রবিবার, ২৭ মে, ২০১২

যে দেশে শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড



অ জ য়  দা শ গু প্ত
আমার সন্তানটি এবার ম্যাকুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করল। অস্ট্রেলিয়ায় অভিবাসন নিয়ে আসার সময় ওর বয়স ছিল আট। পড়ত দ্বিতীয় শ্রেণীতে। তৃতীয় শ্রেণী না হয়ে এক লাফে চতুর্থ শ্রেণী থেকে তার শিক্ষাজীবনের শুরু। সে এক কাহিনী বটে। বঙ্গদেশ থেকে দু’ক্লাস উত্তীর্ণ শিশুর তো তৃতীয় ক্লাসেই যাওয়ার কথা। তা ছাড়া আমাদের ইংরেজি জ্ঞান বা পড়াশোনার পদ্ধতিও এদের চেয়ে অগ্রসর। ধারণা ছিল তাকে পুনর্বার দ্বিতীয় শ্রেণী থেকেই শুরু করতে হবে। হল উল্টো, কেন এই ব্যতিক্রম? তখন কি আর জানতাম, এ দেশে শিক্ষাও নিয়মের অধীনে, সুশৃঙ্খল আর সবার জন্য সাম্য মেনে চলে। জুনের আগে জন্মালে যে ক্লাসে, জুনের পরে জন্মালে তার পরের ক্লাসে পড়তে হবে এটাই নিয়ম। যেহেতু তার জন্ম মে মাসে, তাকে জোর করেই চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি করানো হল। এই নিয়মের কারণে আমাদের দেশের মতো জন্মদিন, মাস বা বয়স নিয়ে বিশৃঙ্খলা নেই, নেই কোনো ঝুট-ঝামেলা। সবার জন্য এক নিয়ম, আর এই নিয়মের সূতিকাগার হচ্ছে রাষ্ট্র। প্রতিটি মানবশিশুর জন্মতারিখ, সময় আর জন্মের বৃত্তান্ত সেখানে রেজিস্টার্ড, সে দেশে এ জাতীয় বিধি মেনে চলার সমস্যা হওয়ার কারণ নেই। বলছিলাম প্রাথমিক শিক্ষার কথা। ছেলে তো চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে পড়ল ঘোর বিপদে, ভয়ে স্কুলেই যেতে চায় না। একদিন বিদ্যালয় প্রাঙ্গণের বিশাল বৃক্ষটিকে পরম মমতায় জড়িয়ে সে কী কাঁদা। অস্বাভাবিক কিছু নয়, একদিকে সহপাঠীদের ভাষা না বোঝার কারণে বোবার মতো থাকা, অন্যদিকে উঁচু ক্লাস। আমরা পড়লাম অগাধ সমুদ্রে। কী করে পার হব এই সঙ্কটসমুদ্র? একটাই সন্তান আমাদের, আর তার ভবিষ্যত্ ভেবেই তো অভিবাসনের নামে দেশান্তরী হওয়া। কী আশ্চর্য! আমাদের চেয়েও বিচলিত হয়ে উঠল স্কুল। স্কুলের রাশভারী ডেপুুটি প্রিন্সিপাল ডেকে পাঠালেন আমাকে। ভাবলাম কপালে নির্ঘাত ভোগান্তি আছে। গালমন্দ দিয়ে হয়তো ছেলেটিকে হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলবে, ‘অনেক হয়েছে বাপু, এবার নিয়ে যাও।’ গিয়ে দেখি অন্য কাণ্ড। ভদ্রলোকই উল্টো আমাকে সরি সরি বলে ক্ষমা চেয়ে অস্থির। এক মাস হয়ে যাচ্ছে তবু তারা তাকে ধাতস্থ করতে পারছে না বা সে ধাতস্থ হচ্ছে না, এ যেন তারই দায়। অবাক করে দিয়ে বললেন, ওই হপ্তা থেকে তার জন্য অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা হয়েছে। আমি তো প্রমাদ গুনতে শুরু করলাম, সবেমাত্র চাকরিতে ঢুকেছি, গিন্নি তখনও শিক্ষানবিশ, এ সময় অতিরিক্ত শিক্ষা ও শিক্ষকের জন্য ডলার জোগাড় করব কীভাবে? ডেপুটি প্রিন্সিপালই জানালেন এসব ক্লাস বা ওর শিক্ষার জন্য তারা যেসব ব্যবস্থা নিচ্ছেন সবই ফ্রি। উল্টো আমাকেই চয়েস দিলেন, ভালো না লাগলে বা উন্নতি না দেখলে যেন যোগাযোগ করি। সে বিস্ময় আমার আজও কাটেনি। প্রাথমিক শিক্ষার সূচনাপর্বে কাঁচুমাচু সন্তানটি এখন এ দেশের মূলধারায় নাটক করে, ইংরেজি পড়ায়। তার যাবতীয় কৃতকার্যতার পেছনে আছে শৈশবের ওই স্কুলিং, আর সুযোগ যারা দিয়েছিলেন সেসব শিক্ষক এ দেশের অন্যতম সম্মানিত ও প্রতিষ্ঠিত নাগরিক। এ দেশে বা যেকোনো উন্নত দেশে স্কুলের শিক্ষকতা পাওয়া বা শিক্ষক হতে পারাটা পরম গৌরবের। শুধু সামাজিক মর্যাদা বা জ্ঞানের কারণে নয়, এদের বেতন এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও আকর্ষণীয়। উঁচু বেতনে প্রাচুর্য আর সচ্ছলতার ভেতর থাকেন বলেই উজাড় করে শিক্ষা ও শিক্ষার্থীকে সময় দেন তারা। বলাবাহুল্য এ দায়িত্বের পুরোভাগে আছে সরকার ও রাষ্ট্রব্যবস্থা।
এ তো গেল সিডনি তথা অস্ট্রেলিয়ার কথা। আমাদের উপমহাদেশের অপেক্ষাকৃত অগ্রসর দেশগুলোর কথাই ভাবুন। এশিয়ার উন্নত দেশ ও সমাজেও শিক্ষকরা আছেন বহাল তবিয়তে। যে দেশের অর্থনীতি যেমন বা জীবনের মান যেমন তেমনি ধারায়ও তার অধীনে সমাজের শীর্ষে আছেন শিক্ষককুল। প্রাথমিক শিক্ষা বিশেষত স্কুলের প্রথম পাঠ, যেখানে জীবনের বীজ বোনার কাজ শুরু হয়, সেই বীজতলার প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখে সমাজ ও সমাজপতিরা। আমাদের দেশেও সে ধারা চালু ছিল। প্লেইন লিভিং আর হাই থিংকিংয়ের স্বর্ণযুগে শিক্ষকরাই ছিলেন আদর্শ। রোল মডেল বলে পরিচিত শিক্ষকদের ভেতর প্রাথমিক স্তরের শিক্ষকরাই ছিলেন অধিক আদৃত। সাইকেল চালিয়ে মাইলের পর মাইল ছুটে শিক্ষা ও জ্ঞান বিতরণ করতেন তারা। অতি সস্তা দামের পাঞ্জাবি-পায়জামা বা সাধারণ পোশাকের এসব শিক্ষককে দেখে রক্তচক্ষু চেয়ারম্যান, এমপি বা পাড়ার গুণ্ডারাও ভড়কে যেত। আদাব-সালাম পায়ে ধরে দোয়া-আশীর্বাদ চাওয়াটা ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। পাড়া-মহল্লা বা গ্রামগঞ্জে যে কোনো আপদ-বিপদ বা সালিশ-বিচারে এরাই ছিলেন নিয়ামক। কালক্রমে কালো টাকা, সন্ত্রাস আর দুর্নীতির চাপে অন্য ধরনের মানুষ ‘হঠাত্ বড়লোক’ হয়ে ওঠা বাঙালিরাই সব কিছু গ্রাস করে নিল। মাতব্বর আর সমাজপতিদের দৌরাত্ম্যে একঘরে হতে হতে শিক্ষকরা আজ পরাজিত ও পর্যুদস্ত। প্রাইমারি শিক্ষকের হাল যে কোথায় নেমেছে সাম্প্রতিক ঘটনাবলিই তার বড় উদাহরণ। রাষ্ট্র কোথায় পাশে এসে দাঁড়াবে, কোথায় তাকে আশ্রয় দেবে, বড় বা উজ্জ্ব্বল করে তুলবে, তার পরিবর্তে রাস্তায় নেমে এসেছে প্রতিপক্ষ হয়ে। সে প্রতিপক্ষ বা শত্রুতা আজ এতই প্রকট, জাতির কাঁধে তুলে দেওয়া হয়েছে শিক্ষার লাশ। আমি ভাবি এমন ঘটনা বা এর সিকিভাগও যদি এসব দেশে ঘটত, তোলপাড় হয়ে যেত সবকিছু। সরকারের গদি তো নড়তই, রাষ্ট্রও বিচলিত হয়ে উঠত। ধন্য আমাদের সমাজ, ধন্য বঙ্গদেশ, এই ভারি লাশের বোঝাও তাকে কম্পিত বা নতজানু করতে পারল না। শিক্ষা তবে কোন দেশের কোন জাতির মেরুদণ্ড? আমাদের না উন্নত দেশগুলোর?
লেখক : প্রবাসী সাংবাদিক
dasguptajoye.hotmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন