শুক্রবার, ২২ জুন, ২০১২

হাতি আসুক রোহিঙ্গা খেদাও


হা সা ন হা ফি জ

শহরে বিদ্যুত্ নেই। বর্ষাকালেও ভ্যাপসা গরমে জান কাহিল। অতএব, ঘুরে আসা যাক বনাঞ্চল থেকে। কথাই আছে—জঙ্গল মে মঙ্গল হ্যায়। অরণ্যের নিবিড় নিভৃতি বড়ই নিরিবিলি। মানুষ হচ্ছে জগতের সবচেয়ে খতরনাক প্রাণী। বনের বাঘারা (মাসুম বাচ্চা হওয়া সত্ত্বেও) পর্যন্ত শান্তিতে থাকতে পারছে না এদের জ্বালায়। টেনেহিঁচড়ে নিয়ে আসা হচ্ছে শাহরিক পরিবেশে। পাচার করলে উমদা লাভ।
আমাদের এবারের গল্প বনাঞ্চল নিয়ে। তবে বাঘ বর্জিত। পুরানকালে নাটকে নারী চরিত্র বলতে গেলে থাকতই না। দু-চারটি থাকলেও অভিনয় করতেন পুরুষরা। নারী চরিত্র বর্জিত নাটকের চাহিদা ছিল বেশি। আজকের নাট্যাংশে ব্যাঘ্রদের ঠাঁই নেই। নির্জলা গাছগাছড়া নিয়ে কায়-কারবার। কোনো কোনো দুর্মুখের মধ্যে খারাপ কিছু দেখবেন। তা দেখুন। আমরা মচকাব না। লাইক মহাজোট সরকার। আমরা ইতিবাচক অংশেই ঘুরপাক খেতে থাকব। আমরা বনের বারোটা বাজানো প্রকল্পের পক্ষে। জোরালো সব যুক্তি তুলে ধরব। মামলা না জিতার কোনো রাস্তাই নাই।
কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলা। বারবাকিয়া সংরক্ষিত বনাঞ্চল। সেখানে চলছে বনদখলের মহোত্সব। আইনে বসতি গড়ার ওপর কড়া নিষেধাজ্ঞা আছে। থাকুক। কে তোয়াক্কা করে। মাস তিনেক সময়েই বনের চিত্র পাল্টে গেছে। দিন বদলের তুফান বইছে না? বনাঞ্চল তো দেশের বাইরে নয়। ঝড়ঝাপটা তার গায়েও লাগবে। তিন মাসে এক হাজার ৩১২টি বাড়িঘর নির্মিত। আরও এক হাজার নির্মাণের প্রক্রিয়াধীন। মাশাআল্লাহ্। চমত্কার প্রবৃদ্ধি। ডাবল ডিজিট। এ প্রকল্প তো অর্থমন্ত্রী আবুল মাল অভিহিত ‘দুষ্টু শেয়ারবাজার’ না। এটা হলো “মিষ্টি দখলের প্রকল্প। ‘ইহা’ অনুসরণীয় মডেল।”
তিন দখলদার জানিয়েছেন, সংশ্লিষ্ট বন বিটের কর্মকর্তাকে মোটা উেকাচ দিয়ে তারা বনভূমি দখলে নেন। তারপর বাড়ি তৈরি। এই প্যাকেজের অনুঘটক এক মালি। তিনি বন বিটের লোক। এক বিট কর্মকর্তা মওকা দিচ্ছেন বনভূমি দখলের। মাগনা নয়। নীতি হচ্ছে ‘ফ্যালো কড়ি মাখো তেল’। পাঁচ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত মালপানি খসালেই ব্যস। কাম সারা। গত ২৩ মে বড়ছড়া এলাকায় সংঘটিত ঘটনা বড়ই লজ্জার, নিন্দনীয়ও বটে। অবৈধ বসতি স্থাপনকারীদের কাছে একজন মাসোয়ারা তুলতে গিয়েছিলেন। রাশি খারাপ ছিল। মাসোয়ারা তো পানইনি, উল্টো গণপিটুনিতে সিধা হতে হয়েছে। কলিকাল আর কাকে বলে! রাবিশ!!
সেই বিট কর্মকর্তাকে ধরেছিলেন সাংবাদিকরা। যথারীতি অস্বীকার করলেন তিনি। নিয়মই তাই। বললেন, সংঘবদ্ধভাবে কিছু লোক বন দখল করেছে। তৈরি করছে বাড়িঘর। লোকবলের সঙ্কট আছে। সে কারণে এদের উচ্ছেদ করা যাচ্ছে না। বিট কর্মকর্তার এই বক্তব্য/দাবি কতটা ন্যায্য, আমরা জানি না। সময়ে প্রমাণিত হবে। মহাস্বপ্নিল পদ্মা সেতু নিয়ে পানি ঘোলা কম হয়নি। বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ দুর্নীতির। বাংলাদেশ সরকার সেই অভিযোগ প্রবলভাবে অস্বীকার করেছে। তারস্বরে প্রতিবাদ। শেষতক কী দাঁড়াল? যাহা রটে তাহা বটে। এক্ষণে ‘থলের বিড়াল’ বের হতে শুরু করেছে। কালা না ধলা বিড়াল, সেইটা অবশ্য বলা মুশকিল। লেটেস্ট খবর : পদ্মা সেতু প্রকল্পে চার কোটি ৭০ লাখ ডলার বরাদ্দ ছিল পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের জন্য। এ নিয়েই কালো বিড়ালের লাফঝাঁপ। পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের কাজ পাইয়ে দেয়ার জন্য কানাডাভিত্তিক প্রতিষ্ঠানকে টার্গেট করা হয়। এসএনসি—লাভালিন সেই প্রতিষ্ঠানের নাম। ১০ শতাংশ অর্থ কমিশন চাওয়া হয় তাদের কাছে। চাইলেন কারা? যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ তিন কর্মকর্তা। সাবেক মন্ত্রীও আছেন।
পদ্মা সেতু রাজকীয় ব্যাপার। চুনোপুঁটিদের বিষয় না। আপাতত বন-জঙ্গল নিয়েই থাকি। বনখেকোদের সপক্ষে আছেন। যুক্তি খাড়া করণের চেষ্টা করা যাক। সেই যুক্তি খোঁড়া হবে, সন্দেহ নাই। হোক না! নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো। মাজুল কতিপয় যুক্তি এখানে দাঁড় করানোর (বাঁশ দিয়ে ঠেকনা মার্কা) অপচেষ্টা। বন দখলদাররা বেশ করেছে। তাদের ‘অবৈধ’ বলাটা ভালো দেখায় না। শরম লাগে। ছয় ঘোড়াঅলা মইনুদ্দিন, মার্কিন সিটিজেন ফখরুদ্দীনের তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার কি অবৈধ? সেটা তো বর্তমান সরকার বলে না। শরমায়। কানাকে কানা বলতে হয় না। দুঃসাহস করে বলে ফেললে মহাবিপদ। ১১ হাজার ভোল্ট। কান টানলে মাথা চলে আসে যে!
আজাইড়া বনপ্রেমিক হয়ে লাভ কী? ওতে কি দুটো পয়সা আসে পকেটে? জাতীয় আবাসন সঙ্কট প্রকট হয়ে উঠছে দিন দিন। হাজার হাজার বাড়িঘর লাগবে। হলে বহু লোকজনের মাথা গোঁজার ঠাঁই হবে। তারা বন-জঙ্গল কেটেকুটে সাফ করবে। সবজি আনাজ ফসল লাগাবে। সমৃদ্ধ হবে কৃষি খাত। বনের হিংস্র জীবজন্তু মেরে কেটে জনজীবনের নিরাপত্তা দেবে। বেহুদা জীব-জানোয়ার বাঁচিয়ে লাভ কী? তারা মানুষখেকো। অন্য প্রাণীও উদরস্থ করে। বাঘে মানুষ খায়, জখম করে। বন্য হাতির গোদা পায়ের পাছড়া-পাছড়িতে পাবলিক অতিষ্ঠ। এরাও কিন্তু খুনি। মানুষ মেরে ক্ষান্তি। ফি-বছর ফসল নষ্ট করে এন্তার। এসব দর্পিত ঐরাবত আমদানি হয় আমাদের পিয়ারের দোস্ত ইন্ডিয়ার অভ্যন্তর থেকে। বিনা ভিসায়, বিনা পাসপোর্টে। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ আমাদের কিশোরী ফেলানীকে গুলি করে মেরে ফেলে। ঝুলিয়ে রাখে কাঁটাতারে। বিএসএফ কিন্তু মারকুটে হাতি বাহিনীকে আটকায় না। সেই মুরোদও অবশ্য নাই ওদের। বাংলাদেশ আজ বিপন্ন আর্ত রোহিঙ্গা মুসলমানদের ঠেকিয়ে দিচ্ছে। পুশ ব্যাক করছে। যারা ঠেকাচ্ছে, তারা কিন্তু দাদা দেশের বন্য হাতি দেখলে লেজ গুটিয়ে পালায়। কী বৈপরীত্য সেলুকাস!
hasanhafiz51@gmail.com

তালা-চাবির কারিগর


সুমন
সুমন
মুক্তাগাছা শহরে এসে যখন পৌঁছালাম, তখন সূর্য ঠিক মাথার ওপর। মাঝদুপুরেও মানুষের আনাগোনায় জমজমাট হয়ে আছে শহরের বাজারটি। খাবারের দোকানগুলোয় দারুণ ভিড়। অনেক খোঁজাখুঁজি শেষে পাওয়া যায় মুক্তাগাছার বিখ্যাত মণ্ডার দোকান। গোপাল পালের বিখ্যাত মণ্ডা দিয়েই হবে দুপুরের পেটপুজো—এমনটা ঠিক করেই মাঝদুপুরে মুক্তাগাছায় আসা। 
কিন্তু তা হয় না। শুধু মণ্ডা খেয়ে দুপুর পার করা মুশকিল। অনেক কিছু খাওয়ার পরও ভাত না খেলে মনে হয়, দিনটা বুঝি উপোসেই গেল। সস্তা, ভাঙাচোরা একটা হোটেলে গিয়ে ধোঁয়া ওঠা গরম গরম ভাত, কুমড়ো ভাজি আর কচি মুরগির রান চিবোতে গিয়েই পরিচয় হয় সুমনের সঙ্গে। ভালো খাবারের দোকানের হদিস দিয়ে তিনি সাহায্য করছিলেন আমাদের। সুমন তালা-চাবির কারিগর। বাজারের ফুটপাত নয়, একদম ঠিক পথের ওপর মাদুর বিছিয়ে বসে তিনি করেন তাঁর ব্যবসা। পথ দিয়ে যানবাহন গেলেও তাঁর দোকানের পাশ কাটিয়ে যেতে হয়। এ পথের তিনিই রাজা। 
ব্যবসাটা বহু দিনের। এলাকায় ভালো ছেলে বলে পরিচিত, তাই পথের মাঝখানে বসা দোকান নিয়ে নেই কারও কোনো অভিযোগ। ‘গরিব মানু। আমারে সবাই ভালা পায়। ভালা জায়গায় দোহান দেহার ট্যাকা কই পামু। রাশ্তাই ভরসা।’ পথের মাঝখানে কেন দোকান দেওয়া—এ প্রশ্নের জবাব এভাবেই দিলেন সুমন। সংসারে অভাব আছে তাঁর। তবে এ নিয়ে সারাক্ষণ দুঃখ করার মতো মানুষ নন তিনি। বিয়ে করেছেন অল্প বয়সেই। সংসারে আছে মা-বাবা, স্ত্রী আর এক ভাই। সবাইকে দেখে রাখার দায়িত্ব তাঁর। নিজে পড়াশোনা করেননি তেমন একটা। ভাইটা পড়াশোনা করে বড় চাকুরে হবে—এমনটাই স্বপ্ন সুমনের। একটু ভালো থাকার জন্য, একটু বেশি উপার্জনের জন্য রোদের ভেতরেও অনেকক্ষণ বসে থাকেন তিনি খদ্দেরের আশায়। তালা-চাবি নিয়ে কাজ করার নেশাটা হুট করেই পেয়ে বসে তাঁকে। এটাই যে জীবিকার একমাত্র উপায় হয়ে উঠবে, এমনটা ভাবেননি কখনো। অল্প সময়ের ভেতরেই ঝানু হয়ে উঠেছিলেন তালা-চাবির কাজে। প্রথম দিকে দোকান ছিল না। তাঁর কাজের সুনাম ছড়িয়ে পড়ায় বিপদে পড়লেই লোকজন ডাকত তাঁকে। লোকজনের উপকার করে ভালো লাগত খুব। কেউ কেউ তাঁর কাজে খুশি হয়ে বকশিশ দিত। বিয়ের আগ পর্যন্ত সংসারের সবকিছু বাবাই দেখত। চৌপর দিনভর পরিশ্রম করে সংসারটা চালাতেন তিনি। কিন্তু এখন সুমনই দেখছেন সব। বিয়ে করার পর মাথায় চেপে বসেছে অনেক দায়িত্ব। বাবারও বয়স হয়েছে বিশ্রাম করার। তাই নিজে থেকেই সুমন ধরেছেন সংসারের হাল। পথের ওপর দোকান দিয়ে শুরু করেছেন তালা-চাবির কারবার। আয় নেহাত মন্দ নয় সুমনের। তবে এ টাকায় পাঁচজনের সংসার চালানো খুব কঠিন। আগাগোড়া সুখী মানুষ সুমন জানান, বাড়ির সামনে অল্প একটু জায়গায় সবজির বাগান করেছেন তিনি। বউই করেন বাগান পরিচর্যার কাজ। অভাব কেটে যাবে একদিন, অভাবী কিন্তু আশাবাদী সুমনের মুখে এমন কথা শুনে ভালো লেগে যায় খুব। এমন অভাবে থেকেও তাঁর সুখী থাকার দারুণ ক্ষমতা দেখে হিংসাও হয় কিছুটা। আমরা কি ওর মতো অল্পতে তুষ্ট হতে পারি?
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয় একসময়। পড়ে যায় রোদ। বিদায় নেন সুমন। অল্প কিছু টাকা তাঁর হাতে তুলে দিতে চাইতেই প্রত্যাখ্যান করেন তিনি। শুধু দোয়া করতে বলেন। ভাইটা বড় চাকুরে হবে তার জন্য দোয়া, ঘরে নয়া অতিথি আসবে তার জন্য দোয়া, অসুস্থ মা-বাবার জন্য দোয়া। দোয়া করব এমন নিশ্চয়তা দিয়েই ফেরার পথ ধরি। ফেরার পথে চোখে পড়ে মুক্তাগাছার মস্ত নীল আকাশ। তার বুকে ঠাঁই নিয়েছে কচি-বুড়ো মেঘেদের দল। মুক্তাগাছার গুটিকয়েক ছেলে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে আকাশে। মেঘ কেটে কেটে উড়ছে ঘুড়িগুলো। নীলের পশ্চাদপটে তাদের দেখতে লাগছে বেশ। আকাশের এ নীল যেমন-তেমন নীল নয়, ময়ূরকণ্ঠী নীল। রাজধানীটা ছেড়ে বেরোলেই বড় বেশি চোখে পড়ে আকাশের এমন রং। পরিচিত হওয়া যায় সুমনের মতো সহজ-সরল কিছু মানুষের সঙ্গে।
কিঙ্কর আহ্সান

বুধবার, ২০ জুন, ২০১২

শ্রীশ্রী জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা



শি শি র র ঞ্জ ন দা স বা বু
২১ জুন বাংলা ৭ আষাঢ় শ্রীশ্রী জগন্নাথদেবের রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। মানুষের মাঝে সম্প্রীতি, শান্তি ও মৈত্রীর পরিবেশ গড়ে তোলার জন্যই শ্রী বিগ্রহ গণউত্সব লগ্নে মন্দির ছেড়ে রাজপথে সবাইকে দর্শন দানের জন্য বেরিয়ে আসেন। আন্তর্জাতিক কৃষ্ণ ভাবনামৃত সংঘের প্রতিষ্ঠাতা শ্রী প্রভুপাদ ১৯৬৫ সালে তার গুরুদেবের নির্দেশে পাশ্চাত্যে কৃষ্ণ ভাবনামৃত প্রচারের জন্য আমেরিকায় গিয়েছিলেন। সানফ্রান্সিসকোর হেইট অ্যামবেরিতে ভারতবর্ষের বাইরে প্রথম রথযাত্রা উদযাপন করেছিলেন হিন্দু ধর্মমতে। সব জগতের পরম প্রভু হচ্ছেন শ্রী জগন্নাথদেব। ভক্তদের প্রেমের বশবর্তী হয়ে তিনি নিজেকে রাজপথে নিয়ে যাওয়ার জন্য ভক্তদের অনুমতি দিয়েছেন। শ্রী জগন্নাথদেব অত্যন্ত কৃপাশীল। যারা মন্দিরে তাকে দর্শন করতে আসে না, তাদের সবাইকে কল্যাণ ঐক্য কৃপা আশীর্বাদ করতে তিনি মন্দির থেকে বেরিয়ে আসেন। একবার শ্রীকৃষ্ণ, বলরাম ও সুভদ্রাদেবী সূর্যগ্রহণের কুরুক্ষেত্রে সামন্ত পঞ্চতক তীর্থে স্নান করতে যান। এখনও কুরুক্ষেত্রে সূর্যগ্রহণের সময় স্নান করতে বহু পুণ্যার্থী গমন করেন। পাঁচ হাজার বছর আগে শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকা থেকে গিয়েছিলেন কুরুক্ষেত্রে। শুনে সঙ্গে সঙ্গে তারা ছুটলেন কৃষ্ণকে দর্শন করতে। কৃষ্ণ তখন রথে উঠে বলেছেন, তিনি কুরুক্ষেত্র থেকে তার রাজধানী দ্বারকায় ফিরে যাবেন। সঙ্গে রয়েছেন শ্রী বলরাম ও সুভদ্রা। চারপাশে রাজপুরুষ, সৈনিক, কৃষ্ণের বেশও অন্যরকম। গোপবেশের পরিবর্তে রাজবেশ। হাতে বাঁশির পরিবর্তে ধনুর্বাণ। কোমরে তলোয়ার/বর্ম, মাথায় মুকুট। কৃষ্ণকে এভাবে দেখে গোপাদের মন ভরল না। বিশেষ করে রাধারাণী বললেন, এই কৃষ্ণ আমাদের সেই কৃষ্ণ নয়। তাকে আমরা চিনতাম, বৃন্দাবনের বনে বনে আমাদের সঙ্গে সে লীলা খেলা করত। সেই কৃষ্ণের মাথায় ময়ূরের পাখা, তার পরণে পীত বসন, গলায় বনমালা, হাতে বাঁশি আর এই কৃষ্ণের পরণে তো রাজবেশ। রাধারাণীর সেই মনোভাব বুঝতে পেরে বাজবাসীরা কৃষ্ণের রথের দড়ি ধরে। কৃষ্ণের রথের ঘোড়াগুলো ধরে টানতে টানতে নিয়ে চললেন বৃন্দাবনের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে বলরাম, তিনিও ব্রজবাসীদের শৈশবের, কৈশোরের সাথী। তাকেও রথে চড়ালেন। সুভদ্রা বোন, তাকেও তারা নিয়ে চললেন। জগন্নাথপুরীর এই রথযাত্রাটি হচ্ছে গোপাদের সেই কুরুক্ষেত্র রথযাত্রার দ্যোতিক। রথের সময় জগন্নাথ বা কৃষ্ণকে নিয়ে যাওয়া হয় নীলাচল থেকে সুন্দরাচলে। যেখানে কৃষ্ণ ব্রজবাসীদের সঙ্গে আট দিন ছিলেন। এই হচ্ছে রথযাত্রার ইতিহাস। শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু ভাবতেন—‘কৃষ্ণ, কতদিন ধরে আমি তোমায় দেখতে চেয়েছি। আর এখন আমি তোমাকে দর্শন করছি।’ শ্রী প্রভুপাদ বলেছিলেন, ‘বাঁ পাশে একদল, ডান পাশে একদল, সামনে একদল এবং পেছনের দিকে একদল, আর শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু মাঝখানে থাকতেন। তারা সবাই নাচতেন এবং কীর্তন করতেন। রথযাত্রার সময় ভগবান শ্রীজগন্নাথদের স্বয়ং আমাদের সামনে উপস্থিত হন। তাই এটি এমনই সুন্দর সুযোগময় একটি উত্সব, যার মাধ্যমে আমরা ভগবানের প্রতি আমাদের হৃদয়ের ভক্তি ও প্রেম নিবেদন করতে পারি। রথযাত্রার দিন রথরূঢ় পরমেশ্বর ভগবান শ্রী শ্রী জগন্নাথদেব বলদেব ও সুভদ্রাদেবীকে দর্শন করে আপনার হৃদয়ের ভক্তি নিবেদন করুন, রথের রশি ধরে টানুন। ভগবানের প্রসাদ গ্রহণ করুন এবং আপনার মানব জন্মকে সার্থক করে তুলুন।
বাংলা ১০৭৯ সনে ধামরাইয়ে রথযাত্রা উত্সব হয়। ১১০৪ সন থেকে ১৩৪৪ সন পর্যন্ত মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ার বালিয়াটির অমর নারায়ণ রায় চৌধুরী ও ব্রজেন্দ্র কুমার রায় চৌধুরীর মতো জমিদাররা চারটি রথ তৈরি করে দেন। সর্বশেষ রথটি ছিল ৬৭ ফুট দীর্ঘ ও ৫৪ ফুট প্রস্থ, চার তলাবিশিষ্ট। প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় চার কোনায় চারটি করে প্রকোষ্ঠ ছিল। এই প্রকোষ্ঠগুলোকে নবরত্ন বলা হতো। খচিত ছিল দেবদেবীর মূর্তি। সূক্ষ্ম কারুকার্য করা সুউচ্চ এ রথ দেখার জন্য বিভিন্ন দেশের পর্যটক ভিড় জমাতেন। রথ টানার সময় প্রায় ২৭ মণ পাটের কাছি দরকার হতো। রথটি পাক বাহিনী পুড়িয়ে দেয়। এরপর দুই বছর বাঁশের তৈরি রথ দিয়ে রথযাত্রা পালিত হয়। স্বাধীনতার পর টাঙ্গাইলের দানবীর রণদা প্রসাদ সাহার মেয়ে শ্রীমতি জয়াপতি সাহাসহ দানশীল ব্যক্তিদের সহায়তায় তৈরি করা হয় শ্রী শ্রী যশোমাধবের রথ। ২০০৬ সালে রথযাত্রা উপলক্ষে বিশেষ অতিথি হিসেবে তত্কালীন ভারতীয় হাইকমিশনার বীণা সিক্রি ভারত সরকারের পক্ষ থেকে রথটি পুনর্নির্মাণের ঘোষণা দেন। মোট ব্যয় ধরা হয় ৭৮ লাখ টাকা। ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে আদি রথটির আদলে পুনর্নির্মাণ কাজ শুরু হয়। প্রথমে লোহার পাত দিয়ে ৩৭ ফুট দৈর্ঘ্য ও ২০ ফুট প্রস্থ তিন তলাবিশিষ্ট রথের অবকাঠামো তৈরি করা হয়। এরপর লোহার পাতের ওপর সেগুন কাঠের প্রলেপ দিয়ে সম্পূর্ণ ঢেকে দেয়া হয়েছে। কাঠের ওপর চলছে বিভিন্ন নকশার সূক্ষ্ম কারুকাজ। রথের প্রতি তলায় খচিত হয়েছে দেবদেবীর মূর্তিচিহ্ন। ১৫ চাকাবিশিষ্ট। ঢাকা মহানগরীতে ইসকনের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত বার্ষিক রথযাত্রা মহোত্সবটি নিঃসন্দেহে শ্রী জগন্নাথপুরী ধামের পরই বৃহত্তম অনুষ্ঠান। বরাবরই ঢাকা শহরের মানুষ এই রথযাত্রা উত্সবে আন্তরিকভাবে সাড়া দিয়ে থাকেন এবং তার ফলেই এই উত্সবটিকে তাদের নিজেদের শহরের ঐতিহ্যরূপে আপন করে নিতে পেরেছেন। পরম আনন্দের বিষয়। এখন শুধু পুরী ঢাকায় নয়, সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এই ইসকন রথযাত্রা মহাসাড়ম্বরে পালিত হয়ে আসছে। জগন্নাথদেবের রথযাত্রা সনাতন ধর্মাবলম্বী হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম বড় ধর্মীয় উত্সব। রথের চাকার পবিত্র ঘূর্ণনে মুছে যাক সব অন্ধকার। দূর হয়ে যাক অন্যায়-অশান্তি। মহালা লোকে পূর্ণ হোক ধরিত্রী। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে গড়ে উঠুক অসাম্প্রদায়িকতার বাতাবরণ। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও ধর্মীয় ভক্তিবিশ্বাস আমাদের ঐতিহ্যের সম্প্রীতিকে আরও সমুন্নত করে তুলুক। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। যুগ যুগ ধরে এ দেশে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ তাদের নিজ নিজ ধর্ম অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে পালন করে আসছে। এই পুণ্যময় রথযাত্রার মধ্য দিয়ে সমাজে সম্প্রীতির বন্ধন আরও মজবুত হবে। সাফল্য বয়ে আনবে আমাদের জাতীয় জীবনে। আমার এদেশ সব মানুষের—হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান। দেশমাতা সবার। এ প্রত্যাশা আজকের এ দিনে।
লেখক : ধর্মীয় সংগঠক, কলামিস্ট

রথযাত্রা : ইতিবৃত্ত ও তাৎপর্য



॥ পলাশ কুমার রায় ॥

প্রতি বছর আষাঢ় মাসে জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে অনেক মন্দিরে মেলা বসে। বাংলাদেশের বড় রথযাত্রাটি হয় ঢাকার ধামরাইয়ে শ্রীশ্রী যশোমাধব মন্দির থেকে। প্রায় ৩০০ বছরের পুরনো এই মন্দিরে রয়েছে যশোমাধবের বিগ্রহ। ওই সময়কার জমিদার যশোরাজ পাল বিগ্রহটিকে মন্দিরে স্থাপন করেন। তার পর থেকে এই মন্দিরে নিয়মিত শ্রীশ্রী যশোমাধবের পূজার্চনা হয়ে থাকে। ভগবান জগন্নাথদেব হলেন শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং, যিনি জগতের নাথ বা জগদীশ্বর রূপে প্রকাশিত।
বৃন্দাবন ত্যাগ করে মহারাজ নন্দসূত শ্রীকৃষ্ণ তার দ্বারকালীলায় রত হলেন। সূর্যগ্রহণ উপলক্ষে শ্রীকৃষ্ণ যখন কুরুক্ষেত্রে যান, তখন তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বলরাম ও ভগিনী সুভদ্রা এবং দ্বারকা থেকে অনেকেই তার সাথে গিয়েছিলেন। সেই সময় ব্রজবাসীও সূর্যগ্রহণ উপলক্ষে কুরুক্ষেত্রে গিয়েছিলেন। কুরুক্ষেত্রে বৃন্দাবনের গোপ-গোপীদের সাথে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সাক্ষাৎ হলো। ব্রজবাসী ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে তার বাল্যলীলাস্থল বৃন্দাবনে ফিরিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। তারা তাকে রাজবেশে দেখতে চাইলেন না। তারা শ্রীকৃষ্ণকে বৃন্দাবনে ফিরিয়ে নিয়ে ব্রজের বেশে দেখতে চাইলেন এবং তার সাহচর্য পেতে উন্মুখ হলেন। তখন ব্রজবাসী কৃষ্ণ, বলরাম ও সুভদ্রা দেবীর রথের ঘোড়া ছেড়ে দিয়ে নিজেরাই রথ টানতে টানতে বৃন্দাবনে নিয়ে গেলেন। সে ঘটনা স্মরণ করে ভক্তরা আজো পুরীর জগন্নাথ মন্দির থেকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে রথে টেনে বৃন্দাবনে নিয়ে যান। দ্বারকা রাজ্য যেমন শ্রীকৃষ্ণের ঐশ্বর্যলীলার স্থান, বৃন্দাবন তেমনি মাধুর্যলীলার স্থল। 
রথযাত্রার উৎসবে অংশ নেয়ার মানে হলো আত্মোপলব্ধির পথে এক ধাপ অগ্রসর হওয়া। রথযাত্রা শ্রীকৃষ্ণের অন্যতম লীলা। হিন্দুধর্মের বিশ্বাসমতে, এই উৎসবে অংশ নেয়ার অর্থ হলো সরাসরি কৃষ্ণের সংস্পর্শে আসা। যারা মন্দিরে এসে ভগবানকে দর্শন করেন না, তাদেরকে দর্শন দেয়ার জন্য ভগবান জগন্নাথদেব ভক্ত পরিবেষ্টিত হয়ে নিজেই পথে বের হন। রথোপরি ভগবান জগন্নাথ দেবের একবার দর্শনেই জন্ম-মৃত্যুর পুনরাবর্তন রোধে অগ্রগতি লাভ হয়। কেউ যদি রথের রশি ধরে টানে বা রথ স্পর্শ করে অথবা রথোপবিষ্ট বিগ্রহকে দর্শন করে, তাহলে তার মুক্তি সুনিশ্চিত। এই জন্ম-মৃত্যুর চক্র থেকে অব্যাহতি লাভ করতে হৃদয়ে অবস্থিত সুপ্ত কৃষ্ণভক্তিকে পুনর্জাগ্রত করতে হবে। 
আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সঙ্ঘ (ইস্কন)-এর প্রতিষ্ঠাতা শ্রীকৃষ্ণের একজন শুদ্ধ ভক্ত হিসেবে পৃথিবীর প্রায় সব নগর-গ্রামে রথযাত্রা উৎসব পৌঁছে দিয়েছেন। লন্ডন, প্যারিস, নিউ ইয়র্ক, সানফ্রান্সিসকো, সিডনিসহ বিশ্বের অনেক স্থানে রথযাত্রা উৎসব উদ্যাপিত হচ্ছে।
আজ ঢাকার স্বামীবাগ ইসকন মন্দির থেকে বিকেল ৪টায় রথ শোভাযাত্রা শুরু হয়ে তা ঢাকেশ্বরী মন্দিরে গিয়ে শেষ হবে। সপ্তাহান্তে উল্টো রথযাত্রা ইসকন মন্দিরে গিয়ে শেষ হবে। এবারের রথযাত্রায় লাখো মানুষের সমাগম হবে মর্মে আয়োজকেরা জানান। এই উৎসব ও শান্তিপূর্ণ শোভাযাত্রা সাফল্যমণ্ডিত হোক, এই প্রার্থনা। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আমাদের সবার পাপ-পঙ্কিলতা ক্ষমা করুন, দেশের অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ দূর করে শাসকগোষ্ঠীর হৃদয় কোমলকরত ন্যায়ানুগ পদ্ধতিতে দেশ পরিচালনার শক্তি ও ধৈর্য দিন, আমাদের আদর্শ নাগরিক হওয়ার মানসিকতা তৈয়ার করে দিন, আজকের দিনে এই শুভ প্রার্থনা করি মহান স্রষ্টার কাছে। 
লেখক : আইনজীবী, ঢাকা 
palashroy2012@yahoo.com

মঙ্গলবার, ১৯ জুন, ২০১২

কালো হরফে বন্দি একটি কাল, একটি সত্য


মুস্তাফা জামান আব্বাসী
তাহলে সত্যজিৎ রায় কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ? এই জন্য যে, 'পথের পাঁচালী' অর্থাৎ পথের গানেই আছে জীবনের কথা, যার অপর নাম দীন। ওই যে রেলগাড়িটি মাঠের মধ্যে 'ঝিক' 'ঝিক' শব্দ করে বেরিয়ে গেল চোখের সামনে দিয়ে, চিরায়ত বাংলার পটভূমিতে অপুর জীবনের ট্রিলজি, মুহূর্তে যা চিনিয়ে দিল না বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ চিত্র নির্মাতাকে, এর সঙ্গে চিরায়ত মানুষকে।
জানতে হবে মানুষই দীন, দীনই মানুষ

কলকাতায় অক্সফোর্ড বুক স্টোরে মাঝে মধ্যে যাওয়ার সুযোগ পাই। অনেক দিন আগের কথা। একটি বই খুব ভালো লাগছিল পড়তে। সামনেই শালপ্রাংশু সত্যজিৎ। খানিকক্ষণ তাকিয়েই থাকতে হলো। বললাম :আপনিই...? বললেন, হ্যাঁ, আমিই। অটোগ্রাফ আমার জন্য নয়, মেয়ে শারমিনীর। সই হয়ে গেলে পরিচয় দিলাম। বললেন, আমরা উন্মুখ হয়ে থাকি কখন বাংলাদেশ টিভির প্রোগ্রাম হবে! বিশেষ করে নাটক ও লোকসঙ্গীতের অনুষ্ঠান। বললেন, শিগগিরই আসছি। এলে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব। এসেছিলেন কয়েকবার, যোগাযোগ হয়নি।
ওই বইয়ের দোকানেই অনেক দিন পরে, বিজয়া রায়ের লেখা 'আমাদের কথা' বইটি সংগ্রহ করে উপহার দিই আসমাকে। আবিষ্কৃৃত সত্যজিৎ-বিজয়া। বইটি না পড়লে সত্যজিৎ রায়কে পুরোপুরি চিনতে পারতাম না। এ কারণেই বলে থাকি যে, কালো হরফের লেখায় বন্দি কথাগুলোই চেনাতে পারে একটি মানুষ, একটি কাল, একটি সত্য। এমন বর্ণময়, আলোকময়, চিত্রময় জীবনযাপনের কথা আর পড়িনি। পারস্পরিক সম্মান, ভালোবাসা নিয়ে গড়ে উঠেছিল যে সংসার, তা আজ কিংবদন্তি। সংসার অবশ্যই সুখের হয় রমণীর গুণে; সে রমণী যদি হন বিজয়া।
রবীন্দ্রনাথ ভিক্টোরিয়াকে ভালোবেসেছিলেন কিনা মুখ ফুটে বলেননি; 'বিজয়িনী' কবিতায় সে ভালোবাসা এসে দেখা দিয়েছে। প্রবাদপ্রতিম চলচ্চিত্র স্র্রষ্টার জীবনসঙ্গিনী বিজয়ার কাছে পেয়েছি জানা-অজানা কাহিনী, স্মৃতি-বিস্মৃতির জগৎ থেকে তুলে আনা মানিকের প্রেরণার ইতিবৃত্ত। বাংলার মানিক কী করে হলেন পৃথিবীর সত্যজিৎ_ সেই অকপট স্বনিষ্ঠ বিস্তারিত ৫৭৪ পৃষ্ঠার গল্প যে পড়েনি, বড়ই দুর্ভাগা সে। ৮৪ বছর বয়সে কেউ কলম হাতে নিয়েছেন_ এমন ঘটনা জানা নেই। বিজয়া রায় যখন একবার শুরু করেছেন, শেষ অবধি টেনেছেন তার নিজের ও মানিকের গল্প। তার নিজের গল্প আমার কাছে মনে হয়েছে অবিশ্বাস্য। প্রায়শ পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন মানিক। ঘটনাবহুল জীবনের আশাবাদী দিকটি চিরকাল ছিল অক্ষুণ্ন। তাই বাল্য-কৈশোর-যৌবন-প্রৌঢ়ত্ব-বার্ধক্য ও লেখিকা জীবনের অমরত্ব_ সব মিশে আছে এই গ্রন্থে। একেকটি পাতা পড়ছি আর বন্ধ করে অনেকক্ষণ ভেবেছি। এত সুন্দরও জীবন হয়! কাকা-ছোট পিসি-সানিদা-বাবা-কাকামণি-মেজদি-মানুদা-বড়দি-সরস্বতীদি-মেজপিসি-বড়পিসি-মানিক ঠাকুমা (কোলে মন্টু)-খুড়ি মা (কোলে বাচ্চু)-মা-সেজদি-আমি। যেন ছবিতেই নয়, সামনেই দেখতে পাচ্ছি। এমন অনুভব তারই হবে, যে বিজয়া-সত্যজিতের সঙ্গে মিশে যাবে।
'...পাটনার বাড়িটি ছিল ভারি সুন্দর লাল ইটের বাংলোবাড়ি, নাম ছিল লিলি ভিলা, কুয়োর পাশে আমাদের বড় আদরের দুটো গাছ কুল ও পেয়ারা। ওই পেয়ারা গাছে চড়ে কত যে পেয়ারা চিবিয়েছি তার শেষ নেই। কুল গাছটায় হতো মিষ্টি নারকোলি কুল। বারান্দার দু'পাশে দুটো বড় গাছ, একটা আম অন্যটা নিম। নিমগাছে মালি একটা দোলনা টাঙিয়ে দিয়েছিল, কত দোল খেয়েছি ওই দোলনায়, আর আম গাছের কচি আম পেড়ে তেল নুন লঙ্কা দিয়ে মেখে ছুটির দিনে বই পড়তে পড়তে খেয়েছি, সে কথা ভাবলে এখনো জিভে জল এসে যায় ...'।
মানিকের সঙ্গে যখন ঘনিষ্ঠতা শুরু, সে এক মজার কাহিনী। সেই গাল-ফোলা মানিকের গাল ভেঙে এখন মুখটা লম্বা হয়ে গেছে, আর ওর দিকে তাকাতে গেলে মুখটা অনেকখানি তুলতে হয়। বাইশ বছরের মানিকের ছবি সংগ্রহ করেছি, পাঠকদের উপহার দিলাম। রাসবিহারী এভিনিউর বাড়িতে বিজয়াকে আমি যেন কোথায় দেখেছি।
শান্ত সোনালি আল্পনাময় অপরাহ্নের শেষে আসমাকেও আমি দেখেছিলাম একই দৃষ্টিতে। মন্টু ভাইকে (মুস্তাফা মনোয়ার) গিয়ে বললাম, এই মেয়েটিকে আমার পছন্দ। মন্টু আমার দিকে তাকালো। বলল, ভারি মিষ্টি। কোথায় পেলে? সে খুঁজে বেড়াচ্ছে, কাউকে পায়নি। বললাম, এর একটি পেন্সিল স্কেচ এঁকে দাও। পরদিন একসঙ্গে পেন্সিল স্কেচে অনিন্দ্যসুন্দরী আবির্ভূতা। বিজয়ার কাহিনী পড়ছি আর মনে মনে অবাক হয়ে যাচ্ছি। বার্লিন যাওয়ার সময় দমদম এয়ারপোর্টে হাজির সুপ্রিয়া, উত্তম কুমার, মানিক ও বিজয়া। এরা বাঙালির কাছে মহার্ঘ্য শুধু ছবিতেই নয়, কল্পনাতেও।
কোন পাতা ছেড়ে কোন পাতার কথা বলব। সব পাতা লজেন্সের মতো। অল্প করে যেমন লজেন্স ছোটবেলায় খেতাম! খানিকটা লুকিয়ে রাখতাম, পরে ওদেরকে দেখিয়ে দেখিয়ে খেতাম; এ বইও তেমনি।
একজন মুসলমান হিসেবে আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ, যা আমাকে দীনের কাছাকাছি আনবে। যা আনবে না, তার জন্য সময় ব্যয় করব না। তাহলে সত্যজিৎ রায় কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ? এই জন্য যে, 'পথের পাঁচালী' অর্থাৎ পথের গানেই আছে জীবনের কথা, যার অপর নাম দীন। ওই যে রেলগাড়িটি মাঠের মধ্যে 'ঝিক' 'ঝিক' শব্দ করে বেরিয়ে গেল চোখের সামনে দিয়ে, চিরায়ত বাংলার পটভূমিতে অপুর জীবনের ট্রিলজি, মুহূর্তে যা চিনিয়ে দিল না বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ চিত্র নির্মাতাকে, এর সঙ্গে চিরায়ত মানুষকে। জানতে হবে মানুষই দীন, দীনই মানুষ।
'পথের পাঁচালী' (১৯৫৫), 'অপরাজিত' (১৯৫৬) এবং 'অপুর সংসার' (১৯৫৯) শুধু ক্যান ফেস্টিভ্যালে মনুষ্যজীবনের শ্রেষ্ঠ ডকুমেন্টারি হিসেবে ও ১১টি আন্তর্জাতিক পুরস্কারে বিভূষিত হয়নি; জানিয়েছে সারা পৃথিবীর মানুষের মধ্যে এক ঐক্যের কথা। উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর পুত্র, সুকুমার রায়ের সুপুত্র তার ব্রাহ্মজীবনের পাঁচালি প্রকাশ করেননি এই ট্রিলজিতে, বরং সারা পৃথিবীকে জানিয়েছেন বাঙালি মানসের পরম সত্য_ 'সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই'।
সারা পৃথিবী সত্যজিৎকে একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালির মর্যাদা দিয়েছে; সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের পরেই। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ তাকে আনন্দিত করেছিল, কিন্তু তা নিয়ে যায়নি তাকে একটি শিল্পকর্মের দিকে। রিফিউজিদের দুঃখ-কষ্ট তার মনে প্রভাব ফেলেছিল, সোশিয়ালিজমের দিকে তার গন্তব্য ছিল না, বরং রবীন্দ্রনাথের মতোই তিনি ছিলেন একজন এলিটিস্ট। 'পথের পাঁচালী' ট্রিলজিতে যে দারিদ্র্যের ছবি তিনি এঁকেছেন তা তার নিজের দেখা। চিত্রতারকা নার্গিস তার সমালোচনা করে বলেছেন যে, রায় ভারতের দারিদ্র্য রফতানি করেছেন, আধুনিক ভারত নয়। 'সতরাঞ্জ কি খিলাড়ি'তে অযোধ্যার নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ তার ওপর ভর করেছেন। এগিয়ে এসেছেন সায়িদ জাফরি, আমজাদ খান, শাবানা আজমি, রিচার্ড অ্যাটেনব্যুরো। রবীন্দ্রনাথকে, তার বাবা সুকুমার রায়কে নিয়ে তার ডকুমেন্টারি, সুনীলের লেখা 'অরণ্যের দিনরাত্রি'_ চার যুবকের অ্যাডভেঞ্চার; এর পরে 'প্রতিদ্বন্দ্বী', 'সীমাবদ্ধ' ও 'জনারণ্য' সেলুলয়েডে এনেছেন নতুন নতুন নিরীক্ষা।
বিজয়ার জীবনে হঠাৎ এলো কালো মেঘের বিষণ্নতা নিয়ে মাধবী। সত্যজিৎ তাকে ভালোবেসেছিলেন কিনা, বইতে লেখেননি বিজয়া। কষ্ট পেয়েছেন; মুখ বুজে সয়ে নিয়েছেন সে কষ্ট। রবীন্দ্রনাথের জীবনে প্রেমের অধিষ্ঠাত্রী দেবী একজনই। তার নাম কাদম্বরী। একজনই ব্যতিক্রম, যিনি সমর্পিত শুধু প্রমীলায়, তার নাম নজরুল। নার্গিস-কানন-ফজিলাতুন্নেছার কাছে ক্ষণিকের অতিথি।

মুস্তাফা জামান আব্বাসী :সাহিত্য-সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব
mabbasi@dhaka.net

চলচ্চিত্রের হালচিত্র



মনিরুজ্জামান মনির
চলচ্চিত্র একটি শক্তিশালী গণবিনোদন মাধ্যম। এই চলচ্চিত্রে আছে সপ্তকলা বা Seven Arts-এর সমাহার। যুগে যুগে চলচ্চিত্র, আমাদের দেশে সাধারণে পরিচিত। ফিল্ম বা সিনেমা দর্শকদের টেনে নিয়ে গেছে সিনেমা হলে। সিনেমার সেলুলয়েডের পর্দায় দৃশ্যমান হয়েছে নৃত্য, সঙ্গীত, কাহিনীসমৃদ্ধ চলমান জীবনচিত্র। মাইক্রো বিজ্ঞানের কল্যাণে মনোরঞ্জনের অনেক মাধ্যম নতুন নতুন সহজলভ্য বলে আবিষ্কৃত হলেও চলচ্চিত্রের চাহিদায় বিঘ্ন ঘটেনি কখনও বরং উত্তরোত্তর এর আকর্ষণশক্তি বাড়ছে বলা যায়। তবে এর নির্মাণশৈলীতে আধুনিকত্ব, কাহিনীতে ব্যতিক্রমতা দর্শকদের সম্মোহিত করে আনন্দিত করে বিশ্বজুড়ে। আমাদের দেশের চলচ্চিত্রের ধারা কখনও একই গতিতে প্রবাহিত হয়নি। দেশের অর্থনৈতিক-ব্যবসায়িক সচ্ছলতা রাজনৈতিক স্থিতি অবস্থার উপর অনেকটা নির্ভর করে চলচ্চিত্র নির্মাণে আধিক্য। তবে এর পাশাপাশি চলচ্চিত্রের মন্দ-ভালো আকর্ষণীয় কিনা সেদিকটাও বিবেচ্য হয়ে থাকে। তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন বা এফডিসি থেকে ফিল্ম নির্মাণ হয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। যে এফডিসির প্রধান ফটকে ঝুলছে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের পাথরে খুদাই করা ছবি যা মোটেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এখানে অন্যান্য দেশের স্টুডিওর মতো সিনেমা সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তিত্ব যেমন : আমাদের দেশের প্রথম সবাক চলচ্চিত্রের চিত্র পরিচালক আবদুল জব্বার খান বা কিংবদন্তী চিত্র পরিচালক জহির রায়হানের স্থাপত্য নিদর্শন থাকলে মানানসই হতো। অতি সম্প্রতি সরকার কর্তৃক এফডিসি স্বীকৃত হয়েছে শিল্প বা ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে। অথচ এফডিসি কোনো চলচ্চিত্র প্রশিক্ষণের বা চলচ্চিত্রের মান নিয়ন্ত্রক সরকারি প্রতিষ্ঠান নয়। তবে চলচ্চিত্র নির্মাণের পর সেন্সরবোর্ড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে চলচ্চিত্র জমা দিতে হয়। সেখানে চলচ্চিত্রে অশ্লীলতা বা সরকারের বিরুদ্ধে কোনো দৃশ্য চিত্রায়ন করেছে—এমন কোনো বিষয়ের তারা সেন্সর করে থাকে। কিন্তু মান নির্ণয় করে না। আসলে আমাদের দেশে প্রতিবেশী দেশ ভারতের মতো সামগ্রিকভাবে চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রশিক্ষণের কোনো সরকারি ইনস্টিটিউট নেই। আমার এটা বোধগম্য নয়, সরকার এ বিষয়ে উদাসীন কেন? তথ্য মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে এ বিষয়ে কোনো প্রকল্প কি গ্রহণ করা যেত না? এফডিসি শুধু সরকারি নিয়মনীতির ভিত্তিতে চলচ্চিত্র নির্মাণে কাঁচামাল (ফিল্ম) দিয়ে থাকে। শুটিংয়ের জন্য বিশাল আকৃতির ফ্লোর, ক্যামেরা, এডিটিংয়ের যন্ত্র, কক্ষ, ডাবিং থিয়েটার, নেপথ্য সঙ্গীত সংযোজনের জন্য সাউন্ড কমপ্লেক্স, চিত্র পরস্ফুিটন ও মুদ্রণের জন্য কালার ল্যাব ভাড়া দেয়া হয়। বলা যায় সরকার এখানে বেসরকারি ফিল্মের প্রযোজক বা মালিকদের সঙ্গে ব্যবসা করে থাকে। তবে চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য এফডিসিতে নিবন্ধন প্রক্রিয়া আছে। সেখানে নির্মিতব্য ছায়াছবির সারাংশ (স্ক্রিপ্ট) জমা দেয়ার বিধান রয়েছে। তবে আজ পর্যন্ত শোনা যায়নি কোনো ছবি নির্মাণের অযোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছে। সেখানে সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তা নামক একটি বিরাট বহর আছে। আর আছেন প্রতিষ্ঠানের প্রধান একজন এমডি। আওয়ামী সরকারের বর্তমান শাসনকালে আগের ধারাবাহিকতায় চুক্তিবদ্ধ নিয়োগ দেয়া হয়েছে দলীয় সমর্থিত নাট্য অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়কে। আগে দেয়া হয়েছিল বাংলাদেশ টেলিভিশনের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং হালের সাংস্কৃতিক কিছুটা রাজনৈতিক নেতা ম. হামিদকে। আমি আগেই উল্লেখ করেছি এফডিসি নাটক, বা চলচ্চিত্রের মান নিয়ন্ত্রণ করে না। সে শুধু চলচ্চিত্র নির্মাণে কারিগরি সুবিধা ভাড়ার মাধ্যমে দিয়ে থাকে। এখানে শুধু একজন সরকারি আমলা, সু-প্রশাসকের প্রয়োজন। লোকমুখে শোনা যায় এফডিসিতে নাকি দুর্নীতি নামক ‘কালো বিড়াল’টি ঢুকে পড়েছে। এফডিসির পার্চেজ কমিটি, লাভজনক সব কমিটিতে দলীয় সমর্থিত কর্মকর্তা এবং সিনেমা সংশ্লিষ্ট লোকজনের নাম অন্তর্ভুক্ত আছে বলে শোনা যায়। সেই পার্চেজ কমিটি ডিজিটাল যুগে ৭০ দশকের সাউন্ড, ক্যামেরা, এডিটিং ল্যাবরেটরির এনালগ যন্ত্রপাতি কেনার জন্য সুপারিশ করেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। বর্তমানে এফডিসি থেকে ৪০০ ফিটের একটি নেগেটিভ ক্যানের সরকারি ক্রয়মূল্য ১৬ হাজার ৭শ’ টাকা অথচ বাজারে এর বেসরকারি মূল্য ১৪ হাজার টাকা। এতে কি সরকার ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না? এফডিসির ৯টি শুটিং ফ্লোরের মধ্যে ৮টি ফ্লোরই বরাদ্দ দেয়া হয়েছে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলকে, যেখানে তারা নাটকসহ অন্যান্য টিভি অনুষ্ঠান নিয়মিত ধারণ করছে। সিনেমা শুটিং করার লক্ষ্যে নির্মিত স্টুডিওগুলো চিত্র পরিচালকরা বরাদ্দ চেয়ে পাচ্ছেন না। একজন পরিচালক সমিতির প্রধান এবং খ্যাতিমান চিত্র পরিচালক জানিয়েছেন, তিনি নাকি এমডি সাহেবকে এফডিসির নাম পরিবর্তন করে এমডিসি রাখার প্রস্তাব দিয়েছেন। এমডিসির পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা হলো মিডিয়া ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন।
৯০ দশক এবং তার পরবর্তী দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত চলচ্চিত্রের ব্যবসা ছিল রমরমা। তার পরেই সেই ব্যবসায় নামে অকস্মাত্ ধস। চলচ্চিত্র ব্যবসা যখন মন্দা, দর্শকরা যখন সিনেমা হল থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে এবং অধিক মুনাফা নিশ্চিত লাভের আশায় রাজধানী এবং রাজধানীর বাইরে সিনেমা হলগুলো ভেঙে মার্কেট শপিংমল করা হচ্ছে, তখন চলচ্চিত্র মহলের দুর্বলতার সুযোগে অবতীর্ণ হলেন ত্রাণকারী হয়ে একটি টিভি চ্যানেলের প্রধান। যে চ্যানেলের জন্ম প্রতিবেশী দেশের আশীর্বাদেপুষ্ট হয়ে এবং এর বেড়ে ওঠাতে বর্তমান সরকারের আনুকূল্য প্রেরণা যুগিয়েছে বহুদিন থেকে। আলোচিত চ্যানেলটি চলচ্চিত্রে প্রতিবেশী দেশের আগ্রাসনে কীভাবে সহযোগিতা করা যায় সেই পথ আবিষ্কার করেছে বহুবার। এদেশে সিনেমা হল সমিতির সঙ্গে সেই চ্যানেলটিও ভারতীয় বাংলা, হিন্দি ছবির উত্সব করেছে সব প্রতিবাদ উপেক্ষা করে। আমাদের দেশের অনেকটা বেকার পরিচালককে নিয়ে সংক্ষিপ্ত বাজেটে তৈরি করল একের পর এক ছবি। সেই ছবিগুলো বাংলাদেশের হলগুলোতে মুক্তি দিল না লাখ লাখ টাকা গচ্চা যাওয়ার ঝুঁকি হতে পারে বলে। তারা নিয়মিত প্রয়োজনীয় অ্যাড সংগ্রহের মাধ্যমে নিজস্ব টিভি চ্যানেলে ওই ছবিগুলো মুক্তি দিল। এতে তাদের ছবি নির্মাণ ব্যয় সংরক্ষিত হলো আবার মুনাফাও হলো। আমি আগেই বলেছি এ করে টিভি দর্শক বৃদ্ধি পাবে। সিনেমা হলে দর্শক বৃদ্ধি করতে হলে শিল্পসম্মত ছবি বা বাণিজ্যিক ছবি অধিকসংখ্যক সিনেমা হলে মুক্তি দিতে হবে। আমি আশা করব চলচ্চিত্র শিল্পকে বর্তমান সঙ্কট থেকে উঠে দাঁড়াতে সরকার ও চলচ্চিত্রপ্রিয় বিত্তবান মানুষেরা আরও এগিয়ে আসবেন, আরও সক্রিয় হবেন।
monirlyric@gmail.com

সোমবার, ১৮ জুন, ২০১২

ঘুরে এলাম ইবনে বতুতার দেশ মরক্কো

মোহাম্মদ কায়কোবাদ


বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থীদের বিশ্বমানের প্রোগ্রামিং-নৈপুণ্যের ওপর ভর করে বিদেশে আর কম বেড়ানো হলো না। এমনকি ৯/১১-পরবর্তী বছরগুলোতেও আমেরিকা ভ্রমণ হয়েছে বহুবার। তারপর ইউরোপের নানা দেশ, জাপান, চীন—প্রতিবছরই একবার করে, গত ১৫ বছর। এবার অবশ্য প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা নিয়ে নয়, সমাজে বিজ্ঞানকে কীভাবে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তা নিয়ে সভায় যোগদান করতে।
বাংলাদেশ ইউনেসকো জাতীয় পরিষদের সচিব ড. মুকাদ্দাস আলী ও শাহানা পারভীনের ত্বরিত পদক্ষেপে ও মরক্কোর দূতাবাসের কর্মকর্তার অদূতাবাসসুলভ আন্তরিকতায় ভিসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অনুমতি—সবই যথাসময়ে মিলে গেল। বিশ্বখ্যাত ভ্রমণকারী ইবনে বতুতার দেশে ভ্রমণ। বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের আগে যত ভ্রমণকারী ছিলেন, ইবনে বতুতা ছিলেন তার মধ্যে সবচেয়ে বড়। ইবনে বতুতা ভ্রমণ করেছিলেন ৭৫ হাজার মাইল, পক্ষান্তরে মার্কো পোলো মাত্রই তাঁর তিন ভাগের এক ভাগ।
এমিরেটসের ফ্লাইটে প্রথম দুবাই। ঘণ্টা ছয়েকের যাত্রাবিরতিতে দুবাই বিমানবন্দরের ঐশ্বর্য যেমনটি ক্লান্তি দূর করে অপেক্ষার একঘেয়েমি লাঘব করল, একই সময়ে কোটির কম মানুষের দেশের বিমান কোম্পানির আকাশসম সুনাম, শত শত আধুনিক বিমানে সমৃদ্ধ এমিরেটসের অগ্রযাত্রার সাপেক্ষে আমাদের ১৬ কোটি মানুষের দেশের বাংলাদেশ বিমানের নাজুক অবস্থা যে মন্ত্রী বদলিয়ে কিংবা ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদত্যাগে পরিবর্তন হচ্ছে না, তা দেখে মন ভারী হয়ে গেল। জনসংখ্যার বিচারে আমরা সংযুক্ত আরব আমিরাতের ২০ গুণ বড় হলেও তাদের বিমান সংস্থা আমাদের নিশ্চয়ই কমপক্ষে ২০ গুণ বড়। এতগুলো বিমানের যাত্রী তাদের সারা পৃথিবী থেকে জোগাড় করতে হয়। তারা যদি মনে করে, তাদের ব্যবসাটা ভালো যাচ্ছে না, তাহলে নানা ধরনের প্রদর্শনী করে বিদেশিদের আকৃষ্ট করে। ক্যাসাব্লাঙ্কা থেকে সাত ঘণ্টার ফ্লাইটের পরও আমাদের উড়োজাহাজটি সরাসরি গেটে যাত্রী নামাতে পারেনি, যেখানে প্রায় ২৫০টি গেট। 
আমাদের দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি নিশ্চিত করতে বিমানকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে হবে। অন্ততপক্ষে আমাদের যাত্রীদের যাতায়াতের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা তো সাশ্রয় করা যাবে। সরকারের পয়সায় বিমান ভ্রমণ হলেই বাংলাদেশ বিমান ব্যবহার করতে হবে। ভারতে যারা দীর্ঘদিনের ছুটিতে যায়, তাদের ভারতের জাতীয় এয়ারলাইনস ব্যবহার করতে হয়। এ রকম আইন করলে নিশ্চয়ই আমাদের যাত্রী-সমস্যা হতো না। বছর বিশ আগে একটি পরিসংখ্যান পড়েছিলাম, যাতে লেখা ছিল, বাংলাদেশ বিমান পর্যাপ্ত যাত্রী পেলে আয়ের সর্বোত্তম উৎস হতে পারত। এই সর্বোত্তম উৎস নিয়ে আমরা কেন গবেষণা করি না, কেন এর সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধান বের করি না। বছর দশেক আগেও মালয়েশিয়ায় ভ্রমণকারীদের আকৃষ্ট করার জন্য বিনা পয়সায় হোটেলে থাকা-খাওয়া এবং বিমানবন্দরে যাওয়া-আসা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তাতে সম্ভবত তাদের লাভই হয়েছে। 
যা হোক, তারপর ক্যাসাব্লাঙ্কার ফ্লাইট। এই ফ্লাইটে মধ্য সারিতে আমার পার্শ্ববর্তী সিটে যাত্রী রয়েছে পুরো এক বছর বয়সী সময়ে-অসময়ে অকারণে ক্রন্দনরত এক শিশু এবং তাকে ব্যর্থভাবে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য নিয়োজিত তার অল্পবয়সী অনভিজ্ঞ অসহায় মা ও তার অনুজা খালা। তার সব স্থাবর সম্পত্তির আধার ব্যাগটি বিমান উড্ডয়নের সময় ওপরে শেলফে বিমানবালা রাখতে গেলেই ঘটল বিপত্তি। ব্যাগটি ধরলেই চিৎকার, আবার তাকে না দিলেও তা-ই। একখানি বই পর্যন্ত নিতে ভুলে গেছি। ফলে লম্বা উড্ডয়নকাল শিশুটির সুবাদে ভালোই কাটল। এর ফাঁকে মরক্কো সম্পর্কেও বেশ কিছু জানা গেল। তাদের ভাষা আরবি মরক্কোর উচ্চারণে। বয়স্ক বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানেরা ওই ভাষায়ই কথা বলে। উপনিবেশ থাকার সুবাদে ফরাসি ভাষা চলছে আবার ইদানীং ছেলেমেয়েরা ইংরেজি ভাষায়ও পারদর্শী হচ্ছে। শিশুর মা-বাবা হংকং থাকেন, ইংরেজি উচ্চারণ অতিশয় চমৎকার। 
মধ্যপথে এক যাত্রী তো তার সিট থেকে দাঁড়িয়ে গেল বিমান তার গন্তব্যে চলে এসেছে মনে করে। স্থিতিজড়তা ও গতিজড়তার ব্যবধান বুঝতে অবস্থান পরিবর্তনের যে মাপকাঠি দরকার, তা শূন্য আকাশে তার হাতে ছিল না। টয়লেটে গিয়ে বুক এক বিঘত বেড়ে গেল। এই প্রথম একটি বিদেশি ফ্লাইট দেখলাম, যার না যাত্রাস্থান, না গন্তব্য—কোনোটিই বাংলাদেশের কোনো শহর নয়, অথচ কিছু কিছু নির্দেশ বাংলায়ও রয়েছে। এই নির্দেশ যে কারণেই হোক, যেহেতু ইংরেজি ও আরবিতেও আছে, আমি তো বেশ খুশি। অবশ্য একটি ক্ষুদ্র কাপড়খণ্ডে ততোধিক ক্ষুদ্র লেবেলে থাইল্যান্ড শব্দটি দেখে বুকটি আবার সমপরিমাণ নেমে গেল। ২০০০ সালের গ্রোগ্রামিংয়ের বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে উপঢৌকন হিসেবে প্রতিটি দলকে যে টুপি দিয়েছিল, তার ভেতরে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ দেখে রকেট বানানোর গর্বে মন ভরে গিয়েছিল। কাকতাল কিনা জানি না, আমাদের দলটি সেবারই সবচেয়ে ভালো ফল করেছিল, সারা বিশ্বে একাদশ স্থান, তাও আবার এমআইটি, হার্ভার্ড, বার্কলে, স্ট্যানফোর্ডের মতো বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পেছনে ফেলে। এক যুগ পরে আমাদের সেই সাফল্যের জন্য তৈরি পোশাকশিল্পের বঞ্চিত শিল্পীদের কৃতজ্ঞতা জানাই।
ক্যাসাব্লাঙ্কা বিমানবন্দর দেখেই বোঝা যায়, মরক্কো এমন কোনো ধনী দেশ নয়। তবে দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিক দর-কষাকষির জায়গা হিসেবে রাবাত ও এই শহরটিকে সবাই পছন্দ করে আসছে। আমাদের যেতে হবে রাবাত। প্রাইভেট কারে ক্যাসাব্লাঙ্কা থেকে রাবাতের ৯০ কিলোমিটার দূরত্ব কীভাবে যে এক ঘণ্টায় অতিক্রম করা যায়, তা না গেলে বিশ্বাস হবে না। সারা রাস্তার কোথাও কোনো ট্রাফিক লাইট নেই, শুধু দুটি স্থানে টোল প্লাজা। এক ঘণ্টায় চলে এলাম রাবাত। হাইওয়ে বলতে যা বোঝায় এবং বাংলাদেশে যা নেই। গোটা দেশ হলো সমুদ্রের তীরঘেঁষে, আবহাওয়া সব সময়ই ভালো। রাবাত শহরকে মনে হলো একটি বিশাল পার্ক, রাস্তাগুলো সব একমুখী, সড়কদ্বীপগুলো প্রশস্ত। আফ্রিকার একটি দেশে যে এত গাছ আছে, তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। তাও আবার সাহারা মরুভূমির সঙ্গে লাগানো। রাস্তায় যানবাহনগুলো ট্রাফিক আইন মেনে চলে, কোথাও বড় কোনো যানজট দেখতে পেলাম না। রাস্তায় দু-একজন ভিক্ষুক যে দেখা যায়নি তা নয়, তবে স্মার্ট সবল ভিক্ষুকদের ক্ষুদ্রতর দেহধারী পুলিশ যে ভ্যানে তুলে নিয়ে যাচ্ছে তা দেখেছি ঠিক আমাদের দেশে আন্দোলনরত হরতাল পালনকারী রাজনৈতিক কর্মীদের যেভাবে করা হয়।
আইএসইএসসিওর ৩০ বছর পূর্তি উদ্যাপন উপলক্ষে দেশের প্রধানমন্ত্রী এসেছিলেন, তার দেহরক্ষীকে দেখার সৌভাগ্য হলো না। যারা ছবি তুলতে চেয়েছিল, তাদের কাউকে বঞ্চিত করেননি। রাবাতে অত্যন্ত সাদামাটাভাবে রয়েছে রাজা হাসানের কবর। ২০১১ সালের নির্বাচনে পার্লামেন্টকে যদিও অনেক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তবুও রাজাই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। সম্প্রতি উইকিলিকসের ফাঁস করা তথ্য অনুযায়ী, রাজার সম্পদ দুই বিলিয়ন ডলারের বেশি, আর রাজপ্রাসাদে নাকি প্রতিদিন ব্যয় হয় প্রায় এক মিলিয়ন ডলার। তাও আবার মূলতই পোশাক এবং গাড়ি মেরামতের জন্য। মরক্কোর মুদ্রা দিরহাম, এক মার্কিন ডলার আট দিরহামের কিছুটা বেশি। একটি পার্টি হলো। আটজন অতিথির জন্য প্রথম এল বিশাল পাত্রে করে সালাদ, লেটুসপাতা থেকে নানা বর্ণের সবজি, কিছু ফল একটি পাখির মতো করে সাজিয়ে। এর পর এল পাস্তিলা—অত্যন্ত সুস্বাদু করে তৈরি করা রুটির ভেতর ইতালিয়ান কিংবা মেক্সিকান পাস্তা। এর পর এল গোটা চারেক মরক্কোর মুরগির রোস্ট। সঙ্গে ছিল নানা ধরনের ফলমূলের রস এবং ঠান্ডা পানীয়। 
মানুষের সঙ্গে কথা বলে, অনুষ্ঠানগুলোতে যোগদান করে, রাস্তায় হেঁটে, শপিং সেন্টারে গিয়ে দেশটি সম্পর্কে অনুভূতি ভালোই হলো। হংকং তার স্ট্র্যাটেজিক অবস্থান ব্যবহার করছে, যা করছে সিঙ্গাপুরও। দক্ষিণ কোরিয়া আর জাপানও কী কী ব্যবহার করে অগ্রগতির পথে এগিয়ে যাচ্ছে, এমনকি যুদ্ধবিধ্বস্ত ভিয়েতনামও এগিয়ে যাচ্ছে, ক্ষুদ্র দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত তার বিমান বহর দিয়ে সারা বিশ্বে যোগ্য দেশ হিসেবে মর্যাদা পাচ্ছে, মরক্কো মর্যাদা পাচ্ছে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের দর-কষাকষির স্থান হিসেবে। আমরা বঞ্চিত পোশাকশিল্পের নারীদের এবং মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত খেটে খাওয়া মানুষের অমানুষিক পরিশ্রমের বিনিময়ে অর্জিত বিদেশি মুদ্রা ছাড়া অন্য কোনো শ্রেয়তর উপায়ের সন্ধান করতে পারি কি না।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ফেলো বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস।

শনিবার, ১৬ জুন, ২০১২

রোহিঙ্গা শরণার্থী: ‘দরিয়া কিনারে আজ দুঃখ অথৈ’


অবশ্যই আমাদের রাষ্ট্রবুদ্ধি প্রয়োজন, কিন্তু তার জন্য অমানবিক হতে হবে কেন?
অবশ্যই আমাদের রাষ্ট্রবুদ্ধি প্রয়োজন, কিন্তু তার জন্য অমানবিক হতে হবে কেন?
ফারুক ওয়াসিফ
‘দরিয়া কিনারে আজ দুঃখ অথৈ; 
করজোড়ে বলি, গ্রহণ করো রহম করো ভাই।’
ইতিহাসের কী অদ্ভুত পরিহাস! অষ্টম শতকে এক আরব সওদাগরি জাহাজ পশ্চিম আরাকান উপকূলে ভেঙে পড়ে। স্থানীয় রাজার নির্দেশ হয়, এদের হত্যা করো। অসহায় আরবেরা তখন নিজ ভাষায় রাজার প্রতি ‘রহম’ করার আবেদন জানায়। তারাই এই এলাকার নাম দেয় রহম-ব্রি, যার অর্থ করুণার ভূমি। বর্তমানেও আরাকানে রামব্রি নামের দ্বীপটি আছে, কেবল রহমের কোনো চিহ্ন নেই। বলা হয়, এই রহম থেকেই আরাকানিদের আদি নাম রোহানের উৎপত্তি এবং রোহান থেকে রোহিঙ্গা নামের জন্ম। সেই রহমের দেশের মানুষ স্বদেশে রহমবঞ্চিত হয়ে আমাদের দেশের জলসীমান্তে এসে উপস্থিত। করুণা ভিক্ষা করে তারা বলছে, ‘ভাসা পথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে হে সভ্যতা। আমরা সাতভাই চম্পা মাতৃকাচিহ্ন কপালে করে এসে ঠেকেছি এই বিপাকে—পরিণামে। আমাদের কোলে-কাঁখে শিশু, ঘরপোড়া কাঠে কালো কালো যিশু। দরিয়া কিনারে আজ দুঃখ অথৈ, করজোড়ে বলি, গ্রহণ করো রহম করো ভাই।’
রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের চোখে উটকো ঝামেলা আর মিয়ানমারের কাছে বহিরাগত ‘বাঙালি’। মিয়ানমারে তারা ঘৃণিত, বাংলাদেশে তারা পরিত্যক্ত। সংসদে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি রোহিঙ্গা আন্দোলনের পেছনে জামায়াতে ইসলামীর উসকানি খুঁজলেও ভাসমান মানুষের চোখের পানি দেখতে পাননি। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের শাসকশ্রেণী যে বর্ণবাদী, সাম্প্রদায়িক ঘৃণায় কলঙ্কিত করে, আমাদের সরকারি দৃষ্টিভঙ্গি তা থেকে কতটা ভিন্ন?
মিয়ানমারের সরকার ও জনগণের বড় অংশ গভীরভাবে বিশ্বাস করে, রোহিঙ্গারা অপরাধপ্রবণ, মৌলবাদী, ঠিক মানুষ নয়, দ্বিপদবিশিষ্ট আপদ। তাদের এই বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি সেবনে বাংলাদেশের শাসক মহলেরও দেখি আপত্তি নেই। এ ধরনের মনোভাবকেই জাতবিদ্বেষ, বর্ণবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি বলা হয়। মিয়ানমারে আধাসামরিক সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে শান্তিতে নোবেলজয়ী অং সান সু চিও রোহিঙ্গা ও মুসলমানদের বর্ণবাদী ‘কালার’ নামে ডাকছেন। এ জন্য তাঁদের বর্ণবাদী বললে ‘অপমান’ হবে। অপমান, লাঞ্ছনা ও দুর্দশা তাই রোহিঙ্গাদেরই ললাটলিখন।
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দুর্ভাগ্যের অন্যতম একটি কারণ এই মনোভাব। এই মনোভাবের ধোঁয়া কেটে গেলে দেখা যাবে, রোহিঙ্গারা আজ সে রকম নিপীড়ন ও গণহত্যার শিকার, ১৯৭১ সালে যা এক কোটি বাঙালিকে শরণার্থী হতে বাধ্য করেছিল। আন্তর্জাতিক আইনে শরণার্থী মর্যাদার পূর্ণ দাবিদার হওয়া সত্ত্বেও ধর্মীয় পরিচয় এবং পরাশক্তিগুলোর ভূরাজনৈতিক লীলাখেলায় তারা খরচযোগ্য। তাদের মারলে বা আশ্রয় না দিলে কোনো দোষ নেই। তাদের জন্য জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী হস্তক্ষেপ কিংবা উদ্বাস্তু তহবিলের টাকার টানাটানি কখনো শেষ হয় না। 
উগ্র জাতীয়তাবাদী মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠী করে দিয়েছে। আদমশুমারিতে তাদের গণনা করা হয় না। তাদের বাঁচামরা, বিবাহ ও সন্তানধারণ, কাজ ও ভ্রমণ, লেখাপড়া ও বাণিজ্য—সবই সামরিক শাসকদের কৃপার অধীন। এবারের মতো আরও অজস্রবার তাদের বসতি পুড়েছে, তাদের ওপর জাতিগত শুদ্ধির গণহত্যা চলেছে। অথচ শত শত বছর ধরে এরাই আরাকানের আদিবাসী এবং রোহিঙ্গারা ছিল আরাকানের জনসংখ্যার অর্ধেক। আরাকান রাজ্য এমনিতেই দুর্গম পাহাড় দিয়ে মূল বার্মা থেকে আলাদা। সে কারণে খ্রিষ্টপূর্ব সময় থেকেই বৃহত্তর ভারতবর্ষের সঙ্গেই তাদের যোগাযোগ। এই অঞ্চলে ভারতীয় হিন্দু, বৌদ্ধ ও ইসলামের প্রভাব হাজার বছরের বেশি পুরোনো। মধ্যযুগে এই হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা চন্দ্র-রোসাং আর মুসলমানেরা রোহাং নামেই পরিচিত ছিল। 
প্রাচীন সমৃদ্ধ আরাকানের বিপর্যয়ের শুরু মূলত ১০৪৪-১০৭৭ খ্রিষ্টাব্দে বার্মিজ রাজা আনাওরথার আগ্রাসনের সময় থেকে। তিনি হাজার হাজার স্থানীয় রোসাং, রোহাং এবং রেকং বা রাখাইনদের হত্যা করেন; দেশত্যাগী হয় লাখ লাখ আরাকানি। ঐতিহাসিকেরা সাক্ষ্য দিচ্ছেন, চট্টগ্রামে বসবাসকারী চাকমা, রাখাইন, মারমাসহ অনেক জনগোষ্ঠী সে সময়ই দেশত্যাগী হয়ে বাংলাদেশে বসত করে। রাজা আনাওরথাই প্রথম অহিংসার বৌদ্ধ ধর্মকে বর্ণবাদী ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেন। স্থানীয় বৌদ্ধ মতবাদ হটিয়ে তিনি থেরাভাদা বৌদ্ধ মতবাদের পৃষ্ঠপোষকতা দেন। পঞ্চাশের দশকে বার্মার সামরিক সরকারও একে রাজধর্ম করে এবং দেশের ১৮০টির বেশি আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে ঔপনিবেশিক কায়দায় কোণঠাসা করে রাখে। এরই প্রতিক্রিয়ায় রোহিঙ্গারা ছাড়া বাকি আদিবাসীরা অস্ত্র হাতে তুলে নেয়। সু চির বাবা অং সানের অন্যতম প্রধান সহযোগী ছিলেন মুসলমানদের নেতা উ রাজাক। তিনি সে সময় সেক্যুলার জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুসলমানদের অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদে দীক্ষিত করেন। শিক্ষা ও পরিকল্পনামন্ত্রী হিসেবে মুসলিম ও বৌদ্ধ বার্মিজদের কাছে তিনি জনপ্রিয় ছিলেন। সু চির বাবা অং সানের নেতৃত্বে সংবিধানে সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর বিশেষাধিকার অন্তর্ভুক্তির সময় উ রাজাকের কারণেই মুসলমানরা বাদ পড়ে। সু চি হয়তো ভুলে গেছেন, তাঁর বাবার সঙ্গে একত্রে উ রাজাকও নিহত হন। মিয়ানমারের মুসলিম জনগোষ্ঠীর জঙ্গি বা বিদ্রোহী হওয়ার রেকর্ড অন্য বার্মিজদের তুলনায় শতগুণ কম। অপরাধপ্রবণতার দিক থেকেও তারা পিছিয়ে। সুতরাং মিয়ানমারের সরকারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের মন্ত্রী যা বলেছেন, তা ঠিক নয়। 
পঞ্চাশের দশক থেকে সামরিক সরকার বার্মার জনগণকে উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতায় উত্তেজিত করে বিভক্তির শাসন চালিয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক দাঙ্গার পেছনেও পাওয়া যাচ্ছে এক তরুণ বৌদ্ধ সন্ন্যাসীকে। আফগানিস্তানের তরুণ তালেবান মৌলবাদীদের অনুকরণে তাঁকে বলা হচ্ছে ‘তালেবান সন্ন্যাসী’। বার্মার সরকারি ও বিরোধী দলও মুসলমান ও ভারতীয় বংশোদ্ভূত লোকজনের বিরুদ্ধে এককাট্টা। তাই আজ রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর যে জাতিগত গণহত্যা চলছে, অচিরেই সেটা অন্যান্য ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের বিরুদ্ধে যে হবে না, তার নিশ্চয়তা কী?
ঘৃণার রাজনীতি প্রথম হত্যা করে সত্য ও ইতিহাসকে। যে যুবকটি রাখাইন নারী ধর্ষণের অপরাধী, তার বাবা নিজেও একজন রাখাইন। রাখাইনের ঘরে জন্ম নিয়ে সে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে চলে আসে। বাবার মৃত্যুর পর ছেলেটি ভবঘুরে অপরাধীদের খাতায় নাম লেখায়। অন্যদিকে, ধর্ষণের প্রতিহিংসায় যে ১০ জনকে হত্যা করা হয় তারা কেউই রোহিঙ্গা নয়; এমনকি সবাই মুসলমানও নয়। অভিযোগ রয়েছে, মিয়ানমারের গণতন্ত্রের যাত্রাকে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য পরিকল্পিতভাবে দাঙ্গা ঘটানো হয়েছে। ধর্ষকদের হাতেও যে যোগাযোগ প্রযুক্তি দেখা গেছে, সেটা সাধারণ ভবঘুরেদের হাতে থাকার কথা নয়।
দাঙ্গা শুরু হয় ৮ জুন। কিন্তু গত এপ্রিল থেকেই বার্মার সরকারি গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক দলগুলো মুসলিমবিরোধী জিগির তুলে যাচ্ছিল। কয়েক মাস আগে অং সান সু চির দলের এক এমপি লোক লেলিয়ে দাঙ্গা ঘটান। 

দুই.
মানবসমাজ চিরকালই অভিবাসনপ্রবণ ছিল। অতীতে যখন রাষ্ট্র ও সীমান্তের প্রতাপ এত ছিল না, তখন হরহামেশাই এক সমাজের মানুষ অন্য সমাজে গিয়ে বসতি গেড়েছে এবং গৃহীত হয়েছে। মিয়ানমারের মগ ও রাখাইনেরা যেমন বাংলাদেশে বসতি করে, তেমনি অনেক বার্মিজ জাতিগোষ্ঠী কম্বোডিয়া-ভিয়েতনাম প্রভৃতি অঞ্চল থেকে আজকের মিয়ানমারে এসে থিতু হয়।
১৪৩৩ সালে আরাকান বাংলা সালতনাতের অধীন হয়। আরাকানের রাজারা একাধিকবার রাজ্য হারিয়ে গৌড়ের মুসলিম সুলতান অথবা মোগল দরবারে আশ্রয় নিয়েছেন এবং তাঁদের বাহিনীর সমর্থনেই হারানো রাজ্য উদ্ধার করেছেন। মধ্যযুগ থেকে ১৮ শতক পর্যন্ত অনেক আরাকানি রাজবংশের নামে মুসলমান পরিচয় পাওয়া যায়। এর অর্থ মুসলমানেরা সেখানে সংখ্যা ও সম্মানে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কবি আলাওল, সৈয়দ আশরাফ প্রমুখ আরাকানের রোসাং রাজসভারই মন্ত্রী ছিলেন। চট্টগ্রামের মানুষ যেমন আরাকানে গেছে, তেমনি অনেক আরাকানিও বিভিন্ন যুগে বাংলাদেশে বসতি গড়েছে। ১৪ শতকের ইতিহাসবিদ রশিদুদ্দীন থেকে শুরু করে, তুর্কি নাবিক সিদি আলী, আইন-ই আকবরি, বাহরিস্তান গায়েবি, সিয়ারুল মুতাখারিন-এর লেখকেরাও এর প্রমাণ দিচ্ছেন। ষোড়শ শতকের ব্রিটিশ পর্যটক র‌্যালফ ফিচও আরাকানের নাম বলছেন রুয়ং, যা শুনতে রোয়াংয়ের মতো। ইতালীয় পর্যটক মানুচ্চি ফারসি সূত্র ধরে একে বলেছেন রেকন। চট্টগ্রামের শঙ্খ নদের তীরে বসবাসকারী একটি জনগোষ্ঠীর নাম রোওয়াঙ্গি বা রোয়াংয়ের মানুষ। ষোড়শ শতকে শায়েস্তা খাঁ চট্টগ্রামকে মগ বা আরাকান দখল থেকে মুক্ত করার আগে প্রায় এক শতাব্দী এলাকাটি আরাকানের অংশ ছিল। 
এই ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগের কারণেই আরাকান বিষয়ে বাংলাদেশের সজাগ থাকা প্রয়োজন। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় না দেওয়ার কারণ সাম্প্রদায়িক মুসলিম বিদ্বেষ হলে তা লজ্জার ব্যাপার। মানবিক ও রাজনৈতিক কারণটিই বড় করে দেখতে হবে। 
কিন্তু কেন বাংলাদেশ সমস্যাটি ঘাড়ে নেবে? সরকার যে জাতীয় স্বার্থের অজুহাত দিচ্ছে, তা যদি তারা মানতেন, তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িদের বিক্ষুব্ধ করে তুলতেন না। যারা স্বদেশবাসীদের নিজ ভূমিতে উদ্বাস্তু করে রাখতে পারে, তারা প্রতিবেশীদের আশ্রয় দেবে—এমন আশা বাতুলতা। তবে, মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত, সমুদ্রসীমাসহ বহুবিধ সমস্যা রয়েছে। সেসব সমস্যা সমাধানের চাপ হিসেবে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়া কৌশলগত চাল হিসেবে খারাপ হয় না। অন্যদিকে, দীর্ঘ মেয়াদে আরাকান অঞ্চলের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ বাড়ানোর ক্ষেত্রেও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ভূমিকা রাখতে পারে। আরাকান ও চট্টগ্রামের আরও কাছাকাছি আসা উভয়ের স্বার্থেই দরকার। আরাকানে যত দিন অশান্তি থাকবে, তত দিন আমাদের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে অস্থিতিশীলতার ঢেউ আছড়ে পড়বে। 
এবারে যেহেতু রোহিঙ্গা ইস্যুটি আন্তর্জাতিক মনোযোগে এসেছে, একাত্তরের ভারতের মতো শরণার্থী সমস্যা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ আরাকানে শান্তি কায়েমে ভূমিকা রাখতে পারে। মিয়ানমারে নির্বাচনী গণতন্ত্র কায়েম হলে পূর্বাঞ্চলীয় আসাম-ত্রিপুরার মতো এই অঞ্চলটিও হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশের রাজনৈতিক মিত্র ও ব্যবসায়িক অংশীদার। বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের বিষয়ে একেবারে কঠোর হলে তিন লাখের মতো রোহিঙ্গা এ দেশে আশ্রয় পেত না। কিন্তু এই দায় একা বাংলাদেশের পক্ষে নেওয়া সম্ভব নয়। জাতিসংঘ, আসিয়ানসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে কেবল বাণী ঝাড়লে হবে না, মিয়ানমারের ওপর চাপ দিতে হবে, বাংলাদেশকে তহবিল ও রাজনৈতিক সমর্থন জোগাতে হবে। তার জন্য মিয়ানমারের সামরিক জান্তার সঙ্গে দীর্ঘদিনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক হারাতে হতে পারে ব্রিটেন, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও অস্ট্রেলিয়াকে। আমাদের সরকারের উচিত, বলটা আন্তর্জাতিক মুরব্বিদের মাঠে ঠেলে দেওয়া এবংবলা, আমরা গ্রহণে প্রস্তুত, কিন্তু তোমাদেরই আগে সদিচ্ছার প্রমাণরাখতে হবে। বাংলাদেশে আগমনকারী লাখ লাখ রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসনের স্বার্থেও বিষয়টির একটা আখেরি সুরাহা হওয়া দরকার। কয়েক হাজার শরণার্থীকে ফিরিয়ে এই সমস্যা এড়ানো যাবে না, মানুষ আসাও ঠেকানো যাবে না। 
অবশ্যই আমাদের রাষ্ট্রবুদ্ধি প্রয়োজন, কিন্তু তার জন্য অমানবিক হতে হবে কেন? 
 ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com

কোথায় পেলে ভাই এমন রঙিন পাখা


 আলী যাকের
এখনকার ডিজিটাল যুগে ক্যামেরার চাকতি ঘুরিয়েই সব ছবি দেখা যায়। এক এক করে ছবিগুলো দেখি আর নিজেই নিজের কাজে মুগ্ধ হই। কত রঙিন, কত প্রাণবন্ত এই বনের ছবি! তবুও আমার মনে হয় যে, এই বনের ছবি ক্যামেরার চেয়ে হৃদয়ে ধারণ করা অনেক শ্রেয়। কারণ তাতে করে কেবল 'কী পাইনি' তার হিসাব মেলাতে গিয়ে যে আমরা সদাই উৎকণ্ঠিত থাকি, সেখান থেকে বেরিয়ে এসে নিজেকে বলা যায়, 'এই যদি পেলাম, তাহলে সবই তো পেয়ে গেলাম।' সেক্ষেত্রে রঙিন ছবিগুলো আমাদের আশাব্যঞ্জক এক ইশারায় ব্রতী করতে পারে বৈকি, কিন্তু তার বেশি কিছু নয়। সবই নির্ভর করে মানুষের চিন্তা, চেতনার ওপর


সপ্তাহান্তে ছুটির দিন এলেই আমি বেরিয়ে পড়ি নিসর্গে, সুন্দরের সন্ধানে। আমার এই পাগলামি, এমনকি এবারের জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রচণ্ড তাপকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠি দেখিয়ে ঠিক সেই একই রকম আছে। আমি যখনই ঢাকার বাইরে যাই, আমার সঙ্গে চিরসঙ্গী থাকে আমার ক্যামেরা। কোনো একটি দৃশ্য, কি কোনো মানুষ অথবা অতি ক্ষুদ্র বনফুল, যা-ই আমার ভালো লাগে, আমি আমার ক্যামেরার বোতাম টিপে তার একটা স্থায়ী রূপ দেওয়ার চেষ্টা করি। এই তো সেদিন গাজীপুরে একটি সবুজ ঘাসওয়ালা মাঠের ওপরে বসে রৌদ্রের তাপকে উপেক্ষা করে একের পর এক ক্ষুদ্রকায় ফুলের ছবি তুলছিলাম। সবুজ, সাদা, বেগুনি, হলুদ, গোলাপি, কত বাহারি রঙেই না এরা ফুটে থাকে ঘন সবুজ ঘাসের আড়ালে-আবডালে। আমি অনেক সময় ভেবেছি যে, এসব ফুল যদি আরও শক্তপোক্ত হতো, তাহলে আমাদের দেশের মেয়েরা এগুলো দিয়ে নাকফুল, কি কানের দুল তৈরি করতে পারত অনায়াসে।
যা হোক, আমি দীর্ঘদিন আগে প্রয়াত আলোকচিত্রী ড. নওয়াজেশ আহমেদের সঙ্গী হিসেবে বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়িয়েছি বাংলাদেশের বুনোফুলের সন্ধানে। অনেক ছবি তুলেছি সে সময়, প্রায় পাঁচ বছর কাজ করে। সেখান থেকে নির্বাচিত কিছু ছবি নিয়ে একটি বইও প্রকাশিত হয়েছিল ইংরেজিতে, ঞযব ডরষফ ঋষড়বিৎং ড়ভ ইধহমষধফবংয নামে। তবুও বনফুলে আমার আগ্রহ একটুও কমেনি। আমি যখন ওই ফুলগুলোকে অনেক কাছ থেকে দেখি, তখন আমার বড় দুঃখ হয়। মনে হয় ওই বেচারারা কত আগ্রহ নিয়ে ফোটে, কাতর নয়নে তাকিয়ে থাকে ওপরের দিকে, মানুষের দেখার আশায়; কিন্তু আমরা এমনই হতভাগা যে, এই ফুলগুলোকে দেখেও দেখি না। অনেক সময় জানিও না যে, এই ধরনের এত ফুল আমাদের পায়ের নিচে অবলীলায় মাড়িয়ে আমরা নিজেদের গন্তব্যের দিকে চলে যাই। ওরা আশাও করে না। মানুষ তো কাজে-কর্মে যাবেই। ওরা হয়তো ভাবে যে, মানুষগুলো আমাদের দিকে একবারও তাকিয়ে দেখল না? আমরা কত সাগ্রহে ওদের জন্য ফুটি। ওদের দিকে তাকিয়ে থাকি সামান্য স্বীকৃতির আশায়।
ওই দিন ওই বুনোফুলের ছবি তুলতে তুলতে হঠাৎ মনে হলো যে, খবরের কাগজে পড়েছি, সম্প্রতি আমাদের রাজেন্দ্রপুরের উদ্ভিদ উদ্যানে একটি 'প্রজাপতি পার্ক' তৈরি করা হয়েছে। আমি যেখানে ছিলাম, সেখান থেকে রাজেন্দ্রপুর উদ্যান খুব বেশি দূরে নয়। ভাবলাম, যাই, দেখা করেই আসি প্রজাপতিদের সঙ্গে। রাজেন্দ্রপুর পেঁৗছে গেটে প্রহরীদের কাছে জিজ্ঞেস করতেই তারা সদয় অনুমতি দিল আমায়। দীর্ঘদিন পরে আমি রাজেন্দ্রপুর পার্কে এলাম। ভারি ভালো লাগল। এখনও বর্ষাকাল আসেনি। তবে কী যেন একটা আছে প্রকৃতির মধ্যে যে, ওরা ঠিকই বুঝে যায়, কোন ঋতু যাচ্ছে আর কে আসছে। তাই বর্ষার আগমনের খবর পেয়েই ক্ষুদ্র চারা থেকে শুরু করে বৃহৎ বৃক্ষ_ সবই পত্র-পুষ্পে পল্লবিত হয়ে উঠেছে। ভাওয়ালের মতো লাল মাটির অঞ্চলে একটি বিশেষ বুনোফুল সর্বদাই দেখতে পাওয়া যায়, যা 'ইন্ডিয়ান রোডডেন্ড্রন' নামে পরিচিত। দেখলাম ফুটে আছে সেই ফুল তার অসাধারণ বেগুনি বর্ণে, চারদিকে। লোকমুখে জিজ্ঞেস করে করে পেঁৗছে গেলাম প্রজাপতি উদ্যানে। এই উদ্যানটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের উদ্যোগে এবং তত্ত্বাবধানে অতি সম্প্রতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ওখানে প্রবেশ এখনও তত সহজ হয়ে ওঠেনি। মোবাইলে এর তত্ত্বাবধায়কদের সঙ্গে কিছু কথাবার্তা বলতে হলো। তারপর অনুমতি পাওয়া গেল ভেতরে প্রবেশ করার। অতি অল্প জায়গা নিয়ে রচনা করা হয়েছে এই প্রজাপতি উদ্যান। জানা-অজানা নানা ফুলসজ্জা রচিত হয়েছে, যার অনেকগুলো ফুলই আমাদের অতি পরিচিত। আমি জানতাম না যে, এই ফুলগুলো প্রজাপতিদের অত্যন্ত প্রিয়। তা-ই হবে। কেননা সারা উদ্যান ঘুরে যার দেখা মেলেনি, সেই রঙবেরঙের প্রজাপতিরা, দেখতে পেলাম নেচে নেচে বেড়াচ্ছে ফুল থেকে ফুলে। কত রঙের ছোটখাটো নানা ফুলে ভরা এ বাগান। আর কত ধরনের ছবির মতো দেখতে প্রজাপতি। আমি একাগ্রচিত্তে একের পর এক ছবি তুলতে লাগলাম। বড় ভালো কাজ হয়েছে এই উদ্যানটির প্রতিষ্ঠা করে। এই ধরনের বাগান করতে হলে খুব বেশি জায়গার প্রয়োজন পড়ে না। সামান্য একটু উর্বর জায়গাকে তৈরি করে নিয়ে সেখানে বিশেষ শ্রেণীর ফুল এবং গাছ লাগাতে হয়। তাহলেই অবাক কাণ্ড, প্রজাপতিরা সব ভিড় করে আসে সেই বাগানে! আমাদের মধ্যে যাদেরই এই ধরনের সামান্য জায়গা আছে, তারা হয়তো চেষ্টা করে দেখতে পারি। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, জেলা পর্যায়ে প্রতিটি শহরে সরকার সামান্য উদ্যোগেই এমন উদ্যান রচনা করতে পারেন।
ছবি তুলতে তুলতে কখন যে ঘেমে নেয়ে উঠেছি, বলতে পারব না। ভাবলাম বিশ্রামের প্রয়োজন। অতএব, একটি বড় শালগাছে হেলান দিয়ে ঘাসের ওপর বসে পড়লাম। কত উদ্ভট ধরনের চিন্তাই না মাথায় ভিড় করে আসে! এই যে আজকে সকাল থেকে দুপুর গড়িয়ে এই বিকেল পর্যন্ত এমন নৈসর্গিক বৈচিত্র্যের এক অভিজ্ঞতা, তার তুলনা মেলা ভার। প্রচণ্ড তাবদাহে শরীরী যে যন্ত্রণা, তাকে কত সহজে দূরে সরিয়ে রেখে একেবারে মনের আনন্দে সেই সকাল থেকে দীর্ঘক্ষণ কাজে-অকাজে সময় কাটিয়ে দিলাম। অথচ শহরে যখন থাকি, ইট-পাথরের জঙ্গলে, অনেক সময় তাপানুকূল পরিবেশে, তখন প্রায় ভুলেই যাই যে, এমন সুন্দর সব অভিজ্ঞতার ক্ষেত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে আমাদেরই এই প্রায় অবাসযোগ্য শহরের চারদিকে। মাঝে মধ্যে লক্ষ্য করেছি যে, আমাদের এই শহরেরও ভেতর-বার আছে। প্রায় অন্দরমহল-বহির্মহলের মতোই। অর্থাৎ আমরা যারা অন্দরমহলে থাকায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি, তারা বহির্মহলে যেতে ভয় পাই। সেখানে নিরাপত্তার অভাববোধ করি বিভিন্ন কারণে। মনে হয় কেবল যে আমরা দুর্জনের দ্বারা আক্রান্ত হতে পারি তা-ই নয়, আবহাওয়ার বড় বেশি নিয়ন্ত্রণ বহির্মহলে। তাই সেই আক্রমণ আমাদের বিপর্যস্ত করতে পারে। কিন্তু আমার মনে হয়, অন্দরমহলের এই নিরাপত্তার গণ্ডি পেরিয়ে আমরা যদি চলে যেতে পারি বাইরের নিসর্গ নিয়ন্ত্রিত ভুবন দেখতে, তাহলে হয়তো অনেক সহনীয় হয়ে যেতে পারে আমাদের সদা শঙ্কাময় জীবন। কেবলই 'নেই' যেখানে রাজত্ব করে অবলীলায়, সেখানে বাইরের প্রকৃতি আমাদের এই প্রত্যয় দিতে পারে যে, কিছুই হারিয়ে যায়নি। সবই আছে।
হঠাৎ মনে হয় আজকের তোলা ছবিগুলো দেখি। এখনকার ডিজিটাল যুগে ক্যামেরার চাকতি ঘুরিয়েই সব ছবি দেখা যায়। এক এক করে ছবিগুলো দেখি আর নিজেই নিজের কাজে মুগ্ধ হই। কত রঙিন, কত প্রাণবন্ত এই বনের ছবি! তবুও আমার মনে হয় যে, এই বনের ছবি ক্যামেরার চেয়ে হৃদয়ে ধারণ করা অনেক শ্রেয়। কারণ তাতে করে কেবল 'কী পাইনি' তার হিসাব মেলাতে গিয়ে যে আমরা সদাই উৎকণ্ঠিত থাকি, সেখান থেকে বেরিয়ে এসে নিজেকে বলা যায়, 'এই যদি পেলাম, তাহলে সবই তো পেয়ে গেলাম।' সেক্ষেত্রে রঙিন ছবিগুলো আমাদের আশাব্যঞ্জক এক ইশারায় ব্রতী করতে পারে বৈকি, কিন্তু তার বেশি কিছু নয়। সবই নির্ভর করে মানুষের চিন্তা, চেতনার ওপর। তখনই সেই অমোঘ বাক্য, যা রবীন্দ্রকাব্যে আমরা পড়েছি, তা মূর্ত হয়ে দেখা দেয়_ 'আমারই চেতনার রঙে পান্না হলো সবুজ, চুনি উঠল রাঙা হয়ে...।' আমরা নিজের মধ্যেই, শত হতাশা পরিবৃত হয়েও আশায় দীপ্ত এক ভুবন আবিষ্কার করি। এই সুখ থাকতে, সর্বত্র ছড়িয়ে, কেন নিজের ভেতরেই ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত হই আমরা?

আলী যাকের : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

বৃহস্পতিবার, ১৪ জুন, ২০১২

এত কষ্ট মেহদি হাসানের প্রাপ্য ছিল না


ভারতীয় সংগীতশিল্পী লতা মুঙ্গেশকর বলেছেন, উপমহাদেশের প্রখ্যাত গজলশিল্পী মেহদি হাসান প্রায় নয়-দশ বছর ধরে অসুস্থ ছিলেন। তিনি খুব কষ্ট পেয়েছেন। শেষ বয়সে এতটা কষ্ট তাঁর প্রাপ্য ছিল না। মেহদি হাসানের মৃত্যুর পর আজ বৃহস্পতিবার তাঁকে স্মরণ করতে গিয়ে তিনি এ মন্তব্য করেন। টাইমস অব ইন্ডিয়া অনলাইনের খবরে এ তথ্য প্রকাশিত হয়েছে।
গতকাল ৮৫ বছর বয়সে মারা যান গজলশিল্পী মেহদি হাসান।
ভারতের জীবন্ত এই কিংবদন্তি শিল্পী বলেন, ‘প্রায় ৪০ বছর আগে মেহদি হাসানের সঙ্গে আমার কানাডায় দেখা হয়েছিল। আমি সেখানে তাঁর একটা কনসার্টে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে আমি বিস্মিত হয়েছিলাম। কনসার্টের ভেতরে আমাকে দেখেই তিনি তাঁর গান বন্ধ করে আমাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। পরে তিনি কিংস্টোনে আমার সঙ্গে দেখাও করেছিলেন। এরপর মুম্বাইতে তাঁর যখন প্রথম কনসার্টের আয়োজন করা হয় সেখানে বক্তব্য দিয়েছিলাম।’
লতা মুঙ্গেশকর আরও বলেন, ‘মেহদি হাসানের সঙ্গে আমার শেষ দেখাটা হয়েছিল কয়েক বছর আগে। তিনি আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য বাড়ি পর্যন্ত এসেছিলেন। তখন তিনি খুব অসুস্থ ছিলেন। তাই তিনি হুইলচেয়ারে করে আমার বাড়িতে এসেছিলেন। ওভাবে তাঁকে দেখে আমরা সবাই খুব বিস্মিত হয়েছিলাম। কারণ, পরিবারের সবাই আমরা তাঁর খুব ভক্ত ছিলাম। আমাকে দেখে তিনি কেঁদে ফেলেছিলেন। তিনি আমার মারাঠি ভাষায় গাওয়া একটি গান খুবই পছন্দ করতেন।’

গজল সম্রাট মেহেদী হাসানের ইন্তেকাল




উপমহাদেশের প্রখ্যাত গজল সম্রাট মেহেদী হাসান গত বুধবার পাকিস্তানের করাচী শহরের আগাখান হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়াছেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ... রাজেউন)। মৃত্যুকালে তাঁহার বয়স হইয়াছিল প্রায় ৮৫ বছর। পরিণত বয়সেও কিংবদন্তীসম ধু্রপদ সঙ্গীতের এ উজ্জ্বল নক্ষত্র মেহেদী হাসানের তিরোধান এই উপমহাদেশে সঙ্গীতের জগতে আনিয়াছে শোকের ছায়া। ফুসফুস ও মুত্রনালীর সমস্যায় বেশ কয়েক মাস ধরিয়া ভুগিতেছিলেন তিনি। কিন্তু শিল্পীর নিষেধাজ্ঞার কারণে তাঁহার অসুস্থতার খবর মিডিয়ায় তেমন প্রচার পায় নাই। তবে কিংবদন্তী শিল্পীর মৃত্যুর খবরটি উপমহাদেশের সকল গণমাধ্যমে ছড়াইয়া পড়ার পর তাঁহার অগণতি ভক্ত-অনুরাগীদের মধ্যে সৃষ্টি হইয়াছে গভীর শূন্যতাবোধ। ভারতীয় কবি, গীতিকার জাভেদ আকতার নিজ প্রতিক্রিয়া জানাইতে গিয়া যথার্থই বলিয়াছেন যে, মেহেদী হাসানের মৃত্যুতে ক্ষতি অপূরণীয়। কারণ নিজের জায়গায় ছিলেন তিনি অতুলনীয় একজন শিল্পী। ধ্রুপদ সংগীত চর্চার ক্ষেত্রে পরবর্তী প্রজন্মের বহু বিখ্যাত শিল্পীর কাছে মেহেদী হাসান ছিলেন আদর্শ এবং প্রেরণার একটি বড় উত্স।
মেহেদী হাসানের জন্ম ১৯২৭ সালের ১৮ জুলাই ভারতের রাজস্থানের লুনা গ্রামে । সংগীতে শিল্পীর হাতেখড়ি হয় পিতা ওস্তাদ আজিম খান ও চাচা ওস্তাদ ইসমাল খানের কাছে। তাঁহারা দুজনই ছিলেন ধ্রুপদি গায়ক। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর শিল্পীর পরিবার পাকিস্তানে আসেন। দারিদ্র্য ও অর্থসংকটের কারণে ২০ বত্সর বয়সে মেকানিকের সামান্য কাজ করিয়াছেন। কিন্তু অনন্য কণ্ঠমাধুর্য নিয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছেন যিনি, তাহার প্রকাশ ছিল অনিবার্য। মেহেদী হাসানের মিষ্টি কণ্ঠের রাজস্থানী পল্লীগীতি শুনিয়াই শিল্পীর প্রতি আকৃষ্ট হইয়াছিলেন অনেকে। কাজের ফাঁকে ঠুমরির তালিম নিয়াছেন তিনি। অত:পর ১৯৫৭ সালে পাকিস্তান রেডিওতে অডিশনের সুযোগ পাইবার পর আর পিছনে ফিরিয়া তাকাইতে হয় নাই শিল্পীকে। রেডিওতে কর্মজীবন শুরু হইবার পর অতুলনীয় কণ্ঠমাধুর্য ও সুরসাধনা ক্রমেই তাহাকে গজল সম্রাট হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হইবার পর শিল্পী এ দেশের অসংখ্য ভক্ত-অনুরাগীর মাঝে একাধিকবার আসিয়াছেন। বেশকিছু বাংলা গানে কণ্ঠ দিয়াছেন তিনি, যাহা এখনো তাহার অসংখ্য ভক্ত-অনুরাগীর স্মৃতিতে জাগরূক। চলচ্চিত্রের বহু গানেও কণ্ঠ দিয়াছেন তিনি। পেশাদার গায়ক হইয়াও সংগীত পরিচালক হিসাবে অসাধারণ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন মেহেদী হাসান। ১৯৫৭ হইতে ১৯৯৯ পর্যন্ত তিনি সক্রিয় ছিলেন স্বীয় কর্মজগতে। এ সময় একে একে সৃষ্টি করিয়াছেন বিস্ময়করভাবে জননন্দিত হওয়া বহু গান। দীর্ঘ পাঁচ দশকের সংগীতজীবনে তিন উর্দু, বাংলা, পাঞ্জাবি ও ফারসি ভাষায় ২০ হাজারেরও বেশি গান গাহিয়াছেন। সঙ্গীতে অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ দেশে বিদেশে পাইয়াছেন বহু সম্মাননা ও পুরস্কার। ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন ৯ ছেলে ও ৫ মেয়ের জনক। কিংবদন্তীর এই শিল্পী শেষ গান গাহিয়াছেন ২০০৯ সালে।
প্রকৃত বড় শিল্পী দেশকালের সীমা ছাড়াইয়া নিজ সৃষ্টিগুণেই বহু মানুষের অন্তরে আসন করিয়া নেন। সুরের সম্মোহনী শক্তি দিয়া মেহেদী হাসান উপমহাদেশের সংগীতপ্রেমীদের দীর্ঘদিন আচ্ছন্ন করিয়া রাখিয়াছিলেন, মৃত্যুর পরও তাঁহার স্বর্গীয় কণ্ঠমাধুর্য শ্রোতাকুলকে আরো বহুদিন মোহাবিষ্ট করিয়া রাখিবে সন্দেহ নাই। ভক্ত-অনুরাগীদের ভালবাসায় সংগীতের জগতে অনন্য ধ্রুবতারা হিসাবে বাঁচিয়া থাকিবেন তিনি। আমরা কালজয়ী এই মহান শিল্পীর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করি এবং শিল্পীর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। শিল্পীর শোকসন্তপ্ত পরিবার ও ভক্ত-অনুরাগীদের জানাই সহমর্মিতা।

‘গজলসম্রাট’ মেহদি হাসান


  • মেহদি হাসান
    মেহদি হাসান
  • মেহদি হাসান
    মেহদি হাসান
  • মেহদি হাসান
    মেহদি হাসান

তানভীর খালেক

‘মোহাব্বত জিন্দেগি হ্যায়’, ‘ইয়ে দুনিয়া হ্যায় পেয়ারে’সহ অসংখ্য গজলে কণ্ঠ দিয়ে গজলকে ভিন্ন একটি উচ্চতায় নিয়ে গেছেন যে শিল্পী, তিনি মেহদি হাসান। উপমহাদেশে তাঁর পরিচিতি ‘গজলসম্রাট’ হিসেবেই। দীর্ঘ পাঁচ দশকের সংগীত জীবনে উর্দু, বাংলা, পাঞ্জাবি ও আফগান ভাষায় ২০ হাজারেরও বেশি গানে কণ্ঠ দিয়েছেন গুণী এ শিল্পী। ফুসফুস, কিডনির সমস্যাসহ প্রায় এক যুগ নানা রোগে ভুগে ১৩ জুন বুধবার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত এ গজলশিল্পী।
১৯২৭ সালে অবিভক্ত ভারতে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন মেহদি হাসান খান। রাজস্থানের লুনা গ্রামে জন্ম নেওয়া মেহদি হাসানের বাবা ওস্তাদ আজিম খান এবং চাচা ওস্তাদ ইসমাইল খান ছিলেন ধ্রুপদী সংগীতশিল্পী। সংগীত পরিবারে জন্ম নেওয়ায় শিশুকালেই সংগীতে হাতেখড়ি হয় মেহদি হাসানের।
১৯৪৮ সালে ভারত ভাগের পর মেহদি হাসান সপরিবারে পাকিস্তান চলে যান। সেখানে যাওয়ার পর দারিদ্র্য এসে ভর করে তাঁদের পরিবারে। আর্থিক সংকটের কারণে তাঁদের জীবনধারণ বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় বাইসাইকেলের দোকানে কাজ নেন তরুণ মেহদি হাসান। পরে অটো মেকানিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। ‘মেহদি হাসান: দ্য ম্যান অ্যান্ড হিজ মিউজিক’ বইয়ে পাকিস্তানি লেখক আসিফ নূরানি লিখেছেন, ‘তরুণ বয়সে গাড়ি সারাই করে জীবিকা নির্বাহ করেছেন মেহদি হাসান। তারকাখ্যাতি পাওয়ার পর একবার তাঁর হারমোনিয়াম ভেঙে গেলে তিনি নিজেই সেটা ঠিক করতে বসে যান। এটা দেখে তাঁর আশপাশের সবাই অবাক হয়ে গেলে তিনি জানান, অতীতে জটিল যেসব কল-কব্জা তিনি সারাই করেছেন সেগুলোর তুলনায় হারমোনিয়াম কিছুই না।’ স্মিতভাষী ও বিনয়ী মেহদি হাসানের প্রশংসা করে লেখক আসিফ নূরানি বলেছেন, খ্যাতির শীর্ষবিন্দু স্পর্শ করলেও কখনোই তাঁর বিনয়কে ছাপিয়ে যেতে পারেনি তারকাখ্যাতি।
জীবনধারণের জন্য রীতিমতো যুদ্ধ করতে হলেও নিয়মিতভাবে সংগীতের চর্চা চালিয়ে গেছেন মেহদি হাসান। শত কাজের মধ্যেও ঠিকই সময় বের করে গানের রেওয়াজ করেছেন। তাঁর ধৈর্য ও কষ্টসহিষ্ণুতা ঠিকই একটা সময়ে ফল বয়ে আনে। ১৯৫৭ সালে রেডিও পাকিস্তান থেকে গান গাওয়ার আমন্ত্রণ পান। ঠুমরি গান দিয়ে যাত্রা শুরু করেন তিনি। পরে আত্মপ্রকাশ করেন গজলশিল্পী হিসেবে। সে-ই শুরু। আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। স্বতন্ত্র গায়কী ঢং তারকাখ্যাতি এনে দেয় মেধাবী এই শিল্পীকে।
মেহদি হাসান পাকিস্তানি চলচ্চিত্রে প্লেব্যাকও করেছেন। পাকিস্তানি চলচ্চিত্রের সংগীতে মুকুটবিহিন সম্রাট হিসেবেও তিনি বিবেচিত। ‘কেহনা উসে’, ‘সুর কি কোয়ি সীমা নেহি’, ‘নাজরানা’সহ অন্তত ২৫টি অডিও অ্যালবাম প্রকাশ করেছেন। তাঁর কণ্ঠের যাদু কেবল পাকিস্তানের সীমানাতেই আবদ্ধ থাকেনি, ভারতেও সমান জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। পাকিস্তানি গজলশিল্পীদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম, যিনি ভারতীয় শ্রোতাদের সুরের মাধুর্যে বিমোহিত করেছেন। তাঁর গানের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন ভারতীয় ধ্রুপদী সংগীতের বোদ্ধারাও। তাঁর একনিষ্ঠ ভক্তের তালিকায় রয়েছেন ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপায়ি, সংগীতশিল্পী লতা মঙ্গেশকর প্রমুখ। মেহদি হাসানের কণ্ঠকে ‘ঈশ্বরের কণ্ঠ’ বলেও অভিহিত করেছিলেন লতা।
কাজের স্বীকৃতি হিসেবে জীবদ্দশায় অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন গজলের এই পুরোধা ব্যক্তিত্ব। নিজ দেশ থেকে ‘তমঘা-ই-ইমতিয়াজ’, ‘হিলাল-ই-ইমতিয়াজ’, ‘প্রাইড অব পারফর্মেন্স’ সম্মাননাসহ নেপাল সরকারের ‘গোরখা দক্ষিণা বাহু’ এবং ভারতের সায়গল পুরস্কারও পেয়েছেন মেহদি হাসান।
ঐতিহ্য অনুযায়ী ঠুমরির মতো করেই গজল গাওয়া হতো। কিন্তু মেহদি হাসানই প্রথম সেই প্রথাকে ভেঙে ধ্রুপদ, খেয়াল ও রাজস্থানি ফোক-সংগীতের মিশেলে গজল গাওয়া শুরু করেন। ষাট থেকে আশির দশকের শেষ পর্যন্ত অসাধারণ গায়কী দিয়ে তিনি জয় করেছেন অগণিত শ্রোতার মন। কিন্তু আশির দশকের শেষ দিকে এসে শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে ধীরে ধীরে গান থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে বাধ্য হন কিংবদন্তি এই শিল্পী। দুবার বিয়ে করেছিলেন তিনি। দুই স্ত্রী গত হয়েছেন আগেই। মেহদি হাসান নয় ছেলে ও পাঁচ মেয়ের জনক

বুধবার, ১৩ জুন, ২০১২

‘একটা ছবি তুইলা দেন তো!’


উাহিম
উাহিম
আদি ঢাকার নারিন্দা থেকে নবাবপুর। রিকশায় ১৫ টাকা ভাড়া। সেই পথটুকু প্রতিদিন হেঁটে দোকানে আসে ফাহিম—একা। অথচ তাদের পাশের বাড়ির ছেলেটি লক্ষ্মীবাজারের কাছের মুসলিম হাইস্কুলে যায় নিজেদের গাড়িতে চেপে। 
ছেলেটি যে বয়সে স্কুলে যায়, ফাহিম সে বয়সে নবাবপুরের একটি হার্ডওয়্যার-সামগ্রীর দোকানে কাজ করে। ফাহিম মায়াবী চেহারার চমৎকার একটি ছেলে। সে ঠেলাগাড়ি টানতে পারে, শক্ত ও ভারী মালামাল বহন করতে পারে। অথচ তারও স্কুলে যেতে মন চায়, কিন্তু উপায় নেই। এই সংসারে ফাহিমের এখন আপন বলতে এক মামা আর নানি। মামার আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ। তো কী করা! এই বয়সেই ফাহিমকে কাজে নেমে পড়তে হয়েছে। এখন তার তেরো বছর চলছে, বাকি জীবন এভাবেই যাবে!
ফাহিমের মা টুটু বেগম আর বাবা মোহাম্মদ আলী প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন। ফাহিমকে জন্ম দিয়েই মা টুটু বেগমের শারীরিক অসুস্থতার শুরু। প্রথম কয়েক বছর মোহাম্মদ আলী টুটু বেগমকে চিকিৎসা করিয়েছিলেন, তারপর হয়রান হয়ে পড়েন। একদিন কী এক অছিলায় মোহাম্মদ আলী টুটু বেগমকে তাঁর মায়ের বাড়ি পাঠিয়ে দেন। সেই যে চলে আসা, তারপর মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনি মা-ভাইদের সঙ্গেই ছিলেন। দীর্ঘ সময় মোহাম্মদ আলী স্ত্রী টুটু বেগমকে একবারের জন্যও চোখের দেখাটা দেখতে আসেননি। সন্তানের মায়াও তাঁকে টানেনি। এভাবেই ফাহিম বড় হতে থাকে। আদর-অনাদর, অবহেলা সব মিলিয়ে। মা খুব চাইতেন ছেলেটা পড়াশোনা করুক। স্কুলেও দিয়েছিলেন। কিন্তু পড়াশোনার খরচ চলবে কী করে? তাঁর নিজের কোনো আয় নেই, থাকেন ভাইয়ের সংসারে। খাওয়া-দাওয়া, চিকিৎসা ভাই-ই চালান। ফাহিমের স্কুলে যাওয়া তাই হয়ে ওঠেনি। তো, একদিন স্কুল থেকে উঠিয়ে টুটু বেগম ফাহিমকে পূর্ব পরিচিত আবদুর রাজ্জাকের দোকানে চাকরিতে ঢুকিয়ে দেন। আরেকটা কারণ ছিল ছেলেকে কাজে দেওয়ার। নিজের শরীর ভালো থাকে না। তাঁর মৃত্যুর পর ছেলেটাকে দেখবে কে! ছেলেটা যেন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে—এই ছিল আশা। সে ছেলে নিজের পায়ে কতটা দাঁড়াতে পারল টুটু বেগম তা দেখে যেতে পারেননি। ক্ষয়ে যাওয়া শরীর তাঁর। প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট, সঙ্গে অন্যান্য রোগ মিলে গত মাসে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। মৃত্যুর আগের দিন টুটু বেগমের খুব ইচ্ছা হয়েছিল, মোহাম্মদ আলীর কলারটা চেপে ধরে জানতে চাইবেন, আমার আর ফাহিমের দোষটা কোথায়! কিন্তু সে সুযোগ হয়নি।
আমার সঙ্গে ফাহিমের দেখা এক বছর আগে, নবাবপুরের কাছের এক পুরোনো বাড়িতে বানরের ছবি তুলতে গিয়ে। আমাকে দেখে সে কাছে আসে। তারপর বলে, ‘আমার একটা ছবি তুইলা দেন।’ আমি সেদিন ছবি তুলে দিইনি। এরপর যতবারই দেখা হয়েছে, ‘একটা ছবি তোলেন তো, ছবি তোলেন’—বলে গেছে। 
পরে কিছুদিন আগে ফাহিমের ব্যাপারে বিস্তারিত আলাপ হয় স্থানীয় বাপ্পির সঙ্গে। বাপ্পির কাছেই জানতে পারি ফাহিমের বিস্তারিত। ফাহিমের বাবা-মায়ের আদ্যোপান্ত। তার বাবারা অবস্থাবান। নারিন্দার কাছে হলুদ মসজিদের পাশে তাঁর নিজের বাড়ি। বউ অসুখে পড়লে তিনি খুব বিরক্ত হন। অসুস্থ বউকে কেউ কি টানে, মনে এই উপলব্ধি এলে তিনি টুটু বেগমকে তাঁর মায়ের বাড়ি পাঠিয়ে দেন। একমাত্র সন্তানের কথাও তিনি ভাবেননি তখন। কিছুদিন যেতেই আরেকটা বিয়ে করে বসেন। টুটু বেগম যত দিন বেঁচে ছিলেন শুধু একটা কথাই বলতেন, ‘জানি না ফাহিমের ভবিষ্যৎ কী?’
হাসি-খুশি ফাহিম এসব নিয়ে ভাবে না। আবদুর রাজ্জাকের দোকানে কাজ করে। রাজ্জাক তাকে খুব আদর করেন। আশপাশের দোকানের লোকজনও ফাহিম বলতে অজ্ঞান। কেউ কোনো কাজের কথা বললে ফাহিম না করে না। কাজে তার কোনো ক্লান্তি নেই। যখনই ফাহিমের সঙ্গে দেখা হয়, নিরলস সে কাজ করে চলেছে। শুধু আমার সঙ্গে চোখাচোখি হলেই বলবে, ‘একটা ছবি তুইলা দেন তো!’
ফারুখ আহমেদ
Farukh.ahmed@gmail.com

অবিস্মরণীয় বিপ্লবী নেতা চে গুয়েভারা



 নজমুল হক নান্নু  
স্পা র্টাকাস থেকে শুরু করে এযাবত্কাল পর্যন্ত যত বিপ্লবী নেতা জন্মগ্রহণ করেছেন নিঃসন্দেহে চে গুয়েভারা তাদের মধ্যে একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিপ্লবী নেতা। তাঁর রাজনৈতিক জীবন, বিপ্লবী জীবন ছিল খুবই সংক্ষিপ্ত। ধূমকেতুর মতোই রাজনীতিতে তাঁর আবির্ভাব। তিনি রাজনীতিতে এসেছেন ডান হাতে রাইফেল আর বাম হাতে ডাক্তারী ব্যাগ নিয়ে। বিপ্লবে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েই তিনি রাজনৈতিক মতাদর্শ সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ শুরু করেন। চে গুয়েভারা আর্জেন্টাইন মার্কসবাদী কমিউনিস্ট, বিপ্লবী, চিকিত্সক, লেখক, কবি, বুদ্ধিজীবী, গেরিলা নেতা, কূটনীতিবিদ, সামরিক যুদ্ধের তাত্ত্বিক ও প্রশিক্ষক এবং কিউবা বিপ্লবের অন্যতম প্রধান নেতা। একজন মানুষ যে কত বৈচিত্র্যময় প্রতিভায় সমৃদ্ধ হতে পারে চে গুয়েভারা তার উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত। তিনি জন্মগ্রহণ করেন আর্জেন্টিনায়। বিপ্লব করেন কিউবায়। আর বিপ্লবের মধ্য দিয়েই মৃত্যুবরণ করেন বলিভিয়াতে। তিনি জীবিত থাকাকালীন সমগ্র পৃথিবীকে এমনভাবে ঝাঁকুনি দিয়েছেন, তাঁর মৃত্যুর পর সমগ্র পৃথিবী এমনভাবে আলোড়িত হয়েছে, অতীতে যা আর কখনও এমনটি ঘটেনি। মৃত্যুর পর এ যাবত্কাল পর্যন্ত তাঁর জীবন ইতিহাস নিয়ে পৃথিবীর প্রায় সবগুলো প্রধান প্রধান ভাষায় হাজার হাজার বই লেখা হয়েছে। গবেষণা হয়েছে। এমনকি এখন পর্যন্ত তা অব্যাহত রয়েছে। বর্তমান পৃথিবীর আধুনিক তরুণ সমাজের মধ্যেও চে সম্পর্কে কৌতূহলের সীমা নেই। পরিধেয় বস্ত্রে চে’র ছবিই তার বড় প্রমাণ। চে গুয়েভারার রাজনৈতিক ও বিপ্লবী জীবন ছিল মাত্র আট বছর, ১৯৫৯-১৯৬৭ সাল পর্যন্ত। এই সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে তিনি যা সৃষ্টি করেছেন, সমাজ বিপ্লবে যে অবদান রেখেছেন তা আশ্চর্যতম ঘটনা। তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত লেখনির মধ্যে রয়েছে রাজনীতি ও সামাজিক তত্ত্ব, সামরিক ও গেরিলা যুদ্ধের রণনীতি ও রণকৌশল, কূটনৈতিক পদ্ধতি ও পরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ দলিল, বইপত্র, বক্তৃতার লিখিত কপি, বিভিন্ন ম্যাগাজিনের নিবন্ধ, চিঠিপত্র, ডায়েরী, কবিতা, গান, গল্প, অফিসিয়াল ডকুমেন্টস, মার্কসবাদের ব্যাখ্যা, শ্রমিক, কৃষক, বিপ্লবী পার্টির তাত্ক্ষণিক তাত্ক্ষণিক সিদ্ধান্ত, অর্থনীতি ইত্যাদি বহু বিষয়ের ওপর অজস্র লেখা। চে গুয়েভারার এসব মহামূল্যবান সৃষ্টি কিউবা সরকার আর্কাইভসে সংরক্ষিত করে রেখেছে। এসব সৃষ্টি সর্বকালের জনগণের জন্য দেশপ্রেম, ত্যাগ ও বিপ্লবী জীবনের অনুপ্রেরণার উত্স্য।
১৯৪৭ সালে চে গুয়েভারা বুয়েনস আয়ার্স বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিত্সা শাস্ত্রে অধ্যয়নের জন্য ভর্তি হন। এরপর চে গুয়েভারার জীবন প্রবাহ দ্রুতগতিতে এগিয়ে যেতে থাকে। তিনি সমগ্র ল্যাটিন আমেরিকা ভ্রমণ করে শোষক ও শোষিত মানুষের মধ্যকার শোষণ সম্পর্কে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনের ইচ্ছা পোষণ করেন। ১৯৫০ সালে হঠাত্ করে তিনি একটি তেল ট্যাঙ্কারে খালাসির চাকরি নিয়ে ত্রিনিদাদ ও বৃটিশ গায়ানা ভ্রমণ করেন। তারপর ১৯৫১ সালে বন্ধু আলবার্তো গ্রানাদাসহ ঐতিহাসিক মোটরসাইকেল ভ্রমণে বেড়িয়ে পড়লেন। প্রথমে চিলিতে গ্রামে গ্রামে ঘুরে দেখলেন মানুষের দুর্বিষহ শোষণ-নিপীড়ন। পুরনো মোটরসাইকেল নষ্ট হয়ে গেল। অনেক কষ্টে পেরুতে আমাজন নদীর তীরে এলেন তারা। তারা সু-উচ্চ আন্দিজ পর্বতমালার ওপরে প্রাচীনতম আশ্চর্য নগরী মাচ্চু পিচ্চু ভ্রমণ করলেন। ইনকা সভ্যতার বিকাশ দেখলেন। এরপর কলম্বিয়া। সেখান থেকে ভেনিজুয়েলা হয়ে আর্জেন্টিনায় ফিরে এলেন। ৭ মাস ধরে ল্যাটিন আমেরিকা ভ্রমণ করলেন দু’জন। চে গুয়েভারা ভ্রমণের বাস্তব অভিজ্ঞতা ও খুঁটিনাটি সব কিছুই ডায়রিতে লিখে রেখেছিলেন। পরবর্তী সময়ে ‘দি মটর সাইকেল ডায়ারিস’ এই নামে চে গুয়েভারার একটি বই প্রকাশিত হয়। বইটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। সেই সময় নিউইয়র্ক টাইমস-এর মতে সর্বোচ্চ বিক্রীত বই, ‘দি মটর সাইকেল ডায়ারিস।’ একই নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়, যা দর্শক জনপ্রিয়তার কারণে ২০০৪ সালে পুরস্কার বিজয়ের সম্মান লাভ করে। ১৯৫৩ সালে তিনি ডাক্তারী পাস করলেন, সার্জন ও চর্ম বিশেষজ্ঞ হিসেবে। প্র্যাকটিস করার সনদ ও অনুমতিপত্র পেলেন। কিন্তু শুধুমাত্র ডাক্তারী করে নিজের আর্থিক সচ্ছলতা আনয়নের জন্যই চে গুয়েভারার জন্ম হয়নি। তিনি ১৯৫৩ সালের ৭ জুলাই পুনরায় দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকা সফরে বেরিয়ে পড়লেন, সাথে বাল্যবন্ধু কালিকা (কার্লোস ফেরার)। এবার বলিভিয়া, পেরু, ইকুয়েডর, পানামা, কোস্টারিকা, নিকারাগুয়া, হন্ডুরাস এবং এলসালভাদর ভ্রমণ করলেন। এই দেশে পরিচয় হলো কয়েকজন আর্জেন্টাইন বিপ্লবীর সাথে। আর কোস্টারিকায় পরিচয় হলো কিউবান বিপ্লবী আন্দোলনের কয়েকজন কর্মীর সাথে। এরপর তারা ১৯৫৩ সালে ২৪ ডিসেম্বর এসে পৌঁছলেন গুয়াতেমালায়। এখানেই পেরুর বিপ্লবী মহিলা হিন্দা হিলদাগাদিয়ার সাথে চে’র পরিচয় হলো। সেই সময় গুয়াতেমালায় শাসন ক্ষমতায় ছিলেন গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত বামপন্থী প্রগতিশীল প্রেসিডেন্ট জ্যাকোবো আরবেনজ গুজম্যান। আমেরিকার স্বার্থ বিঘ্নিত হওয়ায় প্রতিবিপ্লবের মাধ্যমে সিআইএ প্রেসিডেন্ট আরবেনজকে উত্খাতের ষড়যন্ত্র করতে থাকে। চে এবং হিলদা প্রতিবিপ্লবে প্রতিহত করার সংগ্রামে যোগ দিলেন। কিন্তু ১৯৫৪ সালের ১৭ জুন আমেরিকা গুয়াতেমালার বিমান থেকে বোমাবর্ষণ শুরু করলো। আরবেনজ  মেক্সিকো দূতাবাসে আশ্রয় নিলেন। চে আর্জেন্টিনা দূতাবাসে আশ্রয় নিলেন। হিলদা গ্রেফতার হলেন। এরপর ১৯৫৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর চে মেক্সিকোতে আসেন। হিলদা কারাগারে অনশন করার কারণে প্রতিবিপ্লবী সরকার তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। তিনিও মেক্সিকোতে এলেন।
 ১৯৫৫ সালের জুলাই মাসে কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ত্রোর সাথে চে’র পরিচয় হয়। আর সেই পরিচয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন তাঁর ছোটভাই রাউল ক্যাস্ত্রো। রাউলের সাথেই চে’র প্রথম পরিচয় হয়। সারারাত ধরে চে ফিদেলের সাথে কিউবা বিপ্লবী অভিযান, রাজনীতি ও রণকৌশল নিয়ে কথা বললেন, পরিকল্পনা করলেন। এরপর স্পেনীয় সেনাবাহিনীর একজন প্রাক্তন কর্নেল আলবার্তো বেয়োর কাছে গোপনে মেক্সিকোতেই গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ শুরু হলো। চে গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণে অসাধারণ কৃতিত্ব প্রদর্শন করলেন। ১৯৬৬ সালের ৭ নভেম্বর বলিভিয়ার নানকাহুয়াসু গেরিলা ঘাঁটিতে পৌঁছলেন চে। ১৯৬৭ সালের ২৩ মার্চ চে’র নেতৃতাধীন গেরিলা বাহিনী নিজেদের চিহ্নিত করলো ‘বলিভিয়ার জাতীয় মুক্তিফৌজ’ নামে। ৮ অক্টোবর কেব্রাদা দেল ইউরোর যুদ্ধে গুরুতর আহত ও নিরস্ত্র অবস্থায় বন্দী হলেন চে। তাঁকে বন্দী অবস্থায় হিগুয়েরা গ্রামের সাধারণ স্কুল বাড়িতে ফেলে রাখা হলো। চিকিত্সা দেয়া হলো না। খাবার পানিটুকুও দেয়া হলো না। অথচ যুদ্ধক্ষেত্রে ড. আর্নেস্টো চে গুয়েভারা নিজে আহত থাকা অবস্থায় আহত শত্রু সৈন্যকে আগে সেবাদান করেছেন, তারপর নিজেদের বাহিনীর আহত কমরেডকে, তারপর নিজের চিকিত্সা করেছেন। যন্ত্রণা দিয়ে ধীরে ধীরে নিষ্ঠুরভাবে হত্যার নীতি গ্রহণ করেছিলেন বলিভিয়া সরকার ও সিআইএ। অবশেষে ৯ অক্টোবর দুপুর ১-২০ মিনিটে এই মহান বিপ্লবী নেতা ড. আর্নেস্টো চে গুয়েভারাকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়। মৃত্যুর সময় চে গুয়েভারা জনগণের উদ্দেশে উচ্চারণ করেছিলেন “হাস্তা লা ভিক্তোরিয়া সিয়াম্প্রে”। অর্থাত্ চিরস্থায়ী বিজয়ের পথে এগিয়ে যাও।
লেখক: আইনজীবী

মঙ্গলবার, ১২ জুন, ২০১২

লালিত জীবন পালিত সুখ



কে জি মোস্তফা
শাহনাজ কবিতাচর্চায় এক নিবেদিত প্রাণ। কবিতা লেখে, কবিতা আবৃত্তি করে। সংসার, স্বামী ও সন্তানদের দেখাশোনার ফাঁকে ফাঁকে ছুটে যায় কবিতার আসরে। কবিতার প্রতি তার প্রচণ্ড অনুরাগ ও আগ্রহ সত্যি প্রশংসনীয়। তার সঙ্গে আমার পরিচয়ের প্রথম দিনে আমি কিছুটা চমকে উঠেছিলাম। ওর চেহারার আদল যেন অনেকটা আমার ছোট খালার। ছোট খালা ছিলেন আমার আবাল্য আকৈশোর সঙ্গী। চিরদুখী খালা আজ আর নেই। বলা যায় অকালেই ইন্তেকাল করেন।
প্রাণচঞ্চল দুরন্ত জীবনের অন্য নাম কৈশোর। সেই কৈশোরে আমার একমাত্র সঙ্গী আমার ছোট খালা। বয়সে বড় হলেও প্রায় সমবয়সী ছিলাম আমরা। মা-বাবার রাগারাগি বকাঝকায় খালা ছিল আমার আশ্রয়-প্রশ্রয়। খালবিল পুকুরে মাছধরা ছিল আমার নেশা। মনের আনন্দে দুজনে মিলে মাছ ধরতাম। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠে কাঁচাপাকা কত রকমের আম যে কুড়াতাম। কবি জসীম উদদীনের সেই বিখ্যাত কবিতাটি—‘বৈশাখ মাসে ঝড়ের দিনে আম কুড়াতে সুখ, পাকা জামের মধুর রসে রঙিন করি মুখ।’ আম জাম ছাড়াও জানা-অজানা ফুল-ফলের কত যে নাম ছিল আজ আর মনে পড়ে না। কোথায় গেল হারিয়ে আমার বাঁশির দেশের মন, আহা আমার বেতসবনের লুকিয়ে থাকা ক্ষণ! সেই জীবন কথার টুকরো টুকরো স্মৃতিগুলো বেজে ওঠে অহরহ।
মনে পড়ে সেইসব অনাদিকালের দৃশ্য। অমন মায়াবী ল্যান্ডস্কেপে চারদিকে খুশি। খুশির বন্যায় ফুটতো কত বিচিত্র ফুল। ঝোপেঝাড়ে গাঢ় সবুজের হাতছানি। পাতার আড়াল থেকে পাখিদের গান। বড় বড় গাছপালা, নিচু ঝোপঝাড়। নানা রকমের প্রজাপতির ওড়াউড়ি। ফুরফুরে হাওয়া। যেখানে নিঃশব্দ যেন শব্দকে খেয়ে ফেলে। সেই নিস্তব্ধতায় আমরা হাঁটতাম। সঙ্গে হাঁটতো কত আবেগ, কত অনুভূতি, কত স্বপ্ন। ভীরু মনে অজানা করুণ সুর, বুকের ভেতর মন কেমন করা দীর্ঘশ্বাস।
প্রাণের মায়া বড় কঠিন মায়া। জ্যৈষ্ঠমাস মধুমাস। আম জাম কাঁঠালের মাস। স্বজনদের কাছ থেকে বার বার ডাক আসে। একটা ধূসর সময়কে সতেজ করার প্রয়াসে মাঝে মাঝে ছুটে যেতে হয়, যাই। মহানগরীর একাকীত্ব, বহুচর্চিত ক্লিন্নতা থেকে মুক্তি পেতে চায় মন।
যদিও পল্লীসমাজ আজ কোণঠাসা, তবু সৌহার্দ্যবিহীন নয়। মানুষের সামাজিক পরিচয় ও আত্মীয়তার বন্ধনকে কখনই অস্বীকার করা যায় না। সেই পরিচয়গুলোই মানুষের প্রধান পরিচয়, সে বন্ধনই জীবনপ্রবাহকে ছন্দে বেঁধে রাখে।
পল্লীগ্রাম, আটপৌরে স্মৃতি। প্রিয় স্মৃতিগুলো কি এ রকমই টাটকা থাকে!
কবেকার সেইসব স্মৃতি। নদীমাতৃক জীবন। সাবেকি বাড়ি। আনমনা ছায়া গাছ। চৈতালি ঘূর্ণি, ঝড় ও ঝরাপাতা, বহু প্রতীক্ষিত ঝিরঝিরে বৃষ্টি।
সেইসব দিন ছিল নিছক জীবনযাপন। নকশিকাঁথা সে জীবন সম্পর্কে আজও অতীতের অবগুণ্ঠনে ভালোবাসা যেন জেগে আছে।
অবশ্য সময়টা দ্রুত পাল্টাচ্ছে। গ্রাম বলে এখন আর তেমন কিছু নেই। কখন গ্রামের ভেতর চলে গেছে শহর, কেউ কি দেখবে আর সাঁকো দিয়ে পারাপার, পালকি গরুর গাড়ি নৌকার বহর! তবে চিরন্তনের হেফাজতে আগের মতোই অবিকল কিছু কিছু গাছ আজও আছে। আছে আম জাম আরও কিছু বাহারি গাছ। অত নাম জানি না, ঘাসবনও রয়েছে।
ফুলে ফলে বীজে সাবেকি বাড়িঘর আজও আঁকড়ে আছে। গোটা কতক শালিক কিচিরমিচির করে অবিরত। অনেক নিঝুম দুপুরে সুরের আর্তিতে কেঁপে কেঁপে ওঠে গাছের পাতাগুলো। সেইসব গাছের নিচে দাঁড়িয়ে এত বছর বাদেও পুরো দৃশ্যটা অনায়াসে স্মরণে আসে।
প্রাক-সন্ধ্যার আদূরে হাওয়া। সাঁঝের পশ্চিম আকাশ উদাসী লাল। বাইরে সোনালি সন্ধ্যা রক্তিম হয়ে উঠেছে। ঘরে ফেরা পাখিদের ডানা ঝাপটানো। এত উপর থেকে ওই আদিগন্ত কী অদ্ভুত লাগে। দিগন্ত থেকে কিছু উপরে আকাশে দপদপ করে জ্বলছে সন্ধ্যাতারা। হাঁটতে হাঁটতে আজ বড় একা লাগে।
জীবন ছিটকে যাচ্ছে। মানুষ ছিটকে ছড়িয়ে পড়ছে, ফোঁটা ফোঁটা হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে অন্য মানুষদের মধ্যে। গতানুগতিক সঙ্কীর্ণ এই জীবনযাপনের সঙ্গে আত্মিক যোগসূত্র শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিগুলো। অতীতের মধ্যে রয়েছে স্বপ্ন দেখার সৃজনশীলতা। রয়েছে লালিত জীবনের পালিত সুখ। জীবন তোমায় জানাই আমি হাজারো সালাম। কোথা থেকে কেমন করে এত দূরে এলাম! সংসারে যা দেয়ার সব দিয়েছি। জীবনে যা আদায় করার, করে নিয়েছি।
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন। তখন গল্পের জোনাকি রঙে সব কিছু যেন ঝিলিমিলি। সব পাখি ঘরে আসে, সব নদী বয়ে যায়, ফুরায় বুঝি জীবনের সব লেনদেন!
চারদিকে বুঝি অন্ধকার নেমে আসে। অন্ধকার, তুমি যতই বিধ্বংসী হও না কেন, প্রেমই আমার জয়লাভের প্রধান অস্ত্র! প্রেম মহান স্রষ্টার দিব্য স্বরূপ!
লেখক : গীতিকার, কবি, সাংবাদিক

শনিবার, ৯ জুন, ২০১২

ফররুখ আহমদ : নবজাগরণের কবি



আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ফররুখ আহমদ। ১৯১৮ সালের ১০ জুন বর্তমান মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলার মাঝআইল গ্রামে তার জন্ম। তিনি মানবতার কবি, সংগ্রাম ও ন্যায়ের কবি, রেনেসাঁর কবি, নবজাগরণের কবি। তিনি লিখেছেন অসংখ্য কবিতা। তিনি কাব্যনাট্য, মহাকাব্য, রোমান্টিক কবিতা, সনেট, ব্যঙ্গ-রসাত্মক কবিতা, শিশুতোষ ছড়া, নাত ও হামদ, ইসলামি, আধুনিক ও দেশাত্মবোধক গান ও কবিতা, এমনকি গল্প ও প্রবন্ধ রচনায় নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়েছেন। 
কবি ফররুখ আহমদ ছোটদের ভালোবাসতেন। তাই তাদের জন্য অনেক ছড়া-কবিতা রচনা করেছেন। শিশুদের জন্য তার গ্রন্থগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেÑ নতুন লেখা, চিড়িয়াখানা, ফুলের জলসা, কিসসা কাহিনী, ছড়ার আসর, পাখির বাসা, হরফের ছড়া প্রভৃতি। ১৯৬৫ সালে বাংলা একাডেমী প্রকাশ করে পাখির বাসা। এ বইয়ে তিনি চমৎকার ছড়া লিখেছেনÑ ‘আয়গো তোরা ঝিমিয়ে পড়া দিনটাতে, পাখির বাসা খুঁজতে যাব একসাথে।’ এই বই লিখে ইউনেস্কো পুরস্কারে ভূষিত হন। তার দ্বিতীয় শিশুতোষ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালে, নাম নতুন লেখা। একই সময় তার লেখা হরফের ছড়া ও ফুলের জলসা গ্রন্থের সবগুলো কবিতা বিভিন্ন ফুলকে নিয়েই রচিত।
ফররুখ আহমদ একাধারে কবি, ছড়াকার, অনুবাদক, প্রবন্ধকার, শিল্পী, গীতিকার, পরিচালক, আবৃত্তিকার হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন এবং ভাষা আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন। তৎকালীন রেডিও পাকিস্তান, ঢাকা কেন্দ্র থেকে প্রচারিত ‘কিশোর মজলিস’ অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন। রেডিওর জন্য কথিকা, নাটিকা, গান ও গীতি আলেখ্য লিখেছেন। তিনি সার্থক গল্পও লিখেছেন। এর মধ্যে বিবর্ণ, মৃত বসুধা, প্রচ্ছন্ন নায়িকা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। আরব্য উপন্যাস অবলম্বেন আলী বাবার কিসসা রচনা করেছেন। সাতসাগরের মাঝি, সিরাজুম মুনীরা, হাতেম তাই, মুহূর্তের কবিতা, হে বন্য স্বপ্নেরা প্রভৃতি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ। সংগ্রামী ও আপসহীন কবি ফররুখ আহমদ আজ আমাদের মধ্যে নেই। আদর্শবান এ ব্যক্তিত্ব ১৯৭৪ সালের ১৯ অক্টোবর মাত্র ৫৬ বছর বয়সে এ নশ্বর পৃথিবী ত্যাগ করেন। পরিতাপের বিষয়, আজ যখন তার মতো কবিদের জীবন ও কর্ম নিয়ে আলোচনা ও অনুসরণ খুবই প্রয়োজন, তখন তিনি সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে বড়ই অবহেলিত। কবির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর জন্য কায়মনোবাক্যে জান্নাত কামনা করছি মহান আল্লাহর দরবারে। 
আফতাব চৌধুরী

নজরুলের সিয়ারসোল স্কুল


স্কুলের শ্রেণীকক্ষ
স্কুলের শ্রেণীকক্ষ


পশ্চিমবঙ্গের খনির শহর রানীগঞ্জ। বর্ধমান জেলার এই ঐতিহ্যবাহী শহরেই রয়েছে সিয়ারসোল রাজ উচ্চবিদ্যালয়। স্কুলটি ১৫৬ বছরের পুরোনো। এই বিদ্যালয় ইতিমধ্যে পালন করেছে সার্ধশতবর্ষ। এই বিদ্যালয়েরই একসময়ের ছাত্র ছিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বাংলাদেশের জাতীয় কবি। বছর চারেক এই বিদ্যালয়ে পড়েছেন তিনি। এখান থেকেই তিনি যোগ দিয়েছিলেন সেনাবাহিনীর ৪৯ নম্বর বাঙালি পল্টনে। তারপর চলে গিয়েছিলেন করাচির সেনানিবাসে। শুধু কি তাই? এখান থেকেই কবির সাহিত্যজীবনের ভিত্তিভূমি তৈরি হয়েছিল। কবি-প্রতিভার উন্মেষ ঘটেছিল। এখান থেকেই কবির মনে ব্রিটিশবিরোধী চেতনার বীজ রোপিত হয়েছিল। 
আজও সিয়ারসোল রাজ বিদ্যালয়ে কবির স্মৃতিবাহী সেই শ্রেণীকক্ষ রয়েছে। ইতিহাসের পথ ধরে এখনো দাঁড়িয়ে আছে সেই বিদ্যালয়, সেই শ্রেণীকক্ষ। তবে অবিকৃত অবস্থায় রাখা হয়েছে কবির স্মৃতিবাহী শ্রেণীকক্ষটিকে। তখন বিরাট একটা হলঘরে পার্টিশন দিয়ে চালানো হতো বিদ্যালয়ের বিভিন্ন ক্লাস। বড় বড় দরজা। লোহার বিম, কাঠ-সুরকির ছাদ। আজ সেই সিয়ারসোল রাজ বিদ্যালয়ে আরও চারটি নতুন ভবন তৈরি হয়েছে। এই বিদ্যালয়ে এখন পাঠ দেওয়া হয় দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত। ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের স্মৃতিবাহী এই বিদ্যালয়ে প্রথম দিকে সহশিক্ষা থাকলেও এখন পড়ানো হয় কেবল ছাত্রদের। ছাত্রসংখ্যা এক হাজার ৯০০। 
তবুও ইতিহাসের স্মৃতিচিহ্ন মুছে দেয়নি বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। পুরোনো ভবনটির সামনে ছিল টালির ছাউনি। সংস্কার করে সেটিকে রাখা হয়েছে অবিকৃতভাবে। হলুদ রঙের এই বিদ্যালয় ভবনের সামনে রয়েছে কবি নজরুলের একটি আবক্ষ মূর্তি। চার পাশে ফুলের বাগান। ছয় একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত এই বিদ্যালয়। সিয়ারসোলের রাজপরিবারের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই বিদ্যালয়টি। 
কবির স্মৃতিবাহী সেই বিদ্যালয়টি দেখার জন্য আমরা চলে আসি রানীগঞ্জ শহরে। শিশুবাগানের কাছে এই বিদ্যালয়ের অবস্থান। আমরা যখন পৌঁছাই, তখন বিদ্যালয় ছুটি হয়ে গেছে। তবুও প্রধান শিক্ষকের অনুগ্রহে আমরা বিদ্যালয়টি ঘুরে ঘুরে দেখার সুযোগ পাই। 
প্রধান শিক্ষক তাপস কুমার চট্টোপাধ্যায় জানালেন, চুরুলিয়া থেকে আসানসোল হয়ে এই বিদ্যালয়ে পড়তে এসেছিলেন কবি নজরুল সেই ১৯১১-১২ সাল নাগাদ। গ্রাম থেকে প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ চুকিয়ে তিনি ভর্তি হয়েছিলেন সম্ভবত পঞ্চম শ্রেণীতে। দরিদ্র ও মেধাবী ছাত্র হওয়ায় নজরুলকে বিনা খরচায় পড়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল এই সিয়ারসোল রাজ বিদ্যালয়ে। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে রানীগঞ্জের ভবতারিণী ছাত্রাবাসে থাকার ব্যবস্থাও করে দিয়েছিল। এই ছাত্রাবাসটি ছিল রানীগঞ্জ শহরের এখনকার অঞ্জনা সিনেমা হলের কাছে। ছাত্রাবাসের কোনো অস্তিত্ব এখন আর নেই। 
কিন্তু বছর খানেক পড়ার পর তিনি এই বিদ্যালয় ছেড়ে চলে যান মাথরুনের নবীনচন্দ্র ইনস্টিটিউশনে। সেখানকার প্রধান শিক্ষক ছিলেন পল্লীকবি কুমুদরঞ্জন মাল্লিক। এখানেও বেশিদিন টিকতে পারেননি নজরুল। এখান থেকেই চলে যান বাংলাদেশের ময়মনসিংহের দড়িরাম হাইস্কুলে। তারপর ১৯১৫ সালের দিকে নজরুল ফের চলে আসেন এই সিয়ারসোল রাজবিদ্যালয়ে। ভর্তি হন সপ্তম শ্রেণীতে। সপ্তম শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষায় ডবল প্রমোশন পেয়ে নবম শ্রেণীতে ওঠেন নজরুল। নজরুলের ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল ১৯১৮ সালে। কিন্তু ১৯১৭ সালের আগস্ট কি সেপ্টেম্বর মাসে এই স্কুল ছেড়ে তিনি ঐতিহাসিক ৪৯ নম্বর বাঙালি পল্টনে যোগ দেন। তারপর চলে যান করাচির সেনানিবাসে। 
প্রধান শিক্ষক আরও বলেছেন, এই বিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময়ই নজরুলের কবি-প্রতিভার প্রকাশ ঘটে। এখানে পড়াশোনার সময় কবি নজরুলের সাহচর্য ঘটে প্রখ্যাত লেখক শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। শৈলজানন্দ ১৯১৭ সালে পড়তেন রানীগঞ্জ হাইস্কুলে। কবি নজরুল রানীগঞ্জের রামবাগানের সেই ঐতিহাসিক বটগাছের নিচে বসে শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে চর্চা করেছেন কবিতার। 
প্রধান শিক্ষক আরও বলেছেন, নজরুলের স্মৃতিবাহী শ্রেণীকক্ষটিকে সংরক্ষণ করা হয়েছে ‘নজরুল স্মৃতিকক্ষ’ নামে। সত্তরের দশকে নকশাল আন্দোলনের সময় আগুনে ভস্মীভূত হয়ে যায় বিদ্যালয়ের সব রেকর্ড ও নথিপত্র। সে সময় ভাগ্যক্রমে রক্ষা পেয়েছিল বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির একটি মিনিটবুক। সেই মিনিটবুকের ১৯১৭ সালের ২ মে ৪ নম্বর রেজিউলিশনে লেখা ছিল দশম শ্রেণীর ছাত্র কাজী নজরুল ইসলামকে মাসে পাঁচ টাকা হারে বৃত্তি দেওয়া হোক ১৯১৮ সালের ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা পর্যন্ত। 
প্রধান শিক্ষক আরও বলেছেন, এই বিদ্যালয়ে পড়াকালীন নজরুল ব্রিটিশবিরোধী দ্রোহ চেতনা, আপসহীন সংগ্রাম, জাতের নামে বজ্জাতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। অনুপ্রাণিত হন স্বদেশ প্রেমে, অসাম্প্রদায়িতার আদর্শে। এই সিয়ারসোলের প্রখ্যাত বিপ্লবী নিবারণচন্দ্র ঘটক ছিলেন নজরুলের প্রিয় শিক্ষক। তিনিই মূলত বিপ্লবের মন্ত্রে উজ্জীবিত করেন নজরুলকে। কবি নজরুল শাস্ত্রীয় সংগীতের শিক্ষা নিয়েছিলেন এই বিদ্যালয়ের অপর শিক্ষক সতীশচন্দ্র কাঞ্জিলালের কাছে। তাই সিয়ারসোল বিদ্যালয় নজরুল জীবনের সঙ্গে মিশে আছে আজও।
অমর সাহা
কলকাতা

ব্রিটেনের রানির হীরকজয়ন্তী


আতাউর রহমান

ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের সিংহাসনে আরোহণের হীরকজয়ন্তী উদ্যাপন উপলক্ষে সে দেশে এ মাসের ২ তারিখ থেকে চার দিনব্যাপী বর্ণাঢ্য উৎসব হয়েছিল, যেটার রেশ এখনো চলছে। অবশ্য এলিজাবেথ রানিই হতে পারতেন না, যদি না তাঁর পিতৃব্য অষ্টম অ্যাডওয়ার্ড ডিভোর্সি মিসেস সিম্পসনের প্রেমে পড়ে স্বেচ্ছায় সিংহাসন ত্যাগ করায় তাঁর বাবা ষষ্ঠ জর্জ ব্রিটেনের রাজা হতেন। 
সে যা হোক। আমি আশির দশকে লন্ডনে বাংলাদেশ মিশনে প্রথম সচিবের পদমর্যাদায় সাড়ে চার বছর কর্মরত ছিলাম বিধায় রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের ব্যাপারে আমার নিজস্ব কিছু মজার স্মৃতি আছে। কিন্তু সেগুলো রোমন্থনের আগে রানির জীবনে সংঘটিত কিছু উপাখ্যান উপস্থাপন করে নিই:
রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের পুরো নাম হচ্ছে এলিজাবেথ আলেকজান্ড্রা মেরি। তিনি ১৯৬৫ সালে একবার গিয়েছিলেন তৎকালীন পশ্চিম জার্মানিতে, রাষ্ট্রীয় সফরে। পশ্চিম জার্মানির সে সময়ের প্রেসিডেন্ট হেনরিক ল্যুবক ইংরেজি ভাষাটা তেমন জানতেন না। হেনরিক এয়ারপোর্টে এসেছেন রানিকে অভ্যর্থনা জানাতে। রানি উড়োজাহাজ থেকে নামতেই তিনি এগিয়ে এসে ভদ্রতা রক্ষার্থে রানির কুশল সংবাদ জিজ্ঞেস করতে গিয়ে ‘হাউ আর ইউ’ বলার পরিবর্তে বলে বসলেন, ‘হু আর ইউ’। অর্থাৎ ‘আপনি কেমন আছেন’ এর পরিবর্তে ‘আপনি কে?’
রানিও কম যান না, তিনি মৃদুহাস্যে জবাব দিয়েছিলেন, ‘আই অ্যাম এলিজাবেথ আলেকজান্ড্রা মেরি অব লন্ডন’, ‘আমি হচ্ছি লন্ডন থেকে আগত এলিজাবেথ আলেকজান্ড্রা মেরি।’
প্রসঙ্গত মনে পড়ে গেল, বারান্তরে রানি রাষ্ট্রীয় সফরে পশ্চিম জার্মানির রাজধানী বন থেকে নেদারল্যান্ডের হেগ শহরে গিয়েছিলেন। তখন আমাদের এখানকার দৈনিক সংবাদ-এর হেডলাইন ছিল এই: ‘রানি বন থেকে হেগে গেলেন।’ এটা নিয়ে তখন খুব হাসাহাসিও হয়েছিল।
গেল শতাব্দীর সত্তরের দশকে নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন ইয়াকুবু গওয়ন। তিনি একবার রাষ্ট্রীয় সফরে বিলেতে গেছেন। সে দেশের প্রচলিত রাষ্ট্রাচার অনুযায়ী রানি এলিজাবেথ তাঁকে লন্ডনের ভিক্টোরিয়া রেলস্টেশনে অভ্যর্থনা জানিয়ে রাষ্ট্রীয় অশ্ববাহিত শকটে করে বাকিংহাম প্রাসাদে নিয়ে যেতে এসেছেন। সম্মানিত অতিথিকে সঙ্গে নিয়ে রানি যেই না শকটে উপবেশন করেছেন, অমনি একটি ঘোড়া সশব্দে বাতকর্ম করে দিল, যেটাকে ইংরেজিতে ফার্টিং বলে। রানির ভদ্রতা ও শালীনতাবোধ এতটাই প্রবল যে তিনি ঘোড়ার এই ব্যবহারে মনে মনে লজ্জিত হয়ে ভাবলেন, সম্মানিত অতিথির কাছে এ জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা দরকার। তাই তিনি মুচকি হেসে প্রেসিডেন্ট গওয়নের উদ্দেশে ‘আমি ক্ষমা চাচ্ছি, আপনার শুরুটা খুব ভালো হলো না’ বলতেই গওয়ন নাকি তৎক্ষণাৎ বলে উঠেছিলেন, ‘আপনার ক্ষমা চাওয়ার প্রয়োজন নেই। তা ছাড়া আমি ভেবেছিলাম, ওটা একটি ঘোড়ার কাণ্ড।’
কথায় বলে, রাজদর্শন নাকি পুণ্যের। বিলেতে আমার সাড়ে চার বছরব্যাপী অবস্থানকালে রাজদর্শন অর্থাৎ রানিদর্শন হয়েছে সর্বসাকুল্যে চারবার—দুবার রানির গার্ডেন পার্টিতে, একবার ইভনিং পার্টিতে ও একবার রানির কাছে আমাদের নতুন রাষ্ট্রদূত কর্তৃক পরিচয়পত্র প্রদানকালে তাঁর সহগামী হওয়ায়। রানি বছরে একবার বসন্তকালের বিকেলে বিলেতসহ কমনওয়েলথভুক্ত ৫৪টি দেশের বিলেতে বসবাসরত নর-নারীদের মধ্য থেকে নির্বাচিত হাজার কয়েক লোককে বাকিংহাম প্রাসাদের ভেতরের বাগানে খোলা আকাশের নিচে চা-চক্রে নিমন্ত্রণ করেন এবং তখন তিনি অত্যন্ত ‘বিল্যাকসড’ভাবে পূর্বনির্ধারিত সময়ের ভেতরে যতটা সম্ভব আমন্ত্রিত অতিথিদের সঙ্গে এলোপাতাড়িভাবে কথাবার্তা বলে বেড়ান। আর ইভনিং পার্টিতে প্রাসাদের হল রুমে বিভিন্ন দেশের নির্দিষ্টসংখ্যক কূটনীতিবিদকে সস্ত্রীক নিমন্ত্রণ করা হয়ে থাকে। সেবার রানি তাঁর স্বামী, ছেলে প্রিন্স চার্লস ও ডায়ানা একসঙ্গে ঘুরে ঘুরে সবার সঙ্গে করমর্দন ও কুশল বিনিময় করছিলেন। একপর্যায়ে প্রিন্স চার্লস পেশাদার কূটনীতিক আমাদের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত প্রয়াত ফকরুদ্দিন অহমদকে বাংলাদেশ মূলত একটি কৃষিপ্রধান দেশ বিধায় সহাস্যে জিজ্ঞেস করে বসলেন, ‘আর ইউ এ ফারমার?’ অর্থাৎ ‘আপনি কি একজন কৃষক?’ রাষ্ট্রদূত ‘নো, আই অ্যাম নট’ বলে দেখলাম একটুখানি মন খারাপ করে আছেন। ততক্ষণে চার্লস সামনে এগিয়ে গেছেন। আমি তাই ব্যাপারটাকে হালকা করার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রদূতকে বললাম, ‘স্যার, প্রিন্স একদিক দিয়ে যথার্থই বলেছেন। কৃষিপ্রধান দেশের প্রতিনিধিত্বকারী রাষ্ট্রদূতও একজন কৃষকই তো হওয়ার কথা।’ রাষ্ট্রদূত আমার কথায় হেসে ফেললেন।
বাকি রইল মুক্তিযোদ্ধা ও লে. জেনারেল (অব.) মীর শওকত আলীর (বর্তমানে প্রয়াত) বাকিংহাম প্যালেসে রানির কাছে পরিচয়পত্র প্রদানের উপাখ্যান। দূতাবাস থেকে রাজকীয় অশ্ববাহিত তিনটি শকটে করে রাষ্ট্রদূত ও তাঁর সহযাত্রী আমরা চারজন কর্মকর্তা বাকিংহাম প্রাসাদের ভেতরে রানির খাস দপ্তরে ঢুকতেই কিছুক্ষণের মধ্যে অনুভব করলাম, গলার রস যেন একদম শুকিয়ে গেছে। হাজার হোক, বাকিংহাম প্যালেস ও রাজদর্শন বলে কথা! রাষ্ট্রদূতও খানিকটা ভড়কে গেছেন মনে হলো। কারণ, প্রটোকলটা ছিল এ রকম: প্রথমে রাষ্ট্রদূত রানির সঙ্গে পরিচিত হবেন; অতঃপর আমরা একজন একজন করে যাব, তিনি আমাদের নাম ধরে পরিচয় করিয়ে দেবেন। পূর্বাহ্নে একপর্যায়ে আমাদের তিনি বলে রাখলেন, ‘আমি যদি আপনাদের কারও নাম বলতে ভুল করি, তাহলে আমাকে কনট্রাডিক্ট করবেন না। আর ঘটলও ঠিক তাই। আমি যখন রানির সঙ্গে পরিচিত হতে উপনীত হলাম, তখন তিনি পরিচয় করিয়ে দিলেন ‘হি ইজ মিস্টার লিয়াকত আলী খাঁন...।’
অর্থাৎ তিনি আমাকে তখনো পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী বানিয়ে দিলেন আর কি। হা হা হা!
আতাউর রহমান: রম্য লেখক। ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক।