এমএ নোমান
বেশ কয়েকদিন আগে জাতীয় প্রেস ক্লাবের ক্যান্টিনে জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের টেবিলে দুপুরের খাবার খেতে বসেছি। হঠাত্ করেই চলে গেল বিদ্যুত্। জাতীয় প্রেস ক্লাবে বিদ্যুতের দু’টি লাইন থাকায় দ্বিতীয় লাইন চালু হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গেই। দুর্ভাগ্য ২-৩ মিনিটের মাথায় দ্বিতীয় লাইনটিও চলে গেল। একজন প্রবীণ সাংবাদিক ক্ষোভ আর আক্ষেপের স্বরে একটু জোর গলায় বলে উঠলেন, “গেলি তো গেলি একেবারে ‘মেগাওয়াট’সহ গেলি। আর সময় পেলি না।” মেগাওয়াট গেল আওয়াজ শুনেই ক্যান্টিনজোড়া সাংবাদিকরা একে অপরের দিকে তাকাচ্ছেন। কিছু সময় পর একজন বলে উঠলেন, “কিছুদিন ধরেই শুনে আসছি হাজার হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদিত হয়েছে। এসব বিদ্যুত্ গেল কই?” অপর একজন বলে উঠলেন, সরকার আপাতত তিন হাজার ৩০০ মেগাওয়াট উত্পাদন করেছে। ‘মেগাওয়াট’ যেহেতু উত্পাদন হয়ে গেছে এখন ধীরে ধীরে বিদ্যুত্ও উত্পাদন হবে। এ নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। জাতীয় প্রেস ক্লাবের পর আমি ‘মেগাওয়াট’ সংক্রান্ত আলোচনা আরও অনেক জায়গায়ই শুনেছি।
‘বাংলাদেশ নতুন করে তেলের জগতে প্রবেশ করতে যাচ্ছে’—এ ঘোষণা দেয়ার জন্য গত ২০ মে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেছেন। জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘আজকের দিনটি বাংলাদেশের জন্য এক ঐতিহাসিক ও অবিস্মরণীয় দিন। সমুদ্র বিজয়ের সাফল্যের পর এবার আমরা তেলের জগতেও প্রবেশ করছি। আমরা সিলেটের দুটি কূপে তেল...।’ চেয়ারম্যানের বক্তব্যের এ পর্যায়ে সেই একই বিড়ম্বনা। বিদ্যুত্ চলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে একজন সাংবাদিক বলে উঠলেন, ‘মেগাওয়াট’ চলে গেল। স্যার আপনারা তেলের জগতে প্রবেশ করতে যাচ্ছেন তো তাই এবার মেগাওয়াট আর থাকতে চাইছে না। সেও চলে গেল।’ সাংবাদিকের এ মন্তব্যের পর চেয়ারম্যানসহ পেট্রোবাংলার কর্মকর্তা ও উপস্থিত অন্য সাংবাদিকরাও তেলের আলোচনা বাদ দিয়ে ‘মেগাওয়াট’ সংক্রান্ত সরস আলোচনায় লিপ্ত হলেন। জেনারেটর চালু হওয়া পর্যন্ত ‘মেগাওয়াট’ নিয়ে ওইদিন এক প্রাণবন্ত ও উপভোগ্য আলোচনা হয়। দেশের বর্তমান ‘বিদ্যুতের নাই অবস্থায়’ বিদ্যুত্ উত্পাদন ও বিতরণকারী সংস্থাগুলোর একই মন্তব্য, ‘বর্তমানে যে হারে বিদ্যুতের লোডশেডিং হচ্ছে তা নজিরবিহীন। এর আগে বাংলাদেশে এ ধরনের লোডশেডিং আর হয়নি।’ রাজধানীতে বিজলি চমকানোর মতো বিদ্যুত্ আসা-যাওয়া করলেও পল্লী এলাকার মানুষ ২-৩ দিন পর বিদ্যুতের দেখা পান। বিদ্যুিভত্তিক ব্যবসা-বাণিজ্য লাটে উঠেছে। ক্ষুব্ধ জনগণ সারা দেশের জেলা ও উপজেলায় বিদ্যুতের দাবিতে সড়ক অবরোধ, বিদ্যুত্ অফিস ভাংচুর, বিদ্যুত্ কর্মকর্তাদের মারধর—এসব এখন নিত্য ঘটনা। তীব্র লোডশেডিং যন্ত্রণায় কাতর জনগণের সঙ্গে ক্ষোভে ফুঁসছেন মহাজোটের শীর্ষস্থানীয় নেতারাও। এ নিয়ে জাতীয় সংসদে গত অধিবেশনেও রসাত্মক আলোচনা হয়েছে। সরকারদলীয় এমপি ফজলে রাব্বি স্পিকারের উদ্দেশে বলেছেন, ‘আজকে আমি গোসল করে আসতে পারিনি। বিদ্যুত্ ছিল না, তাই পাম্প দিয়ে পানি উঠানো সম্ভব হয়নি। মাঝেমধ্যে বাথরুম করে শৌচ কাজ সম্পাদন করার মতোও পানি পাওয়া যায় না।’ অ্যাডভোকেট রাব্বির এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করে আ’লীগের প্রবীণ নেতা তোফায়েল আহমদও বলেছেন, ‘অনেক দিন হলো এলাকায় যাইনি। গেলেই জনগণ জানতে চায়, বিদ্যুত্ গেল কই? জবাব দিতে পারি না।’ গত কয়েক মাস ধরে এমন কোনো সভা-সমাবেশ, সেমিনার, সেম্পোজিয়াম হয়নি যেখানে প্রধানমন্ত্রী ও তার উপদেষ্টারা বিদ্যুত্ উত্পাদন নিয়ে নিজেদের সাফল্যের কথা তুলে ধরেননি। প্রতিনিয়তই তারা তিন হাজার ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদনের ‘বায়বীয়’ হিসাব দিয়ে আসছেন। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বিদ্যুতের চলমান সঙ্কটের জন্য বিগত বিএনপি জোটের পাঁচ বছর ও মইন-ফখরুদ্দীনের ‘দানবীয় অসাংবিধানিক’ সরকারের দুই বছরের শাসনকে দায়ী করেন। তবে মইন-ফখরুদ্দীনের দুই বছরে বিদ্যুতের জন্য কিছু না করাটা দোষের নয় বলেই আমার কাছে মনে হয়। কেননা, অসাংবিধানিক ওই সরকারকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ‘আন্দোলনের ফসল’ ঘোষণা দিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি গত জাতীয় নির্বাচনের আগে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ক্ষমতায় এলে ১/১১’র সরকারের কর্মকাণ্ডের বৈধতা দেবেন।’ কাজেই বিদ্যুত্ উত্পাদন না করার অপরাধ থেকে মইন-ফখরুদ্দীনের দানবীয় সরকার মাফ পেয়ে গেছে বলা চলে। তবে প্রকৃত তথ্য হচ্ছে, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার আগে দেশে সর্বোচ্চ বিদ্যুত্ উত্পাদন হয়েছিল ৪ হাজার ১০০ মেগাওয়াট, যা এখন সাড়ে ৪ হাজারে উন্নীত হয়েছে। মেগাওয়াটের হিসাব বোঝার জন্য পিডিবি’র দেয়া এ তথ্যই যথেষ্ট বলে আমার মনে হয়। এ কথা স্বীকার করতেই হবে, বিদ্যুত্ পরিস্থিতির উন্নতির জন্য ৩৪ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি, রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুত্ কেন্দ্র স্থাপন, ঘড়ির কাঁটা ১ ঘণ্টা এগিয়ে আনাসহ সরকার অনেক কাজই করেছে। ঘড়ির কাঁটা ১ ঘণ্টা এগিয়ে আনার যৌক্তিকতা তুলে ধরে তত্কালীন সংস্থাপন সচিব ইকবাল মাহমুদ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, এতে ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ সাশ্রয় হবে। তার এ যুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে একজন সাংবাদিক পাল্টা প্রশ্ন রেখে বলেছিলেন, ঘড়ির কাঁটা ১ ঘণ্টা এগিয়ে আনলে যদি ৩০০ মেগাওয়াট সাশ্রয় হয় তাহলে কেন ৩ ঘণ্টা এগিয়ে দিয়ে ৯০০ মেগাওয়াট সাশ্রয় করা হবে না। সেদিন এ প্রশ্নের কোনো জবাব দেননি তিনি।
আমার বাসায় বিদ্যুতের মিটারের রিডিং নিতে আসা ডিপিডিসি’র রিডারকে বললাম, আপনি ‘মেগাওয়াট’ সম্পর্কে কিছু জানেন? মুচকি হেসে জবাব দিলেন, ‘মেগাওয়াট’ নয় আমার কাজ হচ্ছে ‘ইউনিট’ নিয়ে। তবে বিদ্যুত্ গেলেই এখন মানুষ বলছে ‘মেগাওয়াট’ গেল। ফিরলে বলে ‘মেগাওয়াট’ এলো।
লেখক : সাংবাদিক
‘বাংলাদেশ নতুন করে তেলের জগতে প্রবেশ করতে যাচ্ছে’—এ ঘোষণা দেয়ার জন্য গত ২০ মে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেছেন। জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘আজকের দিনটি বাংলাদেশের জন্য এক ঐতিহাসিক ও অবিস্মরণীয় দিন। সমুদ্র বিজয়ের সাফল্যের পর এবার আমরা তেলের জগতেও প্রবেশ করছি। আমরা সিলেটের দুটি কূপে তেল...।’ চেয়ারম্যানের বক্তব্যের এ পর্যায়ে সেই একই বিড়ম্বনা। বিদ্যুত্ চলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে একজন সাংবাদিক বলে উঠলেন, ‘মেগাওয়াট’ চলে গেল। স্যার আপনারা তেলের জগতে প্রবেশ করতে যাচ্ছেন তো তাই এবার মেগাওয়াট আর থাকতে চাইছে না। সেও চলে গেল।’ সাংবাদিকের এ মন্তব্যের পর চেয়ারম্যানসহ পেট্রোবাংলার কর্মকর্তা ও উপস্থিত অন্য সাংবাদিকরাও তেলের আলোচনা বাদ দিয়ে ‘মেগাওয়াট’ সংক্রান্ত সরস আলোচনায় লিপ্ত হলেন। জেনারেটর চালু হওয়া পর্যন্ত ‘মেগাওয়াট’ নিয়ে ওইদিন এক প্রাণবন্ত ও উপভোগ্য আলোচনা হয়। দেশের বর্তমান ‘বিদ্যুতের নাই অবস্থায়’ বিদ্যুত্ উত্পাদন ও বিতরণকারী সংস্থাগুলোর একই মন্তব্য, ‘বর্তমানে যে হারে বিদ্যুতের লোডশেডিং হচ্ছে তা নজিরবিহীন। এর আগে বাংলাদেশে এ ধরনের লোডশেডিং আর হয়নি।’ রাজধানীতে বিজলি চমকানোর মতো বিদ্যুত্ আসা-যাওয়া করলেও পল্লী এলাকার মানুষ ২-৩ দিন পর বিদ্যুতের দেখা পান। বিদ্যুিভত্তিক ব্যবসা-বাণিজ্য লাটে উঠেছে। ক্ষুব্ধ জনগণ সারা দেশের জেলা ও উপজেলায় বিদ্যুতের দাবিতে সড়ক অবরোধ, বিদ্যুত্ অফিস ভাংচুর, বিদ্যুত্ কর্মকর্তাদের মারধর—এসব এখন নিত্য ঘটনা। তীব্র লোডশেডিং যন্ত্রণায় কাতর জনগণের সঙ্গে ক্ষোভে ফুঁসছেন মহাজোটের শীর্ষস্থানীয় নেতারাও। এ নিয়ে জাতীয় সংসদে গত অধিবেশনেও রসাত্মক আলোচনা হয়েছে। সরকারদলীয় এমপি ফজলে রাব্বি স্পিকারের উদ্দেশে বলেছেন, ‘আজকে আমি গোসল করে আসতে পারিনি। বিদ্যুত্ ছিল না, তাই পাম্প দিয়ে পানি উঠানো সম্ভব হয়নি। মাঝেমধ্যে বাথরুম করে শৌচ কাজ সম্পাদন করার মতোও পানি পাওয়া যায় না।’ অ্যাডভোকেট রাব্বির এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করে আ’লীগের প্রবীণ নেতা তোফায়েল আহমদও বলেছেন, ‘অনেক দিন হলো এলাকায় যাইনি। গেলেই জনগণ জানতে চায়, বিদ্যুত্ গেল কই? জবাব দিতে পারি না।’ গত কয়েক মাস ধরে এমন কোনো সভা-সমাবেশ, সেমিনার, সেম্পোজিয়াম হয়নি যেখানে প্রধানমন্ত্রী ও তার উপদেষ্টারা বিদ্যুত্ উত্পাদন নিয়ে নিজেদের সাফল্যের কথা তুলে ধরেননি। প্রতিনিয়তই তারা তিন হাজার ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদনের ‘বায়বীয়’ হিসাব দিয়ে আসছেন। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বিদ্যুতের চলমান সঙ্কটের জন্য বিগত বিএনপি জোটের পাঁচ বছর ও মইন-ফখরুদ্দীনের ‘দানবীয় অসাংবিধানিক’ সরকারের দুই বছরের শাসনকে দায়ী করেন। তবে মইন-ফখরুদ্দীনের দুই বছরে বিদ্যুতের জন্য কিছু না করাটা দোষের নয় বলেই আমার কাছে মনে হয়। কেননা, অসাংবিধানিক ওই সরকারকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ‘আন্দোলনের ফসল’ ঘোষণা দিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি গত জাতীয় নির্বাচনের আগে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ক্ষমতায় এলে ১/১১’র সরকারের কর্মকাণ্ডের বৈধতা দেবেন।’ কাজেই বিদ্যুত্ উত্পাদন না করার অপরাধ থেকে মইন-ফখরুদ্দীনের দানবীয় সরকার মাফ পেয়ে গেছে বলা চলে। তবে প্রকৃত তথ্য হচ্ছে, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার আগে দেশে সর্বোচ্চ বিদ্যুত্ উত্পাদন হয়েছিল ৪ হাজার ১০০ মেগাওয়াট, যা এখন সাড়ে ৪ হাজারে উন্নীত হয়েছে। মেগাওয়াটের হিসাব বোঝার জন্য পিডিবি’র দেয়া এ তথ্যই যথেষ্ট বলে আমার মনে হয়। এ কথা স্বীকার করতেই হবে, বিদ্যুত্ পরিস্থিতির উন্নতির জন্য ৩৪ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি, রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুত্ কেন্দ্র স্থাপন, ঘড়ির কাঁটা ১ ঘণ্টা এগিয়ে আনাসহ সরকার অনেক কাজই করেছে। ঘড়ির কাঁটা ১ ঘণ্টা এগিয়ে আনার যৌক্তিকতা তুলে ধরে তত্কালীন সংস্থাপন সচিব ইকবাল মাহমুদ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, এতে ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ সাশ্রয় হবে। তার এ যুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে একজন সাংবাদিক পাল্টা প্রশ্ন রেখে বলেছিলেন, ঘড়ির কাঁটা ১ ঘণ্টা এগিয়ে আনলে যদি ৩০০ মেগাওয়াট সাশ্রয় হয় তাহলে কেন ৩ ঘণ্টা এগিয়ে দিয়ে ৯০০ মেগাওয়াট সাশ্রয় করা হবে না। সেদিন এ প্রশ্নের কোনো জবাব দেননি তিনি।
আমার বাসায় বিদ্যুতের মিটারের রিডিং নিতে আসা ডিপিডিসি’র রিডারকে বললাম, আপনি ‘মেগাওয়াট’ সম্পর্কে কিছু জানেন? মুচকি হেসে জবাব দিলেন, ‘মেগাওয়াট’ নয় আমার কাজ হচ্ছে ‘ইউনিট’ নিয়ে। তবে বিদ্যুত্ গেলেই এখন মানুষ বলছে ‘মেগাওয়াট’ গেল। ফিরলে বলে ‘মেগাওয়াট’ এলো।
লেখক : সাংবাদিক
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন