আশীষ-উর-রহমান | তারিখ: ০৫-০৮-২০১০

সেই মেঘ চারদেয়ালের মধ্যে চতুষ্কোণ ফ্রেমে বন্দী সারে সারে। গ্যালারি চিত্রকে ঢুকতেই জীবনানন্দের মতোই মনে হলো, চোখ মেলে আমি যেন দুই স্তর মেঘের ভেতর প্রবেশ করলাম। যেদিকে তাকাই মেঘ, শুধু মেঘ। কেউ ধূমল, কেউ গৈরিক, কেউ ফুরফুরে পেঁজা পেঁজা, কেউ গলে পড়ছে, কেউ পড়ি পড়ি...প্রকৃতই ‘মেঘের পরে মেঘ জমেছে’ প্রবীণ শিল্পী আবদুল মান্নানের এই প্রদর্শনীতে (২৩ জুলাই—২ আগস্ট)।
মেঘের অনেক নাম: মেঘের নামের বাহারও কম নয়। কাদম্বিনী, জলদ, জলধর, সেক্তা, সেচক, ঘন, নিঃস্বনা, অম্বুবাহ, ধূমল, অভ্র, নীরদ, বারিদ, জীমূত, বলাহক, তোয়াদ, অম্বুদ প্রভৃতি। নামই যার এত এত, শব্দসম্ভারে তার প্রাচুর্য থাকাই স্বাভাবিক। আছেও। মেঘ নিয়ে দেখুন কত শব্দ জমেছে বঙ্গভান্ডারে, ‘মেঘলা’ দিয়েই শুরু করা যাক। ক্রমান্বয়ে পাওয়া যাবে, মেঘপুষ্প (বৃষ্টি), মেঘমেদুর, মেঘতিমির, মেঘভাঙা (রোদ), মেঘমন্দ্র, মেঘযামিনী, মেঘপল (শীলা), মেঘনাল (নীলবস্ত্র), মেঘনাদানুলাসী (ময়ূর), মেঘনির্ঘোষ, মেঘবহ্নি (বিজলী), মেঘাগম (বর্ষা), মেঘাত্যয় (শরৎ), মেঘডম্বর, মেঘসখা, (আরও আগ্রহীরা অভিধান দেখুন)।
মেঘ নিয়ে আছে বেশকিছু প্রবাদ-প্রচন। মনে করুন সেগুলো। ‘মেঘ না চাইতেই জল পেতে পারেন’। তবে মনে রাখা ভালো, ‘ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় পায়।’ ভাবতে ভাবতে কি এও ভাবছেন, মেঘে মেঘে বেলা তো কম গেল না! সময় তো যাবেই। মনটা খুব বেশি ভার হয়ে ওঠে, তবে না হয় কান পেতে দিন মেঘমল্লার রাগে।
মেঘলা দিনের গান: রাগসংগীতে মন না বসলে আছেন রবীন্দ্রনাথ। কত কবিতা, কত গান, ‘কালো মেঘে আঁধার হলো দেখে ডাকতে ছিল শ্যামল দুটি গাই’, ‘ঝুঁটিবাঁধা ডাকাত সেজে দলবেঁধে মেঘ চলেছে যে’, ‘মেঘ বলেছে যাব যাব’ থেকে ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা’, ‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে’—কতই-না বিপুল বৈচিত্র্য! আছে নজরুলের কাজরী ‘পরদেশী মেঘ যাও রে ফিরে’ অথবা ‘মেঘমেদুর বরষায় কোথা তুমি’।
অন্য ধরনের কিছুর তালাশ করলে সতীনাথের গলায় ‘আকাশ এত মেঘলা যেও নাকো একলা’, ভূপেনের ‘মেঘ থমথম করে কেউ নেই’, কিশোর কুমারের ‘হাওয়ায় মেঘ সরায়ে’, হেমন্তের ‘মেঘ কালো আঁধার কালো’ থেকে রুনা লায়লার গাওয়া ‘পরদেশী মেঘ রে আর কোথা যাসনে...’ শুনতে শুনতে পরান জুড়াতে পারেন। আসলে মেঘ নিয়ে গানের অন্ত নেই।
ওগো মেঘ তুমি: মেঘ কী? বিজ্ঞানের ন্যূনতম ধারণা আছে যাঁদের, তাঁরা তা জানেন। ‘মাঠ ঘাট সাগর নদীর পানি সূর্যতাপে বাষ্প হয়ে গেল বাতাসে। সেই উত্তপ্ত ও আর্দ্র বাতাস উঠে গেল ওপরে। ওখানে বতাসের ওপর চাপ কম, তাই তা প্রসারিত হয়ে শীতল হলো। যথেষ্ট শীতল হলে বাতাসের জলীয়বাষ্প ঘনীভূত হয়ে অতি ক্ষুদ্র জলবিন্দু কি বরফবিন্দুর আকারে ভাসতে লাগল আকাশে। সেটিই মেঘ।’ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইব্রাহীম তাঁর বৃষ্টি ও বজ্র বইতে মেঘের এই চমৎকার সংজ্ঞাটি দিয়েছেন, সঙ্গে আছে মজার মজার তথ্য। কখনো কখনো ওই বারিবিন্দু পরস্পরের সঙ্গে মিলেমিশে আকারে বড় আর ভারী হয়ে ওঠে। তখন তো ভেসে থাকা মুশকিল। বৃষ্টি হয়ে তারা নেমে পড়ে, ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঝরে পড়ে ধবল তুষার বা শিলাখণ্ডরূপে। বৈজ্ঞানিক সূত্রটি হলো, প্রথমে ভূপৃষ্ঠের পানির বাষ্পীভবন, তারপর ঊর্ধ্বলোকে তার ঘনীভবনে মেঘে রূপান্তর, অতঃপর অধঃক্ষেপণে ঝরো ঝরো মুখর বাদলধারা। এই হলো চিরাচরিত জলচক্র, যা সুজলা-সুফলা করে রেখেছে পৃথিবীকে আবহমানকাল থেকে।
সে না হয় হলো, কত পানি যায় আর কত আসে তার কি কোনো হিসাব আছে? অবশ্যই। সহজ হিসাবটি হলো, যত যায় তত আসে। ওই বইতে পাওয়া হিসাবে দেখা যাচ্ছে, প্রতিবছর পৃথিবী থেকে যত পানি সূর্যের তাপে বাষ্পীভবন হয়, এক জায়গায় রাখলে তার আয়তন হবে এক লাখ ২৪ হাজার ঘনমাইল। এর মধ্যে সমুদ্র থেকে যায় এক লাখ নয় হাজার ঘনমাইল এবং ভূপৃষ্ঠের নানা উৎস থেকে যায় বাদবাকি ১৫ হাজার ঘনমাইল। ফিরতি পালায় লাভটি হয় কিন্তু স্থলভাগেরই। স্থলের ওপরে পড়ে ২৬ হাজার ঘনমাইল পানি। সমুদ্রে পতন ৯৮ হাজার ঘনমাইল। এই পানি শুকানোর কাজে যে বিপুল উত্তাপের প্রয়োজন, তা তো জোগায় সূর্যই। কতখানি শক্তি যায় বাষ্পীভবনে? পৃথিবীতে পড়া সৌরশক্তির তিন ভাগের এক ভাগ চলে যায় ওই পানি শুকানোর কাজে। এই হলো মোটা দাগে মেঘের রসায়ন।
দেখাই যাচ্ছে, মেঘ নিয়ে কেবল কবির হূদয়ই আকুল-ব্যাকুল হয়েছে, তা নয়। ছায়াদানকারী মেঘ নিয়ে বিজ্ঞানীরাও কম মাথা ঘামাননি। ইদানীং বরং তাঁদের মাথাব্যথাটা একটু বেশিই। জলবায়ু, আবহাওয়ার হালচাল যেভাবে বদলাচ্ছে, তাতে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নিয়েই তাঁরা শঙ্কিত।
গগনে গরজে মেঘ: মেঘ ডাকে। গর্জনে কাঁপিয়ে তোলে চরাচর। তার কোলে কখনো রোদের হাসি, কখনো বুক চিরে বিজলির চমক। সূর্যকে আড়াল করে দেয় সুনিবিড় ছায়া। আবার রোদের রং গায়ে মেখে নিজেই রূপে অপ্সরা। আদিগন্ত তার অবাধ বিচরণ। চিরচলিষ্ণু। যেতে যেতে ছিঁড়েছিটে কুটি কুটি কাগজের মতো সারা আকাশে ছড়ানো। আবার খানিক পরই পরস্পর জুড়ে গিয়ে প্রাগৈতিহাসিক কালের বিকট জন্তুর আকার। পাহাড়-পর্বতের প্রতিকৃতি। মেঘেরা পারেও বটে!
এসব মেঘেরও আছে রকমফের। বিজ্ঞানীরা তিনটি প্রধান ভাগে ফেলেছেন মেঘমালাকে। সবচেয়ে উঁচুতে সরু ফিতার মতো যে মেঘগুলোকে দেখা যায়, তার নাম ‘অলক মেঘ’। অলক মেঘ সব সময়ই অমল ধবল। আকাশজুড়ে ধূসর রঙের মলিন আঁচল উড়িয়ে বেড়ায় ‘স্তর মেঘ’। স্তর মেঘ অলকের চেয়ে নিচে স্তরে স্তরে সাজানো থাকে। সাধারণত, ধূসর দেখায় তাদের রং। রূপের শোভায় অনন্য ‘স্তূপ মেঘ’। এই মেঘগুলো ফুলে-ফেঁপে নানা আকার নেয়। আর গায়ে রোদের কিরণ মেখে মনোহর হয়ে ওঠে তারা। তবে অনেক সময় স্তর ও অলক কিংবা স্তর ও স্তূপ মেঘ মিলেমিশে যেতে পারে। যায়ও।
মেঘ নিয়ে এত কথা বলার পর যদি মেঘদূতের কথাই না বলা হলো, তো সেটি হবে লবণবিহীন ব্যঞ্জনের মতো। অতএব মেঘ নিয়ে কিছু বলতে গেলে মেঘ আর মেঘদূতকে অভিন্ন করে রেখে যাওয়া মহাকবি কালিদাসের কথা বাদ দেয় সাধ্য কার! মেঘের কোনো দেশ নেই, ঠিকানা নেই। মেঘ সব দেশের, সব কালের মানুষের। সেই মেঘকে ভালো না বেসে পারবে কেন মানুষ। কালিদাস তাকে বিরহীর বার্তাবাহক করে পাঠিয়েছিলেন। অন্য দেশের একজন বলেছেন, শুধুই ভালোবাসার কথা। কোন কাজের ভার দেননি তাকে। বদলেয়ারের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে কি?
বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদে শার্লের ‘অচেনা মানুষ’ নামের সেই বিখ্যাত কবিতা দিয়েই তবে শেষ করি মেঘের এই যৎসামান্য প্রশস্তি, ‘বলো আমাকে, রহস্যময় মানুষ, কাকে তুমি সবচেয়ে ভালোবাসো:/ তোমার পিতা, মাতা, ভ্রাতা, অথবা ভগ্নি কে?/ পিতা, মাতা, ভ্রাতা, ভগ্নি—কিছুই নেই আমার।/ তোমার বন্ধুরা?/ ওই শব্দের অর্থ আমি কখনো জানিনি।/ তোমার দেশ?/ জানি না কোন দ্রাঘিমায় তার অবস্থান।/ সৌন্দর্য?/ পারতাম বটে তাকে ভালোবাসতে—দেবী তিনি, অমরা।/ কাঞ্চন?/ ঘৃণা করি কাঞ্চন, যেমন তোমরা ঘৃণা করো ভগবানকে।/ বলো তবে, অদ্ভুত অচেনা মানুষ, কী ভালোবাসো তুমি?/ আমি ভালোবাসি মেঘ...চলিষ্ণু মেঘ...ঐ উঁচুতে... ঐ উঁচুতে.../ আমি ভালোবাসি আশ্চর্য মেঘ দল!’
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন