শনিবার, ১২ মে, ২০১২

শিল্পীর রূপকার কমল দাশগুপ্ত


মোবারক হোসেন খান
কমল দাশগুপ্ত শুধু বাংলা গানের সুরস্রষ্টা নন, তার সুরের নিবিড় পরিচর্যা পেয়েছে হিন্দি, উর্দু, মারাঠিসহ বেশ কয়েকটি ভাষার গান। প্রথিতযশা এ সঙ্গীতজ্ঞ আধুনিক গানসহ আট হাজারেরও বেশি গানের সুর করেছিলেন। বাদ যায়নি আধুনিক, নজরুলসঙ্গীত, গীত, গজল, ভজন, কাওয়ালিসহ সঙ্গীতের বিভিন্ন ধারা। প্রতিভার যথাযথ ব্যবহার আর নিয়ন্ত্রিত অধ্যবসায়ে নিজেকে সহজেই মেলে ধরেন। মেধা-মননে এই জাত শিল্পী তাই সহজে পেয়েছিলেন কবি নজরুল ইসলামের সাহচর্য। কবি বিনা দ্বিধায় এ প্রতিভাবান সুরকারকে নিজের লেখা গান দিতেন সুরযোজনের জন্য। এ ক্ষেত্রে একটি কথা বলে রাখা ভালো, তিনি ইসলামী গান সুরারোপ করেও সমান খ্যাতি পেয়েছেন।
আরবি, ফারসি ও অন্যান্য শব্দের উচ্চারণে নানা মুসলমানি কায়দা-কানুন বেশ রপ্ত করে নেন তিনি । কমল দাশগুপ্ত কিছুদিন ঠুংরির বাদশা ওস্তাদ জমির উদ্দীন খান সাহেবের কাছে গান শেখার সুযোগ লাভ করেন এবং ওস্তাদের প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন। একই সঙ্গে কবি নজরুলের সানি্নধ্য লাভ করায় বিদেশি ভাষার ওপর বেশ দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। তার এসব গুণ ও দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে কবি বেশ কিছু ইসলামী গান কমল দাশগুপ্তের হাতে তুলে দেন। তার সুরে রওশন আরা বেগমের গাওয়া 'হে প্রিয় নবী রাসূল', 'হেরেমের বন্দিনী কাঁদিয়া ডাকে তুমি শুনিতে কি পাও' গান দুটি উল্লেখযোগ্য। সে সময় আরও একটি বিষয়ের চল ছিল_ অনেক হিন্দু শিল্পী মুসলিম ছদ্মনামে ইসলামী গান গাইতেন। রওশন আরা বেগমও ছিল ছদ্মনাম। সঙ্গীতজ্ঞানের বাইরেও আচার-ব্যবহারে অনেক সঙ্গীতগুরুর স্নেহধন্য হয়েছিলেন কমল দাশগুপ্ত। আবার অনেক শিল্পী এই সুরকারের সংস্পর্শে এসে মুগ্ধ হয়েছেন। কমল দাশগুপ্ত দীর্ঘ ৩০ বছর গ্রামোফোন কোম্পানিতে প্রধান সঙ্গীত পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। সে সময়ের স্মৃতিচারণা নিয়ে আসাদুল হকের লেখায় কমল দাশগুপ্তের কিছু কথোপকথন তুলে ধরছি। একদিন অফিস থেকে বের হওয়ার সময় কমল দাশগুপ্ত দেখেন, অভ্যর্থনা কক্ষে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক বসে আছেন। লোকটিকে দেখেই কমল দাশগুপ্ত চিনতে পারেন তিনি তার শিক্ষক ছিলেন। কমল দাশগুপ্ত কাছে গিয়ে কদমমুচি করে নিজেকে তার ছাত্র হিসেবে পরিচয় দেন। বিস্ময়ের সঙ্গে বৃদ্ধ জিজ্ঞেস করেন, আমরা যে শুনতে পাই প্রখ্যাত সুরকার কমল দাশগুপ্তের কথা, সে কি তুমি? কমল দাশগুপ্ত সম্মতিসূচক মাথা নাড়ালে আনন্দে তিনি আত্মহারা হয়ে যান। এরপর কমল দাশগুপ্ত শিক্ষককে দোতলায় নিজ ঘরে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন গ্রামোফোন অফিসে আসার কারণ। শিক্ষক তার মেয়ের কথা জানান। বলেন, কলকাতা আসার প্রধান কারণ ছিল মেয়েকে দিয়ে গান গাওয়ানো। কিন্তু কোনো কোম্পানি কাজ করতে রাজি হয়নি। অবশেষে গ্রামোফোন অফিসে এসেছি। শিক্ষকের কথা শুনে কমল দাশগুপ্ত তার মেয়েকে দোতলায় আসতে বলেন এবং হারমোনিয়ামের সামনে বসিয়ে গান গাইতে বলেন। সে সময়ই শিল্পীকে চুক্তিনামাপত্রে সই করান কমল দাশগুপ্ত। এরপর নিজে শিল্পীকে দীর্ঘদিন তালিম দিয়ে গান রেকর্ড করেন। এই শিল্পীর নাম ছিল মীনা। কবি নজরুল বিরচিত মোট চারটি গান অবলম্বনে দুটি গানে কণ্ঠ দেন এই শিল্পী। গানগুলো হলো 'আরো কতদিন বাকী' এবং 'আমি সন্ধ্যামালতী বন-ছায়া অঞ্চলে'।
কমল দাশগুপ্তের বড় বৈশিষ্ট্য ছিল তিনি শিল্পীর মন পড়তে পারতেন। শিল্পীর গায়কী অনুযায়ী গানের সুর করতেন। গান রেকর্ডিংয়ের আগে তিনি শিল্পীর সঙ্গে দীর্ঘ সময় ব্যয় করতেন। তাই শুধু শিল্পী, সুরকার বা সঙ্গীত নয়, কমল দাশগুপ্তের জাদুকরী কর্মকাণ্ডের সমান অংশীদার ছিল মানসিক প্রসারতা। তিনি নিজে শিল্পীর কাছে যেতেন, চিনতেন, তারপর একসঙ্গে কাজ করতেন। শততম জন্মবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি ক্ষণজন্মা এই সঙ্গীত কাণ্ডারিকে।

মোবারক হোসেন খান : সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন