আশীষ-উর-রহমান | তারিখ: ২৬-১০-২০১০

মাঝরাত পেরিয়ে গেছে। এদিকটায় বেশ শিশির পড়ছে। গান শোনা ক্ষান্ত দিয়ে আমরা ফিরছি রিকশাভ্যানে করে কুষ্টিয়া শহরের দিকে। পথ নির্জন। কালীগঙ্গা নদীর সেতু পার হয়ে মিলপাড়া। অদূরেই শতাব্দীপ্রাচীন মোহিনী মোহন চক্রবর্তী প্রতিষ্ঠিত বিখ্যাত মোহিনী মিল। কাপড়কলের চারপাশ দিয়ে শ্রমিক-কর্মচারী-কর্মকর্তাদের আবাসন, মোহিনী মোহনের নিজের ও পরিবারের অন্যদের বাসভবন, হাসপাতাল—এসব নিয়ে এই এলাকায় বিশাল আবাসিক স্থাপনা গড়ে তুলেছিলেন তিনি। প্রভাব বিস্তার করে রেলস্টেশনটিও নিয়ে এসেছিলেন কাপড়কলের কাছে। পুরোনো সেই লাল রঙের দোতলা-একতলা ঘরবাড়িগুলো এখনো টিকে আছে। সামনে একটুকরো বাগান। ফুল-ফলের গাছপালার ঘন সন্নিবেশ। কুষ্টিয়া শহরের এ প্রান্তটির পরিবেশই অন্য রকম। স্মৃতিজড়ানো এক মায়াময় দৃশ্যপট। জ্যোৎস্নায় গাছের শিশিরভেজা পাতাগুলো চকচক করছে। মাঝে মাঝে রাতজাগা পাখির ডাক আর দূর থেকে ভেসে আসা মরমি গানের সুর। মনে হচ্ছিল যেন স্বপ্নের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি কোথাও।
রিকশাভ্যান এগোচ্ছে, হঠাৎ নাকে এসে ঝাপটা দিয়ে গেল মধুগন্ধমাখা হেমন্তের হাওয়া। কেমন করে এ সৌরভ উপেক্ষা করি, থামতে বললাম চালককে। বেশি বেগ পেতে হলো না খুঁজে পেতে। ডানে-বাঁয়ে তাকাতেই চোখে পড়ল, নিকটেই এক বাড়ির উঠোনে সে দাঁড়িয়ে আছে তার ঝাঁকড়া পত্রপল্লব নিয়ে। ছাতিম। বেশ লম্বা গাছ। অনেক দিনের পুরোনো। গুঁড়িতে বাকলগুলো কুন্দের মতো ফুলে ফুলে আছে। তাতে বৃদ্ধের মুখের বলিরেখার মতো অজস্র সরু, স্ফীত রেখায় ভর্তি। ওপরে গুচ্ছ গুচ্ছ পাতা আর অগুনতি ফুলের থোকায় কী মায়াময় রূপ। নিভৃতে দাঁড়িয়ে থেকে সৌরভের মিতালি করছে রাতের হাওয়ার সঙ্গে। ঝিরিঝিরি বাতাস যেন স্নেহস্পর্শ বুলিয়ে দিচ্ছে তার পাতায়, ফুলে। আর সে হাওয়ায় মাখিয়ে দিচ্ছে মধুর সৌরভ। ম-ম করছে চারপাশটা। আমার সঙ্গী আলোকচিত্রী জাহিদুল করিম তার সর্বক্ষণের সঙ্গী ক্যামেরার ব্যাগ খুলে প্রস্তুত হয়ে গেল ছবি তুলতে।
ছাতিমতরুর সঙ্গে দৃশ্যত ছাতার মিল আছে অনেকটা। গাছের কাণ্ড খানিকটা লম্বা হয়ে শাখাগুলোতে মেলে ধরা ছাতার মতো সঘন পাতার বিস্তার। তারপর আবার কিছু কিছু কাণ্ড আরও একধাপ উঠে গিয়ে মেলে ধরে সবুজ ছাতা। এভাবে কয়েক ধাপে পুরো গাছটিকেই গাঢ়-সবুজ পাতার ঘন সন্নিবেশ মনে হয়, স্তরে স্তরে সবুজ ছাতায় সাজানো। পাতা থাকে সারা বছর। তাই বছরভর ছায়াময় থাকে ছাতিমতলা। পাতার আকার বর্ষাফলকের মতো। বোঁটা ছোট। কাণ্ডের গ্রন্থিতে সাধারণত সাতটি (ক্ষেত্রবিশেষে পাঁচটি) পাতার বৃত্তাকার সন্নিবেশ থাকে। সে কারণে সংস্কৃতে এর নাম ‘সপ্তপর্ণী’। এ ছাড়া আরও কিছু নাম উল্লেখ করেছেন উদ্ভিদবিজ্ঞানী ড. নওয়াজেশ আহমদ তাঁর বাংলার বনফুল বইতে। নামগুলো হলো: পত্রবর্ণ, সুপর্ণক, গুচ্ছপুষ্প, শুক্তিপর্ণ, বৃহত্ত্বগ, শাল্মলিপত্রক, মদগন্ধ, গন্ধিপর্ণ, শারদী, বিনদ, বিন্যক ইত্যাদি। তবে তিনি আরও একটি বিশেষ তথ্য দিয়েছেন, তা হলো—কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের সমাবর্তনের সময় প্রথম উপহার দিতেন ছাতিম পাতা। তবে এই ঘন পাতার সন্নিবেশের কারণে গাছটির মধ্যে একটু গা-ছমছম করা ভাবও আছে। লোকে বলে, ছাতিমগাছে ভূতের বাসা। এ সম্পর্কে একটি লোকছড়াও উদ্ধৃত করেছেন তিনি, ‘শ্যাওড়া গাছে পেতনী ঠাসা/ ছাতিম গাছে ভূতের বাসা’। সম্ভবত এ কারণেই ইংরেজিতে গাছটির নাম Devil tree।
ছাতিমতরু এককালে সারা দেশেই ছিল প্রচুর। আমাদের দেশসহ চীন, ভারত, মিয়ানমার, সিংহলে ছাতিমের আদি বাস। ছাতিমের কাঠ তেমন শক্তপোক্ত নয় বলে দারুমূল্য কম। সে কারণে এই বাণিজ্যিক যুগে কেউ আর ছাতিম রোপণে তেমন উৎসাহী নন। প্রায় দুর্লভ-দর্শনই হয়ে পড়েছে অসাধারণ সুন্দর গাছটি। নেই নেই করেও ঢাকায় কয়েকটি ছাতিমতরু এখনো টিকে আছে নিমতলীতে আনোয়ার পাশা ভবনের সামনে, নিউ ইস্কাটন রোডের পুরোনো পাসপোর্ট অফিসের প্রাঙ্গণে, বিএসএমএমইউতে আছে একটি গাছ। আরও হয়তো আছে কোথাও বিক্ষিপ্তভাবে।
ছাতিমগাছের সঙ্গে সরাসরি পরিচয় না থাকলেও একটা সময়ে, ধরা যাক এখন যাঁদের বয়স চল্লিশোর্ধ্ব, তাঁরা কিন্তু ছাতিমের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এসেছেন অন্যভাবে। সে সময় স্কুল-কলেজগুলোর শ্রেণীকক্ষে কাঠের তৈরি যে ‘ব্ল্যাকবোর্ড’টি টাঙানো থাকত এবং সাদা চক-পেনসিল দিয়ে লেখা হতো, তার ওপরে, সেই বোর্ডটি তৈরি হতো প্রধানত ছাতিমকাঠ দিয়ে। কাঠ হালকা ও মসৃণ, সে কারণে ব্ল্যাকবোর্ডের জন্য ছাতিমতরু ছিল আদর্শ। এ ছাড়া কাঠ-পেনসিল তৈরিতেও এটি প্রচুর ব্যবহূত হয়। এ কারণেই ছাতিমের বৈজ্ঞানিক নাম হয়েছে Alstonia scholaris। বহু ‘স্কলার’ এই ছাতিমের ব্ল্যাকবোর্ডে লিখেই খ্যাতিমান-জ্ঞানবান হয়েছেন।
ছাতিমফুল ফোটা শুরু হয় শরতের শেষ ভাগ থেকে। তবে হেমন্তের শেষার্ধ প্রস্ফুটনের প্রধান মৌসুম। শীতের মাঝামাঝি অবধি ফুটতে থাকে অজস্র থোকায়। একটা সময় গাছের আর পাতাই দেখা যায় না ফুলের গুচ্ছে। ফুলও সবুজাভ। তবে পাতার মতো গাঢ় নয়, কিছুটা নিষ্প্রভ। হেমন্তের শেষ ভাগে ফুলে-পাতায় একাকার হয়ে যায় ছাতিমতরু। ফুলের নিচের অংশ নলের মতো, ওপরের অংশে পাঁচটি পাপড়ি সামান্য বাঁকানো। পরাগকেশ থাকে নলের ভেতরে দিকে, গর্ভকোষ পরস্পর সংযুক্ত। ফুলে তীব্র মধুগন্ধ। রাতের হাওয়া বহুদূর পর্যন্ত সুরভিত হয়ে থাকে।
ছাতিমের ফলও চমৎকার। লম্বা, অনেকটা বরবটির মতো। শীতের শেষে লম্বা লম্বা অজস্র ফলে গাছগুলো যখন ভরে ওঠে, তখন ছাতিমগাছের অন্য এক শোভা। ফল পরিপক্ব হয় বসন্তে। বীজ রোমশ। সহজেই এর চারা গজায়। কিন্ত তা হলে কী হবে, ছাতিমের চেয়ে সেগুন, মেহগনি প্রভৃতির দাম বেশি। কে আর যাবে কেবল সৌন্দর্যে-রূপে-সৌরভে মুগ্ধ হতে ছাতিম লাগাতে!
ছাতিমের ভেষজগুণ অসাধারণ। এর ছাল ও আঠা জ্বর, হাঁপানি, ক্ষত, আমাশয় ও কুষ্ঠরোগের চিকিৎসায় বহুকাল থেকে ব্যবহূত। এ ছাড়া ঘন ছায়ার জন্য মুনিঋষিদের ধ্যানে বসতে ছাতিমতরুতল ছিল পছন্দের তালিকায় অন্যতম।
মুনিঋষিরা কি এখনো জপ-তপের জন্য আশ্রয় নেন ছাতিমতলায়? ছাতিমগাছই তো দুর্লভ! আচমকাই আমরা এখানে পেয়ে গেছি তার সুরভিত সাক্ষাৎ। জাহিদুলের ছবি তোলা শেষ হলো। বুকভরা সৌরভ নিতে নিতে আমরা আবার এগোতে থাকলাম কুষ্টিয়া শহরের দিকে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন