শুক্রবার, ৮ জুন, ২০১২

ছিন্নপত্র

মাহমুদুজ্জামান বাবু


পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর আগের কথা। সামরিক আদালতের কারাদণ্ড মাথায় নিয়ে ঢাকায় এসেছি কেবল। সক্রিয় রাজনীতি করি। সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। এরশাদ সরকারের দমন-পীড়ন চলছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস সকাল-বিকাল গর্জে ওঠে প্রতিদিন। এমন কোনো সকাল ছিল না তখন, যেদিন মিছিলের বিরতি পড়ত। বিরতিহীন সেই প্রতিবাদ প্রতিরোধের সময়ে এক বিকেলে, চলে গিয়েছিলাম বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে। উদ্দেশ্য ছিল অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে দেখা। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের গ্রন্থাগারের সুন্দরতম বর্ণনা পেয়েছিলাম অগ্রজ প্রতীমদের কাছে আরও আগে। কীভাবে সদস্যপদ পাওয়া যাবে সে কৌতূহলও ছিল। সেদিন অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সঙ্গে দেখা হয়নি। মফস্বলী কুণ্ঠা কাউকে জিজ্ঞাসাও করতে সায় দেয়নি। কিন্তু গ্রন্থাগারটি দেখা হয়েছিল। প্রথম প্রেমে পড়ার মতো শিহরণ ছড়িয়ে পড়েছিল মস্তিষ্কে! এত বিচিত্র বই? ছোট্ট পরিসর কিন্তু গোটা বিশ্ব যেন মমতার হাত বাড়িয়ে রেখেছিল সেখানে। ‘বইপড়া’ যে একটি প্র্যতাহিক কাজ হতে পারে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র বাংলাদেশ-জুড়ে সেই আবেগ কতটা ছড়াতে পেরেছে, সেটা গবেষকেরা বলবেন, কিন্তু আমার ব্যক্তিগত কৃতজ্ঞতা এ ক্ষেত্রে অসীম। সেই কেন্দ্রের যিনি নেতা, সেই অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ আসলে যা বলেননি, সেই জন্য তাঁকে সংসদে এসে ক্ষমা চাইতে হবে—এমন কথা বলার আগে সংশ্লিষ্ট সংসদ সদস্যদের কয়েকবার ভাবা উচিত ছিল, এটা ধৃষ্টতা কি না।
এ এক অদ্ভুত সমাজ। রাষ্ট্র। দেশ। জনপ্রতিনিধি হিসেবে যাঁরা জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন, নির্বাচিত হওয়ার পরমুহূর্তেই তাঁরা ভুলে যান যে, প্রতিটা কাজের জন্য তাঁদের জনগণের কাছে জবাবদিহি করার একটা নৈতিক দায় আছে। নানা রকমের প্রতিশ্রুতি, নিজের নির্বাচনী এলাকার যাবতীয় উন্নয়ন, মানুষের কল্যাণ—সব তখন হয়ে পড়ে কেবল কথার কথা। তাঁরা প্রত্যেকেই তখন গোছাতে থাকেন নিজেদের আখের। জনপ্রতিনিধি হওয়ার আগে যিনি ছিলেন হাজারপতি, কিছুদিনের মধ্যেই তিনি কোটিপতির তালিকায় নাম লেখান। টাকা বাড়ে কীভাবে? টাকা কি ডিম পাড়ে হাঁস-মুরগির মতো? ডিম ফুটে বাচ্চা হয় টাকার? এই যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে জনগণের রায় নিয়ে নির্বাচিত হওয়ার পর জনস্বার্থে কাজ না করা—এই প্রবণতাকে আমরা কী বলব?
রিকশাচালক সমসুদ্দিন এই বিষয়ে একেবারেই ঠোঁটকাটা; মধ্যবয়সী সমসুদ্দিনের বাড়ি ময়মনসিংহের ত্রিশাল সদরে। খেত-খোলা নিঃশেষ হয়েছে, তাই এসেছেন ঢাকা শহরে। মাসান্তে বাড়ি যান। কিছু টাকা জমলে। দুই দিন আগে তাঁর রিকশা ভাড়া করেছিলাম কারওয়ান বাজারের পাতালপথের উল্টোমুখ থেকে পান্থপথের স্কয়ার হাসপাতাল পর্যন্ত যাব বলে। সমসুদ্দিনের গালে মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি-গোঁফ। জ্যৈষ্ঠের তাপে তাঁর চোখ লালচে ধূসর। একসময়ের সাদা শার্টটি তিলা পড়ে এখন কালো ছোপ ছোপ। প্যাডেলে পা রেখেই সমসুদ্দিন কী যেন বলেন বিড়বিড় করে। আমি উৎকর্ণ হয়েও শুনতে পাই না ভালো। একবার মনে হলো যেন ‘বেইমান’ শব্দটি শুনলাম। আঁতকে উঠি। কী সর্বনাশ! ভাড়া নিয়ে অবশ্য একটু দর-কষাকষি করেছি রিকশায় ওঠার আগে। সে জন্য আমি বেইমান? স্কয়ার হাসপাতালের উল্টো পাশে রিকশা থেকে নেমে নাম ধাম শুনি সমসুদ্দিনের। নরম গলায় ভয়ে ভয়ে জানতে চাই, ‘আপনার এলাকার এমপি কে?’ সমসুদ্দিন গামছা দিয়ে ঘাম মোছেন। উত্তর দেন ম্লানমুখে, ‘রেজা আলী। বাড়ি লাকসাম।’ আমি বলি, ‘লাকসাম তো কুমিল্লায়।’ সমসুদ্দিনের উত্তর, ‘ভোটের সুময় আওয়ামী লীগ তারে ত্রিশালে খাড়া করাইছে। আমরা হ্যারে ভোট দিছি। হ্যায় অহন সংসদে গিয়া লাকসামের কথা কয়। ত্রিশালের কথা কয় না। এইবার আর আওয়ামী লীগের একটা ভোটও দিতাম না, বুঝছুইন!’ আমার ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে যেন। যাক বাবা, আমি সেই বেইমান না।
ঢাকার চারুশিল্পী নাসির আহমদ কদিন আগে তাঁর গ্রামের বাড়ির এলাকার সাম্প্রতিক আতঙ্ক নিয়ে উদ্বেগ জানাচ্ছিলেন। নাসিরের বাড়ি কুমিল্লার উত্তর মুরাদনগর। সেখানে বাঙুরা, শ্রীকাইল, আকাপুর ইউনিয়নের জনপদজুড়ে ভয়াবহ ডাকাতি ও নারী অপহরণের আতঙ্ক বিরাজ করছে। এক বাড়িতে ডাকাতি শেষে ডাকাতের হাতে ধর্ষিতা ও ধর্ষণের পর একটি মেয়েকে হত্যার পর ঘরের মেয়ে-বউদের ঢাকা ও অন্যান্য শহরে নিকটাত্মীয়ের বাসায় পাঠানো শুরু করেছেন অভিভাবকেরা। রাত জেগে পাহারা দিচ্ছেন গ্রামের মানুষেরা তাঁদের ঘর-গেরস্থালি। গণমাধ্যমে সংবাদ নেই কেন...আমার প্রশ্নের জবাবে নাসির ইঙ্গিত করেছেন গণমাধ্যমকর্মীদের প্রভাবশালী নেতাদের তুষ্ট রাখার বিষয়ে। সত্য-মিথ্যা জানি না। কিন্তু বিষয়টি অনুসন্ধান প্রয়োজন।
নিরাপত্তাহীনতা সর্বব্যাপী এখন। আদালত চত্বরে নারীর শ্লীলতাহানি, সাংবাদিক প্রহার—সবই ঘটছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হাতে। নারীর প্রতি সহিংসতা, মানুষে-মানুষে সংঘাত, মনুষ্যত্বের পরিবর্তে পাশবিকতার হিংস্র উল্লাস আর রাজনীতির নামে-গণতন্ত্রের নামে পক্ষ-প্রতিপক্ষ নির্মূল-প্রক্রিয়ার অচলায়তনে তৃষা হত্যাকাণ্ডের আসামিরা আপিল বিভাগের রায়ে মৃত্যুদণ্ড পরিবর্তিত হয়ে সশ্রম কারাদণ্ড পেল। গাইবান্ধা সদর উপজেলার পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী তৃষা সাঁতার জানত না। বখাটেদের ধাওয়ায় সে পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ২০০২ সালের ১৭ জুলাই। বাঁচার শেষ চেষ্টা করে তৃষা নিহত হয়েছিল। দমবন্ধ হয়ে।
আজ আমার তৃষার মতো দমবন্ধ লাগছে।
 মাহমুদুজ্জামান বাবু: গায়ক ও সংস্কৃতিকর্মী।
che21c@yahoo.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন