আশীষ-উর-রহমান | তারিখ: ০৯-০৬-২০১০

জারুল আমাদের নিজস্ব উদ্ভিদ। বৈজ্ঞানিক নাম Lagerstroemia speciosa। নিম্নাঞ্চলের জলাভূমিতে ভালোভাবে বেড়ে ওঠে। তবে শুকনো এলাকায়ও মানিয়ে নিতে পারে। আকার মাঝারি গোছের। অনেক শাখা-প্রশাখায় মেলে ধরা সবুজ ছাতার মতো দেখায়। কাণ্ড ধূসর। পাতা লম্বাটে। পত্রদণ্ডে বিপরীত দিকে সাজানো থাকে। শীত এর পাতা ঝরিয়ে দেয়। বসন্ত এসে রিক্ত শাখাগুলো ভরিয়ে তোলে নবীন পল্লবে। গ্রীষ্ম তাকে সাজায় উজ্জ্বল বেগুনি রঙের অজস্র ফুলে ফুলে।
জারুল ফুলগুলো থাকে শাখার ডগায়, পাতার ওপরের স্তরে। লম্বা মঞ্জরিতে গাঢ় সবুজের পটভূমিতে বেগুনি ফুলের গুচ্ছ অনিন্দ্য সুন্দর। ছয়টি পাপড়ি। মাঝখানে পুংকেশরের সঙ্গে মাখামাখি হলুদ পরাগকোষ ফুলের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে তোলে। অনেক দিন ধরেই ফুলের শোভা থাকে গাছে। গ্রীষ্মের শুরুতে ফুল ফোটে। কিছুটা কমে এলেও শরৎ অবধি সবুজে-বেগুনিতে জারুল হয়ে থাকে মনোরম।
এর ফল ডিম্বাকৃতির। ফুলের মতোই সুপ্রচুর। ফলভারে শাখা নুয়ে পড়ে। শীতে পাতার সঙ্গে ফলও ঝরে পড়ে। বীজ থেকে সহজেই চারা গজায়। বাড়েও দ্রুত। পথতরু হিসেবে জারুল উপযুক্ত। বাগানেও রোপণ করা যায়।
জারুলের সঙ্গে কৃষ্ণচূড়া ও সানালু পাশাপাশি এক সারিতে থাকলে গ্রীষ্মের ঝলমলে রোদেলা দিনে তাদের লাল-হলুদ-বেগুনি-সবুজের দীপ্তিমান বর্ণচ্ছটা অতুলনীয় হয়ে ওঠে। ইটপাথরে আকীর্ণ হলেও জারুলের শোভায় মুগ্ধ হওয়ার খানিকটা সুযোগ এই রাজধানী শহরেও রয়ে গেছে। রমনা উদ্যান, বেইলি রোড, মিন্টো রোড এবং এর পাশের এলিফ্যান্ট রোড, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও নীলক্ষেত এলাকার জারুলগাছগুলো শহরের রুক্ষতায় লাবণ্য ছড়িয়ে দিয়েছে এই গ্রীষ্মে।
জারুল কাঠও মূল্যবান। লালচে রঙের কাঠ খুবই শক্ত। ভিজলেও সহজে নষ্ট হয় না। ঘরের কড়ি-বর্গা, নৌকা, গরুরগাড়ি, লাঙল, আসবাব তৈরিসহ জারুল কাঠের ব্যবহার বহুবিধ। বাংলাদেশ ছাড়াও চীন, মালয়েশিয়া, ভারতের জলাভূমি অঞ্চলে এর জন্ম। জারুলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ ইংরেজরা উনিশ শতকে এখান থেকে বীজ নিয়ে কুয়ালালামপুর ও ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের অনেক শহরে জারুল লাগিয়েছে। ভেষজ গুণও চমৎকার। জ্বর, অনিদ্রা, কাশি ও অজীর্ণতায় উপকারী। জারুলের আরও একটি জাত আছে। আকারে ছোট বলে একে অনেকে ছোট জারুল বা তিলা জারুলও বলে। বৈজ্ঞানিক নাম Lagerstroemia indica। এটা বৃহত্তর সিলেট ও কিশোরগঞ্জ জেলায় প্রচুর জন্মে।
জীবনানন্দ দাশের কবিতায় জারুলের উপস্থিতি প্রচুর। তিনি লিখেছেন, ‘এই পৃথিবীর এক স্থান আছে—সবচেয়ে সুন্দর করুণ/ সেখানে সবুজ ডাঙা ভরে আছে মধুকূপী ঘাসে অবিরল,/ সেখানে গাছের নাম: কাঁঠাল, অশ্বত্থ, বট, জারুল হিজল...’। তবে এখন সারা দেশেই জারুলের সংখ্যা সামান্য। দেখা পাওয়া প্রায় দুর্লভ। কাঠের জন্যই জারুলগাছ নিধন হয়েছে বেশি। কিন্তু সেভাবে লাগানো হয়নি এর চারা। ফলে স্বভূমেই যেন পরবাসী সে আজ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন