মোকাম্মেল হোসেন
রাত গভীর। নিঝুম। আকাশে ¶য়ে যাওয়া চাঁদ। দূরে কোথাও একটা নিশাচর প্রাণী ডেকে উঠল। জুবায়ের ইত¯—ত ভঙ্গিতে হাঁটছিল। ম্রিয়মাণ চাঁদের আলোয় হঠাৎ সে দেখল, দু’জন লোক তার দিকে এগিয়ে আসছে। তাদের গায়ে রাজকীয় পোশাক। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক ও নাট্যকলা বিষয়ে পাঠদান করা হয়। এছাড়াও আছে একাধিক নাট্যদল। নাট্যকর্মী দু’জন অনেক রাত পর্যš— নিশ্চয়ই কোন নাটকের মহড়া দিয়ে এখন হলে ফিরছেÑ ভাবল জুবায়ের। জুবায়ের নিজেকে আড়াল করার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই লোক দু’জন তার সামনে এসে দাঁড়ায়। এত রাতে জুবায়েরকে দেখে তাদের চেহারায় বিস্ময় ফুটে ওঠে। তারা জুবায়েরের পরিচয় জানতে চায়।
পরিচয় দিতে গিয়ে জুবায়েরের বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। প্রথমেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে মায়ের নিরাভরণ সহজ-সরল মুখ। বাবার গম্ভীর চেহারা। ভাইবোনদের উচ্ছলতা। তাদের নিয়ে কত স্মৃতি, কত কথা যে মনে পড়ে! এরপর এই পৃথিবীর আলো-বাতাসের স্পর্শে যে জীবন নিয়ে বেঁচেছিল সে, সেই জীবনের সব ঘটনা, সব স্মৃতি সিনেমার দৃশ্যের মতো মনের পর্দায় ভেসে উঠতে থাকে। তার মনে পড়ে শৈশব-কৈশোরের কথা। প্রিয় মুখ, প্রিয় বন্ধু ও ¯^জনের কথা। মনে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের কথা। এই ক্যাম্পাস, ক্যাম্পাসের সবুজ সৌন্দর্য, ফুল, প্রজাপতি আর পাখিদের কথা। নি¯—রঙ্গ লেকের জল আর সেই জলে ফুটে থাকা শাপলার কথা। সহপাঠীদের সঙ্গে ক্লাস, আড্ডা, হৈচৈঃ
জুবায়ের আর ভাবতে পারে না। মৃত্যু এসে সীমারেখা টেনে দেয়ার পর তার জাগতিক পরিচয় হারিয়ে গেছে। মহাকালের গর্ভে ঠাঁই নেয়া অযুত-নিযুত মৃত মানুষদের একজন ছাড়া এখন আর কিছু নয় সে। অনেক কষ্টে কান্না সংবরণ করে জুবায়ের উচ্চারণ করে,
: আমার নাম জুবায়ের। আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র ছিলাম। অনেক ¯^প্ন আর অনেক আশা নিয়ে দেশের অন্যতম এ বিদ্যাপীঠে পা রেখেছিলাম আমি। কিন্তু আমার ¯^প্ন সফল হয়নি, আশা পূরণ হয়নি।
লোক দু’জনের একজন এর কারণ জানতে চায়। প্রশ্ন করে,
: কেন?
Ñ কারণ আমাকে মেরে ফেলা হয়েছে। এ বছর জানুয়ারি মাসের ৯ তারিখে ওরা আমাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে।
লোক দু’জন বিমর্ষ হয়। জুবায়ের এবার তাদের পরিচয় জানার চেষ্টা করে। জুবায়েরের কথা শুনে তারা দু’জন দু’জনের দিকে তাকায়। একজন অন্যজনের চোখের ভাষা বোঝার চেষ্টা করে। এক পর্যায়ে একজন মাথা নেড়ে সম্মতি দিতেই অপরজন বলে ওঠে,
: যুবক! তোমার ¯^প্নভঙ্গের কর“ণ কাহিনী শ্রবণ করে যে মহৎপ্রাণ মানুষটির অš—র দুঃখে বিগলিত হয়েছেÑ তিনি মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর। আর আমি হচ্ছি সেই সৌভাগ্যবানদের একজন, যে এই বিশালহƒদয় সম্রাটের কৃপাদৃষ্টি লাভে ধন্য হয়েছিল। আমার নাম ইসলাম খান। ১৬০৮ থেকে ১৬১৩ সাল পর্যš— মোগল সাম্রাজ্যের অš—র্ভুক্ত সুবা বাংলার সুবাদার ছিলাম আমি। সে সময় আমি সুবা বাংলার রাজধানী রাজমহল থেকে ঢাকায় স্থানাš—রিত করি এবং ¶মতাসীন মহানুভব মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের নামানুসারে এর নামকরণ করি জাহাঙ্গীরনগর। উদারহƒদয় সম্রাটের নামকীর্তন করছে যে প্রতিষ্ঠান, তা অবলোকন করার বাসনা নিয়ে আমরা এখানে এসেছিঃ
ইসলাম খানের কথা শুনে জুবায়ের বলে,
: আপনারা অসময়ে এসেছেন। পড়ালেখার পাশাপাশি সবুজ শ্যামল নৈসর্গিক এই ক্যাম্পাসের এক সময় সুনাম ছিল সংস্কৃতি চর্চা, মুক্তচিš—া ও প্রগতিশীলতার জন্য। কিন্তু আজ সব অবর“দ্ধ হয়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে। এখানে এখন শততম ধর্ষণের পূর্তি উৎসব মহাসমারোহে উদযাপন করা হয়। হলের ছাদ থেকে প্রতিপ¶ ছাত্রদের ছুড়ে ফেলে হত্যা করা হয়। এখানে এখন শি¶করা পাঠদানে মনোনিবেশ না করে দলীয় রাজনীতি নিয়ে ব্য¯— থাকেন। পরী¶ার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনার সঙ্গে যুক্ত হন। কন্যাতুল্য ছাত্রী নিপীড়নের কলংকে শি¶কতার মতো একটি মহৎ ও মর্যাদাশীল পেশাকে কলংকিত করেন। অথচ বিলেতের অ·ফোর্ডসদৃশ্য এই বিশ্ববিদ্যালয় নির্দিষ্ট বিধিবিধান অনুসারে পরিচালিত হলে এটি জাতির অহংকারের বস্তুতে পরিণত হতে পারত। কিন্তু তার বদলে এখন এটি একটি নিæমানের দলবাজির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। আর এ দুঃখভার সইতে না পেরে দেখুন, এখানকার সবকিছু কেমন নীরবে রোদন করছে। আপনারা কান পেতে শুনুনÑ এখানে কোথাও কোন আনন্দ নেই। চারদিকে কেবল নিরানন্দের বার্তা। বেদনার ঢেউ। কান্না। হাহাকারঃ
জুবায়েরের কথা শুনে ইসলাম খান ব্যথিত হলেন। সম্রাট জাহাঙ্গীর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এ সময় একটা কোলাহল ধ্বনি ভেসে আসে। সেই কোলাহলের উৎস খুঁজতে খুঁজতে সম্রাট জাহাঙ্গীর, ইসলাম খান ও জুবায়ের উপাচার্যের বাসভবনের সামনে হাজির হয়। সেখানে তখন অনেক মানুষের ভিড়। মানুষের উপস্থিতি ল¶্য করে সম্রাট জোবায়েরকে জিজ্ঞেস করেন,
: এখানে এত মানুষের সমাবেশ কীজন্য?
Ñ সম্রাট, এখানকার লোক সমাগমের উপল¶ হচ্ছেন মাননীয় উপাচার্য। তাকিয়ে দেখুন, শি¶করা এখানে দুটি শিবিরে বিভক্ত হয়ে বসে আছে। এপাশে খড় বিছিয়ে বসে আছে যারা, তাদের কাছে উপাচার্য খলনায়ক। তারা এ খলনায়কের অপসারণ চায়। আর ওদিকে দেখুন, সোফার নরম গদিতে বসে চা পান করছে যারা, যাদের বিনোদনের জন্য টেলিভিশন দেখার ব্যবস্থা করা হয়েছে, তারা উপাচার্যের প¶ের লোক। এরা কিছুতেই উপাচার্যের অপসারণ মেনে নিতে রাজি নয়। পাল্টাপাল্টির এ খেলা প্রায় দু’মাস ধরে চলছে। এর ফলে পাঠদানের কাজ মারাÍকভাবে বিঘিœত হচ্ছে। ছাত্রছাত্রীরা সেশনজটের বিভীষিকায় আতংকে নীল হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেদিকে কারও ভ্রƒ¶েপ নেই। শি¶করা মাসশেষে প্রাপ্য বেতনভাতা পকেটে পুরে গান গাইতে গাইতে গরম চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন। তারপর পান চিবুতে চিবুতে দেশ ও জাতিকে উদ্ধারের উপায় অনুসন্ধান করছেন।
ইসলাম খান অবাক হয়ে জানতে চাইলেন,
: শাসন ¶মতায় অধিষ্ঠিতরা এর সুরাহা করে না কেন?
জুবায়ের দুঃখভরা কণ্ঠে বলে,
: আমাদের শাসকগোষ্ঠী নিরপে¶ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এসব সমস্যার সমাধান খোঁজে না। তারা দেখে, তাদের দলের লোকজন এ¶েত্রে কী অবস্থানে আছে। নিজ দলের লোক যত অন্যায়ই কর“ক, তার
বেলায় সাত খুন মাফ। তাকে তারা র¶ার জন্য সর্বাÍকভাবে চেষ্টা চালায়।
সম্রাট চিšি—ত মুখে বললেন,
: শি¶ার্থীরা এসব মেনে নেয়?
Ñ আমি নিজেও দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। আমি দেখেছি, দলীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত শি¶ার্থীরা এসব শুধু মেনেই নেয় না; তারা এর সপ¶ শক্তি হিসেবেও কাজ করে। সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ শি¶ার্থী এসবের বিপ¶ে থাকলেও তারা র“খে দাঁড়ানোর সাহস পায় না। কারণ ছাত্র রাজনীতির নামে তৈরি হওয়া ক্যাডার বাহিনীর প¶ে থাকে পুলিশ। প্রশাসন। সর্বোপরি রাষ্ট্র¶মতা। তারা এ ¶মতায় বলীয়ান হয়ে যা খুশি তাই করে বেড়ায়।
: আমি এ সময়ের একজন শাসনকর্তা হলে অবশ্যই এ ধরনের রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করতাম।
Ñ সম্রাট, আপনাকে অভিবাদন। আপনি সপ্তদশ শতকের একজন শাসক হয়েও এরকম চিš—া করছেন। আমাদের একবিংশ শতাব্দীর ডিজিটাল রাষ্ট্রনায়করা ভুলেও এ ধরনের চিš—া করবে না। কারণ ছাত্র রাজনীতি হচ্ছে তাদের ¶মতায় আরোহণের অন্যতম সিঁড়ি। এ সিঁড়ি অটুট রাখতে গিয়ে যদি প্রতি বছর দেশের শি¶া প্রতিষ্ঠানগুলোয় বিশ-পঞ্চাশটা লাশ পড়ে তাতে তাদের কিছু যায় আসে না। কারণ শাসকবর্গের সš—ানরা এসব শি¶া প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করে না। এখানে যারা পড়তে আসে, তারা কৃষকের সš—ান, শ্রমিকের সš—ান, মজুরের সš—ান। এদের মৃত্যু নিয়ে তাদের কোন মাথাব্যথা নেই।
উš§ুক্ত জনসমাবেশস্থলে বেশি¶ণ থাকা নিরাপদ নয় ভেবে তিনজন হাঁটতে হাঁটতে লেকের পাড়ে চলে আসে। লেকের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য দেখে সম্রাট বিমোহিত হলেন। তিনি আপনমনে বলে উঠলেন,
: যদিও এ এক অসম্ভব কল্পনা, তারপরও রাতের এই আকাশ সা¶ীÑ আমি যদি এ¶ণে শাহজাদা সেলিমের অবয়ব ফিরে পেতাম আর আনারকলি আমার সামনে এসে দাঁড়াত, তবে তার হাত ধরে এই লেকের পাড়ে হাঁটতে হাঁটতে এর অপূর্ব সৌন্দর্য সুধা পান করতাম।
জুবায়ের এ সময় বলে ওঠে,
: সম্রাট, কিছু মনে করবেন না। আপনি কিন্তু আনারকলির ব্যাপারে কাপুর“ষতার পরিচয় দিয়েছেন।
সম্রাট বিষণœ হলেন। তারপর বললেন,
: কাপুর“ষতাÑ ঠিক আছে। তবে এটাও সত্য যে, আমাদের প্রেম মহাপরাক্রমশালী মোগল সম্রাট আকবরের ¯ে^চ্ছাচারিতার শিকার হয়েছিল।
সম্রাটের কথা শুনে জুবায়ের হাসে। তারপর বলে,
: আনারকলির প্রেম যেমন ¯ে^চ্ছাচারিতার আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল তেমনি বর্তমান উপাচার্যের ¯ে^চ্ছাচারিতায় এ বিশ্ববিদ্যালয় হারাতে বসেছে তার অতীত গৌরব আর সুনাম। উপাচার্যের অসংখ্য ¯ে^চ্ছাচারিতার একটি দৃষ্টাš— হচ্ছে এই লেক। প্রাকৃতিক নিয়মে প্রতি বছর অসংখ্য অতিথি পাখির কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে উঠত এ লেক। পাখিদের অভয়াশ্রম হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছিল এ ক্যাম্পাস। আজ উপাচার্যের ¯ে^চ্ছাচারিতায় পাখিরা হারিয়েছে একটি মনোরম অভয়াশ্রম। অত্যš— পরিতাপের বিষয়, গত শীত মৌসুমে এখানে কোন পাখি আসেনি।
Ñ কেন আসেনি? সম্রাট জানতে চাইলেন।
: উপাচার্য মাছ চাষের জন্য লেক ইজারা দিয়েছেন। ইজারাদাররা অত্যš— নিষ্ঠুরভাবে প্রথমে লেকের শাপলাগুলো উজাড় করেছে। তারপর পানিতে রাসায়নিক পদার্থ ঢেলে এ জলাধারকে মৎস্য চাষের উপযোগী করে তুলেছে।
এ সময় ইসলাম খান বললেন,
: নিশ্চয়ই বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্য এটি করা হয়েছে?
ইসলাম খানের কথা শুনে জুবায়ের না সূচক ভঙ্গিতে হাত নাড়ে। তারপর মুখ বিকৃত করে বলে,
: কেউ জানে না, ইজারার টাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কী উন্নতি সাধন হয়েছে! তবে উপাচার্য ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা যে লাভবান হয়েছেনÑ এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।
মোকাম্মেল হোসেন : সাংবাদিক
ড়হহধপযরঃৎধ@মসধরষ.পড়স
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন