জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান। এখানে প্রায় সময়ই আসি। কিছু মনোরম ছবি চোখ আর ক্যামেরায় বন্দী করে বাড়ি ফিরি। এখানকার গোলাপ বাগান দুটি অসাধারণ। সবুজ গোলাপ এখানেই প্রথম দেখেছি। এখানে আছে চমৎকার একটি পদ্মপুকুর, আছে শাপলাপুকুর আর উদ্যান আলো করা গাছগাছালি। এখানকার বাঁশবাগানটি অনন্য বৈশিষ্ট্য নিয়ে দাঁড়িয়ে। তা ছাড়া এই গ্রীষ্মে আগুনলাল কৃষ্ণচূড়া আর পেল্টোফোরাম কী অসাধারণ করে তুলেছে উদ্যানটিকে, দেখে চোখ ধাঁ ধাঁ খাওয়ার জোগাড়। এখানে অনেক দর্শনার্থী আসে প্রতিদিন, ছুটির দিনে যেখানেই তাকান শুধু মানুষ আর মানুষ। তবে এখানকার গাছপালা নষ্ট করা বা ফুল ছেঁড়ায় তাদের কোনো আগ্রহ নেই। এটা যেকোনো উদ্যানের জন্য খুব সুখকর একটা দিক। উদ্যানের কর্মীরাও বেশ তৎপর। তবে ইজারাদারদের তৎপরতা খুব কম, তাঁরা উদ্যোগী হলে উদ্যানের পরিবেশটা ভালো করা যেত। শুধু পরিবেশগত কারণেই জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের অনেক বদনাম। তবু দর্শনার্থীর কমতি নেই। বিনোদনের খুব অভাব এ দেশে, সে জন্য দেশের অধিকাংশ শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষার যেকোনো দিন, বিশেষত ছুটির দিনে এখানে ছুটে আসে।
উদ্যানের ভেতরে হকারদের ঢোকা নিষেধ। তার পরও একধরনের কর্মজীবী মানুষের একটা বলয় গড়ে উঠেছে এখানে, যারা দর্শনার্থীদের ফুট-ফরমায়েশ শোনে। কেউ বা আবার চা-সিগারেট-চিপস-চানাচুর ইত্যাদি বিক্রি করে থাকে।
এবার বসন্তে মাধবীলতার ছবি তুলতে গিয়েছিলাম। খুব যত্ন করে ছবি তুললাম মাধবীলতার, পাশের গ্লিরিসিডিয়া আর টেবেবুইয়াও বাদ গেল না। এরপর ছবি তুলি ক্যাকটাস ছায়াতরুর ভেতরে। আচ্ছামতো ছবি তোলা শেষে বের হয়ে বাইরের উদালের ছবি ক্লিক করতে গিয়ে ভিউ ফাইন্ডারে ১০-১২ বছরের একটি ছেলে ধরা পড়ে। ছেলেটি তখন টাকা গুনতে গুনতে সামনে এগিয়ে চলেছে। ক্যামেরা ছেলেটির ওপর স্থির হয়ে বেশ কবার ক্লিক করে ওঠে। ছেলেটা দৌড়ের ওপর ছিল, তবু আমার ডাক শুনে কাছে আসে। নাম জানতে চাইলে বলে; আল-আমীন। আমি ব্যাগ থেকে কাগজ-কলম বের করে লিখলাম আলামিন। সে আমার লেখা উঁকি মেরে দেখে সংশোধন করার কথা বলে, ‘ভাইজান, বানান ঠিক করেন। আমার নাম আল-আমীন, আলামিন না।’ আমি বিস্ময় নিয়ে তাকাই। এর মধ্যে সে গড়গড় করে বলে চলেছে, ‘আমি নাম লিখতে পারি, কল্পনা বানান করতে পারি। নার্সারিতে পড়ি, আমার স্কুলের নাম সোহাগ, স্বপ্নধারা পাঠশালা।’ তারপর সে নিজেই বলে তার বাসা মিরপুরের ১০ নম্বরের কাছের দুয়ারীপাড়ায়। রাস্তায় চলতে প্রায় সময়ই আপনারা সদরঘাট টু দুয়ারীপাড়া নামের বাস দেখে থাকবেন। সেই দুয়ারীপাড়ায় কখনো যাওয়া হয়নি। আমি দুয়ারীপাড়া নিয়ে ভাবতে ভাবতে শুনতে পাই, ছেলেটি তখনো বলে চলেছে, ‘বাবা অসুস্থ, কাম করতে পারে না। মা বাসাবাড়িতে কাম করে। আমরা এক ভাই এক বইন। বইনের নাম কুলসুম। আর কিছু ভাইজান?’
এবার ছেলেটির দিকে তাকাই, উচ্ছল প্রাণবন্ত একজন। দেখে মনে হলো অফুরান প্রাণশক্তি তার ভেতর। হুম, কী করিস এখানে? ‘স্যার, মাইনসের কাছে ট্যাকা চাই। ট্যাকা চাইলে মাইনসে না করে না। আমি ছোট তো, আদর করে। মাঝে মাঝে ট্যাকার লগে খাইতে দেয়। খাবার না দিলে ট্যাকা দিয়া কিনা খাই। এই ধরেন শিঙারা, চা, বিস্কুট। প্রতিদিন আমি স্কুল ছুটির পর এই হানে আহি। বিকালবেলা যাইগা।’ টাকা চাইতে লজ্জা করে না? ‘লজ্জা কিসের, ট্যাকা তো আর খালি খালি দেয় না, আমি হেগোর অনেক কাম কইরা দেই!’
আজ কত টাকা পেলি?
‘আজ একটু বেশি পাইছি—১২০ ট্যাকা, আরও পামু। তয় পইত্যেক দিন এমুন পাই না। কোনো দিন এক শ ট্যাকা, আবার কোনো দিন নব্বই ট্যাকার মতন হয়।’
টাকা দিয়ে কী করবি?
‘নানির পান শেষ, নানির লাইগা ১০ ট্যাকার পান কিনুম। আমি একটা আইসক্রিম খামু, কুলসুমের শরীরডা ভালা না। আল্লাহ যেন তার শরীর ভালা কইরা দেয়, হের লাইগা ফকিররে পাঁচ ট্যাকা দিমু, বাকি ট্যাকা মায়রে দিমু।’
তুই কি এমন চেয়ে চেয়ে খাবি সব সময়?
‘না, ভাইজান। কইছি না আমার বাপ অসুস্থ। সংসার চলে না, তাই তো পার্কে আহি। আমি তো ছোট, কাজ করতে পারি না। যহন কাজ করতে পারুম করুম। তা ছাড়া আপনেরে তো কইলাম না, মাইনসে আমারে এমনি এমনি ট্যাকা দেয় না, কত কী কাম যে কইরা লয় আপনে বুজবেন না। শোনেন, ভাইজান, এই যে আপনে খারাইতে কইলেন খারাইলাম, এইটাও একটা কাম! পড়তে আমার খুব ভালা লাগে। স্কুলে আমার রোল নম্বর ৮। আমি পড়ালেখা কইরা অনেক বড় হমু। আমি বড় হয়া পুলিশ হমু।’
পুলিশ হবি কেন?
‘হেগো সক্কলে ডরায়।’
এই জন্য তোর পুলিশ হওয়া লাগব?
‘লাগব, ভাইজান। যে বাড়ি মারে, প্রাণডা বাইর অইয়া যায়।’
আল-আমীনের কথা শুনে আমার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার কথা মনে পড়ে। একদিন তাঁর স্কুলের শিক্ষিকা ডারমাওয়ান তাঁর কাছে জানতে চাইলেন, ‘তুমি বড় হয়ে কী হবে।’ ছেলেটির জবাব ছিল, ‘আমি বড় হয়ে প্রেসিডেন্ট হব।’ শেষ পর্যন্ত ওবামা প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। আল-আমীন কী হতে পারবে শেষ পর্যন্ত!
ফারুখ আহমেদ
উদ্যানের ভেতরে হকারদের ঢোকা নিষেধ। তার পরও একধরনের কর্মজীবী মানুষের একটা বলয় গড়ে উঠেছে এখানে, যারা দর্শনার্থীদের ফুট-ফরমায়েশ শোনে। কেউ বা আবার চা-সিগারেট-চিপস-চানাচুর ইত্যাদি বিক্রি করে থাকে।
এবার বসন্তে মাধবীলতার ছবি তুলতে গিয়েছিলাম। খুব যত্ন করে ছবি তুললাম মাধবীলতার, পাশের গ্লিরিসিডিয়া আর টেবেবুইয়াও বাদ গেল না। এরপর ছবি তুলি ক্যাকটাস ছায়াতরুর ভেতরে। আচ্ছামতো ছবি তোলা শেষে বের হয়ে বাইরের উদালের ছবি ক্লিক করতে গিয়ে ভিউ ফাইন্ডারে ১০-১২ বছরের একটি ছেলে ধরা পড়ে। ছেলেটি তখন টাকা গুনতে গুনতে সামনে এগিয়ে চলেছে। ক্যামেরা ছেলেটির ওপর স্থির হয়ে বেশ কবার ক্লিক করে ওঠে। ছেলেটা দৌড়ের ওপর ছিল, তবু আমার ডাক শুনে কাছে আসে। নাম জানতে চাইলে বলে; আল-আমীন। আমি ব্যাগ থেকে কাগজ-কলম বের করে লিখলাম আলামিন। সে আমার লেখা উঁকি মেরে দেখে সংশোধন করার কথা বলে, ‘ভাইজান, বানান ঠিক করেন। আমার নাম আল-আমীন, আলামিন না।’ আমি বিস্ময় নিয়ে তাকাই। এর মধ্যে সে গড়গড় করে বলে চলেছে, ‘আমি নাম লিখতে পারি, কল্পনা বানান করতে পারি। নার্সারিতে পড়ি, আমার স্কুলের নাম সোহাগ, স্বপ্নধারা পাঠশালা।’ তারপর সে নিজেই বলে তার বাসা মিরপুরের ১০ নম্বরের কাছের দুয়ারীপাড়ায়। রাস্তায় চলতে প্রায় সময়ই আপনারা সদরঘাট টু দুয়ারীপাড়া নামের বাস দেখে থাকবেন। সেই দুয়ারীপাড়ায় কখনো যাওয়া হয়নি। আমি দুয়ারীপাড়া নিয়ে ভাবতে ভাবতে শুনতে পাই, ছেলেটি তখনো বলে চলেছে, ‘বাবা অসুস্থ, কাম করতে পারে না। মা বাসাবাড়িতে কাম করে। আমরা এক ভাই এক বইন। বইনের নাম কুলসুম। আর কিছু ভাইজান?’
এবার ছেলেটির দিকে তাকাই, উচ্ছল প্রাণবন্ত একজন। দেখে মনে হলো অফুরান প্রাণশক্তি তার ভেতর। হুম, কী করিস এখানে? ‘স্যার, মাইনসের কাছে ট্যাকা চাই। ট্যাকা চাইলে মাইনসে না করে না। আমি ছোট তো, আদর করে। মাঝে মাঝে ট্যাকার লগে খাইতে দেয়। খাবার না দিলে ট্যাকা দিয়া কিনা খাই। এই ধরেন শিঙারা, চা, বিস্কুট। প্রতিদিন আমি স্কুল ছুটির পর এই হানে আহি। বিকালবেলা যাইগা।’ টাকা চাইতে লজ্জা করে না? ‘লজ্জা কিসের, ট্যাকা তো আর খালি খালি দেয় না, আমি হেগোর অনেক কাম কইরা দেই!’
আজ কত টাকা পেলি?
‘আজ একটু বেশি পাইছি—১২০ ট্যাকা, আরও পামু। তয় পইত্যেক দিন এমুন পাই না। কোনো দিন এক শ ট্যাকা, আবার কোনো দিন নব্বই ট্যাকার মতন হয়।’
টাকা দিয়ে কী করবি?
‘নানির পান শেষ, নানির লাইগা ১০ ট্যাকার পান কিনুম। আমি একটা আইসক্রিম খামু, কুলসুমের শরীরডা ভালা না। আল্লাহ যেন তার শরীর ভালা কইরা দেয়, হের লাইগা ফকিররে পাঁচ ট্যাকা দিমু, বাকি ট্যাকা মায়রে দিমু।’
তুই কি এমন চেয়ে চেয়ে খাবি সব সময়?
‘না, ভাইজান। কইছি না আমার বাপ অসুস্থ। সংসার চলে না, তাই তো পার্কে আহি। আমি তো ছোট, কাজ করতে পারি না। যহন কাজ করতে পারুম করুম। তা ছাড়া আপনেরে তো কইলাম না, মাইনসে আমারে এমনি এমনি ট্যাকা দেয় না, কত কী কাম যে কইরা লয় আপনে বুজবেন না। শোনেন, ভাইজান, এই যে আপনে খারাইতে কইলেন খারাইলাম, এইটাও একটা কাম! পড়তে আমার খুব ভালা লাগে। স্কুলে আমার রোল নম্বর ৮। আমি পড়ালেখা কইরা অনেক বড় হমু। আমি বড় হয়া পুলিশ হমু।’
পুলিশ হবি কেন?
‘হেগো সক্কলে ডরায়।’
এই জন্য তোর পুলিশ হওয়া লাগব?
‘লাগব, ভাইজান। যে বাড়ি মারে, প্রাণডা বাইর অইয়া যায়।’
আল-আমীনের কথা শুনে আমার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার কথা মনে পড়ে। একদিন তাঁর স্কুলের শিক্ষিকা ডারমাওয়ান তাঁর কাছে জানতে চাইলেন, ‘তুমি বড় হয়ে কী হবে।’ ছেলেটির জবাব ছিল, ‘আমি বড় হয়ে প্রেসিডেন্ট হব।’ শেষ পর্যন্ত ওবামা প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। আল-আমীন কী হতে পারবে শেষ পর্যন্ত!
ফারুখ আহমেদ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন