রবিবার, ২৯ এপ্রিল, ২০১২

পুরনো বিবাদ মেটানো, বৈশাখের দাবি



যে যেভাবে দেখি

॥ মুস্তাফা জামান আব্বাসী ॥

পয়লা বৈশাখ শেষ। এবার বৈশাখী ভাবনাগুলোকে সংহত করি। বৈশাখী কি উড়ে যাওয়ার জন্য একটি দিনের মাতামাতি, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত উদ্দেশ্যহীন শহরের পথে হেঁটে চলা? তা কী করে হয়? এতগুলো লোক পথে বেরিয়েছে একেবারেই উদ্দেশ্যবিহীন, শুধু দিনটিকে উপভোগ করার জন্য। এর কোনো উদ্দেশ্য নেই, শুধু বেলুন নিয়ে হইচই? মেলা মানে মিলন, দু’টি প্রাণের, বহু প্রাণের। তা আর কে মনে রাখছে আজ।
জাপানিদের নববর্ষে গিয়েছি, ওরা বড় হিসাবি জাত, হিসাব ছাড়া নড়ে না। নববর্ষে আসল কাজটা করে বসে, তা হলো পুরনো বিবাদ মেটিয়ে ফেলা, বন্ধুত্বের নতুন খাতা খোলা। আমরা সেটি করি না। গলা ঝেড়ে পুরনো গান গাইতে বসি, ওই গানের মধ্যে প্রবেশ করি না, কোনো কিছুর মধ্যেই প্রবেশ করি না। যা কিছু সব গানে গানে, তাই গান শেষ হলে সব উড়ে যায়।

বলে চলেছি, বিরোধ মিটিয়ে ফেলুন। অন্তরের মালিন্য দূর করুন, দেশবাসীকে মুক্তি দিন। দেশবাসী বিরোধকে মোটেই ভালোবাসে না। তারা একে মনেপ্রাণে প্রত্যাখ্যান করেছে। দিন চলে গেলে ওই প্রত্যাখ্যান আপনাদের সাথে যাবে। আমাদের কথা শুনুন। দেশটাকে রক্ষা করেন। গ্রামে গ্রামে শহরে শহরে ঘৃণা যাদের মধ্যে বসতি স্থাপন করেছে তাদের ভেঙে টুকরো টুকরো করে দেন। সবার ভালোবাসা পাবেন, নইলে ঘৃণা সবাইকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে।
ঘুড়ি উড়ানো ভালো, মিছিলে মিছিলে কিছু মিলনের গান গাওয়া ভালো। থাইল্যান্ডে ইন্দোনেশিয়ায় মুখোশ সংস্কৃতির বিকাশ দেখে এসেছি। সেগুলোও ভালো। আর্ট কলেজের ছেলেমেয়েরা মুখোশ ভালোবাসে। বাঘ, ভালুক, সিংহ, প্যাঁচা, সাপ সবই আছে। এগুলো নিয়ে মিছিল বেরোলে বলার কিছু থাকে না। যারা পুরনো তারা বলেন, এগুলো আমাদের সংস্কৃতির অংশ নয়, মূর্তি বা মুখোশ আমাদের ছিল না, এগুলো আরোপিত। আরোপিত টিকবে না, মিডিয়ায় সারা দিন সারা রাত ধরে দেখানো হলেও সেগুলোর মূল্য হবে না। ঈমান-আকিদার সাথে ওগুলো যাবে না। সংস্কৃতি একটি নদীর মতো, তার প্রবাহকে নিজের ইচ্ছামতো চালানো যায় না। তাই ভালো হয় যদি আমাদের গ্রামের মানুষের সংস্কৃতিকেই প্রাধান্য দেয়া হয়।
এমন কোনো সভা খুঁজে পাই না যেখানে সভ্যজনদের গান ছাড়া অভাজনদের গান গাওয়া হচ্ছে। সেখানে নেই ভাটিয়ালি, বিচ্ছেদী, মারফতি, জারি গান। আরোপিত গান কয়েকজনের জন্য ভালো নিশ্চয়ই। মৃদুমন্দ দখিনা হাওয়ায় শহুরে গানের শহুরে চল। দিনকতক এটি চলবে বৈকি। বাংলার আপামর জনতার গান লোকসঙ্গীত। কোনো টেলিভিশনে সেই গান গাওয়া হয়নি। কেন? আরোপিত সঙ্গীতের প্রাধান্য সেখানে। তোমার গান কিছুই নয়, আমরা যা দেবো সেটিই তোমাদের গান, এ মনোভাব টিকবে না। এটি পরাজিত হবে, এই আমার বক্তব্য।

পুরনো বক্তব্যে আবার। বিভাজিত জাতি কোনো কিছু অর্জন করতে সমর্থ হবে না। বারবার একই কথা বলছি। বিভাজিত হবেন না, কেউই জয়ী হতে পারবেন না। জাতির সব সমস্যায় সবাই মিলে বিচার করুন। সবার কাছে গ্রহণযোগ্য যা, তাকেই গ্রহণ করুন। এটাই ফয়সালা। পশ্চিম বাংলায় সবচেয়ে বড় উৎসব কী? এক কথায় জবাব, দুর্গাপূজা। আমাদের এখানে বছরে দুটো ঈদ। কিছু বন্ধু চাইছেন ঈদের বদলে বৈশাখী উৎসব। ওদের ইচ্ছা বাংলাদেশে বৈশাখ হবে সবচেয়ে বড় উৎসব। মাল্টিন্যাশনালরা কোটি কোটি টাকা দিতে কার্পণ্য করেননি। এবার পশ্চিম বাংলার বন্ধুদের জিজ্ঞেস করুন, এটা ওরা চায় কি না, উত্তর : না। ওরা দুর্গাপূজাকেই চায়। আবার বৈশাখের আবাহনেও ভাসিয়ে দিতে চায় পুরনোর জঞ্জাল, সেটা অন্যায় নয়। বাংলাদেশে বাস করে উল্টো চিন্তার উদ্ভাবকদের সাবধানী হতে হবে। আমাদের সংস্কৃতি প্রয়াস যেন মধ্যপথে বাধা না পায়। আমরা একই সাথে আধুনিক আবার একই সাথে ধর্মের প্রতি অনুগত। ধর্মকে অস্বীকার করলে হবে সঙ্ঘাত, যার কোনো সুস্থির সমাধান আমার জানা নেই। এখানে ঈদ বড় উৎসব হবে। বৈশাখীতেও মাতব আমরা আনন্দে। কোনো বিরোধ নেই। যারা অন্যায় চিন্তা করে তাদের সাথেই বিরোধ।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনেক দিন ছিলাম, সেখানে উপভোগ করেছি ‘থ্যাংকস গিভিং’, যা সবাই পছন্দ করেন। এর সাথে নেই ক্রিসমাসের বিরোধ। আবার একটি গ্রুপ ক্রিসমাসের বিরুদ্ধে লেগেছে। তারা বলে, আমেরিকার আসল উৎসব হওয়া উচিত গ্রামীণ আবহাওয়া থেকে উদ্ভূত ‘থ্যাংকস গিভিং’। খ্রিষ্টানেরা বলছে তা হওয়ার নয়। ধর্মীয় অনুভূতিতে বাধা দিলে তা হবে এক ধরনের লড়াই। লড়াইয়ের দরকার কী, দু’টিই থাকুক। বাংলাদেশেও তাই বিরুদ্ধবাদীদের অন্যায় চিন্তার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে যখন বাড়াবাড়ি দেখি, তখন সহজেই বুঝি এরা কী চায়, এরা চায় আরেক আধিপত্য। এমনকি বৈশাখী ভাবনাতেও তারা উড়ে এসে জুড়ে বসতে চায়।

পয়লা বৈশাখের পরের দিন বৈশাখ উধাও। কোথায় পাঞ্জাবি, কোথায় বৈশাখী শাড়ি। আরেক বছরের জন্য তুলে রাখি। বৈশাখের চার-পাঁচ তারিখ চলে গেলে ওই মাসের আর হিসাব নেই। ধন্য বৈশাখপ্রীতি। নববৈশাখে ডাক্তারের আহ্বান, আব্বাসী সাহেব, আপনার হাই কোলেস্টেরলের জন্য ইলিশ অনুপযোগী, গরুর গোশতের মতোই ওটি পরিহার করুন। এ বছর আর পান্তা-ইলিশ খাওয়া হয়নি। আগামী বছরের কথা বলতে পারি না।
লেখক : সঙ্গীত-সংস্কৃতি ব্যক্তিত্ব
mabbasi@dhaka.net

বৃহস্পতিবার, ২৬ এপ্রিল, ২০১২

‘সত্যবাবু মারা গেছেন?’

ফারুক ওয়াসিফ | তারিখ: ২৭-০৪-২০১২


লিমনের কাটা পা মানবাধিকারের পঙ্গুত্বের প্রতীক হয়ে উঠেছিল। এখন নিখোঁজ ইলিয়াস আলী হয়ে উঠছেন সত্য ও ভরসার গুম হওয়ার প্রতীক। দেশটা হয়ে পড়ছে প্রবাদকথিত সেই অন্ধকার ঘর, যেখানে লুকিয়ে আছে হুলো বিড়ালেরা। তাদের আলোয় আনা যাচ্ছে না। কিন্তু তাদের কাজের কুফল দেশসুদ্ধ সবাই ভোগ করছে। কিংবা তারা বাইরেই বেরিয়ে পড়েছে, দিনদুপুরে নামাচ্ছে অন্ধকার। আমাদের সবাইকে ঢোকাচ্ছে সেই ঘরে, যেখানে মানুষ মরে যাচ্ছে, পুড়ে যাচ্ছে, গুম হয়ে যাচ্ছে। জানা যাচ্ছে না কিছুই।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র হিসাব দিয়েছে, গত ২৭ মাসে ১০০ ব্যক্তি ‘নিখোঁজ’ হয়েছেন। এঁদের জীবন সম্ভবত ইলিয়াস আলীর মতো দামি ছিল না, তাই তাঁদের জন্যকেউ দেশ উথাল-পাতাল করেনি। এঁদের অনেকের লাশ মিলেছে, অনেকের মেলেনি— বেওয়ারিশ হিসেবে কেউ সমাধিস্থ হয়েছেন, কেউ বা তাও হননি। এঁদের খুনিদের পরিচয় ‘অজ্ঞাত’ রেখে সরকারও এদের বেওয়ারিশনাগরিক করে দিয়েছে। ৫ এপ্রিল সাভারে আমিনুল ইসলাম নামের এক শ্রমিকনেতার ক্ষতবিক্ষত লাশ পাওয়া যায়। এখন পর্যন্ত তাঁর হত্যাকারী চিহ্নিত করা যায়নি বা করা হয়নি। সাগর-রুনি যুগলের ঘাতকেরাও আমাদের মধ্যে ঘুরে বেড়ালেও রেলের কালো বিড়ালের মতো অধরাই থেকে যাচ্ছে। এত এত মানুষের ‘ব্যাখ্যাতীত’ গায়েব হওয়ায় যে সরকার বিচলিত না, সেই সরকার নিজেই দায়িত্বহীনতার ‘অন্ধকারে’ নিমজ্জিত। 
এই অবস্থায় সরকারকে হয় সত্য জানাতে হবে, নতুবা ব্যর্থতা স্বীকার করতে হবে। তৃতীয় পথটা হলো, ঘোলা জলকে আরও ঘোলা করা। ঘটনার পরপরই স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলকেই তাদের নেতা নিখোঁজ হওয়ার জন্য দায়ী করে সেটাই করেছেন। তাঁর কথার কোনো বাস্তব ভিত্তি তিনি বা তাঁর সরকারের কেউ জানাতে পারেননি। বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া এবং ইলিয়াস আলীর স্ত্রীর অভিযোগ, সরকারি সংস্থার লোকেরাই ইলিয়াস আলীকে গুম করেছে। জাতীয় দুই নেত্রী তাই পরস্পরের দ্বারা অভিযুক্তই থাকছেন। এই দায় সাফ করার দায়িত্ব তাঁদেরই।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গণহত্যার পর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বৃত্তে একটা ধারণা শক্তিশালী হয় যে, বড় অপরাধের প্রতিকারের দায় প্রথমত রাষ্ট্রের, রাষ্ট্র ব্যর্থ হলে সেই দায় সবার। স্বাধীনতার ৪০ বছর ধরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দায় আমাদের সবার ঘাড়েই ছিল। সম্প্রতি রাষ্ট্র সেই দায় লাঘব করেছে। তেমনি শত শত মানুষের ক্রসফায়ার আর শত মানুষের ‘নিখোঁজ’ হওয়ার প্রতিকারের দায়ও এই রাষ্ট্রের সব নাগরিকের। 
সত্যহীনতায় মানুষ চলতে পারে না। সরকার সত্য জানাবে, এমন ভরসা লোপ পাওয়ায় সত্যের সম্পূর্ণ বেসরকারীকরণ ঘটে গেছে। ইলিয়াস আলীকে নিয়ে প্রচারিত অজস্র গুজবের ভেতর থেকে তাই মনমতো ‘সত্য’ বেছে নিচ্ছে মানুষ। সত্য জানার ও প্রতিষ্ঠা করার সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর হলো রাষ্ট্র। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এই আমলে জাতীয় গুরুত্ববহ কোনো ঘটনা সম্পর্কেই সরকার আমাদের ‘সত্য’ জানাতে পারেনি। তাহলে কি সত্যের ক্ষমতায় তারা ভীত। যে সরকার সত্যকে ভয় পায় বা গুম করে, মানুষ তাদের ভয় পাওয়া শুরু করে। পাশাপাশি, এ রকম সরকারের পরিণতি নিয়েও আমাদের ভীত হওয়ার কারণ থেকে যায়।
এ রকম সরকারকেই ‘অকার্যকর’ বলা হয়। মানুষের অধিকার রক্ষা এবং রাষ্ট্রের সুব্যবস্থাপনার দিক থেকে তাঁরা যতই অকার্যকর হোন, সমস্যা সৃষ্টির ব্যাপারে এই সরকার কিন্তু অতিকার্যকর। সেই অতিকার্যকারিতার ফলই আমরা এখন হাতেনাতে পাচ্ছি। দেশটাকে যেন ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে এক বিরাট কালো ঘরে। তার ভেতর ভীত মানুষেরা অপেক্ষা করছে, কখন কী ঘটে, কার ওপর ঘটে, কী আছে দেশের ভাগ্যে, এর পরে কী? এমন বাস্তবতা ডাচ পদার্থবিদ এরভিন শ্রয়েডিংগারের বদ্ধ ঘরে বন্দী বিড়াল পরীক্ষার কথা মনে করায়। অন্ধকার ঘরে স্টিলের খাঁচায় একটি বিড়াল আর একটি ফাঁদ রাখা হয়। বিড়ালটির দুটি সম্ভাবনা, ফাঁদে পড়ে সে মারাও যেতে পারে, আবার ফাঁদ থেকে দূরে থেকে বেঁচেও যেতে পারে। অঙ্কের হিসাবে একেই বলে ফিফটি-ফিফটি সম্ভাবনা। অর্থাৎ বিড়ালটা অর্ধেক জীবিত, অর্ধেক মৃত। গুম, রহস্যজনক মৃত্যু আর বেওয়ারিশ লাশ হওয়ার এই বাস্তবতায় এভাবে আমরাও শ্রয়েডিংগারের বিড়ালের মতোই অর্ধেক জীবিত অর্ধেক মৃত। 
২.
মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলা শুরু করেছে, ক্রসফায়ারের সঙ্গী হয়েছে গুম। বিশ্বের অভিজ্ঞতাও তা-ই বলে। মেক্সিকো, কলম্বিয়া, আর্জেন্টিনা, চিলি ও ফিলিপাইনে গুম-হত্যা ক্রসফায়ার পর্বের পর গুম-হত্যা পর্ব শুরু হতে দেখা গেছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এবং অধিকারকর্মীরাই এর শিকার। এসব ঘটনা তদন্তে জাতিসংঘ বিশেষ কর্মী দলও গঠন করে। সেখানে বাংলাদেশের বিষয়টাও আলোচিত হয়। বাংলাদেশ বাদে বাকি দেশগুলোয় গুম বা নিখোঁজ হওয়ার জন্য তারা ওই সব দেশের সরকারি নিরাপত্তা সংস্থাকেই দায়ী করে। বাংলাদেশে ১০০-র মতো মানুষ ২৭ মাসে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া, তাদের একটা বড় অংশের ক্ষতবিক্ষত লাশ পাওয়ার পর এই আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেওয়ার উপায় নেই। মানবাধিকারের দিক থেকে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার দিক থেকে এটা খুব বড় বিপদের লক্ষণ। 
প্রখ্যাত সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজ কর্নেল তাহেরসহ বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে অনুসন্ধানে নিয়োজিত। ২০০৬ সালে তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘ভবিষ্যতে যদি এমন অবস্থা আসে, যেখানে হাজার হাজার লোক বিনা বিচারে আটক হচ্ছে, হাজার হাজার লোক কাস্টডিতে থাকা অবস্থায় মারা পড়ছে, সে অবস্থা ঠেকানোর কোনো প্রস্তুতি কি আপনাদের আছে? (২৪ জুলাই ২০০৬, সমকাল) তিনি কিসের ইঙ্গিত করেছিলেন, আমরা জানি না। কিন্তু এ রকম অবস্থার মুখে কোনো ধরনের কোনো প্রস্তুতি যে আমাদের নেই, তা গত কয়েক বছরের বিভিন্ন ঘটনায় প্রমাণিত। কোন লোকটা সরকারি সংস্থার হেফাজতে আটক আর কোন লোকটা সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের শিকার, তা বোঝার উপায় নেই। সরকারি সংস্থাগুলোর কাজের ধরন আর মাফিয়া গোষ্ঠীর কাজের ধরনও মোটামুটি একাকার। বিনা ওয়ারেন্টে, আইনি এখতিয়ারের বাইরে মানুষকে হয়রানি করা হচ্ছে। 
অপরাধীর বিরুদ্ধে অপরাধমূলক কাজও অপরাধ। আটককৃত ব্যক্তিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতের সামনে হাজির করার বাধ্যবাধকতা অনেক ক্ষেত্রে মানা হচ্ছে না। নিতান্ত ফাঁস না হয়ে গেলে, অনেক ক্ষেত্রেই আটক করার খবর স্বীকার পর্যন্ত করা হয়নি। শত শত ক্রসফায়ারের একটিরও সুষ্ঠু তদন্ত হয়নি। আইন প্রয়োগকারী আর আইন লঙ্ঘনকারীর কাজের ধরন একই রকম হয়ে গেলে বিপর্যয়ের মুখে বাঁধ দেওয়া সম্ভব হয় না। লিফশুলজের আশঙ্কার এই ব্যাখ্যাই আমরা বুঝে নিচ্ছি। 
বেআইনি হত্যাকাণ্ডে নিহতের সঙ্গে নিহত হচ্ছে সত্যটাও, দার্শনিকের সত্য না, কবির সত্য না, আদালতের সত্যটাই আমরা জানতে চাই। এই সত্য সরকারের জানা প্রয়োজন; কারণ, আইনের আওতায় জীবন রক্ষা ও জীবন নেওয়ার অধিকার রাষ্ট্রের তরফে একমাত্র তাদের। এই একচেটিয়া অধিকারে কারা ভাগ বসাল, সেটা জানা এবং তাদের দমন ছাড়া আইনের শাসন কায়েম হতে পারে না। সত্য জানা দরকার আদালতেরও। হত্যা চলবে কিন্তু খুনির শাস্তি হবে না; এমন অবস্থায় মানুষআদালতের বাইরে প্রতিকার আইন কার্যকারিতা হারায়। সত্য জানার প্রয়োজন জনগণের, দেশের হালহকিকতের সঙ্গে তাদের প্রতিদিনের রুটি-রুজির সংগ্রামই কেবল নয়, বাঁচা-মরাও অবিচ্ছেদ্য। সত্য দরকার গণতন্ত্রের স্বার্থেও, মিথ্যার মধ্যে জনগণ বা সরকার কেউ পথ খুঁজে পাবে না। তাই সত্যের সন্ধানই রাজনীতির কেন্দ্রীয় প্রশ্ন হয়ে উঠেছে। এই সত্যগুলো ছাড়া তাই জাতীয় অবস্থার পরিমাপ আর করা সম্ভব না। সম্ভব না কে শত্রু আর কে বন্ধু তা চেনা। সম্ভব না, হারানো ভরসা ফিরিয়েআনা। মিথ্যা আশার ছলনে আর ভোলানো যাবে না। 
কেবলইলিয়াস আলীদের মতো মানুষের অধিকার নয়, সাধারণ মানুষকে বেআইনি হত্যা ও আটক থেকে সুরক্ষা দিতে হবে। এর জন্যই যাবতীয় রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, ক্রসফায়ার, গুম, নিখোঁজ হওয়া বিষয়ে জাতীয়ভাবে বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে সত্যানুসন্ধান কমিটি গঠন করতে হবে সরকারকে। সত্যের টিকি যত ওপরে বা যত গভীরেই থাক না কেন, কমিটিকে সেই পর্যন্ত যাওয়ার এখতিয়ার ও বাস্তব সহায়তা দিতে হবে। ব্যক্তি বা নাগরিকের জীবন এবং রাষ্ট্রীয় ভবিতব্য আজ একবিন্দুতে চলে এসেছে। এত মৃত্যু, এত অবিচার, এত মিথ্যা নিয়েবেশি দিন আমরা চলতে পারব না। এ রকম অবস্থায় সত্যই আমাদের সহায়। এই সহায় যদি আমরা না পাই তাহলে প্রখ্যাত সাংবাদিক ফয়েজ আহমদের মতো করেই বলতে হবে, ‘সত্যবাবু মারা গেছেন।’ তিনি অবশ্য একা যাননি, সহমরণের পথে রাজনীতি তাঁর অনুগামীহয়েছে। 
এই বাস্তবতায় আমরা সবাই এখন গুম হওয়ার বা আগুনে পোড়ার আগে, বেওয়ারিশ লাশ হয়ে পড়ে থাকার আগে, হয়ে উঠি শ্রয়েডিংগারের বিড়ালের মতো: অর্ধমৃত বা অর্ধজীবিত।
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com

বুধবার, ১১ এপ্রিল, ২০১২

আজকের তাজা খবর

মুস্তাফা জামান আব্বাসী | তারিখ: ১১-০৪-২০১২



তাজা খবরের পেছনে ধাবিত সবাই। কার না পছন্দ টাটকা মাছ, সবজি। খবরের কাগজে ছাপা হওয়ার আগেই খবর হয়ে পড়ে বাসি। টেলিভিশন রাত ১২টা পর্যন্ত গলাধঃকরণ করছে টাটকা খবর। কাগজওয়ালা নাস্তানাবুদ, কীভাবে নতুন খবর খদ্দেরের কাছে পৌঁছানো যায়। আজকের কাগজে: দুর্নীতি খুঁজে পেয়েছে কানাডা, পরোয়ানা দিয়ে আযাদকে খুঁজে পায়নি পুলিশ, উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে শিক্ষকদের অনশন কর্মসূচি, তদন্তে ব্যর্থতায় সৌদি আরবের হতাশা। খবরগুলোর নিচে লাল কালিতে গিন্নির মন্তব্য: ১. এ আর এমন কী, ২. খুবই স্বাভাবিক, ৩. এক মিনিটের ব্যাপার, ৪. হতাশ হওয়ারই কথা। প্রতিদিন কাগজ পড়ি, নিচে তার মন্তব্য উপভোগ করি। মাঝেমধ্যে আমিও—এভাবে চলছে নীরব খেলা। কদিন আগে লব্ধ প্রতিষ্ঠিত লেখক বের করেছেন কালকে জয় করার উদ্দেশ্যে গ্রন্থ: প্রতিদিনের তাজা খবরের নির্ঘণ্ট।
‘আর্থ ডে’ বা মৃত্তিকা দিবস পালিত হলে কথা ছিল রাতে এক ঘণ্টা অন্ধকারে থাকবে এবং এভাবে বিজলির সাশ্রয় হবে। গতকাল ইন্টারনেটে ছবি এসেছে, টোকিও, সিঙ্গাপুরের রাত সাড়ে আটটার আগে ও পরের রাতের ছবি, যেখানে শহর দুটিতে ছিল প্রথমে প্রজ্বলিত বিজলি ও পরে প্রায় অন্ধকার। ঢাকার ছবি সবচেয়ে মজার, আগে ও পরে শুধু অন্ধকার। টাটকা খবর হলো: পৃথিবীর কাছে ঢাকা শহর অন্ধকার দিয়ে ঢাকা। অন্ধকারের আবার আগে-পরে কী।
সায়মন ড্রিংকে আবার দেখলাম ‘রূপসী বাংলায়’, পূর্বতন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে; তাঁর সঙ্গে দেখা ও কথা হয়েছিল ৪০ বছর আগে। ১৬ বছর বয়সে এই তরুণ ইংল্যান্ড থেকে পালিয়ে এসেছিলেন ভারতে এবং যৌবনে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সঙ্গে হয়েছিলেন একাত্ম, জীবনে প্রত্যক্ষ করেছেন ২২টি যুদ্ধবিপ্লব ও বিদ্রোহ। রবীন্দ্র-বিধৌত বাংলাদেশে এসে জীবনের সবচেয়ে বেশি আনন্দ পেয়েছেন এবং সেদিন পেলেন সম্মান। ওই দিন সবার সঙ্গে এক টেবিলে খানা খেলাম, ওদের কথা শুনলাম। কিন্তু যে জন্য এ ঘটনার উল্লেখ, তা এখন বলছি। স্বাধীনতার পর গেলাম শান্তিনিকেতন, পেলাম পণ্ডিত রবিশঙ্করকে। নানা কথার পর বললাম, ‘আপনাকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জানাচ্ছি অভিবাদন এবং শিগগিরই আপনাকে দেওয়া হবে দ্বৈত নাগরিকত্ব।’ তিনি ভীষণ খুশি হলেন, বললেন, ‘হয়তো পাব না, কিন্তু আপনার কথাতেই পেয়ে গেলাম। সবার ভালোবাসাই আমার নাগরিকত্ব।’ ফিরে এসে অনেক দেয়ালের সঙ্গে ঠোকাঠুকি করলাম। কিছুই হলো না, অধিক সন্ন্যাসীর সমাগমে বিনষ্ট গাজন। আজকের সমাবেশে মন খুঁজে ফিরছিল রবিশঙ্করকে। তিনি অনুপস্থিত, অথচ তাঁর জন্যই ছিল আজ আমার নিভৃত ফুলের সাজি।
উইন্টার গার্ডেনে পরিবেশিত ভোজসভার স্যুপ মুখে নিচ্ছিলেন পুরোনো বন্ধু শেহাবউদ্দিন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সপক্ষে প্রথম রাষ্ট্রদূত, যিনি পাকিস্তানের ডিপ্লোমেটিক সার্ভিস থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। বললাম, ‘তোমার লেখা আত্মজীবনীতে প্রাঞ্জলভাবে অভ্যুত্থানের কথা বর্ণিত হয়েছে, যা অন্য বইতে তা পাইনি।’ শেহাবউদ্দিন চিরকালই মধুর স্বভাবের। বললেন, ‘স্বাধীনতা পদকের পানে চেয়ে স্বাধীনতা চাইনি, দোস্ত। স্বাধীন হয়েছি, এটাই গর্ব।’ অন্যদের দিকে তাকালাম, সবার দানই উল্লেখযোগ্য। শেহাবউদ্দিন বিনয়ী বলে তাঁর ভাগ্যে জুটেছে অদ্য ভোজসভার নিমন্ত্রণপত্রটুকু। ‘স্বাধীনতা দিনের গান’ গানের সম্পাদক হিসেবে আমি। ডা. দীপু মনি জানেন, শত গান আমরাই গেয়েছিলাম, তাই ভোজসভার আমন্ত্রণ। তাই বা মন্দ কী।
সম্পাদকেরা প্রায় সবাই আমার বন্ধু। সুযোগ পেলে তাঁদের উসকে দিই। আগামীর জন্য প্রয়োজন ভালো খবর তৈরির কারখানা, অভাবিত কারখানা, যার খবর আছে সম্পাদকদের। সম্পাদকদের একটি সেমিনারে উপস্থিত কুয়ালালামপুরে। প্রধান বক্তা জানালেন: স্বপ্ন ছাড়া জীবন নেই, খবরের কাগজে মানুষ দেখতে চায় সেই স্বপ্নের বিস্তার। মানুষকে স্বপ্ন দেখানোর কারিগর তিনজন: পত্রিকা সম্পাদক, চলচ্চিত্র স্রষ্টা ও টেলিভিশন স্রষ্টা, আগামী দিনের স্বপ্ননির্মাতা এঁরাই। জিজ্ঞেস করলাম, কীভাবে। বললেন, ‘পত্রিকা সম্পাদক চয়ন করবেন দেশের সবচেয়ে পজিটিভ চিত্র, বিদেশের পজিটিভ চিত্র, সেগুলোই ভেঙে ভেঙে হবে পরিবেশিত। সম্পাদক জানেন কোনটি চির সত্য এবং কোনটি সত্যি হিসেবে প্রকাশ হতে চলেছে আগামী দিনে। খবরের কাগজে একটু একটু করে ছড়িয়ে দিতে হবে সেই স্বপ্ন, যেমনটি করে থাকেন চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন প্রযোজকেরা।’
সুযোগ এলে বললাম লেখকদের কথা, স্বপ্ন ছড়ান যাঁরা মানুষের চোখে, যেমনটি ছড়িয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল। দগ্ধ পৃথিবীতে লেখক তাঁর মন নিয়ে সৃষ্টি করতে পারবেন নতুন পৃথিবী, যেখানে পাওয়া যাবে উত্তম খবর, উত্তম দুনিয়ার উত্তম মানুষদের ছবি। সঞ্চালক বললেন, ‘খুব সুন্দর আপনার কথা। আমরা শুনেছি নতুন বাংলাদেশের কথা, যেখানে সবচেয়ে বড় ভূমিকা লেখকদের। তাঁরাই আসলে আপনাদের স্বপ্নের সোনার বাংলাকে নিয়ে আসবেন সবার সামনে।’
এবার দুটি গল্প।
গিন্নি বাজারে পাঠাচ্ছেন ছোকরা ছেলেকে।
বললেন: টাটকা মাছ আনবি না। ছোকরা অবাক। ম্যাডাম বলেন কী।
ঠিক তা-ই। যে ফল, সবজি, মাছ যত টাটকা, তাতে তত ফর্মালিনের বিষ।
আবার এদিকে যে খবর যত টাটকা, তাতেই চমক, তাতেই বিক্রি।
আমার এক বন্ধু কয়েক মাস পরপরই আমেরিকা থেকে ঢাকা আসেন। পিতা মৃত্যুশয্যায়, প্রতিবারই প্রায়মৃত পিতা উঠে বসেন। অনেক টাকা খরচ হলেও বন্ধু খুশিমনেই ফিরে যান কর্মস্থলে। এবার এসেছেন, খুশিমনে ফেরা হলো না। এবারের খবর: তিনি নেই।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: লেখক-গবেষক, সংগীত ব্যক্তিত্ব।
mabbasi@dhaka.net

শুক্রবার, ৬ এপ্রিল, ২০১২

জাতীয় কবি নজরুলকে নিয়ে


যে যেভাবে দেখি


॥ মুস-াফা জামান আব্বাসী ॥

আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম। তাকে নিয়ে বিগত সত্তর বছরে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে চলেছে নানা কর্মযজ্ঞ। বেশির ভাগ ভালো, কিছু খারাপও রয়েছে। ভারত সরকারের বিদেশ মন্ত্রণালয়ের পাবলিক ডিপ্লোম্যাসি বিভাগ প্রকাশিত ও পরিবেশিত ‘নজরুল দি পোয়েট রিমেম্বার্ড’ অ্যালবামটি হাতে নিয়ে যেমন খুশিতে আত্মহারা হয়েছিলাম, তেমনি এর কয়েকটি ছবি দেখে হতাশায় মন ভরে গেল। নজরুলের পুত্রবধূ কল্যাণী কাজী একজন সম্মানিত মহিলা। তিনি এই অ্যালবামটি সম্পাদনা করেছেন। এতে রয়েছে চুরুলিয়া থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদ পর্যন্ত কবির জীবনের স্মৃতিবাহী অনেক সংগ্রহযোগ্য ছবি, যা ভারত সরকার প্রচুর অর্থ ব্যয় করে প্রথমবারের মতো ছাপিয়েছে। ভালো লেগেছে কবির সান্নিধ্যে আসা অনেকের ছবি, বিশেষ করে তার পুত্র সব্যসাচী, অনিরুদ্ধ, পুত্রবধূ উমা কাজী, কল্যাণী কাজী, নজরুলের সাথে গ্রামোফোন কোম্পানির চুক্তিপত্র, নানাজনের চিঠি, বিশেষ করে বিরজাসুন্দরীকে লেখা নজরুলের চিঠি, প্রমিলা নজরুলকে লেখা আমার পিতা আব্বাসউদ্দিনের চিঠি, নজরুল যে বাসায় ছিলেন সেই বাসাগুলোর ছবি, লেখার পাণ্ডুলিপিগুলো, পারিবারিক কুষ্ঠি, নজরুল ব্যবহৃত আয়না, হাতঘড়ি, ফ্যান, ক্যামেরা, রুমালের বাক্স, চশমা, কলম, প্লেট, রেকর্ড, জামা, গ্রামোফোন রেকর্ড, হারমোনিয়াম, পিয়ানো, পুতুল, প্রথম সংস্করণের মলাট, প্রায় কিছুই বাদ যায়নি।
যা বাদ গেলে খুশি হতাম, তা হলো নজরুল নাকি কতগুলো পুতুলকে সামনে রেখে পূজা করতেন। এই পুতুলগুলোকে বলা হয়েছে নজরুলের ঠাকুরঘরের কালীমূর্তি। খোঁজ নিয়ে জানা গেল এটি একটি বানোয়াট ছবি। বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, ছত্রিশ বছর ছিলেন নির্বাক, নানা ষড়যন্ত্রের নিশ্চিত ফলাফল। কে না জানে, তার হিন্দু বিবাহ মুসলমানেরা মেনে নেয়নি। তাকে দিয়েছিল কাফের ফতোয়া। হিন্দুরা তার মুসলমানি রচনা, উদ্দীপনামূলক জাগরণী গানকে গ্রহণ করেনি। এটি এখন ইতিহাসের অন্তর্গত। নজরুলের দু’ছেলেই অত্যন্ত গুণবান। কোনো ধর্মের প্রতি পরিপূর্ণ উৎসাহ দানা বাঁধার আগেই তারা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। তাদের ছেলেমেয়েরা যেকোনো ধর্মে স'ান পেলে কারো কোনো আপত্তির প্রশ্ন ওঠে না। যার যার ধর্ম তার তার কাছে। এ নিয়ে কারো নেই কোনো মাথাব্যথা, কিন' জাতীয় কবি নজরুলের আরাধ্য কালীমূর্তি ও তৎসঙ্গে চারজন দেবদেবীর সচিত্র উপসি'তি এই অ্যালবামটিকে করেছে প্রশ্নবিদ্ধ। তার চলে যাওয়ার এত দিন পর তার ধর্মবিশ্বাস নিয়ে সচিত্র প্রতিবেদন পরিহার করাই ছিল যুক্তিযুক্ত। শ্যামবাজার স্ট্রিটে যে কালীমন্দিরে নজরুল নিয়মিত যেতেন বলে এই অ্যালবামে ছবি ছাপা হয়েছে তার ভিত্তি নড়বড়ে। নজরুল একজন যোগীর কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন। যোগীবর তার সামনে তার মৃত পুত্র বুলবুলকে উপসি'ত করেছিলেন বলে শোনা যায়। নজরুল সবার কাছে গিয়েছিলেন বুলবুলের খোঁজে, এমনকি যোগীবরের কাছে। আমার লেখা উপন্যাস পুড়িব একাকী গ্রনে' চেষ্টা করেছি ব্যাপারটিকে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে। ধর্মের কোলাহল থেকে বের করে একজন মানবিক কবিকে উপসি'ত করতে চেষ্টা করেছি এই উপন্যাসে। মনে রাখতে হবে সময়টা মহাযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বিপর্যস্ত। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ সেই পরিসি'তি থেকে অনেক দূর এগিয়ে এসেছে বলে আমাদের দাবি। তা না হলে কলকাতায় হতো না নজরুল মঞ্চ, হতো না কাজী নজরুল ইসলাম সরণি, ঢাকায় হতো না কাজী নজরুল ইসলাম মহাসড়ক। ওই মূর্তিগুলোর ছবি মুসলমানদের বোধে আবার নতুন করে দেবে আঘাত, এর কোনো প্রয়োজন ছিল না। আমার অত্যন্ত সম্মানীয় কল্যাণী কাজী এই কাজ থেকে নিবৃত্ত হলে ভালো হতো। আশা করা যায়, ভারত সরকারের বিদেশ মন্ত্রণালয়ের পাবলিক ডিপ্লোম্যাসি বিভাগ, ব্যাপারটি উপলব্ধি করবেন এবং নতুন করে ছাপলে এ ব্যাপারে যথাযথ কাজটি করবেন। ‘কে আর হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে’ অ্যালবামটি দামি, যে কারণে সবার কাছে এটি পৌঁছবে না; এটাই বাঁচোয়া। 
৪ এপ্রিল ২০১২
লেখক : সাহিত্য-সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব
mabbasi@dhaka.net

সেলিব্রেটিদের আত্মীয়তার বন্ধন



আবুল কালাম
বিনোদন জগতে তারকাদের মাঝে আত্মীয়তার বন্ধন অনেকেরই হয়তো জানা নেই। বর্তমানে মিডিয়াতে যারা জনপ্রিয় তাদের অতীত খুঁজলে দেখা যায় নিজেদের মধ্যে আত্মীয়তার বন্ধনের কারণে একে অন্যের হাত ধরেই মিডিয়াতে প্রবেশ করে আজ নিজ নিজ ক্ষেত্রে তারা প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন। 
চিত্র নায়ক রিয়াজ : মূলত ববিতার হাত ধরেই রিয়াজ বড় পর্দায় পা রাখেন। কারণ তিনি ববিতা, চম্পা ও সুচন্দার চাচাতো ভাই। এছাড়া বড় পর্দার এই সময়ের দুই নায়ক আমিন খান ও অমিত হাসান দুইজন ভায়রা ভাই।
কানিজ আলমাস-জুয়েল আইচ : যাদু শিল্পী জুয়েল আইচ ও বিপাশা আইচ স্বামী-স্ত্রী। বিপাশার ভাবী বিউটিশিয়ান কানিজ আলমাস খান। জুয়েল আইচের বড় ভাই পশ্চিমবঙ্গের আলোচিত গীতিকার মানিক আইচ।
শমী কায়সার : ডাক্তার বদরুদ্দোজা চৌধুরীর ছেলে মাহী বি চৌধুরীর আপন খালাত বোন অভিনেত্রী শমী কায়সার। এছাড়া কণ্ঠশিল্পী সুমনা হক মাহীর ফুপাতো বোন। সুমনার মা কবি খালেদা এদিব চৌধুরী। মাহীর স্ত্রী লোপাও একসময় মডেলিং করতেন।
বিজরী বরকতউল্লাহ : কণ্ঠশিল্পী আবিদা সুলতানার ননদ হচ্ছেন অভিনেত্রী বিজরী বরকতউল্লাহ। এই অভিনেত্রীর স্বামী সঙ্গীত পরিচালক শওকত আলী ইমনের বড় বোন আবিদা। ফলে কণ্ঠশিল্পী রফিকুল আলম সম্পর্কে ইমনের দুলাভাই হন। 
ঈশিতা : ব্যান্ড শিল্পী শাফিন আহমেদ ও হামিন আহমেদের ভাবী হন টিভি অভিনেত্রী রুমানা রশীদ ঈশিতা। মাইলস ব্যান্ডের এই শিল্পীদ্বয়ের মামাতো ভাই আরিফ দৌলা অভিনেত্রী ঈশিতার স্বামী।
অর্ণব : একসময়ের টিভি উপস্থাপিকা অদিতি সেন গুপ্তের চাচা কণ্ঠ শিল্পী তপন চৌধুরী। আর বর্তমান প্রজন্মের আলোচিত গায়ক অর্ণব তপন চৌধুরীর বড় ভাই চিত্রশিল্পী স্বপন চৌধুরীর ছেলে। 
ডলি-পলি : কণ্ঠ শিল্পী ডলি সায়ন্তনী, পলি সায়ন্তনী ও বাদশা বুলবুল তিন ভাই বোন। তাদের মা লোকসঙ্গীত শিল্পী মনোয়ারা বেগম। ডলির প্রাক্তন দুই স্বামী হচ্ছেন কণ্ঠশিল্পী রবি চৌধুরী ও গীতিকার আহমেদ রিজভী।
তৌকির আহমেদ : জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার আতহার আলী খান টিভি অভিনেতা ও পরিচালক তৌকির আহমেদের ছোট বোনের স্বামী। সেই সূত্রে আতহার সম্পর্কে তৌকিরের ভগ্নিপতি। এছাড়া অভিনেতা শাহেদ হচ্ছেন তৌকিরের ভায়রা। তাদের শ্বশুর হচ্ছেন অভিনেতা আবুল হায়াত।
কণ্ঠশিল্পী আসিফ : ক্রিকেটার এনামুল হক মনির ভগ্নিপতি হচ্ছেন কণ্ঠশিল্পী আসিফ আকবর। কারণ আসিফের স্ত্রী সালমা আসিফের বড় ভাই হচ্ছেন এনামুল হক মনি।
তানিয়া আহমেদ : অভিনেত্রী তানিয়া আহমেদের আপন দুই মামা চলচ্চিত্র অভিনেতা সোহেল রানা ও রুবেল। এছাড়া তানিয়ার স্বামী হচ্ছেন গায়ক ও সঙ্গীত পরিচালক এসআই টুটুল।

বাপ্পা মজুমদার ও পার্থ প্রতিম মজুমদার : আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মূকাভিনেতা পার্থ প্রতিম মজুমদার ও সঙ্গীত পরিচালক বাপ্পা মজুমদার সঙ্গীতজ্ঞ বারীণ মজুমদারের ছেলে। তাদের মা ইলা মজুমদার। বাপ্পার স্ত্রী অভিনেত্রী মেহবুবা চাঁদনী।
দেবাশীষ বিশ্বাস : প্রয়াত সঙ্গীত পরিচালক সত্য সাহার দুই ছেলে ইমন সাহা ও সুমন সাহা। ইমনের খালাতো ভাই উপস্থাপক দেবাশীষ বিশ্বাস। ইমন, সুমন ও দেবাশীষের মামা চিত্র পরিচালক শিল্পী চক্রবর্তী।
সামিনা-ফাহমিদা : বরেণ্য সঙ্গীত শিল্পী মাহমুদুন নবীর দুই মেয়ে ফাহমিদা নবী ও সামিনা চৌধুরী। তাদের ছোট ভাই পঞ্চম একজন ব্যান্ড শিল্পী। সামিনা চৌধুরীর প্রাক্তন স্বামী ব্যান্ড শিল্পী নকিব খান। তার বর্তমান স্বামী ইজাজ খান স্বপন ওয়ার্ল্ড মিউজিকের কর্ণধার।
শাহনাজ রহমতউল্লাহ : প্রয়াত চলচ্চিত্র অভিনেতা জাফর ইকবালের বোন গায়িকা শাহনাজ রহমত উল্লাহ। 
আগুন-সাবিনা : বর্তমান প্রজন্মের গায়ক ও অভিনেতা আগুনের বাবা খান আতা ও মা কণ্ঠশিল্পী নিলুফার ইয়াসমিন । চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব খান আতার দুই স্ত্রী মাহবুবা রহমান ও নিলুফার ইয়াসমীন। নিলুফার ইয়াসমীনের বড় বোন সাবিনা ইয়াসমীন। সেই হিসেবে আগুনের খালা হন সাবিনা। অপরদিকে মাহবুবা রহমান ও খান আতার ঘরে জন্ম নেন কণ্ঠশিল্পী রুমানা ইসলাম।
রামেন্দু মজুমদার : অভিনেত্রী ত্রপা মজুমদারের বাবা-মা হচ্ছেন ফেরদৌসি মজুমদার ও রামেন্দু মজুমদার। বিজ্ঞাপন নির্মাতা আপন আহসান ত্রপার স্বামী। ফেরদৌসি মজুমদারের বড় দুই ভাইয়ের একজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও শিাবিদ অধ্যাপক কবির চৌধুরী এবং আরেকজন মুনীর চৌধুরী। তারা উভয়েই মারা গেছেন।

বৃহস্পতিবার, ৫ এপ্রিল, ২০১২

ঢাকায় তিন দশকের বৈশাখী মেলা



আশীষ-উর-রহমান
এবার ৩৩ বছর পূর্ণ হচ্ছে ঢাকার বৈশাখী মেলার। মেলা আমাদের ঐতিহ্যবাহী লোকসংস্কৃতির একটি প্রধান উপাদান। দেশজুড়েই বছরের বিভিন্ন সময় নানা ধরনের মেলার আয়োজন হয়ে আসছে প্রাচীনকাল থেকে। এসব মেলা কখনো আয়োজিত হয় ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের অনুষঙ্গ হিসেবে, আবার কখনো ধর্মনিরপেক্ষ সামাজিক বা জাতীয় জীবনের কোনো ঘটনাকে কেন্দ্র করে। তবে মূল বিষয় যা-ই থাকুক, মেলায় সর্বসাধারণের বিপুল সমাগমে একটি আনন্দময় আবহের সৃষ্টি হয়। পাশাপাশি কৃষি বা লোক ও কারুশিল্পসামগ্রীর বিপণনেরও একটি বড় সুযোগ ঘটে। আগের দিনে বিপণনব্যবস্থা, যোগাযোগব্যবস্থা এখনকার মতো উন্নত না থাকায় এসব আঞ্চলিক মেলার বড় রকমের বাণিজ্যিক গুরুত্ব ছিল। এ ছাড়া মেলাকে কেন্দ্র করে যাত্রা, পুতুলনাচ, সার্কাস, নাগরদোলা—এ ধরনের আয়োজন নিস্তরঙ্গ জনজীবনে একটি নির্মল বিনোদনেরও সুযোগ করে দিত।
দিনে দিনে অনেক কিছুর মতো গ্রামীণ মেলার আঙ্গিকও অধুনা বেশ পাল্টে গেছে। উন্নততর যোগাযোগব্যবস্থা, নগরায়ণের বিস্তৃতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার গ্রামপর্যায়ে সম্প্রসারণে মেলার অর্থনৈতিক গুরুত্ব অনেকটা গৌণ হয়ে পড়লেও মেলার প্রতি জনসাধারণের আবেগ ও আকর্ষণ কমেনি। বরং গ্রামের ঐতিহ্যবাহী লোকমেলাগুলোকে শহরে তুলে এনে শহুরে নতুন প্রজন্মের কাছে আপন সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের বিষয়গুলোকে পরিচিত করানোর উদ্যোগ শুরু হয়েছে। রাজধানীতে ঋতুভিত্তিক লোক-উৎসবগুলোর পাশাপাশি বেশ সাড়ম্বরেই এ ধরনের মেলা আয়োজিত হচ্ছে।
বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনের বহুমাত্রিক আয়োজনের মধ্যে বৈশাখী মেলার প্রতি নগরবাসীর রয়েছে বিশেষ আকর্ষণ। বছরের প্রথম দিনটিতে নানা বয়সী নারী-পুরুষ-শিশু পথে নেমে পড়ে উৎসবে শামিল হতে। সারা দিন ঘুরেফিরে তারা একসময় বৈশাখী মেলাতেও একটা চক্কর দিতে ভোলে না। এখানে ঘর-সংসারের জন্য দরকারি এমন অনেক জিনিসপত্রেরই সন্ধান মেলে, যা বছরের অন্য সময় সচরাচর হাতের কাছে পাওয়া মুশকিল। বেড়ানোর আনন্দের সঙ্গে তারা প্রয়োজনীয় কেনাকাটাও সেরে নেয় মেলায়।
ঢাকায় নববর্ষের উৎসবে বৈশাখী মেলার আনুষ্ঠানিক সংযোগ ঘটেছিল ১৯৭৮ সালে। শিল্পগুরু পটুয়া কামরুল হাসান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জাতীয় নকশাকেন্দ্র, যা এখন বিসিকের সঙ্গে একীভূত। এই নকশাকেন্দ্রের ব্যবস্থাপনাতেই নকশাকেন্দ্রের পরিচালক কামরুল হাসান দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কারুশিল্পীদের তৈরি পণ্য ঢাকায় এনে একটি মেলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তাঁকে সহায়তা করেছিলেন তখনকার প্রধান নকশাবিদ শিল্পী ইমদাদ হোসেন। মেলাটি হয়েছিল বাংলা একাডেমীর সঙ্গে যৌথ আয়োজনে একাডেমীর বটতলায়। সেটি ছিল তিন দিনের মেলা। কারুপণ্যের জনপ্রিয়তা ও বাজার সৃষ্টিই ছিল এর মুখ্য উদ্দেশ্য।
নকশাকেন্দ্রের নিজস্ব জায়গা না থাকায় একটি নির্দিষ্ট স্থানে মেলা করা সম্ভব হয়নি তাঁদের পক্ষে। তা সত্ত্বেও প্রতি বৈশাখেই তাঁরা এ মেলার আয়োজন করেছেন। বাংলা একাডেমীর মাঠে প্রথম বছর তিনেক মেলার আয়োজনের পর ধামনন্ডি খেলার মাঠে বহু বছর বৈশাখী মেলা হয়েছে। এরপর সেখান থেকে বৈশাখী মেলা চলে গেছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার মাঠে। তারপর শিশু একাডেমীর প্রাঙ্গণ, আজিমপুর বালিকা বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ হয়ে আবার তিন দশক পর আবার তা ফিরে এসেছে বাংলা একাডেমী মাঠে। এই দীর্ঘ সময় ও নগর-পরিক্রমায় মেলার প্রতি নগরবাসীর আগ্রহ বেড়েছে। দেশের কারুপণ্যের জনপ্রিয়তা এবং বাজার সৃষ্টির ক্ষেত্রেও বিপুল ভূমিকা রেখেছে এ মেলা।
এ বছর বৈশাখী মেলা হবে ১০ দিন। মেলা সম্পর্কে বিসিক নকশাকেন্দ্রের প্রধান নকশাবিদ এস এম শামসুদ্দিন জানালেন, বাংলা একাডেমীর সঙ্গে যৌথ আয়োজনে এবার মেলা হচ্ছে। এতে স্টল আছে দেড় শ। জায়গার স্বল্পতার কারণে আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও অনেককে স্টল দেওয়া যায়নি। বাছাই করে যেসব কারুপণ্য সচরাচর শহরে পাওয়া যায় না, এমন পণ্যকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বরাবরের মতোই একটা আলাদা জায়গা রাখা হয়েছে, যেখানে কারুশিল্পীরা দর্শকদের সামনে তাঁদের কাজ করবেন। পাশাপাশি নাগরদোলা, পুতুলনাচ এবং প্রতি সন্ধ্যায় মেলামঞ্চে বিভিন্ন অঞ্চলের লোকশিল্পীদের অংশগ্রহণে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান তো থাকবেই।

আকাশজুড়ে আশ্চর্য মেঘ


মেঘ


আশীষ-উর-রহমান
সুখে-দুঃখে, বর্ষায়-খরায়, দিনে-রাতে মুখ তুললেই যার মুখোমুখি, কে সে? মেঘ ছাড়া সে আর কেউ নয়। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘মন মোর মেঘের সঙ্গী’—সে সঙ্গী আসলে জন্ম থেকে মৃত্যু, প্রতি মুহূর্তের। শুধু মানুষ নয়, সমগ্র জীবজগৎ, এই সসাগরা পৃথিবীর ওপরে সে নিজেকে প্রসারিত করে দিয়েছে পরম আশীর্বাদের মতো।
সেই মেঘ চারদেয়ালের মধ্যে চতুষ্কোণ ফ্রেমে বন্দী সারে সারে। গ্যালারি চিত্রকে ঢুকতেই জীবনানন্দের মতোই মনে হলো, চোখ মেলে আমি যেন দুই স্তর মেঘের ভেতর প্রবেশ করলাম। যেদিকে তাকাই মেঘ, শুধু মেঘ। কেউ ধূমল, কেউ গৈরিক, কেউ ফুরফুরে পেঁজা পেঁজা, কেউ গলে পড়ছে, কেউ পড়ি পড়ি...প্রকৃতই ‘মেঘের পরে মেঘ জমেছে’ প্রবীণ শিল্পী আবদুল মান্নানের এই প্রদর্শনীতে (২৩ জুলাই—২ আগস্ট)। 
মেঘের অনেক নাম: মেঘের নামের বাহারও কম নয়। কাদম্বিনী, জলদ, জলধর, সেক্তা, সেচক, ঘন, নিঃস্বনা, অম্বুবাহ, ধূমল, অভ্র, নীরদ, বারিদ, জীমূত, বলাহক, তোয়াদ, অম্বুদ প্রভৃতি। নামই যার এত এত, শব্দসম্ভারে তার প্রাচুর্য থাকাই স্বাভাবিক। আছেও। মেঘ নিয়ে দেখুন কত শব্দ জমেছে বঙ্গভান্ডারে, ‘মেঘলা’ দিয়েই শুরু করা যাক। ক্রমান্বয়ে পাওয়া যাবে, মেঘপুষ্প (বৃষ্টি), মেঘমেদুর, মেঘতিমির, মেঘভাঙা (রোদ), মেঘমন্দ্র, মেঘযামিনী, মেঘপল (শীলা), মেঘনাল (নীলবস্ত্র), মেঘনাদানুলাসী (ময়ূর), মেঘনির্ঘোষ, মেঘবহ্নি (বিজলী), মেঘাগম (বর্ষা), মেঘাত্যয় (শরৎ), মেঘডম্বর, মেঘসখা, (আরও আগ্রহীরা অভিধান দেখুন)। 
মেঘ নিয়ে আছে বেশকিছু প্রবাদ-প্রচন। মনে করুন সেগুলো। ‘মেঘ না চাইতেই জল পেতে পারেন’। তবে মনে রাখা ভালো, ‘ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় পায়।’ ভাবতে ভাবতে কি এও ভাবছেন, মেঘে মেঘে বেলা তো কম গেল না! সময় তো যাবেই। মনটা খুব বেশি ভার হয়ে ওঠে, তবে না হয় কান পেতে দিন মেঘমল্লার রাগে। 
মেঘলা দিনের গান: রাগসংগীতে মন না বসলে আছেন রবীন্দ্রনাথ। কত কবিতা, কত গান, ‘কালো মেঘে আঁধার হলো দেখে ডাকতে ছিল শ্যামল দুটি গাই’, ‘ঝুঁটিবাঁধা ডাকাত সেজে দলবেঁধে মেঘ চলেছে যে’, ‘মেঘ বলেছে যাব যাব’ থেকে ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা’, ‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে’—কতই-না বিপুল বৈচিত্র্য! আছে নজরুলের কাজরী ‘পরদেশী মেঘ যাও রে ফিরে’ অথবা ‘মেঘমেদুর বরষায় কোথা তুমি’। 
অন্য ধরনের কিছুর তালাশ করলে সতীনাথের গলায় ‘আকাশ এত মেঘলা যেও নাকো একলা’, ভূপেনের ‘মেঘ থমথম করে কেউ নেই’, কিশোর কুমারের ‘হাওয়ায় মেঘ সরায়ে’, হেমন্তের ‘মেঘ কালো আঁধার কালো’ থেকে রুনা লায়লার গাওয়া ‘পরদেশী মেঘ রে আর কোথা যাসনে...’ শুনতে শুনতে পরান জুড়াতে পারেন। আসলে মেঘ নিয়ে গানের অন্ত নেই। 
ওগো মেঘ তুমি: মেঘ কী? বিজ্ঞানের ন্যূনতম ধারণা আছে যাঁদের, তাঁরা তা জানেন। ‘মাঠ ঘাট সাগর নদীর পানি সূর্যতাপে বাষ্প হয়ে গেল বাতাসে। সেই উত্তপ্ত ও আর্দ্র বাতাস উঠে গেল ওপরে। ওখানে বতাসের ওপর চাপ কম, তাই তা প্রসারিত হয়ে শীতল হলো। যথেষ্ট শীতল হলে বাতাসের জলীয়বাষ্প ঘনীভূত হয়ে অতি ক্ষুদ্র জলবিন্দু কি বরফবিন্দুর আকারে ভাসতে লাগল আকাশে। সেটিই মেঘ।’ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইব্রাহীম তাঁর বৃষ্টি ও বজ্র বইতে মেঘের এই চমৎকার সংজ্ঞাটি দিয়েছেন, সঙ্গে আছে মজার মজার তথ্য। কখনো কখনো ওই বারিবিন্দু পরস্পরের সঙ্গে মিলেমিশে আকারে বড় আর ভারী হয়ে ওঠে। তখন তো ভেসে থাকা মুশকিল। বৃষ্টি হয়ে তারা নেমে পড়ে, ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঝরে পড়ে ধবল তুষার বা শিলাখণ্ডরূপে। বৈজ্ঞানিক সূত্রটি হলো, প্রথমে ভূপৃষ্ঠের পানির বাষ্পীভবন, তারপর ঊর্ধ্বলোকে তার ঘনীভবনে মেঘে রূপান্তর, অতঃপর অধঃক্ষেপণে ঝরো ঝরো মুখর বাদলধারা। এই হলো চিরাচরিত জলচক্র, যা সুজলা-সুফলা করে রেখেছে পৃথিবীকে আবহমানকাল থেকে।
সে না হয় হলো, কত পানি যায় আর কত আসে তার কি কোনো হিসাব আছে? অবশ্যই। সহজ হিসাবটি হলো, যত যায় তত আসে। ওই বইতে পাওয়া হিসাবে দেখা যাচ্ছে, প্রতিবছর পৃথিবী থেকে যত পানি সূর্যের তাপে বাষ্পীভবন হয়, এক জায়গায় রাখলে তার আয়তন হবে এক লাখ ২৪ হাজার ঘনমাইল। এর মধ্যে সমুদ্র থেকে যায় এক লাখ নয় হাজার ঘনমাইল এবং ভূপৃষ্ঠের নানা উৎস থেকে যায় বাদবাকি ১৫ হাজার ঘনমাইল। ফিরতি পালায় লাভটি হয় কিন্তু স্থলভাগেরই। স্থলের ওপরে পড়ে ২৬ হাজার ঘনমাইল পানি। সমুদ্রে পতন ৯৮ হাজার ঘনমাইল। এই পানি শুকানোর কাজে যে বিপুল উত্তাপের প্রয়োজন, তা তো জোগায় সূর্যই। কতখানি শক্তি যায় বাষ্পীভবনে? পৃথিবীতে পড়া সৌরশক্তির তিন ভাগের এক ভাগ চলে যায় ওই পানি শুকানোর কাজে। এই হলো মোটা দাগে মেঘের রসায়ন। 
দেখাই যাচ্ছে, মেঘ নিয়ে কেবল কবির হূদয়ই আকুল-ব্যাকুল হয়েছে, তা নয়। ছায়াদানকারী মেঘ নিয়ে বিজ্ঞানীরাও কম মাথা ঘামাননি। ইদানীং বরং তাঁদের মাথাব্যথাটা একটু বেশিই। জলবায়ু, আবহাওয়ার হালচাল যেভাবে বদলাচ্ছে, তাতে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নিয়েই তাঁরা শঙ্কিত।
গগনে গরজে মেঘ: মেঘ ডাকে। গর্জনে কাঁপিয়ে তোলে চরাচর। তার কোলে কখনো রোদের হাসি, কখনো বুক চিরে বিজলির চমক। সূর্যকে আড়াল করে দেয় সুনিবিড় ছায়া। আবার রোদের রং গায়ে মেখে নিজেই রূপে অপ্সরা। আদিগন্ত তার অবাধ বিচরণ। চিরচলিষ্ণু। যেতে যেতে ছিঁড়েছিটে কুটি কুটি কাগজের মতো সারা আকাশে ছড়ানো। আবার খানিক পরই পরস্পর জুড়ে গিয়ে প্রাগৈতিহাসিক কালের বিকট জন্তুর আকার। পাহাড়-পর্বতের প্রতিকৃতি। মেঘেরা পারেও বটে! 
এসব মেঘেরও আছে রকমফের। বিজ্ঞানীরা তিনটি প্রধান ভাগে ফেলেছেন মেঘমালাকে। সবচেয়ে উঁচুতে সরু ফিতার মতো যে মেঘগুলোকে দেখা যায়, তার নাম ‘অলক মেঘ’। অলক মেঘ সব সময়ই অমল ধবল। আকাশজুড়ে ধূসর রঙের মলিন আঁচল উড়িয়ে বেড়ায় ‘স্তর মেঘ’। স্তর মেঘ অলকের চেয়ে নিচে স্তরে স্তরে সাজানো থাকে। সাধারণত, ধূসর দেখায় তাদের রং। রূপের শোভায় অনন্য ‘স্তূপ মেঘ’। এই মেঘগুলো ফুলে-ফেঁপে নানা আকার নেয়। আর গায়ে রোদের কিরণ মেখে মনোহর হয়ে ওঠে তারা। তবে অনেক সময় স্তর ও অলক কিংবা স্তর ও স্তূপ মেঘ মিলেমিশে যেতে পারে। যায়ও।
মেঘ নিয়ে এত কথা বলার পর যদি মেঘদূতের কথাই না বলা হলো, তো সেটি হবে লবণবিহীন ব্যঞ্জনের মতো। অতএব মেঘ নিয়ে কিছু বলতে গেলে মেঘ আর মেঘদূতকে অভিন্ন করে রেখে যাওয়া মহাকবি কালিদাসের কথা বাদ দেয় সাধ্য কার! মেঘের কোনো দেশ নেই, ঠিকানা নেই। মেঘ সব দেশের, সব কালের মানুষের। সেই মেঘকে ভালো না বেসে পারবে কেন মানুষ। কালিদাস তাকে বিরহীর বার্তাবাহক করে পাঠিয়েছিলেন। অন্য দেশের একজন বলেছেন, শুধুই ভালোবাসার কথা। কোন কাজের ভার দেননি তাকে। বদলেয়ারের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে কি? 
বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদে শার্লের ‘অচেনা মানুষ’ নামের সেই বিখ্যাত কবিতা দিয়েই তবে শেষ করি মেঘের এই যৎসামান্য প্রশস্তি, ‘বলো আমাকে, রহস্যময় মানুষ, কাকে তুমি সবচেয়ে ভালোবাসো:/ তোমার পিতা, মাতা, ভ্রাতা, অথবা ভগ্নি কে?/ পিতা, মাতা, ভ্রাতা, ভগ্নি—কিছুই নেই আমার।/ তোমার বন্ধুরা?/ ওই শব্দের অর্থ আমি কখনো জানিনি।/ তোমার দেশ?/ জানি না কোন দ্রাঘিমায় তার অবস্থান।/ সৌন্দর্য?/ পারতাম বটে তাকে ভালোবাসতে—দেবী তিনি, অমরা।/ কাঞ্চন?/ ঘৃণা করি কাঞ্চন, যেমন তোমরা ঘৃণা করো ভগবানকে।/ বলো তবে, অদ্ভুত অচেনা মানুষ, কী ভালোবাসো তুমি?/ আমি ভালোবাসি মেঘ...চলিষ্ণু মেঘ...ঐ উঁচুতে... ঐ উঁচুতে.../ আমি ভালোবাসি আশ্চর্য মেঘ দল!’

বিদ্যুৎ-সংকটে পুরান ঢাকায় ঈদের ব্যবসায় মন্দা



আশীষ-উর-রহমান
পাইকারি দরে পোশাক নিতে চট্টগ্রাম থেকে গত মঙ্গলবার বিকেলে পুরান ঢাকার চকবাজারের লিজা ফ্যাশনে এসেছিলেন তিন খুচরা বিক্রেতা। এর আগে দুটি চালান নিয়ে গেছেন এখান থেকে। সেসব বিক্রি শেষ। তৃতীয় চালান নিতে এসে দেখলেন, মহাজনের ঘরেই মালামাল নেই। এর কারণ প্রচুর বিক্রি নয়। আসলে এবার চকবাজারসহ পুরান ঢাকার পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো পুরোদমে উৎপাদনই করতে পারেনি। কারণ, বিদ্যুতের সংকট।
লিজা ফ্যাশনের ব্যবস্থাপক মোক্তার হোসেন বললেন, ‘দিনের মধ্যে ছয় থেকে আট ঘণ্টার বেশি কারেন্ট থাকে না। বরাবর ঈদে যা উৎপাদন হয়, এবার তার অর্ধেকও হয়নি। আমরা তবু অন্য কারখানা থেকে কিছু মালামাল তৈরি করেছি। সমস্যা হলো কারিগরদের। তারা চুক্তির ভিত্তিতে কাজ করে। আমাদের যেসব কারিগর ঈদের মৌসুমে কাজ করে ৩০-৪০ হাজার টাকা নিয়ে বাড়ি যেত, এবার তাদের হাতে পাঁচ হাজার টাকাও নেই।’
চকবাজার, উর্দু রোড, পাটুয়াটুলী এলাকার পোশাকের পাইকারি বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বিদ্যুতের সংকট এবার তাঁদের ঈদের ব্যবসায় প্রায় বিপর্যয় ঘটিয়ে দিয়েছে। ঈদ মৌসুমেই সারা বছরের মূল বেচাকেনা চলে। অথচ এবার বিদ্যুত্সংকটের কারণে তাঁরা স্বাভাবিক উৎপাদনও করতে পারেননি।
উর্দু রোডের নওশীন কালেকশন তৈরি করে শার্ট। তাদের তৈরি শার্টের পাইকারি দাম ৪০০ থেকে ১৩৫০ টাকার মধ্যে। প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক সিরাজুল ইসলাম জানালেন, দেশি ও বিদেশি কাপড় দিয়ে তাঁরা নিজেদের কারখানাতেই শার্ট তৈরি করেন। আগে তাঁদের কারখানায় ছিল ফুটমেশিন। এখন সব কারখানাতেই বিদ্যুত্চালিত সেলাই মেশিন ব্যবহূত হচ্ছে। সকাল ১০টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত কারখানায় কাজ চলে। এর মধ্যে কয়েক দফায় মাত্র ঘণ্টা চারেক বিদ্যুৎ থাকে। এ কারণে পুরোদমে উৎপাদন করতে পারেননি তাঁরা।
একই কথা বললেন ড্রেস কুইন গার্মেন্টসের ব্যবস্থাপক বেল্লাল হোসেন। তাঁরা তৈরি করেন মেয়েদের পোশাক। এখানে বাচ্চাদের পোশাকের পাইকারি দাম ১৫০ থেকে ৭০০ টাকা এবং বড়দের থ্রিপিস ৭০০ থেকে ১৫০০ টাকার মধ্যে। পাইকারি বাজারে সাধারণত শবে বরাতের পর থেকে ১৫ রমজান পর্যন্ত বেচাকেনা বেশি চলে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় যায় তাঁদের মালামাল।
লিজা ফ্যাশনের মোক্তার হোসেন বললেন, বিদ্যুতের সমস্যায় কেবল যে উৎপাদন কম হয়েছে তা নয়, পোশাকের দামও বেড়েছে। বিদ্যুতের সংকটে বস্ত্র উৎপাদকেরাও স্বাভাবিক উৎপাদন করতে পারেননি। এ কারণে পোশাক প্রস্তুতকারকেরা প্রয়োজনীয় দেশি বস্ত্রের জোগান পাননি। পোশাক তৈরির জন্য বস্ত্র আমদানি করতে হয়েছে। এতে খরচ বেশি পড়েছে। উপরন্তু নিজেদের কারখানায় উৎপাদন কমে যাওয়ায় ঘাটতি পোষাতে অন্য কারখানা থেকে তাঁদের বেশি মজুরি দিয়ে পোশাক তৈরি করিয়ে নিতে হয়েছে। এসব কারণে এবার পাইকারিতে পোশাকের দাম বেশি পড়েছে, বিক্রিও কমেছে। এর প্রভাব পড়েছে খুচরা বিক্রির ক্ষেত্রে। তাই ঈদের নতুন পোশাক কিনতে ক্রেতাদের বাড়তি টাকা খরচ করতে হচ্ছে।
এসবের মধ্যেও নামকরা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিক্রির পরিমাণ বেশ ভালো। উর্দু রোডের শার্ট প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ওয়ানম্যানের স্বত্বাধিকারী শফিউল আলম জানালেন, সারা দেশেই তাঁদের পোশাকের সুনাম রয়েছে। বিক্রিও ভালো। তবে তাঁরা পড়েছেন অন্য সমস্যায়। অনেকেই তাঁদের পোশাকের নকল করছে। পুরান ঢাকার লেবেল তৈরির প্রতিষ্ঠান থেকে নকল লেবেল তৈরি করে অনেকে ওয়ানম্যানের নাম দিয়ে সেসব নকল পোশাক চালিয়ে দিচ্ছে। এই নকলকারীদের প্রতিরোধ করার কোনো ব্যবস্থা নেই। তিনি বললেন, ‘অনেকেই বিদেশি নামকরা প্রতিষ্ঠানের লেবেল নকল করে পোশাক তৈরি করে বিক্রি করছে। আমরা সে পথে না গিয়ে ব্যবসার ঝুঁকি নিয়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠানের নামেই শার্ট তৈরি শুরু করি। আমরা সফলও হয়েছি। ইচ্ছা ছিল শার্টের পাশাপাশি টি-শার্ট এবং অন্যান্য পোশাক তৈরি করার। কিন্তু নকলবাজদের কারণে তা করতে পারছি না।’
ঈদের এখনো এক সপ্তাহেরও বেশি বাকি। চকবাজার, উর্দু রোড ও এর আশপাশের পাইকারি পোশাকের বাজারে এখন বেচাকেনা তেমন নেই বললেই চলে। অধিকাংশ দোকান ফাঁকা। প্রতিবছর ২০ রোজার পরেও দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে খুচরা বিক্রেতারা মালামাল নিতে আসেন। খুচরাও বিক্রি হয় কিছু কিছু। এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। উৎপাদনই ব্যাহত হয়েছে বিদ্যুতের সংকটে। ব্যবসায়ীরা তাই খুব একটা প্রসন্ন নন। ঈদের মন্দা ব্যবসার ঘাটতি সারা বছর কেমন করে পুষিয়ে নেবেন, সেই ভাবনাই তাঁদের ঈদের আনন্দ ফিকে করে দিয়েছে।

দিনভর সন্ধ্যার আয়োজন


ইফতার


আশীষ-উর-রহমান
এক বছর পর আবার ফিরে এল সেই চেনা দৃশ্য। সকাল থেকেই হোটেল-রেস্তোরাঁ, ফুটপাতের চায়ের দোকানগুলোর ঝাঁপ বন্ধ, নয়তো পর্দা দিয়ে ঘেরা। দেখা যায়নি খানাপিনা করতে, কিংবা প্রকাশ্যে ধূমপান। সংযত সবাই। বাড়িতেও নিত্যদিনের রুটিনের পরিবর্তন। সকালে চা-নাশতার পর্ব নেই। চাকরিজীবীরা প্রাতরাশ না করেই কর্মস্থলমুখী হয়েছিলেন গতকাল বৃহস্পতিবার। পবিত্র মাহে রমজান প্রথম দিন থেকেই বদলে দিয়েছে মানুষের প্রতিদিনের অভ্যস্ত জীবনযাত্রা। সারা দিন পানাহারে বিরত থেকে, আত্মসংযমের সাধনার মধ্য দিয়ে পরম করুণাময় মহান আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি লাভের আশায় রোজা রাখা শুরু করেছেন ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা।
কখনো রোদ, কখনো বৃষ্টি-এই ছিল গতকাল সারা বেলা। পথ কাদাপানিতে একাকার। তবে মেঘমেদুর আবহাওয়া সহায়ক হয়েছিল সিয়াম সাধনার জন্য। বিকেলের দিকে অবশ্য আকাশ বেশ পরিষ্কার হয়ে এসেছিল। সেই সুযোগে বসে গিয়েছিল ঐতিহ্যবাহী ইফতারির পসরা। হোটেলের সামনে, পাড়ার মোড়ে, বাজারগুলোর পথের ধারে, নামজাদা বিপণিবিতানগুলোর সামনে, বাণিজ্যিক এলাকার ফুটপাতে—একরকম সারা শহরই যেন হয়ে উঠেছিল ইফতারির বাজার। টেবিল পেতে তার ওপর লালসালু দিয়ে ঢাকা ঝুরিভরা পেঁয়াজু, বেগুনি, ছোলা, ঘুগনি, জিলাপিসহ হরেক রকমের উপকরণ সাজিয়ে শুরু হয়ে যায় বেচাকেনার পালা। মাগরিবের আজানের আগেই পসরা শূন্য।
বিক্রেতারা জানালেন, ইফতারির পদগুলোর দাম না বাড়ানোরই চেষ্টা করেছেন তাঁরা। বেইলি রোডে ফখরুদ্দিন ফুডস প্রায় অর্ধশত পদ নিয়ে বসেছে ইফতারি বাজার। প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হাজি মোহাম্মদ রফিক জানালেন, ইফতারির পদগুলোর দাম গত বছরের মতোই আছে। তাঁদের ইফতারের খাবারে লাভের বিষয়টি প্রাধান্য পায় না। বরং সারা দিন রোজা রেখে মুসল্লিরা যেন তৃপ্তির সঙ্গে প্রিয় পদগুলো দিয়ে ইফতার করতে পারেন, সে ব্যাপারেই তাঁরা সচেষ্ট থাকেন। 
এখানে খাসির হালিম বড় বাটি বিক্রি হয়েছে ৩৫০ টাকা, ছোট ১০০ টাকা এবং মুরগির হালিম বড় বাটি ৫০০ টাকায়। জিলাপি বড় ১৫০ টাকা কেজি, গরুর চাপ ৪০০ টাকা কেজি, খাসির চাপ ৫০০ টাকা কেজি। খাসির কাচ্চি বড় বাক্স ২০০ টাকা, তেহারি বড় বাক্স ১৪০ টাকা। আস্ত মুরগির রোস্ট ৩০০ টাকা ও খাসির আস্ত পায়ের রোস্ট ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
ইফতারি কিনতে আসা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের চাকুরে সফিউদ্দিন আহমেদ বললেন, ‘এদের হালিম অনেক দিন থেকেই কিনি। প্রথম রোজায় মূলত হালিম কিনতেই এসেছি। দাম গতবারের মতোই আছে। মাংসের কিছু কিছু জিনিসের দাম মনে হচ্ছে একটু যেন বেড়েছে।’ তাঁর মতো অনেকেই প্রথম রোজার ইফতারির জন্য প্রিয় পদগুলো সংগ্রহ করতে পছন্দের ইফতারির দোকানে এসেছিলেন।
পুরান ঢাকার চকবাজারেও বরাবরের মতো দুপুর থেকে চকশাহী মসজিদের সামনের রাস্তাজুড়ে বসেছিল ঐতিহ্যবাহী ইফতারির বাজার। এখানে আস্ত খাসির রোস্টসহ সুতি, মুঠিয়া, জালি, শিক, বঁটি, রেশমি কাবাব, সমুচা, চপ, শিঙাড়া আর ঘুগনি, ছোলা-পেঁয়াজু-জিলাপির মতো হরেক রকমের ইফতারির পদের বৈচিত্র্যময় সমারোহে জমজমাট হয়ে উঠেছিল বাজার। তবে কাবাব, রোস্ট কেনার সামর্থ্য সবার নেই। তাই বেশির ভাগ স্বল্প আয়ের মানুষেরই ভরসা মুড়ি-ছোলা-পেঁয়াজু। তাই দিয়েই সেরে নিয়েছেন তাঁরা প্রথম রোজার ইফতার।
যানজট ঢাকা শহরে নতুন কিছু নয়। তবে গতকাল এতেও পরিবর্তন লক্ষণীয় ছিল। দুপুরের পর থেকেই বেড়ে উঠেছিল যানজট, সন্ধ্যার আগে তো প্রচণ্ড। প্রথম রোজার দিনে অধিকাংশ রোজাদারই চেষ্টা করেছেন বাড়ি ফিরে পরিবার-পরিজনের সঙ্গে একত্রে ইফতার করতে। সে কারণে ভিড়ভাট্টাও বেড়েছিল যানবাহনে। তবে ইফতারের আগের মুহূর্তে বেশ ফাঁকা হয়ে আসে পথের জটলা।
রোজার মাসে বদলেছে ঘর-গেরস্তালির কাজকর্মের চিরাচরিত ধারাও। রান্নাঘরে গৃহিণীদের কর্মব্যস্ততা শুরু হয়েছে দুুপুরের পর থেকেই। সাধ্যমতো ভালো খাবারের আয়োজন করতে চেষ্টা করেছেন সবাই। ইফতারির নানা পদ, রাতের খাবার, সেহিরর আয়োজন—এসব সম্পন্ন করতেই ঘনিয়ে এসেছে সন্ধ্যা। তারপর পরিবারের সবাই মিলে একত্রে খাদ্যপানীয় নিয়ে টেবিলে বসা।
সংযমের মধ্য দিয়ে আত্মশুদ্ধির আহ্বান নিয়ে এসেছে পবিত্র মাহে রমজান। সেই সাধনা জীবনের সর্বক্ষেত্রে সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ বয়ে আনুক—এই প্রার্থনাও ছিল রমজানের প্রথম দিনটিতে।

ঢাকা আজ থেকে বাংলা সুবার রাজধানী

আশীষ-উর-রহমান
রাতারাতি বদলে গেল ঢাকার নসিব। এ যেন মেঘ না চাইতেই বর্ষণেরও অধিক। মোগল সাম্রাজ্যের প্রান্তবর্তী বাংলা সুবার রাজধানীর মর্যাদায় আসীন হলো বঙ্গতিলোত্তমা ঢাকা নগরী। তবে এখন থেকে এর নাম হবে জাহাঙ্গীরনগর। বাংলা সুবার ভূতপূর্ব সুবাদার জাহাঙ্গীর কুলি খান অকস্মাত্ ইন্তেকাল করায় শেখ আলাউদ্দীন ইসলাম খান চিশতির ওপর এই সুবার দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছিল। নানাবিধ সংঘাত-ব্যাঘাতে যাত্রাপথে নতুন সুবাদারের দুই বছর বিলম্ব হয়। অবশেষে রাজকীয় নৌবহরে করে অজস্র অমাত্য ও সৈন্যসামন্তসহ সুবাদার ইসলাম খান ঢাকায় এসে পৌঁছেছেন। সুবাদারের সম্মানার্থে তিনি পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত উল্লসিত জনতা জায়গাটির নাম ইসলামপুর বলে ঘোষণা করে। ঢাকায় পদার্পণের সময় সুবাদার অবস্থান করছিলেন তাঁর শাহি বজরা চাঁদনীতে, আর তাঁর জেনানারা ছিলেন আরেক শাহি বজরা ফতেহ্ দরিয়ায়।
অমিত পরাক্রমশালী দিল্লির মসনদের জ্যোতিষ্ক মহামান্য শাহানশাহ্ নূরুদ্দীন মুহাম্মদ জাহাঙ্গীরের সুযোগ্য সিপাহ্সালার ও সুবাদার ইসলাম খান চিশতি ঢাকায় পৌঁছেই একে বাংলা সুবার রাজধানী ঘোষণা করেছেন। তাঁর এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বাংলার রাজধানী হিসেবে রাজমহলের এত দিনের গৌরব লুপ্ত হলো। মহামান্য শাহেনশাহের প্রতি পরম কৃতজ্ঞতার নিদর্শন হিসেবে ও তাঁর মহান স্মৃতি চিরভাস্বর করে রাখার উদ্দেশ্যে তিনি ঢাকার নতুন নাম রেখেছেন। বাংলার রাজধানী এখন থেকে অভিহিত হবে জাহাঙ্গীরনগর বা জাহাঙ্গীরাবাদ নামে। এই অবিস্মরণীয় ঘটনায় বিশ্ব ইতিহাসে এই শহরের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ হওয়ার পরম সুযোগ সৃষ্টি হলো। এতে এই জনপদ ও জনসাধারণের ভাগ্য উন্নয়নেরও বিপুল সৌভাগ্যের সূচনা ঘটল বলে সমঝদারেরা মন্তব্য করছেন।
দিল্লির মহামহিম শাহানশাহ্র অতিবিশ্বস্ত ও অমিতবিক্রম সুবাদার ইসলাম খান চিশতি ঢাকাকে রাজধানী হিসেবে এলান করার পর আনন্দে আত্মহারা জনসাধারণকে আশ্বাস দিয়ে বলেছেন, দূতমারফত তিনি অতি দ্রুত ঢাকাকে রাজধানী ঘোষণার খবর দিল্লিতে মোগল দরবারে পাঠাবেন। একই সঙ্গে এই শহরকে মোগল সাম্রাজ্য তথা সারা দুনিয়ার একটি শ্রেষ্ঠ শহর হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ন্যায়বিচারক ও উদারহূদয় শাহানশাহেক বিশেষ বদান্যতা ও অনুগ্রহ দেখিয়ে স্বীয় কীর্তি অক্ষুণ্ন রাখার জন্য শাহি ফরমান জারির সুপারিশ করবেন। সুবাদার তাঁর শাহি বজরা চান্দনীতে বসে উপস্থিত ঢাকাবাসী জনতার উদ্দেশে ভাষণ দিচ্ছিলেন।
উপস্থিত জনতার বিপুল উল্লাসের মধ্যে বিজ্ঞ সুবাদার জানান, বহুকাল আগে থেকেই প্রজাহিতৈষী মহামান্য শাহানশাহ্ ও তাঁর সুযোগ্য সহধর্মিণী মহামান্যা সম্রাজ্ঞী নূরজাহান ঢাকার অতুলনীয় মসলিন বস্ত্রের গভীর অনুরাগী বলে এই শহরের পরিচয় তাঁরা ভালোমতোই জানা। তাই তাঁর নামাঙ্কিত এই শহরের যথাবিহিত উন্নয়নে ভারতরাজ সানন্দে তাঁর সম্মতি দেবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
দীর্ঘ পথযাত্রার শ্রমে ও যাত্রাপথে নানা যুদ্ধবিগ্রহে শ্রান্ত সুবাদার তাঁর সংক্ষিপ্ত ভাষণে ঢাকাবাসীকে বরাভয় দিয়ে বলেন, অত্যাচারী মগ, বর্গি ও পর্তুগিজ দস্যুদের বাংলার মাটি থেকে চিরতরে বিতাড়িত করা হবে। জনসাধারণের জানমালের নিরাপত্তা রক্ষায় তিনি প্রভূত সমরশক্তি প্রয়োগ করবেন। দস্যুরা আর কোনো ব্যক্তিকে বলপূর্বক অপহরণ করে দাস হিসেবে বিক্রি করতে পারবে না। বঙ্গবাসী এখন থেকে নিঃশঙ্কচিত্তে চলাফেরা, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং সুখনিদ্রায় রজনী অতিবাহিত করতে পারবেন।
সুবাদারের এই অভয়বাণী উপস্থিত জনতার মধ্যে সঞ্জীবনী শক্তি সঞ্চার করে। বিপুল হর্ষধ্বনি ও গগনবিদারী ঢাকের বাদ্যে তারা পরিবেশ প্রকম্পিত করে তোলে। গ্রীষ্মের পড়ন্ত বেলায় অস্তাচলগামী সূর্য জনতার সেই উল্লাসের ঐতিহাসিক সাক্ষী হয়ে রইল। 
সুবাদার বলেন, জনতার আনন্দ উদ্দীপনায় তিনি প্রসন্ন ও অনুপ্রাণিত বোধ করছেন। অতিশীঘ্র রাজধানীর বহুবিধ উন্নয়নের কর্মযজ্ঞ সূচিত হবে বলে তিনি সবাইকে আশ্বাস দেন। তাত্ক্ষণিকভাবে তিনি শহরের সীমানা চিহ্নিত করার জন্য ঢাকীদের সজোরে বাদন করতে এবং সেই শব্দ অনুসরণ করে অশ্বপৃষ্ঠে চড়ে তিনজন ঘোড়সওয়ারকে পূর্ব, পশ্চিম ও উত্তর দিকে ধাবিত হতে নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, ঢাকের শব্দ যত দূর পর্যন্ত শ্রুতিগোচর হবে, সেখানে সেখানে স্তম্ভ বসিয়ে নয়া রাজধানীর সীমানা সে অবধি বলে নির্ধারণ করা হবে।
বর্মে সুরক্ষিত ঢাল, খঞ্জর ও বর্শাধারী মোগল ঘোড়সওয়ারেরা বিদ্যুদ্বেগে ধাবিত হলে সেই অভিনব দৃশ্যে জনতা উল্লাসে ফেটে পড়ে। উদ্দীপ্ত ঢাকীরা সর্বশক্তিতে ঢাকে কাঠির প্রহার অব্যাহত রাখে। এই অভূতপূর্ব ঢাকবাদ্যের মধ্য দিয়ে বাংলা সুবার নতুন রাজধানী জাহাঙ্গীরনগরের অভিষেক সুসম্পন্ন হয়। সুবাদার রাজধানীবাসীর সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল ও সহযোগিতা কামনা করে পুনরায় নতুন রাজধানীকে তিলোত্তমায় রূপায়িত করার আশ্বাস দিয়ে তাঁর শাহি বজরায় আরোহণ করেন।

সুবাদার যেভাবে ঢাকায় এলেন


নতুন দায়িত্ব নিয়ে দিল্লি থেকে ঢাকা ভ্রমণের চমকপ্রদ ঘটনাবলির স্মৃতি নিয়ে একটি কিতাব রচনা করছেন ঢাকায় আসা মোগল বাহিনীর অন্যতম সিপাহসালার আলাউদ্দীন ইস্পাহানি ওরফে মির্জা নাথান। তাতে ঢাকাবাসের অভিজ্ঞতাও লিপিবদ্ধ করা হবে। প্রথম আলোর প্রতিনিধির সঙ্গে এক অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায় মুগ্ধ সিপাহসালার হূদয়ের মুগ্ধতা অকপটে ব্যক্ত করে বলেন, এমন স্বচ্ছতোয়া নদনদীবিধৌত, মনোরম বৃক্ষশোভিত ও পাখির কূজনমুখরিত মুলুক তিনি আগে কখনো দেখেননি। এ দেশে না এলে জীবনে একটি সুমধুর অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বঞ্চিত হতেন। ঢাকার অপার সৌন্দর্যে অভিভূত হওয়ার কারণেই তিনি তাঁর স্মৃতিধর্মী কিতাবটিতে ঢাকার অভিজ্ঞতা অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
যুবক সিপাহসালার মির্জা নাথান সুবাদার শেখ আলাউদ্দীন ইসলাম খান চিশতির প্রধান নৌ-অধিকর্তা মির-ই-বহর ইহতিমাম খানের পুত্র। তিনি ঢাকায় তশরিফ রেখেছেন পিতার সঙ্গে যৌথভাবে সুবা বাংলার রাজকীয় নৌবহরের দায়িত্ব নিয়ে। বীর যোদ্ধা মির্জা নাথান নানা যুদ্ধে প্রবল পরাক্রম প্রদর্শন করে তরুণ বয়সেই মোগল সেনাবাহিনীর সুদক্ষ সিপাহসালার হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেন। উত্তর-পূর্ব ভারতে মোগল সাম্রাজ্য বিস্তারে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার জন্য মোগল শাহানশাহ্ নূরুদ্দীন মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর তাঁকে ‘সিতাব খান’ উপাধিতে সম্মানিত করেন। ইতিহাস ও সাহিত্যে অগাধ জ্ঞানের কারণেও তিনি দিল্লির বিদগ্ধ মহলে মশহুর। গতকাল তিনি প্রথম আলোর প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলেন।
সিপাহসালার মির্জা নাথান এ সাক্ষাত্কার দেন বেগ মুরাদ খানের দুর্গের ভেতরে নির্মিত এক আলিশান তাঁবুতে বসে। তাঁর ওপর পাকুড়তলীর পূর্ব-দক্ষিণ প্রান্তে এই দুর্গের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। বর্ষা মৌসুমে প্রচুর বৃষ্টিপাতের কারণে দুর্গের ভেতরের অংশ পানিতে সয়লাব হয়ে থাকা সত্ত্বেও তিনি তাঁবুতেই অবস্থান করছেন। রাজকীয় তাঁবুর সামনে পাতা খাটিয়ায় উপবেশন করে আখরোট কাঠের চৌপায়ায় রক্ষিত রেকাবি থেকে তিনি পেস্তা, কাজু ও খুবানির স্বাদ গ্রহণ করছিলেন। সাক্ষাত্কার নেওয়ার সময় সৈন্যদের মধ্যে দুর্গের ব্যবস্থাপনা বিষয়ে দারুণ ব্যস্ততা লক্ষ করা গেছে।
কোমল কবিমনের অধিকারী তরুণ সিপাহসালার বলেন, দিল্লি থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা দেওয়ার পরপরই তিনি ইতিমধ্যেই এক মহাকিতাব রচনা করতে শুরু করেছেন। এটি তিনি প্রচার করবেন গায়বি তখল্লুসে বা ছদ্মনামে। কিতাবটির নাম রাখবেন বাহারিস্তান-ই-গায়বি। কিতাবটির তাত্পর্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রথম আলোকে তিনি জানান, ‘দুনিয়ার শ্রেষ্ঠতম সুলতান নূরুদ্দীন মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরের সৌভাগ্যপূর্ণ রাজত্বকালে বাংলায় সংঘটিত ঘটনার সামান্য অংশও লিপিবদ্ধ করা হলে তা কালের পৃষ্ঠায় স্থায়ী হয়ে থাকবে। এই কিতাবের বিস্ময়কর সত্য কাহিনি থেকে দূরদর্শী ব্যক্তিরা অনেক জ্ঞান আহরণ করতে পারবেন।’ উচ্চাকাঙ্ক্ষী সিপাহসালারের বিশ্বাস, তাঁর এই মহাকিতাব একদিন বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস হবে। আবার পাঠকেরা এতে ধ্রুপদী সাহিত্যের স্বাদও পাবেন।’ তিনি বলেছেন, ‘কিতাবটি ভবিষ্যতেও বহু হাজার বছর পঠিত হবে।’
তাঁদের ঢাকা আসার প্রস্ততি কী ছিল সে ব্যাপারে জানতে চাইলে সিপাহসালার বলেন, ইসলাম খান চিশতিকে সুবাদার হিসেবে পাওয়ার পর বিরাট সৈন্যবাহিনী, হস্তিবাহিনী ও নৌবহর নিয়ে দ্রুত বাংলার পথে ধাবিত হন। প্রথমে তিনি যান সুবা বাংলার ইতিপূর্বেকার রাজধানী মুর্শিদাবাদের আকবরনগর বা রাজমহলে। সেখানে পৌঁছে সার্বিক অবস্থা পর্যালোচনা করে ইহতিমাম খানকে প্রধান নৌ-অধিকর্তা করে পাঠানোর জন্য শাহানশাহ্ জাহাঙ্গীরকে পত্র মারফত অনুরোধ জানান। একই সঙ্গে দুর্নীতিগ্রস্ত ও অযোগ্য পুরোনো কর্মকর্তাদের পদচ্যুত করে নতুন কিছু কর্মকর্তা নিয়োগের জন্য আরজি জানান। তাঁর আরজি রেখে শাহানশাহ্ জাহাঙ্গীর এক হাজার পদাতিক ও তিন শ অশ্বারোহী বাহিনীর দায়িত্ব দিয়ে ইহতিমাম খানকে মির-ই-বহর পদে এবং আবুল হাসানকে ‘মুতাকিদ খান’ উপাধি দিয়ে দেওয়ান পদে নিয়োগ দেন। বিদায়কালে শাহানশাহ্ ইহতিমাম খানকে আরও এক হাজার জাত ও সাত শ অশ্বারোহী সৈন্য দেন। ব্যক্তিগতভাবে উপহার দেন দামি পোশাক, একটি তলোয়ার ও একটি বিশেষ বন্দুক। এ ছাড়া শাহানশাহ্ তাঁদের মানসিংহের সৈন্যবাহিনী ও রোটাস দুর্গ থেকে আনা কামানগুলিও সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন।
দলবল নিয়ে ইহতিমাম খান এলাহাবাদ হাজির হন। তিনি সেখান থেকে ৩৩০টি গজ-নাল বা ছোট কামান, হাত-নাল বা বন্দুক ও শের-দাহান বা বাঘের মুখাকৃতির বড় কামান হস্তগত করেন। এর পর আরও নৌকাসহ বিশাল নৌবহর নিয়ে ঝাঁসিতে পৌঁছে তাঁবু ফেলেন। এখানে তিনি সাবেক দেওয়ান ওয়াজির খানের থেকে জলতরঙ্গ ও নাদুলা নামে দুটি রণতরী ও চারটি শোর-দাহান কামান সংগ্রহ করেন।
ঝাঁসি থেকে তিনি আসেন রাজমহল বা আকবরনগরে। সুবাদার ইসলাম খান, দেওয়ান মুতাকিদ খান ও বকশি খাজা তাহির মোহাম্মদ এখানে মির-ই-বহর ইহতিমাম খানকে স্বাগত জানান। মির্জা নাথান বলেন, ‘সুবাদার ও তাঁর সঙ্গীরা সুসজ্জিত অশ্বপৃষ্ঠে চড়ে মির-ই-বহরকে সংবর্ধনা জানাতে আসেন। মির-ই-বহর ইহতিমাম খানের কাছ থেকে সুবাদার তমিজের সঙ্গে শাহানশাহের পাঠানো শাহি ফরমান গ্রহণ করেন। মির-ই-বহর সঙ্গে আনা কামান থেকে তোপধ্বনি করতে বলেন। কামানের গগনবিদারী আওয়াজ ও ধোঁয়া জল-স্থল আচ্ছন্ন করে ফেলে। বিজয়ীদের তূর্যনিনাদে বিদ্রোহীরা মূর্ছা যায়।’ 
মির্জা নাথান বলেন, এর পর আকবরনগর থেকে সুবাদার ইসলাম খান ভাটির দিকে রওনা হলেও ইহতিমাম খান কৌশলগত কারণে পরে যাত্রা করার জন্য সেখানে থেকে যান। ঢাকায় যাত্রার আগে সুবাদার ইসলাম খান মির-ই-বহরের সৈন্যবাহিনী পরিদর্শন করেন। এ সময় তাঁর বাহিনীতে ছিল ২৯০টি রসদ ও ভারী কামান সজ্জিত নৌযান। জায়গির থেকে আগে পাঠানো ৫০০ অশ্বারোহী ও এক হাজার পদাতিক ছাড়াও সেখানে ছিল ৭৭০ জন সুসজ্জিত অশ্বারোহী সৈন্য, সমরকুশলী তিন হাজার পদাতিক, ৮০টি হাতি ও ৮০ জন অশ্বারোহী। বিশালাকার এই নৌবহর ও সেনাবাহিনী নিয়ে ঢাকায় পৌঁছাতে সুবাদারের প্রায় দুই বছর লেগে যায়।
ঢাকায় পৌঁছাতে সুবাদার ইসলাম খানের এত দীর্ঘ সময় লাগার কারণ সম্পর্কে মির্জা নাথান জানান, বিদ্রোহী জমিদার ও রাজাদের সঙ্গে সুবাদারকে পথে পথে যুদ্ধ করতে হয়েছে। আকবরনগর ত্যাগ করে সুবাদার ইসলাম খান গৌড়ে গিয়ে ছাউনি ফেলেন। এখানে তিনি বিদ্রোহী শামস খান ও সেলিম খানকে যুদ্ধে পরাস্ত করেন। সেখান থেকে আলাইপুর বা নওগাঁ পৌঁছে ভূষণা পরগনা বা ফরিদপুরের রাজা ছত্রাজিতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাঁকে সন্ধি স্থাপনে বাধ্য করেন। এখান থেকে তিনি যুদ্ধ করেন বীরভূমের জমিদার বীর হামির ও অন্য বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে। এর পর তিনি করতোয়া নদীপথে পাবনার চাটমহল বা চাটমোহরে হাজির হন। সেখান থেকে সবাই মিলে আত্রাই নদী বেয়ে পৌঁছান রাজশাহীর গুরুদাসপুর বা নাজিমপুরে। এখানে যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্য সুবাদারের সঙ্গে মোলাকাত করে মোগল বাহিনীকে সহায়তা দেওয়ার চুক্তি করেন।
তত দিনে প্রবল বর্ষা মৌসুম শুরু হয়ে যায়। ভাটি অঞ্চলে যাত্রা করা আর সুবিবেচনার কাজ হবে না ভেবে সুবাদার ঘোড়াঘাটে চলে এসে সেখানে ছাউনি করে ফেলেন। ঘোড়াঘাট থেকে সুবাদার উড়িষ্যার জগন্নাথ মন্দিরের লুণ্ঠনকারী রাজা কেশদাস মারুকে পরাস্ত ও শায়েস্তা করেন। এর পর বশ্যতা আদায় করেন কামরূপের রাজা লক্ষ্মীনারায়ণ ও পরীক্ষিতেরও।
ঘোড়াঘাট থেকে সুবাদার ভাটির দিকে যাত্রা শুরু করেন। শাহজাদপুরে এসে তিনি সেনা ও নৌবহর পরিদর্শন ও গণনা করেন। মুতাসদ্দিদের বা হিসাবরক্ষককে নির্দেশ দেন সমরশক্তির যথাযথ হিসাব তৈরি করে তাঁর কাছে দাখিল করতে। এর পর সুবাদার তাঁর শাহি বজরা চাঁদনিতে উঠে বসেন। তাঁর দুর্ভেদ্য দুর্গের মতো বিশাল শাহি বজরা ঢাকার পথে অগ্রসর হয়। 
মির্জা নাথান বলেন, মির-ই-বহর ইহতিমাম খানও পথে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর সুস্থ হয়ে উঠতে উঠতে বর্ষার একটি সম্পূর্ণ মৌসুম পেরিয়ে যায়। সোনাবাজুতে থাকার সময় অর্থসংকটের কারণে তাঁর মাঝিমাল্লারাও চলে গিয়েছিল। খাজা তাহির মোহাম্মদ বকশি আকবরনগর থেকে শাহানশাহ্র খাসজমির রাজস্ব বাবদ সাত লাখ টাকা নিয়ে এলে অর্থসংকট দূর হয়। তখন নতুন করে মাঝিমাল্লা সংগ্রহ করতে হয়। তা ছাড়া শাহজাদপুর হয়ে সোনাবাজু পরগনা বা পাবনা থেকে আসার পথে অনেক জায়গায় নদী সংকীর্ণ ছিল। শাহি নৌবাহিনীকে এগিয়ে আসার জন্য বেশ কিছু জায়গায় নদী ও সংযোগ খাল খনন করতে হয়। এসব তাঁদের যাত্রাপথে বিলম্ব ঘটিয়ে দেয়।
নদীপথে অসংখ্য বাঁক ঘুরে অত্যন্ত মন্থর গতিতে তাঁরা অগ্রসর হন। সুবাদারের বজরা সে তুলনায় দ্রুত এগিয়ে গিয়েছিল। পরে খাল যোগিনীর ত্রিমোহনায় তাঁদের সুবাদারের সঙ্গে সাক্ষাত্ হয়। সুবাদার তাঁর ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা তুকমাক খান, শেখ কামাল ও মিরাক বাহাদুরকে ছ’মঞ্জিল পথ পেরিয়ে একটি অগ্রবর্তী দল হিসেবে ঢাকায় যাওয়ার নির্দেশ দেন। ঢাকায় পৌঁছে ঢাকা কেল্লা মেরামতের জন্যও তাঁদের নির্দেশ দেওয়া হয়। সুবাদার তাঁদের সাহায্যার্থে শাহি নৌবহর ও গোলান্দাজ বাহিনী থেকে কুড়িটি রণতরী, এক হাজার বন্দুকধারী, ছোট-বড় ৫০টি কামান, এক শ মণ বারুদ ও এক শ মণ সিসা দ্রুত ঢাকা পাঠিয়ে দিতে ইহতিমাম খানকে আদেশ দেন। মির্জা নাথান বলেন, সুবাদারের ইচ্ছা ছিল অগ্রবর্তী বাহিনী পাঠিয়ে স্থানীয় বিদ্রোহীদের মনে ভয় ধরিয়ে দেওয়া।
ঢাকায় আসার পথে ইছামতী নদীর মোহনায় ডাকছাড়ে মসনদ-ই-আলা মুসা খান তাঁদের প্রতিরোধ করেন। প্রকৃতপক্ষে এখানেই সুবাদার সবচেয়ে বড় প্রতিরোধের মুখে পড়েন। প্রবল যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সুবাদার ইসলাম খান জয়ী হন। এসব সুসংবাদ পেয়ে মোগল শাহানশাহ্ জাহাঙ্গীর বিশেষ দূত মারফত প্রশংসাবাচক শাহি ফরমান ও উপহার পাঠান। সুবাদারকে পাঠানো হয় বিশেষ সম্মানজনক পশমি পোশাক, মুক্তাখচিত বন্দুক, এক জোড়া চিতাবাঘ, এক জোড়া ইরাকি ও তুর্কি ঘোড়া ও পাঁচ জোড়া আরবি ঘোড়া। দেওয়ান মুতাকিদ খান ও ইফতিখার খান পান সম্মানজনক পোশাক ও একটি করে ঘোড়া এবং মির-ই-বহর ইহতিমাম খান সম্মানজনক পোশাক ও সম্মানজনক টুপি। মির্জা নাথান জানান, তাঁর বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধ-পরিচালনায় মুগ্ধ হয়ে শাহানশাহ্ তাঁকে নিজের একটি বিশেষ প্রতিকৃতি উপহার দিয়েছেন। উল্লেখ্য, এই বিশেষ প্রতিকৃতি শাহানশাহ্র খাস শিষ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত স্বল্পসংখ্যক কর্মচারীই কেবল পেয়ে থাকেন।
এর পর সুবাদার ইসলাম খান তাঁর দেওয়ান, বকশি ও অন্য কর্মচারীদের নিয়ে নিশ্চিন্ত মনে ঢাকায় প্রবেশ করেন।

মসলিন তদারকির জন্য বিশেষ ব্যবস্থা


মসলিন বস্ত্রের উত্পাদন, তদারকি ও উত্কর্ষ বিধানের জন্য মোগল প্রশাসন সরাসরি ভূমিকা রাখার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। সুবা বাংলার নতুন রাজধানীর প্রশাসনিক দপ্তরের নির্ভরযোগ্য সূত্রের এক তথ্যে জানা গেছে, অচিরেই এ কাজ দেখাশোনার জন্য একটি সরকারি পদ সৃষ্টি করা হবে।
উল্লেখ্য, একমাত্র বঙ্গদেশেই জগদ্বিখ্যাত মসলিন বস্ত্র উত্পাদিত হয়ে থাকে। বহু প্রাচীনকাল থেকে এই দেশের তন্তুবায়েরা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে উত্তম কার্পাস থেকে মিহি তন্তু উত্পাদন করে সুতিবস্ত্র বয়ন করে আসছেন। এর মধ্যে মসলিন বস্ত্র তার সূক্ষ্মতা ও নান্দনিকতায় বিশ্বের বিস্ময়ে পরিণত হয়েছে। মশহুর কলমচিরা লিখেছেন, ঈসা নবীর জন্মের প্রথম শতাব্দীকাল থেকেই বঙ্গদেশে বয়নশিল্প গড়ে উঠেছিল। বংশপরম্পরায় অর্জিত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এই শিল্প দ্রুত উত্কর্ষ লাভ করে। ঢাকা, সোনারগাঁও, ধামরাই, তিতাবাদি, জঙ্গলবাড়ি ও বাজিতপুরের তন্তুবায়েরা মসলিন বস্ত্রের উত্কর্ষে অনন্য সিদ্ধি লাভ করেন।
বর্তমানে মোটা বস্ত্রের পাশাপাশি বেশ কয়েক প্রকারের মসলিন বস্ত্র উত্পাদিত হচ্ছে। উত্তম শ্রেণীর মসলিন বস্ত্রের মধ্যে আছে মলমল, তানজেব, আব-ই-রওয়াঁ, নয়নসুখ, চিকন, চারকোনা, শবনম, জঙ্গলবাড়ি থেকে উত্পাদিত জংলি খাসসা, ডোরিয়া, বুটি, ফুল আঁকা জামদানি। এ ছাড়া কাজহাজী, বাফতে কাজহাজী, সরবুটি, মাহমুদিয়াতি, সরবন্দ, তারাবন্দ, হাম্মাম, সরহন্দকোনা প্রভৃতি নামের মসলিনও উত্পাদিত হচ্ছে।
মুতাকিদ খাঁ উপাধিপ্রাপ্ত রাজস্ব মন্ত্রকের দায়িত্বপ্রাপ্ত সুবাদারের দেওয়ান আবুল হাসান প্রথম আলোকে জানান, সর্বোত্কৃষ্ট শ্রেণীর মসলিন কেবল দিল্লির সম্রাট ও তাঁর পরিবারের জন্য সংরক্ষিত করা হয়েছে। এই শ্রেণীর মসলিনকে চিহ্নিত করা হয়েছে মালবুস খাস নামে। এর পরপরই যে মসলিনটি উত্কৃষ্ট, তার নাম হবে সরকার-ই-আলী। এ মসলিন ব্যবহার করবেন সুবাদার ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা। এই উভয় প্রকারের মসলিনের বাণিজ্যিক বিপণন নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
সংরক্ষিত এই উভয় প্রকার মসলিনের তদারক করার জন্য দারোগা-ই-মালবুস খাস নামে দ্রুত একটি সরকারি পদ সৃষ্টি করা হচ্ছে। তাঁর অধীনে কয়েকজন তদারককারী থাকবেন। দারোগা-ই-মালবুস খাস উত্কৃষ্ট মসলিন তাঁতিদের উত্পাদনের তত্ত্বাবধান করবেন। তিনি বস্ত্রের মান উন্নয়নে প্রয়োজনীয় সকল সহায়তা দেবেন ও উত্পাদিত বস্ত্র সংরক্ষণ করবেন।
অদূর ভবিষ্যতে মালবুস খাস কুঠি নামে একটি স্বতন্ত্র উত্পাদনকেন্দ্র স্থাপন করা হবে বলেও জানা গেছে। এই কুঠি হবে মূলত সরকার-নিয়ন্ত্রিত কারখানা। এখানে মোগলসম্রাট ও তাঁর পরিবারের জন্য মালবুস খাস মসলিন উত্পাদন করা হবে।

দোলাই নদীর পরিবেশ দুর্বিষহ


ঢাকাকে সুবা বাংলার রাজধানী ঘোষণা করার পর মানুষ যখন আনন্দ উদ্যাপন করছে, দোলাই নদীসংলগ্ন এলাকার বসতিগুলিতে মানুষজন তখন অতিষ্ঠ হয়ে দিন যাপন করছে। পরিত্যক্ত নানা বর্জ্য, গবাদিপশুর মৃতদেহসহ নানা দূষিত পদার্থে দোলাই নদীর পরিবেশ সম্প্রতি সঙ্গিন হয়ে উঠেছে।
ঢাকার জন্য দোলাই নদীর প্রবাহ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শুকনো মৌসুমে নদীর অববাহিকায়, বিশেষত নগরীর ওই পারের রবিশস্য এই নদীর পানির ওপর অনেকটা নির্ভরশীল। বর্ষা মৌসুমে মাঝে মাঝে অতিবৃষ্টিতে বন্যার আশঙ্কা দেখা দেয়। তখন এ নদীই বুড়িগঙ্গা থেকে অতিরিক্ত পানি টেনে নিয়ে গিয়ে নগরীকে রক্ষা করে। এ ছাড়া বিদেশি বণিক ও পর্যটকদের অনেকে ঢাকায় প্রবেশের জন্য একে ব্যবহার করে বলে এই নগরীতে বুড়িগঙ্গার পরপরই দোলাই নদীর গুরুত্ব ও মর্যাদা। 
গতকাল সরেজমিনে শহরের দোলাই নদী পরিদর্শন করতে গিয়ে দেখা গেছে, নদী দিয়ে বেশ কয়েকটি গবাদিপশুর পচা মৃতদেহ ভেসে যাচ্ছে। স্থানে স্থানে পাড়ের কাছে ঝুলে পড়া গাছের ডাল আর লতাগুল্মে আটকে পড়ে অসহনীয় গন্ধ ছড়াচ্ছে। নদীর তীরবর্তী বাসিন্দা অমর শীল জানিয়েছেন, এ নদীতে মাঝে মাঝে মানুষের লাশও ভেসে যেতে দেখা যায়। বিশেষত, হিন্দুসম্প্রদায়ের কোনো কোনো বর্ণের লোক সর্পদংশনে বা অপঘাতে মৃত্যুমুখে পতিত হলে সেই সব শবদেহ আর দাহ না করে কলাগাছের ভেলায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়। সেই শবদেহগুলিও একসময় পচে-গলে পরিবেশের ওপর হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।
গত কয়েক বছরে দোলাই নদীর দুই পারে জনবসতি বেড়েছে। কিন্তু বাসিন্দাদের ভালো কোনো পয়োনিষ্কাশনের বন্দোবস্ত নেই। দুই পারের অসংখ্য মানুষ প্রাতঃকৃত্যের কাজে এ নদীকে ব্যবহার করছে। অনেকে নগরীর পরিবেশ-পরিস্থিতির কোনো তোয়াক্কা না করে নদীর পাড়ে পায়খানা বানিয়েছে। এ ছাড়া বসতিগুলির অন্যান্য বর্জ্যও সরাসরি নদীতে এসে পড়ছে।
উল্লেখ্য, স্থানীয় জমিদার ও আশরাফ শ্রেণীর বড় বড় পরিবার নিজস্ব ইঁদারার মাধ্যমে পানীয় জলের চাহিদা মেটায়। কিন্তু আমজনতা তাঁদের ইঁদারা ব্যবহার করতে পারে না বলে এ অঞ্চলের মানুষের একটি বড় অংশের পানির প্রধান উত্স দোলাই নদী। নদীর প্রতি এ অবহেলা অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে এখানে পানীয় জলের তীব্র সংকট দেখা দেবে। বিদেশ থেকে আগত ব্যক্তিদের কাছেও ঢাকা নগরীর মর্যাদা ক্ষুণ্ন হবে। দুনিয়াজুড়ে ঢাকা নগরীর যে সুনাম রয়েছে, তা ভূলুণ্ঠিত হবে।
এলাকার মানুষেরা আশা করছে, মোগল শাহানশাহ্র প্রতিনিধি এখন ঢাকার দায়িত্ব নিয়েছেন। তিনি নিশ্চয়ই ঢাকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ দোলাই নদীর পরিবেশের উন্নয়নে আশু পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।

শাহি বজরায় দিলখোশ মুজরা


গতকাল সন্ধ্যার পর চাঁদনীঘাটের শাহি বজরা চাঁদনীতে কাঞ্চনীদের মুজরা বসেছিল। ঢাকায় আসার দীর্ঘ পথশ্রমের রংদার সেই মেহফিলে সুবাদার ইসলাম খান চিশতি তাঁর মনের শ্রান্তি দূর করেন। বাংলার ভূঁইয়াদের দমনে ব্যস্ত সুবাদার ও তাঁর আমির-ওমরাহ্, দেওয়ান-বকশি ও সিপাহসালারেরা অসংখ্য যুদ্ধবিগ্রহ ও দীর্ঘ যাত্রা শেষে ঢাকায় এসে পদার্পণ করেন। যাত্রা সফলভাবে সমাপ্ত হওয়ায় দিলখোশ সুবাদার তাঁর ঊর্ধ্বতন প্রশাসনিক ও সামরিক কর্মকর্তাদের সম্মানে এ মুজরার আয়োজন করেন। মেহফিলে দেওয়ান, ওমরাহ্, কাজিসহ উচ্চপদস্থ সব রাজকর্মচারী উপস্থিত ছিলেন। ঢাকার কয়েকজন জমিদার ও বড় বণিককেও সে আসরে দাওয়াত করা হয়েছিল।
মেহফিলের জন্য শাহি বজরা সুগন্ধি ফুল ও রঙিন ঝালর দিয়ে সজ্জিত করা হয়। লাল ও সাদা রঙের ফরাস বিছিয়ে ঢেকে দেওয়া হয় পুরো দরবার। পুরো দরবার আলোকিত করা হয় ঘি দিয়ে প্রজ্বলিত ঝাড়লণ্ঠনে। গোলাপ পানি ও আতরের খুশবুতে দরবার ম-ম করছিল।
সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে গণ্যমান্য মেহমানেরা মজলিসে আসতে শুরু করেন। কিছুক্ষণ পর দরবারে সুবাদার তশরিফ রাখলে সব রাজ অতিথি ও ওমরাহ্ তাঁকে দাঁড়িয়ে কুর্নিশ করেন। সবাই উপবেশন করলে আরম্ভ হয় মনমাতানো মুজরা। মেহফিলে গানবাদ্য পরিবেশন করেন দিল্লি থেকে আসা মশহুর ওস্তাদ গিরগিট খান ও ওস্তাদ খুসরো। বিভিন্ন খোশগল্পের মধ্যে বাঈজিরা ঝলমলে সাজে ও চোখ-ধাঁধানো পোশাকে সজ্জিত হয়ে নাচ প্রদর্শন করেন। তাঁরা যে পারদর্শিতা দেখান তাতে উপস্থিত আমির-ওমরাহ্রা ‘মারহাবা’ ‘মারহাবা’ বলে উচ্ছ্বসিত হয়ে প্রশংসা করেন এবং রৌপ্যমুদ্রা ও অলংকার ছুড়ে ছুড়ে উপহার দেন। লক্ষেৗর গুলবদন বাঈ ও দিল্লির রওশন আরা বাঈয়ের নাচে সবাই বেচৈন হয়ে পড়েন। উল্লেখ্য, সুবাদারের বহরের সঙ্গে প্রায় এক হাজার ২০০ জন কাঞ্চনী ঢাকায় এসেছেন বলে একটি সূত্র জানিয়েছে।
খুশবুদার এই মেহফিল রাত দুই ঘটিকা পর্যন্ত গুলজার থাকে। বিদায় নেওয়ার আগে এই মেহফিল আয়োজনের জন্য সবাই সুবাদারকে শুকরিয়া জানান।

রংদার বিকেলে বুড়িগঙ্গার তীরে

সাজ্জাদ শরিফ
বুড়িগঙ্গা নদীর দিকে মুখ করে দাঁড়ালে দৃশ্যপট সেই আগেরই মতো। নদীর স্বচ্ছ টলটলে স্রোতোধারা বয়ে চলেছে অবিরাম। ওপারে যত দূর চোখ যায়, ধানখেতের অবিশ্রাম সবুজ ঢেউ মন জুড়িয়ে দেয়। খটকা লাগে কেবল নদীর বুকে নানা কিসিমের নৌকার অত্যধিক আগমন দেখে। সে খটকা দূর করতে হলে নদীর দিকে পেছন ফিরে পারের দিকে তাকাতে হয়। গত দু-তিন দিনে ভোজবাজির মতো বদলে গেছে বুড়িগঙ্গার পার। বাংলার নতুন সুবাদার আলিশান বহর নিয়ে ঢাকায় তশরিফ রেখেছেন। তাঁর পাইক, বরকন্দাজ, মাহুত ও ঘোড়সওয়ারেরা বুড়িগঙ্গার চিরাচরিত রং ও বাহার একেবারে পাল্টে দিয়েছেন। দিল্লির একটি মহল্লা যেন জাদুবলে ঢাকার বুকে এসে নেমেছে।
কাল বুড়িগঙ্গার মোহনায় পৌঁছানোর আগেই এর পাল্টে যাওয়া রূপটি চোখে এসে লাগে। পারে যাওয়ার পথেই অভূতপূর্ব দৃশ্য। নীল আচকানপরা উমর নামের একজন মাহুত সাত-আটটি হাতির দেখাশোনা করছিলেন। হাতিগুলো নাকি বেশ কিছুদিন ধরে অভুক্ত। তিনি হাতিগুলির জন্য কলাগাছ কেটে এনে স্তূপ করে রেখেছেন। হাতিগুলি খাচ্ছিলও গোগ্রাসে। তিনটি হাতির পিঠ থেকে তখনো হাওদা খোলা হয়নি। কলাগাছ খেতে গিয়ে তারা যারপরনাই পেরেশান ও জেরবার। এত হাতি একসঙ্গে দেখে বাচ্চা থেকে জোয়ান মরদেরা এলাহি ভিড় জমিয়েছে। অনেকে বেজায় হুল্লোড় করছিল। হাতির লেজ ধরে টানার চেষ্টা করছিল কয়েকটি ফাজিল কিশোর। ওদের সামলাতে গিয়ে মাহুত বেচারার পসিনা বেরিয়ে যাওয়ার জোগাড়। বস্তুত, পিলখানার জায়গা নির্ধারিত হয়নি বলে ঢাকা নগরীর আনাচে-কানাচে এখন হাতি ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর এই আজব জানোয়ারগুলির পেছনে জমায়েত করছে ছেলেছোকরার দল।
পারে যেতেই দেখা গেল একেবারে দিল্লির চকের মতো বাজার বসেছে। সে এক রংদার বাজার। এখানে-সেখানে ঘুরছে হাতি আর ঘোড়া। ঘোড়াগুলি দেখতেও আলিশান। ঢাকাই ঘোড়ার মতো গাধা কিসিমের নয়। রেকাব পরানো ঘোড়াগুলি দেখে মনে হচ্ছিল, এখনই যেন তারা জঙ্গে নামবে। লাল টকটকে রেশমের পাগড়ি প্যাঁচানো ঘোড়াটি দেখিয়ে সহিস বললেন, সেটি তুর্কির সম্রাট উপঢৌকন পাঠিয়েছিলেন মোগল শাহানশাহেক। ঘোড়াটি মহা ত্যাঁদড়, কিন্তু জঙ্গে বেপরোয়া। শাহানশাহ্ এর নাম রেখেছেন চুলবুল। বাংলায় যাত্রা করার আগে শাহানশাহ্ সেটি নতুন সুবাদারকে উপহার দিয়েছেন।
যাত্রাপথে অনেক সময় গেছে বলে সুবাদারের বহরে আনাজপাতি, গোশত, মসলার আক্রা দেখা দিয়েছে। সেই সুবাদে সওদাপাতি নিয়ে নদীর পারে রোজগারের ধান্দায় জমায়েত হয়েছে দূরদূরান্ত থেকে আসা অজস্র মানুষ। ধুতি ও লুঙ্গিপরা বিক্রেতাদের ফাঁকে ফাঁকে ঘোরাফেরা করছিলেন বাজার করতে আসা চোগা-চাপকানপরা দিল্লিওয়ালারা। দিল্লি আর বাংলা, আশরাফ আর আতরাফ মিলেমিশে একাকার।
নদীর পারেই জবাই করে দুটি চেকনাইওয়ালা তাগড়াই গরু ফেলে রেখেছিলেন মানু মিঞা। তিনি জানালেন, চাষের কাজেই গরুগুলিকে তিনি কাজে লাগাতেন। কিন্তু বিকিকিনির এমন মওকা তো আর ঘড়ি ঘড়ি আসবে না। তাই চটজলদি এখানে আসা। দু-চার পয়সা আজ যা আসবে, তা দিয়ে পরে তিনটি গরু কেনা যাবে বলে তিনি আশা করছেন।
প্রচণ্ড ভিড় দেখা গেল জিরোবা থেকে আসা পাঁচু রায়ের চাঙাড়ির সামনে। তিনি এনেছেন ১৬ সের ওজনের একটি রোহিত মাছ। কী নসিব, আজকে ফজরের ওয়াক্তেই নাকি জাল ফেলে ধরেছেন তুরাগ নদী থেকে। বহরের বাবুর্চি নওশাদ তাঁর সঙ্গে মুলামুলি করছিলেন। কিন্তু পাঁচু পাঁচসিকা দর হেঁকে বসে আছেন। নওশাদ বললেন, ‘এ তো দেখি দিল্লিও কাত। সবকিছুর এত দরে তো ফতুর হওয়ার জোগাড়।’
এক পাশে কয়েকজন জোলা বসেছিলেন বস্ত্র নিয়েও। দিল্লিওয়ালারা তাঁদের জেনানাদের জন্য পাল্লা দিয়ে কিনছিলেন হরেক রং ও নকশার কাপড়। দু-একজন অবশ্য বললেন, দর একটু বেশি। কয়েকটা দিন যাক, দর খানিকটা পড়লে একই দরে ঢাকার উত্কৃষ্ট কাপড়ই কেনা যাবে।
বাংলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া খুশবুদার মোগলাই হাওয়ায় বুড়িগঙ্গার পার যেন এক লহমায় নতুন জেল্লা ধারণ করেছে। এক নতুন যুগের প্রতীক হিসেবে বহুদূরে দেখা যাচ্ছে নতুন সুবাদারের শাহি বজরার গলুই। সেই বজরার ভেতরে নকশা করা হচ্ছে ভবিষ্যত্ ঢাকার আদল। আর এর বাইরে সোনালি-রুপালি মিনা করা ধাতব গলুই জ্বলজ্বল করছে সূর্যের চোখ ধাঁধানো রোশনাইয়ে।

ঘাটের নাম চাঁদনীঘাট


সুবা বাংলার নবনিযুক্ত সুবাদার শেখ আলাউদ্দীন ইসলাম খান চিশতি তাঁর বিশাল নৌবহর নিয়ে ঢাকায় বুড়িগঙ্গার তীরে অবস্থান করছেন। সুবাদারের মুখপাত্র প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, ঢাকায় বসবাসের জন্য কোনো আবাসিক ভবন নির্ধারিত না হওয়া পর্যন্ত সুবাদার আপাতত তাঁর শাহি বজরা চাঁদনীতেই দিন গুজরান করবেন। পাকুড়তলী থেকে প্রায় এক ক্রোশ পশ্চিম-দক্ষিণে বুড়িগঙ্গার ঘাটে সুবাদারের চাঁদনী বজরা স্থায়ীভাবে নোঙর করানো হয়েছে। একটি সূত্র জানিয়েছে, এটি এখন থেকে সুবাদারের খাস ঘাট হিসেবে ব্যবহূত হবে। সুবাদারের শাহি বজরার নামানুসারে ঘাটটির নাম দেওয়া হয়েছে চাঁদনীঘাট।
উল্লেখ্য, বুড়িগঙ্গার ওই জায়গাটিতে ইতিপূর্বে কোনো ঘাটের অস্তিত্ব ছিল না। সুবাদারের বজরা এখানে নোঙর করানোর জন্য তড়িঘড়ি করে এখানে ঘাট তৈরি করা হয়। এরপর স্থানীয় অধিবাসীদের মুখে মুখে নতুন ঘাটটির নাম চাঁদনীঘাট হিসেবে চাউর হয়ে যায়। লোকজনের দেওয়া প্রীতিপূর্ণ নামটি সুবাদার পছন্দ করেছেন। এখন থেকে ঘাটটি চাঁদনীঘাট নামেই পরিচিত হবে।
জানা গেছে, এই ঘাটে সামরিক নৌবহর থাকবে না। এখানে মূলত আবাসিক বজরাগুলোই অবস্থান করবে। তবে নিরাপত্তার স্বার্থে কয়েকটি দ্রুতগামী সাঁজোয়া নৌকা ঘাটের সীমানা বরাবর অবস্থান করবে। সুবাদার নিজে জাঁকজমকপূর্ণ চাঁদনী বজরাতেই বসবাস করবেন।
বুড়িগঙ্গা নদীর উভয় তীরের নয়নমনোহর নৈসর্গিক দৃশ্যে সুবাদার মুগ্ধ হয়েছেন। বিশেষত রাত্রিকালে জ্যোত্স্নাস্নাত নদীতরঙ্গের অপার সৌন্দর্যমাধুরীতে তিনি অভিভূত। তা ছাড়া নদীতীরবর্তী স্থানের স্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও মুক্ত শীতল হাওয়ায় তিনি অনাবিল প্রশান্তি ও প্রফুল্ল বোধ করেছেন। তাঁর নদীবক্ষে বাস করার বাসনার পেছনে এটিও অন্যতম কারণ বলে জানা গেছে।
সুবাদারের পরিবারের অন্যান্য সদস্য, বিশেষ করে জেনানারা ফতেহ্ দরিয়া নামের অপর একটি শাহি বজরায় বসবাস করবেন বলে জানা গেছে।

পর্তুগিজদের অত্যাচারে উপকূলে নৈরাজ্য


পর্তুগিজদের সীমাহীন দৌরাত্ম্য ও নিষ্ঠুর অনাচারে চট্টগ্রাম ও ভুলুয়া থেকে বাকলা পর্যন্ত উপকূলীয় অঞ্চলের জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। সন্দ্বীপে স্থায়ী আবাস গেড়ে পর্তুগিজরা কয়েক বছর ধরেই দস্যুতা ও নারী অপহরণের মতো দুষ্কর্ম চালিয়ে আসছিল। সম্প্রতি তাদের দৌরাত্ম্য সকল সীমা ছাড়িয়ে গেছে। পর্তুগিজ জলদস্যুরা উপকূলের নানা অঞ্চলে ব্যাপক লুটতরাজ চালাচ্ছে। গত বুধবার লুটতরাজ করে চলে যাওয়ার আগে চট্টগ্রামে তারা দুটি গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। এতে সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত অগ্নিকাণ্ডে আটজন পুরুষ, ১৪ জন নারী ও ১৭ জন শিশু মারা গেছে। 
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, পর্তুগিজ দস্যুরা গত এক সপ্তাহে চট্টগ্রামে নয়জন, ভুলুয়ায় সাতজন ও বাকলায় তিনজন নারীকে অপহরণ করেছে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ভুলুয়ার জমিদার শেখ লতিফ খানের স্ত্রী মর্জিনা বেগম। জমিদারের বাসভবন বেদনায় স্থবির হয়ে আছে। অপহরণের পর গত তিন দিন চুলায় হাঁড়ি চড়েনি। জমিদারের ১২ বছরের মেয়ে মর্সিয়া বেগম এই প্রতিবেদকের সামনে বুক চাপড়ে আহাজারি করছিল। শেখ লতিফ খান বললেন, ‘পর্তুগিজেরা যদি আমার স্ত্রীকে তুলে নিয়ে যাওয়ার হিম্মত্ দেখায়, তাহলে আমজনতা এখানে বেঁচে থাকার ভরসা কোথায় পাবে?’
উপকূলীয় অঞ্চলের দরিদ্র গ্রামবাসীর প্রধান জীবিকা মাছ ধরা। কিন্তু জলদস্যুদের উত্পাতে তারা মাছ ধরতে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না। গ্রামের পর গ্রামে মানুষ অভুক্ত হয়ে আছে।
পর্তুগিজদের এ উত্পাত বহুগুণ বেড়ে গেছে গত বছর আরাকানরাজ মেং রাজগিইর সঙ্গে পর্তুগিজ নেতা সেবাস্তিয়ান গনসালভেজের দ্বন্দ্ব বেঁধে যাওয়ার পর। উচ্চাকাঙ্ক্ষী গনসালভেজে এ মুলুকে এসেছিলেন সৈনিক হিসেবে। সে বৃত্তি ছেড়ে তিনি বাণিজ্যে মন দেন। অচিরেই বল প্রয়োগ করে সন্দ্বীপে ক্ষমতা কায়েম করেন। এর পর আরাকানরাজ ও গনসালভেজ একে অন্যের আনুগত্য আদায়ের জন্য বিধ্বংসী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। তাতে আরাকান রাজপরিবারের সদস্যরাও নিহত হন। উপকূলের নিরীহ মানুষেরা এখন ক্ষমতা কায়েমের সেই দ্বন্দ্বের মাশুল কড়ায়-গন্ডায় দিয়ে চলেছেন।

প্রবল বর্ষণে নৌকাবাইচ স্থগিত


দীর্ঘদিন ধরে গতকালকের জন্য আগ্রহ ও কৌতূহল নিয়ে সবুর করে ছিল ঢাকাবাসী। কথা ছিল সুবাদার ইসলাম খান চিশতির ঢাকা আগমন উপলক্ষে দিনটিতে নৌকাবাইচ হবে। তার কারণ ছিল নানাবিধ। গত চৈত্রসংক্রান্তিতে সাড়ম্বরে চড়কপূজা হয়েছিল বটে, কিন্তু সে উপলক্ষে এ দোলাই নদীর মোহনায় ঐতিহ্যবাহী নৌকাবাইচটি করা হয়নি। ইসলাম খান আসছেন, এই খবর পেয়ে সবাই সাব্যস্ত করেছিলেন দুই-আড়াই মাস পরে তিনি ঢাকা এলে তাঁর সম্মানে এ নৌকাবাইচ অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু একটানা বর্ষণের কারণে নৌকাবাইচ স্থগিত করা হয়েছে।
দোলাই নদীর মোহনায় ঢাকা কেল্লাসংলগ্ন ঘাটগুলোয় দূর-দূরান্ত থেকে নৌকাবাইচে অংশ নিতে আসা দলগুলির মধ্যে হতাশা নেমে আসে এই খবরে। মোগল সুবাদারের আগমন উপলক্ষে সবাই আশা করেছিলেন এবারের নৌকাবাইচ হবে অন্যান্য বছরের চেয়ে অনেক গুণে রংদার। অনেক এলাকায় চাঁদা তুলে নতুন নৌকা বানানো হয়েছে। দোলাই নদীতে গিয়ে দেখা যায়, সাত-আটটি সাজানো ছিপ নৌকা। নৌকাগুলিতে ঢাকঢোলসমেত হতাশ হয়ে বসে ছিলেন কিছু কিছু প্রতিযোগী। 
মঠবাড়ির একটি দল এবারই প্রথম বাইচে অংশ নিতে এসেছিল। বাইচ উপলক্ষে নতুন ছিপ নৌকা বানিয়েছিল তারা। ভাওয়াল থেকে চারজন দক্ষ মাঝিও তারা ভাড়া করে এনেছিল বাইচের জন্য। এখন বাইচ পণ্ড হয়ে যাওয়ায় পুরোটাই খরচের খাতায় চলে গেল। ভাড়ায় আনা মাঝিদের চুক্তি অনুযায়ী পুরো টাকাই পরিশোধ করতে হয়েছে এই দুই গ্রামের দলকে।
বুড়িগঙ্গার ওপারের গ্রাম আইন্তা থেকে আসা নৌকাবাইচ দলের দলনেতা কালু মিঞা জানান, সারা বছর ধরে তাঁরা এই নৌকাবাইচের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছেন। আত্মীয়স্বজনসহ গ্রামের অনেক লোক পরিবার-পরিজন নিয়ে এসেছিল বাইচ দেখতে। এখন সকলেই খুব মন খারাপ করে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। 
খারাপ আবহাওয়ার কারণে নৌকাবাইচ স্থগিত হলেও আয়োজকেরা জানিয়েছেন, নৌকাবাইচ একেবারে পণ্ড হয়ে যায়নি। বর্ষণ কমে এলে ঘটা করে এই বাইচের আয়োজন করা হবে। আয়োজকদের একটি প্রতিনিধিদল নতুন প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে এসেছেন। জানা গেছে, নৌকাবাইচের এই নিদারুণ পরিণতির খবর পেয়ে সুবাদার স্বয়ং ব্যথিত বোধ করছেন। তিনি বলেছেন, নৌকাবাইচের নতুন সময় ধার্য করা হলে, তিনি তা অবলোকন করতে চান। শাহি বজরা চাঁদনী ও ফতেহ্ দরিয়ায় বসে সুবাদার সপরিবারে নৌকাবাইচ দেখবেন বলে তাঁদের আশ্বস্ত করেন।
এই খবরে আয়োজকদের মনে খানিকটা স্বস্তি নেমে এলেও নৌকাবাইচ উপলক্ষে দুই পয়সা রোজগারের আশায় যাঁরা নদীতীরে পসরা নিয়ে বসেছিলেন, তাঁদের হতাশা কাটেনি। এই একটা দিনে বড় একটা উপার্জনের প্রত্যাশা নিয়ে এসেছিলেন অনেকেই। এখন শূন্য হাতে তাঁদের ফিরে যেতে হচ্ছে।

সর্পদংশনে শিশুসহ তিনজনের মৃত্যু

জাফর আহমদ রাশেদ
গত তিন দিনে সর্পদংশনে ঢাকায় এক শিশুসহ তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। এই তিনজনসহ এক মাসে সর্পদংশনে নয়জনের মৃত্যু হলো।
গতকাল গেন্ডারিয়ায় বাঁশবনে বাঁশপাতা ও মরা কঞ্চি কুড়াতে গিয়েছিল দশ বছরের বোন ও আট বছরের ভাই। মরা বাঁশপাতার রঙের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল গোখরো সাপের গায়ের রং। হতভাগ্য ছেলেটা না বুঝে বাঁশপাতা ভেবে হাত দেয় সাপের গায়ে। সঙ্গে সঙ্গে সাপটি তার হাতে দংশন করে। অদূরে পাতা কুড়াচ্ছিল তার বোন। ভাইয়ের আর্তচিত্কার শুনে সে দৌড়ে এলে সাপটি তাকেও ছোবল দেয়।
অদূরে বাঁশঝাড় থেকে পাকা বাঁশ কাটছিলেন জনাকয়েক লোক। দুজনকেই কোলে করে বাড়ি নিয়ে আসেন তাঁরা। ওঝা ডাকার আগেই ছেলেটি মুখে ফেনা তুলে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। হতভাগ্য ছেলেটির নাম ধলা। মেয়েটির নাম ফালানি।
এদিকে গত পরশু রাতে মতির ঝিলে এক কৃষক সাপের কামড়ে মারা গেছেন। সেদিন বৃষ্টির কারণে দুই বিলের মধ্যে সংযোগ নালা দিয়ে প্রচুর পানি নামছিল। মাছ ধরার জন্য সেই নালার মুখে চাঁই বসান বিনু মাঝি। চাঁইয়ের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে এই হতভাগ্য কৃষক সর্পদংশনের শিকার হন। সকালে মাঠে চাষ করতে গিয়ে একদল কৃষক রাস্তার পাশে বিনু মাঝির লাশ আবিষ্কার করেন। তাঁর শরীর বিষে নীল হয়ে গিয়েছিল।
এক মাসে সর্পদংশনে নয়জনের মৃত্যু ঢাকাবাসীর মধ্যে ভীতির সঞ্চার করেছে।

চন্ডুখোরদের উত্পাত

পারভেজ হোসেন
ঢাকায় চন্ডুখোরের দল দিন দিন বেড়েই চলেছে। মাদকের এমন বিস্তার ঢাকায় আগে এত দেখা যায়নি। পূর্বে ধাঙর, চামার, ধোপাদের আখড়ায় তাড়ি অথবা ধেনো মদের সঙ্গে এর কিছুটা প্রচলন ছিল। ক্রমে চন্ডু সেবন বেড়েছে। হালে এই নেশাসক্তদের দল নয়ানীটোলার দিঘিপাড়ে, নয়াটোলার চামারপট্টিতে আর দক্ষিণ দুয়ারের মন্দিরসংলগ্ন পাকুড়তলায় বিরাট আড্ডা বসিয়েছে। তাড়ি ও ধেনো মদের সঙ্গে চন্ডুর নেশায় চুর হয়ে খঞ্জনি-ঢোল বাজিয়ে নৃত্য করে ক্লান্ত হয়ে যেখানে-সেখানে এরা পড়ে থাকে। কখনো কখনো পথচারীদের তাড়া করে।
চন্ডুখোরদের আখড়ায় এখন ভিড় জমাচ্ছে তাঁতি, জেলে, কামার, কুমোরের অল্পবয়সী মর্দরা। কাজে-কর্মে এদের গা নেই। দিনে-দুপুরে চন্ডুর নেশায় বুঁদ কর্মক্ষম যুবকদের নিয়ে গৃহস্থের ঘরে তাই উদ্বেগ বেড়েই যাচ্ছে। এদিকে নেশার পয়সা জোগাড় করতে পারছে না যারা, পাড়া-মহল্লায় তাদের দ্বারা চুরির ঘটনাও বেড়ে গেছে। নগরীর এই নতুন ব্যাধি নিয়ে অনেকেই উদ্বিগ্ন। কিন্তু শহরের বিশিষ্টজনেরা বিষয়টি নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো দরবার করেননি। 
ঢাকাকে রাজধানী ঘোষণা করায় শহরবাসীর চিত্তে যে আনন্দের বন্যা বইছে, আমোদ-ফুর্তির ফুলকি ছুটেছে, তাতে শামিল হয়ে চন্ডুখোরদেরও উত্পাতের মাত্রা ছাড়িয়েছে। কর্তৃপক্ষ ও বিশিষ্টজনেরা যদি এ ব্যাপারে এখনই পদক্ষেপ না নেন, যুবসমাজের পতন অনিবার্য হয়ে উঠবে বলে মনে করছেন সমঝদারেরা। একই সঙ্গে এই চন্ডুখোরদের দৌরাত্ম্য ভবিষ্যতে রাজধানী হিসেবে ঢাকার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় কলঙ্কচিহ্ন হিসেবে দেখা দেবে বলেও তাঁদের ধারণা।

সুবাদার ইসলাম খান চিশতির সাক্ষাত্কার

নতুন রাজধানীর সামনে অপার সম্ভাবনা

সুবা বাংলার নতুন সুবাদার শেখ আলাউদ্দীন ইসলাম খান চিশতি বলেছেন, ঢাকাকে রাজধানী হিসেবে গড়ে যে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে, একে তাঁরা কাজে লাগাতে চান। সুবা বাংলার নানা অংশে অরাজকতার শাসন চলছে। দেশি-বিদেশি দস্যুরা এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে আমজনতার ওপর যে অনাচার করে চলেছে, এর অবসানে তাঁরা সর্বশক্তি প্রয়োগ করবেন বলে তিনি জানান। গতকাল প্রথম আলোর সঙ্গে এক অন্তরঙ্গ সাক্ষাত্কারে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি এ সাক্ষাত্কারে সবাইকে আশ্বস্ত করে বলেন, রাজধানী গড়ে তুলতে অতিরিক্ত যে খরচ হবে তার বন্দোবস্ত করার জন্য তাঁর প্রশাসনের খাজনা বাড়ানোর কোনো পরিকল্পনা নেই। সাক্ষাত্কারের বিস্তারিত নিচে দেওয়া হলো:
প্রথম আলো: মুহতারাম সুবাদার শেখ আলাউদ্দীন ইসলাম খান চিশতি, সুবা বাংলার প্রথম সুবাদার হিসেবে ঢাকায় আপনাকে খোশ আমদেদ। আশা করি, ঢাকায় আপনার অবস্থানের দিনগুলো আনন্দময় হবে।
সুবাদার শেখ আলাউদ্দীন ইসলাম খান চিশতি: সেটি নির্ভর করবে কী ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন আমাকে হতে হবে তার ওপর। তবে তা যা-ই হোক, আমরা এখানে একটি সুশৃঙ্খল শাসনব্যবস্থা এবং উন্নত নগর গড়ে তুলব, যেমন আমি আমার ভাষণে বলেছি। আশা করি, এতে স্থানীয় জনসাধারণ সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে। মহামহিম সম্রাটের পক্ষ থেকে সুবা বাঙ্গালাবাসীকে শুভেচ্ছা।
প্র. আ.: ঢাকার কোন বৈশিষ্ট্যের কারণে আপনি একে রাজধানী করার উপযুক্ত বলে ভেবেছেন?
সুবাদার: ওহ্, এখানকার লাল মাটি।
প্র. আ.: বুঝতে পারলাম না। একটু ব্যাখ্যা করবেন?
সুবাদার: আলবত্। আমি যখন দীর্ঘ নদীপথ পাড়ি দিয়ে আসি, তখন লক্ষ করেছি, এই অঞ্চল জঙ্গলাকীর্ণ আর নদীর অববাহিকা নরম পলিমাটি দিয়ে তৈরি। বন্যায় ওই জায়গাগুলি প্লাবিত হয়, পাড় ভেঙে বিলীন হয়ে যায়। আমি কিছুটা উঁচু ও শক্ত মাটির একটি জায়গা খুঁজছিলাম। আবার একই সঙ্গে কৌশলগত কারণে এমন জায়গাও চাইছিলাম, যেখান থেকে পুরো সুবায় সহজে যোগাযোগ করা যায়। এখানে স্থল-যোগাযোগ উন্নত নয়। কাজেই আমি খুঁজছিলাম নদীর পাড়ে শক্ত মাটির উঁচু একটি অঞ্চল। লক্ষ করলাম, এ অঞ্চলে আরও এক রকমের মাটি লাল ও শক্ত। আমি যে রকম জায়গা খুঁজছিলাম, ঢাকা একেবারে তা-ই।
প্র. আ.: মুর্শিদাবাদ বা সোনারগাঁও কোন বিবেচনায় বাদ দিলেন?
সুবাদার: মুর্শিদাবাদকে বাদ দিয়েছি কৌশলগত কারণে। সেখানে একটি চৌকি থাকবে। অত দূর থেকে এ অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। আরাকানি মগ ও উপকূলীয় দ্বীপগুলোর পর্তুগিজদের আক্রমণ ঠেকাতে হলে মুর্শিদাবাদ থেকে আরও ভাটির দিকে বড় স্থাপনার দরকার। সোনারগাঁওকেও বিবেচনায় রাখিনি, কারণ ঢাকার যোগাযোগ ও কৌশলগত অবস্থান তার চেয়ে ভালো। তা ছাড়া সে জায়গাটি দীর্ঘদিন বিশৃঙ্খল শাসনের মধ্যে ছিল। সেখানকার অধিবাসীরা স্থানীয় শাসকদের প্রতি দুর্বল থাকতে পারে। স্থানীয়দের সহযোগিতা আমাদের প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে একটি নতুন জায়গা থেকে কাজ শুরু করা আমার কাছে উপযুক্ত বলে মনে হয়েছে। ঢাকার লোকজন আগে থেকে শত্রুভাবাপন্ন হয়ে থাকার কারণ নেই।
প্র. আ.: মাননীয় সুবাদার কি তাহলে নিজের শক্তি সম্পর্কে সন্দিহান?
সুবাদার: মোটেই তা নয়। আমি বলতে চেয়েছি, মনোভাবের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। যা হোক, নতুন রাজধানীতে আমরা আমজনতার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী। তাদের নিরাপত্তার বিষয়টিকে আমরা বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছি। মগ, বর্গি, পর্তুগিজদের অত্যাচার বন্ধ করলে মানুষের জীবনযাত্রার মান বাড়বে। স্থানীয় শিল্পেরও বিকাশ ঘটবে। এতে আমাদের প্রশাসনের ওপর তাদের আস্থা তৈরি হবে। পারস্পরিক সুসম্পর্ক সৃষ্টির সুযোগ ঘটবে।
প্র. আ.: আপনি মগ বা পর্তুগিজদের কথা বলেছেন। কিন্তু বারো ভুঁইয়াদের প্রসঙ্গে কিছু বলেননি। এখানে মোগলদের প্রধান লক্ষ্য কি তারাই নয়?
সুবাদার: দেখুন, তাঁদের সম্পর্কে বিশেষ কিছু বলার আছে বলে আমি মনে করি না। এ কথা সত্য যে, বিশাল মোগল সাম্রাজ্যের দূরপ্রান্তবর্তী এই সুবার ওপর কেন্দ্রীয় শাসন সব সময় সুদৃঢ় থাকেনি। তবে এর বাস্তব কারণও ছিল। দুর্গম জঙ্গলাকীর্ণ এই অঞ্চলের স্থল-যোগাযোগ উন্নত নয়। নৌপথ ধীরগতির। কেন্দ্র থেকে প্রয়োজনে দ্রুত প্রচুর সৈন্যসমাবেশ সহজসাধ্য নয়। তার পরও মহামান্য শাহানশাহ্ আকবর তাঁর অসামান্য প্রজ্ঞা ও পরাক্রমে সমগ্র ভারতবর্ষকে তাঁর নিয়ন্ত্রণে এনেছেন। কঠোর হাতে স্থানীয় বিদ্রোহ দমন করেছেন। সামাজ্যে আইনশৃঙ্খলা ও শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাঁর সময়েই আপনি যাদের কথা বলেছেন, তাদের দমন করা হয়েছে। বাদবাকি যে সীমিত ক্ষমতা তাদের উত্তরাধিকারীদের মধ্যে ছিল, তা উত্পাটন করা হয়েছে। আমরা এখানে আসার পথে বিদ্রোহীদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছি। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, তারা মোগল সম্রাটের সম্পূর্ণ বশ্যতা কবুল করেছে। কাজেই এই প্রসঙ্গ নিয়ে আমরা আর ভাবছি না।
প্র. আ.: সুবাদার হিসেবে আপনার প্রথম কাজ কী হবে?
সুবাদার: কাজ তো অনেক। প্রধান কাজ, সড়ক ও জলপথ উন্নয়ন এবং বাণিজ্যের পরিবেশ সৃষ্টি। তবে সবচেয়ে আগে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। আমজনতার জানমাল ও ধর্মকর্মের নিরাপত্তা। প্রাথমিক দিক থেকে গুরুত্বের বিষয় সেটিই। নদীপথে টহল বাড়ানো এবং কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত সেখানে জলদুর্গ গড়ে তুলতে চাই। তবে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো একটি প্রথম কাজের কথা ভাবলে তো বলতে হবে সেটি আমরা ইতিমধ্যেই করেছি—রাজধানী শহরের সীমানা নির্ধারণ।
প্র. আ.: আপনি এর আগে বিহারের সুবাদার ছিলেন। সেখান থেকে সুবা বাংলার দায়িত্ব পাওয়ার বিষয়টিকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন।
সুবাদার: আমি নিজেকে একজন সেনাপতি হিসেবে ভাবতে পছন্দ করি। সেদিক থেকে একটা নতুন জায়গায় এসে একটি নতুন রাজধানীতে সবকিছু নতুন করে গড়ে তোলার বিষয়টিকে আমি যুদ্ধের মতোই ভাবি। আর আপনি যখন যুদ্ধের ময়দানে নামবেন, তখন জয় ছাড়া অন্য কোনো কিছুই ভাববেন না। 
প্র. আ.: একমাত্র এই বিষয়টিই কি গুরুত্বপূর্ণ?
সুবাদার: আমার দিক থেকে ঠিক তা-ই। তবে সামগ্রিক দিক বিবেচনা করলে মোগল সাম্রাজ্যে সুবা বাংলার অর্থনৈতিক ও কৌশলগত গুরুত্ব অত্যন্ত অসীম। আমার তাই মনে হয়, নতুন এই রাজধানীর অপার সম্ভাবনা রয়েছে।
প্র. আ.: কী কারণে?
সুবাদার: এখানকার শিল্পসামগ্রীর কদর বিশ্বব্যাপী। বিশেষত মসলিন তো সারা জাহানে মশহুর। কিন্তু সে অনুযায়ী এই অসামান্য বস্ত্রের উত্পাদন ও বাণিজ্য বিস্তারিত হয়নি। এখন বিদেশি বণিকেরা আসতে শুরু করেছে। দক্ষিণ ও উত্তর ভারত থেকে তারা মসলা নিয়ে যাচ্ছে। এখন ঢাকায় আমরা একটি উন্নত বন্দর গড়ে তুলব। এখান থেকে মসলিন সারা বিশ্বে রপ্তানি হবে। তাঁতি ও স্থানীয় জনসাধারণও এতে লাভবান হবে। একটা বড় রকমের রাজস্বও আদায় হবে। তা ছাড়া এখানে বিপুল উর্বর সমভূমি। কৃষিপণ্য থেকেও সরকারের আয় বাড়বে। আমরা আমাদের ঐতিহ্যবাহী উদ্যানমুখী কৃষি উত্পাদনের দিকটি চালু করতে পারি। আমার বিশ্বাস, অচিরেই এই নতুন রাজধানী বাণিজ্যে বিশ্বের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হয়ে উঠবে। এ জন্য আমাদের এখানে নিরাপত্তার বিধান করতে হবে। সেটা আমরা করব। আরাকান পর্যন্ত আমরা আমাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করব। তাতে সব ধরনের অরাজকতারই অবসান ঘটবে।
প্র. আ.: আপনারা কি তাহলে খাজনা বাড়ানোর কথা ভাবছেন?
সুবাদার: না, না, এই মুহূর্তে সে ধরনের কিছুই আমরা ভাবছি না। আমি যা বলতে চেয়েছি তা হলো, এখানে বাণিজ্য বা কৃষি উত্পাদন বাড়ানোর দিকেই আমরা প্রধানত নজর দেব। উত্পাদন ও বাণিজ্যের পরিমাণ বাড়লে সেখান থেকে স্বাভাবিকভাবেই সরকারি খাজনাও বাড়বে। আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, মোগল সাম্রাজ্যের কোথাও প্রজাদের ওপর আমরা অন্যায় শোষণ ও জুলুম চাপিয়ে দিইনি। সুশাসন, সমতা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, সহযোগিতা—এসব আমাদের শাসনের মৌলিক ভাবাদর্শ। খাজনা কেন, কোনো কিছুই আমরা জনসাধারণের ওপর জুলুম করে চাপিয়ে দিতে চাই না। তুর্কি বা আফগান কিংবা অন্যদের মতো আমরা এসে লুটতরাজ করে যা পাই তা-ই নিয়ে চলে যেতে আসিনি। মোগল শাহানশাহ্রা একে নিজের দেশে বলেই ভেবেছেন। এটাই মোগল বাদশাহির মূল শক্তি।
প্র. আ.: এবার একটি ব্যক্তিগত প্রশ্ন। শোনা যাচ্ছে, আপনি নাকি বজরাতেই বসবাসের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন?
সুবাদার: আপাতত কিছু দিন তাই থাকতে চাই। অন্য কোথাও আমার থাকার পাকা বন্দোবস্ত এখনো হয়নি। ঢাকা কেল্লায় গিয়ে উঠতে পারতাম। কিন্তু তার চেয়ে বজরায় নদীবক্ষে থাকতেই আমি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। নদীপথে দীর্ঘ পথ পার হয়ে আসার সময় খোলা হাওয়া আর এ অঞ্চলের নদীর সৌন্দর্য আমাকে মুগ্ধ করেছে।
প্র. আ.: আপনি একটি সুবার রাজধানী প্রতিষ্ঠা করলেন। নিজেকে আপনি ইতিহাসে কীভাবে দেখতে চান?
সুবাদার: ভবিষ্যতের চেয়ে আমি বর্তমানের চিন্তায় এখন বেশি মগ্ন। আমার একটা পরিকল্পনা আছে। তা বাস্তবায়িত করতে হবে। ইতিহাস অনেক বড় বিষয়। এই শহর নিজেই তার ইতিহাস সৃষ্টি করবে বলে আমি বিশ্বাস করি। বহুকাল ধরে বহু মানুষ সেখানে অবদান রাখার সুযোগ পাবে। কে কখন এই শহরের পত্তন করেছিল তার নামই হয়তো সুদূর ভবিষ্যতের লোকেরা ভুলে যাবে। ইতিহাসের বিষয়টা অতীতের, কিন্তু এর চর্চা তো ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়েই। এই শহরের যে ভবিষ্যত্ সম্ভাবনা আমি দেখতে পাচ্ছি, সেটি সফল হলে সে সাফল্যের মধ্যে নামহীনভাবে হলেও তো আমি থেকে যাব।
প্র. আ.: আপনার কুশল কামনা করি।
সুবাদার: আপনার ও এই সুবার সকলের কুশলও আমি কামনা করি।

দস্যু ও বিদ্রোহ দমনে তৈরি হবে জলদুর্গ


সুবা বাংলার রাজধানী ঢাকা, তথা সমগ্র সুবার নিরাপত্তা জোরদার করতে মহামহিম মোগল শাহানশাহ্ নূরুদ্দীন মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর এ অঞ্চলে জলদুর্গ গড়ে তোলার নির্দেশ দিয়েছেন। শীতলক্ষ্যার ভাটি অঞ্চলে কৌশলগত স্থান চিহ্নিত করে জলদুর্গ নির্মাণ করা হবে বলে জানা গেছে।
সুবাদারের সেনাবিষয়ক কর্মকর্তা বকশি খাজা তাহির মোহাম্মদ প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, জলদুর্গ ও সামরিক স্থাপনার বিষয়ে সুবাদার শেখ আলাউদ্দীন ইসলাম খান চিশতির সঙ্গে আলোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন তাঁর প্রধান নৌ-অধিকর্তা মির-ই-বহর ইহতিমাম খান। বকশি আরও জানান, সুবাদারের অনুরোধক্রমে শাহানশাহ্ জাহাঙ্গীর ইহতিমাম খানকে ৫০ হাজার সৈন্যের নেতৃত্ব দান করে সুবা বাংলার মির-ই-বহর পদে উন্নীত করেছেন। তিনি রাজকীয় নৌবহরসহ এলাহাবাদ ও প্রাক্তন রাজধানী রাজমহল হয়ে সুবাদারের পরপর নতুন রাজধানীতে উপনীত হয়েছেন।
এরই মধ্যে সুবাদার তাঁর সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক বৈঠকে বসেছিলেন। একটি সামরিক সূত্র মারফত জানা গেছে, পর্যায়ক্রমে ইদ্রাকপুর, সোনাকান্দা ও ভাটি অঞ্চলের কৌশলগত স্থানে একাধিক জলদুর্গ গড়ে তোলার জন্য সামরিক কর্মকর্তাদের দেওয়া প্রস্তাবে সে বৈঠকে সুবাদার নীতিগত সম্মতি দিয়েছেন। এসব দুর্গ ভারী কামান ও উন্নত অস্ত্রে সজ্জিত করা হবে। দুর্গসংলগ্ন ঘাটে নৌবহর সদাপ্রস্তুত অবস্থায় মোতায়েন রাখা হবে। এ ছাড়া দুর্গগুলিতে দ্রুতগতিসম্পন্ন অশ্বারোহী বাহিনী ও গজবাহিনীও মোতায়েন করা হবে।
বকশির দপ্তর জানিয়েছে, সৈন্যরা আপাতত ঢাকার দুর্ভেদ্য দুর্গ ঢাকা কেল্লাতেই অবস্থান করবেন। ঢাকা কেল্লা অবশ্য সুবাদারের প্রশাসনিক ভবন হিসেবেও ব্যবহূত হবে। এ ছাড়া দোলাই নদীতে বেগ মুরাদ খান নির্মিত কেল্লা দুটিও সংস্কার করা হবে। সেগুলির একটির দায়িত্ব মির-ই-বহর ইহতিমাম খান নিজে গ্রহণ করবেন। অন্যটির দায়িত্ব দেবেন তাঁর সুযোগ্য পুত্র বীর সেনাধ্যক্ষ আলাউদ্দীন ইস্পাহানী ওরফে মীর্জা নাথানকে। তাঁরা পিতা-পুত্র এই দুই দুর্গেই অবস্থান করবেন। 
বাংলার প্রধান যোগাযোগব্যবস্থা জলপথনির্ভর বলে ব্যবসাবাণিজ্য ও নদীতীরবর্তী জনপদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিপুলসংখ্যক নৌসেনা মোতায়েন করা দরকার বলে সুবাদার ও তাঁর সেনাকর্মকর্তারা মনে করছেন। জানা গেছে, জলপথে মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যু এবং অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহীদের দমনের জন্য কামান ও ভারী অস্ত্রসজ্জিত নৌবহর শীতলক্ষ্যাসহ পার্শ্ববর্তী নদীগুলিতে নিয়মিত টহল দেবে। রাজধানীর পূর্বোল্লিখিত তিনটি দুর্গে সৈন্যসংখ্যা পর্যাপ্ত পরিমাণে বাড়ানো হবে।

ঢাকা রাজধানী সোনারগাঁওয়ে হতাশা


ঢাকাকে রাজধানী ঘোষণা করার ফলে সুবর্ণ গ্রাম বা সোনারগাঁওয়ের সাধারণ মানুষের মধ্যে চাপা সন্তোষ থাকলেও সেখানকার শাসক, বণিক ও উঁচুস্তরের মানুষের মধ্যে ব্যাপক হতাশা লক্ষ করা গেছে। 
সোনারগাঁওয়ের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা কয়েক বছর ধরে কিছুটা বিশৃঙ্খল। চাঁদপুর ও ত্রিপুরার রাজাদের আক্রমণে সোনারগাঁওয়ে কিছুকাল যাবত্ এখানে ব্যাপক অস্থিরতা বিরাজ করছিল। অন্যদিকে নৌপথের আশপাশে পর্তুগিজ ও মগদের যৌথ আক্রমণ, হত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগে এই জনপদের অধিবাসীরা বহুদিন ধরেই দিশেহারা। ব্যবসা-বাণিজ্য, চাষাবাদ ও শিল্পকারখানায় বিরাজ করছিল চরম দুর্যোগ। মোগল রাজ বহুদিন ধরে এ অঞ্চল অধিকার করে এখানে শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে আসছিলেন। সম্প্রতি ইসলাম খান চিশতিকে সুবা বাংলার নতুন সুবাদার করে ঢাকায় পাঠানোর পেছনেও তাঁদের এ উদ্দেশ্য কাজ করেছে। নতুন সুবাদার সোনারগাঁওকে মুক্ত রাখার অভিপ্রায়ে উপদ্রুত অঞ্চলের মধ্যভাগে অবস্থিত ঢাকাকে রাজধানী ঘোষণ করেছেন। এই সংকল্প অনুযায়ী ইতিমধ্যে তাঁর দপ্তর ও আমলাদের জন্য স্থাপনা গড়ার কাজ শুরু হয়েছে। এসব বিষয়কে সোনারগাঁওয়ের শাসক, বড় বণিক ও রইস মানুষেরা মোটেই প্রসন্ন চোখে দেখছেন না।
একমাত্র জগদ্বিখ্যাত মসলিন বোনার তাঁতিপাড়া ও কার্পাস তুলার আড়তে নতুন বাণিজ্যের সম্ভাবনায় চাপা খুশির আভাস মিলেছে। কিন্তু সোনারগাঁওয়ের গৌরবের সূর্য অস্ত যাওয়ার শঙ্কায় চালের আড়ত বা সুগন্ধী মসলার পাইকারি দোকান থেকে সোনালি হেরেমের নায়িকাদের মিনাবাজার— সর্বত্রই দেখা গেছে প্রাণস্পন্দনের অভাব। আকালিয়া খালের তীরে দেওয়াগবাগ হাটেও গতকাল হাটুরেদের মুখে মুখে ছিল একই আলোচনা।
কাঁচা টংকার ঝনঝনানি আর আতর-মেশকাত-জাফরানের গন্ধে মৌ মৌ সওদাগরির সঙ্গে যুক্ত মানুষের মনে এখন একই জিজ্ঞাসা, এখানকার বন্দরে কি আর নোঙর করবে শ্যামদেশ, সিংহল, সুমাত্রা, মালয় বা যবদ্বীপের বাণিজ্য জাহাজ? নাবিক আর সওদাগরদের আগমনে রাতের সরাইখানায় নর্তকিদের নৃত্য, ওস্তাদদের গজল কি থেমে যাবে? 
রাজধানী ঘোষণার কয়েক দিনের মধ্যেই সোনারগাঁওবাসীর কাছে ঢাকা যেন প্রবল প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছে। মোগরাঘাটের একজন কার্পাস পাইকার বললেন, ‘চাষ তো হবে, তুলাও বেচব, ঢাকায় নতুন বাণিজ্য হবে। কিন্তু আমাদের এই ঘাটে কি আর বিক্রিবাট্টা তেমন জমবে? সওদাগরেরা তো এখনই বুড়িগঙ্গায় বাণিজ্য জাহাজ ভেড়ানোর পাঁয়তারা করছে। সোনারগাঁওয়ের দিন বুঝি গেল!’ 
তাঁতিপাড়ার কারিগর কার্তিক বিশ্বাসের বক্তব্যেও ধ্বনিত হলো একই সুর। এলাহাবাদের সুন্দরী হুসনা বাঈজি তাঁর বাঘবন্দী খেলা থামিয়ে বললেন, ‘আমরা তো নেচে-গেয়েই কামাই। যেখানে মজমা জমবে, সেখানেই যাব। কিন্তু ঢাকা রাজধানী হয়েছে তো কি, পানামের কোনো তুলনা নাই।’

উদ্বিগ্ন মগ রাজা

চট্টগ্রামে রাজনৈতিক শক্তির নয়া মেরুকরণ


ফেনী নদী পার হলেই রাখায়ঙ্গ বা আরাকানের মগরাজ্যের সীমানার শুরু। আরেকটু এগোলে সীতাকুণ্ডের পাহাড়। এর দক্ষিণে প্রাচীন বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। সুলতানি আমলে চট্টগ্রামের অধিকার নিয়ে বাংলার সুলতান, ত্রিপুরার রাজা আর মগরাজ্যের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় সংঘর্ষ হয়েছে একাধিকবার। এখন চট্টগ্রাম মগ রাজার এক বিশাল নৌঘাঁটি। রাজার ছোট ভাই এখানকার শাসনকর্তা। বাংলার দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ মগদের ক্রমাগত লুটপাট আর নিষ্ঠুর অত্যাচারে জর্জরিত দীর্ঘদিন।
কয়েক দিন ধরেই চট্টগ্রামের সরাইখানা, জাহাজঘাট, হাটবাজার আর মহল্লায় সর্বত্রই যেন একটা চাপা উদ্বেগ আর অস্বস্তি। কারণ, গোয়েন্দা মারফত মগ রাজদরবারে খবর এসেছে, বাংলার মোগল সুবাদার ইসলাম খান চিশতি এখন থেকে ঢাকায় থাকবেন স্থায়ীভাবে। সঙ্গে থাকবে মোগলদের নৌসেনানি ও সুদক্ষ গোলন্দাজ বাহিনী দিয়ে সজ্জিত এক বিশাল মোগল নওয়ারা আর শক্তিশালী সেনাবাহিনী। এ খবরে মগরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে এর সুদূরপ্রসারী তাত্পর্য বুঝতে আরাকানরাজের দেরি হয়নি। 
বেশ কিছুদিন ধরেই গোয়েন্দা মারফত ভাটি অঞ্চলের বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ইসলাম খানের একের পর এক জয়ের সংবাদ মগরাজা মেং খামায়ুংয়ের কানে পৌঁছেছিল। সম্প্রতি মসনদ-ই-আলা মুসা খান ও অন্য বিদ্রোহীদের পিছু হটায় উদ্বিগ্ন আরাকানরাজ ও চট্টগ্রামের মগসেনানিরা। গোয়েন্দা সূত্রে তাঁরা আরও জেনেছেন, পরাজিত বিদ্রোহীদের সব যুদ্ধহাতি আর নৌবহর সুবাদারের নির্দেশে মোগল বাহিনীতে শামিল করা হয়েছে। ফলে মোগল নওয়ারা দিন দিন ফুলে-ফেঁপে উঠছে। এই শক্তিশালী নৌবাহিনী মগরাজার রণতরীর মোকাবিলায় প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠবে বলে মগ নৌসেনাপতিরা গভীরভাবে শঙ্কা বোধ করছেন।
চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী, বণিক, স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে আলাপচারিতার সূত্রে এ জাতীয় আরও কিছু খবর মিলেছে। মগ রাজা জানতে পেরেছেন যে সুবাদার ইসলাম খান পরাজিত বিদ্রোহীদের দ্বিতীয়বার বিদ্রোহ করার সুযোগ একেবারে নির্মূল করে দিচ্ছেন। যাঁরা বশ্যতা স্বীকার করেছেন, পূর্বসূরিদের মতো তিনি তাঁদের আর নিজ নিজ এলাকায় ফেরত পাঠাচ্ছেন না। তার পরিবর্তে মোগল সেনাবাহিনীর সঙ্গে অন্য বিদ্রোহীদের দমনে ঠেলে দিয়েছেন তাঁদের। ফলে তাঁরা নিজ এলাকায় ধীরে ধীরে শক্তি সঞ্চয় করে সুযোগমতো বিদ্রোহের ঝান্ডা আর ওড়াতে পারছেন না। এতে দিন দিন কমে আসছে বিদ্রোহীদের সংখ্যা। পরিণামে এই সুবায় মোগল শাসন দৃঢ়তর ও সুস্থির হয়ে উঠছে।
চট্টগ্রামের বণিক সম্প্রদায় ও সমুদ্রগামী জাহাজের মালিকেরা বলেছেন, বিদ্রোহ দমনের ফলে শাসন সংহত হলে মোগল বাহিনী ভুলুয়া বা নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের দিকে ধেয়ে আসতে পারে বলে চট্টগ্রামের মগ সেনানিরা সতর্ক দৃষ্টি রাখছেন। তাঁরা জানিয়েছেন, আরাকান রাজদরবারের বিবেচনায় বাংলায় সুসংহত মোগল শাসন চট্টগ্রাম ও আরাকানের নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ। এর প্রতিষেধক হিসেবে ভুলুয়া ও মোগল-বাংলায় ক্রমাগত হামলা চালিয়ে মোগলদের উদ্বিগ্ন ও ব্যতিব্যস্ত রাখার মগনীতি অব্যাহত রাখা মগ রাজার পক্ষে হবে শ্রেয়। চট্টগ্রামের কয়েকজন বর্ষীয়ান ব্যক্তি মন্তব্য করেন, সুলতানি আমল থেকে আরাকান রাজারা এ ধরনের রণনীতিই অনুসরণ করেছেন। মগ রাজার বর্তমান রণনীতি সেই পুরোনো নীতিরই ছায়ামাত্র।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে মগ রাজা কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিতে ব্যস্ত। বর্মার রাজা ও সন্দ্বীপে অবস্থানরত তাঁদের এত দিনের বৈরী প্রতিপক্ষ পর্তুগিজদের সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি মিটিয়ে ফেলে তাদের নিয়ে বাংলায় মোগলদের বিরুদ্ধে জোট বাঁধার পরিকল্পনা করছেন মগরাজা। তিনি অচিরেই সন্দ্বীপে ও বর্মায় দূত পাঠাবেন বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে মগ রাজার একজন বিশিষ্ট পারিষদ জানিয়েছেন।

কুসুম ফুল চাষে মন্দা


বৈরী আব-হাওয়ার কারণে এ বছর ঢাকা ও এর আশেপাশে কুসুম ফুলের চাষ ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এবার পোকার আক্রমণ ও অনাবৃষ্টিতে ফুলে আসল রংও ধরেনি, আকারও হয়েছে ছোট। সব মিলিয়ে এবার শুকনো কুসুম ফুল থেকে তৈরি সুতা ও কাপড়ের রং অন্য বছরের মতো উজ্জ্বল ও পাকা হবে না বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন। 
আমীরগঞ্জের ফুলচাষি জমির মোল্লা তাঁর জমি থেকে কুসুম ফুল তুলেছেন গত বছরের অর্ধেক। সোনারগাঁওয়ের দাদন-চাষি রহমতুল্যা টাকা শোধ দেওয়ার চিন্তায় অস্থির। জমিতে যে ফুল হয়েছে তা দিয়ে দাদনের টাকাই মেটানো সম্ভব হবে না। অঞ্চলের প্রায় সব চাষিরই একই অবস্থা। 
ফলন কম হওয়ায় শুকনো কুসুম ফুলের সরবরাহে ঘাটতির আশঙ্কা রয়েছেই। রঙের দাম বাড়ার আশঙ্কায় সুতি ও রেশমি কাপড়ের উত্পাদনকারী ও বিক্রেতা উভয়েই উদ্বিগ্ন। এই উজ্জ্বল হলুদ-লাল বর্ণের সুতা রঞ্জনকারী প্রাকৃতিক উপাদানটির দাম বাড়ার আশঙ্কায় সবচেয়ে শঙ্কিত তাঁতিরা। রঙিন সুতার দাম বাড়লে তাঁদের উত্পাদন খরচ বেড়ে যাবে। 
বাংলা সুবা থেকে প্রতিবছর প্রচুর শুকনো কুসুম ফুলের গাঁট হিন্দুস্তানের নানা প্রদেশে চালান যায়। বিদেশি বণিকেরাও শুকনো ফুল মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপের নানা দেশে রপ্তানি করে থাকেন। এ বছর এই সরবরাহ অক্ষুণ্ন থাকবে কি না, সে ব্যাপারে গভীর সন্দেহ প্রকাশ করেছেন ঢাকার বাদশাহি বাজারে শুকনো ফুলের মাড়োয়ারি পাইকারি ব্যবসায়ী রসিলাল শেঠ।
কুসুম ফুলের মৌসুমে অনেক গৃহস্থ তাজা কুসুম ফুল রোদে শুকিয়ে বিক্রি করেন। কেউ কেউ এর থেকে রং বের করেও দু-চার পয়সা উপার্জন করেন। এবার তাঁদেরও পথে বসার দশা।

মসজিদ-মন্দিরে বিশেষ প্রার্থনা


মোগল সাম্রাজ্যের মহামান্য শাহানশাহ্র সুযোগ্য সিপাহসালার ও বঙ্গদেশের সুবাদার ইসলাম খান চিশতি ঢাকাকে রাজধানী হিসেবে এলান করায় ঢাকায় আনন্দের ঢল নেমেছে। উঁচু-নিচু সর্বস্তরের মানুষ এ ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে। মোগল সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধি এবং শাহানশাহ্ নূরুদ্দীন মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর ও ইসলাম খানের দীর্ঘায়ু কামনা করে গত জুমার নামাজের পর ঢাকার বিভিন্ন মসজিদে বিশেষ মোনাজাত করা হয়। বিশেষ প্রার্থনাসভা ছিল মন্দিরগুলোতেও। মসজিদ-মন্দিরে ছিল আনন্দবহ পরিবেশ। মোনাজাত ও প্রার্থনাসভায় ঢাকার আশরাফ শ্রেণীর মানুষ, বিভিন্ন পেশার প্রধান ব্যক্তি, স্থানীয় বণিক, মৌলবি-পুরোহিতসহ সর্বস্তরের লোকজন সমবেত হয়।
বিনাত বিবির মসজিদে জুমার নামাজের আগে খুতবায় ইমাম সাহেব বলেন, বাংলার ওপর আল্লাহপাকের অশেষ রহমত নাজিল হয়েছে। আল্লাহর অপার রহমতে রাজমহলের বদলে এখন ঢাকা সুবা বাংলার রাজধানী। 
বিশেষ মোনাজাতে অংশ নিতে আশপাশের এলাকার মুসল্লিরা যেমন এসেছিলেন, তেমনই দূরবর্তী এলাকাগুলো থেকেও এসেছিল অনেক মানুষ। মৈশুণ্ডির লোক যেমন ছিল, তেমনি ছিল নারায়ণদিয়া বা নারিন্দার বাসিন্দাও। এত মুসল্লির সমাগমে মসজিদের প্রবেশপথে টুপি, তসবিহ, আতর ও গোলাপজলের বিক্রি বেড়ে যায় কয়েক গুণ।
মোনাজাতের পর কথা হলো গফুর মিয়ার সঙ্গে। তিনি এসেছেন কলতাবাজার থেকে। তাঁকে বিশেষ আনন্দিত দেখাচ্ছিল। কথা বলে জানা গেল, সকালে দোলাই নদীর তীরে তিনি চার টুকরি বেগুন, ঢ্যাঁড়স, বরবটি, চিচিঙ্গা প্রভৃতি সবজি নিয়ে বসেছিলেন। তাঁর সব সবজি অবিশ্বাস্য কম সময়ে বিক্রি তো হয়েছেই, দামও পাওয়া গেছে ভালো। ভিনদেশি ও ভিন্ন ভাষার তিন-চারজন লোক কোনো দরাদরি না করেই একসঙ্গে তাঁর দুই টুকরি সবজি কিনে নিয়ে গেছে। দোলাই খালের ওপারে অনেক দূর থেকেও লোকজন নদী পেরোচ্ছে। তারাও বেশ কেনাকাটা করেছে। পচা মিয়ার আশা, ব্যবসাপাতি এখন বেশ ভালো জমবে। 
গতকাল বিশেষ প্রার্থনাসভা ছিল ঢাকেশ্বরী মন্দিরেও। বহুদূর থেকেও শোনা গেছে মঙ্গলশাঁখ ও ঢাকবাদ্যের আনন্দধ্বনি। মন্দির প্রাঙ্গণে বসেছিল বিশেষ মেলা। খই-বাতাসা-মুড়কির পাশাপাশি মন্দিরের বাইরে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বসেছিল আলতা, চুড়ি, সিঁদুর ইত্যাদির দোকানি। প্রার্থনাসভায় যোগ দিতে আসা মানুষের মধ্যে ছিল দারুণ আনন্দ-উত্তেজনা।
মন্দিরের বাইরে এক মহিলার সঙ্গে কথা হলো। দুই ছেলেমেয়েকে দুই হাতে ধরে তিনি এসেছেন গেন্ডারিয়া থেকে। নাম শান্তি দাসী। বয়স ৪৩ বছর হলেও তাঁকে মোটেই বৃদ্ধার মতো দেখাচ্ছিল না। দুই ছেলেমেয়ের চেয়ে তাঁর উত্তেজনা আরও অনেক বেশি। এই প্রতিবেদকের এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি ঠোঁট বাঁকিয়ে বললেন, ‘কিসের আবার সোনারগাঁও? ঢাকার সামনে ওর কোনো পাত্তা থাকবে?’

তালিকা হচ্ছে পুরোনো দালানের

শামীম আমিনুর রহমান
সুবাদার শেখ আলাউদ্দীন ইসলাম খান চিশতি ঢাকায় পদার্পণ করে একে মোগল সুবা বাংলার রাজধানী ঘোষণা করার পর জরুরি ভিত্তিতে কিছু কাজ সমাধা করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। সুবাদারের সঙ্গে এসেছে বিরাট সৈন্যবাহিনী, হস্তীবাহিনী, অশ্বারোহী সেনা ও নৌবহর। আরও এসেছেন তাঁর আমির-ওমরাহ ও দেওয়ান-বকশি এবং তাঁদের জেনানা ও পরিবারের সদস্যরা। তাঁদের প্রত্যেকের পদমর্যাদা অনুযায়ী ইমারত ও মহল্লা গড়ে তোলার আশু প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। একই সঙ্গে জরুরি হয়ে পড়েছে রাজধানীকে সুরক্ষা দেওয়া ও পরিকল্পিত উপায়ে গড়ে তোলার জন্য সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ করাও। বস্তুত নতুন সুবাদার ও তাঁর পরিবারের বসবাসের জন্যও কোনো স্থান এখনো নির্ধারণ করা হয়নি। এসব বিষয়ে কয়েক দিন ধরে তিনি নগরবিশারদ ও ওস্তাদ রাজকারিগরদের সঙ্গে নিয়মিত পরামর্শ করছেন। উল্লেখ্য, এখানে পদার্পণ করার পর থেকে তিনি চাঁদনীঘাটের পাশে নদীতে ভাসমান তাঁর প্রিয় বজরা চাঁদনী ও ফতেহ্ দরিয়ায় দিন যাপন করছেন।
দিল্লি থেকে সুবাদারের সঙ্গে আসা একজন নগরবিশারদের সূত্রে জানা গেছে, ইসলাম খান চিশতি ঢাকাকে একটি সৌন্দর্যমণ্ডিত মোগলনগরী হিসেবে গড়ে তোলার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। বুড়িগঙ্গা ও এর সংলগ্ন দোলাই নদীর তীর ঘেঁষেই আমির-ওমরাহদের বসতি গড়ে তোলার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। এতে রাজধানীর প্রবেশপথ সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে থাকবে, যোগাযোগের সুবিধা পাওয়া যাবে এবং পানির বন্দোবস্ত সহজ হবে।
সুবাদার ইসলাম খান চিশতির পরিবার কোথায় থাকবেন, এ প্রতিবেদন লেখার আগ পর্যন্ত সে প্রসঙ্গে কোনো সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে একটি অসমর্থিত সূত্র বলেছে, নিরাপত্তার কারণে নদীর একেবারে তীর ঘেঁষে সুবাদারের থাকার বন্দোবস্ত না-ও করা হতে পারে। নগরীর মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত ঢাকা দুর্গের ভেতরে সুবাদারের প্রাসাদ নির্মাণ করা যায় কি না, সে ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা চলছে।
যুদ্ধে ব্যবহার্য হাতিগুলোর জন্য বুড়িগঙ্গা নদীর কাছাকাছি একটি পিলখানা ও মাহুতদের বসবাসের একটি টুলি বা মহল্লা গড়ে তোলার জন্য বিশেষ স্থান নির্বাচন করাও জরুরি হয়ে পড়েছে। নগরীর বিভিন্ন অংশে পদমর্যাদা অনুযায়ী মহল্লা তৈরি করা ছাড়াও ঢাকাকে একটি অনুপম রাজধানীর চেহারা দেওয়ার জন্য একটি শাহিবাগ বা রাজকীয় উদ্যান তৈরির পরিকল্পনা করতেও সুবাদার বিশেষভাবে নির্দেশ দিয়েছেন। তবে নতুন কোনো উদ্যোগ নেওয়ার আগে তিনি ঢাকার সব রকমের ইমারত ও পাকা দালানের তালিকা করার জন্য যে তাগিদ দিয়েছিলেন, নগরবিশারদেরা সে ব্যাপারে তাঁদের কাজ অনেকটাই গুছিয়ে এনেছেন। একটি প্রাথমিক তালিকা সুবাদারকে দেওয়া হয়েছে এবং সে অনুযায়ী কিছু প্রাথমিক সিদ্ধান্ত ইতিমধ্যেই নেওয়া হয়েছে।
ঢাকায় আসার পথে সুবাদার ইসলাম খান চিশতিকে শীতলক্ষ্যা নদীপথ পার হতে হয়েছে। শীতলক্ষ্যার তীরে কদমরসুল হয়ে ডেমরা নদীপথে তাঁর বজরা বুড়িগঙ্গায় প্রবেশ করে। ডেমরা নদীর মুখে অবস্থিত দুর্গটি কৌশলগত কারণে দখল করা তাঁর কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিল। ঢাকায় প্রবেশের আগেই তাই তাঁর নৌবহর তীব্র লড়াই করে দুর্গটির দখল নিয়ে নেয়। আরও পরে দোলাই নদীর মুখে অবস্থিত বেগ মুরাদ খানের দুর্গটি তাঁরা হস্তগত করেন। বহিঃশত্রুর হাত থেকে রাজধানী ঢাকার প্রতিরক্ষার জন্য এই দুটি দুর্গকেই এখন সুবাদার সবচেয়ে বড় সহায় হিসেবে দেখছেন। তবে একটি বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, ভবিষ্যতে রাজধানীর প্রতিরক্ষাব্যবস্থা শক্তিশালী করার জন্য সুবাদার মূলত নির্ভর করতে চান এ অঞ্চলের সবচেয়ে দুর্ভেদ্য ঢাকা কেল্লার ওপর। তাই তিনি জরুরি ভিত্তিতে ঢাকা কেল্লা সংস্কারের বন্দোবস্ত করার উদ্যোগ নিতে বলেছেন। এই কেল্লার দুই প্রধান প্রবেশদ্বার পূরব দরোয়াজা ও পচ্চিম দরোয়াজা আরও মজবুত করে তোলার জন্যও তিনি নির্দেশ দিয়েছেন।
এ ছাড়া এখন পর্যন্ত ঢাকার যেসব পাকা দালান বা ইমারতের নাম তালিকাভুক্ত হয়েছে, তার প্রায় সবই ধর্মীয় স্থান, যার সিংহভাগ মূলত মুসলিম সাধক ও সুফিদের মাজার। সেগুলির মধ্যে আছে ঢাকার উত্তর-পূর্ব কোণে গৌড়ের শাসকের আদেশে ১৪৭৬ ঈসায়ী সনে পরলোকগত সাধক হজরত শাহজালাল দক্ষিণীর মাজার এবং প্রায় ১৫ মাইল উত্তরে ৪০ দিন চিল্লার পর ১৪৮০ ঈসায়ী সনে পরলোকগত হজরত শাহ আলী বোগদাদির মাজার। হজরত বোগদাদির এক গম্বুজবিশিষ্ট বর্গাকার বাহারি মাজারটি দিল্লির ওস্তাদ কারিগরদের নজর কেড়েছে। মাজারটির লাগোয়া সুলতানি মসজিদ আলাদা দালানের মর্যাদায় তালিকায় স্থান পেয়েছে।
বস্তুত মসজিদগুলিরও প্রয়োজনীয় তথ্যসহ আলাদা একটি তালিকা তৈরির কাজ চলছে। তাতে স্থান পেয়েছে নারায়ণদিয়া বা যাকে লোকে আজকাল ভুলবশত নারিন্দা বলে অভিহিত করে, সেখানকার বিনাত বিবির মসজিদ। হিজরি ৮৬১ সনে বিনাত বিবি এই মসজিদটি স্থাপন করেন। তালিকায় উঠেছে ঢাকা দুর্গের পশ্চিমে নাসওয়ালা গলির তোরণঅলা মসজিদটিও। সুলতান নাসির উদ্দিন মাহমুদের পৃষ্ঠপোষকতায় ইকলিম মুবারকবাদের খাজা জাহানের তদারকিতে এই মসজিদটি নির্মিত হয় ১৪৫৯ ঈসায়ীতে। 
হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পূজার জন্য নির্মিত পাকা দালানের কিছু মন্দিরও তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বল্লাল সেনের স্থাপন করা ঢাকেশ্বরী মন্দির। প্রাচীন এই মন্দিরটি এর আগে ভগ্নদশায় পড়েছিল। বারো ভূঁইয়াদের, বিশেষ করে মসনাদ-ই-আলা ঈসা খানকে দমন করতে মোগল সেনাপতি মানসিংহ ঢাকায় এলে এই মন্দিরটি সংস্কার করেন।

আনন্দে মেতেছে মসলিন তাঁতিরা

আলীম আজিজ
ঢাকা নগরীকে সুবা বাংলার রাজধানী হিসেবে এলান করার পর এই অঞ্চলের মসলিনশিল্পের দিগন্তে নয়া রোশনাই দেখা দিয়েছে। সুবাদার ইসলাম খান ঢাকায় আসছেন, এ খবরে আগেই ঢোল পড়ে গিয়েছিল। কবে তিনি ঢাকায় তশরিফ রাখবেন, সেই দিনটির জন্য ব্যাকুল হয়ে ছিলেন ঢাকা ও সুবর্ণ গ্রাম বা সোনারগাঁওয়ের মসলিনের কারিগরেরা। সুবাদার ঢাকায় পা রাখার পরপরই তাই তাঁতিপল্লিগুলিতে উত্সবের আমেজ ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকা ও এর আশপাশের তাঁতিরা কলাপাতায় দই-চিঁড়া-গুড় দিয়ে প্রতিবেশী ও মেহমানদের আপ্যায়িত করেন। তবে আমাদের সোনারগাঁও প্রতিনিধি জানিয়েছেন, স্থানীয় শাসকদের মন্দ নজরে পড়ার আশঙ্কায় সেখানকার তাঁতিরা ঢাকার মতো তাঁদের মনের আনন্দ খোলামেলা প্রকাশ করতে পারেননি।
তাঁতিরা বলেছেন, দিল্লি থেকে আসা আমির-ওমরাহেদর পরিবার ও আশরাফ জেনানাদের মধ্যে মসলিনের বাহারি শাড়ির কদর বিপুল। এ ছাড়া তাঁদের মাধ্যমে দিল্লিতেও মসলিনের রপ্তানি কয়েক গুণ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাঁতিপল্লিগুলোয় এখন রপ্তানিযোগ্য আব-এ-রওয়াঁ, খাসসা ও শবনম—এই তিন রকমের মসলিন তৈরির ধুম পড়েছে।
এই নতুন সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য কারিগরেরা মহাজনদের কাছ থেকে উচ্চ সুদে ঋণ করছেন। মসলিনের বণিক খয়বর আলী জানালেন, তিনি এরই মধ্যে উত্কৃষ্ট মসলিন তৈরি করার জন্য তিতাবাদি, বাজিতপুর ও ধামরাই থেকে ফুটি কার্পাস খরিদ করেছেন। মদন পরামানিক নামে একজন বণিক ও ইতু মিয়া নামে একজন অবস্থাপন্ন কারিগরের সঙ্গে কথা হলে তাঁরাও একই ধরনের উদ্যোগ নিয়েছেন বলে জানান। 
মসলিন কারিগরেরা মোগল সুবাদারের নতুন প্রশাসনের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন, তাঁরা যেন এ অঞ্চলের শাড়ির বাজার প্রসারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেন। মওকা বুঝে মহাজনেরা যেভাবে সুদের হার বাড়াতে শুরু করেছেন, তাতে তাঁরা গভীর শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তাঁরা এ ব্যাপারেও নতুন প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
আমাদের সোনারগাঁও প্রতিনিধি যে খবর পাঠিয়েছেন, তাতে সেখানে মানুষের মতামত অনেকটা মিশ্র। মোগল শাহানশাহ্ জাহাঙ্গীর বাংলা সুবার দায়িত্ব দিয়ে ইসলাম খানকে ঢাকায় পাঠানোতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন সেখানকার স্থানীয় শাসকেরা। সোনারগাঁওয়ের কয়েকজন ভূঁইয়া ইসলাম খানের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, তাঁরা যেন কোনোক্রমেই সোনারগাঁওয়ে আর নাক গলাতে না আসেন। উল্লেখ্য, মোগল বাহিনী কাছে বারো ভূঁইয়াদের মধ্যে মশহুর বীর মসনদ-ই-আলা মরহুম ঈসা খানের পুত্র মুসা খান রসম্প্রতি পরাজিত হওয়ার পর স্থানীয় শাসকেরা আবার সংগঠিত হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। এই জটিল পরিস্থিতিতে সেখানকার তাঁতিদের মধ্যে ব্যাপক উত্সাহ-উদ্দীপনা থাকলেও প্রকাশ্যে তাঁরা তা চেপে রাখছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কারিগর অবশ্য বলেছেন, রাজা-বাদশাহদের বিরোধের সঙ্গে তাঁদের নিজেদের রুটি-রুজির কোনো সম্পর্ক নেই। তাঁদের আয়-রোজগারের নতুন যে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে, সেটিকে তাঁরা যথাসাধ্য কাজে লাগানোর চেষ্টা করবেন। 
প্রবীণ মহাজনেরা ধারণা করছেন, ঢাকা রাজধানী হওয়ায় এ অঞ্চলে লোকজনের সমাগম বাড়বে। তাতে শুধু মসলিন নয়, নানা দিকেই ব্যবসা-বাণিজ্য আরও বাড়বে, নতুন নতুন কাজের সুযোগ সৃষ্টি হবে। মসলিনশিল্পও এর সুফল থেকে বঞ্চিত হবে না। তাই মসলিনসহ বাংলার ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন শাড়ির নয়া সম্ভাবনার আলোয় কারিগরদের চোখমুখ এখন উজ্জ্বল।

ঢাকায় অচিরেই স্থাপিত হচ্ছে টাঁকশাল

শরিফুজ্জামান
রাজধানী ঘোষণার পর বাংলা সুবার প্রশাসনিক সদর দপ্তর ও বাণিজ্যকেন্দ্র ঢাকায় টাঁকশাল স্থাপন অনিবার্য হয়ে পড়েছে। রাজস্ব মন্ত্রকের দায়িত্বপ্রাপ্ত দেওয়ান আবুল হাসান জানিয়েছেন, নতুন রাজধানীতে টাঁকশাল স্থাপনের সিদ্ধান নেওয়া হয়েছে। প্রাথমিকভাবে টাঁকশালের স্থানও নির্ধারণ করা হয়েছে। ঢাকা কেল্লা সংস্কার করে সেখানে টাঁকশাল স্থাপন করা হবে। এই টাঁকশালে শুধু টাকা বা ধাতব মুদ্রা সংরক্ষণ করা হবে না, মুূদ্রা তৈরির ব্যবস্থাও থাকবে। ভবিষ্যতে রাজস্ব সংগ্রহের মাধ্যম হিসেবে এই টাঁকশাল ব্যবহার করার সম্ভাবনা রয়েছে। 
নতুন রাজধানীর সামগ্রিক উন্নয়নে বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন। এই অর্থ আয় করে প্রথমে তা টাঁকশালে রাখা হবে। টাঁকশালে মুদ্রা সংরক্ষণ ছাড়াও টাকা তৈরির উপায় নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে। প্রশাসন আশা করছে, নতুন রাজধানী অচিরেই বাংলার প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিণত হবে। বিশেষত মসলিন বস্ত্রের বাজার হিসেবে ঢাকায় বিপুল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হবে। বাণিজ্যের জন্য ইউরোপীয় কোম্পানি, দাদন ব্যবসায়ী ও বড় বণিকেরা সোনা ও রুপা নিয়ে ঢাকায় আসবেন। তাঁদের লেনদেনের সুবিধার্থে ধাতু থেকে স্থানীয় মুদ্রা তৈরির ব্যবস্থা রাখা হবে টাঁকশালে। মুদ্রা তৈরির জন্য মোগল রাজকোষে সাড়ে তিন শতাংশ হারে শুল্ক দিতে হবে। এ শুল্ক দেওয়া সাপেক্ষে নতুন মুদ্রা তৈরি করার জন্য দিল্লি থেকে অনুমতি মিলবে। 
উল্লেখ করা যেতে পারে, ১২০৪ ঈসায়ী সনে ইখতিয়ারউদ্দীন বিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজির বাংলা বিজয়ের পর থেকেই বাংলায় টাঁকশাল স্থাপিত হতে থাকে। বিগত সুলতানি আমলে বাংলার রাজধানী সোনারগাঁসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র ও পরগনাগুলোতে টাঁকশাল স্থাপিত হলেও ঢাকায় অদ্যাবধি কোনো টাঁকশাল স্থাপন করা হয়নি। টাঁকশাল না থাকায় ব্যবসাবাণিজ্যের ক্ষেত্রে ঢাকাবাসী ও বিদেশি বণিকেরা স্থানীয় মুদ্রার সংকট নিয়ে নানা ধরনের সমস্যায় জেরবার হচ্ছিলেন। 
নতুন রাজধানীতে টাঁকশাল স্থাপনের সিদ্ধান্ত জেনে বণিক ও মহাজনদের মধ্যে বিপুল উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছে।

শাহি ফরমান

বুড়িগঙ্গায় ছয় ক্রোশ নৌচলাচল নিষিদ্ধ


সুবাদারের দপ্তর থেকে জারি করা এক ফরমানে বুড়িগঙ্গায় চাঁদনীঘাটের ছয় ক্রোশের মধ্যে সব ধরনের নৌযান চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অবিলম্বে এ ফরমান কার্যকর হবে। আইন লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান করে বিধিমালা তৈরির কাজ চলছে বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, সুবাদার ইসলাম খান চিশতি আপাতত শাহি বজরা চাঁদনীতে বসবাস করছেন। সুবাদারের বজরা নোঙর করার পর কৌতূহলী জনতা চাঁদনীঘাটের আশপাশে প্রায়ই ভিড় জমাচ্ছিল। এতে সুবাদারের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। এ ছাড়া বজরায় বসবাসরত নবাব পরিবারের জেনানাদের গোপনীয়তা রক্ষিত হচ্ছিল না। 
জানা গেছে, জনতার অতিরিক্ত ও অমার্জিত কৌতূহলে সুবাদার ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা বিব্রত ও বিরক্ত বোধ করছেন। এ কারণে সুবাদারের নিরাপত্তা ও জেনানাদের আবরুর হেফাজত রক্ষার জন্য চাঁদনীঘাটকে কেন্দ্র করে উভয় পাশে ছয় ক্রোশের মধ্যে কোষা, ডিঙি, ছিপ, পানসি, বজরা, সাম্পানসহ সব ধরনের নৌযান চলাচল সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

শুকরিয়া আদায় করেছেন শাহানশাহ্ জাহাঙ্গীর


সুবাদার ইসলাম খান চিশতি দিল্লি থেকে সাফল্যের সঙ্গে ঢাকায় গিয়ে পৌঁছাতে পারায় গভীর সন্তোষ প্রকাশ করেছেন শাহানশাহ্ নূরুদ্দীন মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর। শাহানশাহ্ বলেন, ইসলাম খানের ওপর যে ভরসা করে তিনি দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন, তা তিনি সফলভাবে পূরণ করেছেন। এবার বাংলা মুলুকে শান্তি কায়েমের পথ সুপ্রশস্ত হলো। এ জন্য তিনি খোদার কাছে হাজার শুকরিয়া আদায় করেন। তিনি বলেন, তাঁদের সফলতার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি নতুন সুবাদার, দেওয়ান ও মির-ই-বহরের জন্য উপহার পাঠিয়েছেন। গতকাল ফতেহ্পুর সিক্রিতে শাহানশাহ্র দরবার-ই-খাসে প্রথম আলোর প্রতিনিধির কাছে তিনি এসব খোশখবর পেশ করেন।
এক প্রশ্নের জবাবে শাহানশাহ্ বলেন, ‘ইসলাম খান বয়সে আমার প্রায় কাছাকাছি। আমরা বড়ও হয়েছি পাশাপাশি। তার পরও তাঁকে আমি ফরজান্দ বা পালিত পুত্রের মতো জ্ঞান করি। তাই মওকা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাত্ক্ষণিকভাবে তাঁকে আমি বাংলার সুবাদারের দায়িত্ব দিতে তিলমাত্র দ্বিধা করিনি।’ শাহানশাহ্ বলেন, ইসলাম খানকে দায়িত্ব দেওয়ার দিনটির কথা তাঁর মনে রোশনাই হয়ে আছে। দিনটি ছিল ১০১৭ হিজরির ২০ মহররম, ১৬০৮ ঈসায়ী সনের মে মাস। বার মঙ্গল। সে দিন দরবার-ই-খাসে উজিরদের সঙ্গে সলা করার সময় বাংলার সুবাদার জাহাঙ্গীর কুলি খানের ইন্তেকালের খবর আসে। তাঁর সেরা ও অনুগত এই ক্রীতদাসের মৃত্যুসংবাদে তিনি অত্যন্ত মর্মাহত হন।
তিনি বলেন, ‘আমি তাত্ক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে ইসলাম খানকে বিহার সুবা থেকে তলব করে বাংলা সুবার দায়িত্ব নেওয়ার আদেশ দিই। তাঁর বদলে বিহার সুবার দায়িত্ব নিতে বলি মশহুর পণ্ডিত আবুল ফজলের পুত্র আফজাল খানকে।’
শাহানশাহ্ জানান, তিনি ইসলাম খানকে কেবল দায়িত্ব দিয়েই খালাস হননি, তাঁর মর্যাদাও প্রভূত পরিমাণে বাড়িয়ে দিয়েছেন। জানা গেছে, দায়িত্ব অর্পণের সঙ্গে সঙ্গে নতুন সুবাদারের সম্মান চার হাজার সৈন্য ও তিন হাজার অশ্বের মনসবে উন্নীত করা হয়। পাশাপাশি তাঁকে সহযোগিতা করার জন্য ইহতিমাম খানকে বাংলার প্রধান নৌ-অধিকর্তার পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। এর আগে ইহতিমাম খানকে মির-ই-বহর উপাধি দিয়ে তাঁর মর্যাদা উন্নীত করা হয় এক হাজার সৈন্য ও তিনশ অশ্বের মনসবে।

কর্মব্যস্ত দিন কাটালেন সুবাদার

মাহবুব আলম
গতকাল পুরো দিনটিই প্রচণ্ড ব্যস্ততায় কাটালেন জাহাঙ্গীরনগর তথা ঢাকার নবনিযুক্ত সুবাদার শেখ আলাউদ্দীন ইসলাম খান চিশতি। দিনভর ঢাকা দুর্গের বিশাল তাঁবুতে নগরের অভিজাত ও শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা জমায়েত হন সুবাদারকে খোশ-আমদেদ জানাতে। হাজিরানে মজলিশের মধ্যে ছিলেন উচ্চপর্যায়ের মনসবদার, প্রখ্যাত জমিদার, বিভিন্ন পেশার প্রধান ব্যক্তিত্ব ও নানা ধর্মীয় গোষ্ঠীর নেতা। হাজির ছিলেন ঢাকার আলেম-মাশায়েখ, মসজিদ ও দরগার মোতোয়াল্লিরা। সঙ্গে ছিলেন বিভিন্ন মহল্লার প্রধান ও স্থানীয় বহিরাগত বণিক গোষ্ঠীর নেতারা। সুবাদারকে মোবারকবাদ জানাতে উপস্থিত হয়েছেন সুবার উচ্চপদস্থ ফৌজি ও শাহি কর্মকর্তারা। তাঁদের মধ্যে ছিলেন দেওয়ান মুতাকিদ খান, বকশি খাজা তাহির মোহাম্মদ, মির-ই-বহর ইহতিমাম খান ও সুসংয়ের জমিদার রঘুনাথ। সবাই শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসেবে বহুমূল্য নজরানা ও পেশকার দিয়েছেন সুবাদারকে।
মনসবদার ও ঢাকার জমিদাররা নজরানা হিসেবে পেশ করেছেন সোনার আশরাফি, নগদ সিক্কা টাকা, হাতির দাঁত, হাতির দাঁতের তৈরি সিংহাসন, কুরসি ও হাতির দাঁতের আঁশে তৈরি শীতলপাটি। সঙ্গে কয়েকজোড়া উত্কৃষ্ট ইরাকি, শঙ্কর, টাঙ্গান ঘোড়া। দারোগা-ই-মলবুস খাসওয়া তাঁতখানার নজরানা হলো ২৫টি মূল্যবান জামদানি কাপড় ও ৫০টি উত্কৃষ্ট মসলিন খণ্ড। ক্ষত্রী ও অন্য বণিকেরা পেশ করেছেন মণিমুক্তাখচিত তরবারি ও খঞ্জরের কোমরবন্ধ। এ ছাড়া পেশ করেছেন সোনা ও বহুমূল্য পাথরে খচিত পাগড়ির শিরপ্যাঁচ, কারুকাজ করা সোনার ফরসি বা গড়গড়া, ঢাকার বিখ্যাত তারের কাজের রুপার আতরপাশ, গোলাপপাশ, শামাদান ও সুদৃশ্য পানদানি। তাঁদের নজরানার মধ্যে আরও ছিল এক মণ আতর তৈরির উত্কৃষ্ট আগর কাঠ, কয়েকটি কাচিচ ও রঙিনজাতীয় ঘোড়া এবং খাঞ্চাভরা সুগন্ধি দ্রব্য। শেখ-মাশায়েখরা দিলেন সোনার পানিতে অলংকৃত হাতে লেখা পবিত্র কোরান শরিফ এবং আকিক ও পান্নায় তৈরি তসবিহর ছড়া। বহিরাগত বণিকেরা পেশ করেছেন সোনার আশরাফি, উত্কৃষ্ট গালিচা, মূল্যবান পাথর, কাচের তৈরি সুদৃশ্য পানপাত্র ও দুরবিন। ইরাকি, রঙিন ও টাঙ্গানজাতীয় কয়েকটি ঘোড়াও ছিল এর সঙ্গে। সুবাদার এসব উপহারের কিছু কিছু রেখে বাকি অংশ ধন্যবাদের সঙ্গে ফিরিয়ে দিয়েছেন।
অনুষ্ঠানের শেষে সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি সুবাহর সুশাসন, নাগরিক জীবনের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতির প্রতিশ্রুতি দেন। নগরের নিরাপত্তার জন্য এক বিশাল মোগল সৈন্যবাহিনী ও মোগল নওয়ারা মোতায়েনের ঘোষণা দিয়ে সড়ক ও জনপথকে চোর-ডাকাতের উপদ্রব ও নৌবাণিজ্যকে জলদস্যুর হাঙ্গামা থেকে মুক্ত রাখার অঙ্গীকার করেন তিনি। বাংলার বিদ্রোহী ভূঁইয়াদের ক্রমাগত হামলার বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে তাঁদের আত্মসমর্পণের জন্যও পুনরায় আহ্বান জানান। আত্মসমর্পণকারী বিদ্রোহী নেতাদের জন্য বাদশাহ সালামতের তথা শাহানশাহ্ জাহাঙ্গীরের পক্ষ থেকে উদার শর্ত ঘোষণা করে তাঁদের ক্ষমা প্রদর্শন ও মনসবদারের মর্যাদা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। এ প্রসঙ্গে সমবেত জমিদার, ভূস্বামী ও ধনী বণিকদের তিনি নৌকা, হাতি, যানবাহন ও রসদ দিয়ে মোগল বাহিনীকে বিদ্রোহীদের দমনে সহায়তা করার নির্দেশ দেন। খাদ্যশস্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মজুদদারি ও মূল্যবৃদ্ধির ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারি দেন তিনি। রাজস্ব সংগ্রহের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের ন্যায়ানুগভাবে কর আদায়ের ও আদায়কৃত করের যথাযথ হিসাবরক্ষণেরও নির্দেশ দেন।
অপরাহ্নে তিনি ঢাকা কেল্লার বিপরীতে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে ওই দিন বিকেলে চাঁদনীঘাটে শাহি রণতরীর বহর পরিদর্শন করেন। পোলো খেলার মাঠে তাঁর মোগল সৈন্যের কুচ ও হস্তি বাহিনীর প্রদর্শনী দেখার কথা ছিল। কিন্তু বৃষ্টির কারণে অনুষ্ঠানটি স্থগিত করা হয়েছে।

পাঠককে খোশ আমদেদ

মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের নির্দেশে সুবাদার ইসলাম খান ১৬১০ সালের বর্ষাকালে ঢাকা এসে পৌঁছান। ঢাকা হয় বাংলা সুবার রাজধানী। রাজধানী ঢাকার ৪০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রকাশিত হলো প্রথম আলোর এই বিশেষ মলাট ক্রোড়পত্র।
ক্রোড়পত্রের রচনাগুলো কল্পিত হলেও ঐতিহাসিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে রচিত। উদ্ধৃতিচিহ্নে ব্যবহূত ঐতিহাসিক চরিত্রগুলোর বক্তব্যে চেষ্টা করা হয়েছে সত্যনিষ্ঠতা রক্ষার। স্থানাভাবে নাম দেওয়া না গেলেও এ ক্রোড়পত্রে বহু গবেষণাগ্রন্থের সহায়তা নেওয়া হয়েছে। 
এ সংখ্যার নামা-অনামা লেখাগুলো লিখেছেন মাহবুব আলম, পারভেজ হোসেন, শামীম আমিনুর রহমান, শরিফুজ্জামান, আশীষ-উর-রহমান, জাফর আহমদ রাশেদ, আলীম আজিজ ও সাজ্জাদ শরিফ।