রবিবার, ২৭ মে, ২০১২

হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশ্তী (রাহ:) -এর জীবন ও শিক্ষা



 শাহ্ কাওসার মুস্তাফা চিশ্তী আবুলউলায়ী  
আ জ ৬ই রজব ১৪৩৩ হিজরী, সুলতানুল হিন্দ হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশ্তী আজমেরী (রাহ:)-এর ৮০০ তম উরস মুবারক উদযাপিত হচ্ছে। ৬৩৩ হিজরী ৬ই রজব/১৬ মার্চ ১২৩৬ খ্রী তিনি ভারতের আজমীর শহরে ইন্তেকাল করেন। তিনি যে কতবড় উচ্চমার্গের অলি ছিলেন তার নিদর্শন প্রকাশ পেয়েছিল তার ওফাতের ঠিক পর মুহূর্তেই। উপমহাদেশের বিখ্যাত আলেমে দীন হযরত শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী (রাহ:) তাঁর আখ্বারুল আখিয়ার নামক সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে, হযরত খাজা সাহেবের ললাটে তাঁর ইন্তেকালের পর পরই “হাবীবুল্লাহ মাতা ফী হুব্বিল্লাহ”(অর্থাত্ আল্লাহর হাবীব(প্রিয়তম) আল্লাহর প্রেমেই ইহ্ধাম ত্যাগ করেছেন) শীর্ষক বাক্যটি ফুটে ওঠে। তিনি উপমহাদেশে এসেছিলেন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়াসাল্লামের নায়েব হিসেব। একথা সত্য যে, তার আগমনের বহু আগেই ইসলাম ও মুসলমানদের ভারতবর্ষে আগমন ঘটে এবং অনেক সুফী সাধক ইসলাম প্রচারে নিজেদের নিয়োজিত করেন। কিন্তু হযরত খাজা সাহেবের আগমনে ইসলাম প্রচারে এক বিপ্লব ঘটে এবং তা একটি সামাজিক বিপ্লবেও রূপান্তরিত হয়। তাঁর আবির্ভাবের পূর্বে বিশেষ করে খ্রিষ্টীয় একাদশ ও দ্বাদশ শতাব্দীতে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ চরম পর্যায়ে উপনীত হয়। উঁচু বর্ণের হিন্দু সমাজ তাদের স্ব-ধর্মের নিচু বর্ণের লোকদেরকে অত্যন্ত ঘৃণার চোখে দেখতে থাকেন। সাধারণ মানুষ উচ্চ বর্ণের লোকদের দ্বারা কীভাবে নিগৃহীত হচ্ছিলেন তার বিবরণ আবু রায়হান আল-বিরূনীর কিতাবুল হিন্দ নামক গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক প্রফেসর খালীক আহ্মাদ নিজামী তার তারীখে মাশায়েখে চিশ্ত নামক গ্রন্থে বিষটির উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন যে, আল্লাহ তাদেরকে মানুষ বানিয়েছিলেন কিন্তু তার বান্দারা তাদেরকে, অর্থাত্ নিচু শ্রেণীর লোকদেরকে জানোয়ারের জীবন যাপনে বাধ্য করছিল। আল-বিরূনী আরো বলেন যে, হিন্দুদের মধ্যে জাতিভেদ প্রকট থাকায় এবং মুসলমানদের মধ্যে কোরআনের আয়াত “ইন্না আক্রামাকুম ইন্দাল্লাহি আত্কাকুম” (অর্থাত্ আল্লাহর কাছে সেই সম্মানিত যে আল্লাহকে অধিক ভয় করে) এর মর্মার্থ অনুযায়ী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে মানবীয় মর্যাদা সম্পর্কিত সম্পূর্ণ ভিন্নতর দুটি চিন্তাধারা বিরাজমান ছিল।
হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশ্তী (রাহ:) সেই সময় এই সব জাতিভেদ এবং স্পৃশ্য-অস্পৃশ্যতার বেড়াজাল ছিন্ন করে তাওহীদের দর্শন প্রচার করেন। তাঁর এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে দলে দলে লোক ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নেয়া শুরু করেন। এখানে উল্লেখ্য যে, হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশ্তী (রাহ:) ইরানের সিজিস্তান নামক স্থানে ৫৩৬/৫৩৭ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম খাজা গিয়াসুদ্দীন হাসান। তিনি অত্যন্ত ধার্মিক ছিলেন। খাজা সাহেব মাত্র ১৫ বছর বয়সে পিতৃহীন হন। পৈতৃক সূত্রে তিনি একটি ফলের বাগান লাভ করেছিলেন। ইব্রাহিম কান্দুযী নামক একজন মজ্জুব বুযুর্গের সংস্পর্শে এসে তাঁর জীবনে আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়। তিনি তাঁর ফলের বাগান অন্যদের দান করে দুনিয়াত্যাগী একজন সাধক হিসাবে নতুন জীবন শুরু করেন। আল্লাহ্র রাস্তায় সফরকালীন সময় নিশাপুরের নিকটে হারূন বা হারভান নামক স্থানে চিশিতয়া তরীকার প্রখ্যাত শায়খ হযরত খাজা উসমান হারূনী (অনেকের মতে হারভানী) এর সাক্ষাত্ ঘটে এবং তাঁর কাছে  বায়আত  গ্রহণ করেন। আখবারুল আখিয়ার নামক গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, হজরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশ্তী (রাহ:) দীর্ঘ ২০ বছর ধরে আপন পীর ও মুর্শেদের খিদমতে থেকে উচ্চতর আধ্যাত্মিক মর্যাদা লাভ করেন। এটা ঐতিহাসিক সত্য যে, খাজা সাহেবের এই বাণী অক্ষরে অক্ষরে সত্যে পরিণত হয়েছিল। আফগানিস্তানের অন্তর্গত ঘোর প্রদেশের সাধনকর্তা মঈমুদ্দীন মুহাম্মদ বিন সাম, যিনি শাহাবুদ্দীন মুহাম্মদ ঘোরী নামে সমধিক পরিচিত। স্বপ্নযোগে হযরত খাজা সাহেবের নির্দেশ পেয়ে ভারত আক্রমণ করেন। দিল্লির সন্নিকটে উভয়ের মধ্যে চরম যুদ্ধ হয় এবং সেই যুদ্ধে দেড়শত ভারতীয় রাজন্যবর্গ পৃথ্বীরাজের পক্ষ অবলম্বন করে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন কিন্তু তাঁদের সকল প্রতিরোধ চূর্ণ করে ঘোরী বিজয়ী হন এবং পৃথ্বীরাজকে জীবিত অবস্থায় বন্দি করা হয় এবং সুলতানের নির্দেশে তিনি নিহত হন। এভাবে এই মহান সাধকের দোআয় এই অত্যাচারী শাসকের হাত থেকে জাতি হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশ্তীর দরবারে গরীব, ধনী সবাই সমানভাবে সমাদৃত হতেন। গরীব মিসকিনকে তিনি অত্যন্ত ভালবাসতেন। এই জন্য তাঁর অত্যন্ত বহুল প্রচলিত উপাধি হল গরীবে নেওয়াজ। হযরত গরীবে নেওয়াজ এর রূহানী ফায়েজে এত বিপুল সংখ্যক লোক ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন যে, ইতিহাসে আর কোন মনীষীর হাতে এত অধিক লোক ইসলাম গ্রহণ করেছেন বলে উল্লেখ নেই। প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় নেতা খাজা হাসান নিজামী বিভিন্ন ঐতিহাসিক গ্রন্থ পর্যালোচনা করে তাঁর প্রখ্যাত গ্রন্থ নিজামী বাঁসরীতে উল্লেখ করেন যে, হযরত গরীবে নেওয়াজ এর হাতে প্রায় এক কোটি লোক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। আর এভাবেই সারা ভারত বর্ষে ইসলামের ব্যাপক প্রচার শুরু হয়। হযরত খাজা সাহেবের পরে তাঁর খলিফাগণ, তাঁদের খলিফাগণ এবং অন্যান্য সূফীয়ে কেরাম ও ধর্ম প্রচারকগণ ইসলাম প্রচারের কাজ অব্যাহত রাখেন এবং বিপথগামী মানুষদের সুপথ প্রদর্শন করতে থাকেন। আজ এই উপমহাদেশে, পঞ্চাশ কোটির অধিক মুসলমানের বাস। এর মূল ভিত হযরত গরীবে নেওয়াজ স্থাপন করে গেছেন। তাঁর শিক্ষার মূল বিষয় ছিল আল্লাহ ও তাঁর সৃষ্টির প্রতি প্রেম। তাঁর কাছে খোদা প্রেমই সবচেয়ে বড় শক্তি। যে আল্লাহকে ভালবাসে সে কোন অপশক্তির কাছে মাথা নত করে না। আজ সমাজে যে হিংসা-বিদ্বেষ বিরাজ করছে এর নিরসনে সকলের খাজা গরীবে নেওয়াজের প্রেমের দর্শন থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত। আর তিনি শিক্ষা নিয়েছিলেন আল্লাহর হাবীব রাহমাতাল্লীল আল-আমিন হযরত রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়াসাল্লামের জীবন দর্শন থেকে। নায়েবে নবী সুলতানুল হিন্দ হযরত গরীবে নেওয়াজের ৮০০তম উরসের এই দিনে প্রার্থনা করি এই উপমহাদেশ তথা সমগ্র বিশ্বে শান্তি বিরাজ করুক, সকলে মহান আল্লাহর প্রেমে উজ্জীবিত হয়ে তাঁর সমগ্র সৃষ্টিকে ভালবাসুক।
n লেখকঃ  প্রফেসর, দর্শন বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

1 টি মন্তব্য: