মনিরুজ্জামান মনির
চলচ্চিত্র একটি শক্তিশালী গণবিনোদন মাধ্যম। এই চলচ্চিত্রে আছে সপ্তকলা বা Seven Arts-এর সমাহার। যুগে যুগে চলচ্চিত্র, আমাদের দেশে সাধারণে পরিচিত। ফিল্ম বা সিনেমা দর্শকদের টেনে নিয়ে গেছে সিনেমা হলে। সিনেমার সেলুলয়েডের পর্দায় দৃশ্যমান হয়েছে নৃত্য, সঙ্গীত, কাহিনীসমৃদ্ধ চলমান জীবনচিত্র। মাইক্রো বিজ্ঞানের কল্যাণে মনোরঞ্জনের অনেক মাধ্যম নতুন নতুন সহজলভ্য বলে আবিষ্কৃত হলেও চলচ্চিত্রের চাহিদায় বিঘ্ন ঘটেনি কখনও বরং উত্তরোত্তর এর আকর্ষণশক্তি বাড়ছে বলা যায়। তবে এর নির্মাণশৈলীতে আধুনিকত্ব, কাহিনীতে ব্যতিক্রমতা দর্শকদের সম্মোহিত করে আনন্দিত করে বিশ্বজুড়ে। আমাদের দেশের চলচ্চিত্রের ধারা কখনও একই গতিতে প্রবাহিত হয়নি। দেশের অর্থনৈতিক-ব্যবসায়িক সচ্ছলতা রাজনৈতিক স্থিতি অবস্থার উপর অনেকটা নির্ভর করে চলচ্চিত্র নির্মাণে আধিক্য। তবে এর পাশাপাশি চলচ্চিত্রের মন্দ-ভালো আকর্ষণীয় কিনা সেদিকটাও বিবেচ্য হয়ে থাকে। তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন বা এফডিসি থেকে ফিল্ম নির্মাণ হয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। যে এফডিসির প্রধান ফটকে ঝুলছে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের পাথরে খুদাই করা ছবি যা মোটেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এখানে অন্যান্য দেশের স্টুডিওর মতো সিনেমা সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তিত্ব যেমন : আমাদের দেশের প্রথম সবাক চলচ্চিত্রের চিত্র পরিচালক আবদুল জব্বার খান বা কিংবদন্তী চিত্র পরিচালক জহির রায়হানের স্থাপত্য নিদর্শন থাকলে মানানসই হতো। অতি সম্প্রতি সরকার কর্তৃক এফডিসি স্বীকৃত হয়েছে শিল্প বা ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে। অথচ এফডিসি কোনো চলচ্চিত্র প্রশিক্ষণের বা চলচ্চিত্রের মান নিয়ন্ত্রক সরকারি প্রতিষ্ঠান নয়। তবে চলচ্চিত্র নির্মাণের পর সেন্সরবোর্ড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে চলচ্চিত্র জমা দিতে হয়। সেখানে চলচ্চিত্রে অশ্লীলতা বা সরকারের বিরুদ্ধে কোনো দৃশ্য চিত্রায়ন করেছে—এমন কোনো বিষয়ের তারা সেন্সর করে থাকে। কিন্তু মান নির্ণয় করে না। আসলে আমাদের দেশে প্রতিবেশী দেশ ভারতের মতো সামগ্রিকভাবে চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রশিক্ষণের কোনো সরকারি ইনস্টিটিউট নেই। আমার এটা বোধগম্য নয়, সরকার এ বিষয়ে উদাসীন কেন? তথ্য মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে এ বিষয়ে কোনো প্রকল্প কি গ্রহণ করা যেত না? এফডিসি শুধু সরকারি নিয়মনীতির ভিত্তিতে চলচ্চিত্র নির্মাণে কাঁচামাল (ফিল্ম) দিয়ে থাকে। শুটিংয়ের জন্য বিশাল আকৃতির ফ্লোর, ক্যামেরা, এডিটিংয়ের যন্ত্র, কক্ষ, ডাবিং থিয়েটার, নেপথ্য সঙ্গীত সংযোজনের জন্য সাউন্ড কমপ্লেক্স, চিত্র পরস্ফুিটন ও মুদ্রণের জন্য কালার ল্যাব ভাড়া দেয়া হয়। বলা যায় সরকার এখানে বেসরকারি ফিল্মের প্রযোজক বা মালিকদের সঙ্গে ব্যবসা করে থাকে। তবে চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য এফডিসিতে নিবন্ধন প্রক্রিয়া আছে। সেখানে নির্মিতব্য ছায়াছবির সারাংশ (স্ক্রিপ্ট) জমা দেয়ার বিধান রয়েছে। তবে আজ পর্যন্ত শোনা যায়নি কোনো ছবি নির্মাণের অযোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছে। সেখানে সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তা নামক একটি বিরাট বহর আছে। আর আছেন প্রতিষ্ঠানের প্রধান একজন এমডি। আওয়ামী সরকারের বর্তমান শাসনকালে আগের ধারাবাহিকতায় চুক্তিবদ্ধ নিয়োগ দেয়া হয়েছে দলীয় সমর্থিত নাট্য অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়কে। আগে দেয়া হয়েছিল বাংলাদেশ টেলিভিশনের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং হালের সাংস্কৃতিক কিছুটা রাজনৈতিক নেতা ম. হামিদকে। আমি আগেই উল্লেখ করেছি এফডিসি নাটক, বা চলচ্চিত্রের মান নিয়ন্ত্রণ করে না। সে শুধু চলচ্চিত্র নির্মাণে কারিগরি সুবিধা ভাড়ার মাধ্যমে দিয়ে থাকে। এখানে শুধু একজন সরকারি আমলা, সু-প্রশাসকের প্রয়োজন। লোকমুখে শোনা যায় এফডিসিতে নাকি দুর্নীতি নামক ‘কালো বিড়াল’টি ঢুকে পড়েছে। এফডিসির পার্চেজ কমিটি, লাভজনক সব কমিটিতে দলীয় সমর্থিত কর্মকর্তা এবং সিনেমা সংশ্লিষ্ট লোকজনের নাম অন্তর্ভুক্ত আছে বলে শোনা যায়। সেই পার্চেজ কমিটি ডিজিটাল যুগে ৭০ দশকের সাউন্ড, ক্যামেরা, এডিটিং ল্যাবরেটরির এনালগ যন্ত্রপাতি কেনার জন্য সুপারিশ করেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। বর্তমানে এফডিসি থেকে ৪০০ ফিটের একটি নেগেটিভ ক্যানের সরকারি ক্রয়মূল্য ১৬ হাজার ৭শ’ টাকা অথচ বাজারে এর বেসরকারি মূল্য ১৪ হাজার টাকা। এতে কি সরকার ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না? এফডিসির ৯টি শুটিং ফ্লোরের মধ্যে ৮টি ফ্লোরই বরাদ্দ দেয়া হয়েছে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলকে, যেখানে তারা নাটকসহ অন্যান্য টিভি অনুষ্ঠান নিয়মিত ধারণ করছে। সিনেমা শুটিং করার লক্ষ্যে নির্মিত স্টুডিওগুলো চিত্র পরিচালকরা বরাদ্দ চেয়ে পাচ্ছেন না। একজন পরিচালক সমিতির প্রধান এবং খ্যাতিমান চিত্র পরিচালক জানিয়েছেন, তিনি নাকি এমডি সাহেবকে এফডিসির নাম পরিবর্তন করে এমডিসি রাখার প্রস্তাব দিয়েছেন। এমডিসির পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা হলো মিডিয়া ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন।
৯০ দশক এবং তার পরবর্তী দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত চলচ্চিত্রের ব্যবসা ছিল রমরমা। তার পরেই সেই ব্যবসায় নামে অকস্মাত্ ধস। চলচ্চিত্র ব্যবসা যখন মন্দা, দর্শকরা যখন সিনেমা হল থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে এবং অধিক মুনাফা নিশ্চিত লাভের আশায় রাজধানী এবং রাজধানীর বাইরে সিনেমা হলগুলো ভেঙে মার্কেট শপিংমল করা হচ্ছে, তখন চলচ্চিত্র মহলের দুর্বলতার সুযোগে অবতীর্ণ হলেন ত্রাণকারী হয়ে একটি টিভি চ্যানেলের প্রধান। যে চ্যানেলের জন্ম প্রতিবেশী দেশের আশীর্বাদেপুষ্ট হয়ে এবং এর বেড়ে ওঠাতে বর্তমান সরকারের আনুকূল্য প্রেরণা যুগিয়েছে বহুদিন থেকে। আলোচিত চ্যানেলটি চলচ্চিত্রে প্রতিবেশী দেশের আগ্রাসনে কীভাবে সহযোগিতা করা যায় সেই পথ আবিষ্কার করেছে বহুবার। এদেশে সিনেমা হল সমিতির সঙ্গে সেই চ্যানেলটিও ভারতীয় বাংলা, হিন্দি ছবির উত্সব করেছে সব প্রতিবাদ উপেক্ষা করে। আমাদের দেশের অনেকটা বেকার পরিচালককে নিয়ে সংক্ষিপ্ত বাজেটে তৈরি করল একের পর এক ছবি। সেই ছবিগুলো বাংলাদেশের হলগুলোতে মুক্তি দিল না লাখ লাখ টাকা গচ্চা যাওয়ার ঝুঁকি হতে পারে বলে। তারা নিয়মিত প্রয়োজনীয় অ্যাড সংগ্রহের মাধ্যমে নিজস্ব টিভি চ্যানেলে ওই ছবিগুলো মুক্তি দিল। এতে তাদের ছবি নির্মাণ ব্যয় সংরক্ষিত হলো আবার মুনাফাও হলো। আমি আগেই বলেছি এ করে টিভি দর্শক বৃদ্ধি পাবে। সিনেমা হলে দর্শক বৃদ্ধি করতে হলে শিল্পসম্মত ছবি বা বাণিজ্যিক ছবি অধিকসংখ্যক সিনেমা হলে মুক্তি দিতে হবে। আমি আশা করব চলচ্চিত্র শিল্পকে বর্তমান সঙ্কট থেকে উঠে দাঁড়াতে সরকার ও চলচ্চিত্রপ্রিয় বিত্তবান মানুষেরা আরও এগিয়ে আসবেন, আরও সক্রিয় হবেন।
monirlyric@gmail.com
৯০ দশক এবং তার পরবর্তী দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত চলচ্চিত্রের ব্যবসা ছিল রমরমা। তার পরেই সেই ব্যবসায় নামে অকস্মাত্ ধস। চলচ্চিত্র ব্যবসা যখন মন্দা, দর্শকরা যখন সিনেমা হল থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে এবং অধিক মুনাফা নিশ্চিত লাভের আশায় রাজধানী এবং রাজধানীর বাইরে সিনেমা হলগুলো ভেঙে মার্কেট শপিংমল করা হচ্ছে, তখন চলচ্চিত্র মহলের দুর্বলতার সুযোগে অবতীর্ণ হলেন ত্রাণকারী হয়ে একটি টিভি চ্যানেলের প্রধান। যে চ্যানেলের জন্ম প্রতিবেশী দেশের আশীর্বাদেপুষ্ট হয়ে এবং এর বেড়ে ওঠাতে বর্তমান সরকারের আনুকূল্য প্রেরণা যুগিয়েছে বহুদিন থেকে। আলোচিত চ্যানেলটি চলচ্চিত্রে প্রতিবেশী দেশের আগ্রাসনে কীভাবে সহযোগিতা করা যায় সেই পথ আবিষ্কার করেছে বহুবার। এদেশে সিনেমা হল সমিতির সঙ্গে সেই চ্যানেলটিও ভারতীয় বাংলা, হিন্দি ছবির উত্সব করেছে সব প্রতিবাদ উপেক্ষা করে। আমাদের দেশের অনেকটা বেকার পরিচালককে নিয়ে সংক্ষিপ্ত বাজেটে তৈরি করল একের পর এক ছবি। সেই ছবিগুলো বাংলাদেশের হলগুলোতে মুক্তি দিল না লাখ লাখ টাকা গচ্চা যাওয়ার ঝুঁকি হতে পারে বলে। তারা নিয়মিত প্রয়োজনীয় অ্যাড সংগ্রহের মাধ্যমে নিজস্ব টিভি চ্যানেলে ওই ছবিগুলো মুক্তি দিল। এতে তাদের ছবি নির্মাণ ব্যয় সংরক্ষিত হলো আবার মুনাফাও হলো। আমি আগেই বলেছি এ করে টিভি দর্শক বৃদ্ধি পাবে। সিনেমা হলে দর্শক বৃদ্ধি করতে হলে শিল্পসম্মত ছবি বা বাণিজ্যিক ছবি অধিকসংখ্যক সিনেমা হলে মুক্তি দিতে হবে। আমি আশা করব চলচ্চিত্র শিল্পকে বর্তমান সঙ্কট থেকে উঠে দাঁড়াতে সরকার ও চলচ্চিত্রপ্রিয় বিত্তবান মানুষেরা আরও এগিয়ে আসবেন, আরও সক্রিয় হবেন।
monirlyric@gmail.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন