বুধবার, ৪ এপ্রিল, ২০১২

লিখে কিছুই হয় না, তা-ও লিখি



মুস্তাফা জামান আব্বাসী | তারিখ: ০৬-০৭-২০১১
চাপদাড়িতে মেহেদি। অপর বাড়ির পড়ন্ত বয়সী দারোয়ান কারণে-অকারণে সালাম দেন আমাকে। এক সকালে বেশ অবাক করে দিয়ে সমঝদারের মতো জানালেন, ‘অনেক দিন আপনার লেখা পাই না।’ জিজ্ঞেস করি, ‘কেমন লেখা চাই?’ বললেন, সাধারণদের কথা অন্তত কিছু লিখুন। রক্ষীর কথায় পরে আসছি।
মাসুক হেলাল ছবি আঁকেন, মাঝেমধ্যে পেনসিল স্কেচের নায়কদের নিয়ে প্রস্তুত করেন ছোট ছোট লেখা, ঘুঁটে-মুটে-রিকশা-ভ্যান-ঠেলা-নাইয়া, ‘কাগজ আছে কাগজ’-এর খেটে খাওয়া মানুষের দৈনন্দিন জীবনের খবর ভেসে ওঠে, হারিয়ে যেত যা হোয়াইট কালার লেখকের কাছে পৌঁছানোর আগেই। নাসির আলী মামুন লিখেছেন, সাধারণ মানুষের গল্প তাঁর তোলা ফটোগ্রাফগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে, যাদের দিকে চোখ মেলে তাকায় না কেউ। কাইয়ুম চৌধুরী যদি ঔপন্যাসিক হতেন, ডিটেইলড মুখচ্ছবি ক্যানভাসে ও লেখায়—দুই জায়গায়ই পেতাম।
বছর পঞ্চাশেক আগে মুস্তাফা মনোয়ারের বড় ভাই মুস্তাফা আজিজ পেনসিল স্কেচের বড় একটি খাতা নিয়ে বাংলা একাডেমীর জনারণ্যে বসে ছবি আঁকতেন কখনো লোলচর্ম বৃদ্ধের, কখনো শিল্পীর, কখনো কিশোরের, কখনো বাদামওয়ালার। খাতাটি ছিল আমার বিস্ময়; বিশেষ করে, যখন তিনি বলতেন কখন কীভাবে ছবি এঁকেছেন বড় বড় নেতার, সাহিত্যিকের, শিল্পীর ও সাধারণ মুখচ্ছবির। ছেলেবেলায় রোগা ছিলাম বিধায় আমার পেনসিল স্কেচটি যখন আঁকা হলো, দেখলাম, রোগা ছেলেটির মুখশ্রী আরও প্যাঁকাটি। মুস্তাফা আজিজ ভাই বললেন, ‘যেদিন সুন্দর হবে, সেদিন হয়তো আমি থাকব না। আজকের এই তরুণ তুমি আগামীর চেয়েও সুন্দর, কথাটি মনে রেখো।’ এখন বুঝি সৌন্দর্য সারল্যে, স্বাভাবিকতায়, নিরাভরণে।
জীবনের ছোট ছোট ছবি। একজনের কথা। ছেলেটি আমারই বয়সী। বয়স ১০। হিমালয়ের পথে কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি সরাসরি দুর্বার গতিতে চলত যে ব্রডগেজ দার্জিলিং মেইল, সেখানে বিক্রি করত তানসেন গুলি। দাম এক আনা। আব্বার কাছে অনেক বায়না দিয়ে চারটি পয়সা সংগ্রহ করতে হতো। কুড়িটির মতো ছোট দানার হজমি জিবে আনত রসানুভূতি। ছেলেটি সম্ভবত পার্বতীপুর থেকে শিলিগুড়ির ট্রেনে থার্ড ও ইন্টার ক্লাসে বিক্রি করত তানসেন। নিজেকে ওর জায়গায় বসিয়ে কল্পনার ফানুস ছুটিয়ে দিতাম। যদি ওর জায়গায় হতাম, কত মানুষের সঙ্গে দেখা হতো, কত কিছু শিখতাম। ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম সেদিন ওর জীবনের স্বপ্ন নিয়ে। বলেছিল, ‘বড় হলে রেলের গার্ড হব, পড়াশোনার সুযোগ পেলে রেলের অফিসার।’ দুবার ছেলেটির সঙ্গে দেখা হয়। ছেলেটি কি রেলের গার্ড বা অফিসার হতে পেরেছিল! কে জানে।
বড় কথা লিখে কী হবে? কেউ পড়বে না, পড়লেও গা করবে না। সমাজ বদলাবে না। গড্ডলিকা প্রবাহে বয়ে চলেছে যে জীবন, খেটে খাওয়া মানুষের, তাতে কী-ই বা যায়-আসে? জীবন এমনি এমনি বয়ে যাবে। সাহিত্য, সংগীত, বিনোদন নিয়ে মেতে থাকবে কিছু লোক, রাজনীতি চলবে নিজস্ব গতিতে। গতির নির্ধারণ বাতুলতা; কখন ঝড় আসবে, কেউ জানে না; যা হওয়ার তা-ই হবে। ইতিহাস তা-ই বলে। একাত্তরে তা-ই দেখেছি। নেতারা নিরুদ্দেশ। খেটে খাওয়া মানুষ ও তাদের সাথিরা অস্ত্র তুলে নিয়েছিল।
যে রিকশা থেকে নামলাম, চালকের বাড়ি বগুড়া। বলল, ‘১০০ জন চালক থাকি উত্তর বাড্ডার একটি চালাঘরে।’ ১০০ জনের বিছানা লাগালাগি। তেলচিটচিটে বালিশ ও শতরঞ্জি। ৮০ জন গাইবান্ধার। কয়েকজন শেরপুর ও বগুড়ার। অর্থাৎ বেশির ভাগ উত্তরবঙ্গের। ‘১০টায় ভাত, দুপুর দুইটায় ও রাতে বাড়ি ফিরে একবার করে। তিনবার ভাত খাই। ভাতই আমার স্বপ্ন, ভাতই আমার জীবন। আমরা এতগুলো লোক কেমনভাবে ঘুমাই, কী খাই, আপনাদের জানতে ইচ্ছে করে না?’ বললাম, একদিন নিজেই যাব অথবা পাঠাব মাসুক হেলালকে।
ঠেলাওয়ালার কথা মাঝেমধ্যে বলি। কারণ, ওদের জীবন অনেক সহজ ও সরল। শরীরও ভালো থাকে। পেশিগুলো কত শক্ত। ওরা যা খায়, তৃপ্তির সঙ্গে খায়। দেশ নিয়ে মাথা ঘামায় না। কে মন্ত্রী হলো, আর কে হলো না, তাতে কিছু আসে-যায় না। শুধু যায়-আসে, যখন কাজ বন্ধ হয়ে যায়, রুজি বন্ধ হয়ে যায় বৃষ্টিতে, কর্মবিরতিতে। ন্যায়ের হরতাল হলে না খেয়েও ঠেলাওয়ালারা সমর্থন দেয়। বরাবর দেখে এসেছি। বিজলি না হলে কষ্ট হয় না। কারণ, ঘরে ফ্যান নেই, বিজলি নেই, পানি নেই, গ্যাসও নেই। এগুলো না হলেও জীবন বয়ে যায়। যার নেই, সে-ই সুখী। যে সব পেল, সব সময় না পাওয়ার অসুখে ভুগছে।
যিনি গৃহরক্ষী, দেখলেই সালাম দেন, বললেন, ‘দেশটিকে স্বাধীন করেছি আমরাই। স্বাধীন রাখার জন্য আমরাই রয়েছি। আর কারও প্রয়োজন নেই। যে বাড়িটি পাহারা দিই, তার জন্য পাই চার হাজার টাকা। কোম্পানি পায় ছয়। দুই হাজার মধ্যস্বত্বভোগীর। এমনি জীবনের প্রতি স্তরে মধ্যের লোকেরা আমাদের ন্যায্য পাওনা লুটে নিচ্ছে। আমি আজ বাড়ি পাহারা দিই। প্রয়োজন হলে আমি সেই শক্তি দিয়েই দেশকে স্বাধীন রাখব।’
জানি, লিখে কিছুই হয় না, তা-ও লিখি।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্য-সংগীতব্যক্তিত্ব।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন