শনিবার, ৯ জুন, ২০১২

নজরুলের সিয়ারসোল স্কুল


স্কুলের শ্রেণীকক্ষ
স্কুলের শ্রেণীকক্ষ


পশ্চিমবঙ্গের খনির শহর রানীগঞ্জ। বর্ধমান জেলার এই ঐতিহ্যবাহী শহরেই রয়েছে সিয়ারসোল রাজ উচ্চবিদ্যালয়। স্কুলটি ১৫৬ বছরের পুরোনো। এই বিদ্যালয় ইতিমধ্যে পালন করেছে সার্ধশতবর্ষ। এই বিদ্যালয়েরই একসময়ের ছাত্র ছিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বাংলাদেশের জাতীয় কবি। বছর চারেক এই বিদ্যালয়ে পড়েছেন তিনি। এখান থেকেই তিনি যোগ দিয়েছিলেন সেনাবাহিনীর ৪৯ নম্বর বাঙালি পল্টনে। তারপর চলে গিয়েছিলেন করাচির সেনানিবাসে। শুধু কি তাই? এখান থেকেই কবির সাহিত্যজীবনের ভিত্তিভূমি তৈরি হয়েছিল। কবি-প্রতিভার উন্মেষ ঘটেছিল। এখান থেকেই কবির মনে ব্রিটিশবিরোধী চেতনার বীজ রোপিত হয়েছিল। 
আজও সিয়ারসোল রাজ বিদ্যালয়ে কবির স্মৃতিবাহী সেই শ্রেণীকক্ষ রয়েছে। ইতিহাসের পথ ধরে এখনো দাঁড়িয়ে আছে সেই বিদ্যালয়, সেই শ্রেণীকক্ষ। তবে অবিকৃত অবস্থায় রাখা হয়েছে কবির স্মৃতিবাহী শ্রেণীকক্ষটিকে। তখন বিরাট একটা হলঘরে পার্টিশন দিয়ে চালানো হতো বিদ্যালয়ের বিভিন্ন ক্লাস। বড় বড় দরজা। লোহার বিম, কাঠ-সুরকির ছাদ। আজ সেই সিয়ারসোল রাজ বিদ্যালয়ে আরও চারটি নতুন ভবন তৈরি হয়েছে। এই বিদ্যালয়ে এখন পাঠ দেওয়া হয় দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত। ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের স্মৃতিবাহী এই বিদ্যালয়ে প্রথম দিকে সহশিক্ষা থাকলেও এখন পড়ানো হয় কেবল ছাত্রদের। ছাত্রসংখ্যা এক হাজার ৯০০। 
তবুও ইতিহাসের স্মৃতিচিহ্ন মুছে দেয়নি বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। পুরোনো ভবনটির সামনে ছিল টালির ছাউনি। সংস্কার করে সেটিকে রাখা হয়েছে অবিকৃতভাবে। হলুদ রঙের এই বিদ্যালয় ভবনের সামনে রয়েছে কবি নজরুলের একটি আবক্ষ মূর্তি। চার পাশে ফুলের বাগান। ছয় একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত এই বিদ্যালয়। সিয়ারসোলের রাজপরিবারের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই বিদ্যালয়টি। 
কবির স্মৃতিবাহী সেই বিদ্যালয়টি দেখার জন্য আমরা চলে আসি রানীগঞ্জ শহরে। শিশুবাগানের কাছে এই বিদ্যালয়ের অবস্থান। আমরা যখন পৌঁছাই, তখন বিদ্যালয় ছুটি হয়ে গেছে। তবুও প্রধান শিক্ষকের অনুগ্রহে আমরা বিদ্যালয়টি ঘুরে ঘুরে দেখার সুযোগ পাই। 
প্রধান শিক্ষক তাপস কুমার চট্টোপাধ্যায় জানালেন, চুরুলিয়া থেকে আসানসোল হয়ে এই বিদ্যালয়ে পড়তে এসেছিলেন কবি নজরুল সেই ১৯১১-১২ সাল নাগাদ। গ্রাম থেকে প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ চুকিয়ে তিনি ভর্তি হয়েছিলেন সম্ভবত পঞ্চম শ্রেণীতে। দরিদ্র ও মেধাবী ছাত্র হওয়ায় নজরুলকে বিনা খরচায় পড়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল এই সিয়ারসোল রাজ বিদ্যালয়ে। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে রানীগঞ্জের ভবতারিণী ছাত্রাবাসে থাকার ব্যবস্থাও করে দিয়েছিল। এই ছাত্রাবাসটি ছিল রানীগঞ্জ শহরের এখনকার অঞ্জনা সিনেমা হলের কাছে। ছাত্রাবাসের কোনো অস্তিত্ব এখন আর নেই। 
কিন্তু বছর খানেক পড়ার পর তিনি এই বিদ্যালয় ছেড়ে চলে যান মাথরুনের নবীনচন্দ্র ইনস্টিটিউশনে। সেখানকার প্রধান শিক্ষক ছিলেন পল্লীকবি কুমুদরঞ্জন মাল্লিক। এখানেও বেশিদিন টিকতে পারেননি নজরুল। এখান থেকেই চলে যান বাংলাদেশের ময়মনসিংহের দড়িরাম হাইস্কুলে। তারপর ১৯১৫ সালের দিকে নজরুল ফের চলে আসেন এই সিয়ারসোল রাজবিদ্যালয়ে। ভর্তি হন সপ্তম শ্রেণীতে। সপ্তম শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষায় ডবল প্রমোশন পেয়ে নবম শ্রেণীতে ওঠেন নজরুল। নজরুলের ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল ১৯১৮ সালে। কিন্তু ১৯১৭ সালের আগস্ট কি সেপ্টেম্বর মাসে এই স্কুল ছেড়ে তিনি ঐতিহাসিক ৪৯ নম্বর বাঙালি পল্টনে যোগ দেন। তারপর চলে যান করাচির সেনানিবাসে। 
প্রধান শিক্ষক আরও বলেছেন, এই বিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময়ই নজরুলের কবি-প্রতিভার প্রকাশ ঘটে। এখানে পড়াশোনার সময় কবি নজরুলের সাহচর্য ঘটে প্রখ্যাত লেখক শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। শৈলজানন্দ ১৯১৭ সালে পড়তেন রানীগঞ্জ হাইস্কুলে। কবি নজরুল রানীগঞ্জের রামবাগানের সেই ঐতিহাসিক বটগাছের নিচে বসে শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে চর্চা করেছেন কবিতার। 
প্রধান শিক্ষক আরও বলেছেন, নজরুলের স্মৃতিবাহী শ্রেণীকক্ষটিকে সংরক্ষণ করা হয়েছে ‘নজরুল স্মৃতিকক্ষ’ নামে। সত্তরের দশকে নকশাল আন্দোলনের সময় আগুনে ভস্মীভূত হয়ে যায় বিদ্যালয়ের সব রেকর্ড ও নথিপত্র। সে সময় ভাগ্যক্রমে রক্ষা পেয়েছিল বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির একটি মিনিটবুক। সেই মিনিটবুকের ১৯১৭ সালের ২ মে ৪ নম্বর রেজিউলিশনে লেখা ছিল দশম শ্রেণীর ছাত্র কাজী নজরুল ইসলামকে মাসে পাঁচ টাকা হারে বৃত্তি দেওয়া হোক ১৯১৮ সালের ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা পর্যন্ত। 
প্রধান শিক্ষক আরও বলেছেন, এই বিদ্যালয়ে পড়াকালীন নজরুল ব্রিটিশবিরোধী দ্রোহ চেতনা, আপসহীন সংগ্রাম, জাতের নামে বজ্জাতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। অনুপ্রাণিত হন স্বদেশ প্রেমে, অসাম্প্রদায়িতার আদর্শে। এই সিয়ারসোলের প্রখ্যাত বিপ্লবী নিবারণচন্দ্র ঘটক ছিলেন নজরুলের প্রিয় শিক্ষক। তিনিই মূলত বিপ্লবের মন্ত্রে উজ্জীবিত করেন নজরুলকে। কবি নজরুল শাস্ত্রীয় সংগীতের শিক্ষা নিয়েছিলেন এই বিদ্যালয়ের অপর শিক্ষক সতীশচন্দ্র কাঞ্জিলালের কাছে। তাই সিয়ারসোল বিদ্যালয় নজরুল জীবনের সঙ্গে মিশে আছে আজও।
অমর সাহা
কলকাতা

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন