আশীষ-উর-রহমান

লিজা ফ্যাশনের ব্যবস্থাপক মোক্তার হোসেন বললেন, ‘দিনের মধ্যে ছয় থেকে আট ঘণ্টার বেশি কারেন্ট থাকে না। বরাবর ঈদে যা উৎপাদন হয়, এবার তার অর্ধেকও হয়নি। আমরা তবু অন্য কারখানা থেকে কিছু মালামাল তৈরি করেছি। সমস্যা হলো কারিগরদের। তারা চুক্তির ভিত্তিতে কাজ করে। আমাদের যেসব কারিগর ঈদের মৌসুমে কাজ করে ৩০-৪০ হাজার টাকা নিয়ে বাড়ি যেত, এবার তাদের হাতে পাঁচ হাজার টাকাও নেই।’
চকবাজার, উর্দু রোড, পাটুয়াটুলী এলাকার পোশাকের পাইকারি বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বিদ্যুতের সংকট এবার তাঁদের ঈদের ব্যবসায় প্রায় বিপর্যয় ঘটিয়ে দিয়েছে। ঈদ মৌসুমেই সারা বছরের মূল বেচাকেনা চলে। অথচ এবার বিদ্যুত্সংকটের কারণে তাঁরা স্বাভাবিক উৎপাদনও করতে পারেননি।
উর্দু রোডের নওশীন কালেকশন তৈরি করে শার্ট। তাদের তৈরি শার্টের পাইকারি দাম ৪০০ থেকে ১৩৫০ টাকার মধ্যে। প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক সিরাজুল ইসলাম জানালেন, দেশি ও বিদেশি কাপড় দিয়ে তাঁরা নিজেদের কারখানাতেই শার্ট তৈরি করেন। আগে তাঁদের কারখানায় ছিল ফুটমেশিন। এখন সব কারখানাতেই বিদ্যুত্চালিত সেলাই মেশিন ব্যবহূত হচ্ছে। সকাল ১০টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত কারখানায় কাজ চলে। এর মধ্যে কয়েক দফায় মাত্র ঘণ্টা চারেক বিদ্যুৎ থাকে। এ কারণে পুরোদমে উৎপাদন করতে পারেননি তাঁরা।
একই কথা বললেন ড্রেস কুইন গার্মেন্টসের ব্যবস্থাপক বেল্লাল হোসেন। তাঁরা তৈরি করেন মেয়েদের পোশাক। এখানে বাচ্চাদের পোশাকের পাইকারি দাম ১৫০ থেকে ৭০০ টাকা এবং বড়দের থ্রিপিস ৭০০ থেকে ১৫০০ টাকার মধ্যে। পাইকারি বাজারে সাধারণত শবে বরাতের পর থেকে ১৫ রমজান পর্যন্ত বেচাকেনা বেশি চলে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় যায় তাঁদের মালামাল।
লিজা ফ্যাশনের মোক্তার হোসেন বললেন, বিদ্যুতের সমস্যায় কেবল যে উৎপাদন কম হয়েছে তা নয়, পোশাকের দামও বেড়েছে। বিদ্যুতের সংকটে বস্ত্র উৎপাদকেরাও স্বাভাবিক উৎপাদন করতে পারেননি। এ কারণে পোশাক প্রস্তুতকারকেরা প্রয়োজনীয় দেশি বস্ত্রের জোগান পাননি। পোশাক তৈরির জন্য বস্ত্র আমদানি করতে হয়েছে। এতে খরচ বেশি পড়েছে। উপরন্তু নিজেদের কারখানায় উৎপাদন কমে যাওয়ায় ঘাটতি পোষাতে অন্য কারখানা থেকে তাঁদের বেশি মজুরি দিয়ে পোশাক তৈরি করিয়ে নিতে হয়েছে। এসব কারণে এবার পাইকারিতে পোশাকের দাম বেশি পড়েছে, বিক্রিও কমেছে। এর প্রভাব পড়েছে খুচরা বিক্রির ক্ষেত্রে। তাই ঈদের নতুন পোশাক কিনতে ক্রেতাদের বাড়তি টাকা খরচ করতে হচ্ছে।
এসবের মধ্যেও নামকরা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিক্রির পরিমাণ বেশ ভালো। উর্দু রোডের শার্ট প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ওয়ানম্যানের স্বত্বাধিকারী শফিউল আলম জানালেন, সারা দেশেই তাঁদের পোশাকের সুনাম রয়েছে। বিক্রিও ভালো। তবে তাঁরা পড়েছেন অন্য সমস্যায়। অনেকেই তাঁদের পোশাকের নকল করছে। পুরান ঢাকার লেবেল তৈরির প্রতিষ্ঠান থেকে নকল লেবেল তৈরি করে অনেকে ওয়ানম্যানের নাম দিয়ে সেসব নকল পোশাক চালিয়ে দিচ্ছে। এই নকলকারীদের প্রতিরোধ করার কোনো ব্যবস্থা নেই। তিনি বললেন, ‘অনেকেই বিদেশি নামকরা প্রতিষ্ঠানের লেবেল নকল করে পোশাক তৈরি করে বিক্রি করছে। আমরা সে পথে না গিয়ে ব্যবসার ঝুঁকি নিয়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠানের নামেই শার্ট তৈরি শুরু করি। আমরা সফলও হয়েছি। ইচ্ছা ছিল শার্টের পাশাপাশি টি-শার্ট এবং অন্যান্য পোশাক তৈরি করার। কিন্তু নকলবাজদের কারণে তা করতে পারছি না।’
ঈদের এখনো এক সপ্তাহেরও বেশি বাকি। চকবাজার, উর্দু রোড ও এর আশপাশের পাইকারি পোশাকের বাজারে এখন বেচাকেনা তেমন নেই বললেই চলে। অধিকাংশ দোকান ফাঁকা। প্রতিবছর ২০ রোজার পরেও দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে খুচরা বিক্রেতারা মালামাল নিতে আসেন। খুচরাও বিক্রি হয় কিছু কিছু। এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। উৎপাদনই ব্যাহত হয়েছে বিদ্যুতের সংকটে। ব্যবসায়ীরা তাই খুব একটা প্রসন্ন নন। ঈদের মন্দা ব্যবসার ঘাটতি সারা বছর কেমন করে পুষিয়ে নেবেন, সেই ভাবনাই তাঁদের ঈদের আনন্দ ফিকে করে দিয়েছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন