আদি ঢাকার নারিন্দা থেকে নবাবপুর। রিকশায় ১৫ টাকা ভাড়া। সেই পথটুকু প্রতিদিন হেঁটে দোকানে আসে ফাহিম—একা। অথচ তাদের পাশের বাড়ির ছেলেটি লক্ষ্মীবাজারের কাছের মুসলিম হাইস্কুলে যায় নিজেদের গাড়িতে চেপে।
ছেলেটি যে বয়সে স্কুলে যায়, ফাহিম সে বয়সে নবাবপুরের একটি হার্ডওয়্যার-সামগ্রীর দোকানে কাজ করে। ফাহিম মায়াবী চেহারার চমৎকার একটি ছেলে। সে ঠেলাগাড়ি টানতে পারে, শক্ত ও ভারী মালামাল বহন করতে পারে। অথচ তারও স্কুলে যেতে মন চায়, কিন্তু উপায় নেই। এই সংসারে ফাহিমের এখন আপন বলতে এক মামা আর নানি। মামার আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ। তো কী করা! এই বয়সেই ফাহিমকে কাজে নেমে পড়তে হয়েছে। এখন তার তেরো বছর চলছে, বাকি জীবন এভাবেই যাবে!
ফাহিমের মা টুটু বেগম আর বাবা মোহাম্মদ আলী প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন। ফাহিমকে জন্ম দিয়েই মা টুটু বেগমের শারীরিক অসুস্থতার শুরু। প্রথম কয়েক বছর মোহাম্মদ আলী টুটু বেগমকে চিকিৎসা করিয়েছিলেন, তারপর হয়রান হয়ে পড়েন। একদিন কী এক অছিলায় মোহাম্মদ আলী টুটু বেগমকে তাঁর মায়ের বাড়ি পাঠিয়ে দেন। সেই যে চলে আসা, তারপর মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনি মা-ভাইদের সঙ্গেই ছিলেন। দীর্ঘ সময় মোহাম্মদ আলী স্ত্রী টুটু বেগমকে একবারের জন্যও চোখের দেখাটা দেখতে আসেননি। সন্তানের মায়াও তাঁকে টানেনি। এভাবেই ফাহিম বড় হতে থাকে। আদর-অনাদর, অবহেলা সব মিলিয়ে। মা খুব চাইতেন ছেলেটা পড়াশোনা করুক। স্কুলেও দিয়েছিলেন। কিন্তু পড়াশোনার খরচ চলবে কী করে? তাঁর নিজের কোনো আয় নেই, থাকেন ভাইয়ের সংসারে। খাওয়া-দাওয়া, চিকিৎসা ভাই-ই চালান। ফাহিমের স্কুলে যাওয়া তাই হয়ে ওঠেনি। তো, একদিন স্কুল থেকে উঠিয়ে টুটু বেগম ফাহিমকে পূর্ব পরিচিত আবদুর রাজ্জাকের দোকানে চাকরিতে ঢুকিয়ে দেন। আরেকটা কারণ ছিল ছেলেকে কাজে দেওয়ার। নিজের শরীর ভালো থাকে না। তাঁর মৃত্যুর পর ছেলেটাকে দেখবে কে! ছেলেটা যেন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে—এই ছিল আশা। সে ছেলে নিজের পায়ে কতটা দাঁড়াতে পারল টুটু বেগম তা দেখে যেতে পারেননি। ক্ষয়ে যাওয়া শরীর তাঁর। প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট, সঙ্গে অন্যান্য রোগ মিলে গত মাসে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। মৃত্যুর আগের দিন টুটু বেগমের খুব ইচ্ছা হয়েছিল, মোহাম্মদ আলীর কলারটা চেপে ধরে জানতে চাইবেন, আমার আর ফাহিমের দোষটা কোথায়! কিন্তু সে সুযোগ হয়নি।
আমার সঙ্গে ফাহিমের দেখা এক বছর আগে, নবাবপুরের কাছের এক পুরোনো বাড়িতে বানরের ছবি তুলতে গিয়ে। আমাকে দেখে সে কাছে আসে। তারপর বলে, ‘আমার একটা ছবি তুইলা দেন।’ আমি সেদিন ছবি তুলে দিইনি। এরপর যতবারই দেখা হয়েছে, ‘একটা ছবি তোলেন তো, ছবি তোলেন’—বলে গেছে।
পরে কিছুদিন আগে ফাহিমের ব্যাপারে বিস্তারিত আলাপ হয় স্থানীয় বাপ্পির সঙ্গে। বাপ্পির কাছেই জানতে পারি ফাহিমের বিস্তারিত। ফাহিমের বাবা-মায়ের আদ্যোপান্ত। তার বাবারা অবস্থাবান। নারিন্দার কাছে হলুদ মসজিদের পাশে তাঁর নিজের বাড়ি। বউ অসুখে পড়লে তিনি খুব বিরক্ত হন। অসুস্থ বউকে কেউ কি টানে, মনে এই উপলব্ধি এলে তিনি টুটু বেগমকে তাঁর মায়ের বাড়ি পাঠিয়ে দেন। একমাত্র সন্তানের কথাও তিনি ভাবেননি তখন। কিছুদিন যেতেই আরেকটা বিয়ে করে বসেন। টুটু বেগম যত দিন বেঁচে ছিলেন শুধু একটা কথাই বলতেন, ‘জানি না ফাহিমের ভবিষ্যৎ কী?’
হাসি-খুশি ফাহিম এসব নিয়ে ভাবে না। আবদুর রাজ্জাকের দোকানে কাজ করে। রাজ্জাক তাকে খুব আদর করেন। আশপাশের দোকানের লোকজনও ফাহিম বলতে অজ্ঞান। কেউ কোনো কাজের কথা বললে ফাহিম না করে না। কাজে তার কোনো ক্লান্তি নেই। যখনই ফাহিমের সঙ্গে দেখা হয়, নিরলস সে কাজ করে চলেছে। শুধু আমার সঙ্গে চোখাচোখি হলেই বলবে, ‘একটা ছবি তুইলা দেন তো!’
ফারুখ আহমেদ
Farukh.ahmed@gmail.com
ছেলেটি যে বয়সে স্কুলে যায়, ফাহিম সে বয়সে নবাবপুরের একটি হার্ডওয়্যার-সামগ্রীর দোকানে কাজ করে। ফাহিম মায়াবী চেহারার চমৎকার একটি ছেলে। সে ঠেলাগাড়ি টানতে পারে, শক্ত ও ভারী মালামাল বহন করতে পারে। অথচ তারও স্কুলে যেতে মন চায়, কিন্তু উপায় নেই। এই সংসারে ফাহিমের এখন আপন বলতে এক মামা আর নানি। মামার আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ। তো কী করা! এই বয়সেই ফাহিমকে কাজে নেমে পড়তে হয়েছে। এখন তার তেরো বছর চলছে, বাকি জীবন এভাবেই যাবে!
ফাহিমের মা টুটু বেগম আর বাবা মোহাম্মদ আলী প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন। ফাহিমকে জন্ম দিয়েই মা টুটু বেগমের শারীরিক অসুস্থতার শুরু। প্রথম কয়েক বছর মোহাম্মদ আলী টুটু বেগমকে চিকিৎসা করিয়েছিলেন, তারপর হয়রান হয়ে পড়েন। একদিন কী এক অছিলায় মোহাম্মদ আলী টুটু বেগমকে তাঁর মায়ের বাড়ি পাঠিয়ে দেন। সেই যে চলে আসা, তারপর মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনি মা-ভাইদের সঙ্গেই ছিলেন। দীর্ঘ সময় মোহাম্মদ আলী স্ত্রী টুটু বেগমকে একবারের জন্যও চোখের দেখাটা দেখতে আসেননি। সন্তানের মায়াও তাঁকে টানেনি। এভাবেই ফাহিম বড় হতে থাকে। আদর-অনাদর, অবহেলা সব মিলিয়ে। মা খুব চাইতেন ছেলেটা পড়াশোনা করুক। স্কুলেও দিয়েছিলেন। কিন্তু পড়াশোনার খরচ চলবে কী করে? তাঁর নিজের কোনো আয় নেই, থাকেন ভাইয়ের সংসারে। খাওয়া-দাওয়া, চিকিৎসা ভাই-ই চালান। ফাহিমের স্কুলে যাওয়া তাই হয়ে ওঠেনি। তো, একদিন স্কুল থেকে উঠিয়ে টুটু বেগম ফাহিমকে পূর্ব পরিচিত আবদুর রাজ্জাকের দোকানে চাকরিতে ঢুকিয়ে দেন। আরেকটা কারণ ছিল ছেলেকে কাজে দেওয়ার। নিজের শরীর ভালো থাকে না। তাঁর মৃত্যুর পর ছেলেটাকে দেখবে কে! ছেলেটা যেন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে—এই ছিল আশা। সে ছেলে নিজের পায়ে কতটা দাঁড়াতে পারল টুটু বেগম তা দেখে যেতে পারেননি। ক্ষয়ে যাওয়া শরীর তাঁর। প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট, সঙ্গে অন্যান্য রোগ মিলে গত মাসে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। মৃত্যুর আগের দিন টুটু বেগমের খুব ইচ্ছা হয়েছিল, মোহাম্মদ আলীর কলারটা চেপে ধরে জানতে চাইবেন, আমার আর ফাহিমের দোষটা কোথায়! কিন্তু সে সুযোগ হয়নি।
আমার সঙ্গে ফাহিমের দেখা এক বছর আগে, নবাবপুরের কাছের এক পুরোনো বাড়িতে বানরের ছবি তুলতে গিয়ে। আমাকে দেখে সে কাছে আসে। তারপর বলে, ‘আমার একটা ছবি তুইলা দেন।’ আমি সেদিন ছবি তুলে দিইনি। এরপর যতবারই দেখা হয়েছে, ‘একটা ছবি তোলেন তো, ছবি তোলেন’—বলে গেছে।
পরে কিছুদিন আগে ফাহিমের ব্যাপারে বিস্তারিত আলাপ হয় স্থানীয় বাপ্পির সঙ্গে। বাপ্পির কাছেই জানতে পারি ফাহিমের বিস্তারিত। ফাহিমের বাবা-মায়ের আদ্যোপান্ত। তার বাবারা অবস্থাবান। নারিন্দার কাছে হলুদ মসজিদের পাশে তাঁর নিজের বাড়ি। বউ অসুখে পড়লে তিনি খুব বিরক্ত হন। অসুস্থ বউকে কেউ কি টানে, মনে এই উপলব্ধি এলে তিনি টুটু বেগমকে তাঁর মায়ের বাড়ি পাঠিয়ে দেন। একমাত্র সন্তানের কথাও তিনি ভাবেননি তখন। কিছুদিন যেতেই আরেকটা বিয়ে করে বসেন। টুটু বেগম যত দিন বেঁচে ছিলেন শুধু একটা কথাই বলতেন, ‘জানি না ফাহিমের ভবিষ্যৎ কী?’
হাসি-খুশি ফাহিম এসব নিয়ে ভাবে না। আবদুর রাজ্জাকের দোকানে কাজ করে। রাজ্জাক তাকে খুব আদর করেন। আশপাশের দোকানের লোকজনও ফাহিম বলতে অজ্ঞান। কেউ কোনো কাজের কথা বললে ফাহিম না করে না। কাজে তার কোনো ক্লান্তি নেই। যখনই ফাহিমের সঙ্গে দেখা হয়, নিরলস সে কাজ করে চলেছে। শুধু আমার সঙ্গে চোখাচোখি হলেই বলবে, ‘একটা ছবি তুইলা দেন তো!’
ফারুখ আহমেদ
Farukh.ahmed@gmail.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন