সোমবার, ৭ মে, ২০১২

কোথায় যাও পথিক



আল মাহমুদ
সম্ভবত একবার লিখেছিলাম, কাদের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করে বেশি তাগাদা পেয়ে হয়রান হতে হয় না। আমি বলেছিলাম, নারীদের কাছ থেকে ঋণ নিলে অপেক্ষাকৃত কম হয়রানি পোহাতে হয়। হয়ত আমার জীবনে যা সত্য তা অন্যের জীবনে ততটা সত্য নাও হতে পারে। তবে ঋণের ওপর ঋণ করতে হলে বুদ্ধিমান ঋণগ্রহীতাদের মেয়েদের কাছে হাত পাতাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। আমি মেয়েদের কাছে ঋণ নিতে উত্সাহ দেয়ার জন্য একথা বলিনি। বলেছি ঋণ গ্রহীতাদের সুবিধা কোথায় সহজে পাওয়া যাবে সেটার একটু আলোচনার জন্য। আমি অবশ্য যখনই আর্থিক সঙ্কটে পড়েছি তখনই আমার স্ত্রীর কাছে হাত পাততে সঙ্কোচ করিনি। আর এটা হলো সবচেয়ে নিরাপদ এবং হয়রানি না পোহাবার প্রসঙ্গ। অবশ্য অনেক দিন হলো আমার স্ত্রী গত হয়েছেন। তার কথা মনে হলে খুবই বিব্রত এবং বিষণ্ন হয়ে থাকি। কিছু কিছু ব্যাপার আছে যা একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় যা বলা সঙ্গত নয় এবং বিব্রত বোধ করার
মতো বিষয়।
আজকাল আমার বয়সের মতোই আমি বিষণ্ন ও বিব্রত অবস্থার মধ্যে কাল কাটিয়ে চলেছি। মনে হয় লেখক হিসেবে, কবি হিসেবে আমি অত্যন্ত সৌভাগ্যবান ব্যক্তি। সময় দ্রুত চলে যাচ্ছে। অথচ স্মৃতির পেছনে ধাওয়া করার অভ্যেস এবং আচরণ এখনও আমাকে একেবারে পরিত্যাগ করেনি। ভালোবাসারও একটা ঋণ আছে, যা প্রেম দিয়ে শোধ করতে হয়। পেছনে ফিরে তাকালে অশ্রুজলে চোখ আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। বেশিদূর অতীতের দিকে তাকানো যায় না। আর অতীতকে দেখার সাহস আমারও তেমন অটুট নেই। আমার শৈশবকালের একটা অভ্যেস ছিল, আমি কাঁদতে পারতাম না। কাঁদার অভ্যেস আমার অপেক্ষাকৃত কম। তবে দুঃখ ও যাতনায় আমার চোখ দিয়ে অশ্রু উপরে পড়ে। দুই গণ্ডদেশ ভিজে পানির নদী বইতে থাকে। আমি সইতে জানি বলেই কাহিনী কইতেও জানি। এ পর্যন্ত কত কথাই তো লিখে গেলাম। মনে হয় কাহিনী অফুরন্ত অনন্তকালের দিকে বয়ে চলেছে। কিন্তু আমি অদৃঢ় মানুষ হলেও চুপ করে তাকিয়ে বসে থাকি। চোখ ভাসে, কিন্তু হৃদয়ের এক স্পর্শকাতর স্থান হাসতে থাকে। তবু লিখে থাকি এবং অক্ষরের মালা বুকের জ্বালা হয়ে নিজেরই মুখের ওপর ঝরতে থাকে, নড়তে থাকে। আমি বেদনার গল্প লিখতে খানিকটা অভ্যস্ত বলেই জানি। যত রচনা আমার প্রকাশিত হয়েছে সে সব হৃদয়বিদারক না হলেও মানুষের অন্তরে বিহ্বলতার সৃষ্টি করে। এর মানে এই নয় যে, আমি আনন্দের কথা লিখতে পারি না। আনন্দের বিষয় হলে তা নিরানন্দ ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। তবে আমার কাছে কবির প্রেমের বিষয়টি একটু অন্যরকম। আমি ইচ্ছে করলে ডালপালা মেলে দিতে পারি। কিন্তু এই ডালপালা মেলে দেয়ার সব বিষয়ই একটি বৃক্ষে পরিণত হয়। আমি কবি হিসেবে গাছের সঙ্গে বায়ুর মর্মর তুলে পাতার খসখস শব্দে কথা বলতে জানি। এজন্যই তো আমি কবি। কবি মানে হলো স্বপ্ন কল্পনার কথক, আমার বিবৃতি ছন্দে প্রকাশিত হয়, গন্ধে পরিবেশকে আকুল করে। প্রাণীদের মধ্যে সঞ্চার করে বেদনার। আমরা এর নাম দিয়েছি বিরহ। এই বিরহের কাহিনী লিখেই কত মানুষ, কবি-পুরুষ অমর হয়েছেন। আমি যদিও অমরতায় অতটা আস্থাবান নই, তবে কবির কর্মক্ষমতায় খুবই ভরসা রাখি। মানুষের কাহিনী বর্ণনায়, প্রেমের গল্পকেই প্রাধান্য দেয়া হয়। আমি অবশ্য প্রেমের কাহিনী একাধিকবার বললেও বিরহের বেদনার বিমর্ষতার গল্পই অধিক বলেছি। কারণ আমি যদিও অনন্তকালের যাত্রী। কিন্তু মুখ ফিরিয়ে মাঝে মধ্যে পার হয়ে আসা প্রান্তর, তেপান্তর ইত্যাদিও পর্যবেক্ষণ করি। আমি দেখি, লিখি এবং একই সঙ্গে পেছন ফিরে পার হওয়া প্রান্তর নদী, গাছপালা সব কিছুই প্রত্যক্ষ করি। আজ তো বহু দূরে এক অজ্ঞাত অসাধারণ বাঁশির সুরে চলে এসেছি। টানে, গানে, আহ্বানে সাড়া দিতে দিতে নিজের পাড়া-প্রান্তর ছাড়িয়ে কোথায় এসে পড়েছি তা আর জানি না, চিনি না। স্থান কাল মানলেও এক জাদুকরী মায়াবী আহ্বান আমাকে প্রায় ৮০ বছর ধরে হাঁটিয়ে নিয়ে এসেছে অফুরন্ত এক প্রান্তরের মধ্যে। শুধু মুখে বলছি চলে যাচ্ছি। কিন্তু মন বলছে কোথায় যাও পথিক!
লেখক : কবি

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন