বৃহস্পতিবার, ৫ এপ্রিল, ২০১২

অমল ধবল শারদীয় দিন



আশীষ-উর-রহমান | তারিখ: ১১-০৯-২০১১
শরতে শুভ্র কাশফুলে ভরে উঠেছে নদীর চর। রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার পদ্মার বুক থেকে ছবিটি তুলেছেন সএই কাঠফাটা রোদ, তো পরক্ষণেই ঝুপ ঝুপ বৃষ্টি। পথে নামলে কখনো স্বেদে সিক্ত, আচমকা বর্ষণে কখনো বা কাকভেজা।
বর্ষাকালে হাতে ছাতা থাকে। বর্ষা বিদায়ের পর ঘর থেকে বেরোনোর সময় ছাতা বইবার গরজও যায়। তবে প্রয়োজনটি একেবারে ফুরোয় না। অতি সাবধানীরা বস্তুটিকে সঙ্গে রাখে। ঠেকা-বেঠেকায় রোদে-বৃষ্টিতে তাকে শিরোধার্য করে সুরক্ষিত থাকে। শরতে ছাতা বয়ে বেড়ানোর বিরক্তি থেকে যাঁরা মুক্ত থাকতে চায়, তাদের মুক্ত আকাশের নিচে রোদে পোড়া বৃষ্টিতে ভেজার বিড়ম্বনা সইতেই হয় মাঝেমধ্যে। 
এটাই শরতের স্বভাব। সে গনগনে রৌদ্র দহনে পোড়াবে, আচমকা বৃষ্টিতে ভেজাবে। এভাবেই চলতে চলতে স্থিরতা আসবে তার খেয়ালি চপল স্বভাবে। বাল্যকালের দৌরাত্ম্য বয়ঃক্রমে প্রশমিত হয়ে লোকে যেমন স্থিতধী হয়ে ওঠে, শরতেরও দুই মাসের পরমায়ুও তাই। শুরুর খামখেয়ালিপনা ঘুচে গিয়ে শেষ বেলায় তার স্নিগ্ধ প্রশান্ত রূপ।
এ বছর বর্ষায় বৃষ্টি হলো প্রচুর। শরতেও তার রেশ কাটছে না। ভাদ্র যাই-যাই, অথচ প্রায়ই আকাশে মন খারাপ করা কালো মেঘের গম্ভীর উপস্থিতি। শরতের অতি বিখ্যাত তুষার ধবল পেঁজা পেঁজা মেঘের নিরলস ভেসে চলার দৃশ্য তেমন দেখা যাচ্ছে না। বর্ষা প্রলম্বিত হওয়ায় কদম ফুটছেই। তবে তাল পাকানো গরম। নদ-নদী, বিল-ঝিল টইটম্বুর। বিদ্যাপতি যেমন বলেছিলেন ‘এ ভরা বাদর মাহে ভাদর...’ পরিবেশ।
একটু-আধটু ব্যতিক্রম থাকতেই পারে। জলবায়ু পরিবর্তনঘটিত প্রতিক্রিয়ায় পরিবেশ প্রতিবেশের চিরচেনা চেহারা বদলাচ্ছে সারা বিশ্বেই। শর ৎ ই বা তার প্রভাবমুক্ত থাকবে কী করে? তবে সেটুকু বাদ দিলে এখনো শর ৎ ই আমাদের ঋতুচক্রে সব থেকে প্রসন্ন, কোমল। তার আকাশ ময়ূরকণ্ঠী নীল নির্মল। সেখানে শিমুল তুলার মতো মেঘেদের ভেসে বেড়ানো দেখে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া...’।
শরতের অনন্যতা তার শুভ্রতায়। গগনে সফেদ মেঘ, ধরাতলে শিশিরভেজা শিউলি। নদীর তীরে রূপালী বালুচরে বিস্তৃত কাশবন ‘ফুলে ফুলে সাদা’। বিল-ঝিলে অগণিত চাঁদমালা আর শাপলার প্রস্ফুটন। শর ৎ শশীর স্তুতিও কম নয়। পূর্ণিমা প্রতি মাসেই একবার করে হয়। তবে শর ৎ পূর্ণিমায় জ্যো ৎ স্নাস্নাত চরাচর যেন এক অনির্বচনীয় সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। ঊর্ধ্ব-অধঃব্যাপী এমন নির্মল শুভ্রতার স্বপ্রকাশ শর ৎ ছাড়া আর কখনো চোখে পড়ে না। শুভ্রতা পবিত্রতার প্রতীক। বর্ষার অজস্র বারিধারা প্রকৃতির সব আবর্জনা, তার অন্তর্গত ক্লেদ ধুয়ে-মুছে তাকে পরিচ্ছন্ন করে তোলে। শরতে প্রকাশিত হয় যেন তার অন্তর্গত সেই নির্মল পবিত্রতার প্রকাশ।
শরতের শেষভাগে আনন্দের আয়োজনও রয়েছে। বাংলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উ ৎ সব দুর্গাপূজার ঢাকের বোলে মুখর হয়ে ওঠে জনপদ। গ্রামাঞ্চলে বিসর্জন উপলক্ষে আয়োজন করা হয় লোকমেলা। বহুকাল থেকেই ধর্মবর্ণ-নির্বিশেষ সব শ্রেণী-পেশার মানুষ এই মেলায় অংশ নেওয়ায় আনন্দ সর্বজনীনতায় সম্প্রসারিত হয়।
এক ধরনের প্রচ্ছন্নতা, যাকে অনেকটা অন্তর্মুখী হয়তো বলা যায়, শরতের স্বভাবটি যেন তেমনি। তাকে দেখতে, জানতে, অনুভব করতে খানিকটা বাড়তি মনোযোগ, একটু নিবিড় অনুসন্ধি ৎ সার প্রয়োজন হয়। নয়তো বর্ষার প্রলম্বিত অংশ বলেই মনে হয় তাকে। শীত, গ্রীষ্ম বা বসন্তের মতো প্রকট নয় তার বৈশিষ্ট্য, উপাদান অনুসঙ্গ। সেই বাড়তি শ্রমটুকু দিতে যাদের আপত্তি নেই, শর ৎ তাদেরই প্রিয় ঋতু।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন