বৃহস্পতিবার, ৮ আগস্ট, ২০১৩

চোখের পানি আটকাতে পারলামনা


old 

এসব কুলাঙ্গার সন্তানের জন্যই মনে হয় জাহান্নাম! বৃদ্ধাশ্রমে চোখের জলে কাটলো স্বজনহারাদের রোজার মাস
অনেকে গভীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকেন, হয়তো এখনি সন্তান এসে আব্বা আম্মা বলে ডাকবে- প্রতিদিন ঐ সময় এই স্মৃতি বুকে ধরে শুধু চোখের পানি ছাড়েন। আসলে কেউ আসবে না। চোখের জলেই হবে তাদের চির বিদায় বলে হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন।
অন্যরকম কষ্টকর ও ভাবনার একটি চিত্র- বৃদ্ধাশ্রমে চোখের জলে কাটে স্বজনহারাদের রোজার মাস- চার বৃদ্ধার মৃত্যু, দাফনেও আসল না আপনরা- আমরাও কি পাশ্চাত্যের অমানবিক জীবনের দিকে?
“মা কথাটি ছোট্ট অতি, কিন্তু জেনো ভাই ইহার চেয়ে নাম যে মধুর, ত্রিভূবনে নাই।” কাজী কাদের নেওয়াজ
স্বার্থের জুয়াখেলায় মত্ত এই বিচিত্র পৃথিবীতে আমরা এতটাই ব্যস্ত যে জীবনের জন্য ধ্রুব মৃত্যুর কথাটাই ভুলে গেছি। এমনি সামনে দিয়ে মৃত মানুষের লাশ নিয়ে গেলেও মনে হয় না মরব। অথচ ঠিক আগামী কালই আমাদের সবাইকে নিম্ন মানের সেলাই বিহীন কাপড় নিয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে। এর পরও মানুষ পিতা-মাতার খোঁজ-খবর রাখে না, মিথ্যা বলে কিংবা ঘুষ খায়।
সন্তান, আপনজন ও আত্মীয়-স্বজনহারা বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের পুরো রমজান মাস কাটলো চোখের জলে। কেউ কেউ ভুলতে পারেননি তাদের পুরানো স্মৃতি। স্ত্রী, স্বামী, সন্তান ও নাতী-নাতনীদের নিয়ে রমজান মাসে এক সঙ্গে ঘরে বসে ইফতার করতেন। এতে কতই আনন্দ উপভোগ করতেন। কয়েকজন বৃদ্ধ বলেন, চাকরি কিংবা ব্যবসার কাজে ব্যস্ত থাকলে ইফতারের সময় ঘনিয়ে এলে স্ত্রী ও সন্তানদের কথা মনে পড়ে যায়। কখন তাদের সঙ্গে একত্রে ইফতার করবেন। তখন চাকরি কিংবা ব্যবসায়ের কাজ রেখে অথবা দ্রুত শেষ করে বাড়ি ফিরে যান। এমন কি স্ত্রী ও সন্তানরা পিতা কখন আসবে? ইফতারি প্রস্তুত করে বসে থাকতো। কোন কারণে ইফতারিতে অংশগ্রহণ করতে না পারলে ঐ দিন বাসায় আপনজনদের ইফতার ঠিকমত হতো না। কিন্তু বয়সের ভারে পরিবারের সবার প্রিয় ব্যক্তি এক সময় আয়-উপার্জন করতে অক্ষম হওয়ায় সবার বোঝা হয়ে যান। বৃদ্ধের প্রতি মানসিক ও শারীরিকসহ কতই নির্যাতন নেমে আসে। অবশেষে নাড়ি ছেড়া ধন ও কলিজার টুকরা সন্তানদের দ্বারা নির্যাতিত হওয়ার ঘটনা পিতা-মাতা সইতে পারেননি। চোখের পানি মুছতে মুছতে বাড়ি থেকে পাড়ি দেন অচেনা পথে। অবশেষে ঠাঁই নেন হূদয়বান ব্যক্তি ও শিল্পপতি খতীব আব্দুল জাহিদ মুকুলের প্রতিষ্ঠিত গাজীপুর মনিপুরের বিশিয়া কুড়িবাড়ি বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে। মাদারীপুরের মতিজান (৭৪), নারায়ণগঞ্জের নাসিমা বেগম (৮০), বীর মুক্তিযোদ্ধা কুলসুম বিবি (৮১), ময়মনসিংহের ওসমান গনি (৭০), গফরগাঁও-এর আব্দুল খালেক (৭০), পিডব্লিউডির সাবেক হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম (১০৫) এ সব কথা বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।
বৃদ্ধাশ্রমে পহেলা রমজানে ইফতারের সময় তাদের সেই স্মৃতি মনে পড়ে। ঐ দিন অনেক বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ইফতারি হাতে নিয়ে কেঁদে ফেলেন। জীবনের শেষ সময় কলিজার টুকরা সন্তান কিংবা আপনজন দ্বারা বিতাড়িত হয়ে একাকী ইফতার করতে হবে, এটা তাদের কল্পনার বাইরে। অনেকে বলেন, এটা তাদের কপালের লিখন। প্রতিদিন রমজানে ইফতার ঘনিয়ে আসার ঘণ্টাখানেক আগে বৃদ্ধাশ্রমের বারান্দায় সারিবদ্ধভাবে তারা একে অপরের পুরনো স্মৃতি নিয়ে গল্প করেন। অনেকে গভীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকেন, হয়তো এখনি সন্তান এসে আব্বা আম্মা বলে ডাকবে, আসেন ইফতারের সময় হয়েছে, এক সঙ্গে ইফতার করি। প্রতিদিন ঐ সময় এই স্মৃতি বুকে ধরে শুধু চোখের পানি ছাড়েন। আসলে কেউ আসবে না, চোখের জলেই হবে তাদের চির বিদায় বলে হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন।
গত রমজানে চারজন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা মারা গেছেন। তাদের মধ্যে তিনজনের দাফন বৃদ্ধাশ্রমে হয়েছে। অপরজনের লাশ স্বজনরা নিয়ে যায়। তাও খবর দেয়ার পর স্বজনরা এসেছেন। যেভাবে নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়ে বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা বৃদ্ধাশ্রমে এসেছেন, লালশটি নিয়ে আপজনরা এর দায় মুক্ত হতে চেয়েছে বলে কয়েক বৃদ্ধ জানান। এ যেন, কাটা ঘায়ে লবণ দেয়ার মত কাজ বলেও কোন কোন বৃদ্ধ অভিমত ব্যক্ত করেন।
বৃদ্ধাশ্রমে ১৯০ জন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা রয়েছেন। তাদের মধ্যে ৪০ জন বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে গিয়ে রমজান মাস কাটিয়েছেন। বাকি ১৫০ জনের মধ্যে ৪৫ জন বৃদ্ধ ও ৫৫ জন বৃদ্ধা বৃদ্ধাশ্রমে রোজা রেখেছিলেন। ৫০ জন অসুস্থতার কারণে রোজা রাখতে পারেননি বলে বৃদ্ধাশ্রমের সুপার মোহাম্মদ শরীফ জানান।
তখনো শেষ বিকালের লালচে আলোর খেলা চলছে দিগন্তে। নতুন আরেকটি সন্ধ্যার আগমনী সংকেত বাজছে। কেন যেন পুরোনো মানুষদের কথা ভীষণ মনে পড়ছিলো। কিভাবেই যে টুপটাপ ঝড়ে গেছে চারপাশের প্রিয় মানুষগুলো। যে জায়গাটাতে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে রাস্তাটা কোথাও যেন হারিয়ে গেছে। রাস্তাও বোধ হয় পথ হারায় কখনো কখনো।
এই জায়গাটাতেই প্রায়ই দেখা হতো এক প্রবীণের সাথে। অশীতিপর এই মানুষটির সাথে আলাপও হতো বটে। এই ভদ্রলোকের হাঁটাটাকে সব সময়ই মনে হতো উদ্দেশ্যহীন, গন্তব্যহীন। আসলে এ রকম অনেক নুয়েপড়া কুঁজো হয়ে যাওয়া বৃদ্ধরা এখানে ওখানে ঘরছাড়া বালকের মত ঘুরে বেড়ায়।
বয়স ৬০-৬৫ পেরুলেই খুব ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। আমাদের দেশের শিতি-অশিতি সব শ্রেণীর মানুষেরা মনে করে পশ্চিমা দেশের তুলনায় আমরা আমাদের বাবা মাকে বেশি সম্মান করি, ভালবাসি। কিন্তু আমার কাছে তুলনা করার ব্যাপারটি খুব হাস্যস্পদ মনে হয়।
oldhomeআমরা আমাদের প্রবীণ বাবা মায়ের ব্যক্তি স্বাধীনতার কতটা মূল্য দেই? আমাদের দেশের বেশীর ভাগ ছেলে মেয়ে; বাবা-মায়ের বয়স হয়ে গেলে মনে করি ওরা বুড়ো হয়েছে। ওদের আবার কি মতামত। ওরা তো সেকেলে। অনেকেতো নিজের কারণেই হোক কিংবা পরিস্থিতির কারণেই হোক বাবা-মাকে বোঝা মনে করে থাকে। এসব বাবা-মা এমন এক পরিস্থিতির শিকার হন যে পরিবার যদি তাদের না দেখে তাহলে তাদের দেখ-ভালের কেউ থাকে না। কারণ আমাদের সমাজে সামান্য হলেও একজন বৃদ্ধের মূল্য শুধু পরিবারের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকে।
দেশপ্রেমের জোয়ারে এদেশের মানুষ শুধু ভাসতে শিখছে, মানুষের জীবনের দাম দিতে শিখেনি। একজন বৃদ্ধ লোকের প্রতি কোন রকমের সহানুভূতি আমরা দেখাই না। অথচ পাশ্চাত্য দেশে বিভিন্ন স্তরের সরকারি সংস্থা থেকে পাওয়া যায় নানা রকম সুযোগ-সুবিধা। শুধু তাই নয় ডাক্তারের টাকা, হাসপাতালের টাকা, এমনকি ওষুধের টাকাও আসে সরকারি তহবিল থেকে। তারপর পয়ষট্টির পর থেকে বাসের ভাড়া, প্লেনের ভাড়া, ট্রেনের ভাড়া, কাপড় চোপড়ের দাম, জুতোর দাম সবকিছুতে ছাড় দেওয়া হয়। সময় সময় সরকার তাদের পৃথিবীর বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান দেখার জন্য ভ্রমনভাতাও দেয়। অথচ আমাদের দেশে এসবের বিন্দুমাত্র সুযোগ সুবিধা নেই একজন বৃদ্ধলোকের। সঙ্গত কারনেই বাবা-মাকে দেখার দায়িত্ব সন্তানের।
যেহেতু আমাদের ‘পারিবারিক বন্ধন’ হাজার বছরের লালিত ঐতিহ্য। সেহেতু এই বন্ধন অটুট রাখার জন্যেই বৃদ্ধ বাবা-মা’র সকল প্রকার দায়িত্ব সন্তানের। পাশ্চাত্যে কথা ভেবে আজকাল অনেকেই বাবা-মার দায়িত্ব নিতে অনাগ্রহী হয়ে পড়ে। তারা মনে করে ব্যক্তি স্বাধীনতার মূল্য নিয়ে চলাফেরা যায়না। অথচ এই বাবা-মার সন্তান হিসাবে যখন আমরা বড় হয়ে উঠি তখন কোনো বাবা মা কি তার সন্তানকে বোঝা মনে করে ? ছেলে যে বড় হবে মস্ত বড় চাকরি করবে। আমাদের সব কষ্ট পুষিয়ে দেবে। এই ভালবাসার কতটুকু মূল্য ছেলে মেয়েরা দেয় ? খুব বেশী অধিকার সচেতনা আমাদের মন মানসিকতাকে হীন করে দিয়েছে। সুখ অন্বেষণে জীবনটাকে আমরা বারবার ওলট পালট করে দেখি ঠিক, কিন্তু ক’জন সুখী হতে পারছি?
পাশ্চাত্য দেশগুলোতেও বাবা মা’রা সস্তানকে যথেষ্ট যত্নে লালন পালন করে। সন্তানরাও তাদের বাবা মাকে অনেক বেশী ভালবাসে। তবে তাদের ক্ষেত্র ব্যতিক্রম এটুকুই যে, সেইসব বাবা মায়েরা নিজেদের জীবনকেই সব চেয়ে বেশী প্রাধান্য দেয়। যার ফলে তাদের পারিবারিক কোন বন্ধন থাকে না।
কিন্তু আমাদের বাবা মারা তো সন্তানের জন্যেই সব কিছু করে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এমন কোন বাবা মা কি আছে যারা সন্তানের জন্য নিজেদের সুখ, স্বাচ্ছন্দ বিসর্জন দেননি। যে বাবা মা জীবনের ধন ভেবে সন্তান সংসার আঁকড়ে ধরে রাখে, সেই সন্তানই একদিন বড় হয়ে সেই বাবা মা যে জীবন ধারাতে অভ্যস্ত সে জীবন ধারাটা পালটে দিতে চায়। তাদের ব্যক্তি স্বাধীনতার কোন মূল্য দিতে চায় না। তাদের মতামতের গুরুত্ব না দিয়ে বরং আমাদের সিদ্ধান্ত তাদের ওপর চাপিয়ে দিতে চাই।
আমরা কি একবারও ভেবে দেখেছি একটি বয়সে আমরাও বুড়ো হব। যাদের আমরা বলি বুড়ো হয়েছে, বেশী কথা বললে বলি; ভিমরতিতে ধরেছে, ভেবে কি দেখি আমিও বুড়ো হবো, কানে শুনবো না হয়তো, স্মৃতিভ্রম হবে, হাত-পা কাঁপবে। এমনও তো হতে পারে রাতের আধাঁরে হঠাৎ বেড়িয়ে পড়তে পারি অতীতের খোঁজে।
এখন যারা বলি আমি সন্তানের বোঝা হবো না, তাদের দয়া ওপর নির্ভর করবো না, আমি তাদের এই ধারনার সাথে কখনোই একমত হতে পারি না। আমার সন্তান আমাকে দেখবে না তো কাকে দেখবে? আমার সব কিছুইতো সন্তানের জন্য, সন্তানতো আমার। আমার সাথেতো সন্তানের রক্তের বন্ধন।
আসলে এই যে বন্ধন এই বন্ধন রার দায়িত্ব বাবা মা আর সন্তানেরই। এই বন্ধন অটুট থাকলে ব্যক্তি স্বাধীনতা ভোগ করার জন্য বাবা-মা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রয়োজন হয়না।
আমি তো মনে করি আমাদের সবার সুস্থ মন মানসিকতাই আমাদের সকল প্রকার ব্যক্তি স্বাধীনতা রার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে সম। যে বাবা মা তিলে তিলে একটি সাজানো সংসার গড়ে তুলেছেন কি করে এই সংসার ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করা যায়! কি করে সম্ভব এই সংসার গড়ার কারিগরদের উপো করা?
আমরা যদি মনে করতাম গুরুজন রাগ করেছেন, না হয় অন্যায়ই করেছে; আমরা কি পারিনা তাদের সবকিছু ভালবাসার গুনে মেনে নিতে। একটাইতো জীবন। বাবা-মা-সন্তান সবাই মিলে সেই জীবনের পুরোটাকে আনন্দে ভরপুর রাখতে কিছুটা ত্যাগ স্বীকার করলে কি এমন ক্ষতি হবে?
তবে একথা অনস্বীকার্য সন্তানের পাশাপাশি রাষ্ট্রেরও বয়স্ক মানুষদের প্রতি যথেষ্ট দায়িত্ব নেওয়া প্রয়োজন। যে মানুষ দেশের জন্যে কাজ করেছে, দেশের মানুষের জন্য সারাজীবন স্ব স্ব অবস্থান থেকে শ্রম দিয়েছেন। তাদেরকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রাষ্ট্র থেকে সকল সুবিধা দেয়া অবশ্যই প্রয়োজন।
কেমন আছেন প্রবীণ নিবাসে নির্বাসিত দুখিনী মায়েরা
‘মা জননী নাইরে যাহার/ ত্রিভুবনে তাহার কেহ নাইরে/ মায়ের মতো আপন কেহ নাই।
মা কথাটি ছোট্ট অতি/ কিন্তু জেন ভাই/ তাহার চেয়ে নাম যে মধুর ত্রিভুবনে নাই।’
মায়ের একধার দুধের দাম/কাটিয়া গায়ের চাম/পাপস বানাইলেও ঋণের শোধ হবে না/এমন দরদি ভবে কেউ হবে না আমার মা… জীবনমুখী এ বাংলা গানের সুর অনেকের মোবাইল টিউন, ওয়েলকাম টিউনে শোনা যায়।
মায়ের প্রতি ভালোবাসা রয়েছে বলেই হয়তো এসব গান তারা ডাউনলোড করছেন। শুধু গান লোড কেন, ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো এদেশে এখনও বহু সন্তান রয়েছেন, যারা মায়ের জন্য জীবন উত্সর্গ করতে পারেন। কিন্তু তার বিপরীতে মায়ের প্রতি সন্তানদের চরম অবহেলা-অবজ্ঞার চিত্র ধরা পড়ে বৃদ্ধাশ্রমসহ সমাজের নিম্নবিত্ত পরিবার ছাড়িয়ে উচ্চবিত্ত পর্যন্ত। প্রবীণ মায়েরা কেমন রয়েছেন—তা জানার জন্য বিভিন্ন আশ্রম ঘুরে জানা গেছে, মৃত্যু মুহূর্তে সংসারবিচ্ছিন্ন লোকচক্ষুর আড়ালে পরবাসে থাকা মায়েদের ভিড় বাড়ছে!
নিষ্প্রাণ, বোধশূন্য, গতানুগতিক জীবনযাত্রার বাইরে থাকা ওইসব মায়ের সঙ্গে কথা হয়। কেমন আছেন তারা জানতে চাইলে অনেকেরই চোখে পানি এসে যায়! কেউ বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন, ভাষা খুঁজে পান না। আবার কেউ পাছে সমাজে প্রতিষ্ঠিত সন্তানের মানহানি হয় কিংবা ছেলের রক্তচক্ষু দেখতে হয়—সে ভয়েও গণমাধ্যমে কথা বলতে চাননি। কেউ আবার নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দেন—‘চোখের সামনে না থাকুক, তবুও আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।’
প্রবীণ হিতৈষী সংঘের আশ্রমে এখন শুধু রাজধানী থেকে নয়, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মায়েদের ঠাঁই হয়। কেমন আছেন? জানতে চাইলে জবাব আসে—কুয়াশাচ্ছন্ন পর্বতমালার মতো অন্ধকার হয়ে আসছে চারদিক! আর্থিক সচ্ছলতায় ভরা সংসারে প্রার্থিব সুখ পেয়ে এবং স্বজনদের কাছ থেকে ছিন্ন হচ্ছে শারীরিক ও মানসিক সংযোগের সেতুবন্ধন। অনিশ্চয়তা, উত্কণ্ঠা, শঙ্কায় নিজের ঘরও হয়ে উঠেছে পরবাস। চারপাশটা কেবলই ফাঁকি আর মমতার ফাঁদ! মন তখন খুঁজে বেড়ায় একটা আশ্বাস—আশ্রয়, নির্ভরতা আর শুশ্রূষা। সারাজীবন ধরে তিল তিল করে গড়ে তোলা সব সহায়-সম্পত্তি, ভিটেমাটি বিক্রি করে দিয়ে শেষ আশ্রয় হয় রাজধানীর আগারগাঁও প্রবীণ হিতৈষী সংঘের বৃদ্ধাশ্রমে—আবেগাপ্লুত হয়ে কথাগুলো বলেন নার্গিস সুফিয়া আক্তার। রংপুরের বাসিন্দা সুফিয়ার (৫৫) স্বামী বড় পুলিশ অফিসার ছিলেন (নাম প্রকাশ করতে চাননি)। এক ছেলে লেখাপড়া শেষে বাবা-মাকে ছেড়ে অস্ট্রেলিয়ায় স্থায়ী হলেন; তিন মেয়ে যে যার সংসার নিয়ে ব্যস্ত। প্রতাপশালী স্বামীর আত্মম্ভরিতা ভেঙে খান খান হয়ে যায় দেখে মন বলে ওঠে বিকল্প পথ খুঁজি! পরস্পরের প্রতি নির্ভরশীল মানুষ দুটি রিক্ত জীবনের শেষপ্রান্তে এসে নির্জনে একাকীত্ব বেছে নিলেন। বিস্তৃত ও নিজস্ব পরিধি থেকে বিচ্ছিন্ন হলেন সুফিয়া। এখন স্বামী-স্ত্রী দুজনে একই ছাদের নিচে। কিন্তু দুজনের মাঝখানে একটা ইট-পাথরের দেয়াল। কথাগুলো বলতে বলতে তার বুকের ভেতর থেকে নিঃশ্বাস ওঠে। চোখের পানি আড়াল করতেই দুটি কিডনি নষ্ট হয়ে যাওয়া অসুস্থ সুফিয়া খাট থেকে নেমে সামনের বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ান। শান্ত কণ্ঠে বলেন, ‘গভীর রাতে যখন ঘুম আসে না, তখন ছেলেমেয়ের মুখ মনে পড়ে; কিন্তু মনে করতে চাই না! কারও কাছে তো হাত পাততে হয় না। তবুও জোর করেই মনের মধ্যে এলোমেলো ভাবনা উঁকি দেয়। সব ভুলতে চাই। কাউকে চাই না।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারের হোমিও (অবসরপ্রাপ্ত) ডাক্তার ছেলেমেয়ের রক্তচক্ষুর ভয়ে নাম বলতে চাননি অশীতিপর ওই বৃদ্ধা। সংসারে দৈনন্দিন গতানুগতিক জীবনের অভ্যস্ততা তার সংসারে কাল হলো। তার দায়িত্বশীলতা ছেলেবউয়ের কাছে একরকম নাক গলানোর মতো! যা পরবর্তীতে কাল হয়ে দাঁড়ায়। সংসার জীবনে টুকটাক অশান্তিতে তার জন্য প্রায় ৫০ বছর বয়সী ছেলে জায়গা করে দিল বৃদ্ধাশ্রমে। অভিমানী স্বরে বললেন, ‘ছেলে যেখানেই আমায় ফেলে রাখুক, আমার সামনে এলে সব কষ্ট ভুলে যাই। শুধু অপেক্ষায় থাকি ও কখন আমার সামনে আসবে!’ চোখ ছলছল করে ওঠে। নীরব থাকেন কিছুক্ষণ। কোনো সমস্যা নেই বললেও কথায় কথায় অনেক কিছুই বললেন। তার কষ্টটা বুকে চেপে রেখেছেন একরকম জোর করেই। এ প্রতিনিধি চলে আসতে গেলে হাত বাড়ান। তার চোখের ভাষা বলে দেয়—আরও একটু থাকো পাশে, সময় যেন কাটে না! স্বামীহারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত পল্লবীর নার্গিস জাহানের মলিন পোশাক। ‘তবুও এই বেশে ভালো আছি। সংসারে একটা মেয়ে। কিছুদিন ছিলাম। তারপর মায়ের আর জায়গা হলো না মেয়ের কাছে’—বললেন তিনি। ভাগ্যপীড়িত করুণ নিঃসঙ্গ জীবনের সঙ্গে মোকাবিলায় মানসিক দৃঢ়তা তার মধ্যে। আবুজর গিফারি কলেজের প্রাক্তন এক প্রভাষকের (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) অভিমানে সংযত আবেগ—‘এইতো এখানে রেখে খাওয়া-পরার খরচ দিচ্ছে। প্রতি মাসে খরচ হয় প্রায় ১০ হাজার টাকা। ভালো না বাসলে কী আর এত খরচ ছেলেমেয়েরা দেয়? তারা দেশে নেই। ভালো হয়েছে, দেশে তো এখন স্বাভাবিক মৃত্যুরও গ্যারান্টি নেই। দু’বছর আগেও তাদের কথা মনে করে কষ্ট হতো। এখন হয় না। যে যেখানেই থাকুক, তারা যেন থাকে দুধে-ভাতে।’ তবে প্রবীণ হিতৈষী সংঘের বৃদ্ধাশ্রমের মায়েরা জানান, এখানে এত লোক আসে। তারা প্রত্যেকই অনেক বয়সী এবং অসুস্থ। এখানে এটাস্টড বাথরুম না থাকায় কষ্ট হয়। রাতে কেউ কেউ অন্ধকারে পড়ে যান। একজন জানান, ক’দিন আগে অন্ধকারে পড়ে গিয়ে হাতে ব্যথা পেয়েছেন। তারা এটাস্টড বাথরুম এবং খাবারের মানটা আরও একটু ভালো করার আহ্বান জানান।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ের প্রবীণ নিবাসে থাকা বৃদ্ধ নারগিস জাহানের (৭০) মুখোমুখি হতেই তিনি বিষণ্ন হয়ে পড়েন। চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। অবুঝ অসহায় শিশু সন্তানটির ঊনিশ থেকে বিশ হলে যে মায়ের খানাদানা, ঘুম হারাম হয়ে যেত, সেই মাকে ৭ বছর ধরে দেখতে আসেনি তার হতভাগ্য সন্তান। শিক্ষকতা করেছেন প্রায় ২৯ বছর। ছেলেমেয়েদের নাম পরিচয় অথবা তারা কে কি করছেন তা না জানিয়ে শুধু বলেছেন, মৃত্যুর আগে তাদের দেখতে চান। ৪০৬ নম্বর রুমে নিবাস তার। ভীষণ অসুস্থ, বিছানায় শুইয়ে আছেন। অর্থের অভাবে চিকিৎসা হচ্ছে না। সন্তানরা যেমন দেখছেন না, তেমনি কোন স্বজন অথবা সহৃদয় সুজনের সাহায্যও মিলছে না।
নারগিস সুফিয়া (৬৬) আর এক মা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রকৃতির সঙ্গে কি যেন বলছিলেন। দু’পায়ে পানি জমে ফুলে রয়েছে। কোমরে দারুণ ব্যথা। স্বামী পুলিশের এসপি ফজলুল হক বসুনিয়া ১৯৯৮ সালে মারা যান। ৫ বছর ধরে প্রবীণ নিবাসে আছেন। একমাত্র ছেলে সাইফুল হক বসুনিয়া ১৫ বছর অস্ট্রেলিয়ায় জীবনযাপন করে সম্প্রতি সস্ত্রীক দেশে ফিরেছেন। মাকে দু’বার দেখতে এসেছিলেন ফলমূল নিয়ে। নারগিস সুফিয়া জানান, ভয় পান চোখের পানি ফেলতে গিয়ে, শুনেছি চোখের পানি নাকি সন্তানদের অমঙ্গল ডেকে আনে। কিন্তু শত চেষ্টা করেও চোখের পানি ধরে রাখতে পারেন না। তিনি চান তার সন্তানের মঙ্গল। ফলমূল নয়, শেষ বয়সে ছেলের সঙ্গে থাকতে চান তিনি।
মীরা চৌধুরী জানালার গ্রিল ধরে বাইরের সবুজ চত্বরের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। তার বয়স ৭৭ বছর, মা, কেমন আছেন বলতেই মুখ ঘুরিয়ে নির্বাক হয়ে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। ব্যথিত কণ্ঠে জানালেন, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। স্বামী জোসেফ চৌধুরী প্রায় ৮ বছর আগে মারা গেছেন। জীবনে যা কিছু গড়েছেন সবই একমাত্র সন্তানকে দিয়েছেন। এখন তিনি একা। তার শক্তি-সামর্থ্য কিছুই নেই। থাকছেন এ প্রবীণ নিবাসে। ছেলে অপূর্ব হাসান চৌধুরী আমেরিকায় থাকেন। ছেলের মুখখানা দেখতে বড়ই ইচ্ছে করে তার। ভাতের লোকমা মুখের কাছে নিতেই সন্তানদের চেহারা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। গলা দিয়ে খাবার নামে না।
দিলরুবা মাসুদ নামে এক মা চলতি বছরের ডিসেম্বর মাসে এ নিবাসেই মারা যান। ৭ বছর এ নিবাসে ছিলেন। ছেলে সৌদ আল মাসুদ আমেরিকা প্রবাসী। নিবাসে থাকা অবস্থায় ছেলে কোনদিনই মাকে দেখতে আসেননি। খোঁজও নেননি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নিবাসে কর্মরত একজন বলেছেন, দিলরুবা মাসুদ অনেক দিন অসুস্থ অবস্থায় ছিলেন। ছেলেকে দেখার জন্য শুধুই কাঁদতেন। এভাবেই কেটেছে তার জীবনের শেষ দিনগুলো। নিবাসে থাকা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা জানান, সন্তান সব সময় সন্তান। তাই তাদের নাম বলছি না। তারা অসম্মানিত হলে বড়ই কষ্ট পাব। তারা ভালো থাকুক এটাই খোদার কাছে দোয়া করি। সাংবাদিকদের জন্য তাদের বকা শুনতে হয়। সন্তানরা রাগ করেন। সন্তানরা নিষেধ করে দিয়েছেন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে। কোনভাবেই যেন তারা তাদের ছবি তুলতে না পারে তাও বলে দিয়েছে। মলিন মুখে তিনি বলেন, বেশ ভালোই আছি বাবা। সন্তানরা ভালো থাকুক, প্রত্যেক মা-ই তো তাই চান।
লেখক : এম ইউ আলম, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক

বৃহস্পতিবার, ৫ জুলাই, ২০১২

শবে বারাআত ও প্রাসঙ্গিক কথা



জুলফিকার আহমদ কিসমতী : 
১৪ শাবান দিবাগত রাতকে আরবীতে লাইলাতুল বারাআত আর উর্দু-ফারসি ভাষায় শবে বারাআত বলা হয়। শব অর্থ রাত আর বারাআত অর্থ অব্যাহতি বা মুক্তি। মানুষ জীবনের চলার পথে বিভিন্ন লোভ-প্রলোভন ও ঘাত-প্রতিঘাতের সম্মুখীন হয়ে যে সব অপরাধে লিপ্ত হয়, ভবিষ্যতে একই  অপরাধে ও অন্যায়ে লিপ্ত হবে না এরূপ দৃঢ় সংকল্প সহকারে কায়মনোবাক্যে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলে করুণাময় স্রষ্টা বছরের যে কোনো সময়ই বান্দার অপরাধ মার্জনা করতে পারেন। কিন্তু এছাড়া সারা বছরের বিভিন্ন সময়-ক্ষণের মধ্যে এমন কিছু মুহূর্ত রয়েছে যেগুলোর মধ্যে তিনি বান্দার কাতর ফরিয়াদ অধিক শুনে থাকেন। তন্মধ্যে পবিত্র রমযান মাসের মহান সংযম প্রশিক্ষণের পূর্ব প্রস্তুতির মাস শাবান একটি। হাদীস শরীফে এ মাসের যথেষ্ট গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে। সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফে হযরত আয়েশা (রা.) কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে যে, আমি রাসূল (সা.)কে রমযান মাস ছাড়া অন্য কোনো মাসে শাবান মাসের মত এত অধিক রোযা রাখতে দেখিনি। তিনি কোনো সময় শাবানের সমগ্র মাসই, আবার কোনো সময় সামান্য দু'একদিন ছাড়া গোটা মাসই রোযা রাখতেন। তবে মহানবী (সা.) নিজে তা করলেও উম্মতকে শাবান মাসের প্রতিদিন রোযা রাখতে নিষেধ করেছেন। রমযানের পূর্বে অল্প কয়েকদিন হলেও রোযা ভাঙতে হবে। অপর হাদীসে আছে ‘‘তোমাদের মধ্যে কেউ যেন এক অথবা দু'দিন পূর্বে রোযা না রাখে। কিন্তু তিরমিযী শরীফে আছে শাবান মাসের যখন অর্ধেক বাকি থাকে, তখন থেকে রমযানের পূর্ব পর্যন্ত আর রোযা রাখবে না। শাবান মাসের এই গুরুত্বের দিক থেকে চিন্তা করলে ১৪ শাবান দিবাগত রাতের গুরুত্বও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিশেষ করে আইয়ামে বীয তথা প্রতি চান্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ দিবাগত রাতের মর্যাদা এমনিতেও স্বীকৃত। তার ওপর শাবানের মাস হওয়াতে সে গুরুত্ব আরও বেড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। এছাড়া মহানবী (সা.) এ রাতে নির্জনভাবে গুনাহ মাফীর জন্যও আল্লাহর কাছে অধিক কান্নাকাটি করেছেন বলে উল্লেখ পাওয়া যায়। সুতরাং এসব গুরুত্বের প্রেক্ষিতে এ রাতকে শবে বারাআত বা গুনাহ মুক্তির রাত বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। তবে এ রাতের গুরুত্ব যতই থাক, পবিত্র কুরআনে বর্ণিত ‘‘লাইলাতুল কদর’’ বা শবে কদরের মতো একে গুরুত্ব দেয়ার দ্ব্যর্থহীন প্রমাণ কুরআন-হাদীসে অনুপস্থিত।
শবে বারাআত মুসলমানদের মনে ইবাদত ও নেক কাজের স্পৃহাকে জাগিয়ে দেয়। এ উপলক্ষে সমবেত মুসলমানদের অন্তরে বিশেষ ভাব-চেতনা ও ধর্মীয় অন্যান্য বিষয়াদি পালনের আগ্রহ সৃষ্টিতে বিরাট সহায়ক হয়। বিশেষ করে জুমার দিনের তুলনায় এ উপলক্ষে মসজিদের মুসল্লীদের উপস্থিতির সংখ্যা অধিক থাকে বিধায় সকলের সামনে রমযানের সিয়াম সাধনা সংক্রান্ত মাসআলা-মাসায়েল, সিয়ামের উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও তাৎপর্য সম্পর্কে তাদের অবহিত করার বিরাট সুযোগ ঘটে। এ ব্যাপারে শবে বারাআতের শরয়ী গুরুত্বের প্রশ্ন তুলে যারা এ রাত ও তার ইবাদতকে ভিন্নভাবে মূল্যায়ন করেন বর্তমান ধর্মবিমুখতার যুগে আমাদের দেশের মুসলমানদের অন্তরে এ রাতটি যে আসন করে নিয়েছে তাদের উচিত মুসলমানদের এ ভাবধারাকে আহত না করা। বিশেষ করে যেখানে নেকভাব বর্ধক ফযিলতের হাদীস বর্ণনায় সনদের চুলচেরা বাছবিচারে শিথিলতার অবকাশ বিদ্যমান, সেখানে বিষয়টিকে ইসলামী ভাববর্ধক সংস্কৃতির একটি অঙ্গ হিসেবে ধরে নিলেই বা ক্ষতি কি?
শবে বারাআতে কুরআন তিলাওয়াত, নফল নামায, কবর যিয়ারতের মাধ্যমে মুর্দারের প্রতি সওয়াব রেসানী ও মাগফিরাতের দোয়া সকলেরই করা উচিত। এ রাতে আল্লাহর কাছে নিজের পূর্ববর্তী গুনাহখাতার ব্যাপারে তওবা করে পবিত্র রমযানের সিয়াম সাধনার জন্য মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ একান্ত জরুরি। পবিত্র হাদীসে ‘‘নেসফুম মিন শাবান’’ শব্দের প্রতি গুরুত্ব আরোপের মাধ্যমে মূলত সেই গুরুত্ব ও তাৎপর্যের দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। তবে এ রাতের নফল ইবাদতগুজারী যাতে ফজরের ফরয নামায তরক হবার কারণ না হয়, সেদিকেও সকলের লক্ষ্য রাখতে হবে। শবে বারাআত উপলক্ষে বাজি পোড়ানো, মাযারে গিয়ে কবরে সিজদা করা, কবরে বাতি দেয়া ইত্যাদি বিদআত শিরেকী কাজ যাতে না হতে পারে সেদিকে সকলের সতর্ক দৃষ্টি থাকা উচিত। অন্যথায় কল্যাণের বদলে তা অকল্যাণই বয়ে আনতে বাধ্য। খানাপিনার প্রস্তুতি অনেক সময় শবে কদর ও শবে বারাআতের ইবাদতকে নষ্ট করে। এসব বিষয়ের ব্যাপারে সতর্ক থাকা সকলের কর্তব্য।

শুক্রবার, ২২ জুন, ২০১২

হাতি আসুক রোহিঙ্গা খেদাও


হা সা ন হা ফি জ

শহরে বিদ্যুত্ নেই। বর্ষাকালেও ভ্যাপসা গরমে জান কাহিল। অতএব, ঘুরে আসা যাক বনাঞ্চল থেকে। কথাই আছে—জঙ্গল মে মঙ্গল হ্যায়। অরণ্যের নিবিড় নিভৃতি বড়ই নিরিবিলি। মানুষ হচ্ছে জগতের সবচেয়ে খতরনাক প্রাণী। বনের বাঘারা (মাসুম বাচ্চা হওয়া সত্ত্বেও) পর্যন্ত শান্তিতে থাকতে পারছে না এদের জ্বালায়। টেনেহিঁচড়ে নিয়ে আসা হচ্ছে শাহরিক পরিবেশে। পাচার করলে উমদা লাভ।
আমাদের এবারের গল্প বনাঞ্চল নিয়ে। তবে বাঘ বর্জিত। পুরানকালে নাটকে নারী চরিত্র বলতে গেলে থাকতই না। দু-চারটি থাকলেও অভিনয় করতেন পুরুষরা। নারী চরিত্র বর্জিত নাটকের চাহিদা ছিল বেশি। আজকের নাট্যাংশে ব্যাঘ্রদের ঠাঁই নেই। নির্জলা গাছগাছড়া নিয়ে কায়-কারবার। কোনো কোনো দুর্মুখের মধ্যে খারাপ কিছু দেখবেন। তা দেখুন। আমরা মচকাব না। লাইক মহাজোট সরকার। আমরা ইতিবাচক অংশেই ঘুরপাক খেতে থাকব। আমরা বনের বারোটা বাজানো প্রকল্পের পক্ষে। জোরালো সব যুক্তি তুলে ধরব। মামলা না জিতার কোনো রাস্তাই নাই।
কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলা। বারবাকিয়া সংরক্ষিত বনাঞ্চল। সেখানে চলছে বনদখলের মহোত্সব। আইনে বসতি গড়ার ওপর কড়া নিষেধাজ্ঞা আছে। থাকুক। কে তোয়াক্কা করে। মাস তিনেক সময়েই বনের চিত্র পাল্টে গেছে। দিন বদলের তুফান বইছে না? বনাঞ্চল তো দেশের বাইরে নয়। ঝড়ঝাপটা তার গায়েও লাগবে। তিন মাসে এক হাজার ৩১২টি বাড়িঘর নির্মিত। আরও এক হাজার নির্মাণের প্রক্রিয়াধীন। মাশাআল্লাহ্। চমত্কার প্রবৃদ্ধি। ডাবল ডিজিট। এ প্রকল্প তো অর্থমন্ত্রী আবুল মাল অভিহিত ‘দুষ্টু শেয়ারবাজার’ না। এটা হলো “মিষ্টি দখলের প্রকল্প। ‘ইহা’ অনুসরণীয় মডেল।”
তিন দখলদার জানিয়েছেন, সংশ্লিষ্ট বন বিটের কর্মকর্তাকে মোটা উেকাচ দিয়ে তারা বনভূমি দখলে নেন। তারপর বাড়ি তৈরি। এই প্যাকেজের অনুঘটক এক মালি। তিনি বন বিটের লোক। এক বিট কর্মকর্তা মওকা দিচ্ছেন বনভূমি দখলের। মাগনা নয়। নীতি হচ্ছে ‘ফ্যালো কড়ি মাখো তেল’। পাঁচ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত মালপানি খসালেই ব্যস। কাম সারা। গত ২৩ মে বড়ছড়া এলাকায় সংঘটিত ঘটনা বড়ই লজ্জার, নিন্দনীয়ও বটে। অবৈধ বসতি স্থাপনকারীদের কাছে একজন মাসোয়ারা তুলতে গিয়েছিলেন। রাশি খারাপ ছিল। মাসোয়ারা তো পানইনি, উল্টো গণপিটুনিতে সিধা হতে হয়েছে। কলিকাল আর কাকে বলে! রাবিশ!!
সেই বিট কর্মকর্তাকে ধরেছিলেন সাংবাদিকরা। যথারীতি অস্বীকার করলেন তিনি। নিয়মই তাই। বললেন, সংঘবদ্ধভাবে কিছু লোক বন দখল করেছে। তৈরি করছে বাড়িঘর। লোকবলের সঙ্কট আছে। সে কারণে এদের উচ্ছেদ করা যাচ্ছে না। বিট কর্মকর্তার এই বক্তব্য/দাবি কতটা ন্যায্য, আমরা জানি না। সময়ে প্রমাণিত হবে। মহাস্বপ্নিল পদ্মা সেতু নিয়ে পানি ঘোলা কম হয়নি। বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ দুর্নীতির। বাংলাদেশ সরকার সেই অভিযোগ প্রবলভাবে অস্বীকার করেছে। তারস্বরে প্রতিবাদ। শেষতক কী দাঁড়াল? যাহা রটে তাহা বটে। এক্ষণে ‘থলের বিড়াল’ বের হতে শুরু করেছে। কালা না ধলা বিড়াল, সেইটা অবশ্য বলা মুশকিল। লেটেস্ট খবর : পদ্মা সেতু প্রকল্পে চার কোটি ৭০ লাখ ডলার বরাদ্দ ছিল পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের জন্য। এ নিয়েই কালো বিড়ালের লাফঝাঁপ। পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের কাজ পাইয়ে দেয়ার জন্য কানাডাভিত্তিক প্রতিষ্ঠানকে টার্গেট করা হয়। এসএনসি—লাভালিন সেই প্রতিষ্ঠানের নাম। ১০ শতাংশ অর্থ কমিশন চাওয়া হয় তাদের কাছে। চাইলেন কারা? যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ তিন কর্মকর্তা। সাবেক মন্ত্রীও আছেন।
পদ্মা সেতু রাজকীয় ব্যাপার। চুনোপুঁটিদের বিষয় না। আপাতত বন-জঙ্গল নিয়েই থাকি। বনখেকোদের সপক্ষে আছেন। যুক্তি খাড়া করণের চেষ্টা করা যাক। সেই যুক্তি খোঁড়া হবে, সন্দেহ নাই। হোক না! নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো। মাজুল কতিপয় যুক্তি এখানে দাঁড় করানোর (বাঁশ দিয়ে ঠেকনা মার্কা) অপচেষ্টা। বন দখলদাররা বেশ করেছে। তাদের ‘অবৈধ’ বলাটা ভালো দেখায় না। শরম লাগে। ছয় ঘোড়াঅলা মইনুদ্দিন, মার্কিন সিটিজেন ফখরুদ্দীনের তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার কি অবৈধ? সেটা তো বর্তমান সরকার বলে না। শরমায়। কানাকে কানা বলতে হয় না। দুঃসাহস করে বলে ফেললে মহাবিপদ। ১১ হাজার ভোল্ট। কান টানলে মাথা চলে আসে যে!
আজাইড়া বনপ্রেমিক হয়ে লাভ কী? ওতে কি দুটো পয়সা আসে পকেটে? জাতীয় আবাসন সঙ্কট প্রকট হয়ে উঠছে দিন দিন। হাজার হাজার বাড়িঘর লাগবে। হলে বহু লোকজনের মাথা গোঁজার ঠাঁই হবে। তারা বন-জঙ্গল কেটেকুটে সাফ করবে। সবজি আনাজ ফসল লাগাবে। সমৃদ্ধ হবে কৃষি খাত। বনের হিংস্র জীবজন্তু মেরে কেটে জনজীবনের নিরাপত্তা দেবে। বেহুদা জীব-জানোয়ার বাঁচিয়ে লাভ কী? তারা মানুষখেকো। অন্য প্রাণীও উদরস্থ করে। বাঘে মানুষ খায়, জখম করে। বন্য হাতির গোদা পায়ের পাছড়া-পাছড়িতে পাবলিক অতিষ্ঠ। এরাও কিন্তু খুনি। মানুষ মেরে ক্ষান্তি। ফি-বছর ফসল নষ্ট করে এন্তার। এসব দর্পিত ঐরাবত আমদানি হয় আমাদের পিয়ারের দোস্ত ইন্ডিয়ার অভ্যন্তর থেকে। বিনা ভিসায়, বিনা পাসপোর্টে। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ আমাদের কিশোরী ফেলানীকে গুলি করে মেরে ফেলে। ঝুলিয়ে রাখে কাঁটাতারে। বিএসএফ কিন্তু মারকুটে হাতি বাহিনীকে আটকায় না। সেই মুরোদও অবশ্য নাই ওদের। বাংলাদেশ আজ বিপন্ন আর্ত রোহিঙ্গা মুসলমানদের ঠেকিয়ে দিচ্ছে। পুশ ব্যাক করছে। যারা ঠেকাচ্ছে, তারা কিন্তু দাদা দেশের বন্য হাতি দেখলে লেজ গুটিয়ে পালায়। কী বৈপরীত্য সেলুকাস!
hasanhafiz51@gmail.com

তালা-চাবির কারিগর


সুমন
সুমন
মুক্তাগাছা শহরে এসে যখন পৌঁছালাম, তখন সূর্য ঠিক মাথার ওপর। মাঝদুপুরেও মানুষের আনাগোনায় জমজমাট হয়ে আছে শহরের বাজারটি। খাবারের দোকানগুলোয় দারুণ ভিড়। অনেক খোঁজাখুঁজি শেষে পাওয়া যায় মুক্তাগাছার বিখ্যাত মণ্ডার দোকান। গোপাল পালের বিখ্যাত মণ্ডা দিয়েই হবে দুপুরের পেটপুজো—এমনটা ঠিক করেই মাঝদুপুরে মুক্তাগাছায় আসা। 
কিন্তু তা হয় না। শুধু মণ্ডা খেয়ে দুপুর পার করা মুশকিল। অনেক কিছু খাওয়ার পরও ভাত না খেলে মনে হয়, দিনটা বুঝি উপোসেই গেল। সস্তা, ভাঙাচোরা একটা হোটেলে গিয়ে ধোঁয়া ওঠা গরম গরম ভাত, কুমড়ো ভাজি আর কচি মুরগির রান চিবোতে গিয়েই পরিচয় হয় সুমনের সঙ্গে। ভালো খাবারের দোকানের হদিস দিয়ে তিনি সাহায্য করছিলেন আমাদের। সুমন তালা-চাবির কারিগর। বাজারের ফুটপাত নয়, একদম ঠিক পথের ওপর মাদুর বিছিয়ে বসে তিনি করেন তাঁর ব্যবসা। পথ দিয়ে যানবাহন গেলেও তাঁর দোকানের পাশ কাটিয়ে যেতে হয়। এ পথের তিনিই রাজা। 
ব্যবসাটা বহু দিনের। এলাকায় ভালো ছেলে বলে পরিচিত, তাই পথের মাঝখানে বসা দোকান নিয়ে নেই কারও কোনো অভিযোগ। ‘গরিব মানু। আমারে সবাই ভালা পায়। ভালা জায়গায় দোহান দেহার ট্যাকা কই পামু। রাশ্তাই ভরসা।’ পথের মাঝখানে কেন দোকান দেওয়া—এ প্রশ্নের জবাব এভাবেই দিলেন সুমন। সংসারে অভাব আছে তাঁর। তবে এ নিয়ে সারাক্ষণ দুঃখ করার মতো মানুষ নন তিনি। বিয়ে করেছেন অল্প বয়সেই। সংসারে আছে মা-বাবা, স্ত্রী আর এক ভাই। সবাইকে দেখে রাখার দায়িত্ব তাঁর। নিজে পড়াশোনা করেননি তেমন একটা। ভাইটা পড়াশোনা করে বড় চাকুরে হবে—এমনটাই স্বপ্ন সুমনের। একটু ভালো থাকার জন্য, একটু বেশি উপার্জনের জন্য রোদের ভেতরেও অনেকক্ষণ বসে থাকেন তিনি খদ্দেরের আশায়। তালা-চাবি নিয়ে কাজ করার নেশাটা হুট করেই পেয়ে বসে তাঁকে। এটাই যে জীবিকার একমাত্র উপায় হয়ে উঠবে, এমনটা ভাবেননি কখনো। অল্প সময়ের ভেতরেই ঝানু হয়ে উঠেছিলেন তালা-চাবির কাজে। প্রথম দিকে দোকান ছিল না। তাঁর কাজের সুনাম ছড়িয়ে পড়ায় বিপদে পড়লেই লোকজন ডাকত তাঁকে। লোকজনের উপকার করে ভালো লাগত খুব। কেউ কেউ তাঁর কাজে খুশি হয়ে বকশিশ দিত। বিয়ের আগ পর্যন্ত সংসারের সবকিছু বাবাই দেখত। চৌপর দিনভর পরিশ্রম করে সংসারটা চালাতেন তিনি। কিন্তু এখন সুমনই দেখছেন সব। বিয়ে করার পর মাথায় চেপে বসেছে অনেক দায়িত্ব। বাবারও বয়স হয়েছে বিশ্রাম করার। তাই নিজে থেকেই সুমন ধরেছেন সংসারের হাল। পথের ওপর দোকান দিয়ে শুরু করেছেন তালা-চাবির কারবার। আয় নেহাত মন্দ নয় সুমনের। তবে এ টাকায় পাঁচজনের সংসার চালানো খুব কঠিন। আগাগোড়া সুখী মানুষ সুমন জানান, বাড়ির সামনে অল্প একটু জায়গায় সবজির বাগান করেছেন তিনি। বউই করেন বাগান পরিচর্যার কাজ। অভাব কেটে যাবে একদিন, অভাবী কিন্তু আশাবাদী সুমনের মুখে এমন কথা শুনে ভালো লেগে যায় খুব। এমন অভাবে থেকেও তাঁর সুখী থাকার দারুণ ক্ষমতা দেখে হিংসাও হয় কিছুটা। আমরা কি ওর মতো অল্পতে তুষ্ট হতে পারি?
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয় একসময়। পড়ে যায় রোদ। বিদায় নেন সুমন। অল্প কিছু টাকা তাঁর হাতে তুলে দিতে চাইতেই প্রত্যাখ্যান করেন তিনি। শুধু দোয়া করতে বলেন। ভাইটা বড় চাকুরে হবে তার জন্য দোয়া, ঘরে নয়া অতিথি আসবে তার জন্য দোয়া, অসুস্থ মা-বাবার জন্য দোয়া। দোয়া করব এমন নিশ্চয়তা দিয়েই ফেরার পথ ধরি। ফেরার পথে চোখে পড়ে মুক্তাগাছার মস্ত নীল আকাশ। তার বুকে ঠাঁই নিয়েছে কচি-বুড়ো মেঘেদের দল। মুক্তাগাছার গুটিকয়েক ছেলে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে আকাশে। মেঘ কেটে কেটে উড়ছে ঘুড়িগুলো। নীলের পশ্চাদপটে তাদের দেখতে লাগছে বেশ। আকাশের এ নীল যেমন-তেমন নীল নয়, ময়ূরকণ্ঠী নীল। রাজধানীটা ছেড়ে বেরোলেই বড় বেশি চোখে পড়ে আকাশের এমন রং। পরিচিত হওয়া যায় সুমনের মতো সহজ-সরল কিছু মানুষের সঙ্গে।
কিঙ্কর আহ্সান

বুধবার, ২০ জুন, ২০১২

শ্রীশ্রী জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা



শি শি র র ঞ্জ ন দা স বা বু
২১ জুন বাংলা ৭ আষাঢ় শ্রীশ্রী জগন্নাথদেবের রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। মানুষের মাঝে সম্প্রীতি, শান্তি ও মৈত্রীর পরিবেশ গড়ে তোলার জন্যই শ্রী বিগ্রহ গণউত্সব লগ্নে মন্দির ছেড়ে রাজপথে সবাইকে দর্শন দানের জন্য বেরিয়ে আসেন। আন্তর্জাতিক কৃষ্ণ ভাবনামৃত সংঘের প্রতিষ্ঠাতা শ্রী প্রভুপাদ ১৯৬৫ সালে তার গুরুদেবের নির্দেশে পাশ্চাত্যে কৃষ্ণ ভাবনামৃত প্রচারের জন্য আমেরিকায় গিয়েছিলেন। সানফ্রান্সিসকোর হেইট অ্যামবেরিতে ভারতবর্ষের বাইরে প্রথম রথযাত্রা উদযাপন করেছিলেন হিন্দু ধর্মমতে। সব জগতের পরম প্রভু হচ্ছেন শ্রী জগন্নাথদেব। ভক্তদের প্রেমের বশবর্তী হয়ে তিনি নিজেকে রাজপথে নিয়ে যাওয়ার জন্য ভক্তদের অনুমতি দিয়েছেন। শ্রী জগন্নাথদেব অত্যন্ত কৃপাশীল। যারা মন্দিরে তাকে দর্শন করতে আসে না, তাদের সবাইকে কল্যাণ ঐক্য কৃপা আশীর্বাদ করতে তিনি মন্দির থেকে বেরিয়ে আসেন। একবার শ্রীকৃষ্ণ, বলরাম ও সুভদ্রাদেবী সূর্যগ্রহণের কুরুক্ষেত্রে সামন্ত পঞ্চতক তীর্থে স্নান করতে যান। এখনও কুরুক্ষেত্রে সূর্যগ্রহণের সময় স্নান করতে বহু পুণ্যার্থী গমন করেন। পাঁচ হাজার বছর আগে শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকা থেকে গিয়েছিলেন কুরুক্ষেত্রে। শুনে সঙ্গে সঙ্গে তারা ছুটলেন কৃষ্ণকে দর্শন করতে। কৃষ্ণ তখন রথে উঠে বলেছেন, তিনি কুরুক্ষেত্র থেকে তার রাজধানী দ্বারকায় ফিরে যাবেন। সঙ্গে রয়েছেন শ্রী বলরাম ও সুভদ্রা। চারপাশে রাজপুরুষ, সৈনিক, কৃষ্ণের বেশও অন্যরকম। গোপবেশের পরিবর্তে রাজবেশ। হাতে বাঁশির পরিবর্তে ধনুর্বাণ। কোমরে তলোয়ার/বর্ম, মাথায় মুকুট। কৃষ্ণকে এভাবে দেখে গোপাদের মন ভরল না। বিশেষ করে রাধারাণী বললেন, এই কৃষ্ণ আমাদের সেই কৃষ্ণ নয়। তাকে আমরা চিনতাম, বৃন্দাবনের বনে বনে আমাদের সঙ্গে সে লীলা খেলা করত। সেই কৃষ্ণের মাথায় ময়ূরের পাখা, তার পরণে পীত বসন, গলায় বনমালা, হাতে বাঁশি আর এই কৃষ্ণের পরণে তো রাজবেশ। রাধারাণীর সেই মনোভাব বুঝতে পেরে বাজবাসীরা কৃষ্ণের রথের দড়ি ধরে। কৃষ্ণের রথের ঘোড়াগুলো ধরে টানতে টানতে নিয়ে চললেন বৃন্দাবনের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে বলরাম, তিনিও ব্রজবাসীদের শৈশবের, কৈশোরের সাথী। তাকেও রথে চড়ালেন। সুভদ্রা বোন, তাকেও তারা নিয়ে চললেন। জগন্নাথপুরীর এই রথযাত্রাটি হচ্ছে গোপাদের সেই কুরুক্ষেত্র রথযাত্রার দ্যোতিক। রথের সময় জগন্নাথ বা কৃষ্ণকে নিয়ে যাওয়া হয় নীলাচল থেকে সুন্দরাচলে। যেখানে কৃষ্ণ ব্রজবাসীদের সঙ্গে আট দিন ছিলেন। এই হচ্ছে রথযাত্রার ইতিহাস। শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু ভাবতেন—‘কৃষ্ণ, কতদিন ধরে আমি তোমায় দেখতে চেয়েছি। আর এখন আমি তোমাকে দর্শন করছি।’ শ্রী প্রভুপাদ বলেছিলেন, ‘বাঁ পাশে একদল, ডান পাশে একদল, সামনে একদল এবং পেছনের দিকে একদল, আর শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু মাঝখানে থাকতেন। তারা সবাই নাচতেন এবং কীর্তন করতেন। রথযাত্রার সময় ভগবান শ্রীজগন্নাথদের স্বয়ং আমাদের সামনে উপস্থিত হন। তাই এটি এমনই সুন্দর সুযোগময় একটি উত্সব, যার মাধ্যমে আমরা ভগবানের প্রতি আমাদের হৃদয়ের ভক্তি ও প্রেম নিবেদন করতে পারি। রথযাত্রার দিন রথরূঢ় পরমেশ্বর ভগবান শ্রী শ্রী জগন্নাথদেব বলদেব ও সুভদ্রাদেবীকে দর্শন করে আপনার হৃদয়ের ভক্তি নিবেদন করুন, রথের রশি ধরে টানুন। ভগবানের প্রসাদ গ্রহণ করুন এবং আপনার মানব জন্মকে সার্থক করে তুলুন।
বাংলা ১০৭৯ সনে ধামরাইয়ে রথযাত্রা উত্সব হয়। ১১০৪ সন থেকে ১৩৪৪ সন পর্যন্ত মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ার বালিয়াটির অমর নারায়ণ রায় চৌধুরী ও ব্রজেন্দ্র কুমার রায় চৌধুরীর মতো জমিদাররা চারটি রথ তৈরি করে দেন। সর্বশেষ রথটি ছিল ৬৭ ফুট দীর্ঘ ও ৫৪ ফুট প্রস্থ, চার তলাবিশিষ্ট। প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় চার কোনায় চারটি করে প্রকোষ্ঠ ছিল। এই প্রকোষ্ঠগুলোকে নবরত্ন বলা হতো। খচিত ছিল দেবদেবীর মূর্তি। সূক্ষ্ম কারুকার্য করা সুউচ্চ এ রথ দেখার জন্য বিভিন্ন দেশের পর্যটক ভিড় জমাতেন। রথ টানার সময় প্রায় ২৭ মণ পাটের কাছি দরকার হতো। রথটি পাক বাহিনী পুড়িয়ে দেয়। এরপর দুই বছর বাঁশের তৈরি রথ দিয়ে রথযাত্রা পালিত হয়। স্বাধীনতার পর টাঙ্গাইলের দানবীর রণদা প্রসাদ সাহার মেয়ে শ্রীমতি জয়াপতি সাহাসহ দানশীল ব্যক্তিদের সহায়তায় তৈরি করা হয় শ্রী শ্রী যশোমাধবের রথ। ২০০৬ সালে রথযাত্রা উপলক্ষে বিশেষ অতিথি হিসেবে তত্কালীন ভারতীয় হাইকমিশনার বীণা সিক্রি ভারত সরকারের পক্ষ থেকে রথটি পুনর্নির্মাণের ঘোষণা দেন। মোট ব্যয় ধরা হয় ৭৮ লাখ টাকা। ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে আদি রথটির আদলে পুনর্নির্মাণ কাজ শুরু হয়। প্রথমে লোহার পাত দিয়ে ৩৭ ফুট দৈর্ঘ্য ও ২০ ফুট প্রস্থ তিন তলাবিশিষ্ট রথের অবকাঠামো তৈরি করা হয়। এরপর লোহার পাতের ওপর সেগুন কাঠের প্রলেপ দিয়ে সম্পূর্ণ ঢেকে দেয়া হয়েছে। কাঠের ওপর চলছে বিভিন্ন নকশার সূক্ষ্ম কারুকাজ। রথের প্রতি তলায় খচিত হয়েছে দেবদেবীর মূর্তিচিহ্ন। ১৫ চাকাবিশিষ্ট। ঢাকা মহানগরীতে ইসকনের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত বার্ষিক রথযাত্রা মহোত্সবটি নিঃসন্দেহে শ্রী জগন্নাথপুরী ধামের পরই বৃহত্তম অনুষ্ঠান। বরাবরই ঢাকা শহরের মানুষ এই রথযাত্রা উত্সবে আন্তরিকভাবে সাড়া দিয়ে থাকেন এবং তার ফলেই এই উত্সবটিকে তাদের নিজেদের শহরের ঐতিহ্যরূপে আপন করে নিতে পেরেছেন। পরম আনন্দের বিষয়। এখন শুধু পুরী ঢাকায় নয়, সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এই ইসকন রথযাত্রা মহাসাড়ম্বরে পালিত হয়ে আসছে। জগন্নাথদেবের রথযাত্রা সনাতন ধর্মাবলম্বী হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম বড় ধর্মীয় উত্সব। রথের চাকার পবিত্র ঘূর্ণনে মুছে যাক সব অন্ধকার। দূর হয়ে যাক অন্যায়-অশান্তি। মহালা লোকে পূর্ণ হোক ধরিত্রী। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে গড়ে উঠুক অসাম্প্রদায়িকতার বাতাবরণ। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও ধর্মীয় ভক্তিবিশ্বাস আমাদের ঐতিহ্যের সম্প্রীতিকে আরও সমুন্নত করে তুলুক। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। যুগ যুগ ধরে এ দেশে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ তাদের নিজ নিজ ধর্ম অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে পালন করে আসছে। এই পুণ্যময় রথযাত্রার মধ্য দিয়ে সমাজে সম্প্রীতির বন্ধন আরও মজবুত হবে। সাফল্য বয়ে আনবে আমাদের জাতীয় জীবনে। আমার এদেশ সব মানুষের—হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান। দেশমাতা সবার। এ প্রত্যাশা আজকের এ দিনে।
লেখক : ধর্মীয় সংগঠক, কলামিস্ট

রথযাত্রা : ইতিবৃত্ত ও তাৎপর্য



॥ পলাশ কুমার রায় ॥

প্রতি বছর আষাঢ় মাসে জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে অনেক মন্দিরে মেলা বসে। বাংলাদেশের বড় রথযাত্রাটি হয় ঢাকার ধামরাইয়ে শ্রীশ্রী যশোমাধব মন্দির থেকে। প্রায় ৩০০ বছরের পুরনো এই মন্দিরে রয়েছে যশোমাধবের বিগ্রহ। ওই সময়কার জমিদার যশোরাজ পাল বিগ্রহটিকে মন্দিরে স্থাপন করেন। তার পর থেকে এই মন্দিরে নিয়মিত শ্রীশ্রী যশোমাধবের পূজার্চনা হয়ে থাকে। ভগবান জগন্নাথদেব হলেন শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং, যিনি জগতের নাথ বা জগদীশ্বর রূপে প্রকাশিত।
বৃন্দাবন ত্যাগ করে মহারাজ নন্দসূত শ্রীকৃষ্ণ তার দ্বারকালীলায় রত হলেন। সূর্যগ্রহণ উপলক্ষে শ্রীকৃষ্ণ যখন কুরুক্ষেত্রে যান, তখন তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বলরাম ও ভগিনী সুভদ্রা এবং দ্বারকা থেকে অনেকেই তার সাথে গিয়েছিলেন। সেই সময় ব্রজবাসীও সূর্যগ্রহণ উপলক্ষে কুরুক্ষেত্রে গিয়েছিলেন। কুরুক্ষেত্রে বৃন্দাবনের গোপ-গোপীদের সাথে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সাক্ষাৎ হলো। ব্রজবাসী ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে তার বাল্যলীলাস্থল বৃন্দাবনে ফিরিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। তারা তাকে রাজবেশে দেখতে চাইলেন না। তারা শ্রীকৃষ্ণকে বৃন্দাবনে ফিরিয়ে নিয়ে ব্রজের বেশে দেখতে চাইলেন এবং তার সাহচর্য পেতে উন্মুখ হলেন। তখন ব্রজবাসী কৃষ্ণ, বলরাম ও সুভদ্রা দেবীর রথের ঘোড়া ছেড়ে দিয়ে নিজেরাই রথ টানতে টানতে বৃন্দাবনে নিয়ে গেলেন। সে ঘটনা স্মরণ করে ভক্তরা আজো পুরীর জগন্নাথ মন্দির থেকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে রথে টেনে বৃন্দাবনে নিয়ে যান। দ্বারকা রাজ্য যেমন শ্রীকৃষ্ণের ঐশ্বর্যলীলার স্থান, বৃন্দাবন তেমনি মাধুর্যলীলার স্থল। 
রথযাত্রার উৎসবে অংশ নেয়ার মানে হলো আত্মোপলব্ধির পথে এক ধাপ অগ্রসর হওয়া। রথযাত্রা শ্রীকৃষ্ণের অন্যতম লীলা। হিন্দুধর্মের বিশ্বাসমতে, এই উৎসবে অংশ নেয়ার অর্থ হলো সরাসরি কৃষ্ণের সংস্পর্শে আসা। যারা মন্দিরে এসে ভগবানকে দর্শন করেন না, তাদেরকে দর্শন দেয়ার জন্য ভগবান জগন্নাথদেব ভক্ত পরিবেষ্টিত হয়ে নিজেই পথে বের হন। রথোপরি ভগবান জগন্নাথ দেবের একবার দর্শনেই জন্ম-মৃত্যুর পুনরাবর্তন রোধে অগ্রগতি লাভ হয়। কেউ যদি রথের রশি ধরে টানে বা রথ স্পর্শ করে অথবা রথোপবিষ্ট বিগ্রহকে দর্শন করে, তাহলে তার মুক্তি সুনিশ্চিত। এই জন্ম-মৃত্যুর চক্র থেকে অব্যাহতি লাভ করতে হৃদয়ে অবস্থিত সুপ্ত কৃষ্ণভক্তিকে পুনর্জাগ্রত করতে হবে। 
আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সঙ্ঘ (ইস্কন)-এর প্রতিষ্ঠাতা শ্রীকৃষ্ণের একজন শুদ্ধ ভক্ত হিসেবে পৃথিবীর প্রায় সব নগর-গ্রামে রথযাত্রা উৎসব পৌঁছে দিয়েছেন। লন্ডন, প্যারিস, নিউ ইয়র্ক, সানফ্রান্সিসকো, সিডনিসহ বিশ্বের অনেক স্থানে রথযাত্রা উৎসব উদ্যাপিত হচ্ছে।
আজ ঢাকার স্বামীবাগ ইসকন মন্দির থেকে বিকেল ৪টায় রথ শোভাযাত্রা শুরু হয়ে তা ঢাকেশ্বরী মন্দিরে গিয়ে শেষ হবে। সপ্তাহান্তে উল্টো রথযাত্রা ইসকন মন্দিরে গিয়ে শেষ হবে। এবারের রথযাত্রায় লাখো মানুষের সমাগম হবে মর্মে আয়োজকেরা জানান। এই উৎসব ও শান্তিপূর্ণ শোভাযাত্রা সাফল্যমণ্ডিত হোক, এই প্রার্থনা। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আমাদের সবার পাপ-পঙ্কিলতা ক্ষমা করুন, দেশের অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ দূর করে শাসকগোষ্ঠীর হৃদয় কোমলকরত ন্যায়ানুগ পদ্ধতিতে দেশ পরিচালনার শক্তি ও ধৈর্য দিন, আমাদের আদর্শ নাগরিক হওয়ার মানসিকতা তৈয়ার করে দিন, আজকের দিনে এই শুভ প্রার্থনা করি মহান স্রষ্টার কাছে। 
লেখক : আইনজীবী, ঢাকা 
palashroy2012@yahoo.com

মঙ্গলবার, ১৯ জুন, ২০১২

কালো হরফে বন্দি একটি কাল, একটি সত্য


মুস্তাফা জামান আব্বাসী
তাহলে সত্যজিৎ রায় কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ? এই জন্য যে, 'পথের পাঁচালী' অর্থাৎ পথের গানেই আছে জীবনের কথা, যার অপর নাম দীন। ওই যে রেলগাড়িটি মাঠের মধ্যে 'ঝিক' 'ঝিক' শব্দ করে বেরিয়ে গেল চোখের সামনে দিয়ে, চিরায়ত বাংলার পটভূমিতে অপুর জীবনের ট্রিলজি, মুহূর্তে যা চিনিয়ে দিল না বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ চিত্র নির্মাতাকে, এর সঙ্গে চিরায়ত মানুষকে।
জানতে হবে মানুষই দীন, দীনই মানুষ

কলকাতায় অক্সফোর্ড বুক স্টোরে মাঝে মধ্যে যাওয়ার সুযোগ পাই। অনেক দিন আগের কথা। একটি বই খুব ভালো লাগছিল পড়তে। সামনেই শালপ্রাংশু সত্যজিৎ। খানিকক্ষণ তাকিয়েই থাকতে হলো। বললাম :আপনিই...? বললেন, হ্যাঁ, আমিই। অটোগ্রাফ আমার জন্য নয়, মেয়ে শারমিনীর। সই হয়ে গেলে পরিচয় দিলাম। বললেন, আমরা উন্মুখ হয়ে থাকি কখন বাংলাদেশ টিভির প্রোগ্রাম হবে! বিশেষ করে নাটক ও লোকসঙ্গীতের অনুষ্ঠান। বললেন, শিগগিরই আসছি। এলে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব। এসেছিলেন কয়েকবার, যোগাযোগ হয়নি।
ওই বইয়ের দোকানেই অনেক দিন পরে, বিজয়া রায়ের লেখা 'আমাদের কথা' বইটি সংগ্রহ করে উপহার দিই আসমাকে। আবিষ্কৃৃত সত্যজিৎ-বিজয়া। বইটি না পড়লে সত্যজিৎ রায়কে পুরোপুরি চিনতে পারতাম না। এ কারণেই বলে থাকি যে, কালো হরফের লেখায় বন্দি কথাগুলোই চেনাতে পারে একটি মানুষ, একটি কাল, একটি সত্য। এমন বর্ণময়, আলোকময়, চিত্রময় জীবনযাপনের কথা আর পড়িনি। পারস্পরিক সম্মান, ভালোবাসা নিয়ে গড়ে উঠেছিল যে সংসার, তা আজ কিংবদন্তি। সংসার অবশ্যই সুখের হয় রমণীর গুণে; সে রমণী যদি হন বিজয়া।
রবীন্দ্রনাথ ভিক্টোরিয়াকে ভালোবেসেছিলেন কিনা মুখ ফুটে বলেননি; 'বিজয়িনী' কবিতায় সে ভালোবাসা এসে দেখা দিয়েছে। প্রবাদপ্রতিম চলচ্চিত্র স্র্রষ্টার জীবনসঙ্গিনী বিজয়ার কাছে পেয়েছি জানা-অজানা কাহিনী, স্মৃতি-বিস্মৃতির জগৎ থেকে তুলে আনা মানিকের প্রেরণার ইতিবৃত্ত। বাংলার মানিক কী করে হলেন পৃথিবীর সত্যজিৎ_ সেই অকপট স্বনিষ্ঠ বিস্তারিত ৫৭৪ পৃষ্ঠার গল্প যে পড়েনি, বড়ই দুর্ভাগা সে। ৮৪ বছর বয়সে কেউ কলম হাতে নিয়েছেন_ এমন ঘটনা জানা নেই। বিজয়া রায় যখন একবার শুরু করেছেন, শেষ অবধি টেনেছেন তার নিজের ও মানিকের গল্প। তার নিজের গল্প আমার কাছে মনে হয়েছে অবিশ্বাস্য। প্রায়শ পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন মানিক। ঘটনাবহুল জীবনের আশাবাদী দিকটি চিরকাল ছিল অক্ষুণ্ন। তাই বাল্য-কৈশোর-যৌবন-প্রৌঢ়ত্ব-বার্ধক্য ও লেখিকা জীবনের অমরত্ব_ সব মিশে আছে এই গ্রন্থে। একেকটি পাতা পড়ছি আর বন্ধ করে অনেকক্ষণ ভেবেছি। এত সুন্দরও জীবন হয়! কাকা-ছোট পিসি-সানিদা-বাবা-কাকামণি-মেজদি-মানুদা-বড়দি-সরস্বতীদি-মেজপিসি-বড়পিসি-মানিক ঠাকুমা (কোলে মন্টু)-খুড়ি মা (কোলে বাচ্চু)-মা-সেজদি-আমি। যেন ছবিতেই নয়, সামনেই দেখতে পাচ্ছি। এমন অনুভব তারই হবে, যে বিজয়া-সত্যজিতের সঙ্গে মিশে যাবে।
'...পাটনার বাড়িটি ছিল ভারি সুন্দর লাল ইটের বাংলোবাড়ি, নাম ছিল লিলি ভিলা, কুয়োর পাশে আমাদের বড় আদরের দুটো গাছ কুল ও পেয়ারা। ওই পেয়ারা গাছে চড়ে কত যে পেয়ারা চিবিয়েছি তার শেষ নেই। কুল গাছটায় হতো মিষ্টি নারকোলি কুল। বারান্দার দু'পাশে দুটো বড় গাছ, একটা আম অন্যটা নিম। নিমগাছে মালি একটা দোলনা টাঙিয়ে দিয়েছিল, কত দোল খেয়েছি ওই দোলনায়, আর আম গাছের কচি আম পেড়ে তেল নুন লঙ্কা দিয়ে মেখে ছুটির দিনে বই পড়তে পড়তে খেয়েছি, সে কথা ভাবলে এখনো জিভে জল এসে যায় ...'।
মানিকের সঙ্গে যখন ঘনিষ্ঠতা শুরু, সে এক মজার কাহিনী। সেই গাল-ফোলা মানিকের গাল ভেঙে এখন মুখটা লম্বা হয়ে গেছে, আর ওর দিকে তাকাতে গেলে মুখটা অনেকখানি তুলতে হয়। বাইশ বছরের মানিকের ছবি সংগ্রহ করেছি, পাঠকদের উপহার দিলাম। রাসবিহারী এভিনিউর বাড়িতে বিজয়াকে আমি যেন কোথায় দেখেছি।
শান্ত সোনালি আল্পনাময় অপরাহ্নের শেষে আসমাকেও আমি দেখেছিলাম একই দৃষ্টিতে। মন্টু ভাইকে (মুস্তাফা মনোয়ার) গিয়ে বললাম, এই মেয়েটিকে আমার পছন্দ। মন্টু আমার দিকে তাকালো। বলল, ভারি মিষ্টি। কোথায় পেলে? সে খুঁজে বেড়াচ্ছে, কাউকে পায়নি। বললাম, এর একটি পেন্সিল স্কেচ এঁকে দাও। পরদিন একসঙ্গে পেন্সিল স্কেচে অনিন্দ্যসুন্দরী আবির্ভূতা। বিজয়ার কাহিনী পড়ছি আর মনে মনে অবাক হয়ে যাচ্ছি। বার্লিন যাওয়ার সময় দমদম এয়ারপোর্টে হাজির সুপ্রিয়া, উত্তম কুমার, মানিক ও বিজয়া। এরা বাঙালির কাছে মহার্ঘ্য শুধু ছবিতেই নয়, কল্পনাতেও।
কোন পাতা ছেড়ে কোন পাতার কথা বলব। সব পাতা লজেন্সের মতো। অল্প করে যেমন লজেন্স ছোটবেলায় খেতাম! খানিকটা লুকিয়ে রাখতাম, পরে ওদেরকে দেখিয়ে দেখিয়ে খেতাম; এ বইও তেমনি।
একজন মুসলমান হিসেবে আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ, যা আমাকে দীনের কাছাকাছি আনবে। যা আনবে না, তার জন্য সময় ব্যয় করব না। তাহলে সত্যজিৎ রায় কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ? এই জন্য যে, 'পথের পাঁচালী' অর্থাৎ পথের গানেই আছে জীবনের কথা, যার অপর নাম দীন। ওই যে রেলগাড়িটি মাঠের মধ্যে 'ঝিক' 'ঝিক' শব্দ করে বেরিয়ে গেল চোখের সামনে দিয়ে, চিরায়ত বাংলার পটভূমিতে অপুর জীবনের ট্রিলজি, মুহূর্তে যা চিনিয়ে দিল না বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ চিত্র নির্মাতাকে, এর সঙ্গে চিরায়ত মানুষকে। জানতে হবে মানুষই দীন, দীনই মানুষ।
'পথের পাঁচালী' (১৯৫৫), 'অপরাজিত' (১৯৫৬) এবং 'অপুর সংসার' (১৯৫৯) শুধু ক্যান ফেস্টিভ্যালে মনুষ্যজীবনের শ্রেষ্ঠ ডকুমেন্টারি হিসেবে ও ১১টি আন্তর্জাতিক পুরস্কারে বিভূষিত হয়নি; জানিয়েছে সারা পৃথিবীর মানুষের মধ্যে এক ঐক্যের কথা। উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর পুত্র, সুকুমার রায়ের সুপুত্র তার ব্রাহ্মজীবনের পাঁচালি প্রকাশ করেননি এই ট্রিলজিতে, বরং সারা পৃথিবীকে জানিয়েছেন বাঙালি মানসের পরম সত্য_ 'সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই'।
সারা পৃথিবী সত্যজিৎকে একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালির মর্যাদা দিয়েছে; সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের পরেই। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ তাকে আনন্দিত করেছিল, কিন্তু তা নিয়ে যায়নি তাকে একটি শিল্পকর্মের দিকে। রিফিউজিদের দুঃখ-কষ্ট তার মনে প্রভাব ফেলেছিল, সোশিয়ালিজমের দিকে তার গন্তব্য ছিল না, বরং রবীন্দ্রনাথের মতোই তিনি ছিলেন একজন এলিটিস্ট। 'পথের পাঁচালী' ট্রিলজিতে যে দারিদ্র্যের ছবি তিনি এঁকেছেন তা তার নিজের দেখা। চিত্রতারকা নার্গিস তার সমালোচনা করে বলেছেন যে, রায় ভারতের দারিদ্র্য রফতানি করেছেন, আধুনিক ভারত নয়। 'সতরাঞ্জ কি খিলাড়ি'তে অযোধ্যার নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ তার ওপর ভর করেছেন। এগিয়ে এসেছেন সায়িদ জাফরি, আমজাদ খান, শাবানা আজমি, রিচার্ড অ্যাটেনব্যুরো। রবীন্দ্রনাথকে, তার বাবা সুকুমার রায়কে নিয়ে তার ডকুমেন্টারি, সুনীলের লেখা 'অরণ্যের দিনরাত্রি'_ চার যুবকের অ্যাডভেঞ্চার; এর পরে 'প্রতিদ্বন্দ্বী', 'সীমাবদ্ধ' ও 'জনারণ্য' সেলুলয়েডে এনেছেন নতুন নতুন নিরীক্ষা।
বিজয়ার জীবনে হঠাৎ এলো কালো মেঘের বিষণ্নতা নিয়ে মাধবী। সত্যজিৎ তাকে ভালোবেসেছিলেন কিনা, বইতে লেখেননি বিজয়া। কষ্ট পেয়েছেন; মুখ বুজে সয়ে নিয়েছেন সে কষ্ট। রবীন্দ্রনাথের জীবনে প্রেমের অধিষ্ঠাত্রী দেবী একজনই। তার নাম কাদম্বরী। একজনই ব্যতিক্রম, যিনি সমর্পিত শুধু প্রমীলায়, তার নাম নজরুল। নার্গিস-কানন-ফজিলাতুন্নেছার কাছে ক্ষণিকের অতিথি।

মুস্তাফা জামান আব্বাসী :সাহিত্য-সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব
mabbasi@dhaka.net