বৃহস্পতিবার, ৫ এপ্রিল, ২০১২

শরতের রাতের শোভা



আশীষ-উর-রহমান | তারিখ: ০৬-১০-২০১০
একবার এক রাজকন্যা সূর্যের প্রভায় মুগ্ধ হয়ে প্রেমে পড়ল তার। কিন্তু সূর্য প্রত্যাখ্যান করল মর্তবাসিনীর হূদয়াবেগ। বঞ্চনায় আত্মহনন করল অভিমানিনী। তার চিতাভস্ম থেকে জন্ম নিল একটি গাছ। দিনে দিনে সেটি পরিণত হলো। শিশিরভেজা এক মৌসুমে তার শাখায় শাখায় ফুটল মিষ্টি সৌরভ ছড়ানো শুভ্র ফুলের রাশি। কিন্তু ফুলগুলো ফুটল রাতের নিভৃতে আর ঝরে পড়ল দিনের আলো ফোটার আগেই। যেন সূর্যের আলো তাকে স্পর্শ করতে না পারে। নিশুতির এই ফুলটিই হলো শিউলি বা শেফালি। পৌরাণিক কাহিনিতে শিউলির জন্মবৃত্তান্ত এ রকমই।
শিউলি না ফুটলে শরতের শুভ্রতা যেন অপূর্ণই থেকে যায়। তার সুবাসে সৌন্দর্যে মুগ্ধ রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘শরৎ প্রাতের প্রথম শিশির প্রথম শিউলি ফুলে।’ শুধু কি এই? ‘ওগো শেফালি বনের মনের কামনা’, ‘হূদয় কুঞ্জবনে মঞ্জুরিল মধুর শেফালিকা’, আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ/ আমরা গেঁথেছি শেফালি মালা’, ‘শিউলি-সুরভিত রাতে, বিকশিত জ্যোৎস্নাতে’, ‘সকল বন আকুল করে শুভ্র শেফালিকা’—কবিগুরুর এমন অজস্র পঙিক্ত বাংলা সাহিত্যকেও সুবাসিত করে রেখেছে।
আর বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যক’-এর পাঠকদের নিশ্চয়ই এ প্রসঙ্গে লবটুলিয়ার জঙ্গলের শিউলি বনের কথাটি মনে পড়বে। শিউলি নিয়ে বিস্তারিত তথ্য আছে উদ্ভিদবিদ দ্বিজেন শর্মার শ্যামলী নিসর্গ বইতে।
শিউলির তুষারধবল পাপড়িগুলো পরস্পরের সঙ্গে জোড়া লাগানো। তাতে শিশিরবিন্দু। নিচে উজ্জ্বল হলুদ বা প্রায় কমলা রঙের বৃন্ত। তাকালে চোখ জুড়িয়ে যায়। বেলা ডোবার পর থেকে ফুটতে থাকে। তখন তাকে দেখা যায় না বটে, কিন্তু বাতাসে ভেসে আসা মিষ্টি সুবাস জানিয়ে দেয় তার অস্তিত্ব। বড়ই স্বল্প আয়ু শিউলি ফুলের। নিশির শিশিরভেজা ফুলগুলো ঝরে পড়ে সূর্যোদয়ের আগেই। গাছতলা ভরে ওঠে তাদের স্নিগ্ধ সমারোহে। বাড়ির আশপাশে শিউলিগাছ থাকলে ভোরে ঘুম থেকে উঠে ছেলেপুলেদের তার তলায় ফুল কুড়াতে যাওয়ার উৎসাহ-আনন্দ চিরকালের। সেই স্মৃতি হয়তো অনেকেই ফিরিয়ে নিয়ে যায় শিউলি-সুরভিত শৈশবের দিনগুলোতে।
শিউলি এই উপমহাদেশেরই নিজস্ব উদ্ভিদ। আদি নিবাস মধ্য ও উত্তর ভারতে। বৈজ্ঞানিক নাম Nyctanthes arbortristis. আদরে-যত্নে বাড়ির আশপাশে, উঠানের কোণে বা বাগানে শিউলি বেড়ে ওঠে। গাছ তেমন বড় নয়। ডালপালা প্রচুর। বাকল পুরু, ফ্যাকাশে রঙের। সরু শাখার দুই পাশে বিপরীত দিকে ঘন পাতার বিন্যাস। পাতা একটু খসখসে। কিনার খাঁজকাটা ও ডগা সরু। শীতে ও বসন্তে পাতা ঝরে যায়। গ্রীষ্মে নতুন পাতায় শাখা ভরে ওঠে। ফুল ফোটা শুরু হয় শরতের প্রথম থেকে। শিউলি ফল চ্যাপটা, অনেকটা বোতামের মতো। শুকনো ফল গাছতলায় ঝরে পড়ে। সহজেই নতুন চারা গজায়।
শিউলি ফুলের মালা গাঁথা যায়, অবশ্য এই মালা বকুল, গাঁদা, গোলাপ, বেলির মতো তেমন দীর্ঘস্থায়ী হয় না। শারদীয় দুর্গাপূজার অঞ্জলিতে শরতের শিউলি যে থাকবেই, সে তো জানা কথা। এর বোঁটার রং দিয়ে কাপড় রাঙানো যায়। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা তাঁদের বস্ত্ররঞ্জিত করেন শিউলি বোঁটার রঙেই। হিন্দু-বৌদ্ধ উভয় সম্প্রদায়ের কাছেই পবিত্রপুষ্প হিসেবে শিউলির আলাদা মর্যাদা আছে।
শিউলির কদর ভেষজবিদদের কাছেও। পাতার রস তিক্ত। তিব্বিয়া হাবিবিয়া কলেজের সহকারী অধ্যাপক হাকিম ফেরদৌস ওয়াহিদ জানালেন, তিক্ত হলেও পাতার রস অনেক উপকারী। মৌসুমি জ্বর, গলা বসা, ক্রিমি, জন্ডিস ও খাদ্যে বিষক্রিয়াজনিত সমস্যায় দু-তিন চামচ পাতার সর সেবন উপকারী। বীজ বেটে মাথায় লাগালে খুশকি ও উকুনের সমস্যা কমে। বীজের তেল ভিমরুল, মৌমাছি বা বোলতা দংশিত স্থানে প্রলেপ দিলে দ্রুত যন্ত্রণার উপশম। এ সময় অনেকেরই চোখ ওঠে। শিউলি ফুল বোঁটাসমেত বেটে পাতলা কাপড়ে পুঁটলি করে তা দিয়ে চোখ মুছলে যন্ত্রণার উপশম ও রোগ নিরাময় হয়।
শিউলির কাঠ তেমন মূল্যবান নয়, তার দরকারও নেই। শিউলি মূল্যবান থাকুক সৌন্দর্যে-সৌরভে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন