বৃহস্পতিবার, ৩১ মে, ২০১২

একা একটি তরুণী এবং কয়েকজন পুলিশ

ফারুক ওয়াসিফ | তারিখ: ০১-০৬-২০১২
তিনজন পুলিশ মিলে একটি মেয়েকে পেটাচ্ছে। প্রথম আলোর ছবি। পুলিশের হিংস্র মুখ, বর্বর লাঠি, সব স্পষ্ট। কেবল অস্পষ্ট মেয়েটির মুখ। সামাজিক বিড়ম্বনার কথা ভেবে ছবিতে অস্পষ্ট করে রাখা হয়েছে তার মুখচ্ছবি। ঘটনার শুরুতে যে মেয়েটিকে আমরা নিপীড়িত চেহারায় দেখি, ঘটনার শেষে তাকেই ফিরে পাই বীরোচিত সংগ্রামের নায়িকা হিসেবে। যদি সে নারী না হতো, যদি আমাদের দেশে নারীকে কেবল নিপীড়িতা বা কলঙ্কিতা চেহারায় দেখার ও দেখানোর কুঅভ্যাস জারি না থাকত, তাহলে বীরের বন্দনা মেয়েটির প্রাপ্য হতো।
তার নিপীড়ন যতটা সত্য, ততটাই সত্য তার প্রতিবাদের সাহসিকতা, তার আত্মমর্যাদা রক্ষার জেদ। নারীর ওপর আরোপিত ভাবমূর্তি ভেঙে নির্যাতন মোকাবিলা করাই এই প্রায়-কিশোরী ক্লাস এইট পাস, নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েটির প্রধান সার্থকতা। হে মেয়ে, তোমার মুখ যে আমাদের অস্পষ্ট করে দিতে হলো, সেটা আমাদের পুরুষালি মনেরই সমস্যা। অন্য সময়, অন্য সমাজ হলে তোমার মুখ দেখার জন্য, তোমাকে অভিনন্দন জানানোর জন্য অজস্র মানুষ ছুটে আসত। অথচ আমাদের দুর্বলতা ঢাকতে আমরা তোমাকেই লুকিয়ে রাখছি।

স্পষ্ট পুলিশ ও অস্পষ্ট মুখের সেই মেয়েটি
অস্পষ্ট মুখের সেই মেয়েটি সব স্পষ্ট করে দিয়েছে। পুলিশ কতটা নির্যাতক, পুলিশ কতটা যৌন নিপীড়ক এবং পুলিশ কতটা আইন ও অধিকারের বিপরীত শক্তি। নিজের শরীরে পীড়নের চিহ্ন বয়ে সে এই সত্য আবারও প্রমাণ করছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন ‘ভালো’ পুলিশের সার্টিফিকেট দিচ্ছেন, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী যখন পুলিশ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকতে বলেছেন, তখন সেই ‘ভালো’ পুলিশ মেয়েটি ও তার পরিবারকে নিরাপদ দূরত্বে থাকতে দেয়নি। কিন্তু আর দশটি নির্যাতনের ঘটনা থেকে এই ঘটনা খুবই আলাদা। মেয়েটি এখানে নীরবে সহ্য করেনি, পালিয়ে বাঁচতে চায়নি বা অপমানে আত্মহত্যা করে বসেনি। এখানে সে রুখে দাঁড়িয়ে সাংবাদিক, আইনজীবী, মানবাধিকারকর্মীসহ নাগরিকদের পথ দেখিয়েছে।
আদালতের গা-ঘেঁষেই পুলিশ ক্লাব। তার সামনের রাস্তায় মা-বাবার সঙ্গে ভাগাভাগি করে প্রথম পিটুনি খায় সে। তারপর তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় ক্লাবের ভেতরে। সেখানে যা হয় তার সঙ্গে কোনো মাফিয়া নির্যাতনকেন্দ্রের পরিস্থিতিরই তুলনা চলে। এক ঘরে বাবাকে পেটানো হচ্ছে। অন্য একটি ঘরে একা সেই তরুণী এবং তাকে ঘিরে কয়েকজন উদগ্র পুলিশ। তার সঙ্গে যা করা হয়েছে, তার সঠিক নাম পুলিশি সন্ত্রাস ও যৌন নিপীড়ন। সরকার আমাদের বলেছিল, নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে পুলিশকে জিরো টলারেন্স দেখাতে বলা হয়েছে। সেই পুলিশ এমনই পুলিশ, যে নিজেই অবতীর্ণ হয়েছে যৌন নির্যাতকের ভূমিকায়। নাগরিকের নিরাপত্তার সহায় পুলিশ এখন ভয়ের ডাকনাম।

রাষ্ট্র বনাম পরিবার
এই ঘটনায় আক্রান্ত হয়েছে পরিবার। মা, বাবা ও কন্যা—তিনজন তিন ঘরে আটক। সেই মা এক কানে তাঁর স্বামীর চিৎকার শুনছেন, অন্য কানে শুনছেন মেয়ের আর্তনাদ। পুলিশ কিছুই শুনছে না। তারা বধির। তারা পিটিয়ে যাচ্ছে, নির্যাতন করেই যাচ্ছে। তখনই মা, মেয়ে আর বাবার কান্নার ধ্বনি একাকার হয়ে লাঞ্ছিত মানবতার হাহাকার হয়ে ওঠে। এই হাহাকার এই মুহূর্তে বাংলাদেশে নিপীড়িত মানবতারই ডাক।
সেই হাহাকার শুনেই বোধ হয় পুলিশের অন্য কয়েকজন কর্মকর্তা এসে তাঁদের উদ্ধার করেন। যদি তাঁরা সাড়া না দিতেন, যদি তাঁরা বাকিদের মতো অমানুষই হয়ে থাকতেন, তাহলে হয়তো আরেকটা ইয়াসমিন, আরেকটা সীমা চৌধুরীর পরিণতি হতে পারত। কয়েকজন কর্মকর্তার এই সাড়া বিপর্যয়ের মধ্যে ক্ষীণ আশার আলামত হতে পারত। কিন্তু হয়নি।
পুলিশ এবার ‘সত্যিকার’ পুলিশি কারবার শুরু করে দিল। সেই হস্তক্ষেপ করা কর্মকর্তারা পরিবারটির কাছে ক্ষমা চাইলেন না, অপরাধ করা পুলিশদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও ভাবলেন না। তাঁরা ভাবলেন পরিবারটিকে আটকে রেখে ‘কুকীর্তি’ গোপন করবার কথা। পুলিশ তারপর পুলিশি কায়দাতেই বাপ-বেটি আর মাকে ধরে কোতোয়ালি থানায় নিয়ে যায়। বাবার স্থান হয় হাজতে আর মা-মেয়েকে রাখা হয় একটি ঘরে। রাত ১০টা পর্যন্ত গরাদের ভেতর-বাইরে তারা কোনো একজন ত্রাণকর্তার অপেক্ষা করছিল।
এই সময়ে কি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে খবর গিয়েছিল? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অথবা স্বরাষ্ট্রসচিবের কিছু করণীয় ছিল কি? মানবাধিকারকর্মী, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল যা করেছেন, তাঁদের উচিত ছিল সেই কাজটিই করা। তাহলে অন্তত আইন ও সরকারের কার্যকারিতার একটা নমুনা মিলত। কিন্তু মেলেনি। রাষ্ট্রের একক হলো পরিবার। পরিবার না টিকলে রাষ্ট্র টিকবে না। একটি পরিবার যেখানে বিপন্ন, সেই বিপন্নতার জন্য দায়ী যেখানে স্বয়ং রাষ্ট্র, সেখানে রাষ্ট্রীয় হর্তাকর্তাদের উদাসীনতা কি রাষ্ট্রের পক্ষে যায়?

সভ্যতার শেষ প্রহরীরা
আইনের রক্ষকের দায়িত্বে থাকা সরকার যেখানে আইনি সংস্থার আইনভঙ্গে বিচলিত হচ্ছে না, সেখানে নাগরিকদেরই নিজেদের অধিকার রক্ষায় এগিয়ে আসতে হয়। এত কথা হয়তো মেয়েটি ভাবেনি। সহজাত আত্মরক্ষার প্রবৃত্তির বশেই হয়তো মা ও মেয়ে করণীয় ঠিক করে। ঘটনা প্রবেশ করে দ্বিতীয় পর্বে। বিকেলের দিকে তারা থানা থেকে বেরিয়ে সেই আদালত চত্বরেই ফিরে আসে, যেখান থেকে তাদের দুর্ভাগ্যের শুরু হয়েছিল এবং যা নাকি ন্যায়বিচারের তীর্থভূমি। উপস্থিত সাংবাদিক ও আইনজীবীদের কাছে তারা ফরিয়াদ করে, তারা সাহায্য চায়। বেশ কয়েকজন সাংবাদিক এবং আইনজীবী তাঁদের ডাকে সাড়া দেন। দফায় দফায় মার খেয়েও এই সাংবাদিকদের বোধ হয় শিক্ষা হয়নি। তরুণ আইনজীবীদেরও হয়তো মনে পড়েছিল, আইনজীবিতা শুধু ব্যবসায় নয়, দায়িত্বও বটে। মেয়েটির পাশে দাঁড়িয়ে তাঁরা বোঝালেন, মানুষ আছে এখনো। সেই মানুষেরা সবাই ‘পুলিশ’ হয়ে যায়নি। ওদিকে পুলিশ তো জেনে গেছে, সাংবাদিক পেটালে কিছু হয় না। আইনজীবী পেটালে কিছু হয় না। তারা এবার সাংবাদিক-আইনজীবী পেটায় এবং মা-মেয়েসহ প্রতিবাদী আইনজীবী ও সাংবাদিকদের থানায় ধরে নিয়ে আটকে রাখে।
বাকি ঘটনাও সবার জানা। সুলতানা কামাল ছুটে আসেন, আটককৃতদের না নিয়ে থানা ছাড়বেন না বলে জেদ ধরেন এবং রাত পৌনে ১০টায় তাঁরা সবাই ছাড়া পান। অস্পষ্ট মুখের তরুণীর সাহসিকতায় যে করুণ নাটকের শুরু, সুলতানা কামালের অসাধারণ দায়িত্বনিষ্ঠায় তা উপসংহারে পৌঁছায়। এক নারীর প্রতিবাদ আর আরেক নারীর দায়িত্ব পালনে প্রমাণ হয়, মানবতার গতি করতে ঝুঁকি নিতে হয়।
এ অবস্থায় সাংবাদিক আর আইনজীবীদের দায়িত্ব অনেক বেড়ে যায়। সাংবাদিক কেবল সংবাদ সংগ্রাহক নন। জনগণের অংশ হয়ে থাকা, জনস্বার্থের পক্ষে থাকা আর সৎ থাকার দায় তাঁদের রয়েছে। কারণ, তাঁদের পেশাটাই অন্যায় ও মিথ্যার বিরুদ্ধে। তাঁরা ভীত হলে বা আপন গর্তে মুখ লুকালে দাপট আর মিথ্যাই জয়ী হবে। আইনকে মানুষের পক্ষে ধরে রাখার দায় আইনজীবীরাও এড়াতে পারেন না। নির্যাতিত মেয়েটির পাশে দাঁড়িয়ে, মার খেয়ে তাঁরা প্রমাণ করেছেন অসভ্যতার বিরুদ্ধে তাঁরাই সভ্যতার শেষ প্রহরী। এ কথাটি অনেক দিন আমরা ভুলে ছিলাম। ক্রমাগত মানবাধিকার লঙ্ঘনের তালিকায় নিহত বা আহত সাংবাদিকদের নাম যুক্ত হওয়ার এই বাস্তবতায় আর ভুলে থাকার সুযোগ নেই। যদি থাকি, তাহলেআমাদের ভূমিকা ছবির ওই কলাপসিবল গেটের শিকধরে দাঁড়িয়েথাকা মানুষগুলোর মতোই অথর্ব হয়ে যাবে।

কোথাও কেউ নেই?
এই ঘটনার একটি শিক্ষা আছে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গবেষক আকবর আলি খানের কথায় সেটাই উচ্চারিত হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় এক সভায় তিনি বলেছেন, ‘সর্বক্ষেত্রে নাগরিকদের সজাগ, সক্রিয় ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে, প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। না-হয় দুঃশাসন দেখা দেবে।’ নাগরিক নজরদারি, প্রতিবাদ ও নাগরিক সংহতি ছাড়া যে বাঁচা যায় না, অস্পষ্ট মুখের ওই মেয়েটি সেটাই জানিয়ে গেল। বুঝিয়ে দিল ভয়, নিরাপত্তাহীনতা আর দুঃশাসনই শেষ কথা নয়।
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন