ফারুক ওয়াসিফ | তারিখ: ২৭-০৪-২০১২
লিমনের কাটা পা মানবাধিকারের পঙ্গুত্বের প্রতীক হয়ে উঠেছিল। এখন নিখোঁজ ইলিয়াস আলী হয়ে উঠছেন সত্য ও ভরসার গুম হওয়ার প্রতীক। দেশটা হয়ে পড়ছে প্রবাদকথিত সেই অন্ধকার ঘর, যেখানে লুকিয়ে আছে হুলো বিড়ালেরা। তাদের আলোয় আনা যাচ্ছে না। কিন্তু তাদের কাজের কুফল দেশসুদ্ধ সবাই ভোগ করছে। কিংবা তারা বাইরেই বেরিয়ে পড়েছে, দিনদুপুরে নামাচ্ছে অন্ধকার। আমাদের সবাইকে ঢোকাচ্ছে সেই ঘরে, যেখানে মানুষ মরে যাচ্ছে, পুড়ে যাচ্ছে, গুম হয়ে যাচ্ছে। জানা যাচ্ছে না কিছুই।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র হিসাব দিয়েছে, গত ২৭ মাসে ১০০ ব্যক্তি ‘নিখোঁজ’ হয়েছেন। এঁদের জীবন সম্ভবত ইলিয়াস আলীর মতো দামি ছিল না, তাই তাঁদের জন্যকেউ দেশ উথাল-পাতাল করেনি। এঁদের অনেকের লাশ মিলেছে, অনেকের মেলেনি— বেওয়ারিশ হিসেবে কেউ সমাধিস্থ হয়েছেন, কেউ বা তাও হননি। এঁদের খুনিদের পরিচয় ‘অজ্ঞাত’ রেখে সরকারও এদের বেওয়ারিশনাগরিক করে দিয়েছে। ৫ এপ্রিল সাভারে আমিনুল ইসলাম নামের এক শ্রমিকনেতার ক্ষতবিক্ষত লাশ পাওয়া যায়। এখন পর্যন্ত তাঁর হত্যাকারী চিহ্নিত করা যায়নি বা করা হয়নি। সাগর-রুনি যুগলের ঘাতকেরাও আমাদের মধ্যে ঘুরে বেড়ালেও রেলের কালো বিড়ালের মতো অধরাই থেকে যাচ্ছে। এত এত মানুষের ‘ব্যাখ্যাতীত’ গায়েব হওয়ায় যে সরকার বিচলিত না, সেই সরকার নিজেই দায়িত্বহীনতার ‘অন্ধকারে’ নিমজ্জিত।
এই অবস্থায় সরকারকে হয় সত্য জানাতে হবে, নতুবা ব্যর্থতা স্বীকার করতে হবে। তৃতীয় পথটা হলো, ঘোলা জলকে আরও ঘোলা করা। ঘটনার পরপরই স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলকেই তাদের নেতা নিখোঁজ হওয়ার জন্য দায়ী করে সেটাই করেছেন। তাঁর কথার কোনো বাস্তব ভিত্তি তিনি বা তাঁর সরকারের কেউ জানাতে পারেননি। বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া এবং ইলিয়াস আলীর স্ত্রীর অভিযোগ, সরকারি সংস্থার লোকেরাই ইলিয়াস আলীকে গুম করেছে। জাতীয় দুই নেত্রী তাই পরস্পরের দ্বারা অভিযুক্তই থাকছেন। এই দায় সাফ করার দায়িত্ব তাঁদেরই।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গণহত্যার পর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বৃত্তে একটা ধারণা শক্তিশালী হয় যে, বড় অপরাধের প্রতিকারের দায় প্রথমত রাষ্ট্রের, রাষ্ট্র ব্যর্থ হলে সেই দায় সবার। স্বাধীনতার ৪০ বছর ধরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দায় আমাদের সবার ঘাড়েই ছিল। সম্প্রতি রাষ্ট্র সেই দায় লাঘব করেছে। তেমনি শত শত মানুষের ক্রসফায়ার আর শত মানুষের ‘নিখোঁজ’ হওয়ার প্রতিকারের দায়ও এই রাষ্ট্রের সব নাগরিকের।
সত্যহীনতায় মানুষ চলতে পারে না। সরকার সত্য জানাবে, এমন ভরসা লোপ পাওয়ায় সত্যের সম্পূর্ণ বেসরকারীকরণ ঘটে গেছে। ইলিয়াস আলীকে নিয়ে প্রচারিত অজস্র গুজবের ভেতর থেকে তাই মনমতো ‘সত্য’ বেছে নিচ্ছে মানুষ। সত্য জানার ও প্রতিষ্ঠা করার সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর হলো রাষ্ট্র। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এই আমলে জাতীয় গুরুত্ববহ কোনো ঘটনা সম্পর্কেই সরকার আমাদের ‘সত্য’ জানাতে পারেনি। তাহলে কি সত্যের ক্ষমতায় তারা ভীত। যে সরকার সত্যকে ভয় পায় বা গুম করে, মানুষ তাদের ভয় পাওয়া শুরু করে। পাশাপাশি, এ রকম সরকারের পরিণতি নিয়েও আমাদের ভীত হওয়ার কারণ থেকে যায়।
এ রকম সরকারকেই ‘অকার্যকর’ বলা হয়। মানুষের অধিকার রক্ষা এবং রাষ্ট্রের সুব্যবস্থাপনার দিক থেকে তাঁরা যতই অকার্যকর হোন, সমস্যা সৃষ্টির ব্যাপারে এই সরকার কিন্তু অতিকার্যকর। সেই অতিকার্যকারিতার ফলই আমরা এখন হাতেনাতে পাচ্ছি। দেশটাকে যেন ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে এক বিরাট কালো ঘরে। তার ভেতর ভীত মানুষেরা অপেক্ষা করছে, কখন কী ঘটে, কার ওপর ঘটে, কী আছে দেশের ভাগ্যে, এর পরে কী? এমন বাস্তবতা ডাচ পদার্থবিদ এরভিন শ্রয়েডিংগারের বদ্ধ ঘরে বন্দী বিড়াল পরীক্ষার কথা মনে করায়। অন্ধকার ঘরে স্টিলের খাঁচায় একটি বিড়াল আর একটি ফাঁদ রাখা হয়। বিড়ালটির দুটি সম্ভাবনা, ফাঁদে পড়ে সে মারাও যেতে পারে, আবার ফাঁদ থেকে দূরে থেকে বেঁচেও যেতে পারে। অঙ্কের হিসাবে একেই বলে ফিফটি-ফিফটি সম্ভাবনা। অর্থাৎ বিড়ালটা অর্ধেক জীবিত, অর্ধেক মৃত। গুম, রহস্যজনক মৃত্যু আর বেওয়ারিশ লাশ হওয়ার এই বাস্তবতায় এভাবে আমরাও শ্রয়েডিংগারের বিড়ালের মতোই অর্ধেক জীবিত অর্ধেক মৃত।
২.
মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলা শুরু করেছে, ক্রসফায়ারের সঙ্গী হয়েছে গুম। বিশ্বের অভিজ্ঞতাও তা-ই বলে। মেক্সিকো, কলম্বিয়া, আর্জেন্টিনা, চিলি ও ফিলিপাইনে গুম-হত্যা ক্রসফায়ার পর্বের পর গুম-হত্যা পর্ব শুরু হতে দেখা গেছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এবং অধিকারকর্মীরাই এর শিকার। এসব ঘটনা তদন্তে জাতিসংঘ বিশেষ কর্মী দলও গঠন করে। সেখানে বাংলাদেশের বিষয়টাও আলোচিত হয়। বাংলাদেশ বাদে বাকি দেশগুলোয় গুম বা নিখোঁজ হওয়ার জন্য তারা ওই সব দেশের সরকারি নিরাপত্তা সংস্থাকেই দায়ী করে। বাংলাদেশে ১০০-র মতো মানুষ ২৭ মাসে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া, তাদের একটা বড় অংশের ক্ষতবিক্ষত লাশ পাওয়ার পর এই আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেওয়ার উপায় নেই। মানবাধিকারের দিক থেকে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার দিক থেকে এটা খুব বড় বিপদের লক্ষণ।
প্রখ্যাত সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজ কর্নেল তাহেরসহ বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে অনুসন্ধানে নিয়োজিত। ২০০৬ সালে তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘ভবিষ্যতে যদি এমন অবস্থা আসে, যেখানে হাজার হাজার লোক বিনা বিচারে আটক হচ্ছে, হাজার হাজার লোক কাস্টডিতে থাকা অবস্থায় মারা পড়ছে, সে অবস্থা ঠেকানোর কোনো প্রস্তুতি কি আপনাদের আছে? (২৪ জুলাই ২০০৬, সমকাল) তিনি কিসের ইঙ্গিত করেছিলেন, আমরা জানি না। কিন্তু এ রকম অবস্থার মুখে কোনো ধরনের কোনো প্রস্তুতি যে আমাদের নেই, তা গত কয়েক বছরের বিভিন্ন ঘটনায় প্রমাণিত। কোন লোকটা সরকারি সংস্থার হেফাজতে আটক আর কোন লোকটা সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের শিকার, তা বোঝার উপায় নেই। সরকারি সংস্থাগুলোর কাজের ধরন আর মাফিয়া গোষ্ঠীর কাজের ধরনও মোটামুটি একাকার। বিনা ওয়ারেন্টে, আইনি এখতিয়ারের বাইরে মানুষকে হয়রানি করা হচ্ছে।
অপরাধীর বিরুদ্ধে অপরাধমূলক কাজও অপরাধ। আটককৃত ব্যক্তিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতের সামনে হাজির করার বাধ্যবাধকতা অনেক ক্ষেত্রে মানা হচ্ছে না। নিতান্ত ফাঁস না হয়ে গেলে, অনেক ক্ষেত্রেই আটক করার খবর স্বীকার পর্যন্ত করা হয়নি। শত শত ক্রসফায়ারের একটিরও সুষ্ঠু তদন্ত হয়নি। আইন প্রয়োগকারী আর আইন লঙ্ঘনকারীর কাজের ধরন একই রকম হয়ে গেলে বিপর্যয়ের মুখে বাঁধ দেওয়া সম্ভব হয় না। লিফশুলজের আশঙ্কার এই ব্যাখ্যাই আমরা বুঝে নিচ্ছি।
বেআইনি হত্যাকাণ্ডে নিহতের সঙ্গে নিহত হচ্ছে সত্যটাও, দার্শনিকের সত্য না, কবির সত্য না, আদালতের সত্যটাই আমরা জানতে চাই। এই সত্য সরকারের জানা প্রয়োজন; কারণ, আইনের আওতায় জীবন রক্ষা ও জীবন নেওয়ার অধিকার রাষ্ট্রের তরফে একমাত্র তাদের। এই একচেটিয়া অধিকারে কারা ভাগ বসাল, সেটা জানা এবং তাদের দমন ছাড়া আইনের শাসন কায়েম হতে পারে না। সত্য জানা দরকার আদালতেরও। হত্যা চলবে কিন্তু খুনির শাস্তি হবে না; এমন অবস্থায় মানুষআদালতের বাইরে প্রতিকার আইন কার্যকারিতা হারায়। সত্য জানার প্রয়োজন জনগণের, দেশের হালহকিকতের সঙ্গে তাদের প্রতিদিনের রুটি-রুজির সংগ্রামই কেবল নয়, বাঁচা-মরাও অবিচ্ছেদ্য। সত্য দরকার গণতন্ত্রের স্বার্থেও, মিথ্যার মধ্যে জনগণ বা সরকার কেউ পথ খুঁজে পাবে না। তাই সত্যের সন্ধানই রাজনীতির কেন্দ্রীয় প্রশ্ন হয়ে উঠেছে। এই সত্যগুলো ছাড়া তাই জাতীয় অবস্থার পরিমাপ আর করা সম্ভব না। সম্ভব না কে শত্রু আর কে বন্ধু তা চেনা। সম্ভব না, হারানো ভরসা ফিরিয়েআনা। মিথ্যা আশার ছলনে আর ভোলানো যাবে না।
কেবলইলিয়াস আলীদের মতো মানুষের অধিকার নয়, সাধারণ মানুষকে বেআইনি হত্যা ও আটক থেকে সুরক্ষা দিতে হবে। এর জন্যই যাবতীয় রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, ক্রসফায়ার, গুম, নিখোঁজ হওয়া বিষয়ে জাতীয়ভাবে বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে সত্যানুসন্ধান কমিটি গঠন করতে হবে সরকারকে। সত্যের টিকি যত ওপরে বা যত গভীরেই থাক না কেন, কমিটিকে সেই পর্যন্ত যাওয়ার এখতিয়ার ও বাস্তব সহায়তা দিতে হবে। ব্যক্তি বা নাগরিকের জীবন এবং রাষ্ট্রীয় ভবিতব্য আজ একবিন্দুতে চলে এসেছে। এত মৃত্যু, এত অবিচার, এত মিথ্যা নিয়েবেশি দিন আমরা চলতে পারব না। এ রকম অবস্থায় সত্যই আমাদের সহায়। এই সহায় যদি আমরা না পাই তাহলে প্রখ্যাত সাংবাদিক ফয়েজ আহমদের মতো করেই বলতে হবে, ‘সত্যবাবু মারা গেছেন।’ তিনি অবশ্য একা যাননি, সহমরণের পথে রাজনীতি তাঁর অনুগামীহয়েছে।
এই বাস্তবতায় আমরা সবাই এখন গুম হওয়ার বা আগুনে পোড়ার আগে, বেওয়ারিশ লাশ হয়ে পড়ে থাকার আগে, হয়ে উঠি শ্রয়েডিংগারের বিড়ালের মতো: অর্ধমৃত বা অর্ধজীবিত।
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com
লিমনের কাটা পা মানবাধিকারের পঙ্গুত্বের প্রতীক হয়ে উঠেছিল। এখন নিখোঁজ ইলিয়াস আলী হয়ে উঠছেন সত্য ও ভরসার গুম হওয়ার প্রতীক। দেশটা হয়ে পড়ছে প্রবাদকথিত সেই অন্ধকার ঘর, যেখানে লুকিয়ে আছে হুলো বিড়ালেরা। তাদের আলোয় আনা যাচ্ছে না। কিন্তু তাদের কাজের কুফল দেশসুদ্ধ সবাই ভোগ করছে। কিংবা তারা বাইরেই বেরিয়ে পড়েছে, দিনদুপুরে নামাচ্ছে অন্ধকার। আমাদের সবাইকে ঢোকাচ্ছে সেই ঘরে, যেখানে মানুষ মরে যাচ্ছে, পুড়ে যাচ্ছে, গুম হয়ে যাচ্ছে। জানা যাচ্ছে না কিছুই।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র হিসাব দিয়েছে, গত ২৭ মাসে ১০০ ব্যক্তি ‘নিখোঁজ’ হয়েছেন। এঁদের জীবন সম্ভবত ইলিয়াস আলীর মতো দামি ছিল না, তাই তাঁদের জন্যকেউ দেশ উথাল-পাতাল করেনি। এঁদের অনেকের লাশ মিলেছে, অনেকের মেলেনি— বেওয়ারিশ হিসেবে কেউ সমাধিস্থ হয়েছেন, কেউ বা তাও হননি। এঁদের খুনিদের পরিচয় ‘অজ্ঞাত’ রেখে সরকারও এদের বেওয়ারিশনাগরিক করে দিয়েছে। ৫ এপ্রিল সাভারে আমিনুল ইসলাম নামের এক শ্রমিকনেতার ক্ষতবিক্ষত লাশ পাওয়া যায়। এখন পর্যন্ত তাঁর হত্যাকারী চিহ্নিত করা যায়নি বা করা হয়নি। সাগর-রুনি যুগলের ঘাতকেরাও আমাদের মধ্যে ঘুরে বেড়ালেও রেলের কালো বিড়ালের মতো অধরাই থেকে যাচ্ছে। এত এত মানুষের ‘ব্যাখ্যাতীত’ গায়েব হওয়ায় যে সরকার বিচলিত না, সেই সরকার নিজেই দায়িত্বহীনতার ‘অন্ধকারে’ নিমজ্জিত।
এই অবস্থায় সরকারকে হয় সত্য জানাতে হবে, নতুবা ব্যর্থতা স্বীকার করতে হবে। তৃতীয় পথটা হলো, ঘোলা জলকে আরও ঘোলা করা। ঘটনার পরপরই স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলকেই তাদের নেতা নিখোঁজ হওয়ার জন্য দায়ী করে সেটাই করেছেন। তাঁর কথার কোনো বাস্তব ভিত্তি তিনি বা তাঁর সরকারের কেউ জানাতে পারেননি। বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া এবং ইলিয়াস আলীর স্ত্রীর অভিযোগ, সরকারি সংস্থার লোকেরাই ইলিয়াস আলীকে গুম করেছে। জাতীয় দুই নেত্রী তাই পরস্পরের দ্বারা অভিযুক্তই থাকছেন। এই দায় সাফ করার দায়িত্ব তাঁদেরই।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গণহত্যার পর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বৃত্তে একটা ধারণা শক্তিশালী হয় যে, বড় অপরাধের প্রতিকারের দায় প্রথমত রাষ্ট্রের, রাষ্ট্র ব্যর্থ হলে সেই দায় সবার। স্বাধীনতার ৪০ বছর ধরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দায় আমাদের সবার ঘাড়েই ছিল। সম্প্রতি রাষ্ট্র সেই দায় লাঘব করেছে। তেমনি শত শত মানুষের ক্রসফায়ার আর শত মানুষের ‘নিখোঁজ’ হওয়ার প্রতিকারের দায়ও এই রাষ্ট্রের সব নাগরিকের।
সত্যহীনতায় মানুষ চলতে পারে না। সরকার সত্য জানাবে, এমন ভরসা লোপ পাওয়ায় সত্যের সম্পূর্ণ বেসরকারীকরণ ঘটে গেছে। ইলিয়াস আলীকে নিয়ে প্রচারিত অজস্র গুজবের ভেতর থেকে তাই মনমতো ‘সত্য’ বেছে নিচ্ছে মানুষ। সত্য জানার ও প্রতিষ্ঠা করার সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর হলো রাষ্ট্র। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এই আমলে জাতীয় গুরুত্ববহ কোনো ঘটনা সম্পর্কেই সরকার আমাদের ‘সত্য’ জানাতে পারেনি। তাহলে কি সত্যের ক্ষমতায় তারা ভীত। যে সরকার সত্যকে ভয় পায় বা গুম করে, মানুষ তাদের ভয় পাওয়া শুরু করে। পাশাপাশি, এ রকম সরকারের পরিণতি নিয়েও আমাদের ভীত হওয়ার কারণ থেকে যায়।
এ রকম সরকারকেই ‘অকার্যকর’ বলা হয়। মানুষের অধিকার রক্ষা এবং রাষ্ট্রের সুব্যবস্থাপনার দিক থেকে তাঁরা যতই অকার্যকর হোন, সমস্যা সৃষ্টির ব্যাপারে এই সরকার কিন্তু অতিকার্যকর। সেই অতিকার্যকারিতার ফলই আমরা এখন হাতেনাতে পাচ্ছি। দেশটাকে যেন ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে এক বিরাট কালো ঘরে। তার ভেতর ভীত মানুষেরা অপেক্ষা করছে, কখন কী ঘটে, কার ওপর ঘটে, কী আছে দেশের ভাগ্যে, এর পরে কী? এমন বাস্তবতা ডাচ পদার্থবিদ এরভিন শ্রয়েডিংগারের বদ্ধ ঘরে বন্দী বিড়াল পরীক্ষার কথা মনে করায়। অন্ধকার ঘরে স্টিলের খাঁচায় একটি বিড়াল আর একটি ফাঁদ রাখা হয়। বিড়ালটির দুটি সম্ভাবনা, ফাঁদে পড়ে সে মারাও যেতে পারে, আবার ফাঁদ থেকে দূরে থেকে বেঁচেও যেতে পারে। অঙ্কের হিসাবে একেই বলে ফিফটি-ফিফটি সম্ভাবনা। অর্থাৎ বিড়ালটা অর্ধেক জীবিত, অর্ধেক মৃত। গুম, রহস্যজনক মৃত্যু আর বেওয়ারিশ লাশ হওয়ার এই বাস্তবতায় এভাবে আমরাও শ্রয়েডিংগারের বিড়ালের মতোই অর্ধেক জীবিত অর্ধেক মৃত।
২.
মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলা শুরু করেছে, ক্রসফায়ারের সঙ্গী হয়েছে গুম। বিশ্বের অভিজ্ঞতাও তা-ই বলে। মেক্সিকো, কলম্বিয়া, আর্জেন্টিনা, চিলি ও ফিলিপাইনে গুম-হত্যা ক্রসফায়ার পর্বের পর গুম-হত্যা পর্ব শুরু হতে দেখা গেছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এবং অধিকারকর্মীরাই এর শিকার। এসব ঘটনা তদন্তে জাতিসংঘ বিশেষ কর্মী দলও গঠন করে। সেখানে বাংলাদেশের বিষয়টাও আলোচিত হয়। বাংলাদেশ বাদে বাকি দেশগুলোয় গুম বা নিখোঁজ হওয়ার জন্য তারা ওই সব দেশের সরকারি নিরাপত্তা সংস্থাকেই দায়ী করে। বাংলাদেশে ১০০-র মতো মানুষ ২৭ মাসে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া, তাদের একটা বড় অংশের ক্ষতবিক্ষত লাশ পাওয়ার পর এই আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেওয়ার উপায় নেই। মানবাধিকারের দিক থেকে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার দিক থেকে এটা খুব বড় বিপদের লক্ষণ।
প্রখ্যাত সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজ কর্নেল তাহেরসহ বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে অনুসন্ধানে নিয়োজিত। ২০০৬ সালে তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘ভবিষ্যতে যদি এমন অবস্থা আসে, যেখানে হাজার হাজার লোক বিনা বিচারে আটক হচ্ছে, হাজার হাজার লোক কাস্টডিতে থাকা অবস্থায় মারা পড়ছে, সে অবস্থা ঠেকানোর কোনো প্রস্তুতি কি আপনাদের আছে? (২৪ জুলাই ২০০৬, সমকাল) তিনি কিসের ইঙ্গিত করেছিলেন, আমরা জানি না। কিন্তু এ রকম অবস্থার মুখে কোনো ধরনের কোনো প্রস্তুতি যে আমাদের নেই, তা গত কয়েক বছরের বিভিন্ন ঘটনায় প্রমাণিত। কোন লোকটা সরকারি সংস্থার হেফাজতে আটক আর কোন লোকটা সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের শিকার, তা বোঝার উপায় নেই। সরকারি সংস্থাগুলোর কাজের ধরন আর মাফিয়া গোষ্ঠীর কাজের ধরনও মোটামুটি একাকার। বিনা ওয়ারেন্টে, আইনি এখতিয়ারের বাইরে মানুষকে হয়রানি করা হচ্ছে।
অপরাধীর বিরুদ্ধে অপরাধমূলক কাজও অপরাধ। আটককৃত ব্যক্তিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতের সামনে হাজির করার বাধ্যবাধকতা অনেক ক্ষেত্রে মানা হচ্ছে না। নিতান্ত ফাঁস না হয়ে গেলে, অনেক ক্ষেত্রেই আটক করার খবর স্বীকার পর্যন্ত করা হয়নি। শত শত ক্রসফায়ারের একটিরও সুষ্ঠু তদন্ত হয়নি। আইন প্রয়োগকারী আর আইন লঙ্ঘনকারীর কাজের ধরন একই রকম হয়ে গেলে বিপর্যয়ের মুখে বাঁধ দেওয়া সম্ভব হয় না। লিফশুলজের আশঙ্কার এই ব্যাখ্যাই আমরা বুঝে নিচ্ছি।
বেআইনি হত্যাকাণ্ডে নিহতের সঙ্গে নিহত হচ্ছে সত্যটাও, দার্শনিকের সত্য না, কবির সত্য না, আদালতের সত্যটাই আমরা জানতে চাই। এই সত্য সরকারের জানা প্রয়োজন; কারণ, আইনের আওতায় জীবন রক্ষা ও জীবন নেওয়ার অধিকার রাষ্ট্রের তরফে একমাত্র তাদের। এই একচেটিয়া অধিকারে কারা ভাগ বসাল, সেটা জানা এবং তাদের দমন ছাড়া আইনের শাসন কায়েম হতে পারে না। সত্য জানা দরকার আদালতেরও। হত্যা চলবে কিন্তু খুনির শাস্তি হবে না; এমন অবস্থায় মানুষআদালতের বাইরে প্রতিকার আইন কার্যকারিতা হারায়। সত্য জানার প্রয়োজন জনগণের, দেশের হালহকিকতের সঙ্গে তাদের প্রতিদিনের রুটি-রুজির সংগ্রামই কেবল নয়, বাঁচা-মরাও অবিচ্ছেদ্য। সত্য দরকার গণতন্ত্রের স্বার্থেও, মিথ্যার মধ্যে জনগণ বা সরকার কেউ পথ খুঁজে পাবে না। তাই সত্যের সন্ধানই রাজনীতির কেন্দ্রীয় প্রশ্ন হয়ে উঠেছে। এই সত্যগুলো ছাড়া তাই জাতীয় অবস্থার পরিমাপ আর করা সম্ভব না। সম্ভব না কে শত্রু আর কে বন্ধু তা চেনা। সম্ভব না, হারানো ভরসা ফিরিয়েআনা। মিথ্যা আশার ছলনে আর ভোলানো যাবে না।
কেবলইলিয়াস আলীদের মতো মানুষের অধিকার নয়, সাধারণ মানুষকে বেআইনি হত্যা ও আটক থেকে সুরক্ষা দিতে হবে। এর জন্যই যাবতীয় রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, ক্রসফায়ার, গুম, নিখোঁজ হওয়া বিষয়ে জাতীয়ভাবে বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে সত্যানুসন্ধান কমিটি গঠন করতে হবে সরকারকে। সত্যের টিকি যত ওপরে বা যত গভীরেই থাক না কেন, কমিটিকে সেই পর্যন্ত যাওয়ার এখতিয়ার ও বাস্তব সহায়তা দিতে হবে। ব্যক্তি বা নাগরিকের জীবন এবং রাষ্ট্রীয় ভবিতব্য আজ একবিন্দুতে চলে এসেছে। এত মৃত্যু, এত অবিচার, এত মিথ্যা নিয়েবেশি দিন আমরা চলতে পারব না। এ রকম অবস্থায় সত্যই আমাদের সহায়। এই সহায় যদি আমরা না পাই তাহলে প্রখ্যাত সাংবাদিক ফয়েজ আহমদের মতো করেই বলতে হবে, ‘সত্যবাবু মারা গেছেন।’ তিনি অবশ্য একা যাননি, সহমরণের পথে রাজনীতি তাঁর অনুগামীহয়েছে।
এই বাস্তবতায় আমরা সবাই এখন গুম হওয়ার বা আগুনে পোড়ার আগে, বেওয়ারিশ লাশ হয়ে পড়ে থাকার আগে, হয়ে উঠি শ্রয়েডিংগারের বিড়ালের মতো: অর্ধমৃত বা অর্ধজীবিত।
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন