মঙ্গলবার, ২৯ মে, ২০১২

‘ওগো নজরুল হয়নি মোদের কোন ভুল’



মনিরুজ্জামান মনির
‘চিরতরে আমি দূরে চলে যাবো। তবু আমারে দেবো না ভুলিতে’—কবি নজরুল এই গানের অংশবিশেষ শুধু তার প্রিয়ার উদ্দেশে উচ্চারণ করেননি, তিনি সমগ্র মানব পাঠক, মানব-শ্রোতার উদ্দেশে এই গীতিময় বাণী রচনা করেছিলেন। সত্যিই তো আমরা নজরুলকে, নজরুলের অপূর্ব সৃষ্টিকে ভুলতে পারিনি, কখনও ভুলতে পারব না। তাই তো কবির ১১৩তম জন্মবার্ষিকী উদযাপিত হয়েছে, এই বাংলাদেশে সাড়ম্বরে, সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে। নজরুল বলেছিলেন, ‘আমার এই পরিচয় হোক, আমি তোমাদের লোক’। হ্যাঁ, অবশ্যই নজরুল আমাদের লোক। আমাদের সাহিত্য, সংস্কৃতি, সঙ্গীতের রাজকীয় ভাণ্ডারের অর্ধেকের বেশি পূর্ণ করে রেখেছেন তিনি। যুগে যুগে সেই সঞ্চয় আমাদের করবে অহঙ্কারী, করবে অনুপ্রাণিত। অভিমান করে নজরুল কখনও বলেছেন, ‘আমায় নহেগো ভালোবাসো শুধু ভালোবাসো মোর গান।’ নজরুলের গানকে এবং নজরুলকে ভালো না বেসে উপায় নেই। কেননা তার গানে আছে সাম্যের কথা, মানবতার কথা, নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কথা, ঝঞ্ঝার মতো উচ্ছল, প্রকৃতির মতো সচ্ছলতার কথা। বিশ্বলয়ে খেলা করা বিরাট শিশুর কথা। অসাম্প্রদায়িকতার কথা, মানবপ্রেমের কথা, ইতিহাসের কথা, সংগ্রামের কথা, বেঁচে থাকার অধিকার আদায়ের কথা, তারুণ্যের কথা, যৌবনের কথা, তার গানের সুর, রাগ-রাগিণী আশ্রিত-মিশ্রিত হয়ে নতুন এক ম্যালোডিপূর্ণ সুরের রূপ ধারণ করেছে। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘সহজ কথায় বলতে আমায় কহ যে, সহজ কথা যায় না বলা সহজে।’ নজরুল ইসলাম তার গানে ওই সহজ কথা বলেছেন সহজে। তাই সহজ কথায় ভাব প্রকাশ নজরুলগীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সাধারণ মানুষের একজন গান শুনে বুঝতে পারে এটি তার হৃদয়ের কথা, অনুভবের কথা। নজরুল তার গানের মতো, কবিতার মতো, গল্পের মতো জীবন যাপন করেছেন। এই সৃষ্টিগুলো তার বাস্তব অভিজ্ঞতারই আন্তরিক বহিঃপ্রকাশ। স্মৃতির ফ্ল্যাশব্যাকে দেখা যায় তিনি জন্মের পর থেকে দারিদ্র্যপীড়িত মানুষ, বিটিশবিরোধী আন্দোলনে সশরীরে সংগ্রামরত সৈনিক, কণ্ঠশিল্পী, গানের শিক্ষক, একজন প্রেমের কাঙাল, সাচ্চা প্রেমিক। নজরুল তার সাহিত্যকর্মে, সঙ্গীত সৃষ্টিতে বাংলার সঙ্গে মিশ্রণ ঘটিয়েছেন কিছু উর্দু, আরবি, ফার্সি শব্দসহ বিদেশি সহজবোধ্য শব্দ। এতে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধ বা অলঙ্কৃত হয়েছে বলা যায়। তার কিছু কিছু গানের সুরেও ইরানি, ইরাকি, মিসরীয় প্রলেপ লক্ষ্য করা যায়। এতে বাংলা গানে সুরের নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। নজরুলগীতির আঙ্গিক গায়কি এতই ব্যতিক্রমী, মৌলিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী যে, সেই গীত নিয়মিত পরিবেশনকারী গায়ক-গায়িকাকে নজরুলগীতির শিল্পী হিসেবে চিহ্নিত বা বিশেষিত করে দেয়। এই প্রসঙ্গে কণ্ঠশিল্পী ফিরোজা বেগম, সোহরাব হোসেন, সুধীন দাস, খালিদ হোসেন, শবনম মুশতারী, ফাতেমা তুজ জোহরা, মোঃ সালাউদ্দিন, রওশন আরা মোস্তাফিজ, নাশিদ কামাল প্রমুখের নাম উল্লেখ করা যায়। নজরুল অন্যায়-অবিচারে ‘বিদ্রোহী’ হয়েছেন, বাজিয়েছেন ‘অগ্নিবীণা’, ‘বিষের বাঁশী’। নজরুলগীতি যেমন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মন্দিরে পূজায় প্রার্থনায় গীত হয়েছে, তেমনি ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মনের মসজিদে উচ্চারিত হয়েছে আল্লাহ ও নবীর হামদ-নাতে। কবির এক হাতে ছিল বাঁশের বাঁশরী, আরেক হাতে রণতূর্য্য। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে নজরুলের গান হয়েছিল মেশিনগান, শব্দসৈনিক শিল্পীদের শত্রু বিনাশের ধারালো অস্ত্র। একাত্তরের রণাঙ্গনে ইথারে গর্জে উঠত তার ‘বিদ্রোহী’ কবিতা, আর বজ্রসঙ্গীত—‘এই শিকল পরা ছল মোদের, চল চল ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল’, ‘মোরা ঝঞ্ঝার মত উদ্দাম’, ‘ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি আমার দেশের মাটি’ ইত্যাদি। নজরুলের সঙ্গে কারও তুলনা হয় না। তিনি শ্রেষ্ঠতম শিখরে একটি আপন ভুবন তৈরি করেছেন। সেখানেই তার একান্ত বসবাস। আমার জীবনে কবি দর্শন একটি উল্লেখযোগ্য অহঙ্কারযোগ্য স্মৃতি। স্বাধীনতা-উত্তরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান বাকরুদ্ধ জীবন্ত কিংবদন্তি কবিকে বাংলাদেশে নিয়ে এলেন। হাজার লোকের লাইনে দাঁড়িয়ে আমিও দর্শন করলাম কবিকে। কী আনন্দ এবং বিস্ময় লেগেছিল তা বলে বোঝানো যাবে না। দেখলাম তার সেই মায়াভরা, প্রেমভরা সুগভীর চোখ দুটো, কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে। ঠোঁট দুটো বিরতিহীনভাবে নড়ছে, কাঁপছে। আমি আশায় ছিলাম, এই বুঝি কবি কথা বলবেন। সবই ব্যর্থ। কবি আর কখনও কথা বললেন না। তার পুঞ্জীভূত অনেক বছরের অনেক কথা পৃথিবীর মানুষের কাছে না বলা, না জানাই রয়ে গেল। আমার কেবল মনে পড়তে লাগল কবির লেখা দুটি গানের দুটি পঙক্তি। ১. ‘তোমাদের প্রাণে চাহিয়া বন্ধু আমি আর জাগিবো না’ এবং ২. ‘কথা কও কও কথা থাকিও না চুপ করে’। আমার দ্বিতীয় স্মৃতি কলকাতার কালিঘাটে এইচএমভি’র প্রাচীন দফতরে কবি নজরুল ইসলামের গান লেখার কক্ষ দর্শন। কবিকে বাংলাদেশের জাতীয় কবির মর্যাদা দেয়া হলো, নাগরিকত্ব দেয়া হলো। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ফার্মগেট থেকে শাহবাগ পর্যন্ত রাস্তার নামকরণ ‘কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ’ করলেন। কিন্তু ধানমন্ডিতে কবির স্মৃতি ঘেরা কবি ভবনটি জাদুঘর হিসেবে সংরক্ষণ করা হলো না। আমি এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র গীতিকার তাকে নিয়ে একটি গান লিখে কবির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছিলাম অনেক আগে। গানটির সুরকার ছিলেন প্রয়াত আবু তাহের, কণ্ঠশিল্পী সৈয়দ আবদুল হাদি।

ওগো নজরুল
হয়নি মোদের কোন ভুল।
মসজিদেরই পাশে তোমার
দিলাম চিরস্থান।
তুমি কি শুনতে পাওনা আজান?
monirlyric@gmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন