বুধবার, ২০ জুন, ২০১২

শ্রীশ্রী জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা



শি শি র র ঞ্জ ন দা স বা বু
২১ জুন বাংলা ৭ আষাঢ় শ্রীশ্রী জগন্নাথদেবের রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। মানুষের মাঝে সম্প্রীতি, শান্তি ও মৈত্রীর পরিবেশ গড়ে তোলার জন্যই শ্রী বিগ্রহ গণউত্সব লগ্নে মন্দির ছেড়ে রাজপথে সবাইকে দর্শন দানের জন্য বেরিয়ে আসেন। আন্তর্জাতিক কৃষ্ণ ভাবনামৃত সংঘের প্রতিষ্ঠাতা শ্রী প্রভুপাদ ১৯৬৫ সালে তার গুরুদেবের নির্দেশে পাশ্চাত্যে কৃষ্ণ ভাবনামৃত প্রচারের জন্য আমেরিকায় গিয়েছিলেন। সানফ্রান্সিসকোর হেইট অ্যামবেরিতে ভারতবর্ষের বাইরে প্রথম রথযাত্রা উদযাপন করেছিলেন হিন্দু ধর্মমতে। সব জগতের পরম প্রভু হচ্ছেন শ্রী জগন্নাথদেব। ভক্তদের প্রেমের বশবর্তী হয়ে তিনি নিজেকে রাজপথে নিয়ে যাওয়ার জন্য ভক্তদের অনুমতি দিয়েছেন। শ্রী জগন্নাথদেব অত্যন্ত কৃপাশীল। যারা মন্দিরে তাকে দর্শন করতে আসে না, তাদের সবাইকে কল্যাণ ঐক্য কৃপা আশীর্বাদ করতে তিনি মন্দির থেকে বেরিয়ে আসেন। একবার শ্রীকৃষ্ণ, বলরাম ও সুভদ্রাদেবী সূর্যগ্রহণের কুরুক্ষেত্রে সামন্ত পঞ্চতক তীর্থে স্নান করতে যান। এখনও কুরুক্ষেত্রে সূর্যগ্রহণের সময় স্নান করতে বহু পুণ্যার্থী গমন করেন। পাঁচ হাজার বছর আগে শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকা থেকে গিয়েছিলেন কুরুক্ষেত্রে। শুনে সঙ্গে সঙ্গে তারা ছুটলেন কৃষ্ণকে দর্শন করতে। কৃষ্ণ তখন রথে উঠে বলেছেন, তিনি কুরুক্ষেত্র থেকে তার রাজধানী দ্বারকায় ফিরে যাবেন। সঙ্গে রয়েছেন শ্রী বলরাম ও সুভদ্রা। চারপাশে রাজপুরুষ, সৈনিক, কৃষ্ণের বেশও অন্যরকম। গোপবেশের পরিবর্তে রাজবেশ। হাতে বাঁশির পরিবর্তে ধনুর্বাণ। কোমরে তলোয়ার/বর্ম, মাথায় মুকুট। কৃষ্ণকে এভাবে দেখে গোপাদের মন ভরল না। বিশেষ করে রাধারাণী বললেন, এই কৃষ্ণ আমাদের সেই কৃষ্ণ নয়। তাকে আমরা চিনতাম, বৃন্দাবনের বনে বনে আমাদের সঙ্গে সে লীলা খেলা করত। সেই কৃষ্ণের মাথায় ময়ূরের পাখা, তার পরণে পীত বসন, গলায় বনমালা, হাতে বাঁশি আর এই কৃষ্ণের পরণে তো রাজবেশ। রাধারাণীর সেই মনোভাব বুঝতে পেরে বাজবাসীরা কৃষ্ণের রথের দড়ি ধরে। কৃষ্ণের রথের ঘোড়াগুলো ধরে টানতে টানতে নিয়ে চললেন বৃন্দাবনের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে বলরাম, তিনিও ব্রজবাসীদের শৈশবের, কৈশোরের সাথী। তাকেও রথে চড়ালেন। সুভদ্রা বোন, তাকেও তারা নিয়ে চললেন। জগন্নাথপুরীর এই রথযাত্রাটি হচ্ছে গোপাদের সেই কুরুক্ষেত্র রথযাত্রার দ্যোতিক। রথের সময় জগন্নাথ বা কৃষ্ণকে নিয়ে যাওয়া হয় নীলাচল থেকে সুন্দরাচলে। যেখানে কৃষ্ণ ব্রজবাসীদের সঙ্গে আট দিন ছিলেন। এই হচ্ছে রথযাত্রার ইতিহাস। শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু ভাবতেন—‘কৃষ্ণ, কতদিন ধরে আমি তোমায় দেখতে চেয়েছি। আর এখন আমি তোমাকে দর্শন করছি।’ শ্রী প্রভুপাদ বলেছিলেন, ‘বাঁ পাশে একদল, ডান পাশে একদল, সামনে একদল এবং পেছনের দিকে একদল, আর শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু মাঝখানে থাকতেন। তারা সবাই নাচতেন এবং কীর্তন করতেন। রথযাত্রার সময় ভগবান শ্রীজগন্নাথদের স্বয়ং আমাদের সামনে উপস্থিত হন। তাই এটি এমনই সুন্দর সুযোগময় একটি উত্সব, যার মাধ্যমে আমরা ভগবানের প্রতি আমাদের হৃদয়ের ভক্তি ও প্রেম নিবেদন করতে পারি। রথযাত্রার দিন রথরূঢ় পরমেশ্বর ভগবান শ্রী শ্রী জগন্নাথদেব বলদেব ও সুভদ্রাদেবীকে দর্শন করে আপনার হৃদয়ের ভক্তি নিবেদন করুন, রথের রশি ধরে টানুন। ভগবানের প্রসাদ গ্রহণ করুন এবং আপনার মানব জন্মকে সার্থক করে তুলুন।
বাংলা ১০৭৯ সনে ধামরাইয়ে রথযাত্রা উত্সব হয়। ১১০৪ সন থেকে ১৩৪৪ সন পর্যন্ত মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ার বালিয়াটির অমর নারায়ণ রায় চৌধুরী ও ব্রজেন্দ্র কুমার রায় চৌধুরীর মতো জমিদাররা চারটি রথ তৈরি করে দেন। সর্বশেষ রথটি ছিল ৬৭ ফুট দীর্ঘ ও ৫৪ ফুট প্রস্থ, চার তলাবিশিষ্ট। প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় চার কোনায় চারটি করে প্রকোষ্ঠ ছিল। এই প্রকোষ্ঠগুলোকে নবরত্ন বলা হতো। খচিত ছিল দেবদেবীর মূর্তি। সূক্ষ্ম কারুকার্য করা সুউচ্চ এ রথ দেখার জন্য বিভিন্ন দেশের পর্যটক ভিড় জমাতেন। রথ টানার সময় প্রায় ২৭ মণ পাটের কাছি দরকার হতো। রথটি পাক বাহিনী পুড়িয়ে দেয়। এরপর দুই বছর বাঁশের তৈরি রথ দিয়ে রথযাত্রা পালিত হয়। স্বাধীনতার পর টাঙ্গাইলের দানবীর রণদা প্রসাদ সাহার মেয়ে শ্রীমতি জয়াপতি সাহাসহ দানশীল ব্যক্তিদের সহায়তায় তৈরি করা হয় শ্রী শ্রী যশোমাধবের রথ। ২০০৬ সালে রথযাত্রা উপলক্ষে বিশেষ অতিথি হিসেবে তত্কালীন ভারতীয় হাইকমিশনার বীণা সিক্রি ভারত সরকারের পক্ষ থেকে রথটি পুনর্নির্মাণের ঘোষণা দেন। মোট ব্যয় ধরা হয় ৭৮ লাখ টাকা। ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে আদি রথটির আদলে পুনর্নির্মাণ কাজ শুরু হয়। প্রথমে লোহার পাত দিয়ে ৩৭ ফুট দৈর্ঘ্য ও ২০ ফুট প্রস্থ তিন তলাবিশিষ্ট রথের অবকাঠামো তৈরি করা হয়। এরপর লোহার পাতের ওপর সেগুন কাঠের প্রলেপ দিয়ে সম্পূর্ণ ঢেকে দেয়া হয়েছে। কাঠের ওপর চলছে বিভিন্ন নকশার সূক্ষ্ম কারুকাজ। রথের প্রতি তলায় খচিত হয়েছে দেবদেবীর মূর্তিচিহ্ন। ১৫ চাকাবিশিষ্ট। ঢাকা মহানগরীতে ইসকনের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত বার্ষিক রথযাত্রা মহোত্সবটি নিঃসন্দেহে শ্রী জগন্নাথপুরী ধামের পরই বৃহত্তম অনুষ্ঠান। বরাবরই ঢাকা শহরের মানুষ এই রথযাত্রা উত্সবে আন্তরিকভাবে সাড়া দিয়ে থাকেন এবং তার ফলেই এই উত্সবটিকে তাদের নিজেদের শহরের ঐতিহ্যরূপে আপন করে নিতে পেরেছেন। পরম আনন্দের বিষয়। এখন শুধু পুরী ঢাকায় নয়, সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এই ইসকন রথযাত্রা মহাসাড়ম্বরে পালিত হয়ে আসছে। জগন্নাথদেবের রথযাত্রা সনাতন ধর্মাবলম্বী হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম বড় ধর্মীয় উত্সব। রথের চাকার পবিত্র ঘূর্ণনে মুছে যাক সব অন্ধকার। দূর হয়ে যাক অন্যায়-অশান্তি। মহালা লোকে পূর্ণ হোক ধরিত্রী। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে গড়ে উঠুক অসাম্প্রদায়িকতার বাতাবরণ। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও ধর্মীয় ভক্তিবিশ্বাস আমাদের ঐতিহ্যের সম্প্রীতিকে আরও সমুন্নত করে তুলুক। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। যুগ যুগ ধরে এ দেশে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ তাদের নিজ নিজ ধর্ম অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে পালন করে আসছে। এই পুণ্যময় রথযাত্রার মধ্য দিয়ে সমাজে সম্প্রীতির বন্ধন আরও মজবুত হবে। সাফল্য বয়ে আনবে আমাদের জাতীয় জীবনে। আমার এদেশ সব মানুষের—হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান। দেশমাতা সবার। এ প্রত্যাশা আজকের এ দিনে।
লেখক : ধর্মীয় সংগঠক, কলামিস্ট

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন