চলছে। চলছে জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য, ভাষা ও সাহিত্য সংরক্ষণের কার্যক্রমও। একটি জাতি এ পর্যন্ত যা অর্জন করেছে তার স্বীকৃতি এবং সংরক্ষণ এবং তারই পাশাপশি আগামীতে সে যা অর্জন করবে অথবা করা উচিত দিনরাত তারই দীক্ষা চলেছে রমনা-পারের এই কর্মচঞ্চল প্রতিষ্ঠানগুলোয়। একদিকে সোহরাওয়ার্দী এবং রমনা উদ্যানের কোমল ঘাসে ঢাকা মায়াবী চত্বর, অপরদিকে সৃজনের, জ্ঞানের, গবেষণার এবং সংরক্ষণের সমুদ্র মন্থনের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলো। আর এ দু’য়ের ঠিক মাঝখান দিয়ে চলে যাওয়া মসৃণ ও প্রশন্ত পথ ধরে যতবার আমি যাতায়াত করি, ততবারই আনন্দ ও গর্বে আমার বুক ভরে ওঠে। বিশাল কলকাতা শহরের বহুবিধ আকর্ষণীয় ও দর্শনীয় স্থানকে পিছে ফেলে ভিক্টোরিয়ার বিপরীতে একাডেমি, নন্দন ও রবীন্দ্রসদন সন্নিহিত এলাকায় পা রাখলেই অনুভব করা যায় যে কলকাতার হূদয় এখানেই বাস করে। এখান থেকেই সে তার উত্তাপ ও ঐশ্বর্যের ছটা ছড়িয়ে দেয় গোটা শহরে-সমগ্র বাংলায়। রমনার সবুজ চত্বর ছুঁয়ে চলা পথ দিয়ে চলাচলের সময় একইভাবে মনে হয় ঢাকা শহরের আত্মাকে পুরনো লালবাগে অথবা নতুন ধানমণ্ডি, গুলশান-বনানীতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। কারণ চার শতাব্দীর পুরনো এই শহরের আত্মাটি ঠিক এখানেই বাস করে এবং এই আত্মার একটা অদ্ভুত সম্প্রসারণ ক্ষমতা রয়েছে। জাতির বিশেষ প্রয়োজনীয় মুহূর্তগুলোতে তাই সে অনায়াসেই ঢাকা শহরকে ছাপিয়ে সমগ্র দেশের আত্মা হয়ে গর্জে উঠতে অথবা স্বস্তির সুবাতাস ছড়াতে কোনো কুণ্ঠাবোধ করে না। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ এবং ১৬ ডিসেম্বরে গোটা পৃথিবী তা জেনেছে। ’৯০-এর এরশাদবিরোধী আন্দোলনে এই চত্বরকেই আমরা দেখেছি বারংবার রণক্ষেত্র হয়ে উঠতে এবং পরিণামে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাকেই বিজয়ী হয়ে উঠতে দেখতাম আমরা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নামে পরিচিত রমনার এই অংশটির পাশ দিয়ে পথ অতিক্রম করার সময় অথবা তার ভেতরে ঘোরাফেরা করতে গিয়ে কখনও কখনও মনে হয়েছে, দীর্ঘকাল ধরে ঘোড়দৌড়ের মাঠ হিসেবে পরিচিত এই বিশাল মাঠটিকে শুধু সবুজ ঘাসে ছাওয়া মাঠ হিসেবে রেখে দিলেই ভালো হতো। আগামী দিনের কোনো ঐতিহাসিক মুহূর্তে লাখো মানুষের দৃপ্ত উপস্থিতি ও পদভারে তাহলে তার জেগে ওঠার পথটি সুগম থাকত। ইতোমধ্যে পরিবেশবাদীদের একটি দলকে কয়েক দফা দাবি সমেত লিফলেট বিলি করতে দেখেছি। ওদের দাবিগুলোকে তখন বেশ জোরালোই মনে হয়েছিল।
কিন্তু রমনার ওই সবুজ উঠোনোর প্রতিটি মৃত্তিকাকণা আর ঘাসের ডগার মধ্যে জাগরণের একটা অসাধারণ শক্তি আছে। আর সে জাগরণের রূপ ও আমাদের বৈচিত্র্যময় ঋতুগুলোর মতোই একটি থেকে আরেকটি আলাদা। না, শুধু রূপ নয়, তার সত্তাটিকেও মনে হয় স্বতন্ত্র। কখনও প্রফুল্ল, কখনও সজল, আবার কখনও রুদ্র। পরিস্থিতি-পরিবেশ এবং প্রয়োজনের দিকে লক্ষ রেখেই সে তার এই রূপবৈচিত্র্যের প্রকাশ ঘটায় এবং তা ঘটাতে শুরু করে বাংলা নতুন বছরের একেবারে প্রথম দিন থেকে। রমনা এখন অসাম্প্রদায়িক বাঙালি সংস্কৃতির বর্ণাঢ্য উত্সব নববর্ষ উদযাপনের প্রধান পীঠস্থান। সেদিন এক আশ্চর্য সুন্দর, সজীব ও প্রফুল্ল রূপের ঐশ্বর্য ছড়ানো থাকে রমনার পথে পথে, ঘাসে ঘাসে, ফুলে ফুলে এবং পাতায় পাতায়। গলা খুলে সেদিন তো আমরা ‘ এসো হে বৈশাখ। এসো এসো’ গানটি গেয়েই থাকি। কিন্তু সেই সঙ্গে আমার সেদিন গাইতে ইচ্ছা করে-‘রমনা আমার, আমার রমনা। তোমার এই প্রফুল্ল রূপটিই আমাদের অনেক গানের আর অনেক সৃষ্টির প্রেরণা...’
‘রমনা’ শব্দের আভিধানিক অর্থ রম্য বা রমণীয় স্থান। বর্তমানে ঢাকা শহরের অধিকাংশ স্থানের নামগুলোই তার অর্থের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এ নিয়ে মজার মজার গল্প-কৌতুক ও গানের কথাও আমরা জানি। কিন্তু রমনা এদিক থেকে এক আশ্চর্য ব্যতিক্রম। চার শতাধিক বছরের পুরনো এই রাজধানী শহরের অনেক কিছুর বদল ঘটলেও অনড় অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে রমনা-তার নামের অর্থ ও তাত্পর্যগত অক্ষুণ্নতা নিয়ে। এবং অনুমান করি এমনি করে সে অনায়াসেই পার করে দেবে আরও কয়েকশ’ বছর।
বহু মানুষের বহু দিবসের স্বপ্ন, কল্পনা, শ্রম, দূরদৃষ্টি ও ভালোবাসার ফসল এই রমনা। তাদের সবার কাছেই আমাদের ঋণ ও কৃতজ্ঞতা জমা হয়ে আছে। তাদের সবাই আমাদের কাছে স্মরণীয়। তবে তাদের মধ্যে সবার আগে যে মানুষটি আমাদের সামনে এসে দাঁড়ান, তিনি সুবেদার ইসলাম খান চিশতি।
মধ্যযুগের পাঠান-শাসিত বাংলায় ১৫৭৬ সালে সম্রাট আকবর যুদ্ধজয়ী মোগল বাহিনী প্রেরণ করে বাংলাকে মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। তবে সম্মুখযুদ্ধে পরাজিত হলেও পাঠান ও বারভূঁইয়ারা তাত্ক্ষণিকভাবে মোগল আনুগত্য স্বীকার করে নেয়নি। জলাজঙ্গলময় বাংলার বিভিন্ন প্রান্তরে পদে পদে তারা মোগলদের জন্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে চলছিল। অনেকটা গেরিলা যুদ্ধের মতোই ছিল তাদের সেই রণকৌশল। ফলে বাংলা দখল করতে অনেক দিন পর্যন্ত মোগলরা স্বস্তিতে থাকতে পারেনি। এরকম অবস্থায় ১৬০৫ সালে সম্রাট আকবরের মৃত্যু হয়। জাহাঙ্গীর ক্ষমতায় এসেই তার দুধভাই কুতুবউদ্দীনকে বাংলার সুবেদার করে পাঠান। কিন্তু কুতুবউদ্দীনের মধ্যে সুশাসকের কোনো গুণাবলিই ছিল না। অত্যন্ত কাপুরুষোচিতভাবে শের আফগানকে হত্যা করতে গিয়ে নিজের পৈতৃক প্রাণটিই খুইয়ে বসেন। তার শূন্য জায়গায় নতুন সুবেদারের দায়িত্ব নিয়ে আসেন ইসলাম খান চিশতি। তিনি ছিলেন ফতেপুর সিক্রির সেলিম চিশতির নাতি। উন্নত এবং দৃঢ় চারিত্রিক গুণাবলির অধিকারী ছিলেন তিনি। সুবেদারের দায়িত্ব নিয়ে রাজমহল থেকে বাংলার রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তর করেন। তারই ভালোবাসা ও দূরদৃষ্টির কারণে ঢাকা পায় রাজধানী হওয়ার গৌরব। এটা ১৬০৮ সালের (মতান্তরে ১৬১০) ঘটনা। ঢাকা তখন ছিল বহু মানুষের এক অপরিকল্পিত শহর। অধিকাংশ বাড়িই ছিল খড়ের। নাগরিক সুযোগ-সুবিধা, পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা, প্রশস্ত রাস্তাঘাট, চাকচিক্যময় বাড়িঘর-এসব কোনো কিছুর সঙ্গেই ঢাকাবাসীর তখন পরিচয় ছিল না। ইসলাম খান ঢাকায় পা রাখার পরই ত্রিপক্ষীয় যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। প্রথমেই তিনি লুটেরা মগ-ফিরিঙ্গিদের দমন করেন। তারপর বিদ্রোহী বারভূঁইয়া ও পাঠানদের দিকে নজর দেন। প্রতিটি যুদ্ধেই তিনি অসামান্য সাফল্য অর্জন করে বাংলায় মোগল শাসনের ভিত সুদৃঢ় করে গড়ে তোলেন। এসব রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও তিনি ঢাকা শহরকে একটি সুন্দর ও সুসজ্জিত শহর হিসেবে গড়ে তোলার উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তার সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই জলাজঙ্গলে পরিপূর্ণ ‘রমনা’ হয়ে ওঠে ‘রমণীয় রমনা’। যেখানে এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, সেখানেই প্রতিষ্ঠিত হয় এক রাজকীয় মোগল উদ্যান ‘বাদশাহী বাগ’। আর উদ্যান সন্নিহিত এলাকায় গড়ে তোলা হয় মোগল স্থাপত্যের শৈল্পিক সুষমামণ্ডিত গম্বুজ, মিনার, আবাসগৃহ, মসজিদ ইত্যাদি। ঢাকা যতদিন মোগল রাজধানী ছিল, ততদিন রমনার পরিচর্যা এবং উত্তরোত্তর সমৃদ্ধির কোনো ব্যত্যয় হয়নি। কিন্তু মোগল যুগের অবসানের পর রমণীয় রমনা আবার ঝোপজঙ্গলে ঢেকে যাওয়া এক পরিত্যক্ত অঞ্চলে পরিণত হয়। যত্নের অভাবে দৃষ্টিনন্দন মোগল স্থাপনাগুলো জীর্ণ হতে হতে ধ্বংসের কাছে আত্মসমর্পণ করে। পুরো এক শতাব্দী ধরে চলে সেখানে পেঁচা আর ইঁদুরের লুকোচুরি। অতঃপর ১৮২৫ সালে ঢাকার কালেক্টর গত্. উড়বিং-এর হাতে শুরু হয় নতুন করে তাতে প্রাণ প্রতিষ্ঠার কাজ। আর ১৯৪৯ সালে ৭১ প্রজাতির বৃক্ষ এবং ৮৮.৫০ একর জায়গায় আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয় রমণী পার্কের। বর্তমানে এর আয়তন কিছুটা কমেছে, তবে বেড়েছে বিভিন্ন প্রজাতির দৃষ্টিকাড়া উদ্ভিদের সংখ্যা-ছয়টি ঋতুর রূপবৈচিত্র্য নিবিড়ভাবে পরখ করার জন্য, যা নিসর্গপ্রেমী মানুষদের কেবলই হাত বাড়িয়ে কাছে টানে।
পঞ্চাশের দশকের কিছু সাহিত্যে অত্যন্ত বেদনার সঙ্গে ১৯৫০-এ সংঘটিত হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গার কিছু মর্মন্তুদ বর্ণনা পড়েছিলাম। পড়তে পড়তে চোখের জলে বুক ভিজেছিল। তবুও পড়েছিলাম। তারই একটা বর্ণনা আমার মনে বিশেষভাবে দাগ কেটেছিল। সেই ভয়ঙ্কর দাঙ্গায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় তাদের বাড়িঘর, সম্পদ, স্বজন-সবকিছু হারিয়ে রমনার কালীমন্দির ও তার আশপাশে আশ্রয় নিয়েছিল। রাতে তারা সবাই একত্রিত হলেও দিনের বেলা বিভিন্ন কাজে শহরের নানা জায়গায় ছড়িয়ে থাকত। কিন্তু দিনশেষে আবার ফিরে আসত রমনায়। যেসব নবাগত পথ ভুলে যেতেন তারা রমনার কালীমন্দিরের উঁচু চূড়া লক্ষ করে হারানো ঠিকানা খুঁজে পেতেন। আজকের ঢাকার গগনচুম্বী অট্টালিকা এবং ভূমিকম্পের আশঙ্কা নিয়ে কথা শুরু করেছিলাম। আবার ফিরে যাই সেখানেই। সত্যি সত্যি যদি কোনো দিন এখানে শক্তিশালী কোনো ভূমিকম্প আছড়ে পড়ে, তবে সেদিনও এই রমনার খোলা উদ্যান আর সবুজ ঘাসে ঢাকা প্রান্তরই হয়তো আবার হয়ে উঠবে নতুনভাবে বিপন্ন, দুর্গত ও আশ্রয়চ্যুত মানুষের সাময়িক আশ্রয়স্থল, পা রাখার জায়গা।
লেখক : শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন