আল মাহমুদ
অসুখ-বিসুখে জর্জরিত হয়েও দিন তো আমার কেটেই যাচ্ছে। দিনের পেছনে দিন, সপ্তাহ, মাস, বছর অতিক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে। এখন মনে প্রশ্ন তো জাগবেই, এই দেখার অভিজ্ঞতা নিয়ে কী কাজ করেছি, কার জন্য করেছি, কোথায় জমা হয়ে আছে আমার এই পরিশ্রমের শস্য। আবার দেখেছি হিসাব মেলাতে মন সায় দেয় না। পড়েছি, উপভোগ করেছি। এর উপাদেয় অংশ শরীরে-মনে মিশে আছে। আমি কবি মানুষ। আমার তো কাজ ছিল স্বপ্ন, ছন্দ, গন্ধ নিংড়িয়ে সৌন্দর্যের রস সৃষ্টি করা। আমি তো বশ মানিনি। কাজ করেছি। তারপর ভাঁজ করে রেখে দিয়েছি। একদিন ভেবেছি কেউ না কেউ এই ভাঁজ খুলে আঁচ করবে আমার কাজের তেজ, তীক্ষষ্টতা, পরাক্রম কী পরিমাণ ছিল। আমি ইতিহাসের পেছনে ছুটতে চেয়েছি। ইতিহাস আমাকে রেখে নানা বাঁক ঘুরে চলে গেছে তার নির্দিষ্ট নিয়মে। আমি সময়ের সাক্ষী হয়ে বেঁচে আছি। কী সাক্ষী দেব আমি ভবিষ্যতের কাছে? একটাই কথা বলতে পারি, আমি ভালোবেসেছিলাম। প্রতিদান পেয়েছি কী পাইনি এটা আর তুলে লাভ কী। আমার কাজ আমি করেছি। পেছন ফিরে তাকাইনি। একটা কথা আছে না, পেছনে যা রেখে এসেছ তা তোমার অতীত নয়, তোমার অভিজ্ঞতা, দুঃখ-কষ্ট ও যন্ত্রণার ইতিহাস মাত্র। জগতে যা কিছু দেখ তার একটা বিবরণ তুমি তোমার পছন্দমত লিখেছ, ভালো কথা। না লিখলেও কারও কিছু কি এসে যেত? তুমি কবিতা লিখেছ কেন? এজন্য যে তুমি সত্যকে স্বপ্নে মিশ্রিত করতে চেয়েছিলে—এ কাজটি তুমি কমবেশি করে গেছ এবং সেখানে তুমি চাও বা না চাও তোমার বিপরীতে দাঁড় করিয়েছ এক সঙ্গিনীকে। এইতো তোমার সৃষ্টি। পরিমাপ করতে গেলে অতি সামান্য ব্যাপার। কিন্তু যেহেতু তুমি কবি, সে কারণে সত্য ও মিথ্যায়, কল্পনায় ও বাস্তবে তুমি যা ধরতে চেয়েছিলে সেটা নিঃসন্দেহে ছন্দ, গন্ধ, মিল এবং শেষ পর্যন্ত এক আকাশের দিকে উত্থিত প্রার্থনা। এগুলো তুমি মোটামুটিভাবে করে গেলেও তোমার মধ্যে আছে এক অতৃপ্তি। এই অতৃপ্তি নিয়ে তোমার সঙ্কোচ করতে হবে না, মানুষমাত্রই অতৃপ্ত। সে বহু বছর ধরে সুখাদ্য, সুপেয় কঠিন ও তারল্য পর্যায়ক্রমে গলাধঃকরণ করে যাচ্ছে। এতে কি তোমার পেট ভরেছে? বলতো কত হাজার বছর ধরে খাচ্ছ? কিন্তু তোমার কি ক্ষিধে মিটেছে? যদি না মিটে থাকে তুমি তো তোমার খাওয়া বন্ধ করবে না। ভোগ-লালসালিপ্ততা কখনও মানুষ বন্ধ করতে পারে না। সে সহস্র বছর খেয়ে ভাড়ার উজাড় করেছে। তবু তার আশ মেটেনি। তবে একটা কাজ সে করেছে। সেটা হলো বারে বারে কবি হয়ে জন্মেছে। শব্দে গন্ধে অনন্তের গান সে রচনা করেছে। সে সুখের মধ্যে বিচ্ছেদের কল্পনাকে অশ্রুজলে সিক্ত করেছে। সে তিক্ততাকে, রিক্ততাকে বুকে জড়িয়ে ধরে অকারণে কেঁদেছে। বারণ মানেনি। সে শুধু একটাই কথা বলতে জগতের কানকে ঝালাপালা করে দিয়েছে। আর সে কথাটির বিষয়বস্তু হলো তার নিজের দেয়া নাম অনুযায়ী প্রেম। আমরা এই প্রেমের ইতিহাসকে বার বার রচনা করি, রটনা করি এবং ঘটনায় পর্যবসিত করি। আমরা ট্র্যাজেডির জন্ম দিই। মানুষ প্রথম যে জায়গা থেকে বিভিন্ন ভাষায় আলাদা হয়ে বেরিয়ে এসেছিল সেই শহরটির নাম ছিল বাবেল। বাবেল শব্দের অর্থ হলো বিচ্ছেদ। এই বাবেল থেকেই বাইবেল শব্দের উত্পত্তি হয়েছে। বাইবেল হলো মহাবিচ্ছেদের কাহিনী।
লেখক : কবি
লেখক : কবি
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন