উপমহাদেশের প্রখ্যাত গজল সম্রাট মেহেদী হাসান গত বুধবার পাকিস্তানের করাচী শহরের আগাখান হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়াছেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ... রাজেউন)। মৃত্যুকালে তাঁহার বয়স হইয়াছিল প্রায় ৮৫ বছর। পরিণত বয়সেও কিংবদন্তীসম ধু্রপদ সঙ্গীতের এ উজ্জ্বল নক্ষত্র মেহেদী হাসানের তিরোধান এই উপমহাদেশে সঙ্গীতের জগতে আনিয়াছে শোকের ছায়া। ফুসফুস ও মুত্রনালীর সমস্যায় বেশ কয়েক মাস ধরিয়া ভুগিতেছিলেন তিনি। কিন্তু শিল্পীর নিষেধাজ্ঞার কারণে তাঁহার অসুস্থতার খবর মিডিয়ায় তেমন প্রচার পায় নাই। তবে কিংবদন্তী শিল্পীর মৃত্যুর খবরটি উপমহাদেশের সকল গণমাধ্যমে ছড়াইয়া পড়ার পর তাঁহার অগণতি ভক্ত-অনুরাগীদের মধ্যে সৃষ্টি হইয়াছে গভীর শূন্যতাবোধ। ভারতীয় কবি, গীতিকার জাভেদ আকতার নিজ প্রতিক্রিয়া জানাইতে গিয়া যথার্থই বলিয়াছেন যে, মেহেদী হাসানের মৃত্যুতে ক্ষতি অপূরণীয়। কারণ নিজের জায়গায় ছিলেন তিনি অতুলনীয় একজন শিল্পী। ধ্রুপদ সংগীত চর্চার ক্ষেত্রে পরবর্তী প্রজন্মের বহু বিখ্যাত শিল্পীর কাছে মেহেদী হাসান ছিলেন আদর্শ এবং প্রেরণার একটি বড় উত্স।
মেহেদী হাসানের জন্ম ১৯২৭ সালের ১৮ জুলাই ভারতের রাজস্থানের লুনা গ্রামে । সংগীতে শিল্পীর হাতেখড়ি হয় পিতা ওস্তাদ আজিম খান ও চাচা ওস্তাদ ইসমাল খানের কাছে। তাঁহারা দুজনই ছিলেন ধ্রুপদি গায়ক। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর শিল্পীর পরিবার পাকিস্তানে আসেন। দারিদ্র্য ও অর্থসংকটের কারণে ২০ বত্সর বয়সে মেকানিকের সামান্য কাজ করিয়াছেন। কিন্তু অনন্য কণ্ঠমাধুর্য নিয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছেন যিনি, তাহার প্রকাশ ছিল অনিবার্য। মেহেদী হাসানের মিষ্টি কণ্ঠের রাজস্থানী পল্লীগীতি শুনিয়াই শিল্পীর প্রতি আকৃষ্ট হইয়াছিলেন অনেকে। কাজের ফাঁকে ঠুমরির তালিম নিয়াছেন তিনি। অত:পর ১৯৫৭ সালে পাকিস্তান রেডিওতে অডিশনের সুযোগ পাইবার পর আর পিছনে ফিরিয়া তাকাইতে হয় নাই শিল্পীকে। রেডিওতে কর্মজীবন শুরু হইবার পর অতুলনীয় কণ্ঠমাধুর্য ও সুরসাধনা ক্রমেই তাহাকে গজল সম্রাট হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হইবার পর শিল্পী এ দেশের অসংখ্য ভক্ত-অনুরাগীর মাঝে একাধিকবার আসিয়াছেন। বেশকিছু বাংলা গানে কণ্ঠ দিয়াছেন তিনি, যাহা এখনো তাহার অসংখ্য ভক্ত-অনুরাগীর স্মৃতিতে জাগরূক। চলচ্চিত্রের বহু গানেও কণ্ঠ দিয়াছেন তিনি। পেশাদার গায়ক হইয়াও সংগীত পরিচালক হিসাবে অসাধারণ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন মেহেদী হাসান। ১৯৫৭ হইতে ১৯৯৯ পর্যন্ত তিনি সক্রিয় ছিলেন স্বীয় কর্মজগতে। এ সময় একে একে সৃষ্টি করিয়াছেন বিস্ময়করভাবে জননন্দিত হওয়া বহু গান। দীর্ঘ পাঁচ দশকের সংগীতজীবনে তিন উর্দু, বাংলা, পাঞ্জাবি ও ফারসি ভাষায় ২০ হাজারেরও বেশি গান গাহিয়াছেন। সঙ্গীতে অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ দেশে বিদেশে পাইয়াছেন বহু সম্মাননা ও পুরস্কার। ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন ৯ ছেলে ও ৫ মেয়ের জনক। কিংবদন্তীর এই শিল্পী শেষ গান গাহিয়াছেন ২০০৯ সালে।
প্রকৃত বড় শিল্পী দেশকালের সীমা ছাড়াইয়া নিজ সৃষ্টিগুণেই বহু মানুষের অন্তরে আসন করিয়া নেন। সুরের সম্মোহনী শক্তি দিয়া মেহেদী হাসান উপমহাদেশের সংগীতপ্রেমীদের দীর্ঘদিন আচ্ছন্ন করিয়া রাখিয়াছিলেন, মৃত্যুর পরও তাঁহার স্বর্গীয় কণ্ঠমাধুর্য শ্রোতাকুলকে আরো বহুদিন মোহাবিষ্ট করিয়া রাখিবে সন্দেহ নাই। ভক্ত-অনুরাগীদের ভালবাসায় সংগীতের জগতে অনন্য ধ্রুবতারা হিসাবে বাঁচিয়া থাকিবেন তিনি। আমরা কালজয়ী এই মহান শিল্পীর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করি এবং শিল্পীর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। শিল্পীর শোকসন্তপ্ত পরিবার ও ভক্ত-অনুরাগীদের জানাই সহমর্মিতা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন