শুক্রবার, ৬ এপ্রিল, ২০১২

জাতীয় কবি নজরুলকে নিয়ে


যে যেভাবে দেখি


॥ মুস-াফা জামান আব্বাসী ॥

আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম। তাকে নিয়ে বিগত সত্তর বছরে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে চলেছে নানা কর্মযজ্ঞ। বেশির ভাগ ভালো, কিছু খারাপও রয়েছে। ভারত সরকারের বিদেশ মন্ত্রণালয়ের পাবলিক ডিপ্লোম্যাসি বিভাগ প্রকাশিত ও পরিবেশিত ‘নজরুল দি পোয়েট রিমেম্বার্ড’ অ্যালবামটি হাতে নিয়ে যেমন খুশিতে আত্মহারা হয়েছিলাম, তেমনি এর কয়েকটি ছবি দেখে হতাশায় মন ভরে গেল। নজরুলের পুত্রবধূ কল্যাণী কাজী একজন সম্মানিত মহিলা। তিনি এই অ্যালবামটি সম্পাদনা করেছেন। এতে রয়েছে চুরুলিয়া থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদ পর্যন্ত কবির জীবনের স্মৃতিবাহী অনেক সংগ্রহযোগ্য ছবি, যা ভারত সরকার প্রচুর অর্থ ব্যয় করে প্রথমবারের মতো ছাপিয়েছে। ভালো লেগেছে কবির সান্নিধ্যে আসা অনেকের ছবি, বিশেষ করে তার পুত্র সব্যসাচী, অনিরুদ্ধ, পুত্রবধূ উমা কাজী, কল্যাণী কাজী, নজরুলের সাথে গ্রামোফোন কোম্পানির চুক্তিপত্র, নানাজনের চিঠি, বিশেষ করে বিরজাসুন্দরীকে লেখা নজরুলের চিঠি, প্রমিলা নজরুলকে লেখা আমার পিতা আব্বাসউদ্দিনের চিঠি, নজরুল যে বাসায় ছিলেন সেই বাসাগুলোর ছবি, লেখার পাণ্ডুলিপিগুলো, পারিবারিক কুষ্ঠি, নজরুল ব্যবহৃত আয়না, হাতঘড়ি, ফ্যান, ক্যামেরা, রুমালের বাক্স, চশমা, কলম, প্লেট, রেকর্ড, জামা, গ্রামোফোন রেকর্ড, হারমোনিয়াম, পিয়ানো, পুতুল, প্রথম সংস্করণের মলাট, প্রায় কিছুই বাদ যায়নি।
যা বাদ গেলে খুশি হতাম, তা হলো নজরুল নাকি কতগুলো পুতুলকে সামনে রেখে পূজা করতেন। এই পুতুলগুলোকে বলা হয়েছে নজরুলের ঠাকুরঘরের কালীমূর্তি। খোঁজ নিয়ে জানা গেল এটি একটি বানোয়াট ছবি। বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, ছত্রিশ বছর ছিলেন নির্বাক, নানা ষড়যন্ত্রের নিশ্চিত ফলাফল। কে না জানে, তার হিন্দু বিবাহ মুসলমানেরা মেনে নেয়নি। তাকে দিয়েছিল কাফের ফতোয়া। হিন্দুরা তার মুসলমানি রচনা, উদ্দীপনামূলক জাগরণী গানকে গ্রহণ করেনি। এটি এখন ইতিহাসের অন্তর্গত। নজরুলের দু’ছেলেই অত্যন্ত গুণবান। কোনো ধর্মের প্রতি পরিপূর্ণ উৎসাহ দানা বাঁধার আগেই তারা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। তাদের ছেলেমেয়েরা যেকোনো ধর্মে স'ান পেলে কারো কোনো আপত্তির প্রশ্ন ওঠে না। যার যার ধর্ম তার তার কাছে। এ নিয়ে কারো নেই কোনো মাথাব্যথা, কিন' জাতীয় কবি নজরুলের আরাধ্য কালীমূর্তি ও তৎসঙ্গে চারজন দেবদেবীর সচিত্র উপসি'তি এই অ্যালবামটিকে করেছে প্রশ্নবিদ্ধ। তার চলে যাওয়ার এত দিন পর তার ধর্মবিশ্বাস নিয়ে সচিত্র প্রতিবেদন পরিহার করাই ছিল যুক্তিযুক্ত। শ্যামবাজার স্ট্রিটে যে কালীমন্দিরে নজরুল নিয়মিত যেতেন বলে এই অ্যালবামে ছবি ছাপা হয়েছে তার ভিত্তি নড়বড়ে। নজরুল একজন যোগীর কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন। যোগীবর তার সামনে তার মৃত পুত্র বুলবুলকে উপসি'ত করেছিলেন বলে শোনা যায়। নজরুল সবার কাছে গিয়েছিলেন বুলবুলের খোঁজে, এমনকি যোগীবরের কাছে। আমার লেখা উপন্যাস পুড়িব একাকী গ্রনে' চেষ্টা করেছি ব্যাপারটিকে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে। ধর্মের কোলাহল থেকে বের করে একজন মানবিক কবিকে উপসি'ত করতে চেষ্টা করেছি এই উপন্যাসে। মনে রাখতে হবে সময়টা মহাযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বিপর্যস্ত। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ সেই পরিসি'তি থেকে অনেক দূর এগিয়ে এসেছে বলে আমাদের দাবি। তা না হলে কলকাতায় হতো না নজরুল মঞ্চ, হতো না কাজী নজরুল ইসলাম সরণি, ঢাকায় হতো না কাজী নজরুল ইসলাম মহাসড়ক। ওই মূর্তিগুলোর ছবি মুসলমানদের বোধে আবার নতুন করে দেবে আঘাত, এর কোনো প্রয়োজন ছিল না। আমার অত্যন্ত সম্মানীয় কল্যাণী কাজী এই কাজ থেকে নিবৃত্ত হলে ভালো হতো। আশা করা যায়, ভারত সরকারের বিদেশ মন্ত্রণালয়ের পাবলিক ডিপ্লোম্যাসি বিভাগ, ব্যাপারটি উপলব্ধি করবেন এবং নতুন করে ছাপলে এ ব্যাপারে যথাযথ কাজটি করবেন। ‘কে আর হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে’ অ্যালবামটি দামি, যে কারণে সবার কাছে এটি পৌঁছবে না; এটাই বাঁচোয়া। 
৪ এপ্রিল ২০১২
লেখক : সাহিত্য-সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব
mabbasi@dhaka.net

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন