রবিবার, ২৯ এপ্রিল, ২০১২

পুরনো বিবাদ মেটানো, বৈশাখের দাবি



যে যেভাবে দেখি

॥ মুস্তাফা জামান আব্বাসী ॥

পয়লা বৈশাখ শেষ। এবার বৈশাখী ভাবনাগুলোকে সংহত করি। বৈশাখী কি উড়ে যাওয়ার জন্য একটি দিনের মাতামাতি, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত উদ্দেশ্যহীন শহরের পথে হেঁটে চলা? তা কী করে হয়? এতগুলো লোক পথে বেরিয়েছে একেবারেই উদ্দেশ্যবিহীন, শুধু দিনটিকে উপভোগ করার জন্য। এর কোনো উদ্দেশ্য নেই, শুধু বেলুন নিয়ে হইচই? মেলা মানে মিলন, দু’টি প্রাণের, বহু প্রাণের। তা আর কে মনে রাখছে আজ।
জাপানিদের নববর্ষে গিয়েছি, ওরা বড় হিসাবি জাত, হিসাব ছাড়া নড়ে না। নববর্ষে আসল কাজটা করে বসে, তা হলো পুরনো বিবাদ মেটিয়ে ফেলা, বন্ধুত্বের নতুন খাতা খোলা। আমরা সেটি করি না। গলা ঝেড়ে পুরনো গান গাইতে বসি, ওই গানের মধ্যে প্রবেশ করি না, কোনো কিছুর মধ্যেই প্রবেশ করি না। যা কিছু সব গানে গানে, তাই গান শেষ হলে সব উড়ে যায়।

বলে চলেছি, বিরোধ মিটিয়ে ফেলুন। অন্তরের মালিন্য দূর করুন, দেশবাসীকে মুক্তি দিন। দেশবাসী বিরোধকে মোটেই ভালোবাসে না। তারা একে মনেপ্রাণে প্রত্যাখ্যান করেছে। দিন চলে গেলে ওই প্রত্যাখ্যান আপনাদের সাথে যাবে। আমাদের কথা শুনুন। দেশটাকে রক্ষা করেন। গ্রামে গ্রামে শহরে শহরে ঘৃণা যাদের মধ্যে বসতি স্থাপন করেছে তাদের ভেঙে টুকরো টুকরো করে দেন। সবার ভালোবাসা পাবেন, নইলে ঘৃণা সবাইকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে।
ঘুড়ি উড়ানো ভালো, মিছিলে মিছিলে কিছু মিলনের গান গাওয়া ভালো। থাইল্যান্ডে ইন্দোনেশিয়ায় মুখোশ সংস্কৃতির বিকাশ দেখে এসেছি। সেগুলোও ভালো। আর্ট কলেজের ছেলেমেয়েরা মুখোশ ভালোবাসে। বাঘ, ভালুক, সিংহ, প্যাঁচা, সাপ সবই আছে। এগুলো নিয়ে মিছিল বেরোলে বলার কিছু থাকে না। যারা পুরনো তারা বলেন, এগুলো আমাদের সংস্কৃতির অংশ নয়, মূর্তি বা মুখোশ আমাদের ছিল না, এগুলো আরোপিত। আরোপিত টিকবে না, মিডিয়ায় সারা দিন সারা রাত ধরে দেখানো হলেও সেগুলোর মূল্য হবে না। ঈমান-আকিদার সাথে ওগুলো যাবে না। সংস্কৃতি একটি নদীর মতো, তার প্রবাহকে নিজের ইচ্ছামতো চালানো যায় না। তাই ভালো হয় যদি আমাদের গ্রামের মানুষের সংস্কৃতিকেই প্রাধান্য দেয়া হয়।
এমন কোনো সভা খুঁজে পাই না যেখানে সভ্যজনদের গান ছাড়া অভাজনদের গান গাওয়া হচ্ছে। সেখানে নেই ভাটিয়ালি, বিচ্ছেদী, মারফতি, জারি গান। আরোপিত গান কয়েকজনের জন্য ভালো নিশ্চয়ই। মৃদুমন্দ দখিনা হাওয়ায় শহুরে গানের শহুরে চল। দিনকতক এটি চলবে বৈকি। বাংলার আপামর জনতার গান লোকসঙ্গীত। কোনো টেলিভিশনে সেই গান গাওয়া হয়নি। কেন? আরোপিত সঙ্গীতের প্রাধান্য সেখানে। তোমার গান কিছুই নয়, আমরা যা দেবো সেটিই তোমাদের গান, এ মনোভাব টিকবে না। এটি পরাজিত হবে, এই আমার বক্তব্য।

পুরনো বক্তব্যে আবার। বিভাজিত জাতি কোনো কিছু অর্জন করতে সমর্থ হবে না। বারবার একই কথা বলছি। বিভাজিত হবেন না, কেউই জয়ী হতে পারবেন না। জাতির সব সমস্যায় সবাই মিলে বিচার করুন। সবার কাছে গ্রহণযোগ্য যা, তাকেই গ্রহণ করুন। এটাই ফয়সালা। পশ্চিম বাংলায় সবচেয়ে বড় উৎসব কী? এক কথায় জবাব, দুর্গাপূজা। আমাদের এখানে বছরে দুটো ঈদ। কিছু বন্ধু চাইছেন ঈদের বদলে বৈশাখী উৎসব। ওদের ইচ্ছা বাংলাদেশে বৈশাখ হবে সবচেয়ে বড় উৎসব। মাল্টিন্যাশনালরা কোটি কোটি টাকা দিতে কার্পণ্য করেননি। এবার পশ্চিম বাংলার বন্ধুদের জিজ্ঞেস করুন, এটা ওরা চায় কি না, উত্তর : না। ওরা দুর্গাপূজাকেই চায়। আবার বৈশাখের আবাহনেও ভাসিয়ে দিতে চায় পুরনোর জঞ্জাল, সেটা অন্যায় নয়। বাংলাদেশে বাস করে উল্টো চিন্তার উদ্ভাবকদের সাবধানী হতে হবে। আমাদের সংস্কৃতি প্রয়াস যেন মধ্যপথে বাধা না পায়। আমরা একই সাথে আধুনিক আবার একই সাথে ধর্মের প্রতি অনুগত। ধর্মকে অস্বীকার করলে হবে সঙ্ঘাত, যার কোনো সুস্থির সমাধান আমার জানা নেই। এখানে ঈদ বড় উৎসব হবে। বৈশাখীতেও মাতব আমরা আনন্দে। কোনো বিরোধ নেই। যারা অন্যায় চিন্তা করে তাদের সাথেই বিরোধ।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনেক দিন ছিলাম, সেখানে উপভোগ করেছি ‘থ্যাংকস গিভিং’, যা সবাই পছন্দ করেন। এর সাথে নেই ক্রিসমাসের বিরোধ। আবার একটি গ্রুপ ক্রিসমাসের বিরুদ্ধে লেগেছে। তারা বলে, আমেরিকার আসল উৎসব হওয়া উচিত গ্রামীণ আবহাওয়া থেকে উদ্ভূত ‘থ্যাংকস গিভিং’। খ্রিষ্টানেরা বলছে তা হওয়ার নয়। ধর্মীয় অনুভূতিতে বাধা দিলে তা হবে এক ধরনের লড়াই। লড়াইয়ের দরকার কী, দু’টিই থাকুক। বাংলাদেশেও তাই বিরুদ্ধবাদীদের অন্যায় চিন্তার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে যখন বাড়াবাড়ি দেখি, তখন সহজেই বুঝি এরা কী চায়, এরা চায় আরেক আধিপত্য। এমনকি বৈশাখী ভাবনাতেও তারা উড়ে এসে জুড়ে বসতে চায়।

পয়লা বৈশাখের পরের দিন বৈশাখ উধাও। কোথায় পাঞ্জাবি, কোথায় বৈশাখী শাড়ি। আরেক বছরের জন্য তুলে রাখি। বৈশাখের চার-পাঁচ তারিখ চলে গেলে ওই মাসের আর হিসাব নেই। ধন্য বৈশাখপ্রীতি। নববৈশাখে ডাক্তারের আহ্বান, আব্বাসী সাহেব, আপনার হাই কোলেস্টেরলের জন্য ইলিশ অনুপযোগী, গরুর গোশতের মতোই ওটি পরিহার করুন। এ বছর আর পান্তা-ইলিশ খাওয়া হয়নি। আগামী বছরের কথা বলতে পারি না।
লেখক : সঙ্গীত-সংস্কৃতি ব্যক্তিত্ব
mabbasi@dhaka.net

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন