হরতাল শব্দটা বর্তমানে আমাদের নিকট খুব পরিচিত। দেশবাসীর কাছে হরতাল সহনীয় হয়ে গেছে। যদিও হরতাল খুবই শক্ত কর্মসূচি। এটা জন-জীবনকে স্তব্ধ করে দেয়। তবুও হরতাল হচ্ছে। মনে হচ্ছে ভবিষ্যতেও হবে। যদিও আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি বর্তমান আছে। তবে আমরা এখনও গণতান্ত্রিক রীতি পদ্ধতি মনেপ্রাণে গ্রহণ করতে পারি নাই। আমাদের সরকার বা রিরোধী দল সবাই মুখে গণতান্ত্রিক কথা বললেও কার্যক্ষেত্রে গণতন্ত্রের চর্চা করে না। এটা দেশ ও জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক।
বর্তমানে দেশের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এক অস্বস্তিকর অবস্থা বিরাজ করছে। বর্তমান সরকারের বিগত তিন বছরাধিক সময় কাল কোন ক্ষেত্রেই আশাব্যঞ্জক কোন অগ্রগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে না। যদিও সরকার ও সরকারি দল আওয়ামী লীগ দাবি করছে প্রতিক্ষেত্রে সফলতা। মানুষ অনেক আশা করে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিল। কিন্তু ইতোমধ্যে মানুষ এত হতাশ যে, সরকারের জনপ্রিয়তা খুবই নিম্ন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বিদ্যুতের দু্রাপ্যতা, আইন-শৃংখলার অবনতি, জান-মালের নিরাপত্তাহীনতা, পররাষ্ট্রনীতিতে ব্যর্থতা, ইসলামের প্রতি বৈরিতা, অত্যধিক ভারতপ্রীতি, সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতির বিস্তারসহ সর্বক্ষেত্রে ব্যর্থতা মানুষকে বর্তমান সরকারের প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে তুলেছে।
সরকার তাদের জনপ্রিয়তার নিম্নগতি সম্পর্কে সচেতন। তা তাদের কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে। জলন্ত উদাহরণ ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নিয়ে সরকারের তুঘলকীকান্ড। নিজেদের স্বার্থের কথা চিন্তা করে আওয়ামী লীগ সরকার ঢাকাকে উত্তর ও দক্ষিণ দু'ভাগে ভাগ করে। কিন্তু তারপরও জনগণের উপর আস্থা রাখতে পারছে না। এজন্য নানা কৌশলে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেও তা স্থগিত করার ব্যবস্থা নেয়।
সর্বশেষ দেশে হত্যা, গুম, ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধ এত বৃদ্ধি পাচ্ছে যা অতীতে কখনও হয়নি। এমনকি বিভিন্নভাবে জানা যাচ্ছে যে সরকারি বিভিন্ন বাহিনী অনেক ক্ষেত্রে এসব অপকর্মের সাথে জড়িত। শুধু তাই নয় শোনা যাচ্ছে সরকার তার প্রতিপক্ষকে দমনের জন্য বা নির্মূল করার জন্য বিভিন্ন বাহিনীকে অবৈধ কর্মে ব্যবহার করছে। এ নিয়ে দেশে-বিদেশে বেশ আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে।
সর্বশেষ বি.এন.পি নেতা ইলিয়াস আলীর গুম হওয়া নিয়ে বিশ্বব্যাপী সমালোচনার ঝড় উঠছে। দেশের মানুষ খুবই বিব্রত এবং হতাশাগ্রস্ত। বি.এন.পি তাদের এমন একজন কেন্দ্রীয় নেতাকে উদ্ধারের জন্য যে কোন কর্মপন্থা নিতে বাধ্য। এক্ষেত্রে তারা জনমত সৃষ্টি করে তা সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে চাচ্ছে। এটা স্বাভাবিক বটে। ইলিয়াস আলীকে যেভাবে অপহরণ করা হয়েছে তাতে সরকারের সংশ্লিষ্টতা একেবারে অস্বীকার করা কঠিন। অপহরণ পরবর্তী সরকারি মন্ত্রীবর্গ এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রীর কথাবার্তায় জনগণ নাখোশ।
যাক সরকার বলছে তারা ইলিয়াস আলীকে উদ্ধারের জন্য আন্তরিকভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সরকারের উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গের কথাবার্তায় সে রকম মনে করা কঠিন। বাস্তবেও কাজের অগ্রগতি বলতে কিছু নেই। অবশ্য কর্তৃপক্ষের কথাবার্তায় কিছুটা আশ্বস্ত হওয়ার কারণ রয়েছে যে ইলিয়াস আলী তাদের কাছে রয়েছে।
এমতাবস্থায় বিরোধীদল বিশেষ করে বি.এন.পি'র পক্ষে চুপ করে থাকা সম্ভব নয়। দল, দেশ ও জাতির প্রয়োজনে তাকে পদক্ষেপ নিতেই হবে। তবে সেক্ষেত্রেও আমরা বিরোধীদল ও জোটের নিকট হতে দায়িত্বশীল আচরণ আশা করি। তাই তারা হরতাল আহবান করেছে। ইতিপূর্বে ৩ দিন হরতাল করেছে। পরে আবার ২ দিন হরতাল আহবান করেছে। আপাতত আর হরতাল না দেয়ার চিন্তা করছে। তবে এক্ষেত্রে সরকার ও সরকারি দলেরও করণীয় আছে।
সন্দেহ নেই হরতাল জনমানুষের জীবনযাত্রা ব্যাহত করে। দরিদ্র মানুষের ভোগান্তি বাড়ায়। দেশের ক্ষতি করে। দেশের অর্থনীতিকে আঘাত করে। বিশেষ করে দিনমজুর ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ক্ষতি সবচেয়ে বেশি। এমনকি তাদের উপোস পর্যন্ত থাকতে হয়। জান-মালের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এমন কোন দিন হরতাল যায় না যে কিছু মানুষের প্রাণ না যায়। কিছু যানবাহন ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
তাই প্রশ্ন উঠেছে হরতালের বিকল্প কিছু কর্মসূচি দেয়ার। সরকারপন্থী কিছু বুদ্ধিজীবী ও ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ হরতাল না দিয়ে অন্য কর্মসূচি দেয়ার আহবান জানাচ্ছেন। কিন্তু কথা হলো অতীতে তারা কোথায় ছিলেন? বিগত বি.এন.পি সরকারের সময় আওয়ামী লীগ কতদিন হরতাল করেছে তা-কি তাদের জানা আছে? সে সময় তারা কেন এরকম বুদ্ধিজীবী-সুলভ কথা বলেন নাই? তখন তাদের দেশপ্রেম কোথায় ছিল?
শুধু হরতাল নয়, এখন বিরোধীদল লাগাতার হরতাল অবরোধ দিয়ে সরকারকে নাজেহাল করেছে। দেশকে করেছে বিধ্বস্ত। তখন তাদের একটাই কথা ছিল বি.এন.পি'কে হঠাও। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিকে যে কোন ভাবেই ক্ষমতায় যেতে হবে। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিকে দেশের মানুষ পছন্দ করে কি করে না তার প্রমাণ হবে ভোটে। তাই বলে তারা যা খুশী ইচ্ছা করতে পারে না। কিন্তু আমাদের দেশের স্বাধীনতার পক্ষের দাবিদার শক্তি যা খুশী তাই করতে চায়। করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে খাম-খেয়ালী। তাই বর্তমানে মানুষ এদের নিয়ে হতাশ ও আতংকগ্রস্থ।
দেশের বর্তমান অবস্থায় মানুষ কঠিন কর্মসূচি চায়। শুধু হরতাল নয়, আরও কঠিন কিছু থাকলে তা দিলে দেশ ও জাতির স্বার্থে জনগণ তা মেনে নিতে প্রস্তুত। বি.এন.পিসহ বিরোধী পার্টিকে জনগণের মনের ভাষা বুঝতে হবে। সঠিক ও সাহসী নেতৃত্ব নিয়ে সামনে অগ্রসর হতে হবে। জনগণ কখনো নিজেরা সামনে অগ্রসর হয় না তাদেরকে অগ্রসর করতে হয়। পৃথিবীর ইতিহাস তাই বলে। হরতাল ডেকে ঘরে বসে থাকলে চলবে না। মাঠে-ময়দানে নামতে হবে - থাকতে হবে। নির্যাতন করে আন্দোলন বেশিদিন দাবিয়ে রাখা যায় না। শুধু মুখের কথা আর হাতের জোরে রাজনীতিতে সফল হওয়া যায় না। জনগণের মন জয় করতে হলে দেশপ্রেম থাকতে হয়। মানুষের পাশে দাঁড়াতে হয়। তা করতে আওয়ামী লীগ ব্যর্থ হচ্ছে।
সুধীসমাজ অবশ্য উভয় জোটকে আলোচনার টেবিলে বসাতে পারলে লাভ হতে পারে। এক্ষেত্রে সরকার ও সরকারপন্থীদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। কিন্তু তাতে প্রয়োজন নিরপেক্ষ দেশপ্রেমিক একটা সুশীল সমাজ। সে রকম সমাজ আমাদের দেশে আছে কি? যদি না থাকে তাহলে আন্দোলনের বিকল্প নাই। সেক্ষেত্রে হরতাল চলবেই। দেশবাসী সে জন্য প্রস্তুত।
ডা: সুলতান আহমদ
ধানমন্ডি, ঢাকা
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন