শনিবার, ৯ জুন, ২০১২

সোনালি অতীতে ফিরছে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়


  • আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ভবন।
    আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ভবন।
    ছবি: ওয়েবসাইট
  • বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিক্টোরিয়া গেট।
    বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিক্টোরিয়া গেট।
    ছবি: ওয়েবসাইট
  • আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদ।
    আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদ।
    ছবি: ওয়েবসাইট
  • মাওলানা আজাদ লাইব্রেরি।
    মাওলানা আজাদ লাইব্রেরি।
    ছবি: ওয়েবসাইট
  • রেজিস্ট্রার আব্দুল জলিলের সঙ্গে শিক্ষার্থীরা।
    রেজিস্ট্রার আব্দুল জলিলের সঙ্গে শিক্ষার্থীরা।
    ছবি: ইন্ডিয়া টুডে

রুবাইয়া জান্নাত

ব্রিটিশদের কাছে সাম্রাজ্য, সম্মান, শৌর্য-বীর্য, ভাষা, শিক্ষা, অর্থ-সম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি—সব কিছু হারিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের যখন ত্রাহি অবস্থা, তখনই যেন ত্রাতা হয়ে এলেন স্যার সৈয়দ আহমদ খান। ঘৃণা, ক্ষোভ আর ভয় নিয়ে মুসলমানরা যখন ইংরেজদের কাছ থেকে যোজন যোজন দূরে অবস্থান করছে, তখন সৈয়দ আহমদ বুঝতে পারলেন ইংরেজদের এড়িয়ে চললে সর্বনাশ আরও বাড়বে। বরং ইংরেজি শিখেই ইংরেজদের ঘায়েল করতে হবে। যে চিন্তা সেই কাজ। তাই দেরি না করে ১৮৭৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন আলীগড় অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ। যার পরিণত রূপ আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়।
আলীগড় কেবল একটি বিশ্ববিদ্যালয়ই নয়। অর্থনীতি, সমাজ, রাজনীতি—সব দিক থেকে পিছিয়ে পড়া মুসলমানদের একটি আন্দোলনও ছিল বটে। যে আন্দোলন ব্রিটিশ-ভারতে মুসলমানদের রাজনীতিতে ভবিষ্যতের পাথেয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যে আন্দোলন দুই হাত ভরে ব্রিটিশ-ভারতকে দিয়ে গেছে জাঁদরেল রাজনীতিবিদ, পণ্ডিত, সমাজ সংস্কারকসহ অসংখ্য গুণীজন। দেশ ভাগের পর ভারত, পাকিস্তান এমনকি বাংলাদেশের শীর্ষ রাজনীতিবিদের অনেকেই ছিলেন আলীগড়ের ছাত্র। ভারতের প্রথম মুসলমান রাষ্ট্রপতি জাকির হোসেন (১৯৬৭-১৯৬৯), বর্তমান উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারি, দেশ ভাগের পর পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নওয়াবজাদা লিয়াকত আলী খান (১৯৪৭-১৯৫১), পাকিস্তানের সাবেক গভর্নর জেনারেল ও পরে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন, স্বৈরশাসক জেনারেল আইয়ুব খান (যদিও ডিগ্রি সমাপ্ত করেননি), বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মনসুর আলীসহ (জানুয়ারি ১৯৭৫ থকে আগস্ট ১৯৭৫) উপমহাদেশের বহু বরেণ্য ও বিখ্যাত ব্যক্তি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন।
কিন্তু, কালের বিবর্তনে আলীগড়ের সেই ঐতিহ্যে ধুলো জমতে থাকে। কেন যেন খেই হারিয়ে ফেলতে শুরু করে। পড়াশোনা বাদ দিয়ে হানাহানি ও সংঘর্ষে লিপ্ত থেকেই দিনের বেশির ভাগ সময় ব্যয় করত শিক্ষার্থীরা। ফলে একটা সময় পড়ালেখার তুলনায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহিংসতাই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয় হয়ে ওঠে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই কিসত রূপ। বহু বছর পর আবারও ঘুরে দাঁড়িয়েছে আলীগড়।
চলতি বছর ভারতের জনপ্রিয় ইংরেজি সাময়িকী ইন্ডিয়া টুডে আর জরিপকারী প্রতিষ্ঠান নেইলসনের যৌথ জরিপে দেশের প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে পঞ্চম স্থান দখল করে ভালোই চমক দেখিয়েছে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়। গত বছরের তুলনায় ছয় ধাপ এগিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টি।
আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের আলীগড় শহরে অবস্থিত। ১৮৭৫ সালে গুটিকয়েক শিক্ষার্থী নিয়ে যে প্রতিষ্ঠানের যাত্রা, আজ সেখানে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ২৭ হাজার। শিক্ষক রয়েছেন এক হাজার ৩০০ জন। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অনুপাত ১:১৯। পাঁচটি অনুষদের আওতায় এর বিভাগ আছে ৯৫টি। ছাত্রছাত্রীদের আবাসনের জন্যও আছে প্রায় ৮০টি ছাত্রাবাস। এর মধ্যে ছাত্রীদের জন্য ১৫টি।
আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবছর বাড়ছে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা। যে কারণে নতুন নতুন ক্যাম্পাস খোলার চিন্তা করতে হচ্ছে কর্তৃপক্ষকে। ২০১১ সালে কেরালার মালাপ্পুরামে খোলা হয় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস। বিহারের কিষানগড় ও মহারাষ্ট্রের আওরঙ্গাবাদে এর আরও দুটি শাখা ক্যাম্পাস রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে চালু হয়েছে আরেকটি ক্যাম্পাস। এ ছাড়া, একটি ইউনানি মেডিকেল কলেজ, জওহরলাল নেহরু মেডিকেল কলেজ, একটি প্রকৌশল কলেজ, দুটি পলিটেকনিক ও ১২টি অনুষদ এর অধিভুক্ত।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়ন আর শিক্ষাগত মানোন্নয়নের কারণে খুব দ্রুতই বিস্তৃত হচ্ছে আলীগড়ের পরিসর। জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও লিঙ্গ নির্বিশেষে সবার জন্য উন্মুক্ত এ বিশ্ববিদ্যালয়। নামে মুসলিম শব্দটি থাকলেও হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান—সব সম্প্রদায় থেকে আগত ছেলেমেয়েরা একসঙ্গেই পাঠ নিচ্ছে এখানে। নেই কোনো জাতিগত বা ধর্মীয় বৈষম্য। ভারতের সাম্প্রদায়িক চিন্তাধারাকে অতিক্রম করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদী মনোভাব গড়ে তোলাই এখন বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সাধারণ বিষয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন আধুনিক বিষয়ে পড়াশোনার সুযোগ রয়েছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে। সব মিলিয়ে প্রায় আড়াই শ বিষয়ে পড়ার সুযোগ রয়েছে শিক্ষার্থীদের সামনে। এর মধ্যে আছে—এমটেক ন্যানো টেকনোলজি, জীববৈচিত্র্য ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণের ওপর স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা, বন্য জীবন বাস্তু সংস্থান ও ব্যবস্থাপনা, সার্জিক্যাল এন্ডোস্কোপ কৌশলের মতো উদ্ভাবনী ও উন্নত বিষয়ের ওপর সার্টিফিকেট কোর্স। রয়েছে ডেন্টাল সার্জারি, পরিবেশগত রসায়ন, খাদ্য বিশ্লেষণ ও জৈব পরীক্ষাগার কলাকৌশল বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা কোর্স। এই কোর্সগুলো চালু করার জন্য গড়ে তোলা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর প্রোফেশনাল কোর্সেস।
দেশ-বিদেশের অনেক শিক্ষার্থীই পড়তে আসেন আলীগড়ে। পৃথিবীর ২৪ দেশের প্রায় ৩০০ জন শিক্ষার্থী বিভিন্ন বিষয়ে এখানে লেখাপড়া করছেন। এঁদের মধ্যে আফ্রিকা, পশ্চিম এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় এশিয়ার শিক্ষার্থীরাই বেশি। কোনো কোনো বিভাগে সার্ক ও কমনওয়েলথের সদস্যভুক্ত দেশগুলোর শিক্ষার্থীদের জন্য কিছু আসন বরাদ্দ থাকে।
অসাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত এই বিশ্ববিদ্যালয়টি পড়াশোনার পাশাপাশি আরও নানা বিষয়ে শিক্ষার্থীদের আধুনিক করে তুলতে চেয়েছে। তাই পড়াশোনার প্রধান মাধ্যম ইংরেজি হলেও এর পাশাপাশি হিন্দি, উর্দু, ফার্সি, আরবি, সংস্কৃত, তেলেগু, তামিল, বাংলা, মালায়লাম, মারাঠি, পাঞ্জাবি, কাশ্মীরি, ফরাসি, তুর্কি, জার্মান ও রুশ ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। প্রযুক্তির দিক থেকেও বেশ এগিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। সম্প্রতি প্রকৌশল প্রযুক্তি বিভাগে নতুন একটি উন্নয়ন ও গবেষণা বিভাগ চালু করা হয়। এর ই-রিসোর্স সিস্টেমের মধ্য দিয়ে ৩০ হাজারেরও অধিক শিক্ষার্থী ও ৩০০ কর্মী গবেষণা অনুদান কিংবা যে কোনো ধরনের তথ্য সহায়তার বিশেষ সুবিধা পাচ্ছেন।
সুনির্দিষ্টভাবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আর গবেষণার ওপর বিশেষ নজর দেওয়ার কারণেই এমন অভাবনীয় সাফল্যের মুখ দেখতে পায় আলীগড়। ২০০৮ থেকে ২০০৯—মাত্র এক বছরের মাথায় এ বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রিধারীদের সংখ্যা ২২০ জন থেকে এক লাফে ৫০০-তে গিয়ে দাঁড়ায়। যেটা আগের বছরের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি আলীগড়ের এখন শিক্ষকেরাও প্রচণ্ড উদ্যমী। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক শিক্ষক প্রতিবছর অন্তত একটি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাময়িকীতে নিজের গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন।
আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলাতে আর শিক্ষার্থীদের উন্নত শিক্ষা নিশ্চিত করতে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করেছে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়। এর মধ্যে আছে উইসকন্সিন, ক্লিভল্যান্ড, আটলান্টা, জন হপকিন্স ও নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়।
শুধু শিক্ষার্থীদের উন্নত শিক্ষা আর আধুনিক সুযোগ সুবিধা দিয়েই ক্ষান্ত নয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণের বিভিন্ন ঐতিহাসিক ভবনগুলো রক্ষণাবেক্ষণেও বিশেষ মনোযোগী তারা। ১৯২০ সালে প্রতিষ্ঠিত আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবন ও স্থাপনাগুলো তত্কালীন বিভিন্ন ইতিহাসের সাক্ষী। আর এসব ভবন সংরক্ষণে ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে একটি কমিটি গঠন করে কর্তৃপক্ষ। ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থার দিল্লি সার্কেলের প্রেসিডেন্ট কে কে মোহাম্মদের নেতৃত্বে এই কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির পরামর্শ অনুযায়ী ক্যাম্পাসে গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল মসজিদটি পুনঃস্থাপনের কাজ শুরু হয়। এ কাজে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বরাদ্দ রয়েছে প্রায় আড়াই শ কোটি রুপি।
আলীগড়ে রয়েছে ভারতের প্রথম ও এশিয়া মহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার। গ্রন্থাগারটির নাম মওলানা আজাদ গ্রন্থাগার। শিক্ষার্থীদের উন্নত সুযোগ-সুবিধা এনে দিতে এই গ্রন্থাগারের পেছনে প্রায় চার কোটি রুপি খরচ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ১৯৬০ সালে ভারতের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু এই গ্রন্থাগারটির উদ্বোধন করেন। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও স্বাধীন ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী মওলানা আবুল কালাম আজাদের নাম অনুসারে তিনি এ গ্রন্থাগারের নামকরণ করেন। এ গ্রন্থাগারটিতে সাড়ে ১১ লাখের বেশি বই, তথ্য-উপাত্ত, দলিল সংরক্ষিত রয়েছে। পাশাপাশি দুর্লভ কিছু সংগ্রহে ভরপুর এ গ্রন্থাগার। মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল-কোরআনের পাণ্ডুলিপি আছে এখানে। এটি চতুর্থ খলিফা হজরত আলীর সময়কার। এ গ্রন্থাগারের আরেকটি দুর্লভ সংগ্রহ বায়েজিদ আনসারির একটি হলনামা। মোগল আমলের নামকরা অনেক শিল্পীর আঁকা চিত্রকর্ম আছে এখানে। এঁদের মধ্যে সম্রাট জাহাঙ্গীর আমলের প্রসিদ্ধ একজন চিত্রকর মানসুর নাকাশের আঁকা ‘লাল ফুল’ নামের চিত্রকর্মটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আছে সম্রাট বাবর, আকবর ও শাহজাহানের আমলের রাজকীয় আইন-কানুন আর রায়ের কপি।
আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় শুধু মুসলিম কবি, লেখক, চিন্তাবিদ বা রাজনীতিবিদের জন্ম দেয়নি, নাসিরউদ্দিন শাহের মতো অভিনেতাকেও তৈরি করেছে। শতাব্দী প্রাচীন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের হূত গৌরব ফিরিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর কর্তৃপক্ষ। এবং তাঁরা সে কাজে অনেকটাই সফল। —ইন্ডিয়া টুডে ও উইকিপিডিয়া অবলম্বনে

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন