শনিবার, ১৯ মে, ২০১২

আপন দর্পণ: যাবার সময় হলে


 মুস্তাফা জামান আব্বাসী  

নাতি-নাতনিরা চলে যাওয়া বরদাস্ত করতে পারে না। কোথাও যাব শুনলেই মুখ গম্ভীর করে। ব্যাঙ্ককে ও ইউনাইটেড মিলে শরীরের উপর যেরকম খোঁচাখুঁচি হচ্ছে তাতে কারও চলে যাওয়ার কথাই মনে হবে। আমার এক বন্ধু রাগ করে ইংল্যান্ডে চলে যায়, সেখানে খপ্পরে পড়ে এক মেম সাহেবের। কুড়ি বছর ধরে তার সঙ্গে অনুবাদ করে কথা বলার পর এবং দু’টি সন্তানের জন্ম দেয়ার পর আবার রাগ করে ঢাকায় চলে আসে। বলে, ওর সঙ্গে আর ঘর করব না। আরেকজন মহিলা খোঁজ করে তার সঙ্গে বিয়ে দিলাম। এরপর বহুদিন খবর নেই। শুনলাম কুষ্টিয়া থেকে তার বাবার কনস্টিটিউয়েন্সি থেকে ইলেকশনে দাঁড়াবে। পরশুদিন বনানী কবরস্থানে নেমপ্লেট পড়ছি। এটা আমার একটি অভ্যেস। হঠাত্ দেখি তার নাম। রেফাউল হক। সে সবার উপর রাগ করে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে। আমি রাগ করিনি, যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছি।
প্রস্তুতির প্রথমপর্ব সবার কাছে ক্ষমা চাওয়া, বিশেষ করে আপনজনের কাছে, যাদের মনে না জেনে আঘাত দিয়েছি যখন-তখন। গান গেয়েছি ‘ও তুই যারে আঘাত হানলি রে মনে সেজন কি তোর পর’, অথচ আপনজনকেই আঘাত দিয়ে গেছি চিরদিন। ভেবেছি, সে তো আমার আপন, তাকে আঘাত দেয়াই চলে। আসলে তা নয়। তার মন যুগিয়ে চলাই ছিল আমার কাজ, তা আমি করিনি। তাই আজ সবচেয়ে মনে কষ্ট পাচ্ছি, আপনজনকে আঘাত দেয়ার কষ্ট। ঠিক করেছি আর কাউকে আঘাত দেব না। অথচ এ প্রতিজ্ঞা রাখতে পারছি না। একটু আগে চা দেরি করে দেয়ায় মেইডকে বকেছি, খবরের কাগজ দেরি করে দেয়ায় কাগজওয়ালাকে, সারাদিন কাউকে আঘাত না দেয়ার প্রতিজ্ঞা রাখতে পারিনি। এ যেন হয়ে পড়েছে মজ্জাগত অর্থাত্ চরিত্রের সঙ্গে আঘাত দেয়াটাও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে। যখন যা খুশি করে চলেছি। প্রভুকে দেয়া কোন প্রতিশ্রুতি রক্ষা করিনি। সকালে ঘুম থেকে উঠে তার দাসত্বের অঙ্গীকার করেছি প্রায় এক ঘণ্টা, অথচ পরক্ষণেই অনায়াসেই নফেসর দাসত্ব করেছি। নফেসর দাস, প্রভুর নই। তাই যাওয়ার ক্ষণে হিসেব কষতে গিয়ে দেখি পুরোটাই নফেসর দখলে চলে গেছে। ঘরবাড়ি, সহায়- সম্পত্তি, পরিবার সব কিছুই টানে, প্রভু ছাড়া। মসিজদে যাই, সেখানেও নফ্স টানছে, তাহলে যাই কোথায়? কোনদিন কি প্রভুর দাসত্ব করতে পারব, যে ক’দিন আছি শুধু কি প্রভুর জন্যে কয়েক মিনিটের ওঠাবসা করে চলে যাব, তার সান্নিধ্য কি পাব না?
রাস্তায় বেরিয়ে দেখি কেউ কারও বন্ধু নই, সবাই সবার কাজ করে চলেছেন শুধু রোজগারের জন্যে। কারও দিকে ভালোবাসার দৃষ্টি মেলে ধরার অবকাশ নেই। রাজনীতিতে ঘোরতর সংঘাত, কেউ কাউকে সহ্য করতে পারছে না। গণতন্ত্র জায়গা করে দিয়েছে আপন খুশিতন্ত্রে। যারা ভাল লোক তারা কোথাও জায়গা পাচ্ছে না, ব্যবসা-বাণিজ্য, রুজি-রোজগার সবখান থেকে দেয়া হচ্ছে তাদেরকে হঠিয়ে। কোথাও গিয়ে দু’দণ্ড শান্তি পাওয়ার মত বন্ধু নেই। তাহলে এই বন্ধুগুলো গেল কোথায়? এই ভাবনায় দিন-রাত কষ্ট পাচ্ছি এবং একবার ভাবছি তাহলে এখান থেকে চলে যাওয়াই ভাল। যেখানে প্রেম নেই, ভালবাসা নেই, নেই সামান্যতম সহানুভূতি, সেখানে কেন কাল অতিবাহন।
কবরস্থানেও ব্যবসা, কবর বিক্রি হচ্ছে পাঁচ থেকে দশ লক্ষ টাকা। আজিমপুর কবরস্থানে যাদেরকে পাবেন তেলাওয়াতে মশগুল, তারাই ব্যবসায়ে নিযুক্ত। এখানে শায়িত অলি-আল্লাহ্, দু’ভাইয়ের ইচ্ছা সাধারণ কবরস্থানে যেন নির্বিঘ্নে ঘুমুতে পারি, থাকবে না কোন বেড়া, দেয়াল ও মনুমেন্ট। মক্কা-মদিনায় বড় বড় অলিদের কবরের পাশ দিয়ে হেঁটেছি। নির্দেশিকা নেই, পরিচয় আছে তাঁর কাছে, যার কাছ থেকে এসেছি।
১৭ মে, ২০১২
লেখক:অধ্যাপক-সংগীতজ্ঞ
mabbasi@dhaka.net

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন