মুস্তাফা জামান আব্বাসী
ঈদের মাঠে দেখা হওয়া, ঈদের মাঠে এটাই চাওয়া-পাওয়া। শিশু বয়সে কোচবিহারের মাঠে বাবার হাত ধরে ঈদের মাঠে যাওয়ার স্মৃতি ভিড় করে। বুঝতে পারি ওই দিনটির মতো হয় না। ছোট্ট পৃথিবীর নানা দেশে শত মসজিদে নামাজ আদায়—ফজর থেকে এশা। কোথাও ইফতার, তারাবি।
গত জুলাই মাসে আমেরিকায় এসে ভাবছি প্রেসিডেন্ট বারাক হোসেন ওবামার কথা। তাঁর নানা পরিকল্পনার মধ্যে একটি, মুসলমানদের সঙ্গে বিবাদ মিটিয়ে ফেলা। ওবামা এবার বুঝি কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ঈদের মাঠে এসে দেখা দেবেন। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ঈদের জামাতে ওবামা দেখা দেবেন, মুসলিম বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করার মতো সংবাদ বৈকি।
আমার কাহিনী অনেক দীর্ঘ, অল্প একটু বলছি। বালটিমোরে ঈদের জামাতে এসে দেখা পেলাম ড. নিয়াজের। সেই ১৯৯০ সালে। নিয়াজ তখনো ঢাকার ডাকসাইটে চক্ষু সার্জন হয়ে ওঠেনি। পড়াশোনা করছে। বলল, ‘চাচা, কী যে ভালো লাগছে আপনাকে পেয়ে। সুদূর দেশান্তরে মনে হচ্ছে যেন আপন পিতাকেই পেয়েছি কাছে।’ শ দুয়েক বাঙালি এসেছেন ঈদের মাঠে, জায়নামাজ হাতে। উত্সাহ চোখে পড়ে নতুন টুপি ও নতুন জামায়। খালেদ ও মেয়ে সামিরা পড়াশোনা করছে জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে। বালটিমোরে আমাদের ছোট্ট সংসার, বাসায় অপেক্ষমাণ দুই মেয়ে ও স্ত্রী আসমা। দুধ সেমাই ও জর্দা সেমাই নিয়ে। সেমাই নেই, ঈদও নেই।
আমেরিকায় এসে বোঝার চেষ্টা করি কীভাবে ধর্ম বর্মের মতো আচ্ছাদন করেছে মুসলমানদের। কোণঠাসা হয়ে মসজিদে, ঈদের জামাতে নিজেদের নতুন করে আবিষ্কার করছে তারা। ইহুদিরা ‘হলোকস্টের’ পরে আবার নতুন করে ধর্মের প্রতি নিবিষ্ট হয়। ৯/১১-এর পরে নানা দেশ থেকে আগত অধিবাসীরা মসজিদমুখী। এক দিনের ঈদের জামা পরা নয়, মুসলমান হওয়ার পোশাক। কয়েক শ মসজিদ, কয়েকটিতে সিজদা দিয়েছি। নিউ মেক্সিকোর লাসক্রুসাস শহরের কাছে আবিকিউ, নির্মাণশৈলীতে পৃথিবীর দর্শনীয় মসজিদ, এস্কিমোদের বাড়ির আদলে তৈরি মসজিদটি। ওয়াশিংটন ডিসির মসজিদ কর্ডোভার ডিজাইনে, দৃষ্টিকে করে আপ্লুত, যেন স্পেনে চলে গেছি। নিউইয়র্কে ১০টি মসজিদের মধ্যে নামাজ আদায় করে লক্ষাধিক বাঙালি। নির্মাণশৈলীতে আমেরিকার মসজিদের মতো এত বৈচিত্র্য আর কোথাও পাইনি। মুসলমানের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বাঙালি দেশান্তরি হওয়ার সময় কোরআন শরিফকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে এবং আমেরিকার মাটিতে নতুন করে বপন করেছে বিশ্বাসের চারা। কেউ বলেছে, তোমাদের মানুষের চোখে এত পানি? বললাম, তাদের সহায় যে ওই অশ্রুটুকুই, বিধাতার কাছে যা সমর্পিত। আবার কেউ এসে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে।
বাঙালি মসজিদ? সাউথ ফ্লোরিডার বোকারটন শহরে পাঁচ একর জায়গা নিয়ে গড়ে ওঠা ছায়াঢাকা, পাখিডাকা ঘন সবুজের আড়ালে মসজিদ। প্রথম দেখাতেই মন ভরে গেল। চারধার সবুজ, যেন বাংলাদেশ। ২০০ বাঙালি শুনতে এসেছে অদেখা শিল্পী ও লেখকের গান, বক্তৃতা। দুই ঘণ্টা নবীর জীবনের ঘটনা-নির্যাস তুলে ধরার ফাঁকে পরিবেশন করছি নাত ও হামদ। ঘন ঘন চোখের পানি মুছছেন বাঙালি ঘরনিরা, তাঁদের স্বামীরা। নজরুল ও আব্বাসউদ্দীনের সাক্ষাত্ প্রতিনিধি তাঁদের সামনে। বললাম, শখ ছিল বায়তুল মোকাররম মসজিদের ‘মুয়াজ্জিন’ হব। যদি ঘর বাঁধি কোনো দিন, হতে চাই এই মসজিদের মুয়াজ্জিন। বায়তুল মোকাররম মসজিদের আমি ছিলাম অবৈতনিক ‘ঝাড়ুদার’। মিউনিসিপ্যালিটির অনুমোদন সাপেক্ষে বোকারটনে গড়ে উঠবে আলিশান বেঙ্গল মসজিদ। এ বছরের পয়লা থেকে ছয় রমজান এখানেই ইফতার, মাগরিব, এশা, তারাবি আর রাতের খাবারের সঙ্গে ৪০ জন বাঙালি দিয়েছেন প্রেমপ্রীতি। হাফিজ আল্লারাখার কণ্ঠ থেকে মধু ঝরে পড়ছে, মন ছুটে যায় মক্কা ও মদিনায়।
বোকারটন ইসলামিক সেন্টার বড় মসজিদ। কয়েক বছর জুমার নামাজ আদায় করেছি, একবার ঈদ। ফ্লোরিডা আটলান্টিক ইউনিভার্সিটির জমিতে আরবেরা বানিয়েছেন। খতিব বয়সে তরুণ, সন্তানতুল্য। তার খুতবা মনে রাখার মতো।
“প্রতিদিন মুসলমান থাকতে হবে, প্রতি মুহূর্ত, নিজের প্রয়োজনে। সত্, সাহসী, কর্মপ্রিয়, বিশ্বাসযোগ্য, দয়ায় আর্দ্র, মমতায় বিলীন, সর্বধর্মের প্রতি ঔদার্যে মহান ও সর্বক্ষেত্রে আধুনিক। যাদের দেশে এসেছি মিশব সহাবস্থানের কারণে, বন্ধুত্বের জন্য নয়। লেখাপড়া ও গবেষণায় নিয়োজিত হব, সামাজিক অনুসরণ করব না কোনোক্রমেই। প্রাচুর্য ও সম্পদ প্রচ্ছন্ন শিরক, প্রভু থেকে বিচ্ছিন্ন করে যা মুমিনদের। ঈদের তাত্পর্য নয় বিলাসবহুলতা, ‘ঈদ ফ্যাশন’, ‘ঈদ ধামাকা’, লোক দেখানো জাকাত-নামাজ। প্রভুকে যা দেওয়ার তা হতে হবে: বান্দার সংগোপন সমর্পণ। প্রাচুর্যের মোহে আচ্ছন্ন মুসলমানদের বিপর্যয় রোধ করা যাবে না। ঈদ বা আনন্দ ৩০ দিন ভুখা থাকার তাত্পর্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। ঈদ মোবারক।”
এবার ওবামা। তাঁর বাবা হার্ভার্ডের ডক্টরেট, ১৯৫৯ সালে এসেছিলেন হাওয়াইয়ে ছাত্র হিসেবে। আমি হনলুলুতে ইস্ট ওয়েস্ট সেন্টারে যখন কর্মরত, তাঁর বাবার সঙ্গে অথবা তাঁর সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে পারত। সেখানেই ইউনিভার্সিটি অব মায়ামিতে বড় অনুষ্ঠানে আমি একক শিল্পী।
ওবামা একজন ক্যাথলিক, যিনি ইসলাম ধর্মের প্রতি মমত্ব ব্যক্ত করেছেন। এর আগেও ঈদের জামাতে বক্তৃতা করেছেন দুজন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট। ভারতের প্রধানমন্ত্রীরা ঈদের দিনে মুসলমানদের পাশে এসে দাঁড়ান।
শোলাকিয়ায় ওবামার দেখা হয়তো পাব না। মনের মাঠে দেখা হওয়াটাই বড় কথা, যেখানে সব মানুষ এক।
mabbasi@dhaka.net
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন