মুস্তাফা জামান আব্বাসী | তারিখ: ১২-০১-২০১২
হাজার হাজার লোক হাসনের গান শুনতে এসেছে। কেউ তাঁকে দেখেনি, শুধু নাম শুনেছে। সুনামগঞ্জে তৃতীয়বারের মতো যাওয়ার আমন্ত্রণ পেলে খুশি হওয়ারই কথা, যেখানে মাটির বিছানায় শুয়ে কবি দীর্ঘদিন। নির্মলেন্দু চৌধুরীর কল্যাণে বিশ্ববিশ্রুত। ছেলে উৎপলেন্দু চৌধুরী গানগুলো জিইয়ে রাখেন কলকাতায়। তিনিও লোকান্তরিত। উজির মিয়া, বিদিতলাল দাস, আরতি ধর ও এই অভাজনের মতো কয়েকজনের প্রস্থান হলেই হাসনগীতির প্রথম গায়কেরা মঞ্চ থেকে বিদায় নেবেন।
মঞ্চে গিয়ে গাইলাম যে গান: ‘হাসন রাজায় বলে/ ও আল্লা ঠেকাইলায় ভবের জালে’—এটি তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ গান বলে আমার ধারণা। হাসন রাজা কী ও কেন তা নিয়ে গবেষণা চলছে। কিছু বলেছি জালালউদ্দিন রুমির স্মরণসভায়, তুরস্কের ইস্তাম্বুলে ২০০৮ সালে ঘর ভর্তি পণ্ডিত-সভায়। প্রবন্ধটি ছাপা হয়েছে এবং যথারীতি কেউ পড়েননি। বলেছি, রুমি ও হাসন সমগোত্রীয়, একজন তুরস্কের, অন্যজন সুনামগঞ্জের; একজন ৮০০ বছর আগের, একজন তার পরের। গানগুলো গাইতে গেলে মনে পড়বে রুমির মস্নবি ও নাত। ১০-১২টি গান গাইলে এবং তার বিবরণ করলে হাসন রাজা সামনে এসে পড়েন। প্রভাবশালী ব্যক্তিরা পার্টি ব্যানারে তাঁকে নিয়ে উপস্থিত হন, আমরা যারা কিছু বুঝে উঠতে না পেরে হতভম্ব। উনি ছিলেন জমিদার, শেষ পর্যন্ত তা-ই থাকলে তাঁকে নিয়ে আজকের এই উৎসব হতো না। তাঁদের কেউ মনে রাখে না। মনে রাখে তাঁদের, যাঁরা জমিদারি ছেড়ে সবচেয়ে বড় জমিদারের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। একই কথা লালন ও রাধারমণ সম্পর্কে। উদ্যোক্তারা জিজ্ঞেস করেন, আপনি লোকসংস্কৃতির লোক, কোথায় সেট করি আপনাকে। শোনাই রবীন্দ্রনাথের গান: ‘সবার শেষে যা বাকি রয় তাহাই লব/ তোমার চরণ ধুলায় ধুলায় ধূসর হব’। ওরা চট করে বুঝতে পারে না। বলি, সবার শেষে দিন।
উনি সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত, তবু জমিদারের ঠাটবাটের ধার ধারতেন না। গ্রামেই বাড়ি এবং তাঁদের সঙ্গে একাত্ম হয়েই জীবন কেটেছে, পাঁচজনের মতো বড়মানুষির বেড়া তুলে ধরেননি। লুঙ্গির মতো করে পরা একখানা ছোট ধূতি, গায়ে বা গলায় একখানা চাদর থাকত কি থাকত না, আর পায়ে কাঠের খড়ম—এই তো হাসন রাজা। সংসার ছেড়ে নয় সন্ন্যাস। গাইছেন: ‘সোনার কোটি মানুষ দেখ বসিয়া অন্তরে/ ঝলমল ঝলমল করে রে’। গবেষকেরা—প্রভাতচন্দ্র গুপ্ত, ড. আবদুল ওয়াহাব, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ—হাসন রাজাকে তুলে ধরেছেন।
১৮৯৭ সালের ১২ জুন বড় ভূমিকম্প হলে ৮ দশমিক ৮ স্কেলের এই ভূমিকম্প হাসন রাজাকে কাঁপিয়ে দেয়। লেখেন: ‘ভূমিকম্পের মাসে বন্ধু ফিরে দেখা দিল.../ প্রেমের ফাঁদে বন্দী করিয়া অন্তরে ছাপাইল’। তিনি কাঁচাঘর ত্যাগ করেননি। সহজ-সরল বাঁশের মাটির ছনের তৈরি চৌচালা ঘরটি ১৪ থেকে ১৬ ফুট উঁচু ছিল, ঘরের মধ্যে অনেকগুলো সারি সারি ঘর। বৃষ্টির পানি ছনের ফাঁক দিয়ে চুয়ে পড়ত হাসন রাজার বিছানায়। দিলারাম বলছেন: ‘বৃষ্টির পানি পড়লে আমরা সাহেবের বড় ছাতাটি বিছানার উপর টাঙাইয়া দিতাম। তুফানের সময় ঘরের কোণে লুকাতেন এবং আল্লার নাম জপ করতেন। গাইতেন: দয়াল বন্ধু ও দয়াধর মুই অধমেরে/ কৃপা করিয়া করা দয়া ডাকি হে তুমারে’। ১৯১০ সালে হাসন রাজা ঢাকায় এসেছিলেন দুই মাসের জন্য। ছেলে গনিউর রেজা তাঁর জন্য একটি পাকা বাড়ি তৈরি করতে উদ্যত হন। সুনামগঞ্জে ফিরে এসেই ছেলেকে করলেন তিরস্কার: এটি আমাদের জন্য নয়, বাবা। গাইলেন: ‘হাসন রাজা রে মইলে বসতি হইবে কই/ কোথা থাকি আসিয়াছি কোথা আসিয়া রই’। আজকের দিনের বড়লোকেরা তাঁর গান শুনছেন, তাঁর দর্শনের ধারেকাছেও নেই। যিনি যত সম্ভ্রান্ত, তাঁর বাড়িতে তত জৌলুশ। সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা হাসনের গানের কিছুই বোঝেননি।
গান গাওয়ার সময় ২০ হাজার মানুষ। প্রধান অতিথি জিজ্ঞেস করলেন, গান, না বক্তৃতা। শ্রোতারা সমস্বরে বলল: গান, গান, গান। এ কেমন অতিথি, বক্তৃতা করতে করতে ধরেন গান, আবার বক্তৃতা, অশ্রুজলের সঙ্গে কবির দর্শন। দর্শন আর কিছু নয়, রাসুলুল্লাহ [সা.]-এর জীবন, যিনি মাটিতে শুতেন, খেতেন মাটির পেয়ালায়, তা-ও একবেলা, ঘুমুতেন কম, আল্লাহর স্মরণই তাঁর ঘুম। হাসন রাজা গাইছেন: ‘তোমার ঘর তোমার বাড়ি তোমার বাগিচা/ যে দেখিল সত্য দেখেছে, যে না দেখে মিথ্যা’।
এবার বলি, আসমা ও আমি সুনামগঞ্জে গিয়ে কী পেলাম। লন্ডন, আমেরিকা সর্বত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা হাসন রাজার প্রপৌত্ররা, তাঁদের ছেলেমেয়েরা, বউরা কী সযতনে যে আমাদের রেখেছেন একটি দিন, স্মরণের মণিকোঠায় তা অক্ষয় হয়ে রইল। হাসনকে দেখিনি, গান গেয়ে গেছি। এঁদের সন্তানদের মুখের আদলে সুমধুর ব্যবহারে, আতিথেয়তায় যেন উপস্থিত মহান কবি। এই উৎসবের কর্ণধার সামারীন দেওয়ান, আমার গানের পর আমার অনুরোধে একটি গান গেয়ে শোনালেন। সাধা গলা নয়, যেন আমি দেখতে পেলাম বহু দিন আগের হাসন রাজাই এসে তাঁর গান গেয়ে গেলেন।
হাসন রাজা ইনস্টিটিউট হচ্ছে সিলেটে, সুনামগঞ্জে, লন্ডনে। বাউল ও সুফি মিলিয়ে বাংলার নিজস্ব মানসিক ফসল। তার সঙ্গে ইবনুল আরবির মিল, যিনি সবকিছুর মধ্যে আল্লাহকে খুঁজে পান। কেউ বা ব্যান্ডের তালে তালে নাচছে, সেটা অপরাধ নয়, সেই সঙ্গে মনকেও নাচতে হবে।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্য-সংগীতব্যক্তিত্ব।
mabbasi@dhaka.net
মঞ্চে গিয়ে গাইলাম যে গান: ‘হাসন রাজায় বলে/ ও আল্লা ঠেকাইলায় ভবের জালে’—এটি তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ গান বলে আমার ধারণা। হাসন রাজা কী ও কেন তা নিয়ে গবেষণা চলছে। কিছু বলেছি জালালউদ্দিন রুমির স্মরণসভায়, তুরস্কের ইস্তাম্বুলে ২০০৮ সালে ঘর ভর্তি পণ্ডিত-সভায়। প্রবন্ধটি ছাপা হয়েছে এবং যথারীতি কেউ পড়েননি। বলেছি, রুমি ও হাসন সমগোত্রীয়, একজন তুরস্কের, অন্যজন সুনামগঞ্জের; একজন ৮০০ বছর আগের, একজন তার পরের। গানগুলো গাইতে গেলে মনে পড়বে রুমির মস্নবি ও নাত। ১০-১২টি গান গাইলে এবং তার বিবরণ করলে হাসন রাজা সামনে এসে পড়েন। প্রভাবশালী ব্যক্তিরা পার্টি ব্যানারে তাঁকে নিয়ে উপস্থিত হন, আমরা যারা কিছু বুঝে উঠতে না পেরে হতভম্ব। উনি ছিলেন জমিদার, শেষ পর্যন্ত তা-ই থাকলে তাঁকে নিয়ে আজকের এই উৎসব হতো না। তাঁদের কেউ মনে রাখে না। মনে রাখে তাঁদের, যাঁরা জমিদারি ছেড়ে সবচেয়ে বড় জমিদারের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। একই কথা লালন ও রাধারমণ সম্পর্কে। উদ্যোক্তারা জিজ্ঞেস করেন, আপনি লোকসংস্কৃতির লোক, কোথায় সেট করি আপনাকে। শোনাই রবীন্দ্রনাথের গান: ‘সবার শেষে যা বাকি রয় তাহাই লব/ তোমার চরণ ধুলায় ধুলায় ধূসর হব’। ওরা চট করে বুঝতে পারে না। বলি, সবার শেষে দিন।
উনি সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত, তবু জমিদারের ঠাটবাটের ধার ধারতেন না। গ্রামেই বাড়ি এবং তাঁদের সঙ্গে একাত্ম হয়েই জীবন কেটেছে, পাঁচজনের মতো বড়মানুষির বেড়া তুলে ধরেননি। লুঙ্গির মতো করে পরা একখানা ছোট ধূতি, গায়ে বা গলায় একখানা চাদর থাকত কি থাকত না, আর পায়ে কাঠের খড়ম—এই তো হাসন রাজা। সংসার ছেড়ে নয় সন্ন্যাস। গাইছেন: ‘সোনার কোটি মানুষ দেখ বসিয়া অন্তরে/ ঝলমল ঝলমল করে রে’। গবেষকেরা—প্রভাতচন্দ্র গুপ্ত, ড. আবদুল ওয়াহাব, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ—হাসন রাজাকে তুলে ধরেছেন।
১৮৯৭ সালের ১২ জুন বড় ভূমিকম্প হলে ৮ দশমিক ৮ স্কেলের এই ভূমিকম্প হাসন রাজাকে কাঁপিয়ে দেয়। লেখেন: ‘ভূমিকম্পের মাসে বন্ধু ফিরে দেখা দিল.../ প্রেমের ফাঁদে বন্দী করিয়া অন্তরে ছাপাইল’। তিনি কাঁচাঘর ত্যাগ করেননি। সহজ-সরল বাঁশের মাটির ছনের তৈরি চৌচালা ঘরটি ১৪ থেকে ১৬ ফুট উঁচু ছিল, ঘরের মধ্যে অনেকগুলো সারি সারি ঘর। বৃষ্টির পানি ছনের ফাঁক দিয়ে চুয়ে পড়ত হাসন রাজার বিছানায়। দিলারাম বলছেন: ‘বৃষ্টির পানি পড়লে আমরা সাহেবের বড় ছাতাটি বিছানার উপর টাঙাইয়া দিতাম। তুফানের সময় ঘরের কোণে লুকাতেন এবং আল্লার নাম জপ করতেন। গাইতেন: দয়াল বন্ধু ও দয়াধর মুই অধমেরে/ কৃপা করিয়া করা দয়া ডাকি হে তুমারে’। ১৯১০ সালে হাসন রাজা ঢাকায় এসেছিলেন দুই মাসের জন্য। ছেলে গনিউর রেজা তাঁর জন্য একটি পাকা বাড়ি তৈরি করতে উদ্যত হন। সুনামগঞ্জে ফিরে এসেই ছেলেকে করলেন তিরস্কার: এটি আমাদের জন্য নয়, বাবা। গাইলেন: ‘হাসন রাজা রে মইলে বসতি হইবে কই/ কোথা থাকি আসিয়াছি কোথা আসিয়া রই’। আজকের দিনের বড়লোকেরা তাঁর গান শুনছেন, তাঁর দর্শনের ধারেকাছেও নেই। যিনি যত সম্ভ্রান্ত, তাঁর বাড়িতে তত জৌলুশ। সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা হাসনের গানের কিছুই বোঝেননি।
গান গাওয়ার সময় ২০ হাজার মানুষ। প্রধান অতিথি জিজ্ঞেস করলেন, গান, না বক্তৃতা। শ্রোতারা সমস্বরে বলল: গান, গান, গান। এ কেমন অতিথি, বক্তৃতা করতে করতে ধরেন গান, আবার বক্তৃতা, অশ্রুজলের সঙ্গে কবির দর্শন। দর্শন আর কিছু নয়, রাসুলুল্লাহ [সা.]-এর জীবন, যিনি মাটিতে শুতেন, খেতেন মাটির পেয়ালায়, তা-ও একবেলা, ঘুমুতেন কম, আল্লাহর স্মরণই তাঁর ঘুম। হাসন রাজা গাইছেন: ‘তোমার ঘর তোমার বাড়ি তোমার বাগিচা/ যে দেখিল সত্য দেখেছে, যে না দেখে মিথ্যা’।
এবার বলি, আসমা ও আমি সুনামগঞ্জে গিয়ে কী পেলাম। লন্ডন, আমেরিকা সর্বত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা হাসন রাজার প্রপৌত্ররা, তাঁদের ছেলেমেয়েরা, বউরা কী সযতনে যে আমাদের রেখেছেন একটি দিন, স্মরণের মণিকোঠায় তা অক্ষয় হয়ে রইল। হাসনকে দেখিনি, গান গেয়ে গেছি। এঁদের সন্তানদের মুখের আদলে সুমধুর ব্যবহারে, আতিথেয়তায় যেন উপস্থিত মহান কবি। এই উৎসবের কর্ণধার সামারীন দেওয়ান, আমার গানের পর আমার অনুরোধে একটি গান গেয়ে শোনালেন। সাধা গলা নয়, যেন আমি দেখতে পেলাম বহু দিন আগের হাসন রাজাই এসে তাঁর গান গেয়ে গেলেন।
হাসন রাজা ইনস্টিটিউট হচ্ছে সিলেটে, সুনামগঞ্জে, লন্ডনে। বাউল ও সুফি মিলিয়ে বাংলার নিজস্ব মানসিক ফসল। তার সঙ্গে ইবনুল আরবির মিল, যিনি সবকিছুর মধ্যে আল্লাহকে খুঁজে পান। কেউ বা ব্যান্ডের তালে তালে নাচছে, সেটা অপরাধ নয়, সেই সঙ্গে মনকেও নাচতে হবে।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্য-সংগীতব্যক্তিত্ব।
mabbasi@dhaka.net
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন