রবিবার, ২৭ মে, ২০১২

‘জেনেশোনে বিষ করেছি পান' এই মধুমাসে


সাজজাদ হোসাইন খান

জ্যৈষ্ঠমাসকে বলা হয় মধুমাস। এ মাসে নানা ধরনের রসালো ফলে সয়লাব হয় হাট-বাজার। এক সময় শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলো ছুটি ঘোষণা করতো এ মাসে। এই ছুটির নাম ছিল আম-কাঁঠালের ছুটি, গ্রীষ্মের ছুটি নামেও পরিচিতি ছিল। ছাত্র-ছাত্রীগণ গ্রামে ছুটে যেত, ফল-উৎসব করতো। নানাবাড়ি, দাদাবাড়ি করতো। একটা অন্যরকম অনুভূতি আনন্দে আন্দোলিত করতো বড়-ছোট সবাইকে। এখন আর সে দৃশ্য দেখা যায় না। স্কুল-কলেজগুলোতেও আম-কাঁঠালের ছুটির অস্তিত্ব নাই। থাকলেও তা নামে মাত্র। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে ফল-ফলাদির গাছ প্রায় উজাড়। গ্রাম-গঞ্জ বৃক্ষশূন্য হতে চলেছে। প্রয়োজনের তুলনায় অপর্যাপ্ত হলেও নানা কিসিমের ফল কেবল আম-কাঁঠালই নয় বিভিন্ন নামের রসালো ফল বাজারে আসে। এই ফলের মিষ্টিগন্ধ তখন বাতাসকে উতলা করে, হৃদয়কে করে প্রশান্ত, আর রসনাকে করে তৃপ্ত। জ্যৈষ্ঠমাস এখন উপস্থিত রসালো ফলের ডালি নিয়ে। আম, কাঁঠাল, জাম, লিচু, তরমুজসহ আরো অনেক ফলই এখন বাজারে। কিন্তু উচ্চমূল্যের কারণে অনেকেরই নাগালের বাইরে এসব ফল। বিশেষ করে স্বল্প আয়ের মানুষের কাছে ফল ভক্ষণ এক প্রকার দুরূহ ব্যাপার। তবু মওসুমী ফলের অপেক্ষায় থাকে শহর-গ্রামের মানুষ।
ফিবছর এই সময়টা আসে আনন্দ-উল্লাসের সাথে। পাশাপাশি আতঙ্ক-আশঙ্কাও ছড়িয়ে পড়ে দেশময়। কারণ এইসব ফলের শতকরা আটানববই ভাগই থাকে বিষ বহনকারী। ফল ভক্ষণের ফলে দীর্ঘমেয়াদী বিষক্রিয়ায় মানবদেহ জেরবার হয় মারাত্মক সব ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে। পুষ্টির পরিবর্তে মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ায়। কোন সময় ফলের পচন রোধে আবার কোন সময় অপুষ্ট ফল পাকানোর জন্য ওষুধ প্রয়োগ করে একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী। যে ওষুধ মানবদেহকে মারাত্মক ক্ষতির দিকে ধাবিত করে। শেষাবধি মৃত্যুর কারণ হয়। তাই এই দুষ্টচক্রকে ‘অসাধু' বিশেষণের আওতায় না এনে সরাসরি ‘খুনি' শব্দটি ব্যবহার করা দরকার। চিকিৎসা-বিজ্ঞানের মতে, ফলে যে পরিমাণ অহিতকর ওষুধ মেশানো হয় তা মানবদেহে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করে। পুষ্টির পরিবর্তে অপুষ্টির জন্ম দেয়। প্রতি মওসুমে এই বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয় পত্র-পত্রিকায়, সভা-সেমিনারে। বছর ঘুরলেই সব ভুলে যায় মানুষ। দ্বিগুণ উৎসাহে খুনি ব্যবসায়ীরা কার্বাইড-ফর্মালিন ইস্তেমাল শুরু করে। যদিও অভিযান জরিমানার মহড়াও সরকারের বিশেষ বিভাগগুলোর পক্ষ থেকে করা হয়। এসব অভিযানে তেমন কোন ইতিবাচক লক্ষণ বাজারে পড়তে দেখা যায় না। বিষ মেশানো ফলে বাজার ভরা থাকে। বেচা-বিক্রিও মন্দ হয় না। প্রতি মওসুমেই সরকারের এই বিভাগটি তাদের জনসংখ্যার স্বল্পতা এবং যন্ত্রপাতির অপ্রতুলতার অজুহাত প্রকাশ করে। এই অজুহাত আর কতকাল চলবে? কুমিরের এক ছানাকে সাতবার দেখানোর মতো হয়েছে এদের। প্রশ্ন রাখলেই তারা একটি শব্দই উচ্চারণ করে ‘অল্প-স্বল্প' ইত্যাদি। তবে দেশবাসীর ধারণা, কথিত স্বল্পতার পশ্চাতে অন্য কোন বৃহৎ কারণ লুকিয়ে থাকা বিচিত্র নয়। যেমন ফুটপাত পরিষ্কার হয় না আইনশৃক্মখলা বাহিনীর সাথে ফুটপাত ব্যবসায়ীদের বামহাতের কায়কারবারের কারণে। এটি যেভাবে ওপেন সিক্রেটের তালিকায় উঠে গেছে ঠিক তেমনি এই বিভাগটিরও সিক্রেটের ফুল ফুটতে শুরু করেছে ইতোমধ্যে। এত জরিমানা-সাবধান বাণী শুনানোর পরও প্রতি মওসুমে একই দৃশ্য কেন দেখছে মানুষ। বিষেভরা লোভনীয় ফলে বাজার সয়লাব হবে কেন? খুনি তেজারতরা চাঙ্গা হয় কোন সাহসে!
আপাতকারণ গুরুপাপে লঘুদন্ড। খুনির ফাঁসির বদলে যদি সাতদিনের হাজতবাস হয় তাহলেতো খুনির পোয়াবারো হবেই। হাজতবাস শেষ করে বিপুল উৎসাহে দ্বিতীয় খুনের আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। এমনটাই অপরাধীর দস্তুর। ফল ফসলে যারা বিষ মিশায় অধিক লাভের আশায়, কঠিন শাস্তির পরিবর্তে জরিমানা-টরিমানায় এদেরকে নিবৃত করা সম্ভব হবে না। কারণ অর্থলোভ একটি দুরারোগ্য ব্যাধির নাম। এই জাতীয় ব্যাধি উপশমে প্রয়োজন উচ্চতর চিকিৎসা, উচ্চতর চিকিৎসক। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে দেশে এ দু'টিরই অভাব প্রকট।
ফল-ফলাদিতে বিষ, আনাজ-পাতিতে বিষ, বিশেষ করে খাবার জিনিসে বিষ প্রয়োগের মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। খাবার-দাবার এবং ফল-ফসলে নির্দিষ্ট মেয়াদে সংরক্ষণের জন্য প্রিজারভেটিভ ব্যবহারের একটা রীতি রয়েছে। তাও সহনীয় পরিমাণে, যা মানবদেহ ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে না। কিন্তু বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম। প্রিজারভেটিভের নামে এখানে সরাসরি বিষজাতীয় ওষুধ প্রয়োগ করা হচ্ছে। আনাজ-পাতিতেও একেবারেই অনাহূতভাবে ফর্মালিন-কার্বাইড জাতীয় ওষুধ স্প্রে করছে। মাছে ফর্মালিন মেশানো তো বর্তমানে স্বাভাবিক রীতি হিসাবেই উঠে আসছে। অপুষ্ট ফল পাকানোর জন্য ব্যবহার করে কার্বাইড। এসব ওষুধের মাত্রাতিরিক্ত প্রয়োগ বিষয়টিকে জটিল করে তুলছে। চিকিৎসকরা বলছেন, ফলে বিষ মানব দেহে ক্যান্সারের মতো মারাত্মক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। হৃদরোগ, ডায়াবেটিসের মতো রোগীর সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে কেবলমাত্র বিষাক্ত ফল ভক্ষণের কারণে।
এরই মধ্যে মওসুমী ফল আম নামতে শুরু করেছে। ফলের দোকানগুলোতে সাজানো আছে পাকা আম। আসলেই কি এগুলো পাকা? পরীক্ষা করলে দেখা যাচ্ছে, অপুষ্ট আম কার্বাইড প্রয়োগ করে পাকানো হয়েছে। ইতোমধ্যে বিএসটিআই লোকজন বিভিন্ন আড়তে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ কার্বাইড যুক্ত আম ধ্বংস করেছে। ফি-বছরই তারা এ কাজটি করে থাকেন। তারা নিজেরাই ঘোষণা করেন তাদের লোকবল এবং যন্ত্রপাতির অপ্রতুলতার কারণে অভিযান অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এই সুযোগে খুনি-ব্যবসায়ীরা মুনাফা গুণে। বিপরীতে বিষভরা আম খেয়ে ক্রেতা সাধারণ অসুস্থ হয়।
এই অপরাধের দন্ড যে পরিমাণ তা মোটেও যুক্তিযুক্ত নয়। পাঁচ-দশ হাজার বা লাখ টাকা জরিমানা অপরাধের তুলনায় এটি কোন শাস্তিই নয়। এই জরিমানার অর্থ তারা তুলে নিচ্ছে অন্য কোন চালান থেকে। যে জন্যে এই অপরাধের মাত্রা কমার বদলে বৃদ্ধি পাচ্ছে। খাদ্যদ্রব্যে যারা বিষ মিশায় তারা আসলে জীবননাশের অপরাধে অপরাধী। খুনের বদলে খুন। এদের অবশ্যই মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা উচিত। নিদেন পক্ষে যাবজ্জীবন কারাদন্ড। সেখানে ৫/১০ হাজার টাকা জরিমানা হাস্যকর বলেই মনে হয়। সভ্যদেশে খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল মারাত্মক অপরাধ বলেই বিবেচিত হয়। প্রয়োজনবোধে আইনের সংশোধন দরকার। আইন কঠোর না হলে, শাস্তির মাত্রা বৃদ্ধি না পেলে খুনি-ব্যবসায়ীগণকে নিবৃত করা হবে অসম্ভব। তাছাড়া একটি-দুটি আড়ৎ এবং ৫-১০ মণ আম ধ্বংস করে শুদ্ধি অভিযানের শুদ্ধতার ফল পাওয়া যাবে না। কেবল পাইকারী দোকানদার নয়, খুচরা দোকানগুলোতেও হানা দিতে হবে। ঘোষণা দিতে হবে যার কাছেই বিষ মাখানো ফল পাওয়া যাবে, তারই জেল-জরিমানা। যেমন নকল নোটের ব্যাপারে ঘোষণা আছে। তাছাড়া যারা অভিযানের হর্তাকর্তা তাদের সাধুতা এবং স্বচ্ছতা অপরাধীদের দ্বিতীয়বার অপরাধে অগ্রসর হতে একশ'বার ভাবনায় ফেলবে। এমন ঘোষণা এবং কার্যক্রম যতসত্বর আসবে ততই মঙ্গল দেশ এবং জনগণের জন্যে।
কার্বাইড-ফরমালিন পুষ্ট ফলে বাজার সয়লাব হবার আরও একটি বড় কারণ হলো ক্রেতাসাধারণের নির্বুদ্ধিতা এবং অসচতেনতা। ফলে বিষ এ তথ্যটি বোধ হয় কারো অজানা থাকার কথা নয়। যেভাবে এ খবরটি পত্র-পত্রিকায় চাউর হয় তাতে করে তো বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরেই পৌঁছে যায়। এরপরও এক শ্রেণীর মানুষ মওসুমের প্রথম ফলটির আস্বাদ নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এই ব্যস্ততায় খুনি ব্যবসায়ীরা উৎসাহ পায়।  জেনে-শোনে যদি কেউ বিষ পান করে তাকে নিবৃত করা কষ্টকর তো বটেই। যে জন্যে বিষ মাখানো ফল বাজার পায়। মওসুমের প্রথম ফলটি খেতে হবে। অবশ্যই খাব, যদি তা পুষ্ট এবং স্বাস্থ্যকর হয়। কিন্তু প্রায়শই দেখা যায়, বাজার থেকে যে ফলটি কেনা হচ্ছে এর ৯৮ ভাগই ভেজাল, শরীরের জন্য ক্ষতিকর। তারপরও কেউ কেউ হুমড়ি খেয়ে পড়ে দোকানে। এ ধরনের বেবুঝ ক্রেতার কারণেও অসাধু বা খুনি-ব্যবসায়ী যে নামেই ডাকা হয়, যাদের দৌরাত্ম্য কমছে না। ক্রেতাদেরও দায়িত্ব আছে। নিজের বুঝতো পাগলেও বুঝে। আমরা কি পাগলের চেয়েও অধম হয়ে গেলাম?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন