সুকোমল বড়ুয়া | তারিখ: ০৬-০৫-২০১২
আজ থেকে আড়াই হাজার বছরেরও বেশি আগে, ৫৬৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে এমনি এক শুভ তিথিতে গৌতম বুদ্ধ পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন। বুদ্ধত্ব লাভ করেন ৫২৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে, তাঁর মহাপরিনির্বাণ ঘটে ৪৮৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। তাঁর জন্ম ও বুদ্ধত্ব লাভের মধ্য দিয়েই পৃথিবীর বুকে এমন একটি ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যার বাণী সম্পূর্ণ অহিংস ও মানবতাবাদী। বৌদ্ধধর্ম একটি বিশ্বজনীন অহিংস, মানবতাবাদী ধর্ম। এ ধর্মের বাণীগুলো মানবিক আবেদনে পরিপূর্ণ। মানবতা এবং মানবিক গুণাবলির বহিঃপ্রকাশই এই ধর্মের বিশেষত্ব।
শুরু থেকেই মানবকল্যাণে মহামতি বুদ্ধের কণ্ঠে মহাপ্রেমের মহাবাণী উৎসারিত হয়েছিল। বুদ্ধত্ব লাভের পর পঞ্চবর্গীয় শিষ্যদের তিনি বলেন, ‘হে ভিক্ষুগণ, বহুজনের হিতের জন্য, বহুজনের সুখ ও মঙ্গলের জন্য এমন ধর্ম প্রচার করো, যেই ধর্মের আদি, মধ্য এবং অন্তে কল্যাণ; সেই অর্থযুক্ত, ব্যঞ্জনযুক্ত পরিপূর্ণ, পরিশুদ্ধ ব্রহ্মচর্য প্রকাশিত করো।’
‘সকল প্রাণী সুখী হোক। ভয়হীন ও নিরুপদ্রব হোক।’ এই বাণী প্রথম ধ্বনিত হয়েছিল বুদ্ধের কণ্ঠে। সূত্রনিপাত গ্রন্থের মৈত্রীসূত্রে বলা হয়েছে: ‘সভয় বা নির্ভয়, হ্রস্ব বা দীর্ঘ, বৃহৎ বা মধ্যম, ক্ষুদ্র বা স্থূল, দৃশ্য অথবা অদৃশ্য, দূরে অথবা নিকটে যে সকল জীব জন্মগ্রহণ করেছে বা জন্মগ্রহণ করবে, সে সকল প্রাণী সুখী হোক।’
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বুদ্ধের দুটি বাণী বিশ্ববাসীকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট ও অনুপ্রাণিত করেছিল: মুক্তির জন্য ঈশ্বর বা পরনির্ভরশীল না হওয়া, এবং আত্মনির্ভরশীল হওয়া। তিনি তাঁর শিষ্যদের বলতেন, ‘হে ভিক্ষুগণ, তোমরা মুক্তির জন্য পরনির্ভরশীল হয়ো না, অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থেকো না, নিজেই নিজের প্রদীপ হও, নিজে নিজের শরণ গ্রহণ করো।’ এ বাণীর মধ্যেই রয়েছে সর্বজীবের মুক্তি ও কর্মস্বাধীনতার পূর্ণ আশ্বাস।
বুদ্ধের শিক্ষায় অধ্যাত্ম জীবনে মানুষের মুক্তির পাশাপাশি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও স্বাচ্ছন্দ্যবোধের কথাও গুরুত্ব পেয়েছে। সামাজিক মর্যাদা ও শিক্ষার গুরুত্বকে তিনি খাটো করে দেখেননি। তিনি জানতেন, প্রকৃত শিক্ষাই মানুষের মনকে বড় করে, ভালো-মন্দ বিচার করার শক্তি দেয়। তিনি মনে করতেন, ইন্দ্রিয়পরায়ণতা বা অতিরিক্ত ভোগলিপ্সা নির্বাণ লাভের অন্তরায়; তা থেকে দুঃখমুক্তি আসে না।
মহামানব বুদ্ধের বিশ্বজনীন মুক্তির ব্যাকুলতা এবং মানবতাবাদী ঐতিহ্য বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। আজ পৃথিবীব্যাপী ক্রোধ, সহিংসতা, জিঘাংসা, দুঃখ দেখলে মনে হয়, বুদ্ধের অহিংস বাণীর কত প্রয়োজন। বুদ্ধ চেয়েছিলেন মানবসমাজকে সর্ববিধ দুঃখের হাত থেকে উদ্ধার করতে। তিনি আন্তর্জাতিক, দেশ ও জাতির গণ্ডি অতিক্রম করে সমগ্র বিশ্বের মানুষের দুঃখ-বেদনার কথা ভেবেছিলেন। বুদ্ধের চিন্তাধারাকে প্রাচীনকালে ভারতীয় ও গ্রিক দার্শনিকেরা এবং পরবর্তীকালে রুশো, গান্ধী ও মাও জেদং স্বাগত জানিয়েছিলেন।
বুদ্ধ অধ্যাত্ম বা বৈরাগ্য জীবনের মুক্তির পাশাপাশি সামাজিক, রাষ্ট্রীয় এবং বিশ্বজনীন মুক্তি ও নিরাপত্তা চেয়েছিলেন। বস্তুত বুদ্ধের এই মুক্তিদর্শন আধ্যাত্মিক জগৎ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পূর্ণতাসহ জাগতিক সব প্রকার সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যকে পূর্ণ করে। তাই বিশ্বের সাম্যবাদীরা বুদ্ধের সমাজ ও অর্থনৈতিক মুক্তির এই চেতনাকে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। বুদ্ধ ধনবাদী তথা পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থাকে যেমন উৎসাহিত করেননি, তেমনি বর্ণ ও বৈষম্যবাদী সমাজকেও কখনো স্বাগত জানাননি। কারণ, বুদ্ধ জানতেন, ধনবাদ কিংবা পুঁজিবাদ কখনো মানুষের জীবনে সামগ্রিক সুখ আনতে পারে না। বুদ্ধ চেয়েছেন মধ্যম পন্থার মাধ্যমে ‘সকলের জন্য অধিক সুখ প্রতিষ্ঠা’।
বৌদ্ধসমাজ দর্শনে সাম্যবাদ, গণতন্ত্র এবং সব মানুষের ধর্মীয় অধিকারলাভ প্রভৃতি বিষয় বিশেষভাবে স্থান পেয়েছে। তাঁর জীবনদর্শনে চিন্তা ও মননের স্বাধীনতা, মুক্তবুদ্ধির চর্চা ও মূল্যবোধ বিকাশের সব বিষয় অমিত প্রেরণা জুগিয়েছে। তিনি সমাজের বহু আক্রান্ত মূল্যবোধকে বল্গাহীনভাবে দেখেননি। বুদ্ধ তাঁর জীবনদর্শনে ও শিক্ষামূলক আদর্শে অতিমানবিক বা অতিপ্রাকৃতিক জীবনকে গ্রহণ করেননি। তাঁর উন্নততর জীবনে অনাড়ম্বর ও বৈচিত্র্যহীন সংযত আচরণ, আদর্শ ব্যক্তিত্ব ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ও সংবেদনশীল বিনয়নীতি সামগ্রিক জীবনে বিশেষভাবে প্রত্যক্ষ করা যায়।
প্রকৃত জীবন গঠনের মানসে শীলের গুরুত্ব বৌদ্ধধর্মে সর্বত্র বা সংযত আচরণকে তিনি বিশেষভাবে প্রাধান্য দিয়েছেন। এ জন্য বৌদ্ধধর্মে পঞ্চশীলে আছে প্রাণীবধ বা হিংসা না করা, চৌর্যবৃত্তি না করা, মিথ্যা কথা না বলা, ব্যভিচার বা যৌনাচার না করা, কোনো প্রকার মাদকদ্রব্য সেবন না করা প্রভৃতি। এগুলো হলো সুন্দর আচরণবিধি, যা সৌজন্য, ভদ্রতা, মানবতা, সহিষ্ণুতা, পরোপকার, মার্জিত রুচি, দায়িত্ব-কর্তব্যবোধসহ সৃজনশীল কর্ম, সাম্য, মৈত্রী প্রভৃতি আদেশ-উপদেশের নির্দেশনা। এসব মানবিক গুণের অনুশীলনকে বুদ্ধ উৎসাহিত করেছেন। এসব গুণের সমাবেশেই একটি মানুষের জীবন যেমন সুন্দর ও পরিপূর্ণ হয়, তেমনি সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবনও জননীতি, জন-আদর্শে পরিপূর্ণ ও সমৃদ্ধিশালী হয়। অতএব, বুদ্ধের বহুমাত্রিক কল্যাণময়তা এভাবে মানবগোষ্ঠীকে মঙ্গলের পথে আসতে আহ্বান জানায়। বিশ্বশান্তি ও বিশ্বমানবতা গঠনে প্রেরণা জোগায়।
বৌদ্ধধর্ম বলছে, বিজ্ঞানের আবিষ্কার আপাতদৃষ্টিতে সুখ-সমৃদ্ধময় মনে হলেও মানব কিংবা জীবকুলকে জরা, ব্যাধি, মৃত্যু থেকে মুক্তি দিতে পারেনি। তাই বুদ্ধ বলেন, ‘আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গের মতো আর কোনো মার্গ নেই; চতুরার্য্যের সমান আর কোনো সত্য নেই।’ কিন্তু বিজ্ঞানের সঙ্গে বৌদ্ধধর্মের কোনো বিরোধ নেই। বরং বৌদ্ধধর্ম সত্যিকার অর্থে বিজ্ঞানসম্মত ধর্ম। তবে ভোগবাদী বিজ্ঞান ও লোকোত্তর বিজ্ঞানের মধ্যে বেশ পার্থক্য রয়েছে। ভোগবাদী বিজ্ঞান মানুষকে অমঙ্গলের পথে নিয়ে যায়। ভোগবাদী বিজ্ঞানের অপব্যবহারের ফলে আজ বিশ্বে যুদ্ধ, আণবিক বোমা ও মারণাস্ত্র ব্যবহূত হচ্ছে। এগুলো বিশ্বশান্তির হাতিয়ার হতে পারে না।
মহামতি বুদ্ধের মতো আজ চিকিৎসাবিজ্ঞানীরাও বলছেন, মানুষের দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনা, হিংসা-বিদ্বেষ থেকেই মারাত্মক ব্যাধির সৃষ্টি হয়। এ জন্য বুদ্ধ লোভ-লালসাহীন ভাবনার কথা বলেছেন; উদগ্র কামনা-বাসনাপূর্ণ ভাবনা ত্যাগ করতে বলেছেন। এতেই মানুষের প্রকৃত মানসিক শান্তি আসতে পারে।
পৃথিবীর মানুষ আজ যুদ্ধ, হানাহানি, রক্তপাতের ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কাও কাজ করে, শঙ্কা হয় পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের। কেন? বৌদ্ধদর্শনে এর উত্তর পাওয়া যায় অতি সহজে। বুদ্ধ বলেন, ক্রোধ, লোভ, দ্বেষ, মোহ, কামনা-বাসনা থেকেই এসব অশান্তি এবং যুদ্ধবিগ্রহের উদ্ভব। লোভ, দ্বেষ ও ক্রোধের বশবর্তী হয়ে পরস্পরের প্রতি যুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছি। একে অপরকে আক্রমণ করে চলেছি। একে অন্যকে ধ্বংস করার জন্য প্রবৃত্ত হচ্ছি। এটা ব্যক্তিজীবনকে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত করে, তেমনি ক্ষতিগ্রস্ত করে দেশ তথা গোটা বিশ্বকে। ক্ষোভ বা ক্রোধের বশবর্তী হয়ে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া যায় সত্যি; কিন্তু এর ভয়াবহ পরিণতি যে গোটা বিশ্বের নিরীহ মানুষকে দিতে হয়, সেই বোধ যুদ্ধবাজ শাসকদের নেই। যারা এমন চরিত্রের, তাদের উদ্দেশে বুদ্ধের বাণী এ রকম: ‘যুদ্ধক্ষেত্রে হাজার হাজার যোদ্ধাকে পরাস্ত করা বড় কথা নয়, যে নিজেকে অর্থাৎ নিজের রিপুসমূহকে দমন করতে পেরেছে, সেই প্রকৃত জয়ী।’
আমরা অন্যকে জয় করতে চাই বিভিন্ন শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে। অথচ আমাদের মেধা ও প্রজ্ঞা দিয়ে নিজেকে জয় করতে চাই না। এর চেয়ে অগৌরবের বিষয় আর কী হতে পারে? যুদ্ধ মানবসভ্যতার এক অভিশাপ। মানুষের মেধার আবিষ্কার মানুষকে হত্যা করার জন্য নয়, মানবজাতিকে ধ্বংস করার জন্য নয়। সম্রাট অশোক বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করার আগে কলিঙ্গ যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন। সেই যুদ্ধের ভয়াবহতা তাঁর মনকে দারুণভাবে আহত করেছিল। বুদ্ধের অমৃতবাণী তাঁর অশান্ত হূদয়ে শান্তির বারতা এনেছিল। বুদ্ধের বাণীটি ছিল এ রকম: ‘অপ্রমাদ অমৃতের পথ, প্রমাদ মৃত্যুর পথ। অপ্রমাদীরা অমর, যাঁরা প্রমত্ত তাঁরা মৃতের ন্যায়।’ মহামতি বুদ্ধের এ রকম মানবতাবাদী মতবাদ ও অহিংসনীতি বিশ্বের সব মানবগোষ্ঠীকে এক অভিন্ন বিশ্বমৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ হতে উজ্জীবিত করে।
হিংসা, হানাহানি, ষড়যন্ত্র, এমনকি পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কার অস্থির এই একুশ শতকে বুদ্ধের বাণী আগের চেয়েও বেশি প্রাসঙ্গিক।
‘সব্বে সত্তা সুখীতা ভবন্তু’—বিশ্বের সকল জীব সুখী হোক। সকলেই মঙ্গল লাভ করুক। বাংলাদেশ সমৃদ্ধময় হোক। বিশ্বে শান্তি বিরাজ করুক। ‘নিব্বানং পরমং সুখং’—নির্বাণ পরম সুখ, নির্বাণ পরম শান্তি।
ড. সুকোমল বড়ুয়া: সভাপতি, বিশ্ব বৌদ্ধ ফেডারেশন, বাংলাদেশ চ্যাপ্টার।
sukomalbaruapalidu@gmail.com
বুদ্ধপূর্ণিমা ও বুদ্ধবাণীর তাৎপর্য
দিলীপ কুমার বড়ুয়া
আজ শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা। জন্ম, বুদ্ধত্বলাভ এবং মহাপরিনির্বাণ (মৃত্যু)—বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তক মহামানব গৌতম বুদ্ধের জীবনে এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে সংঘটিত হয়েছিল। তাই বৈশাখী পূর্ণিমাকে বুদ্ধপূর্ণিমাও বলা হয়। বিশ্ব বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর কাছে দিনটির আবেদন অনন্যসাধারণ।
সিদ্ধার্থ গৌতম ছিলেন রাজপুত্র। সর্বজীবের মঙ্গল ও দুঃখ থেকে মুক্তির পথ অন্বেষণের জন্য পরিবার-পরিজন, রাজপ্রাসাদের বিলাসী জীবন, স্ত্রী-পুত্র, পিতা-মাতা ও রাজসিংহাসনের মায়া ত্যাগ করে তিনি পথে নেমেছিলেন। সুদীর্ঘ ছয় বছর কঠোর সাধনায় লাভ করেন বোধি, খ্যাত হন বুদ্ধ নামে। আবিষ্কার করেন চার আর্য সত্য: জগতে দুঃখ আছে, দুঃখের কারণ আছে, দুঃখের নিরোধ আছে এবং দুঃখ নিরোধের উপায় আছে। দুঃখ নিরোধের উপায় হিসেবে তিনি নির্দেশ করেন আটটি অঙ্গসমন্বিত পথ আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ: সৎ দৃষ্টি, সৎ সংকল্প, সৎ বাক্য, সৎ ব্যবহার, সৎ জীবিকা, সৎ প্রচেষ্টা, সৎ চিন্তা এবং সাধু ধ্যানে চিত্তকে নিবিষ্ট করা। এ পথই শান্তির পথ। এ ছাড়া তিনি আবিষ্কার করেন জন্ম, মৃত্যু ও দুঃখের কারণ প্রতীত্যসমুৎপাদ তত্ত্ব। এ তত্ত্বের মূল নীতি হলো: ওটা থাকলে এটা হয়, ওটার উৎপত্তিতে এটার উৎপত্তি, ওটা না থাকলে এটা হয় না, ওটার নিরোধে এটার নিরোধ হয়।
এই তত্ত্ব অনুযায়ী, পৃথিবীর সবকিছুই কার্যকারণ শৃঙ্খলে আবদ্ধ এবং শর্তসাপেক্ষ। জড়জগৎ ও মনোজগৎ—নীতির দ্বারা পরিশাসিত হয়। ১০টি কারণে জন্ম, মৃত্যু ও দুঃখের সৃষ্টি হয়। তাই প্রতীত্যসমুৎপাদ তত্ত্বকে দ্বাদশ নিদানও বলা হয়। এসব নিদান বা কারণ হচ্ছে: ১. অবিদ্যা ২. সংস্কার ৩. বিজ্ঞান ৪. নাম-রূপ ৫. ষড়ায়তন ৬. স্পর্শ ৭. বেদনা বা অনুভূতি ৮. তৃষ্ণা ৯. উপাদান ১০. ভব বা উৎপত্তি ১১. এবং ১২. জন্ম, জরা, ব্যাধি, দুঃখ ইত্যাদি। এই ১২টি কারণ শর্ত সাপেক্ষে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। একটির কারণে অপরটি উৎপন্ন হয়, একটির নিরোধে অপরটির নিরোধ হয়। এই তত্ত্ব বিশ্লেষণে দেখা যায়, অবিদ্যার কারণে সংস্কার, সংস্কারের কারণে বিজ্ঞান, বিজ্ঞানের কারণে নাম-রূপ, নাম-রূপের কারণে ষড়ায়তন, ষড়ায়তনের কারণে স্পর্শ, স্পর্শের কারণে বেদনা, বেদনার কারণে তৃষ্ণা, তৃষ্ণার কারণে উপাদান, উপাদানের কারণে ভব, ভবের কারণে জন্ম এবং জন্মের কারণে মানুষ জরা, ব্যাধি, মৃত্যু, অপ্রিয়সংযোগ, প্রিয়বিচ্ছেদ, ঈপ্সিত বস্তুর অপ্রাপ্তিজনিত দুঃখ প্রভৃতি ভোগ করে। বর্ণিত কারণসমূহ একটির কারণে অপরটির ধ্বংস হয়। ফলে অবিদ্যা বিদূরিত হলে সংস্কার বিদূরিত হবে, এমনিভাবে জন্ম নিরোধ করা গেলে জরা, ব্যাধি এবং মৃত্যু-দুঃখ নিরোধ হবে।
বুদ্ধ উপর্যুক্ত দর্শন এমন একসময় প্রচার করেছিলেন, যখন প্রাচীন ভারতের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী জাতিভেদ প্রথার নিগড়ে আবদ্ধ, অসাম্য-অনাচার সর্বস্বতার দ্বারা দারুণভাবে বিপর্যস্ত, ধর্মীয় অধিকার থেকে বঞ্চিত এবং বিশ্বাসরূপী সংস্কারের বেড়াজালে শৃঙ্খলিত ছিল। তিনি মানুষকে কোনো প্রকার বন্ধনে আবদ্ধ করেননি, বিশ্বাসরূপী শৃঙ্খল দ্বারাও বাঁধেননি। অধিকন্তু দিয়েছিলেন বুদ্ধি ও বিবেকের স্বাধীনতা। তাই তিনি নিজেকে ত্রাণকর্তা হিসেবে উপস্থাপন করেননি। বরং উপস্থাপিত হয়েছেন পথপ্রদর্শক হিসেবে। তাঁর উপদেশ ছিল ‘নিজের দীপ প্রজ্বলিত করে নিজেই নিজের মুক্তির পথ পরিষ্কার করো, অন্যের ওপর নির্ভর কোরো না।’
বুদ্ধ কখনো জন্মকে প্রাধান্য দেননি, প্রাধান্য দিয়েছেন কর্মকে। তাই তাঁকে বলতে দেখি, ‘জন্মের দ্বারা কেউ চণ্ডাল হয় না, কর্মের দ্বারাই চণ্ডাল হয়।’ তাঁর ধর্ম কর্মপ্রধান, আপনি আচরি ধর্ম, অনুশীলন ও মননের ধর্ম। এ ধর্মে অদৃষ্টবাদ ও বাহ্যিক আড়ম্বরতার কোনো স্থান নেই। যে যেরূপ কর্ম করবে, সে সেরূপ ফল ভোগ করবে। নৈতিকতা এ ধর্মের অন্যতম আদর্শ। সমগ্র ত্রিপিটক অধ্যয়ন করলেও বৌদ্ধ হওয়া যায় না, যদি না তার নৈতিক চরিত্রের দৃঢ়তা থাকে। বুদ্ধ বলেছেন, ‘তিনিই প্রকৃত বৌদ্ধ (ভিক্ষু), যাঁর চিত্ত বিশুদ্ধ, নৈতিকতায় প্রোজ্জ্বল, লোভ-দ্বেষ-মোহ হতে মুক্ত এবং সত্যদৃষ্টি বা প্রজ্ঞার ওপর প্রতিষ্ঠিত।’
একজন বৌদ্ধকে অশুভ কর্ম থেকে বিরত থাকতে হবে, বিরত থাকতে অন্যকে উৎসাহিত বা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করতে হবে। অপর দিকে শুভ বা মঙ্গলজনক কর্ম করতে হবে এবং অপরকেও উৎসাহিত করতে হবে। অশুভ কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য বৌদ্ধদের শীল পালন করতে হয়। তন্মধ্যে প্রধান পাঁচটি শীল পঞ্চশীল নামে পরিচিত। এই পাঁচটি শীল হচ্ছে: ১. প্রাণী হত্যা থেকে বিরত থাকা ২. অদত্ত বস্তু গ্রহণ না করা বা চুরি না করা ৩. ব্যভিচার থেকে বিরত থাকা ৪. মিথ্যাচার থেকে বিরত থাকা এবং ৫. মাদকদ্রব্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকা। পৃথিবীতে সব দুঃখ, অশান্তি, অন্যায় ও উপদ্রবের মূলে আছে এই পাঁচটি অপকর্ম। হত্যা, চুরি, ব্যভিচার ও মাদক সেবন—বর্তমান বিশ্বের বিরাট সমস্যা। এই সমস্যা মানুষকে শঙ্কিত করে তুলেছে। সভ্যতাকে করছে বিপন্ন। অথচ বুদ্ধ নির্দেশিত পঞ্চশীল এবং আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ অনুশীলন করলে সহজেই এই সমস্যা থেকে মুক্তি লাভ করা যায়। বুদ্ধ ব্যক্তিজীবনের উৎকর্ষের মধ্য দিয়ে সামাজিক উৎকর্ষ সাধন করতে চেয়েছিলেন। বুদ্ধের চিন্তা-চেতনার কেন্দ্রে ছিল মানুষ। অধিবিদ্যাসংক্রান্ত বিষয়ে তিনি নির্লিপ্ত থাকতেন। জগৎ শাশ্বত না অশাশ্বত, ধ্রুব না অধ্রুব এসব অধিবিদ্যাসংক্রান্ত প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলতেন, ‘কোনো ব্যক্তি শরাহত হলে আগে সেবা দিয়ে তাকে সুস্থ করে তোলা উচিত, নাকি কে শরটি নিক্ষেপ করল, কোন্ দিক থেকে শরটি এল প্রভৃতি আগে অনুসন্ধান করা উচিত? জগৎ-সংসার দুঃখের ফণায় বিকীর্ণ, জরাতরঙ্গে উদ্বেল এবং মৃত্যুর উগ্রতায় ভয়ংকর। এসব প্রশ্নের চেয়ে দুঃখ থেকে মুক্তি লাভের চেষ্টা ও উপায় অনুসন্ধান করাই উত্তম।’ মানুষের দুঃখমুক্তিই ছিল তাঁর অভীপ্সা। সমাজ যাদের পতিত হিসেবে উপেক্ষা করেছে, তিনি তাদের উপেক্ষা করেননি। তিনি পতিতকে টেনে তুলে, পথভ্রান্তকে পথ প্রদর্শন করে সমাজে মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবাইকে তাঁর ধর্মে স্থান দিয়ে তিনি মনুষ্যত্বের জয়গান করেছেন। তিনি নিজেকে এবং তাঁর ধর্মকে সামপ্রদায়িকতার গণ্ডি ও সংকীর্ণতার মধ্যে আবদ্ধ রাখেননি। তাঁকে বলতে দেখি, ‘গঙ্গা, যমুনা... প্রভৃতি নদী যেমন সাগরে মিলিত হয়ে নাম হারিয়ে ফেলে, তেমনি ব্রাহ্মণ, বৈশ্য, শূদ্র, ক্ষত্রিয়, চণ্ডাল প্রভৃতি আমার ধর্মে প্রবেশ করে নাম হারিয়ে ফেলে, এখানে সকল মানুষ এক।’ বুদ্ধ প্রতিষ্ঠিত সংঘে বিভিন্ন শ্রেণী ও সমপ্রদায়ের লোক ছিল, যারা আপন মহিমা ও কৃতিত্বে সংঘের মধ্যে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত ছিল। তাঁর সর্বজনীন বাণীর সুধারস বারাঙ্গনার জীবনকেও পঙ্কিলতামুক্ত করেছিল।
বিশ্বের সব প্রাণীর প্রতি মৈত্রী ও করুণা প্রদর্শন তাঁর প্রচারিত ধর্মের অনন্য দিক। তাঁর অমৃত বাণী বিশ্বের ক্ষুদ্রতম প্রাণী থেকে বৃহত্তম প্রাণীকে পর্যন্ত রক্ষার প্রেরণা জোগায়। তাঁর হাতে ছিল মানবপ্রেমের বাঁশরি, কণ্ঠে ছিল মৈত্রী ও করুণার অমৃত বাণী এবং লক্ষ্য ছিল সত্য ও ন্যায়ের ধর্ম বিতরণ। তাঁকে বলতে দেখি, ‘সাধক ভিক্ষু! মৈত্রীপূর্ণ চিত্তে সকল প্রাণীর প্রতি অপ্রমেয় মৈত্রীভাব পোষণ করবে। মাতা যেমন তার একমাত্র পুত্রকে নিজের জীবন দিয়ে রক্ষা করে, সেরূপ সকল প্রাণীর প্রতি মৈত্রী ও ভালোবাসা প্রদর্শন করবে। কাউকে আঘাত কোরো না। শত্রুকে ভালোবাসা দিয়ে আপন করে নেবে।’ বিশ্বের সকল প্রাণীর প্রতি বুদ্ধের মমত্ববোধ সর্বকালের মানুষের মনে এক গভীর আবেদন সৃষ্টি করেছে। এই মহামন্ত্রে দীক্ষা নিয়ে সম্রাট অশোক সম্যকভাবে উপলব্ধি করেছিলেন, ‘রাজ্য জয়, যুদ্ধ, নিপীড়ন, যাগযজ্ঞ-বলি সত্যিকারের ধর্ম হতে পারে না।’ তাই তিনি হিংসানীতি পরিহার করে মৈত্রী-ভালোবাসার নীতি গ্রহণের মাধ্যমে রাজ্যজয়ের পরিবর্তে ধর্মজয়ের পথ গ্রহণ করেছিলেন। বুদ্ধের প্রচারিত ধর্মের বিশেষত্ব হলো মৈত্রীভাবনা, যা বৌদ্ধমাত্রই অত্যাবশ্যকভাবে পালনীয়। মৈত্রীভাবনার মূল মন্ত্র হলো: ‘সকল প্রাণী সুখী হোক, শত্রুহীন হোক, অহিংসিত হোক, সুখে কাল যাপন করুক।’
মানুষ আজ ধ্বংসাত্মক খেলায় মত্ত। সমগ্র বিশ্বে আজ সংঘাত, সন্ত্রাস, পারস্পরিক অবিশ্বাস, সমপ্রদায় ও জাতিগত ভেদাভেদ এক ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। পারস্পরিক সমঝোতার অভাবে পাশাপাশি রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে চলছে যুদ্ধের প্রস্তুতি। ইতিপূর্বে অনেক যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। তাতে জাতিগত লাভ হয়নি কিছুই। বরং সভ্যতা ও সংস্কৃতি হয়েছে বিপন্ন। শান্তিকামী মানুষ আর যুদ্ধ চায় না, সামপ্রদায়িক ও জাতিগত ভেদাভেদ চায় না। শান্তি চায়। শান্তি চায়। শান্তি চায়।
আজকের এই শুভ বুদ্ধপূর্ণিমা দিবসে আমাদের প্রত্যাশা—শান্তির জয়গানে ভরে উঠুক বিশ্ব। ‘সকল প্রাণী সুখী হোক’।
ড. দিলীপ কুমার বড়ুয়া: অধ্যাপক, চেয়ারম্যান, পালি অ্যান্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
বুদ্ধের শিক্ষায় শান্ত হোক পৃথিবী
বিমান চন্দ্র বড়ুয়া
হাজার বছরের পবিত্রতা ও মানবমুক্তির বার্তা নিয়ে আবারও ফিরে এল পবিত্র বুদ্ধপূর্ণিমা। পৃথিবীতে নতুন অরুণোদয়ে আবারও যোগ হলো একটি বুদ্ধ নববর্ষ। পৃথিবীব্যাপী বুদ্ধের নীতি ও আদর্শ সামনে রেখে, বুদ্ধের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা উদ্যাপন করছেন পবিত্র বুদ্ধপূর্ণিমা। এটি সমগ্র পৃথিবীর বৌদ্ধদের কাছে সর্ববৃহৎ পবিত্র ও পুণ্যময় ধর্মীয় উৎসব।
আড়াই হাজার বছরেরও বেশি আগে বুদ্ধ যে জীবনকে তুচ্ছ মনে করে ফেলে গিয়েছিলেন, সেই তুচ্ছ জীবন আজ অনেক বড় হয়ে উঠেছে সুখপ্রত্যাশীদের কাছে। বুদ্ধের জীবনপ্রবাহে কোনো রকম উত্তেজনা ছিল না। কোনো রকম আরাম-আয়েশ ছিল না। কোনো রকম মোহ ছিল না। অলৌকিক ক্ষমতার বিকাশ ছিল না। তিনি অন্ধকারদর্শী ধর্মের জগৎ থেকে মানুষকে সৎ, ন্যায় ও বাস্তবতার পথ প্রদর্শন করছিলেন। মানুষের অধিকারের প্রতি বুদ্ধ সজাগ ছিলেন। এখন প্রশ্ন জাগে, প্রাচীন ভারত তাহলে কি ধর্মদর্শনে সমৃদ্ধ ছিল না? সমৃদ্ধ ছিল বটে। কিন্তু বর্ণবৈষম্য, জাত-পাতের ভেদাভেদ, ছুঁতমার্গের প্রাবল্যে ভেসে চলা ভারতকে একমাত্র জাগ্রত হওয়ার পথে নিয়ে এলেন বুদ্ধ নিজেই। বুদ্ধ বলেন, ‘গঙ্গা, যমুনা...প্রভৃতি বড় নদী বিভিন্ন দিক থেকে উৎপন্ন হয়েও যেমন সমুদ্রে মিলে গিয়ে তাদের স্বতন্ত্র সত্তা হারিয়ে ফেলে, তেমনি ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র প্রভৃতি তাঁর ধর্মে এসে জাতি ও গোত্র হারিয়ে ফেলে।’ এখানে তদানীন্তন জাতিভেদ প্রথার মূলে তিনি কুঠারাঘাত করে প্রচলন করেছিলেন সাম্যনীতির। তিনি নারী-পুরুষ সবাইকে এক করে দেখছেন। নারীও যে সাধনার মাধ্যমে পুরুষের সমকক্ষ হতে পারেন, তা-ও তিনি বলেছিলেন। তাঁর ধর্মে অস্পৃশ্য পতিতা, নিপীড়িত নারী যেমন আছেন, তেমনি রয়েছে ধনী-গরিব, উঁচু-নিচু সবার সহাবস্থান।
বুদ্ধের ধর্ম মানবকল্যাণের ধর্ম। জীবনকে সুন্দর পথে, পরিশুদ্ধতার পথে, শান্তির পথে এবং মনকে পবিত্র করার জন্য রয়েছে বুদ্ধের নীতিমালা। এগুলো পরিপালনের মাধ্যমে মানুষ পারিবারিক জীবনে, সামাজিক জীবনে, সর্বোপরি রাষ্ট্রীয় জীবনে সুখ ও শান্তির পরশ পাবে। বর্তমান বিশ্বে চলছে হিংসা, প্রতিহিংসা, ঘৃণা ও নিষ্ঠুর অমানবিক কার্যকলাপ। ফলে লোভ, দ্বেষ এবং মোহ আশ্রিত প্রদুষ্ট চিত্তের জগতে সৃষ্টি হচ্ছে নিন্দিত ও গর্হিত অমানবিক কার্যাবলি যুদ্ধ, সংঘাত মারামারি, সন্ত্রাস ইত্যাদি। আধুনিক সভ্যতার মধ্যে যে নৈতিক অবক্ষয় দেখা যাচ্ছে, তাতে বুদ্ধবাণী মূল্যায়নের সময় এসেছে। প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য যে সংঘাত হচ্ছে প্রতিনিয়ত, তাতে অশান্তি ক্রমেই বেড়ে চলেছে। বুদ্ধ বলেন, ‘শত্রুতার দ্বারা কখনো শত্রুতার উপশম হয় না। মিত্রতার দ্বারাই শত্রুতার উপশম হয়।’
বুদ্ধ সত্য ও সুন্দর জীবনযাপনের ক্ষেত্রে নিজেকেই সর্বাগ্রে স্থান দিয়েছেন। প্রত্যেক মানুষের মধ্যে যে আত্মশক্তি রয়েছে, সেই শক্তির বিকাশ সাধনের কথা বলেছেন বুদ্ধ। তিনি বলেন, ‘নিজেই নিজের উদ্ধার সাধন করো। নিজেই নিজেকে পরীক্ষা করো। মানুষ নিজেই নিজের প্রভু, নিজেই নিজের আশ্রয়। বণিক যেমন তার সুন্দর অশ্বকে বশে রাখে, তুমিও সেরূপ নিজেকে বশে রাখো।’ তিনি আরও বলেন, ‘অন্যের শরণ নিয়ে লাভ নেই। নিজের শরণ নাও, নিজেকে আত্মদীপ করে জ্বালিয়ে তোলো।’ একাকী পথচলার সময় পায়ে কাঁটা বিদ্ধ হলে তা পথিককেই তুলে নিতে হবে। এগুলো কালজয়ী বাণী।
সর্বকালকে অতিক্রম করতে সক্ষম এ বাণী। এগুলোই মানুষকে সঠিক পথের সন্ধান দিতে পারে। নব নব চেতনায় জাগ্রত করে তুলতে পারে সমাজের বিবেকবান প্রতিটি মানুষকে। সুতরাং মানুষকে লোভ, দ্বেষ ও মোহের আবর্ত থেকে বেরিয়ে আসার জন্য নিজের প্রচেষ্টার প্রয়োজন। জীবনে সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য আপন শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। মহান বুদ্ধ সেই আপন শক্তিকে কাজে লাগিয়ে প্রকৃতির কোলে বুদ্ধগয়ার বোধিবৃক্ষমূলে গভীরভাবে ধ্যানস্থ হয়েছিলেন। এ সময় তিনি চরম সত্যকে আলিঙ্গন করেছিলেন। এখানে তিনি ইতিহাসকে গৌরবান্বিত করেছেন। আর ভারতকে করেছেন মহিমামণ্ডিত। তিনি মহাসত্যের জন্য দুস্তর পথ পাড়ি দিলেন। নির্বাণ লাভের আনন্দে অবগাহন করলেন।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন প্রান্তে, বিভিন্ন ভাষায় অগণিত মানুষ বুদ্ধকে স্মরণ করেন। কিছুই না হোক, শৌর্য, বীর্য, প্রাজ্ঞতা এবং অন্ধকার থেকে সরে আসার জন্য তাঁর প্রার্থনা একান্তই অপরিহার্য। প্রতিনিয়ত মানুষ বিজ্ঞানসম্মত, যুক্তিবাদী ও বুদ্ধিবৃত্তিক কথায় বিশ্বাসী। জ্ঞানীমাত্রই কোনো কিছু স্বীকার করতে হলে ভাবের আবেগ অপেক্ষা যুক্তির আশ্রয় নেন। বুদ্ধের শিক্ষার অন্যতম উপাদান যুক্তিবিচারের মাধ্যমে পথচলা। তিনি অন্ধভাবে কোনো কিছু গ্রহণ বা বিশ্বাস করতে বলেননি।
অনৈক্য পরাজয়ের কারণ। প্রত্যেক মানুষের স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশের অধিকার রয়েছে। এই গণতান্ত্রিক অধিকার যখনই বাধাগ্রস্ত হয়, সেখানেই দেখা দেয় অসন্তোষ। বুদ্ধ তাঁর প্রবর্তিত সংঘে গণতান্ত্রিক নিয়ম চালু করেছিলেন। বুদ্ধের সময়ে রাজা অজাতশত্রু প্রথম দিকে বৈশালীর লিচ্ছবীদেরকে পরাজিত করতে পারেননি। কারণ, তারা গণতন্ত্রের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধা দেখাত আর ঐক্যবদ্ধভাবে তা পালন করত। বুদ্ধভাষিত সপ্ত অপরিহানীয় নীতির মধ্যে দুটি নীতিতেই গণতন্ত্রের উল্লেখ রয়েছে। যেমন: ক. সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কর্মসূচি নির্ধারণ করা এবং খ. নির্ধারিত কর্মসূচি সম্মিলিতভাবে সম্পাদন করা। সমাজ, সংগঠন, রাষ্ট্রে যত দিন গণতন্ত্র ও ঐক্য বজায় থাকবে, তত দিন তাদের কোনো রকম পরাজয় হবে না।
আজ পৃথিবীতে আবার খুব প্রয়োজন হয়ে পড়েছে বুদ্ধের মানবতার, বিনয় (নিয়মনীতি), সাম্য, মৈত্রী, করুণা, মুদিতা, উপেক্ষা, ত্যাগ, উদারতার। বুদ্ধ যে পথ প্রদর্শন করেছিলেন—লোভান্ধ, দ্বেষান্ধ, মোহান্ধ ও ক্রোধান্ধ মানুষ আজ তা থেকে অনেক অনেক দূরে। মানুষ যদি নিজের আশ্রয় কোনো অন্ধকারের পরিবর্তে আলোকশিখায় দৃশ্যমান হয়, তবে তাকে সে মানবে না—এমন কথা কখনো বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না। বুদ্ধের অনির্বাণ চেতনা অন্তরে জাগ্রত করার মাধ্যমে মানুষ পেতে পারে অমৃতের সন্ধান। অন্তরের ক্রোধ ও রিপুগুলোকে জয় করা সভ্যতার জন্য খুবই অপরিহার্য। এটা আমরা সবাই বুঝতে পারলেও জয় করতে পারি না কখনো। এ জন্য শান্ত পৃথিবীর স্বার্থে ও অহিংসাময় সমাজব্যবস্থার স্বার্থে বুদ্ধেরই প্রয়োজন; প্রয়োজন তাঁর শিক্ষার একান্ত অনুশীলন; প্রয়োজন তাঁর শান্তির অমৃত নিধির অন্বেষণ—প্রকৃতপক্ষে তাঁর যথার্থ অনুসরণ।
বিমান চন্দ্র বড়ুয়া: সহযোগী অধ্যাপক, পালি অ্যান্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং একাডেমিক কাউন্সিলর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
শুরু থেকেই মানবকল্যাণে মহামতি বুদ্ধের কণ্ঠে মহাপ্রেমের মহাবাণী উৎসারিত হয়েছিল। বুদ্ধত্ব লাভের পর পঞ্চবর্গীয় শিষ্যদের তিনি বলেন, ‘হে ভিক্ষুগণ, বহুজনের হিতের জন্য, বহুজনের সুখ ও মঙ্গলের জন্য এমন ধর্ম প্রচার করো, যেই ধর্মের আদি, মধ্য এবং অন্তে কল্যাণ; সেই অর্থযুক্ত, ব্যঞ্জনযুক্ত পরিপূর্ণ, পরিশুদ্ধ ব্রহ্মচর্য প্রকাশিত করো।’
‘সকল প্রাণী সুখী হোক। ভয়হীন ও নিরুপদ্রব হোক।’ এই বাণী প্রথম ধ্বনিত হয়েছিল বুদ্ধের কণ্ঠে। সূত্রনিপাত গ্রন্থের মৈত্রীসূত্রে বলা হয়েছে: ‘সভয় বা নির্ভয়, হ্রস্ব বা দীর্ঘ, বৃহৎ বা মধ্যম, ক্ষুদ্র বা স্থূল, দৃশ্য অথবা অদৃশ্য, দূরে অথবা নিকটে যে সকল জীব জন্মগ্রহণ করেছে বা জন্মগ্রহণ করবে, সে সকল প্রাণী সুখী হোক।’
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বুদ্ধের দুটি বাণী বিশ্ববাসীকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট ও অনুপ্রাণিত করেছিল: মুক্তির জন্য ঈশ্বর বা পরনির্ভরশীল না হওয়া, এবং আত্মনির্ভরশীল হওয়া। তিনি তাঁর শিষ্যদের বলতেন, ‘হে ভিক্ষুগণ, তোমরা মুক্তির জন্য পরনির্ভরশীল হয়ো না, অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থেকো না, নিজেই নিজের প্রদীপ হও, নিজে নিজের শরণ গ্রহণ করো।’ এ বাণীর মধ্যেই রয়েছে সর্বজীবের মুক্তি ও কর্মস্বাধীনতার পূর্ণ আশ্বাস।
বুদ্ধের শিক্ষায় অধ্যাত্ম জীবনে মানুষের মুক্তির পাশাপাশি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও স্বাচ্ছন্দ্যবোধের কথাও গুরুত্ব পেয়েছে। সামাজিক মর্যাদা ও শিক্ষার গুরুত্বকে তিনি খাটো করে দেখেননি। তিনি জানতেন, প্রকৃত শিক্ষাই মানুষের মনকে বড় করে, ভালো-মন্দ বিচার করার শক্তি দেয়। তিনি মনে করতেন, ইন্দ্রিয়পরায়ণতা বা অতিরিক্ত ভোগলিপ্সা নির্বাণ লাভের অন্তরায়; তা থেকে দুঃখমুক্তি আসে না।
মহামানব বুদ্ধের বিশ্বজনীন মুক্তির ব্যাকুলতা এবং মানবতাবাদী ঐতিহ্য বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। আজ পৃথিবীব্যাপী ক্রোধ, সহিংসতা, জিঘাংসা, দুঃখ দেখলে মনে হয়, বুদ্ধের অহিংস বাণীর কত প্রয়োজন। বুদ্ধ চেয়েছিলেন মানবসমাজকে সর্ববিধ দুঃখের হাত থেকে উদ্ধার করতে। তিনি আন্তর্জাতিক, দেশ ও জাতির গণ্ডি অতিক্রম করে সমগ্র বিশ্বের মানুষের দুঃখ-বেদনার কথা ভেবেছিলেন। বুদ্ধের চিন্তাধারাকে প্রাচীনকালে ভারতীয় ও গ্রিক দার্শনিকেরা এবং পরবর্তীকালে রুশো, গান্ধী ও মাও জেদং স্বাগত জানিয়েছিলেন।
বুদ্ধ অধ্যাত্ম বা বৈরাগ্য জীবনের মুক্তির পাশাপাশি সামাজিক, রাষ্ট্রীয় এবং বিশ্বজনীন মুক্তি ও নিরাপত্তা চেয়েছিলেন। বস্তুত বুদ্ধের এই মুক্তিদর্শন আধ্যাত্মিক জগৎ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পূর্ণতাসহ জাগতিক সব প্রকার সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যকে পূর্ণ করে। তাই বিশ্বের সাম্যবাদীরা বুদ্ধের সমাজ ও অর্থনৈতিক মুক্তির এই চেতনাকে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। বুদ্ধ ধনবাদী তথা পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থাকে যেমন উৎসাহিত করেননি, তেমনি বর্ণ ও বৈষম্যবাদী সমাজকেও কখনো স্বাগত জানাননি। কারণ, বুদ্ধ জানতেন, ধনবাদ কিংবা পুঁজিবাদ কখনো মানুষের জীবনে সামগ্রিক সুখ আনতে পারে না। বুদ্ধ চেয়েছেন মধ্যম পন্থার মাধ্যমে ‘সকলের জন্য অধিক সুখ প্রতিষ্ঠা’।
বৌদ্ধসমাজ দর্শনে সাম্যবাদ, গণতন্ত্র এবং সব মানুষের ধর্মীয় অধিকারলাভ প্রভৃতি বিষয় বিশেষভাবে স্থান পেয়েছে। তাঁর জীবনদর্শনে চিন্তা ও মননের স্বাধীনতা, মুক্তবুদ্ধির চর্চা ও মূল্যবোধ বিকাশের সব বিষয় অমিত প্রেরণা জুগিয়েছে। তিনি সমাজের বহু আক্রান্ত মূল্যবোধকে বল্গাহীনভাবে দেখেননি। বুদ্ধ তাঁর জীবনদর্শনে ও শিক্ষামূলক আদর্শে অতিমানবিক বা অতিপ্রাকৃতিক জীবনকে গ্রহণ করেননি। তাঁর উন্নততর জীবনে অনাড়ম্বর ও বৈচিত্র্যহীন সংযত আচরণ, আদর্শ ব্যক্তিত্ব ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ও সংবেদনশীল বিনয়নীতি সামগ্রিক জীবনে বিশেষভাবে প্রত্যক্ষ করা যায়।
প্রকৃত জীবন গঠনের মানসে শীলের গুরুত্ব বৌদ্ধধর্মে সর্বত্র বা সংযত আচরণকে তিনি বিশেষভাবে প্রাধান্য দিয়েছেন। এ জন্য বৌদ্ধধর্মে পঞ্চশীলে আছে প্রাণীবধ বা হিংসা না করা, চৌর্যবৃত্তি না করা, মিথ্যা কথা না বলা, ব্যভিচার বা যৌনাচার না করা, কোনো প্রকার মাদকদ্রব্য সেবন না করা প্রভৃতি। এগুলো হলো সুন্দর আচরণবিধি, যা সৌজন্য, ভদ্রতা, মানবতা, সহিষ্ণুতা, পরোপকার, মার্জিত রুচি, দায়িত্ব-কর্তব্যবোধসহ সৃজনশীল কর্ম, সাম্য, মৈত্রী প্রভৃতি আদেশ-উপদেশের নির্দেশনা। এসব মানবিক গুণের অনুশীলনকে বুদ্ধ উৎসাহিত করেছেন। এসব গুণের সমাবেশেই একটি মানুষের জীবন যেমন সুন্দর ও পরিপূর্ণ হয়, তেমনি সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবনও জননীতি, জন-আদর্শে পরিপূর্ণ ও সমৃদ্ধিশালী হয়। অতএব, বুদ্ধের বহুমাত্রিক কল্যাণময়তা এভাবে মানবগোষ্ঠীকে মঙ্গলের পথে আসতে আহ্বান জানায়। বিশ্বশান্তি ও বিশ্বমানবতা গঠনে প্রেরণা জোগায়।
বৌদ্ধধর্ম বলছে, বিজ্ঞানের আবিষ্কার আপাতদৃষ্টিতে সুখ-সমৃদ্ধময় মনে হলেও মানব কিংবা জীবকুলকে জরা, ব্যাধি, মৃত্যু থেকে মুক্তি দিতে পারেনি। তাই বুদ্ধ বলেন, ‘আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গের মতো আর কোনো মার্গ নেই; চতুরার্য্যের সমান আর কোনো সত্য নেই।’ কিন্তু বিজ্ঞানের সঙ্গে বৌদ্ধধর্মের কোনো বিরোধ নেই। বরং বৌদ্ধধর্ম সত্যিকার অর্থে বিজ্ঞানসম্মত ধর্ম। তবে ভোগবাদী বিজ্ঞান ও লোকোত্তর বিজ্ঞানের মধ্যে বেশ পার্থক্য রয়েছে। ভোগবাদী বিজ্ঞান মানুষকে অমঙ্গলের পথে নিয়ে যায়। ভোগবাদী বিজ্ঞানের অপব্যবহারের ফলে আজ বিশ্বে যুদ্ধ, আণবিক বোমা ও মারণাস্ত্র ব্যবহূত হচ্ছে। এগুলো বিশ্বশান্তির হাতিয়ার হতে পারে না।
মহামতি বুদ্ধের মতো আজ চিকিৎসাবিজ্ঞানীরাও বলছেন, মানুষের দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনা, হিংসা-বিদ্বেষ থেকেই মারাত্মক ব্যাধির সৃষ্টি হয়। এ জন্য বুদ্ধ লোভ-লালসাহীন ভাবনার কথা বলেছেন; উদগ্র কামনা-বাসনাপূর্ণ ভাবনা ত্যাগ করতে বলেছেন। এতেই মানুষের প্রকৃত মানসিক শান্তি আসতে পারে।
পৃথিবীর মানুষ আজ যুদ্ধ, হানাহানি, রক্তপাতের ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কাও কাজ করে, শঙ্কা হয় পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের। কেন? বৌদ্ধদর্শনে এর উত্তর পাওয়া যায় অতি সহজে। বুদ্ধ বলেন, ক্রোধ, লোভ, দ্বেষ, মোহ, কামনা-বাসনা থেকেই এসব অশান্তি এবং যুদ্ধবিগ্রহের উদ্ভব। লোভ, দ্বেষ ও ক্রোধের বশবর্তী হয়ে পরস্পরের প্রতি যুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছি। একে অপরকে আক্রমণ করে চলেছি। একে অন্যকে ধ্বংস করার জন্য প্রবৃত্ত হচ্ছি। এটা ব্যক্তিজীবনকে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত করে, তেমনি ক্ষতিগ্রস্ত করে দেশ তথা গোটা বিশ্বকে। ক্ষোভ বা ক্রোধের বশবর্তী হয়ে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া যায় সত্যি; কিন্তু এর ভয়াবহ পরিণতি যে গোটা বিশ্বের নিরীহ মানুষকে দিতে হয়, সেই বোধ যুদ্ধবাজ শাসকদের নেই। যারা এমন চরিত্রের, তাদের উদ্দেশে বুদ্ধের বাণী এ রকম: ‘যুদ্ধক্ষেত্রে হাজার হাজার যোদ্ধাকে পরাস্ত করা বড় কথা নয়, যে নিজেকে অর্থাৎ নিজের রিপুসমূহকে দমন করতে পেরেছে, সেই প্রকৃত জয়ী।’
আমরা অন্যকে জয় করতে চাই বিভিন্ন শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে। অথচ আমাদের মেধা ও প্রজ্ঞা দিয়ে নিজেকে জয় করতে চাই না। এর চেয়ে অগৌরবের বিষয় আর কী হতে পারে? যুদ্ধ মানবসভ্যতার এক অভিশাপ। মানুষের মেধার আবিষ্কার মানুষকে হত্যা করার জন্য নয়, মানবজাতিকে ধ্বংস করার জন্য নয়। সম্রাট অশোক বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করার আগে কলিঙ্গ যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন। সেই যুদ্ধের ভয়াবহতা তাঁর মনকে দারুণভাবে আহত করেছিল। বুদ্ধের অমৃতবাণী তাঁর অশান্ত হূদয়ে শান্তির বারতা এনেছিল। বুদ্ধের বাণীটি ছিল এ রকম: ‘অপ্রমাদ অমৃতের পথ, প্রমাদ মৃত্যুর পথ। অপ্রমাদীরা অমর, যাঁরা প্রমত্ত তাঁরা মৃতের ন্যায়।’ মহামতি বুদ্ধের এ রকম মানবতাবাদী মতবাদ ও অহিংসনীতি বিশ্বের সব মানবগোষ্ঠীকে এক অভিন্ন বিশ্বমৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ হতে উজ্জীবিত করে।
হিংসা, হানাহানি, ষড়যন্ত্র, এমনকি পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কার অস্থির এই একুশ শতকে বুদ্ধের বাণী আগের চেয়েও বেশি প্রাসঙ্গিক।
‘সব্বে সত্তা সুখীতা ভবন্তু’—বিশ্বের সকল জীব সুখী হোক। সকলেই মঙ্গল লাভ করুক। বাংলাদেশ সমৃদ্ধময় হোক। বিশ্বে শান্তি বিরাজ করুক। ‘নিব্বানং পরমং সুখং’—নির্বাণ পরম সুখ, নির্বাণ পরম শান্তি।
ড. সুকোমল বড়ুয়া: সভাপতি, বিশ্ব বৌদ্ধ ফেডারেশন, বাংলাদেশ চ্যাপ্টার।
sukomalbaruapalidu@gmail.com
বুদ্ধপূর্ণিমা ও বুদ্ধবাণীর তাৎপর্য
দিলীপ কুমার বড়ুয়া
আজ শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা। জন্ম, বুদ্ধত্বলাভ এবং মহাপরিনির্বাণ (মৃত্যু)—বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তক মহামানব গৌতম বুদ্ধের জীবনে এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে সংঘটিত হয়েছিল। তাই বৈশাখী পূর্ণিমাকে বুদ্ধপূর্ণিমাও বলা হয়। বিশ্ব বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর কাছে দিনটির আবেদন অনন্যসাধারণ।
সিদ্ধার্থ গৌতম ছিলেন রাজপুত্র। সর্বজীবের মঙ্গল ও দুঃখ থেকে মুক্তির পথ অন্বেষণের জন্য পরিবার-পরিজন, রাজপ্রাসাদের বিলাসী জীবন, স্ত্রী-পুত্র, পিতা-মাতা ও রাজসিংহাসনের মায়া ত্যাগ করে তিনি পথে নেমেছিলেন। সুদীর্ঘ ছয় বছর কঠোর সাধনায় লাভ করেন বোধি, খ্যাত হন বুদ্ধ নামে। আবিষ্কার করেন চার আর্য সত্য: জগতে দুঃখ আছে, দুঃখের কারণ আছে, দুঃখের নিরোধ আছে এবং দুঃখ নিরোধের উপায় আছে। দুঃখ নিরোধের উপায় হিসেবে তিনি নির্দেশ করেন আটটি অঙ্গসমন্বিত পথ আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ: সৎ দৃষ্টি, সৎ সংকল্প, সৎ বাক্য, সৎ ব্যবহার, সৎ জীবিকা, সৎ প্রচেষ্টা, সৎ চিন্তা এবং সাধু ধ্যানে চিত্তকে নিবিষ্ট করা। এ পথই শান্তির পথ। এ ছাড়া তিনি আবিষ্কার করেন জন্ম, মৃত্যু ও দুঃখের কারণ প্রতীত্যসমুৎপাদ তত্ত্ব। এ তত্ত্বের মূল নীতি হলো: ওটা থাকলে এটা হয়, ওটার উৎপত্তিতে এটার উৎপত্তি, ওটা না থাকলে এটা হয় না, ওটার নিরোধে এটার নিরোধ হয়।
এই তত্ত্ব অনুযায়ী, পৃথিবীর সবকিছুই কার্যকারণ শৃঙ্খলে আবদ্ধ এবং শর্তসাপেক্ষ। জড়জগৎ ও মনোজগৎ—নীতির দ্বারা পরিশাসিত হয়। ১০টি কারণে জন্ম, মৃত্যু ও দুঃখের সৃষ্টি হয়। তাই প্রতীত্যসমুৎপাদ তত্ত্বকে দ্বাদশ নিদানও বলা হয়। এসব নিদান বা কারণ হচ্ছে: ১. অবিদ্যা ২. সংস্কার ৩. বিজ্ঞান ৪. নাম-রূপ ৫. ষড়ায়তন ৬. স্পর্শ ৭. বেদনা বা অনুভূতি ৮. তৃষ্ণা ৯. উপাদান ১০. ভব বা উৎপত্তি ১১. এবং ১২. জন্ম, জরা, ব্যাধি, দুঃখ ইত্যাদি। এই ১২টি কারণ শর্ত সাপেক্ষে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। একটির কারণে অপরটি উৎপন্ন হয়, একটির নিরোধে অপরটির নিরোধ হয়। এই তত্ত্ব বিশ্লেষণে দেখা যায়, অবিদ্যার কারণে সংস্কার, সংস্কারের কারণে বিজ্ঞান, বিজ্ঞানের কারণে নাম-রূপ, নাম-রূপের কারণে ষড়ায়তন, ষড়ায়তনের কারণে স্পর্শ, স্পর্শের কারণে বেদনা, বেদনার কারণে তৃষ্ণা, তৃষ্ণার কারণে উপাদান, উপাদানের কারণে ভব, ভবের কারণে জন্ম এবং জন্মের কারণে মানুষ জরা, ব্যাধি, মৃত্যু, অপ্রিয়সংযোগ, প্রিয়বিচ্ছেদ, ঈপ্সিত বস্তুর অপ্রাপ্তিজনিত দুঃখ প্রভৃতি ভোগ করে। বর্ণিত কারণসমূহ একটির কারণে অপরটির ধ্বংস হয়। ফলে অবিদ্যা বিদূরিত হলে সংস্কার বিদূরিত হবে, এমনিভাবে জন্ম নিরোধ করা গেলে জরা, ব্যাধি এবং মৃত্যু-দুঃখ নিরোধ হবে।
বুদ্ধ উপর্যুক্ত দর্শন এমন একসময় প্রচার করেছিলেন, যখন প্রাচীন ভারতের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী জাতিভেদ প্রথার নিগড়ে আবদ্ধ, অসাম্য-অনাচার সর্বস্বতার দ্বারা দারুণভাবে বিপর্যস্ত, ধর্মীয় অধিকার থেকে বঞ্চিত এবং বিশ্বাসরূপী সংস্কারের বেড়াজালে শৃঙ্খলিত ছিল। তিনি মানুষকে কোনো প্রকার বন্ধনে আবদ্ধ করেননি, বিশ্বাসরূপী শৃঙ্খল দ্বারাও বাঁধেননি। অধিকন্তু দিয়েছিলেন বুদ্ধি ও বিবেকের স্বাধীনতা। তাই তিনি নিজেকে ত্রাণকর্তা হিসেবে উপস্থাপন করেননি। বরং উপস্থাপিত হয়েছেন পথপ্রদর্শক হিসেবে। তাঁর উপদেশ ছিল ‘নিজের দীপ প্রজ্বলিত করে নিজেই নিজের মুক্তির পথ পরিষ্কার করো, অন্যের ওপর নির্ভর কোরো না।’
বুদ্ধ কখনো জন্মকে প্রাধান্য দেননি, প্রাধান্য দিয়েছেন কর্মকে। তাই তাঁকে বলতে দেখি, ‘জন্মের দ্বারা কেউ চণ্ডাল হয় না, কর্মের দ্বারাই চণ্ডাল হয়।’ তাঁর ধর্ম কর্মপ্রধান, আপনি আচরি ধর্ম, অনুশীলন ও মননের ধর্ম। এ ধর্মে অদৃষ্টবাদ ও বাহ্যিক আড়ম্বরতার কোনো স্থান নেই। যে যেরূপ কর্ম করবে, সে সেরূপ ফল ভোগ করবে। নৈতিকতা এ ধর্মের অন্যতম আদর্শ। সমগ্র ত্রিপিটক অধ্যয়ন করলেও বৌদ্ধ হওয়া যায় না, যদি না তার নৈতিক চরিত্রের দৃঢ়তা থাকে। বুদ্ধ বলেছেন, ‘তিনিই প্রকৃত বৌদ্ধ (ভিক্ষু), যাঁর চিত্ত বিশুদ্ধ, নৈতিকতায় প্রোজ্জ্বল, লোভ-দ্বেষ-মোহ হতে মুক্ত এবং সত্যদৃষ্টি বা প্রজ্ঞার ওপর প্রতিষ্ঠিত।’
একজন বৌদ্ধকে অশুভ কর্ম থেকে বিরত থাকতে হবে, বিরত থাকতে অন্যকে উৎসাহিত বা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করতে হবে। অপর দিকে শুভ বা মঙ্গলজনক কর্ম করতে হবে এবং অপরকেও উৎসাহিত করতে হবে। অশুভ কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য বৌদ্ধদের শীল পালন করতে হয়। তন্মধ্যে প্রধান পাঁচটি শীল পঞ্চশীল নামে পরিচিত। এই পাঁচটি শীল হচ্ছে: ১. প্রাণী হত্যা থেকে বিরত থাকা ২. অদত্ত বস্তু গ্রহণ না করা বা চুরি না করা ৩. ব্যভিচার থেকে বিরত থাকা ৪. মিথ্যাচার থেকে বিরত থাকা এবং ৫. মাদকদ্রব্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকা। পৃথিবীতে সব দুঃখ, অশান্তি, অন্যায় ও উপদ্রবের মূলে আছে এই পাঁচটি অপকর্ম। হত্যা, চুরি, ব্যভিচার ও মাদক সেবন—বর্তমান বিশ্বের বিরাট সমস্যা। এই সমস্যা মানুষকে শঙ্কিত করে তুলেছে। সভ্যতাকে করছে বিপন্ন। অথচ বুদ্ধ নির্দেশিত পঞ্চশীল এবং আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ অনুশীলন করলে সহজেই এই সমস্যা থেকে মুক্তি লাভ করা যায়। বুদ্ধ ব্যক্তিজীবনের উৎকর্ষের মধ্য দিয়ে সামাজিক উৎকর্ষ সাধন করতে চেয়েছিলেন। বুদ্ধের চিন্তা-চেতনার কেন্দ্রে ছিল মানুষ। অধিবিদ্যাসংক্রান্ত বিষয়ে তিনি নির্লিপ্ত থাকতেন। জগৎ শাশ্বত না অশাশ্বত, ধ্রুব না অধ্রুব এসব অধিবিদ্যাসংক্রান্ত প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলতেন, ‘কোনো ব্যক্তি শরাহত হলে আগে সেবা দিয়ে তাকে সুস্থ করে তোলা উচিত, নাকি কে শরটি নিক্ষেপ করল, কোন্ দিক থেকে শরটি এল প্রভৃতি আগে অনুসন্ধান করা উচিত? জগৎ-সংসার দুঃখের ফণায় বিকীর্ণ, জরাতরঙ্গে উদ্বেল এবং মৃত্যুর উগ্রতায় ভয়ংকর। এসব প্রশ্নের চেয়ে দুঃখ থেকে মুক্তি লাভের চেষ্টা ও উপায় অনুসন্ধান করাই উত্তম।’ মানুষের দুঃখমুক্তিই ছিল তাঁর অভীপ্সা। সমাজ যাদের পতিত হিসেবে উপেক্ষা করেছে, তিনি তাদের উপেক্ষা করেননি। তিনি পতিতকে টেনে তুলে, পথভ্রান্তকে পথ প্রদর্শন করে সমাজে মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবাইকে তাঁর ধর্মে স্থান দিয়ে তিনি মনুষ্যত্বের জয়গান করেছেন। তিনি নিজেকে এবং তাঁর ধর্মকে সামপ্রদায়িকতার গণ্ডি ও সংকীর্ণতার মধ্যে আবদ্ধ রাখেননি। তাঁকে বলতে দেখি, ‘গঙ্গা, যমুনা... প্রভৃতি নদী যেমন সাগরে মিলিত হয়ে নাম হারিয়ে ফেলে, তেমনি ব্রাহ্মণ, বৈশ্য, শূদ্র, ক্ষত্রিয়, চণ্ডাল প্রভৃতি আমার ধর্মে প্রবেশ করে নাম হারিয়ে ফেলে, এখানে সকল মানুষ এক।’ বুদ্ধ প্রতিষ্ঠিত সংঘে বিভিন্ন শ্রেণী ও সমপ্রদায়ের লোক ছিল, যারা আপন মহিমা ও কৃতিত্বে সংঘের মধ্যে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত ছিল। তাঁর সর্বজনীন বাণীর সুধারস বারাঙ্গনার জীবনকেও পঙ্কিলতামুক্ত করেছিল।
বিশ্বের সব প্রাণীর প্রতি মৈত্রী ও করুণা প্রদর্শন তাঁর প্রচারিত ধর্মের অনন্য দিক। তাঁর অমৃত বাণী বিশ্বের ক্ষুদ্রতম প্রাণী থেকে বৃহত্তম প্রাণীকে পর্যন্ত রক্ষার প্রেরণা জোগায়। তাঁর হাতে ছিল মানবপ্রেমের বাঁশরি, কণ্ঠে ছিল মৈত্রী ও করুণার অমৃত বাণী এবং লক্ষ্য ছিল সত্য ও ন্যায়ের ধর্ম বিতরণ। তাঁকে বলতে দেখি, ‘সাধক ভিক্ষু! মৈত্রীপূর্ণ চিত্তে সকল প্রাণীর প্রতি অপ্রমেয় মৈত্রীভাব পোষণ করবে। মাতা যেমন তার একমাত্র পুত্রকে নিজের জীবন দিয়ে রক্ষা করে, সেরূপ সকল প্রাণীর প্রতি মৈত্রী ও ভালোবাসা প্রদর্শন করবে। কাউকে আঘাত কোরো না। শত্রুকে ভালোবাসা দিয়ে আপন করে নেবে।’ বিশ্বের সকল প্রাণীর প্রতি বুদ্ধের মমত্ববোধ সর্বকালের মানুষের মনে এক গভীর আবেদন সৃষ্টি করেছে। এই মহামন্ত্রে দীক্ষা নিয়ে সম্রাট অশোক সম্যকভাবে উপলব্ধি করেছিলেন, ‘রাজ্য জয়, যুদ্ধ, নিপীড়ন, যাগযজ্ঞ-বলি সত্যিকারের ধর্ম হতে পারে না।’ তাই তিনি হিংসানীতি পরিহার করে মৈত্রী-ভালোবাসার নীতি গ্রহণের মাধ্যমে রাজ্যজয়ের পরিবর্তে ধর্মজয়ের পথ গ্রহণ করেছিলেন। বুদ্ধের প্রচারিত ধর্মের বিশেষত্ব হলো মৈত্রীভাবনা, যা বৌদ্ধমাত্রই অত্যাবশ্যকভাবে পালনীয়। মৈত্রীভাবনার মূল মন্ত্র হলো: ‘সকল প্রাণী সুখী হোক, শত্রুহীন হোক, অহিংসিত হোক, সুখে কাল যাপন করুক।’
মানুষ আজ ধ্বংসাত্মক খেলায় মত্ত। সমগ্র বিশ্বে আজ সংঘাত, সন্ত্রাস, পারস্পরিক অবিশ্বাস, সমপ্রদায় ও জাতিগত ভেদাভেদ এক ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। পারস্পরিক সমঝোতার অভাবে পাশাপাশি রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে চলছে যুদ্ধের প্রস্তুতি। ইতিপূর্বে অনেক যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। তাতে জাতিগত লাভ হয়নি কিছুই। বরং সভ্যতা ও সংস্কৃতি হয়েছে বিপন্ন। শান্তিকামী মানুষ আর যুদ্ধ চায় না, সামপ্রদায়িক ও জাতিগত ভেদাভেদ চায় না। শান্তি চায়। শান্তি চায়। শান্তি চায়।
আজকের এই শুভ বুদ্ধপূর্ণিমা দিবসে আমাদের প্রত্যাশা—শান্তির জয়গানে ভরে উঠুক বিশ্ব। ‘সকল প্রাণী সুখী হোক’।
ড. দিলীপ কুমার বড়ুয়া: অধ্যাপক, চেয়ারম্যান, পালি অ্যান্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
বুদ্ধের শিক্ষায় শান্ত হোক পৃথিবী
বিমান চন্দ্র বড়ুয়া
হাজার বছরের পবিত্রতা ও মানবমুক্তির বার্তা নিয়ে আবারও ফিরে এল পবিত্র বুদ্ধপূর্ণিমা। পৃথিবীতে নতুন অরুণোদয়ে আবারও যোগ হলো একটি বুদ্ধ নববর্ষ। পৃথিবীব্যাপী বুদ্ধের নীতি ও আদর্শ সামনে রেখে, বুদ্ধের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা উদ্যাপন করছেন পবিত্র বুদ্ধপূর্ণিমা। এটি সমগ্র পৃথিবীর বৌদ্ধদের কাছে সর্ববৃহৎ পবিত্র ও পুণ্যময় ধর্মীয় উৎসব।
আড়াই হাজার বছরেরও বেশি আগে বুদ্ধ যে জীবনকে তুচ্ছ মনে করে ফেলে গিয়েছিলেন, সেই তুচ্ছ জীবন আজ অনেক বড় হয়ে উঠেছে সুখপ্রত্যাশীদের কাছে। বুদ্ধের জীবনপ্রবাহে কোনো রকম উত্তেজনা ছিল না। কোনো রকম আরাম-আয়েশ ছিল না। কোনো রকম মোহ ছিল না। অলৌকিক ক্ষমতার বিকাশ ছিল না। তিনি অন্ধকারদর্শী ধর্মের জগৎ থেকে মানুষকে সৎ, ন্যায় ও বাস্তবতার পথ প্রদর্শন করছিলেন। মানুষের অধিকারের প্রতি বুদ্ধ সজাগ ছিলেন। এখন প্রশ্ন জাগে, প্রাচীন ভারত তাহলে কি ধর্মদর্শনে সমৃদ্ধ ছিল না? সমৃদ্ধ ছিল বটে। কিন্তু বর্ণবৈষম্য, জাত-পাতের ভেদাভেদ, ছুঁতমার্গের প্রাবল্যে ভেসে চলা ভারতকে একমাত্র জাগ্রত হওয়ার পথে নিয়ে এলেন বুদ্ধ নিজেই। বুদ্ধ বলেন, ‘গঙ্গা, যমুনা...প্রভৃতি বড় নদী বিভিন্ন দিক থেকে উৎপন্ন হয়েও যেমন সমুদ্রে মিলে গিয়ে তাদের স্বতন্ত্র সত্তা হারিয়ে ফেলে, তেমনি ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র প্রভৃতি তাঁর ধর্মে এসে জাতি ও গোত্র হারিয়ে ফেলে।’ এখানে তদানীন্তন জাতিভেদ প্রথার মূলে তিনি কুঠারাঘাত করে প্রচলন করেছিলেন সাম্যনীতির। তিনি নারী-পুরুষ সবাইকে এক করে দেখছেন। নারীও যে সাধনার মাধ্যমে পুরুষের সমকক্ষ হতে পারেন, তা-ও তিনি বলেছিলেন। তাঁর ধর্মে অস্পৃশ্য পতিতা, নিপীড়িত নারী যেমন আছেন, তেমনি রয়েছে ধনী-গরিব, উঁচু-নিচু সবার সহাবস্থান।
বুদ্ধের ধর্ম মানবকল্যাণের ধর্ম। জীবনকে সুন্দর পথে, পরিশুদ্ধতার পথে, শান্তির পথে এবং মনকে পবিত্র করার জন্য রয়েছে বুদ্ধের নীতিমালা। এগুলো পরিপালনের মাধ্যমে মানুষ পারিবারিক জীবনে, সামাজিক জীবনে, সর্বোপরি রাষ্ট্রীয় জীবনে সুখ ও শান্তির পরশ পাবে। বর্তমান বিশ্বে চলছে হিংসা, প্রতিহিংসা, ঘৃণা ও নিষ্ঠুর অমানবিক কার্যকলাপ। ফলে লোভ, দ্বেষ এবং মোহ আশ্রিত প্রদুষ্ট চিত্তের জগতে সৃষ্টি হচ্ছে নিন্দিত ও গর্হিত অমানবিক কার্যাবলি যুদ্ধ, সংঘাত মারামারি, সন্ত্রাস ইত্যাদি। আধুনিক সভ্যতার মধ্যে যে নৈতিক অবক্ষয় দেখা যাচ্ছে, তাতে বুদ্ধবাণী মূল্যায়নের সময় এসেছে। প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য যে সংঘাত হচ্ছে প্রতিনিয়ত, তাতে অশান্তি ক্রমেই বেড়ে চলেছে। বুদ্ধ বলেন, ‘শত্রুতার দ্বারা কখনো শত্রুতার উপশম হয় না। মিত্রতার দ্বারাই শত্রুতার উপশম হয়।’
বুদ্ধ সত্য ও সুন্দর জীবনযাপনের ক্ষেত্রে নিজেকেই সর্বাগ্রে স্থান দিয়েছেন। প্রত্যেক মানুষের মধ্যে যে আত্মশক্তি রয়েছে, সেই শক্তির বিকাশ সাধনের কথা বলেছেন বুদ্ধ। তিনি বলেন, ‘নিজেই নিজের উদ্ধার সাধন করো। নিজেই নিজেকে পরীক্ষা করো। মানুষ নিজেই নিজের প্রভু, নিজেই নিজের আশ্রয়। বণিক যেমন তার সুন্দর অশ্বকে বশে রাখে, তুমিও সেরূপ নিজেকে বশে রাখো।’ তিনি আরও বলেন, ‘অন্যের শরণ নিয়ে লাভ নেই। নিজের শরণ নাও, নিজেকে আত্মদীপ করে জ্বালিয়ে তোলো।’ একাকী পথচলার সময় পায়ে কাঁটা বিদ্ধ হলে তা পথিককেই তুলে নিতে হবে। এগুলো কালজয়ী বাণী।
সর্বকালকে অতিক্রম করতে সক্ষম এ বাণী। এগুলোই মানুষকে সঠিক পথের সন্ধান দিতে পারে। নব নব চেতনায় জাগ্রত করে তুলতে পারে সমাজের বিবেকবান প্রতিটি মানুষকে। সুতরাং মানুষকে লোভ, দ্বেষ ও মোহের আবর্ত থেকে বেরিয়ে আসার জন্য নিজের প্রচেষ্টার প্রয়োজন। জীবনে সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য আপন শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। মহান বুদ্ধ সেই আপন শক্তিকে কাজে লাগিয়ে প্রকৃতির কোলে বুদ্ধগয়ার বোধিবৃক্ষমূলে গভীরভাবে ধ্যানস্থ হয়েছিলেন। এ সময় তিনি চরম সত্যকে আলিঙ্গন করেছিলেন। এখানে তিনি ইতিহাসকে গৌরবান্বিত করেছেন। আর ভারতকে করেছেন মহিমামণ্ডিত। তিনি মহাসত্যের জন্য দুস্তর পথ পাড়ি দিলেন। নির্বাণ লাভের আনন্দে অবগাহন করলেন।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন প্রান্তে, বিভিন্ন ভাষায় অগণিত মানুষ বুদ্ধকে স্মরণ করেন। কিছুই না হোক, শৌর্য, বীর্য, প্রাজ্ঞতা এবং অন্ধকার থেকে সরে আসার জন্য তাঁর প্রার্থনা একান্তই অপরিহার্য। প্রতিনিয়ত মানুষ বিজ্ঞানসম্মত, যুক্তিবাদী ও বুদ্ধিবৃত্তিক কথায় বিশ্বাসী। জ্ঞানীমাত্রই কোনো কিছু স্বীকার করতে হলে ভাবের আবেগ অপেক্ষা যুক্তির আশ্রয় নেন। বুদ্ধের শিক্ষার অন্যতম উপাদান যুক্তিবিচারের মাধ্যমে পথচলা। তিনি অন্ধভাবে কোনো কিছু গ্রহণ বা বিশ্বাস করতে বলেননি।
অনৈক্য পরাজয়ের কারণ। প্রত্যেক মানুষের স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশের অধিকার রয়েছে। এই গণতান্ত্রিক অধিকার যখনই বাধাগ্রস্ত হয়, সেখানেই দেখা দেয় অসন্তোষ। বুদ্ধ তাঁর প্রবর্তিত সংঘে গণতান্ত্রিক নিয়ম চালু করেছিলেন। বুদ্ধের সময়ে রাজা অজাতশত্রু প্রথম দিকে বৈশালীর লিচ্ছবীদেরকে পরাজিত করতে পারেননি। কারণ, তারা গণতন্ত্রের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধা দেখাত আর ঐক্যবদ্ধভাবে তা পালন করত। বুদ্ধভাষিত সপ্ত অপরিহানীয় নীতির মধ্যে দুটি নীতিতেই গণতন্ত্রের উল্লেখ রয়েছে। যেমন: ক. সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কর্মসূচি নির্ধারণ করা এবং খ. নির্ধারিত কর্মসূচি সম্মিলিতভাবে সম্পাদন করা। সমাজ, সংগঠন, রাষ্ট্রে যত দিন গণতন্ত্র ও ঐক্য বজায় থাকবে, তত দিন তাদের কোনো রকম পরাজয় হবে না।
আজ পৃথিবীতে আবার খুব প্রয়োজন হয়ে পড়েছে বুদ্ধের মানবতার, বিনয় (নিয়মনীতি), সাম্য, মৈত্রী, করুণা, মুদিতা, উপেক্ষা, ত্যাগ, উদারতার। বুদ্ধ যে পথ প্রদর্শন করেছিলেন—লোভান্ধ, দ্বেষান্ধ, মোহান্ধ ও ক্রোধান্ধ মানুষ আজ তা থেকে অনেক অনেক দূরে। মানুষ যদি নিজের আশ্রয় কোনো অন্ধকারের পরিবর্তে আলোকশিখায় দৃশ্যমান হয়, তবে তাকে সে মানবে না—এমন কথা কখনো বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না। বুদ্ধের অনির্বাণ চেতনা অন্তরে জাগ্রত করার মাধ্যমে মানুষ পেতে পারে অমৃতের সন্ধান। অন্তরের ক্রোধ ও রিপুগুলোকে জয় করা সভ্যতার জন্য খুবই অপরিহার্য। এটা আমরা সবাই বুঝতে পারলেও জয় করতে পারি না কখনো। এ জন্য শান্ত পৃথিবীর স্বার্থে ও অহিংসাময় সমাজব্যবস্থার স্বার্থে বুদ্ধেরই প্রয়োজন; প্রয়োজন তাঁর শিক্ষার একান্ত অনুশীলন; প্রয়োজন তাঁর শান্তির অমৃত নিধির অন্বেষণ—প্রকৃতপক্ষে তাঁর যথার্থ অনুসরণ।
বিমান চন্দ্র বড়ুয়া: সহযোগী অধ্যাপক, পালি অ্যান্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং একাডেমিক কাউন্সিলর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন